খেত আর আবাদ যেখানে শেষ হয়েছে, সেইখানে পাহাড়ের একটা ঢল, সেইখানে পেচাদের ঘোটের মজলিস বসবে। অতি নোংরা ঢালু জমি; শেয়ালকাটা, বাবলার্কাটায় ভরা; উপরে মস্ত পাকুড় গাছটা, সরু একটা পাগদণ্ডি বেয়ে সেখানে উঠতে হয়। রাত্রে জায়গাটাতে এলে ভয় করে কিন্তু দিনের বেলায় যখন সূর্য ওঠে, এখান থেকে ছায়ায় বসে পাহাড়েঘেরা গ্রাম, নদী সবই অতি চমৎকার দেখায়।

 পাকুড় গাছে, লতা-পাতায় ঝোপে-ঝাড়ে জায়গাটা এমনি ঢাকা যে একবিন্দুও চাদের আলো সেখানে পড়তে পায় না। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে হুতুম পেঁচার চোখ টপটপ করে জ্বলছে, আর কিছু দেখাও যাচ্ছে না, শোনাও যাচ্ছে না, অথচ অনেক পাখিই আজ সেখানে জুটেছে ঘোঁট করতে। পেঁচার সর্দার হুতুম একে একে নাম ধরে ডাকতে লাগলেন, আর চারি দিকে একটার পর একটা লাল, নীল, হলদে, সবুজ চোখ জ্বালিয়ে দেখা দিতে থাকল একে একে ধুঁধুল পেঁচা, কাল্ পেঁচা, কুটুরে পেঁচা, গুড়গুড়ে পেঁচা, দেউলে পেঁচা, দালানে পেঁচা, গেছো পেঁচা, জংলা পেঁচা, পাহাড়ী পেঁচা। হুথুমথুমে ডেকে চলেছে, “ভূতো পেঁচা, খুদে পেঁচা, চিলে পেঁচা, গো-পেঁচা, গোয়ালে পেঁচা, লক্ষ্মী পেঁচা,” লক্ষ্মী পেঁচার দেখা নেই, চোখও জ্বলছে না। হুতুম ঘাড় ফুলিয়ে রেগে ডাক দিলে,” ল-ক্-বী-পে-এT-এ্যা-চ-আ আ।” লক্ষ্মী পেঁচা তাড়াতাড়ি এসে চোখ খুলে হাপাতে হাপাতে বললে, “অনেক দূর থেকে আসতে হয়েছে, বিলম্ব হয়ে গেল।” চিলে পেচা চেচিয়ে বললে, “সেইজন্যেই ত্বর করা তার উচিত ছিল।”

 সব পেঁচা একত্র হয়েছে, তখন হুতুম গম্ভীরভাবে বললেন, “কাজ আরম্ভ হবার আগে এসো ভাই সব এককাট্ট হয়ে এক স্বরে নিজের নিজের ঢাকের বান্তি বাজিয়ে দিই,“হুতুম-ঘুম,তুহুম-কুম। লাগ লাগ ঘুট। লাগ লাগ ঘুট। দে ধুলো, দে ধুলো, দে ধুলো, চোর-আ-আ গো-ফ-তা।” সমস্ত রাত্রিটার অন্ধকার বিকট শব্দে ভ'রে দিয়ে পেচাগুলো ডানা ঝাপটাতে লাগল, আর অন্ধকারের জয় দিতে থাকল,

ঘুটঘুটে আঁধারে
আমরা খুলি চোখ,
—যত লাল চোখ।

বুকে বসাই নোখ,
রক্তে গিলি ঢোক।
হাড় ভাঙি আর ঘাড় ভাঙি
আর দিই কোপ
ঝোপ বুঝে কোপ।
আঁদাড়ে কোপ, পাদাড়ে কোপ।

  “চোপচোপ” বলে হুতুম সবাইকে থামিয়ে গম্ভীর স্বরে আঁধারের স্তুতি আওড়ালেন, “নিকুম রাত, দুপুর রাত, নিশুতি রাত। কেষ্ট পক্ষের কষ্টি পাথর কালো আকাশের কালে রাত। বর্ষাকালের কাজল মাখা পিছল রাত। নিখুত রাত। কালোর পরে একটি খুত তারার টিপ। ভয়ংকরী নিশীথিনী, বিরূপ ঘোর, ছায়ার মায়া, থাকুন, তিনি রাখুন। নিশাচর নিশাচরী রক্তপাত করি,আচম্বিতে নিঝুম রাতে, ফুপুর রাতে। নষ্টচন্দ্র, ভ্রষ্ট তারা, ভিতর-বার অন্ধকার-রাত সারারাত। নিঝুম স্থপুর, নিখুত দুপুর, অফুর রাত।”

 হুতুম পেচা চুপ করলেন। খানিক চারি দিক যেন গমগম করতে লাগল, কারু সাড়াশব্দ নেই, অন্ধকারে কেবল ছুচোর খুসখাস আর বেড়ালের গা-চাটার চটচট শোনা যেতে লাগল। পাকুড়তলায় এত বড়ো গম্ভীর মজলিস কোনোদিন বসে নি।

 এইবার বয়েসে সবার বড়োচিলে পেচার পালা। সে চড়া গলায় চীৎকার করে শুরু করলে, “ভাই সব।” সব জলন্ত চোখগুলো অমনি চিলের দিকে ফিরল। “ভাই সব, আমরা আজ এই কতকালের পুরনো মিসকালো পাকুড়তলায় ঘুটঘুটে আঁধারে কেন এসেছি জান? খুন খুন খুন করতে, এ আমি চেচিয়েই বলব। কিসের ভয়। কাকে ভয়।” তার পর একেবারে নবমে গলা চড়িয়ে চিলে বললে, “ভয় করব না,চেচিয়েই বলি, কুঁকড়োটাচো-ও-ও-র”, ব’লেই বুড়োচিলের গলা ভেঙে গেল, সে খক খক করে কাসতে লাগল, আর অন্ত সব পেচা চেঁচাতে থাকল, “চোর। ডাকাত। সি দেল। বদমাশ। আমাদের সর্বস্ব নিলে।”

 চড়াই অমনি বলে উঠল, “কী নিলে শুনি।”

 “আমাদের আনন্দ, আমাদের তেজ সবই হরণ করছে জান না?” ব’লে পেচাগুলো চড়াইয়ের দিকে কটমট করে চাইতে লাগল।

 চড়াই একটু দূরে সরে একটা বাঁশঝাড়ে বসে শুধলে, “তোমাদের তেজ কেমন করে হরণ করলে সে"

 “কেন, গান গেয়ে। তার স্বর শুনলেই আমাদের দুঃখু আসে, বেদনা বোধ হয়; সব পেচারই মন খারাপ হয়ে যায়, কেননা তার সাড়া পেলেই মনে পড়ে।”

 “আলো আসছে।” ব’লেই চড়াই সট করে বাঁশঝাড়ে লুকল। হুতুম রেগে চড়াইকে বললে, “চুপ। খবরদার, ও জিনিসের নাম আর কোরো না, ও নাম শুনলেই রাত্রির মন চঞ্চল হয়ে যেন পালাই পালাই করতে থাকে।”

 চড়াই বেরিয়ে এসে বললে, “আচ্ছা না-হয় দিন আসছে বলা যাক।” অমনি সব পেচা শিউরে উঠে চারি দিকে “উ আঁ” করতে লাগল আর কানে ডান ঢেকে বিকট মুখ করে বলতে লাগল, “থামো, থামো, চুপ, চুপ।” চড়াই আবার লুকিয়ে পড়ল, পেচাদের বিকট চেহারা দেখে তার একটু ভয় হল। হুতুম খানিক ভেবে বললে, “বলো-না বাপু, যা আসবার তা আসছে।” চড়াই বললে, “যাক ও কথা, যা আসবার তা তো আসবেই, কেউ তো ঠেকাতে পারবে না।”

 হুতুম বললে, “তা তো জানি, কিন্তু আসবার আগে তার নাম কেন সে কুঁকড়ো করে বলে তো? তার কাঁসির মতো গলা শুনলেই সেই শেষ রাতের কথাই যে মনে আসে।”

 “ঠিক, ঠিক, সত্যি, সত্যি।” সব পেচাই বলে উঠল। দিনের কথা মনে করতেও তাদের বিষম কষ্ট হচ্ছিল।

 হুতুম বললে, “রাত যখন পোহাবার দিকেই যায়নি, তখন থেকেই পাজি কুঁকড়োটা গান শুরু করে....।”

 সবাই অমনি বলে উঠল, “ডাকু হ্যায়। চোট্ট হ্যায়।” হুতুম আবার বললে, “বাকি রাতটুকু সে একেবারে কাঁচা-ঘুম ভাঙিয়ে মাটি করে দেয়।” চারি দিক থেকে অমনি চেঁচানি উঠল, “মাটি। মাটি। একেবারে মাটি। নেহাত মাটি।” তার পর একে একে সবাই আপনার আপনার দুঃখু জানাতে লাগল। ধুঁধুল বললে, “খরগোশের গর্তর কাছে খানিক বসতে না বসতে কুঁকড়োটা
ডাক দেয় আর অমনি আমায় সরতে হয়।” কাল পেঁচা বললে, “পেটের খিদে ভালো করে মেটাবার জো নেই সেটার জ্বালায়।” কেউ বললে, “তাঁর সাড়া কানে এলেই আর মাথা ঠিক রাখতে পারি নে, এটা করতে ওটা করে ফেলি। খুন করতে হয় মশায় তাড়াতাড়ি। যেন আমারি দায় পড়েছে। জখমগুলোও যে একটু শক্ত করে বসাব তার সময় পাই নে মশায়। যতটুকু মাংস দরকার তার বেশি একটু কি সংগ্রহ করবার জো আছে ওটার জালায়। ওর গলাটা শুনলেই দেখিযেন অন্ধকার দেখতে-দেখতে ফিকে হচ্ছে, আর আমি ভয়ে একেবারে কেঁচো হয়ে যাই।”

 চড়াই শুনে শুনে বললে, “আচ্ছা সব দোষ কি কুঁকড়োর। এ-পাড়াও-পাড়ায় আরো তো অনেক মোরগ আছে যারা ডেকে থাকে।”

 হুতুম বললে, “তাদের গানকে আমরা ভয় করি নে। ওই কুঁকড়োর ডাকটাই যত নষ্টের গোড়া, সেইটেই বন্ধ করা চাই।”

 সবাই অমনি চেচিয়ে উঠল, “বন্ধ হোক। বন্ধ হোক। চাই বন্ধ করা চাই।” আর ডান। বাজাতে লাগল। গোলমাল একটু থামলে গো-পেচ বললে, “তা যাই বল, চড়াই আমাদের জন্যে অনেক করেছেন।” চড়াই ভয় পেয়ে বললে, “কী, কী, আমি আবার বললেম কী, ও আবার কেমন কথা?” খুদে পেচা বললে, “কুঁকড়োর নিন্দে রটিয়ে তার নকল দেখিয়ে তামাশ করে।” অমনি দেউলে, দালানে, গুড়গুড়ে, গোয়ালে, গেছে, জংলা, পাহাড়ে সব পেচা হাসতে লাগল “হুঃ হুঃ ঠিক ঠিক, বা বা, ঠিক ঠিক, হু হু হু হু হু-উ-উ, খুব ঠিক খুব ঠিক।”

 হুতুম রোয়া ফুলিয়ে পাখী ঝাপটালে,“বসস-স।” অমনি সব চুপ হয়ে গেল। চিলে পেঁচা গলা কাঁপিয়ে চিঁ চিঁ করে বললে, “তার নিন্দেই রটাও আর নকলই দেখাও সে তো তাতে থোড়াই ডরায়। বেপরোয়া সে গান গেয়ে চলে, আর বেকার আমরা কেঁপেই মরি। এই দেখে-না সাজগোজ হীরে-জহরতের দিক দিয়ে দেখলে ময়ূরের সামনে কুঁকড়োটা দাড়াতেই পারে না, কিন্তু তবু তার গান, সে তো এখনো আমাদের জালাতে ছাড়ছে না।” সব পেঁচা বিকট চীৎকার করতে থাকল, “ধরে কুঁকড়োকে। মারো কুঁকড়োকে, ধুমাধুম ধুমাধুম।”

 হুতুম চটপট ডান ঝেড়ে খাড়া হয়ে দাড়িয়ে সবাইকে বললে,“থামোথামো শোনো শোনে, এা্টেন-সা-ন অ-ব-ধা-ন।” অমনি সব পেঁচা ডানা ছড়িয়ে গোল চোখগুলো পাকিয়ে স্থির হয়ে বসল, এমনি গম্ভীর হয়ে যে, রাতটাও মনে হতে লাগল যেন কত বড়ো, কত-না গভীর। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে থেকে লক্ষ্মী পেচা আস্তে আস্তে বললে, “তাকে মারাতে হয় না। যে সময়ে সে ঘরের বাইরে এসে দাড়ায় সে সময় আমরা দেখতেই পাই নে, চোখে সব যে বোধ হয় ধোয়া আর ধাধী— ধা-ধা ধ।” ব’লেই লক্ষ্মী পেচা চুপ করলে, আর সব পেচা গুমরোতে থাকল।

 তখন পাকুড়গাছের আগডালের উপর থেকে কুটুরে পেঁচা মিহি আওয়াজ দিলে, “বোলুঙ্গা কুছ, সল্লা হ্যায় কুছ।” হুতুম উপর দিকে চেয়ে বললে, “শুনি, তোমার মতলবটা কী।” কুটুরে সট করে নীচের ডালে নেমে বসে আরম্ভ করলে, “পাহাড়ের ওদিকটায় একটা লোক অদ্ভূত সব পাখির চিড়িয়াখানা বানিয়েছে, নানা দেশী-বিদেশী মোরগ, নানা জাতের নানা কেতার ধরা আছে। ময়ুর যিনি রাজ্যের অদ্ভুত পাখির খবর রাখেন, তিনি কুঁকড়োকে কিছুতে দেখতে পারেন না, কেননা, ময়ুরের একটিমাত্র বৈ ফুটি স্বর নেই, তাও আবার কর্ণকুহর ভেদ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। কিন্তু কুঁকড়োর ডাক, সে সোজা অন্ধকারের বুকে গিয়ে বেঁধে আর তার পর যে কাগুটা ঘটে তা কারুর জানতে বাকি নেই। কাজেই ময়ূর স্থির করেছেন চিনেমুরগির কুলতলার মজলিসে তিনি এই-সব অদ্ভুত মোরগদের হাজির করবেন।” “চিনে-মুরগির সঙ্গে আলাপ করে দিতে বুঝি?” বলেই সব পেচা হেঁ হেঁ করে হাসতে থাকল।

 কুটুরে বললে, “এই-সব অদ্ভূত মোরগের কাছে কি কুঁকড়ে দাড়াতে পারবে। একেবারে খাড়া দাড়িয়ে মাটি হবে।” গোয়ালে পেচা বলে উঠল, “হাজির তারা হবে কেমন করে। খাচা না খুলে দিলে তো সেই সব খাসা মোরগদের এক পা নড়বার সাধ্যি নেই।”

 কুটুরে সবাইকে আশ্বাস দিয়ে বললে, “তারও উপায় করা গেছে। যে পাহাড়ী ছোড়াটা খাচ খুলে সকালে তাদের দানাপানি খাওয়ায় সে কাল যেমন খাচা খুলবে আর আমি অমনি। তার মুখে গিয়ে ডানার এক ঝাপটা দেব। নিশ্চয়ই সে কাদতে কঁদিতে দৌড় দেবে খাচ খোলা রেখে। পেঁচার বাতাস গায়ে লাগলেই অসুখ, সেটা জানো তো। তার পর সব মোরগকে নিয়ে সরে পড়ো আর কি।”

 চড়াই বললে, “ওদিকে কুঁকড়ে বলছেন যে তিনি মজলিসে মোটেই যেতে রাজি নন।”  বেড়াল বললে, “যাবে না কী। নিশ্চয়ই যাবে। দেখ নি সোনালিয়া মুরগিটির সঙ্গে তার কত ভাব। আমি এই লিখে দিচ্ছি সোনালিয়া কুঁকড়োকে মজলিসে হাজির করবেই কাল।” চড়াই বুঝলে কালে বেড়ালটা সারাদিন ঘুমোয় বটে, কিন্তু কোথা কী হয় সেটুকুও দেখে শোনে, গোলাবাড়ির সব খবরই সে রাখে চোখ বুজে বুজেই।

 চড়াই বললে, “হাজির যেন হলেন কুঁকড়ে, তার পর?” “তার পর আর কী। কুঁকড়ে যখন দেখবেন পাড়ার সবাই অদ্ভুত সব মোরগদের খাতির করতেই ব্যস্ত, এমন-কি, হয়তো সোনালি পর্যন্ত, জেনে রেখে তখন খুটিনাটি বাধবেই আর তা হলেই—”

 “কুঁকড়োর লড়াই না হয়ে যায় না।” বলেই হুতুম ঠোঁটে ঠোঁট বাজিয়ে দিলেন। কিন্তু বেড়াল বললে, “ধরে লড়ায়ে কুঁকড়োর হার না হয়ে জিতই হয়ে গেল ফস করে। তখন উপায়?”

 কুটুরে অমনি বললে, “সে ভাবনা নেই,ওই-সবখাসা মোরগদের মধ্যে যে বাজখাই পালোয়ান মোরগ আছে তাকে পারে এমন কেউ দেখি নে। মানুষ তার পায়ে লোহার কাট-দেওয়া যে কাতান বেঁধে দিয়েছে তার এক ঘা খেলে কুঁকড়োকে আর দেখতে হবে না, একেবারে চিৎপটাং।” বলে কুটুরে হাসতে লাগল। সঙ্গে সব পেঁচাই ধাই ধাই করে নাচতে থাকল।

 হুতুম বললে, “আমি তো বাপু আগে গিয়ে তার মাথার মোরগ ফুলটা ছিঁড়ে খাব, কপা কপ কপা কপ।”

 চড়াই মনে মনে বললে, “গতিক তো খারাপ দেখছি। কুঁকড়োকে খবর দেব নাকি।” কিন্তু চেচিয়ে সে সবাইকে বললে, “বেশ হবে, খুব হবে, ভালোই হবে, কী বল।”

 কুটুরে বললে, “মজা বলে মজা। খাসা মোরগগুলোও দু-চারটে মরবে নিশ্চয়। পেট ভরে খাও; সেগুলো কি নষ্ট করা ভালো।”

 হুতুম চিলের কানে-কানে বললে, “কুঁকড়োর কাবারের পর দুজনে মিলে, বুঝেছ কিনা, চড়াই ভাতি...” আর তার পরে ধুঁধুলে পেঁচা কী বলতে যাচ্ছে এমন সময় দূরে কুঁকড়োর সাড়া পড়ল, “গ-তোল-তোল।” পেঁচারা শুনলে, “পটোল তোল।” অমনি ভয়ে সব চুপ। কুটুরে ক্রমেই মাথা হেঁট করতে লাগল। কে যেন তার ঘাড় ধরে মাটিতে মুখ ঘষেদিতে চাচ্ছে। এতক্ষণ পেঁচা-সব রোঁয়া ফুলিয়ে বিকট চেহার করে বসে ছিল, দেখতে দেখতে ফুটে রবারের গোলার মতো চুপসে গেল, যেন কতদিন খায় নি। মুখে কারু কথা সরছে না, কেবল চোখ পিটপিট করে এ ওকে শোধাচ্ছে, “হল কী। কী ব্যাপার।” তার পর ডানা মেলে একে একে সবাই পালায় দেখে চড়াই বললে, “এরি মধ্যে চললে নাকি।” চড়ায়ের কথা কে-ইবা শোনে। চড়াই যত বলে, “ভোর হতে এখনো দেরি, চলুক না ঘোট আরো খানিক।” সব পেচা চোখ পিটপিট করে বলে, “না না না, আর না, আর না, আর না।” হুতুম বললে, “গেলুম।” ধুঁধুল বললে, “মলুম।” “বাঁচাও বঁচিাও।” বলছে আর-সব পেচাগুলো। তাড়াতাড়িতে কোথায় যাবে, কী করবে ঠিক পাচ্ছে না, কানার মতো কখনো কাট-গাছে গিয়ে পড়ছে, কখনো পাথরে টক্কর খাচ্ছে। আর ডানা দিয়ে চোখ-মুখ ঘষছে আর বলছে, “উঃ গেছি। উঃ গেছি।” “লাগছে লাগছে।” বলতে বলতে একে একে সব পেচা চম্পট দিলে। সব-শেষ হুতুম পেচাট “গেলুম। গেলুম।” বলতে বলতে উড়ে পালাল।

 চড়াই দেখলে অন্ধকারের মধ্যে কালে কালো নৌকার মতো দলে-দলে পেচাগ্রাম ছাড়িয়ে ক্রমে পাহাড়ের গায়ে মিলিয়ে গেল। আর কেউ কোথাও নেই, পাকুড়তলা সে একা রয়েছে। “ফজর তো হল এখন ছোটো হাজরির জন্তে একটা গঙ্গা ফড়িং পেলে হয় ভালো।” ব’লে চড়াই এদিক ওদিক করছে, এমন সময় একটা ঝোপের আড়াল থেকে ঝপ করে সোনালিয়া বেরিয়ে এল। চড়াই অবাক হয়ে বললে, “একি। এত রাত্রে আপনি এখানে ৷”

 সোনালিয়া একটু দূরে থেকে পেচাদের যুক্তি সমস্ত শুনেছিল, সে হাপাতে হাপাতে বললে, “কী ভয়ানক ব্যাপার, চড়াই তো কুঁকড়োর বন্ধু, এখন বন্ধুকে বাচাতে চেষ্টা তো তার করা উচিত।” চড়াই আবার ফড়িং-এর সন্ধান করতে করতে বললে, “পেঁচা ভাজা খেতে কী মজা তা পাখিজন্মে তারা কেউ জানলে না—।”

 সোনালিয়া অবাক হল। চড়াইটার রকম দেখে সে রেগে বললে, “কথার জবাব দাও-না।” “কীঃ” ব’লেই চড়াই ফিরে দাড়াল। সোনালি শুধলে, “ঘোঁটের খবর জানতে চাচ্ছি।” চড়াই ধীরে সুস্থে উত্তর করলে, “ঘোঁটটা খুব চলেছিল, সব দিকেই ভালো।”  সোনালি চড়াই-এর হেঁয়ালির অর্থ বুঝলে না; সে পরিষ্কার জবাব চাইলে। চড়াই বললে, “অন্ধকার বেশ ঘুটঘুটে আর পেঁচাগুলোও বেশ মোটা-সোটা দেখলেম।”

 “তারা তাকে মারবার যুক্তি করলে?” সোনালি শোধালে।

 “না, মারবার নয় তাকে পরলোকে পাঠাবার যুক্তি।” বলে চড়াই সোনালিকে আশ্বাস দিয়ে বললে, “তবু কতকটা রক্ষে, কী বলে।” সোনালি কি বলতে যাচ্ছিল, চড়াই বললে, “ভাবছ কেন, শেষ দাড়াবে যা তা ফক্কাঃ, বুঝলে।” সোনালি ভয়ে ভয়ে বললে, “যাই বল কিন্তু পেচারা তো সহজ পাখি নয়।”

 চড়াই হেসে বললে, “কিন্তু তাদের যুক্তিটা মোটেই ভয়ানক নয়। আরো অনেক যুক্তি তারা এটেছে আঁটবেও। পেচাগুলো যদি সহজ পাখি হত তবে ঘুট না করে খাবার ঘুটেই তারা বেড়াত। কিন্তু তাদের ভুরু চোখের উপরে, নীচে, আশে পাশে, আর চোখগুলো দেখেছ তো? মনে হয় যেন পাহারোলার লণ্ঠন, খোলো আর বন্ধ করে। আর ঠোঁট তো দেখেছ?” বলেই চড়াই “ছিঃ ছিঃ” বলে ডানা ঝাড়া দিয়ে বললে, “তুমি কিছু ভেবে। না সোনালি। সব ঠিক হবে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা চাই, বুঝলে কিনা।”

 সোনালি চড়াই-এর হেঁয়ালি বড়ো একটা বুঝলে না কিন্তু কুঁকড়োর পুরনো বন্ধু হয়ে চড়াই এখনো যখন হাসিতামাশা করছে তখন ভয়ের কারণ খুবই কম এটা তার মনে হল। “কিন্তু তবু কী জানি, কুঁকড়োকে সব কথা জানানো ভালো।” ব’লে সোনালি গোলাবাড়ির দিকে যাবে, চড়াই তাকে তাড়াতাড়ি পথ আগলে বললে, “অমন কাজটি কোরো না, যদি-বা কুঁকড়ে সেখানে না যান, এই ঘোটের কথা শুনলে নিশ্চয়ই যাবেন, আর তা হলে লড়াই বাধবেই।” সোনালি চড়ায়ের কথা রাখলে। চড়াই যখন তার পুরনো বন্ধু, তখন তারি পরামর্শমত কাজ করাই ঠিক। সোনালি যাচ্ছিল, ফিরে এল।

 ওদিক থেকে শব্দ এল, “গা তো ল।” চড়াই আর সোনালি ফিরে দেখলে কুঁকড়ে আসছেন। কুঁকড়ে হাক দিলেন, “কো-উ-ন হ্যায়।”  সোনালি মিহিমুরে উত্তর দিলে, “সো-না-লি-য়া”, কুঁকড়ে শোধালেন, “ওখানে আর কেউ আছে কি।” সোনালি চড়াইকে চোখ টিপে বললে, “না মশায়।” ঘোঁটের কথা কুঁকড়োকে যেন বলা না হয় সোনালিকে সে বিষয়ে সাবধান করে দিয়ে, চড়াই আস্তে আস্তে বাবলা গাছের তলায় একটা খালি ফুলের টবের আড়ালে গিয়ে লুকোল।