ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/গোলাপী রঙের সুন্দর পুরী

গোলাপী রঙের সুন্দর পুরী।

 আরো দেড়ক্রোশ উত্তরাভিমুখে। উদয়পুরের পর হইতে—মরুভূমির পর মরুভূমি। সমস্ত ভূমিই অভিশাপগ্রস্ত;—মাটির উপরে যেন একটা শাদা ভস্মের স্তর পড়িয়াছে; যেন একটা আগ্নেয়গিরির ব্যাপক অগ্ন্যুচ্ছাসে এই ভস্ম চারিদিকে বিকির্ণ হইয়াছে। পূর্ব্বে যেখানে জঙ্গল ছিল, গ্রাম ছিল, কৃষিভূমি ছিল—এখন সমস্তই একাকার,—একই বিষণ্ন রঙে রঞ্জিত। কিন্তু এই উদাস উজাড় মরুপ্রদেশেও একটি সুরম্য নগর, পূর্ণ প্রাচ্যমহিমায় বিরাজ করিতেছে। সে সকল বীথি, সমুচ্চ দস্তুর প্রাকারাবলী, ছুচালখিলান-সমন্বিত দ্বারসমূহ এইখানে আসিয়া মিলিত হইয়াছে,—উহা শুভ্রপরিচ্ছদধারী অশ্বারোহী পুরুষে, পীত কিংবা লোহিত অবগুণ্ঠনে আবৃত রমণীবৃন্দে পরিপূর্ণ। গরুর গাড়ি যাতায়াত করিতেছে। সুসজ্জিত উটেরা সারিবন্দি হইয়া চলিয়াছে। সু-কালের মত চারিদিকে বিচিত্র রঙের ছড়াছড়ি—জীবন-উদ্যমের উদ্দামস্ফূর্ত্তি।

 কিন্তু প্রাকারাবলীর পাদদেশে, ছেঁড়া ন্যাক্‌ড়ার বস্তার মত ও সব কি দেখা যায়?—উহার মধ্যে কতকগুলা মনুষ্যের আকার প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। জমির উপর ঐ লোকগুলা কে? উহারা কি মাতাল? উহারা কি রুগ্‌ণ? আহা! কতকগুলা শীর্ণকায় জীব, কতকগুলা অস্থিপঞ্জর, কতকগুলা “মমি” শব! কিন্তু না, এখনো যে নড়িতেছে; চোখের পাতা পড়িতেছে, চোখ মেলিয়া চাহিতেছে! শুধু তাহা নহে, খাড়া হইয়া উঠিয়াছে। জঙ্ঘাকার লম্বা-লম্বা অস্থিখণ্ডের উপর ভর দিয়া টল্‌মল্‌ করিতেছে।

 প্রথম দ্বারটি পার হইবার পরেই আর একটি দ্বার! এই দ্বারটি ভিতরকার প্রাচীরগাঁথনির মধ্য হইতে কাটিয়া বাহির করা। দস্তুর চুড়াদেশ পর্য্যন্ত এই প্রাচীরটী গোলাপী রঙে রঞ্জিত;—গোলাপী রঙের জমির উপর ভারতীয় নক্‌সার ধরণে নিয়মিত-অস্তরে শাদা শাদা ফুলের নক্‌সা কাটা। পুরু ধূলার স্তরের উপর, এখনো কতকগুলা শ্যামবর্ণ মনুষ্যের গাদা রহিয়াছে;—যেন ভস্মরাশির মধ্যে নিমজ্জিত। পুষ্পচিত্র-বিভূষিত এই সুন্দর গোলাপী রঙের প্রাচীরের সম্মুখে উহাদিগকে আরো কদাকার দেখাইতেছে। দেখিলে মনে হয়, যেন অস্থিপঞ্জরের উপর একখণ্ড শুকানন চাম্‌ড়া লাগাইয়া দেওয়া হইয়াছে। হাড়গুলা যেন স্পষ্ট করিয়া গোণা যায়। হাঁটু ও কনুয়ের গাঁট যেন একএকটা মোটা গোলা;—লাঠির গাঁঠের মত। উরতে শুধু একটা হাড়—নীচের জঙ্ঘা অপেক্ষা শীর্ণ; জঙ্ঘাতেও দুইটি অস্থিখণ্ড ছাড়া আর কিছুই নাই। উহাদের মধ্যে কতকগুলা লোক এক পরিবারের মত দলবদ্ধ হইয়া আছে; কতকগুলা বিচ্ছিন্নভাবে ইতস্তত রহিয়াছে। কেহ বা দুই হাত ছড়াইয়া মাটির উপর পড়িয়া যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করিতেছে; কেহ বা বোবার মত, স্থাণুর মত, উবু হইয়া নিশ্চলভাবে বসিয়া আছে; চোখগুলা জ্বরবিকারগ্রস্ত রোগীর ন্যায়; লম্বা-লম্বা দাঁত ঠোঁট হইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছে—ঠোঁট পিছনে হটিয়া গিয়াছে। এক কোণে—একটি মাংসহীন জীর্ণশীর্ণ বৃদ্ধা ছেঁড়া ন্যাক্‌ড়ার উপর বসিয়া নীরবে ক্রন্দন করিতেছে। বোধ হয়, এ সংসারে তাহার আর কেহ নাই।

 এই দ্বারযুগল যেই পার হইলাম, অমনি নগরের অভ্যন্তরদেশ আমার সমক্ষে সহসা প্রকাশিত হইল। আমি এরূপ দেখিব বলিয়া আদৌ প্রত্যাশা করি নাই। কি আশ্চর্য্য কাণ্ড! কি ঐন্দ্রজালিক ব্যাপার!

 একটা বৃহৎ নগর সমস্তই গোলাপী;—উহার প্রাকারাবলী উহার দেবালয়, উহার গৃহাদি, উহার কীর্ত্তিস্তম্ভ—সমস্তই গোলাপী; সমস্তের উপর একই রকম শাদা ফুলের নক্‌সা। রাজার এ কি অদ্ভুত খেয়াল! দেখিলে মনে হয়, ভারতীয়-ধরণের ফুলের নক্‌সা-কাটা যেন একটি অখণ্ড প্রাচীর বরাবর প্রসারিত। মনে হয়, যেন অষ্টাদশ শতাব্দীর কোন পুরাতন ‘‘একরঙা” নগর। কিন্তু এখানে সমস্ত মিলিয়া তাহা হইতে একটি পূর্ণ সৌন্দর্য্য বিস্ফূরিত হয়, তাহার তুলনা আর কোথাও নাই। অন্যান্য একরঙা নগরের সহিত এই বিষয়েই ইহার প্রভেদ। ইহা একেবারেই অনন্যসদৃশ।

 লম্বা-লম্বা রাস্তা, ঠিক সমসূত্রে নির্ম্মিত আমাদের “বুল্‌ভার’’ (Boulvard) রাস্তা অপেক্ষা দ্বিগুণ চওড়া। রাস্তার দুই ধারে সারি-সারি উচ্চ অট্টালিকা; এই সকল অট্টালিকার সম্মুখভাগ,—প্রাচ্যদেশসুলভখাম্‌খেয়ালি-কল্পনানুযায়ী কত যে বিচিত্র আকারে নির্ম্মিত, তাহার আর অন্ত নাই। মাল্য-নক্‌সা-ভূষিত ছোট-ছোট কত খিলান; অটচুড়া প্রভৃতি এত অতিরিক্ত পরিমাণে উপর্য্যুপরি বিন্যস্ত যে, এরূপ আর কুত্রাপি দৃষ্ট হয় না। সমস্তই গোলাপী রঙের। খুব সামান্য ছোটখাটো ঢালাই কাজ কিংবা ফলপুষ্পের নক্‌সা—তাহাও শাদা-শাদা সূত্রাকার কারুকর্ম্মে খচিত। যে সকল অংশ খোদিত, তাহার উপর যেন শাদা “লেসের” কাজ (Lace) বসানো। পক্ষান্তরে, যে সকল অংশ সমতল, তাহার উপর সেই একই গোলাপী রং—সেই একই রকমের ফুলের নক্‌সা চিত্রিত।

 এই সব রাস্তার সর্ব্বত্রই জনতার গতিবিধি। সর্ব্বত্রই উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা। শতশত দোকানদার নানাপ্রকার দ্রব্যসামগ্রী মাটির উপর সাজাইয়া রাখিয়াছে। দুই ধারের “পদপথ”—কাপড়ে, তাম্রসামগ্রীতে, অস্ত্রাদিতে সমাচ্ছন্ন। আবার এই জনতার মধ্যে কতকগুলি রমণীও চলাফেরা করিতেছে। উহাদের বিচিত্র রঙের ও বিচিত্র ঢঙের নক্‌সা-কাটা অবগুণ্ঠন; স্কন্ধ পর্য্যন্ত সমস্ত নগ্নবাহু বাজুবন্দে ভূষিত।

 এই বড় রাস্তার মধ্য দিয়া রৌপ্য-অস্ত্রধারী আশ্বারোহিগণ ঝক্‌মকে জিনের উপর বসিয়া চলিয়াছে। শিং-রং-করা বলদেরা বড়বড় শকট টানিয়া লইয়া যাইতেছে। রজ্জুবদ্ধ দ্বি-ককুদ উষ্ট্রগণ দীর্ঘরেখায় সারিবন্দি হইয়া চলিয়াছে। জরির পোষাক পরিয়া হস্তিবৃন্দ চলিয়াছে; উহাদের শুণ্ডের উপর চিত্রবিচিত্র নক্‌সা অঙ্কিত। এক-ককুদ উষ্ট্রেরা চলিয়াছে; তাহাদের পৃষ্ঠে দুইজন করিয়া লোক উপবিষ্ট—একজনের পিছনে আর একজন। এই সকল উষ্ট্র অষ্ট্রিচ্‌পাখীর মত সম্মুখে ঘাড় বাড়াইয়াদিয়া লঘুপদক্ষেপে দুল্‌কি-চালে চলিয়াছে। ফকির-সন্ন্যাসীরা চলিয়াছে—একেবারে নগ্নকায়;—আপাদমস্তক শাদা চূর্ণে আচ্ছন্ন। পাল্‌কী চলিয়াছে, তাঞ্জাম চলিয়াছে। সমস্তই যেন প্রাচ্য পরীদৃশ্যের একটি চিত্রপট—অপূর্ব্ব একরঙা গোলাপী ফ্রেমের মধ্যে আবদ্ধ।

 কতকগুলা লোক রাজার পোষা চিতাদিগকে রজ্জুবদ্ধ করিয়া, জনতায় অভ্যস্ত করাইবার জন্য উহাদিগকে লইয়া বেড়াইতেছে। চিতারা সতর্কভাবে পা টিপিয়াটিপিয়া চলিয়াছে। উহাদিগকে দেখিতে অদ্ভুত। মাথায় ছোট-ছোট জরির টুপি; থুঁতির নীচে একটা পুষ্পাকার ফিতার গ্রন্থি। মখ্‌মলের মত পায়ের থাবাগুলা,—একটার পর একটা,—কি সন্তর্পণেই মাটির উপর রাখিয়া চলিতেছে! আরো বেশী নিরাপদ্‌ হইবার জন্য কতকগুলি লোক উহাদের আংটা-বদ্ধ পুচ্ছ ধরিয়া রহিয়াছে। ইহারা ছাড়া আরো চারিজন পরিচারক পিছনে-পিছনে চলিয়াছে।

 তা ছাড়া, সেই প্রাকারদ্বারের সম্মুখে যে-শ্রেণীর জীব দেখা গিয়াছিল, সেইরূপ কতকগুলি লোক এখানেও বিষণ্নমুখে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। দেখিলে মনে হয়, যেন গোর হইতে পলাইয়া আসিয়াছে। উহারা সাহস করিয়া এই পুষ্পবর্ণরঞ্জিত সুন্দর পুরীতে প্রবেশ করিয়াছে এবং আপনাদের অস্থিগুলা টানিয়া-টানিয়া লইয়া বেড়াইতেছে!…প্রথমে দেখিয়া যেরূপ মনে হইয়াছিল, তাহা অপেক্ষা এই সব লোকের সংখ্যা আসলে অনেক বেশী। অন্তঃপ্রবিষ্ট নিষ্প্রভ নেত্রে যাহারা টলিয়া-টলিয়া ইতস্তত বেড়াইতেছে, শুধু ইহারাই যে দুর্ভিক্ষপীড়িত লোক, তাহা নহে; দোকানদারদের মধ্যে, সুশোভন সুসজ্জিত দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে, ছেঁড়া ন্যাক্‌ড়ার বস্তার মত—নরকঙ্কালের মত, এইরূপ আরো কতকগুলা লোক পাথর-বাঁধানো পদপথের উপর পড়িয়া আছে। পথ-চল্‌তি লোকেরা—পাছে উহাদের মাড়াইয়া ফেলে, এই ভয়ে একটু পাশ কাটাইয়া চলিতেছে…এই প্রেতমূর্ত্তিগুলা চতুষ্পার্শ্বস্থ ক্ষেত্রভূমির কৃষক। যে অবধি বৃষ্টির অভাব হইয়াছে, তখন হইতেই উহারা, শস্যনাশনিবারণার্থ প্রাণপণে যুঝাবুঝি করিয়াছে; এই দীর্ঘকাল, উহারা যে দারুণ কষ্ট ভোগ করিয়াছে,—উহাদের দেহের অসম্ভব কৃশতা তাহারই ফল। এখন সব শেষ হইয়া গিয়াছে। গরুবাছুর সমস্তই মরিয়া গিয়াছে। মৃত গরুর চামড়াও উহারা জঘন্য মূল্যে বিক্রয় করিয়াছে। যে সকল জমিতে, উহারা চাষবুনানি করিয়াছিল, সমস্তই এখন শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছে। সেখানে এখন আর কিছুই অঙ্কুরিত হয় না। একমুঠা অন্নের জন্য উহারা কাপড়চোপড়, রূপার গহনাপত্র,—উহাদের যাহা-কিছু ছিল, সমস্তই বিক্রয় করিয়াছে। কয়েকমাস ধরিয়া উহাদের শরীর ক্রমশই শীর্ণ হইতেছে। তাহার পর এখন এই দারুণ দুর্ভিক্ষ;—ক্ষুধার অসহ্য যন্ত্রণা। ক্রমে শবদেহের পূতিগন্ধে সমস্ত গ্রামপল্লী আচ্ছন্ন হইয়া গেল।

 অন্ন! হাঁ, এই সব লোক একমুঠা অন্নের জন্য লালায়িত; তাই উহারা এই নগরাভিমুখে আসিয়াছে। এইখানে আসিলে লোকে উহাদের প্রতি দয়া করিবে, উহাদের প্রাণ বাঁচাইবে—এইরূপ উহাদের বিশ্বাস ছিল। কেন না, উহারা পরস্পরায় শুনিয়াছিল,—নগর-অবরোধের সময় খাদ্যসামগ্রী যেরূপ নগরের মধ্যে সংগ্রহ করিয়া রাখা হয়, সেইরূপ এইখানে রাশিরাশি চাউল-ময়দা রক্ষিত হইয়াছে; এবং এই নগরে আসিলেই সকলে একমুঠা খাইতে পায়।

 বস্তুত রাজার আদেশক্রমে সারিবন্দি উষ্ট্রপৃষ্ঠে বস্তা বস্তা চাউল ও ছোলা দূরপ্রদেশ হইতে সহরে অষ্টপ্রহর আমদানি হইতেছে। ধান্যাগারে—এমন কি, পদপথের উপরেও উহা জমা করিয়া রাখা হইতেছে;—শুধু এই ভয়ে, পাছে চতুর্দ্দিকের দুর্ভিক্ষ এই সুন্দর গোলাপী নগরেও প্রবেশ করে। এখানে খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যায় সত্য, কিন্তু উহা ক্রয় করিতে হয়। ক্রয় করিবার জন্য অর্থ চাই। সত্য বটে, রাজধানীতে যে সকল দরিদ্রের বসতি, রাজা তাহাদিগকে অর্থাদি বিতরণ করিতেছেন। কিন্তু চতুষ্পার্শ্বস্থ ক্ষেত্রভূমির শতসহস্র কৃষক, যাহারা অন্নাভাবে ক্ষুধার জ্বালায় মরিতেছে, তাহাদের সাহায্যের জন্য এই অর্থে কুলায় না। তাই উহাদিগকে আসিতে দেওয়া হইতেছে না। তাই তাহারা রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, আহারস্থানের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে—শুধু এই আশাভরে, যদি কেহ একমুষ্টি চাউল তাহাদের নিকট নিক্ষেপ করে। তাহার পর, যখন শয়নের সময় হয়, তখন উহারা যেখানে হয় একস্থানে শুইয়া পড়ে; এমন কি, পদপথের সানের উপরেই শুইয়া পড়ে। বোধ হয়, উহাই তাহাদের অন্তিমশয্যা।

 এইমাত্র শ-খানেক বস্তার চাউল উষ্ট্রপৃষ্ঠে এখানে আসিয়া পৌঁছিল। ধান্যাগারগুলা বোধ হয় পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। তাই ধান্যাগারের সম্মুখস্থ পদপথের উপর এই বস্তাগুলা নামাইয়া রাখিতে হইবে। ৫ হইতে ১০ বৎসরের কঙ্কালসার নগ্নকায় তিনটি শিশু সেইখানে বিশ্রাম করিতেছিল। একজন প্রতিবেশী বলিল,—“ইহারা তিনটি ভাই; ইহাদের মা-বাপ—যাহারা উহাদের আনিয়াছিল, তাহারা মরিয়াছে (বলা বাহুল্য, ক্ষুধার জ্বালায়); তাই, উহারা এইখানেই পড়িয়া আছে, উহাদের আর কেহ নাই।” যে স্ত্রীলোকটি এই কথা বলিতেছিল, তাহার কথার ভাবে মনে হইল, এসমস্তই যেন স্বাভাবিক ঘটনা। আকারপ্রকারে স্ত্রীলোকটি দুষ্টা বলিয়াও মনে হয় না!…কি ভয়ানক! ইহারা কিরকম লোক? ইহাদের হৃদয় না-জানি কি উপাদানে গঠিত! এদিকে ইহারা একটি পাখী মারিবে না; অথচ ইহাদের দ্বারের সম্মুখে কতকগুলা অনাথ পরিত্যক্ত শিশু অনাহারে মরিতেছে, তাহা দেখিয়াও উহাদের হৃদয় একটুও বিচলিত হইতেছে না।

 যে শিশুটি সব চেয়ে ছোট, তাহার প্রায় সব শেষ হইয়া আসিয়াছে। একেবারে গতিশক্তি রহিত। মুদ্রিত চোখের পাতার ধারে-ধারে যে মাছি বসিয়াছে, তাহাদের তাড়াইবারও শক্তি নাই। রন্ধনার্থ ছাগাদিপশুর অন্ত্র বাহির করিয়া ফেলিলে যেরূপ হয়, উহাদের উদর সেইরূপ দেখিতে হইয়াছে। রাস্তায় সানের উপর শরীরকে ক্রমাগত টানাহ্যাঁচ্‌ড়া করায়, পিঠের হাড় মাংসের মধ্যে বিঁধিয়া গিয়াছে।

 যাহাই হউক, এই শস্যের বস্তাগুলা রাখিবার জন্য উহাদিগকে এক্ষণে সরানো আবশ্যক। যে শিশুটি সব চেয়ে বড়, সে অতীব বাৎসল্যসহকারে ছোটটিকে কাঁধে করিয়া লইল এবং মধ্যমটির হাত ধরিল; কেন না, মধ্যমটির এখনো একটু চলিবার শক্তি আছে। এইরূপে উহারা নীরবেনিঃশব্দে সেখান হইতে প্রস্থান করিল।

 ছোটটির চক্ষু মুহূর্ত্তের জন্য একবার উন্মীলিত হইল। আহা! উহার চোখের দৃষ্টি অন্যায়রূপে দণ্ডিত নির্দ্দোষ বধ্যজনের দৃষ্টির মত। যন্ত্রণার ভাব,—তিরস্কারের ভাব,—কি হেতু সর্ব্বজনপরিত্যক্ত হইয়া এতটা কষ্টভোগ করিতেছে, তজ্জন্য বিস্ময়ের ভাব—সমস্তই যেন ঐ দৃষ্টিতে পরিব্যক্ত!...কিন্তু ক্ষণপরেই তাহার সেই মুমূর্ষু চক্ষু আবার নিমীলিত হইল; আবার মাছিগুলা আসিয়া চোখের পাতার উপর বসিল। বেচারা শিশুটির ক্ষুদ্র মস্তক তাহার বড় ভায়ের শীর্ণ কাঁধের উপর আবার ঢলিয়া পড়িল।

 পা একটু টলিল; কিন্তু চোখে জল নাই; মুখে একটি কাতরোক্তি নাই; শিশু-ধৈর্য্য ও শিশু-আত্মত্যাগের যেন সাক্ষাৎ মূর্ত্তি—এইরূপে সে, ভাই-দুটিকে লইয়া চলিয়া গেল। বড়টি আপনাকে বাড়ীর কর্ত্তা বলিয়া মনে করে। তাহার পর সে যখন দেখিল, এতটা দূরে আসিয়াছে যে, এখন আর কাহারো পথের অন্তরায় হইবার সম্ভাবনা নাই, তখন খুব সতর্কতার সহিত, অতি সন্তর্পণে ভাইদুটিকে রাস্তার সানের উপর আবার শুয়াইয়া দিল এবং নিজেও তাহাদের পার্শ্বে শয়ন করিল।

 এই চৌমাথা-রাস্তায়—যেখানে সমস্ত সুন্দর রাস্তাগুলি আসিয়া মিলিত হইয়াছে—যে শোভাসৌন্দর্য্য এই নগরের বিশেষত্ব, তাহা যেন পূর্ণমাত্রায় ফুঠিয়া উঠিয়াছে। রাস্তার শেষপ্রান্ত পর্য্যন্ত সমস্তই গোলাপী ও তাহার উপর শাদা গোলাপফুলের নক্‌সা। দেবমন্দিরের গোলাপী চুড়াসমূহ ধূলাচ্ছন্ন আকাশ ভেদ করিয়া ঊর্দ্ধে উঠিয়াছে; তাহার চারিপার্শ্বে কালো-কালো পাখী আবর্ত্তের ন্যায় ঘোরপাক দিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। রাজপ্রাসাদের সম্মুখভাগও গোলাপী, তাহার উপর শাদা ফুলেম নক্‌সা;—আমাদের বড়-বড় গির্জ্জার সম্মুখভাগ অপেক্ষাও উচ্চ; প্রায় একশত সমপ্রমাণ চতুষ্ক উপর্য্যুপরি ন্যস্ত;—প্রত্যেকেরই একইপ্রকার স্তম্ভ শ্রেণী, একই প্রকার গরাদে, একইপ্রকার ছোট-ছোট গম্বুজ; সর্বোপরি রাজনিশান,—শুষ্কবায়ুভরে পতপতশব্দে আকাশে উড়িতেছে। ফুলের নক্সা-কাটা গোলাপী রঙের প্রাসাদগৃহাদি—চতুষ্পথের চারিপার্শ্ব হইতে সুরু করিয়া ধূলিময় রাস্তার সুদূর প্রান্ত পর্য্যন্ত সমসূত্ররেখায় বরাবর চলিয়া গিয়াছে।

 এই চতুষ্পথের লোকেরা অলঙ্কারে আরো অধিক বিভূষিত, আরো অধিক জীবন-উদ্যমে পূর্ণ, বিচিত্র বর্ণে আরো অধিক সমুজ্জল। ক্ষুধাক্লিষ্ট পরিব্রাজকদিগের সংখ্যা,— বিশেষতঃ ক্ষুদ্র বালকদিগের সংখ্যা এখানে আবো অধিক। কেন না, এই রাস্তার মাঝখানেই, খোলা জায়গায়,—চাউলের পিঠা, চিনি কিংবা মধু দিয়া প্রস্তুত মিষ্টান্নের পাক হইতেছে; তাহাতেই উহারা আকৃষ্ট হইতেছে। বলা বাহুল্য, উহাদিগকে কিছুই দেওয়া হইতেছে না, তবু উহারা দুর্ব্বল কম্পমান ছোট-ছোট পায়ের উপর ভর দিয়া এইখানেই দাঁড়াইয়া আছে।

 এই সকল ক্ষুধিতের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে। উহারা করাল বন্যার মত গ্রাম-পল্লী হইতে ঠেলিয়া আসিতেছে; সহরের দ্বারদেশে পৌঁছিবার পূর্ব্বেই, দূরত্বের নিদর্শন-খোঁটার মত, উহাদের মৃতশরীরে সমস্ত পথ পরিচিহ্নিত হইতেছে।

 একজন বলয়বিক্রেতা দোকানদার গরম গরম কচুরী খাইতেছিল; তাহারি সম্মুখে, একজন রমণী—রমণীর কঙ্কাল বলিলেও হয়—যাচ্ঞার ভাবে সেইখানে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার শুষ্ক স্তনের উপর, তাহার বুকের হাড়ের উপর, সে একটি কঙ্কালসার শিশুকে জাপ্‌টাইয়া ধরিয়া আছে। না, দোকানদার তাহাকে কিছুই দিল না; এমন কি, তাহার দিকে একবার চাহিয়াও দেখিল না। সেই মৃতকল্প শিশুর শুষ্কস্তনা জননী একেবারে যেন পাগলের মত হইল। সে দাঁত বাহির করিয়া নেক্‌ড়ে বাঘের মত দীর্ঘস্বরে একটা চীৎকার করিয়া উঠিল। রমণী যুবতী,—বোধ হয় এক সময়ে দেখিতেও সুশ্রী ছিল। তাহার দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট কপোলদেশে এখনো যৌবনের চিহ্ন দেদীপ্যমান। বোধ হয় ১৬বৎসর বয়স; প্রায় বালিকা বলিলেই হয়।…অবশেষে সে বুঝিতে পারিল, কেহই তাহার প্রতি দয়া করিবে না; সে পরিত্যাক্তা অনাথা। কোন বন্যপশু শক্রকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া পলাইবার পথ না দেখিয়া নিরুপায় হইয়া যেরূপ চীৎকার করিতে থাকে সেইরূস সে চীৎকার করিতে লাগিল। তাহার নিকট দিয়া প্রকাণ্ডকায় হস্তিগণ নিঃশব্দে ধীরপদক্ষেপে চলিয়া যাইতেছে। তাহাদের আহারের জন্য, বহুদূর হইতে, মহার্ঘ মূল্যে ডালপালা সংগ্রহ করিয়া আনা হইয়াছে।

 কাকদিগের কলরব এই সমস্ত জনকোলাহল ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। হাজার-হাজার কাক গৃহছাদের উপর বসিয়া কা-কা ধ্বনি করিতেছে। কাকদিগের এই চিরকেলে কলরব ভারতবর্ষে আর সমস্ত শব্দকে ছাড়াইয়া উঠে। আজকাল তাহাদের ডাকের আরো বৃদ্ধি হইয়াছে—এখন উহা উল্লাসের সীমায় পৌঁছিয়াছে। যে সময়ে শবের পূতিগন্ধে চারিদিক্‌ আচ্ছন্ন হইয়া যায়, সেই দুর্ভিক্ষের সময়ই ইহাদের সু-কাল—প্রাচুর্যের কাল।  সে যাহই হউক, প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যানের মধ্যে রাজার কুমীরেরা এখন আহার করিবে।

 রাজার এই প্রাসাদটি একটি বৃহৎ জগৎ বলিলেই হয়। ইহার সংশ্লিষ্ট কত বিভিন্ন আবাস-গৃহ, কত অশ্বশালা, কত হস্তিশালাই যে আছে, তাহার আর অন্ত নাই। কুম্ভীরসরোবরে পৌঁছিতে হইলে, লৌহ-শলাকা-হর্ষিত কত উচ্চদ্বার পার হইতে হয়, (Louvre) লুভ্‌র-প্রাঙ্গণের মত কত বড়-বড় প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিতে হয়। এই সব প্রাঙ্গণের ধারে-ধারে, গরাদেওয়ালা গবাক্ষবিশিষ্ট ঘোরদর্শন কত-কত ইমারত রহিয়াছে। বলা বাহুল্য, উহাদের দেওয়াল গোলাপী রঙে রঞ্জিত এবং উহাতে সাদা ফুলের নক্‌সা কাটা। আজ এই অঞ্চলে খুব লোকের ভিড়। আজ এখানে লোক ডাকিয়া-ডাকিয়া আনা হইতেছে। আজ সৈনিকদিগের বেতন পাইবার দিন। তাই সমস্ত সৈন্য আজ এখানে উপস্থিত। উহাদিগকে দেখিতে একটু জংলি ধরণের, কিন্তু বেশ লম্বা-চওড়া; হস্তে বল্লম অথবা ধ্বজপতাকা। ভারী-ভারী সেকেলে-ধরণের মুদ্রা, অথবা চৌকণা তাম্রমুদ্রা উহাদিগকে দেওয়া হইতেছে।

 থাম-ওয়ালা, খোদাই-করা ছোট-ছোট খিলানবিশিষ্ট মার্ব্বেলের একটা দালানঘরে, একটা প্রকাণ্ড ফ্রেমের উপর বেগ্‌নি-মখ্‌মলের একটা কাপড়ের টান রহিয়াছে—দশজন কারিকর তাহার উপর “তোলাকাজের’’ (raised work) সোনালি জরির ফুল বুনিতেছে। রাজার একটি প্রিয় হাতীর জন্য নূতন পোষাক তৈয়ারী হইতেছে।

 কঠিনশ্রমসহকৃত জলসেকের প্রভাবে উদ্যানগুলা এখনো সবুজ রহিয়াছে। এই তাপদগ্ধ শুষ্কপ্রদেশের মধ্যে এই মরুকাননগুলি দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। এই উদ্যানগুলি উপবনের ন্যায় বিশাল; এবং উহাদের মধ্যে একপ্রকার বিষাদময় শোভা পরিলক্ষিত হয়। উহা ৫০ ফিট উচ্চ দস্তুর প্রাচীরদ্বারা বেষ্টিত। উহাদের পথগুলি প্রাচীন-ধরণের;— সোজা-সোজা ও মার্ব্বেল দিয়া বাঁধানো;—ঝাউ, তাল, গোলাপ ও নারাঙ্গিকুঞ্জে বিভূষিত। নারাঙ্গিফুলের গন্ধে চারিদিক্‌ আমোদিত। ছায়ায় বসিয়া বিশ্রাম করিবার জন্য সর্ব্বত্রই মার্ব্বেল-পাথরের আরামকেদারা। নর্ত্তকীদের জন্য স্থানে-স্থানে চতুষ্ক-মণ্ডপ এবং রাজকুমারদিগের স্নানের জন্য মার্ব্বেলে বাঁধানো চৌবাচ্ছা। এখানে ময়ুর আছে, বানর আছে; এমন কি, নারাঙ্গিগাছের তলায়, শিকারে বহির্গত ছুঁচাল-মুখ তস্করবৃত্তি শৃগালদিগকেও দেখিতে পাওয়া যায়।

 অবশেষে সেই বৃহৎ সবোবর! ইহাও ভীষণ প্রাচীরে আবদ্ধ। দুইতিনবৎসরব্যাপী অনাবৃষ্টির ফলে ইহার প্রায় অর্দ্ধেক জল শুকাইয়া গিয়াছে। ইহার পাঁকের উপর শতবর্ষজীবিত গণ্ডশৈলপ্রায় প্রকাণ্ডপ্রকাণ্ড কুম্ভীর নিদ্রা যাইতেছে। এই সময়ে শুক্নবস্ত্রধারী একজন বৃদ্ধ ঘাটের সিঁড়ির উপর আসিয়া, মস্‌জিদের মুয়েজ্জিনের মত সুস্পষ্টস্বরে টানাসুরে কি-একটা ক্রমাগত আবৃত্তি করিতে লাগিল;—নানাপ্রকারবাহুভঙ্গি-সহকারে কুমীরদিগকে ডাকিতে লাগিল। তখন কুমীরেরা জাগিয়া উঠিল। প্রথমে ধীরে ধীরে ও অলসভাবে,—ক্ষণপরেই—ক্ষিপ্রভাবে-চটুলভাবে সাঁতার দিয়া নিকটে আসিল। তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে বড়-বড় কচ্ছপও আসিল। তাহারাও ডাক শুনিয়াছে। তাহারাও খাইতে চায়। যেখানে সেই বৃদ্ধ এবং দুইজন ভৃত্য মাংসের ঝুড়ি হস্তে দাঁড়াইয়া ছিল, সেই সোপানপংক্তির নীচে আসিয়া উহারা চক্রাকারে সমবেত হইল এবং সীসাবর্ণ শ্লেষ্ম-চট্‌চটে মুখ ব্যাদান করিয়া ঐ সব মাংস গিলিবার জন্য প্রস্তুত হইল; তখন উহাদের মুখের মধ্যে ছাগলের পাঁজরা, ভেড়ার পা, ফুসফুস, অস্ত্রাদি নিক্ষিপ্ত হইল।

 কিন্তু বাহিরের রাস্তায়, সেই সব ক্ষুধিত মনুষ্যদিগকে খাওয়াইবার জন্য মুয়েজ্জিনের কণ্ঠস্বরে কেহই তাহাদিগকে ডাকিতেছে না। সেই নবাগত ভিক্ষুকেরা এখনো ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; কেহ তাহাদের পানে চাহিয়া দেখিলে তখনি হাত বাড়াইয়া দিতেছে,—পেট চাপ্‌ড়াইতেছে। যাহারা ভিক্ষা চাহিয়া-চাহিয়া একেবারে হতাশ হইয়াছে, তাহারা জনতার মধ্যে—অশ্বগণের মধ্যে, ভূতলে শুইয়া পড়িয়াছে। প্রাসাদমন্দিরাদির দুইটি বীথি যেখানে মিলিত হইয়াছে, সেইখানকার একটি চত্বর-ভূমিতে,—যেখানে দোকানদার, ঘোড়সওয়ার, মল্‌মল্‌বস্ত্রাবৃত অলঙ্কারভূষিত রমণী প্রভৃতির বহুল জনতা,—সেইখানে একজন বিদেশী, একজন ফরাসী,—শীর্ণকায় বীভৎসদর্শন চলৎশক্তিরহিত একগাদা ভিক্ষুকের নিকট আসিয়া তাহার গাড়ি থামাইল এবং নতকায় হইয়া তাহাদের স্পন্দহীন নিশ্চেষ্ট হস্তে কতকগুলা মুদ্রা অর্পণ করিল। তখন হঠাৎ একদল “মমি”-শব যেন পুনর্জ্জীবিত হইয়া উঠিল; মলিন চীরবস্ত্রের মধ্য হইতে মাথা তুলিল; চোখ মেলিয়া দেখিতে লাগিল। পরে সেই কঙ্কালমূর্ত্তিগুলা খাড়া হইয়া দাঁড়াইল। “ওরে! কে একজন আসিয়া ভিক্ষা দিচ্চে, পয়সা দিচ্চে; এইবার তবে খাদ্য-সামগ্রী কিন্‌তে পারা যাবে।” যে-সব ভিক্ষুকের গাদা,—আর-একটু দূরে—পথ-চল্‌তি লোকের পিছনে, কাপড়ের বস্তার পিছনে, অথবা মিঠাইওয়ালার উনানের পিছনে প্রচ্ছন্ন ছিল, ক্রমশ তাদের মধ্যেও এই পুনর্জাগৃতি সংক্রামিত হইল। সেই সব গাদা নড়িয়া উঠিল, উঠিয়া দাঁড়াইল, অগ্রসর হইতে লাগিল। যাহাদের চোপসানো ঠোঁটের মধ্য হইতে দাঁত বাহির হইয়া পড়িয়াছে, যাহাদের মাছি-লাগা চোখ কোটরে ঢুকিয়া গিয়াছে, কণ্ঠনালীর অস্থিবলয়ের উপর যাহাদের স্তনগুল খালী থলের মত ঝুলিয়া পড়িয়াছে,—সেই সব শ্মশান-প্রেতেরা সেই বিদেশী ফরাসীকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল;—তাহার দিকে ঠেলিয়া আসিতে লাগিল; পক্ষান্তরে তাহাদের দীননেত্র যেন মার্জ্জনাভিক্ষা করিতে লাগিল, আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিল, কাকুতিমিনতি করিতে লাগিল।…

 তাহার পর নিস্তব্ধভাবে সকলে সরিয়া পড়িল,—কোথায় যেন মিলাইয়া গেল। ঐ প্রেতগণের মধ্যে একজনের পা দৌর্ব্বল্য-প্রযুক্ত টলিতেছিল; সে আর-একজনের কাঁধে ভর দিল;—এইরূপ পরস্পরের ঠেলা ও চাপে,—পুতুলনাচের পুতুলগুলার মত, একতাড়া পাকাটির মত, সবাই একসঙ্গে ভূতলে পড়িয়া গেল। কাহারও এতটুকু শক্তি নাই যে, সেই ঠেলা সাম্‌লাইয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে, উহারা মাটিতে পড়িয়া ধূলায় লুটাইতে লাগিল, মূর্চ্ছিত হইল, আর উঠিতে পারিল না।…

 এই সময়ে একটা বাদ্যের রোল ক্রমশ নিকটবর্ত্তী হইল। আবার জনতার গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল। কাল দেবালয়ে উৎসব হইবে—ইহাই ঘোষণা করিবার জন্য মন্দিরের কতকগুলি লোক রাস্তায় সমারোহে বাহির হইয়াছে। এই সময়ে, পথ করিবার জন্য, একজন রক্ষিপুরুষ ক্ষুধাক্লিষ্টা একটি বৃদ্ধাকে ধরিল। এই বৃদ্ধা ধূলিতে মুখ গুঁজিয়া, দুই হাত সটান্ ছড়াইয়া, পুলিস-নির্দ্দিষ্ট লাইন্ ছাড়াইয়া, যাত্রাপথের উপর পড়িয়া ছিল। রক্ষিপুরুষ সেই কম্পিতকায় বৃদ্ধাকে উঠাইয়া-লইয়া পদপথের উপর রাখিয়া দিল।

 এই সুন্দর সমারোহের ঠাট্‌ আবার চলিতে আরম্ভ করিল। প্রথমে একটা কালো হাতী যাত্রা শুরু করিল। ইহার শুণ্ড শেষপ্রান্ত পর্য্যন্ত স্বর্ণবর্ণে রঞ্জিত। শানাই ও কর্ত্তাল বাজাইতে বাজাইতে বাদকেরা সকলের পিছনে চলিয়াছে। শানাইয়ে একটা বিষাদগম্ভীর সুর আলাপ করিতেছিল।

 পরে, উচ্চ মুক্তার মুকুটে সুশোভিত হইয়া, দেবসজ্জায় সজ্জিত একদল বালককে পৃষ্ঠে লইয়া, চারিটা ধূসরবর্ণ হস্তী অগ্রসর হইল। গজারূঢ় সুসজ্জিত বালকেরা, রঙিন সুগন্ধি চূর্ণরাশি জনতার উপর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। এই চূর্ণ এত পাতলা ও লঘু যে, উহা জলদজাল বলিয়া মনে হয়। প্রথমেই এই চুর্ণ নিজ্‌ হাতীদের উপর নিপতিত হইল। এই সব হাতীদের মধ্যে কেহ বা বেগ্‌নি, কেহ বা হল্‌দে, কেহ বা সবুজ, কেহ বা লাল—এইরূপ চিত্রিত রঙে রঞ্জিত হইল। এই মোহনমূর্ত্তি বালকেরা স্মিতহাস্যসহকারে মুঠা-মুঠা চূর্ণ জনতার মধ্যে নিক্ষেপ করিতে লাগিল; লোকদের পরিচ্ছদ, পাগ্‌ড়ী, মুখ,—নানারঙে রঞ্জিত হইল। যে সকল দুর্ভিক্ষপীড়িত কঙ্কালসার ক্ষুদ্র বালকেরা ভূতলশায়ী হইয়া এই সমারোহযাত্রা দেখিতেছিল,—এমন কি—তাহাদের উপরেও এই চূর্ণমুষ্টির বর্ষণ হইতে লাগিল। তাহাদের দুর্ব্বল হস্ত ক্ষিপ্রতার সহিত আপনাদিগকে রক্ষা করিতে না পারায়, তাহাদের চক্ষু সেই চূর্ণে আচ্ছন্ন হইয়া গেল।

 সহসা দিবাবসান হইল। চতুর্দ্দিক্‌স্থ সেই শাদা ফুলের নক্সা-কাটা একঘেয়ে গোলাপী রং ক্রমে স্নান হইয়া আসিল। আকাশ Periwinkle ফুলের রং ধারণ করিল। উহা ধূলায় এরূপ আচ্ছন্ন যে, রজতরঞ্জিত চন্দ্রমাও পাংশুবর্ণ বলিয়া মনে হইতে লাগিল। ঘুমাইবার জন্য পাখীর ঝাঁক নীচে নামিয়া আসিল। গোলাপী প্রাসাদসমূহের কানাচের উপর,—পায়রা ও কাক কৃষ্ণবর্ণ দীর্ঘরজ্জুর আকারে সারিবন্দি হইয়া ঘেঁষাঘেঁষি বসিল। কিন্তু শকুনি ও চিলেরা এখনো বিলম্ব করিতেছে—এখনো গয়ংগচ্ছভাবে আকাশে ঘোরপাক দিতেছে। যে সকল মুক্ত বানর গৃহাদির উপর বাস করে, এখন নিদ্রার সময় উপস্থিত হওয়ায়, তাহারা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে;—থাবার উপর ভর দিয়া, উর্দ্ধপূচ্ছ হইয়া, পরস্পরকে অনুধাবন করিতেছে। উহাদের অপূর্ব্ব ছায়ামূর্ত্তিগুলা গৃহছাদের ধারে ধারে ছুটাছুটি করিতেছে। নীচে, বড় রাস্তা জনশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। কেন না, প্রাচ্য নগরসমূহে, রাত্রিকালে কোন কাজকর্ম্ম হয় না।

 একটা পোষ চিতাবাঘিনী শুইবার জন্য এখনি প্রাসাদে যাইবে। টুপিটা তাহার পাশে রহিয়াছে,—একটা রাস্তার কোণে বেশ ভালমানুষের মত উবু হইয়া বসিয়া আছে। তাহার পরিচারকেরাও তাহাকে ঘিরিয়া ঐরূপভাবে বসিয়া আছে। তাহাদের মধ্যে সেই পুচ্ছধারী ভৃত্যটিও আছেন। দুই-পা দূরে, একদল দুর্ভিক্ষপীড়িত বালক ভূমিতে পড়িয়া হাঁপাইতেছে; বাঘিনীর Jude-মণির মত ফিঁকা হরিদ্বর্ণ চক্ষুর প্রহেলিকাপূর্ণ দৃষ্টি তাহাদের উপর নিপতিত রহিয়াছে।

 দোকানদারেরা তাড়াতাড়ি তাহাদের বিচিত্ররঙের বস্ত্রাদি ভাঁজ করিয়া রাখিতেছে; তাহাদের ঝক্‌ঝকে তাম্রসামগ্রী—তাহাদের থালা, তাহাদের ঘটিবাটী ঝুড়ির মধ্যে উঠাইয়া রাখিতেছে। এই সমস্ত জিনিষপত্র উঠাইয়া তাহারা নিজ নিজ গৃহে চলিয়া গেল। এই সব নেত্ররঞ্জন দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে যে সকল কঙ্কালমূর্ত্তি, দল বাঁধিয়া ইতস্তত শুইয়া ছিল;—দ্রব্যসামগ্রী অপসারিত হইলে ক্রমে তাহারা একটু-একটু করিয়া নেত্রসমক্ষে প্রকাশ পাইতে লাগিল। এখানে ইহারাই এখন অবশিষ্ট;—এই পদপথের উপর এখন ইহাদেরই একাধিপত্য।

 ক্রমশ এই দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকেরা, দল ছাড়িয়া পৃথক্‌ হইয়া পড়িল। এখন চারিদিক জনশূন্য—এখন ইহাদিগকেই অধিক সংখ্যায় দেখা যাইতেছে। একটু পরেই দেখিতে পাইবে, তাহাদের মৃতশরীরে—তাহাদের মলিন চীরবস্ত্রে সমস্ত পদপথ পরিচিহ্নিত।

 নগর প্রাচীরের বাহিরে, উদাস-উজাড় ক্ষেত্রভূমির মধ্যে, এই সন্ধ্যাকালে,—প্রাণিপুঞ্জে সমস্ত মরা-গাছগুলা আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে। চিল, শকুনি, বড়-বড় জাঁকালো ময়ূর, এক একপরিবারের মত দল বাঁধিয়া গাছের উপর বিশ্রাম করিতেছে। পত্রহীন লঘু শাখাপ্রশাখার মধ্যে যেসব স্থান শূন্য ছিল, এক্ষণে উহাদের দ্বারা পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। উহাদের দিবসের ডাক অনেকটা থামিয়া আসিয়াছে; অনেকক্ষণ পরে-পরে একএকবার ডাকিয়া উঠিতেছে। একটু পরে একেবারেই নীরব হইবে। ময়ূরদের প্যান্‌পেনে ছিঁছ্‌কাঁদুনি ডাক সন্ধ্যার প্রাক্কাল পর্য্যন্ত চলিতে থাকে, তাহার পরেই শৃগালেরা শোকোচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে উহার “উতর” গাইতে আরম্ভ করে।

 রাত্রি দশটা। এ নগরের পক্ষে অনেক রাত্রি; কেন না, এখানে দিবাবসানের সঙ্গে-সঙ্গেই সমস্ত কাজকর্ম্ম বন্ধ হইয়া যায়। চতুদ্দিক্‌স্থ মাঠময়দান একেবারেই নিস্তব্ধ। দূর দিগন্তে, মনে হয়, যেন কুয়াসা হইয়াছে। উহা ধূলি বই আর কিছুই নহে। সমস্তই শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। শাদা গুঁড়ায় ঢাকা মাটির উপর, মরা-গাছের উপর, চন্দ্রালোক পতিত হইয়াছে। আবার এই অমল শুভ্রতার উপর হঠাৎ নৈশশৈত্যের আবির্ভাব হওয়ায় মনে হইতেছে যেন তুষার পড়িয়াছে, শীতঋতু আসিয়াছে, যে-সব আসন্নমৃত্যু দুর্ভিক্ষপীড়িত বালকেরা নগ্নাবস্থায় ভূতলে পড়িয়া কষ্টে শ্বাসগ্রহণ করিতেছে, না জানি, তারা এখন শীতে কতই কাতর। এখন খুবই ঠাণ্ডা পড়িয়াছে।

 বাহিরের ন্যায়, নগরপ্রাচীরের অভ্যন্তরে ও সমস্ত নিস্তব্ধ। কদাচিৎ কোথাও, দেবালয় হইতে চাপা-সঙ্গীতধ্বনি শোনা যাইতেছে। তা ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। এই সকল দেবালয়ের গজমূর্ত্তিশোভিত উচ্চ সোপান দিয়া শুক্লপরিচ্ছদধারী কতকগুলি লোক এখনো উঠা-নামা করিতেছে; তা ছাড়া একটিও প্রাণী নাই। রাস্তাঘাট সমস্তই শূন্য। লোকের চলাচল না থাকায়, এই সকল রাস্তা যেন আরো চওড়া ও বিশাল বলিয়া মনে হইতেছে। নৈশ নিস্তব্ধতার মধ্যে, এই গোলাপী নগর[১] চন্দ্রালোকেও গোলাপী দেখাইতেছে; এবং ইহার সৌধপ্রাসাদ ও প্রাসাদের দস্তুর চূড়াবলী যেন আরো বর্দ্ধিতায়তন হইয়া উঠিয়াছে।

 দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় যেখানে চাউলের বস্তা গাদা করিয়া রাখা হইয়াছে এবং যেখানে বেত্রধারী রক্ষিপুরুষেরা পাহারা দিতেছে—সেই পদপথের উপর এবং সেই বস্তাগুলার পার্শ্বে, এখনো সেই সব কালো-কালো পঙ্কালমূর্ত্তির গাদা! দূরদূরান্তরে, ছোট-ছোট পাথরের কুলুঙ্গি-ঘর যাহা দিনমানে জনতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল, তাহা এখন নেত্রসমক্ষে প্রকাশ পাইতেছে। প্রত্যেক কুলুঙ্গির মধ্যে একএকটি বিগ্রহ—গজমুণ্ডধারী ঘোরদর্শন গণেশ, কিংবা মৃত্যুর দেবতা শিব অধিষ্ঠিত। সকলেরই গলায় মালা এবং সকলেরই নিকটে একএকটা প্রদীপ জ্বলিতেছে;—এই প্রদীপ সমস্ত রাত্রি জ্বলিবে।

 এই সব ময়লা ছেঁড়া ন্যাক্‌ড়ার গাদা—যাহার কোন-একটা বিশেষ রূপ নাই, নাম নাই, যাহা অনির্দ্দেশ্য—ইহাই এই সুরম্য গোলাপী নগরের একমাত্র কলঙ্ককালিমা। মধ্যে-মধ্যে এই ন্যাক্‌ড়ার গাদা হইতে, কখন বা কাশির শব্দ, কখন বা গোঙানি-শব্দ, কখন বা নাভিশ্বাসের শব্দ শুনা যায়; আবার কখন-কখন দেখা যায়,—সেই ন্যাক্‌ড়ার গাদা হইতে কেহ বা বাহুরূপ অস্থিখণ্ড বাহির করিয়া নাড়িতেছে; কেহ বা সেই ন্যাক্‌ড়াগুলা জ্বরবিকারগ্রস্ত রোগীর ন্যায় উন্মত্তভাবে ঝাঁকাইতেছে;—গাঁট-বাহির-করা অস্থিসার পাগুলা ছুঁড়িতেছে। যাহারা এইরূপ মাটির উপর মুক্তাকাশতলে পড়িয়া আছে, তাহাদের পক্ষে, কি জ্বালাময় দিবস, কি প্রশান্ত রাত্রি, কি প্রভাময় প্রভাত—সকলি সমান। তাহাদের কোন আশাভরসা নাই। তাহাদের প্রতি কাহারও মায়া-মমতা নাই। তাহাদের ভারক্লান্ত মস্তক যেখানে একবার ঢলিয়া পড়িয়াছে, সেইখানেই পড়িয়া থাকিবে; সেই পদপথের সানের উপরই উহাদিগকে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকিতে হইবে; এবং সেই মৃত্যুতেই উহাদের সকল যন্ত্রণার অবসান হইবে।

  1. জয়পুর—অনুবাদক