ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/রাজাদিগের চাঁদ্‌নী-দরবারের ছাদ

রাজাদিগের চাঁদ্‌নী-দরবারের ছাদ।

 যে ভগ্নাবশেষরাশি আমার পদপ্রান্ত পর্য্যন্ত ক্রমশ নামিয়া আসিয়াছে, তাহার উপর সান্ধ্যগগনবিলম্বিত পাণ্ডুবর্ণ পূর্ণচন্দ্র স্বকীয় ম্লানজ্যোতি এখনো বিস্তার করিতে আরম্ভ করে নাই। একঘণ্টাকাল হইল, যদিও সূর্য্যদেব চতুর্দিক্‌স্থ শৈলমালার পশ্চাতে অস্তমিত হইয়াছেন, তথাপি এখনো তাঁহার পীতাভ আলোকে দিগন্ত আলোকিত। আমি আজ একাকী, বিভবমহিমান্বিত ও বন্যভীষণ কোন এক স্থানে,—একটা পুরাতন রাজপ্রাসাদের ছাদের উপর অবস্থিত হইয়া, রাত্রির প্রতীক্ষা করিতেছি। ইহা যেন একটা গরুড়পক্ষীর প্রকাণ্ড নীড়; পূর্ব্বে ধনরত্নে পূর্ণ ছিল; শত্রুর ভীতিজনক ও দুরধিগম্য ছিল। কিন্তু আজ ইহা শূন্য; একটা পরিত্যক্ত বৃহৎ নগরের মধ্যে অবস্থিত; কতকগুলি ভৃত্য ইহার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত।

 আমি আকাশের খুব উচ্চদেশে উঠিয়াছি। সুচারুরূপে খোদিত যে সব প্রস্তরফলক ছাদের গরাদে-বেষ্টনের কাজ করিতেছে, সেই সব প্রস্তরের উপর হইতে ঝুঁকিয়া দাঁড়াইলে দেখিতে পাওয়া যায়—নীচে সুগভীর খাত মুখব্যাদান করিয়া আছে; সেই খাতের তলদেশে,—গৃহ, মন্দির, মস্‌জিদ্‌ প্রভৃতির ভগ্নাবশেষ।

 যদিও আমি খুব উচ্চে উঠিয়াছি,—তথাপি আমার চতুর্দ্দিকে, আরো কত উচ্চতর ভূমি রহিয়াছে। যে শৈলভূমির উপর এই প্রাসাদটি অধিষ্ঠিত, উহা চক্রাকারে-পরিবেষ্টিত আর একটা উচ্চতর পর্ব্বতমালার কেন্দ্রস্থল। আমার চতুর্দ্দিকে, সরু-সরু তীক্ষ্নাগ্র লালপাথরের বড়-বড় শৈলচূড়া;—সমস্তই প্রাকারে বেষ্টিত। এই প্রাকারাবলী—উচ্চতম চূড়াপ্রান্ত পর্য্যন্ত বরাবর সমান চলিয়া গিয়াছে; এবং এই দস্তুর বপ্রের করাতী-দন্ত, পীতাভ আকাশের গায়ে, অতীব নির্দ্দয়ভাবে অঙ্কিত রহিয়াছে। এই অন্তরীক্ষের প্রাচীরটি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ডের দ্বারা গঠিত এবং এরূপ সঙ্কটস্থানের উপর স্থাপিত যে, উহা দুরধিগম্য বলিলেও হয়;—একটা চক্রের পরিধিরূপে কয়েকক্রোশ ঘিরিয়া রহিয়াছে। ইহা অতীতযুগের এমন একটি কীর্ত্তি—যাহার ঔদ্ধত্য ও প্রকাণ্ডতায় একেবারে বিস্ময়বিহ্বল হইয়া পড়িতে হয়। এই সব প্রাকারাদি এত উচ্চে উঠিয়াছে—এমন বেপরোয়াভাবে খাড়া হইয়া রহিয়াছে যে, দেখিলে মাথা ঘুরিয়া যায়। বহু পুরাকালে, এই নগরের জন্য,—নিম্নস্থ এই রাজপ্রাসাদের জন্য,—একটি অপূর্ব্ব প্রাচীর নির্ম্মাণ করা আবশ্যক বিবেচিত হইয়াছিল; তাই, এই চতুদ্দিক্‌স্থ শৈলমালাকে দুর্ভেদ্য গিরিদুর্গে পরিণত করা হয়। এই প্রাকারপরিধির মধ্যে প্রবেশ করিবার একটিমাত্র ফুকর আছে; ইহা একটা বৃহৎ প্রাকৃতিক “ফাটলের” মত; উহার মধ্য দিয়া সুদূরপ্রসারিত একটা মরুভূমি অস্ফুটভাবে পরিলক্ষিত হয়।

 এইখানে আসিবার জন্য, আমি দিবাবসানে জয়পুর হইতে ছাড়িয়াছি। যে সকল ভগ্নাবশেষ আমার চারিদিকে ঘিরিয়া আছে,—ইহাই পুরাতন রাজধানী অম্বর। দুই শতাব্দী হইল, ইহার স্থান জয়পুর অধিকার করিয়াছে।[১]

 কতকগুলি পথপ্রদর্শক সঙ্গে লইয়া—এবং “সুন্দর গোলাপীনগরের” রাজা আমার ব্যবহারের জন্য যে ঘোড়া দিয়াছেন, সেই সব ঘোড়া লইয়া আমি যাত্রা করিয়াছি। এই অম্বর-প্রাসাদে যে সব ছাদের উপর আমি এইমাত্র উঠিয়াছি—এই সব ছাদে বর্ত্তমান রাজার পূর্ব্বপুরুষেরা পূর্ব্বে বাস করিতেন। আমি জয়পুরের রমণীয় পরীদৃশ্য ও দান্তে-বর্ণিত ভীষণ নরকদৃশ্য,—এই উভয়ই এড়াইবার জন্য তাড়াতাড়ি জয়পুর হইতে বাহির হইয়া এই পল্লিপ্রদেশে আসিয়াছি। আর-কিছু না হোক্‌—অন্তত এখানে সমস্তই শেষ হইয়া গিয়াছে,—এখন শুধু মৃত্যুর নিস্তব্ধতা বিরাজ করিতেছে।

 কিন্তু আমি জানিতাম—দুর্গপ্রাকারের দ্বারদেশ পার হইবামাত্র, আমাকে আরো একটা ঘোরতর ভীষণ পথ অতিক্রম করিতে হইবে। যুদ্ধের অনেকদিন পরে, যুদ্ধক্ষেত্রের মত একটা-কোন দৃশ্য হয় ত আমাকে দেখিতে হইবে;—হয় ত দেখিতে হইবে, সূর্য‍্যাতপশুষ্ক রাশি রাশি মৃতশরীর বহুদিন হইতে ইতস্তত পড়িয়া রহিয়াছে; হয় ত দেখিব, কতকগুলা শবশরীর নিশ্বাস ফেলিতেছে,—নড়িতেছে—কখন-কখন উঠিয়া দাঁড়াইতেছে,—আমার অনুসরণ করিতেছে এবং কষ্টের আকস্মিক আবেগে প্রার্থনাচ্ছলে আমার হস্ত জাপ্‌টাইয়া ধরিতেছে।


 আমি যা ভাবিয়াছিলাম, তাই। আজ দেখিলাম, এই শ্মশানভূমে অনেকগুলি বৃদ্ধা পড়িয়া রহিয়াছে—যেন কতকগুলো অস্থি ও ন্যাক্‌ড়ার বস্তা। ইহারা কোন মাতামহী কিংবা পিতামহী—যাহাদের বংশধরেরা নিশ্চয়ই মরিয়াছে; এবং এইবার নিজেদের মরিবার পালা, এইরূপ মনে করিয়া ইহারাও অদৃষ্টের হস্তে আত্মসমর্পণ করিয়া মৃত্যুর প্রতীক্ষায় শান্তভাবে শুইয়া আছে। ইহারা কিছুই চাহে না; একটুও নড়ে-চড়ে না; কেবল ইহাদের বড় বড় উন্মীলিত নেত্রে দারুণ বিষাদ-নৈরাশ্য পরিব্যক্ত হইতেছে। উপরে, মরাগাছের ডালে বসিয়া কাকেরা ইহাদিগকে নজরে-নজরে রাখিতেছে;—আসল সময়ের প্রতীক্ষা করিতেছে।

 আজ কিন্তু অন্যদিন অপেক্ষাও অধিক-সংখ্যক শিশু দেখিলাম। আহা! এই ক্ষুদ্র শিশুগুলি,—কেন তাহারা এত কষ্ট পাইতেছে, কেন সকলে তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছে, এইরূপ ভাবিয়াই যেন বিস্মিত; এবং বিচারপ্রার্থনার ভাবে আমার দিকে যেন দীনভাবে চাহিয়া আছে!…এই ছোট ঘোট দুর্ব্বল মাথাগুলির ভার—তাহাদের শীর্ণ কঙ্কালশরীর যেন আর বহন করিতে পারিতেছে না; একএকবার আস্তে আস্তে মাথা তুলিতেছে, আবার বিশ্বস্তভাবে চক্ষু নিমীলিত করিয়া আমার হাতের উপর ঢলিয়া পড়িতেছে,—যেন আমার আশ্রয়ে নিশ্চিন্তমনে একটু ঘুমাইতে চাহে। কখন-কখন দেখা যায়, সাহায্যের কাল উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু অনেক-সময়ে ইহাও দেখিতে পাই,—হাতে পয়সা দিবামাত্র উহারা উঠিয়া দাঁড়াইতেছে এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী কিনিবার জন্য কষ্টেস্রষ্টে চাউলের দোকানে যাইতেছে।

 আশ্চর্য্য! কি সামান্য ব্যয়েই এই শিশুগুলির প্রাণরক্ষা করা যায়![২]

 এই গোলাপীরঙের সিংহদ্বারগুলি পার হইবার পরেই, সম্মুখে তিনক্রোশব্যাপী রাশিরাশি ভগ্নাবশেষ; তাহার পরেই পল্লিপ্রদেশের প্রকৃত মরুভূমি; মরা-গাছের বাগান-বাগিচার মধ্যে কত গম্বুজ, কত মন্দির, স্বচ্ছপ্রস্তরে নির্ম্মিত কত চতুষ্কমণ্ডপ একটার পর একটা চলিয়াছে, তাহার আর অন্ত নাই। বানর, কাক ও শকুনি ছাড়া এখানে আর কেহই বাস করে না। এদেশের প্রত্যেক নগরের আশপাশে এই সকল জীবের নিত্য গতিবিধি। এই সমস্ত শ্মশানভূমি, পূর্ব্ববর্ত্তী সভ্যতার ধ্বংশাবশেষে সমাচ্ছন্ন।

 বলা বাহুল্য, কর্ষিত ক্ষেত্রের চিহ্নমাত্রও আর লক্ষিত হয় না। জন প্রাণী নাই; কেবল মাছিতে গ্রামপল্লি ভরিয়া গিয়াছে।

 তাহার পর যখন গিরিমালার পাদদেশে—সেই লাল-পাথরের রাজ্যে আসিয়া পৌঁছিলাম, মনে হইল, যেন সর্ব্বত্রই জ্বলন্ত অঙ্গার। এমন কি, ছায়াময় স্থানেও, ধূলা-ভরা এমন একএকটা শুক্না দম্‌কা-বাতাস আসিতেছে যে, তাহাতে যেন মুখ একেবারে ঝল্‌সিয়া যায়।

 উদ্ভিজ্জের মধ্যে বড়-বড় cactus ছাড়া আর কিছুই নাই—সেই মরা-গাছগুলা শুধু খাড়া হইয়া রহিয়াছে;—সমস্ত শৈলখণ্ড উহাদের কণ্টকময় বৃন্তে কণ্টকিত।

 আমার দুইজন পথপ্রদর্শক পৃষ্ঠে ঢাল ও হস্তে বল্লম লইয়া অশ্বপৃষ্ঠে চলিয়াছে। বাহাদুর ও আক্‌বরের আমলে, সৈনিকদের এইরূপ সাজ ছিল।

 অপরাহ্ন পাঁচঘটিকার সময় সূর্য্যের প্রখরকিরণে আমাদের চক্ষু যেন ঝলসাইয়া গেল। অম্বরের রুদ্ধ-উপত্যকার গায়ে, যেখানে একটা সরু ফাঁক আছে, সেই ফাকঁটি অবশেষে আমাদের নেত্রগোচর হইল। একটা ভীষণ দ্বার, এই একমাত্র প্রবেশপথটিকে রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। তাহার পরেই হঠাৎ সেই প্রাচীন রাজধানীটি আমাদের নেত্রসমক্ষে উদ্ঘাটিত হইল। সান-বাঁধানো ঢালু সোপান দিয়া আমাদের ঘোড়ারা পিছ্‌লাইয়া পিছ্‌লাইয়া চলিতেলাগিল;—এইরূপে আমরা রাজাদিগের পুরাতন প্রাসাদে আরোহণ করিলাম। বেলে-পাথর ও মার্ব্বেলে গঠিত এই প্রাসাদটি শৈলরাশির উপর রাজসিংহাসনের মত সদর্পে বিরাজ করিতেছে; এবং সেখানে অধিষ্টিত হইয়া চতুর্দ্দিক্‌স্থ ধ্বংশাবশেষগুলি অবলোকন করিতেছে।

 প্রবেশ করিয়া,—উপরে উঠিতে উঠিতে, যে-ই একটা মোড় ফিরিলাম, অমনি কৃষ্ণবর্ণ ঘোরদর্শন একটি মন্দির দৃষ্টিপথে পতিত হইল;—যাহার ভূমি শোণিতধারায় কলঙ্কিত, এবং যেখান হইতে মৃতপশুর পূতিগন্ধ সর্ব্বদা নিঃসৃত হইতেছে। ইহা পুরাতন পশুবলির স্থান। মন্দিরের গর্ভদেশে, একটা কুলুঙ্গির মধ্যে, প্রচণ্ডভীষণ দুর্গা অধিষ্ঠিত; মূর্ত্তিটা অতীব ক্ষুদ্র ও অস্ফুটাবয়ব;—একটা ক্রুরকর্ম্মা রাক্ষসী, লাল ন্যাক্‌ড়ায় জড়ানো। ধ্বজস্তম্ভের ন্যায় একটা প্রকাণ্ড ঢাক তাহার পদতলে স্থাপিত। ঐখানে, বহুশতাব্দী হইতে, প্রতিদিন প্রাতে, ছাগবলি হইয়া আসিতেছে; সেই ছাগের তপ্তশোণিত একটা পিতলের গামলায় ও তাহার সশৃঙ্গ মুণ্ডটা একটা থালায় রক্ষিত হইয়া থাকে। আশ্চর্য্য! সংহারদেবতার পত্নী দুর্গারূপে এই ভীষণ কালী কিরূপে হিন্দুদেবতাদিগের মধ্যে স্থান পাইল? যে দেশে জীবহিংসা নিষিদ্ধ, সেই দেশে, কিছুদিন পূর্ব্বে এই স্থানে, রক্তপিপাসু কালীর সম্মুখে কিনা নরবলি হইত! না জানি, কোন্ পুরাকালের গর্ভ হইতে—কোন্ অমানিশার মধ্য হইতে এই কালীমূর্ত্তি নিঃসৃত হইয়াছে!…

 আমরা পথের প্রত্যেক আড্ডায় যেখানেই থামিতেছি, সেই খানেই আমাদের সম্মুখে “গজাল-মারা” পিতলের দ্বারসমূহ উদ্ঘাটিত হইতেছে। তাহার পর অশ্বপৃষ্ঠ হইতে নামিয়া পদব্রজে,—প্রাঙ্গণের মধ্য দিয়া, বাগানের মধ্য দিয়া, সিঁড়ি দিয়া—বরাবর উপরে উঠিতে লাগিলাম।

 মোটা-মোটা থামওয়ালা মার্ব্বেলের দালান; তাহাতে কত সূক্ষ্ম বিচিত্র কারুকার্য্য; উহার খিলানমণ্ডপ পূর্ব্বে ছোট ছোট কাচের টুকরা ও আয়নার টুকরায় আচ্ছাদিত ছিল; গুহাগাত্রের ন্যায় এখন সমস্ত “ছাতাপড়া” হইলেও, স্থানে-স্থানে এখনো ঝক্‌মক্‌ করিতেছে। দরজাগুলা কাঠের—গজদন্তখচিত। কতকগুলা চৌবাচ্ছা, খুব উচ্চদেশে স্থাপিত, এখন উহাতে একটু জল রহিয়াছে। অন্তঃপুরমহিলাদের জন্য শৈলগর্ভ খনন করিয়া কতকগুলা স্নানাগার নির্ম্মিত হইয়াছে; এবং সকলের মধ্যস্থলে, প্রাচীরবদ্ধ একটা “ঝোলানো”-বাগান;—তাহার সম্মুখেই কতকগুলা অন্ধকেরে ঘর সমুদ্ঘাটিত—উহাই রাজকুমারীদিগের, রাণীদিগের ও অবরুদ্ধ সমস্ত সুন্দরীদিগের অন্তঃপুর। আরো উচ্চতর ছাদে উঠিবার উদ্দেশে যখন ঐখান দিয়া চলিয়া গেলাম, তখন দেখিলাম, শতবর্ষ-বয়স্ক নারাঙ্গিবৃক্ষসমূহের সৌরভে সমস্ত স্থানটা আমোদিত। কিন্তু এখানকার বৃদ্ধ রক্ষক অতীব তীব্রভাবে বানরদিগের নামে অভিযোগ করিয়া বলিতেছিল যে, উহারাই এখানকার মালিক বলিলেই হয়; উহাদের উৎপাতে সমস্ত নেবু হস্তগত হওয়া দুষ্কর।

 আমি এখন, এই শেষপ্রান্তবর্ত্তী ছাদটির উপর বসিয়া রাত্রির প্রতীক্ষা করিতেছি। চন্দ্রালোকে রাজসভার অধিবেশনের জন্য জম্‌কালো-বারণ্ডাবেষ্টন সমন্বিত এই ছাদ রাজারা নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন। এখনি জ্যোৎস্না হইবে, আমিও জ্যোৎস্নালোকে এই স্থানটির সহিত একটু পরিচয় করিয়া লইব।

 চীল, শুকুনি, ময়ূব, ঘুঘু, তালচঞ্চু প্রভৃতি পক্ষীরা সকলেই এখন নিজনিজ নীড়ে শয়ন করিয়াছে; তাই এই পরিত্যক্ত প্রাসাদটি এখন আরো নিস্তব্ধ। উচ্চ শৈলমালার অন্তরালে সূর্য্য অনেকক্ষণ আমার নিকটে প্রচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু এইবার নিশ্চয়ই অস্তমিত হইয়াছে। কেন না নীচেকার কেল্লার একটা ময়দানে কতকগুলি মুসলমান রক্ষিপুরুষ মেক্কার দিকে মুখ করিয়া নেমাজ করিতেছে। উহারা নেমাজের এই পবিত্র সময়টি যথাকালে ঠিক জানিতে পারে।

 ঠিক এই সময়ে রক্তাপ্লুত কালীমন্দির হইতেও একটা গহন-গম্ভীর ধ্বনি নিম্নদেশ হইতে আমার নিকট আসিয়া পৌঁছিল। ব্রাহ্মণ্যিক পূজা-অর্চ্চনারও এই সময়। লোহিতবসনা রাক্ষসীদেবীর ঢাক তাহারই “গৌরচন্দ্রিমা” আরম্ভ করিয়াছে।

 প্রথম-সঙ্কেতের মত ঢাকের উপর দুই চারিবার সজোরে ঘা পড়িল; তাহার পরেই ভীষণ শব্দঘটা; পরক্ষণেই, আর্ত্তনাদী শানাই ও কাংস্যকর্ত্তাল তাহার সহিত যোগ দিল। আর একটা শঙ্খ স্বরগ্রামের দুটিমাত্র স্বর অবলম্বন করিয়া ঘোররবে অবিশ্রামে বাজিতে লাগিল।

 এই শব্দ যেন ভূগর্ভ হইতে আমার নিকট আসিয়া পৌঁছিতেছে; ক্রমেই স্ফীত হইয়া উঠিতেছে; এবং উপর্যুপরি-বিন্যস্ত অসংখ্য শূন্যগর্ভ ও শব্দযোনি দালানের মধ্য দিয়া, এই উচ্চ ছাদ পর্য্যন্ত পৌঁছিতে পৌঁছিতেই অনেকটা রূপান্তরিত হইতেছে। সহসা, উচ্চ আকাশ হইতে, প্রত্যুত্তরচ্ছলে কাঁশরঘণ্টার ধ্বনি নিঃসৃত হইল।

 এই ধ্বনি, একটি ক্ষুদ্র শিবমন্দির হইতে যেন পূর্ণপক্ষভরে এই দিকে উড়িয়া আসিতেছে। আমার চতুর্দ্দিকে যে সকল উদগ্র শৈলচূড়া রহিয়াছে, তাহারি একটার উপরে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত।

 যাহার দন্তুর চূড়াবলী কালো চিরুণীর দাঁতের মত পীতাভ ম্লান অম্বরে পরিস্ফুটরূরে অঙ্কিত—সেই গগনচুম্বী প্রাকারের গায়ে এই মন্দিরটি ঠেস্‌ দিয়া রহিয়াছে।

 এই সকল ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এতটা শব্দকোলাহল আমি প্রত্যাশা করি নাই। কিন্তু ভারতবর্ষে, নগরাদি যতই জনপরিত্যক্ত হউক না,—মন্দিরাদি যতই ভগ্নদশাপন্ন হউক না, পূজা-অনুষ্ঠানের কোথাও গতিরোধ হয় না; দেবসেবা বরাবরই সমান চলিতে থাকে।

 কয়েক মিনিট ধরিয়া, কাঁশর-ঘণ্টা মুখরিত সেই ক্ষুদ্র মন্দিরটির দিকে আমি মাথা তুলিয়াছিলাম; তাহার পর যে-ই ভূতলের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম, অম্‌নি আমার নিজের ছায়া দেখিয়াই চমকিত হইলাম,—ছায়াটি বেশ পরিস্ফুট ও সহসা-অঙ্কিত। সহজবুদ্ধিতে প্রথমে আমার এইরূপ মনে হইল, বুঝি কেহ আমার পিছনে কোন এক অপূর্ব্ব আলোকের দীপ ধরিয়াছে—কিংবা হয় ত কেহ বৈদ্যুতিক দীপের শুভ্ররশ্মি আমার উপর প্রক্ষেপ করিয়াছে;—কিন্তু আসলে তাহা নহে। যাহার কথা আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম, সেই গোলাকার পূর্ণচন্দ্র—সেই রাজদরবারের চন্দ্রমা, ইহারি মধ্যে স্বপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া স্বকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছেন;—এতই সহসা এদেশে দিবাবসান হয়। অন্য স্থাবরপদার্থেরও সুপরিস্ফুট ছায়া সর্ব্বত্র পতিত হইয়াছে;—মধ্যে-মধ্যে ছায়া আলোকের দ্বন্দ্ব চলিতেছে। চান্দ্র-দরবারের ছাদের উপর চন্দ্রমা স্বকীয় শুভ্রমহিমায় বিরাজ করিতেছেন।

 উক্ত উৎকট বর্ব্বর বাদ্যধ্বনি থামিয়া গেলে আমি নীচে নামিব; এই সময়ে, কত খাড়া সিঁড়ি দিয়া, কত সরু বারণ্ডা-পথ দিয়া, কত দালানের মধ্য দিয়া একাকী এই রাত্রিকালে আমায় নামিতে হইবে;—আর রাত্রিকালে এই প্রাসাদটি বানর ও অপচ্ছায়াদিগেরই আশ্রয়স্থান। তাই, ওই বাদ্যধ্বনি না থামিলে আমার চলিতে সাহস হইতেছে না।

 বড়ই বিলম্ব হইতেছে,—বড়ই বিলম্ব হইতেছে। এই সময়ের মধ্যে আকাশে সমস্ত তারাই ফুটিয়া উঠিল।

 এই স্থানটি যেমন একদিকে রাজমহিমায় মহিমান্বিত—তেমনি আবার নিভৃত-নিরালয়। যে রাজারা এই চাঁদনী-দরবারের কল্পনা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের কল্পনার দৌড় না জানি কতটা ছিল!

 যাহা হউক, অর্দ্ধঘণ্টার পরে, ঢাকের বাদ্য ও পবিত্র পঙ্খের নিনাদ একটু প্রশমিত হইল। শঙ্খনাদের টানটা এখনো চলিয়াছে—তবে, একটু মৃদুভাবে; মধ্যে-মধ্যে আবার যেন প্রাণপণে ধ্বনিত হইতেছে;— তবে এখন একটু রহিয়া-রহিয়া। এইবার যেন শব্দটার মরণযন্ত্রণা উপস্থিত,—এইবার মরিল;—সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হওয়াতেই যেন মরিল। আবার সব নিস্তব্ধ। সকলের তলদেশ,—উপত্যকার গভীর অন্তস্তল—অম্বরের ধ্বংসাবশেষে সমাচ্ছন্ন। সেইখান হইতে শৃগালের শোকবিষন্ন তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর আবার শুনা যাইতে লাগিল।

 আবার যখন আমি নীচে নাবিতে লাগিলাম, তখন সিঁড়ির মধ্যে—প্রাসাদের নিম্নস্থ দালানগুলার মধ্যে, তেমন অন্ধকার আর নাই। সে সমস্তই চন্দ্রমার শুভ্রকিরণে—নীলাভ কিরণে—অনুবিদ্ধ হইয়াছে; দন্তাকৃতি ছোট ছোট জান্‌লার ফাঁক দিয়া রজতকিরণ প্রবেশ করিয়া, গবাক্ষের সুন্দর গঠনরেখা হর্ম্ম্যতলের সানের উপর অঙ্কিত করিয়াছি; অথবা, প্রাচীরের প্রস্তরফলকের উপর বিলুপ্ত খচিত-কাজগুণিকে (mosaic) আবার যেন ফুটাইয়া তুলিয়াছে; মনে হয়, যেন সমস্ত দেওয়ালের গায়ে রত্নবাজি কাথবা সলিলবিন্দু বিকীর্ণ। যখন আমি কুসুমসৌরভাভিসিক্ত উদ্যানের মধ্য দিয়া চলিতে লাগিলাম, নারাঙ্গিনেবুব উচ্চতম শাখাগুলির হেলন-দোলনে ও মর্ম্মরশব্দে কপিবৃন্দ চকিত চঞ্চল হইয়া উঠিল।

 নীচে, প্রথম-দ্বারগুলির সম্মুখে,—যেখানে ছাদের স্বল্প শৈত্যের পরেই বায়ু যেন আবার হঠাৎ গরম হইয়া উঠিয়াছে - সেইখানে বল্লমহস্তে অশ্বপৃষ্ঠের উপর আমার পথ প্রদর্শকেরা আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। এই নৈশশান্তির মধ্যে ঘোড় সওয়ার হইয়া শান্তভাবে আবার আমরা জয়পুর অভিমুখে ফিরিলাম। কাল প্রভাতে নিশ্চিতই জয়পুর হইতে প্রস্থান করিব মনে করিয়াছি।

 এখান হইতে দেড়শতক্রোশ দূরে, বিকানায়াবে যাইব মনে করিয়াছিলাম; কিন্তু সে সঙ্কল্প ত্যাগ করিয়াছি। শুনিলাম, সেখানে দুর্ভিক্ষের ভীষণতা চূড়ান্তসীমায় উঠিয়াছে; রাস্তাঘাট সমস্তই মৃতদেহে আচ্ছন্ন। না, এ ভীষণ দৃশ্য আমার যথেষ্ট দেখা হইয়াছে; আর দেখিতে ইচ্ছা নাই। এখন আমি সেই সব প্রদেশের অভিমুখে যাত্রা করিব, যেখানে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ ততটা নাই; অথবা বঙ্গোপসাগরের সমীপবর্ত্তী সেই সব প্রদেশে যাইব, যেখানে এখনো লোকের প্রাণরক্ষা হইতেছে।

  1. ১৭২৮ খৃষ্টাব্দে জয়পুর স্থাপিত হয়।
  2. একজন ভারতবাসীর মিতভোজনের দৈনিক ব্যয় প্রায় দুই-আনা মাত্র!