ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/দেবালয়
দেবালয়।
ভারতে, দেবালয়ের খিলান-মণ্ডপ নিম্ন, সমাধিমন্দিরের ছাদের ন্যায় গুরুভার ও ভারাবনত; এইজন্য দেবালয়ের মধ্যে, প্রায় সময়ের পূর্ব্বেই সন্ধ্যার আবির্ভাব হয়।
অস্তমান সূর্যের আলো এখনও রহিয়াছে; কিন্তু ইহারই মধ্যে মাদুরার বৃহৎ রন্দিরের প্রবেশপথের-প্রস্তরময় খিলান-পথের দুই ধারে ছোট ছোট দীপ জ্বালান হইয়াছে। ইহা মন্দিরের একপ্রকার প্রবেশ-দালান; এইখানে ফুলের মালা বিক্রী হয়। কুলঙ্গী প্রভৃতি মন্দিরের সমস্ত খোঁজখাঁজের মধ্যে, খিলান-পথের দুইধারে যে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মূর্তি রহিয়াছে তাহাদের ফাঁকের মধ্যে মাল্যবিক্রেতারা তাহাদের দোকান বসাইয়াছে। আমার ন্যায় কোন লোক বাহির হইতে আসিলেই একটা ছায়া পড়িয়া, সমস্তই যেন একসঙ্গে মিশিয়া যায়;—পুতুলগুলা, বিকট মূর্ত্তিগুলা, মনুষ্যমূর্তি, বড় বড় প্রস্তর-মূর্তি, সেই সব বহুবাহুবিশিষ্ট মূর্ত্তি—যাহাদের অঙ্গভঙ্গী প্রভৃতি দ্বিবাহু বিশিষ্ট মানুষেরই মত—সমস্তই মিশিয়া যায়। সেখানে ‘ধর্ম্মের গরুরা’ও রহিয়াছে, উহারা সমস্ত দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়ায় এবং ঘুমাইবার জন্য মন্দিরে প্রবেশ করিবার পূর্ব্বে, খাড়া ও ফুল ধীরে অন্থে চর্বণ করে। এই খিলান-পথের পরেই একটা দ্বার; দেবমূর্ত্তিময় অভ্রভেদী মন্দির'চূড়ার তলদেশে, একটা অন্ধকেরে সুড়ঙ্গ-কাটা পথ। এই পথ দিয়া একেবারেই মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করা যায়; মন্দির না বলিয়া ইহাকে একটা নগর বলিলেও চলে; এই নিস্তব্ধ অথচ শব্দায়মান নগরটি পথে-পথে একেবারে আচ্ছন্ন—পথগুলা আড়াআড়িভাবে প্রসারিত; এবং ইহার অসংখ্য লোক সমস্তই প্রস্তরময়। প্রত্যেক স্তম্ভ, প্রত্যেক বিরাটাকৃতি পিপা এক-একটা অখণ্ড প্রস্তরে নির্মিত; কি উপায়ে যে উহাদিগকে খাড়া করিয়া তুলিয়াছে তাহা আমাদের বুদ্ধির অগম্য,—(অবশ্য লক্ষ লক্ষ বাহু-পেশীর সমবেত চেষ্টায়) তাহার পর, বিবিধ দেবতা ও দানবের মূর্তি খুদিয়া-খুদিয়া বাহির করা হইয়াছে। এই খিলান মণ্ডপগুলি প্রায়ই সমতল; প্রথম দৃষ্টিতে বুঝিতে পারা যায় না কেমন করিয়া উহারা ভারসাম্য রক্ষা করিয়া স্থিরভাবে দণ্ডায়মান আছে। এই খিলানমণ্ডপগুলি ৮১০ গজ লম্বা অখণ্ড প্রস্তরে নির্মিত, এবং দুই প্রান্তে ভর দিয়া রহিয়াছে, আমাদের সাদাসিধা কাঠফলকের মত এইরূপ কত অসংখ্য প্রস্তরখণ্ড পাশাপাশি অবস্থিত। এই সমস্ত,পুরাতন মিসরের ‘থেব’ ও ‘সেমৃফিস নগরের ধরণে নির্মিত; কালের দ্বারা বিনষ্ট হইবার নহে উহারা প্রায় অনন্তকালস্থায়ী। “শ্রী-রাগম"-মন্দিরের ন্যায়, এখানেও, আকাশে সতেজে পা ছুঁড়িতেছে এইরূপ অশ্বের মুর্তি কিংবা দেবতাদের মূর্তি সারি সারি রহিয়াছে এবং সুদূর আঁধারে ক্রমশ মিশিয়া গিয়াছে। এই সকল মুর্তির কৃষ্ণবর্ণ মসৃণ তলদেশ—যেখানে মানুষের হাত কিংবা শরীর পৌঁছায়—তাহা মনুষ্য ও পশুর দৈনিক গাত্র ঘর্ষণে ক্ষয় হইয়া গিয়াছে— এবং শুধু ইহাতেই উহাদের প্রাচীনত্ব সূচিত হয়। একদিকে বিরাট মহিমা, অপরদিকে গোময়-রাশি; একদিকে ইন্দ্রপুরীর বিলাস-বিভব, অপর দিকে বর্বরোচিত অযত্ন তাচ্ছিল্য। খাড়ার ও কাটা-কদলীপত্রের মালা—যাহা পূর্ব্বে কোন উৎসবের সময়ে টাঙ্গান হইয়াছিল, তাহা গুড়া গুড়া হইয়া মাটিতে পড়িতেছে ও পচিয়া উঠিতেছে। বিচিত্র কাল্পনিক জীবজন্তু; কাগজ ও ময়দাপিণ্ডে নির্ম্মিত সজীব হাতীর প্রমাণ সাদা হস্তি-মূর্তি —সমস্তই কোণে কোণে পচিতেছে। ধর্ম্মের গাভীগণ, ও যে সব জীবন্ত হাতী কুটিমতলে মুক্তভাবে বিচরণ করে, উহারা সর্ব্বত্রই তাহাদের বিষ্ঠা ছড়াইয়াছে—নগ্নপদের ঘর্ষণে মসৃণীকৃত চক্চকে তৈলাক্ত মেজের উপরেও ছড়াইয়াছে। বড় বড় বাদুড় চামচিকা এই ভীষণ খিলান-মণ্ডপে বংশবৃদ্ধি করিতেছে; উহারা, নৌকার পালের মত, বড়-বড় কালো ডানাগুলা সর্ব্বত্রই নাড়া দিতেছে কিন্তু তাহার শব্দ শোনা যায় না—পালকের ডানা হইলে বোধ হয় খুব শব্দ হইত।••••••
অভ্যন্তরস্থ একটা মুক্তাকাশ অঙ্গনের মধ্যে সন্ধ্যার আলো আবার আমি মুহূর্তকাল দেখিতে পাইলাম। সেখানে আর কেহই নাই, কেবল কতকগুলা ময়ূর, প্রস্তরময় পশুমূক্তির উপর বসিয়া বোরা-ফেরা করিতেছে। প্রাচীর-ঘেরের উর্দে, ন্যূনাধিক দূরে, কতকগুলা লাল ও সবুজ মন্দির-চূড়া মাথা তুলিয়া রহিয়াছে। এই দেবমূর্তিময় চূড়াগুলি চিরবিস্ময়জনক। এই চূড়ার গায়ে, রাশীকৃত দেবতাদের মাঝামাঝি একস্থানে, চাতক ও টিয়ার নীড় ঝুলিতেছে এবং সেই সব নীড়ের চতুষ্পার্শে পাখীগুলা নড়া-চড়া করিতেছে এবং যেখানে শূল-মুখের ন্যায় কতকগুলা গোঢ় উঠিয়াছে এবং যাহা এখনো সূর্যকিরণে আলোকিক,—সেই উদ্ধতম চূড়াদেশের খুব নিকটে কাকেরা চীলদিগের সহিত উন্মতভাবে ঘোর-পাক্ দিতেছে।
এই অঙ্গন ছাড়াইয়া, মন্দিরের আর একটি গভীরতর অংশে, আমি পুরোহিতকে অবশেষে দেখিতে পাইলাম। পূর্ব্বেই তাহার নিকট আমার সম্বন্ধে অনুবোধ-পত্র পাঠান হইয়াছিল; দেবীর বেশভূষা তিনিই আমাকে দেখাইবেন, এইরূপ কথা আছে।
বোধহয় কাল আমি সে-সব বেশভূষা দেখিতে পাইব না, কেননা কাল একটা উৎসবের দিন। শ্রীরাগমের বিষ্ণু যেমন প্রতিবৎসর রথে করিয়া তাহার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন, মাদুরার শিব পাৰ্বতীও সেইরূপ প্রতি বৎসর, তাহাদের জন্য খনিত একটা বৃহৎ জলাশয়ের চতুর্দিকে নৌকা করিয়া পরিভ্রমণ করেন। সেই নৌযাত্রার পূর্ব্বদিনে আমরা এখানে আসিয়াছি।
কিন্তু পরশ প্রত্যুষে, যখনই মন্দিরের মধ্যে একটু আলো দেখা দিবে, পুরোহিত সেই গুপ্ত কক্ষের দ্বার আমার নিকট উদ্ঘাটিত করিবেন এবং আমাকে দেবীর বত্নভাণ্ডার প্রদর্শন করিবেন।