ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/দয়াশীল নর্ত্তকী—বালামণি
দয়াশীল নর্ত্তকী-বালামণি।
মাদুরা নগরে একটি নর্তকী আছে,—সে যেমন রূপলাবণ্যের জন্য সেইরূপ বদান্যতার জন্যও প্রখ্যাত। এই শ্রেণীর রমণীদিগের চিরপ্রথা- অনুসারে, বালামণি প্রথমে একজন নবাবের রক্ষিত ছিল। নবাব মৃত্যুকালে, তাহার সমস্ত হীরা জহরৎ তাহাকে দিয়া যান। তাই পুত্তলীর ন্যায় তাহার সর্ব্বাঙ্গ মণিরত্নে বিভূষিত। এখন সে প্রভূত ঐশ্বর্যের অধিকারিণী ও স্বাধীন। কিন্তু তাহার ধন ঐশ্বর্য্য শিল্পকলার অনুশীলনে ও দানধর্ম্মেই ব্যয়িত হইয়া থাকে। বালামণি একটা নাট্যশালা স্থাপন করিয়াছে;আমাদের সহস্র সহস্র বৎসর পূর্ব্বে, ভারতে যে সব নাটক রচিত হয়, সেই নাটকগুলি, নিজ মনোহর অভিনয়ের দ্বারা পুনর্জীবিত করিয়া তুলিয়াছে।
আমি আজ রাত্রে, সমুজ্জ্বল জ্যোত্মালোকে, তালীবনের মধ্য দিয়া,সেই দয়াশীলা নর্তকী বালামণির নাট্যালয়-অভিমুখে যাত্রা করিলাম। তাল-তরুর শাখাগুলি, সুদীর্ঘ ভঙ্গুর বেতসের ন্যায় অবনত হইয়া আছে, এবং সেই শাখা প্রান্তবর্তী কৃষ্ণকায় পত্রপুঞ্জ, মৃদুল অনিলে সঞ্চালিত হইয়া, পরস্পরের সহিত সংঘর্ষিত হইতেছে।
আমি যখন আমার নির্দিষ্ট স্থানে উপনীত হইলাম, তখন বালামণি রঙ্গপীঠে অধিষ্ঠিত;—চিত্রিত পুষ্পোদ্যানের পশ্চাদ্ভাগে, পরী-প্রাসাদের ক্ষুদ্র একটি স্বর্ণময় চূড়াগৃহের মধ্যে বন্দিভাবে অবস্থিত হইয়া, গবাক্ষর সম্মুখে বসিয়া, বীণা বাজাইতে বাজাইতে গান গাহিতেছিল। বালামণি একজন রাজকুমারী, পার্শ্ববর্তী রাজ্যের কোনও রাজার সহিত তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হয়, এবং সেই রাজা তাহার উদ্দেশে এখনই আসিয়া উপস্থিত হইবে। প্রথম আরম্ভ হইতেই, তাহার বীণা-বাদনে, তাহার কণ্ঠস্বরে, শোতৃবর্গের চিত্ত বিমোহিত। পুরাতন উৎকীর্ণ চিত্রাদি হইতে তাহার সাজসজ্জা অনুকৃত হইয়াছে। তাহার পাশ্বমুখের ছায়া-ছবিটি অপূর্ব্ব সুন্দর। এই গায়িকার প্রত্যেক অঙ্গভঙ্গিতে, তাহার ভূষণ-সমাচ্ছন্ন অঙ্গের হীরক মাণিক্যগুলি ঝিক্ মিক্ করিয়া জ্বলিতেছে।
অন্য নাট্য সজ্জাগুলিতে, এমন একটি অবোধ শিশুসুলভ সারল্য, প্রকটিত যে, দেখিলে একটু আমোদ বোধ হয়; এবং সেই সঙ্গে, বিদেশ ভূমির ভাব, দূরত্বের ভাব, মানস-পটে অঙ্কিত হয়। নাট্যশালাটি অতীব বিশাল; উহাতে সহস্রাধিক লোক ধরিতে পারে; কিন্তু উহার গঠনে কোন প্রকার মার্জিতরুচির পরিচয় পাওয়া যায় না;—মন্দিরের ধারে, ধর্ম্মমহোৎসবের সময়ে যেরূপ গৃহ এখানে সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়, সেইরূপ কাঠ দৰ্মা বাঁশ দিয়া হালকা ধরণে নির্মিত। রঙ্গপীঠের দুই পার্শ্বে, পুরাতন রাজবংশীয় রাজকুমারীদিগের বসিবার কক্ষ। কিন্তু, আজ তাঁহার আসিবেন না, আজ তাঁহাদের “আসিবার দিন” নহে। আর সর্ব্বত্রই, নাট্যশালার সমস্ত আসনগুলিই প্রেক্ষকমণ্ডলীর দ্বারা অলঙ্কৃত। ঘরের ভিতরটা খুব গরম, এবং ফুলের গন্ধে আমোদিত।
সেই লুপ্ত ভাষা—যে ভাষা হিন্দু ইউরোপীয় ভাষাসমূহের মাতৃস্থানীয়া, —সেই সংস্কৃত ভাষায় বালামণি গান গাহিতেছে, এবং সেই ঘোর পুরাকালে নাটকটি যে ভাবে লিথিত হইয়াছিল, ঠিক সেই ভাবে সমস্তটা অভিনীত হইবে; শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে, আমি ছাড়া আর সকলেরই এতটুকু পাণ্ডিত্য আছে যে, উহা শুনিয়া বুঝিতে পারে।
আখ্যানবস্তুটি মোটামুটি এইরূপ; আজ রাত্রে, বালামণি যাহার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছে, সেই রাজকুমারীকে, সাত জন রাজকুমার -সকলেই সহোদর ভাতা—এক সঙ্গে ভালবাসে। পাছে কোন ভ্রাতার মনে কষ্ট হয়, এই জন্য তাহারা সকলেই প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, কেহই উহাকে বিবাহ করিবে না; এমন কি, তাহাদের পিতা, যে ভ্রাতার জন্য এই বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করিয়াছেন, সেও উহাকে বিবাহ করিবে না, এইরূপ শপথ করিয়াছে। প্রথম প্রথম, তাহারা সকলেই সুখ স্বচ্ছন্দে কাল যাপন করিতেছিল, রাজকুমারীর বন্ধুত্বে ও তাহার স্মিতহাস্যেই তাহারা সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু একদিন যখন তাহারা মৃগয়ার্থ কোন বনে গমন করে, কতকগুলা দুরাত্মা দৈত্য, শুদ্ধসত্ব শুভ্রকেশ মুনির রূপ ধারণ করিয়া তাহাদিগকে ছলিতে আসিল। তাহাদের প্রত্যেকের মনে কামজ লালসা উদ্বোধিত করিয়া দিয়া, এবং নানা প্রকার মিথ্যা কথা রটনা করিয়া, পরস্পরের বিরুদ্ধে পরস্পরকে উত্তেজিত করিয়া দিল। তখনই বিদ্বেষবুদ্ধি ও দুর্ভাগ্য প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু কোনও দুষ্কর্ম আচরিত হইবার পূৰ্বেই, দেবযোনিরা এ দিকে অনেক যুঝাযুঝির পর, তাহাদের মনকে আবার অধিকার করিল। তখন আবার রাজকুমারগণ স্বকীয় চিত্তস্থৈর্য্য লাভ করিল, এবং সেই রাজকুমারীর সহিত ভগিনী-সম্বন্ধ পাতাইয়া, কোন প্রকারে কালযাপন করিতে লাগিল। পরে বার্ধক্য উপস্থিত হইলে, যখন তাহাদের সমস্ত বাসনা নির্বাপিত হইল, তখন তাহারা কর্ত্তব্যপালনের আত্মপ্রসাদ অনুভব করিতে লাগিল; এবং তাহাদের গৃহ আবার সুখশান্তিতে পূর্ণ হইল। প্রত্যেক অঙ্কের শেষে, কিছু কালের জন্য যে সময়ে বিরাম হয়, সেই বিরামকালে, আমি বালামণির নেপথ্য-কক্ষে গমন করিলাম, আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিব—এ সংবাদ পূর্ব্বেই তাহাকে দেওয়া হইয়াছিল। আমি তাহার রূপলাবণ্যের প্রশংসা করিলাম, এবং বলিলাম, তাহার গৃহীত রাজকুমারীর ভূমিকাটি বিশুদ্ধরূপে অভিনীত হইয়াছে। তাহার ক্ষুদ্র কক্ষটি নিতান্ত সাদাসিধা ধরণের—ঘরের মেজে সপ দিয়া মোড়া। তাহার ইতস্ততঃ-বিকীর্ণ হীরক-অলঙ্কার ও অঙ্গভূষণাদি দেখিয়া বিস্ময়ে অভিভূত হইতে হয়,—মনে হয়, চাষার কুটীরে কোনও ঔপন্যাসিক দৈত্য আসিয়া এই সকল বিচিত্র উপহার বুঝি বর্ষণ করিয়াছে। কক্ষদ্বারে আসিবামাত্রই, তাহার ভৃত্যেরা, চিরপ্রথানুসারে, জরি-বিজড়িত একটি স্কুল ফুলের মালা সহজ-শোভন শিষ্টতা-সহকারে, আমার গলায় পরাইয়া দিল। বালামণি মন খুলিয়া আমার নিকট বলিল,—পুরাতন উৎকৃষ্ট নাটকগুলি হাতে পুনরুজ্জীবিত হয়, সেই উদ্দেশ্যেই এই নাট্যশালা স্থাপিত হইয়াছে। আমি যখন বলিলাম, আমার ফরাসী বন্ধুবর্গের নিকট আমি তাহার কথা বলিব, তখন সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল।
তাহার পরদিন, কোন একটা সাধারণ স্থানে, তাহার সহিত পুনর্ব্বার আমার সাক্ষাৎ হইল—মাদ্রাজ-রেলপথের ষ্টেশনে;—দুঃখের বিষয়, এই রেলপথ মাদুরা পর্য্যন্ত গিয়াছে। বালামণির সঙ্গে দুই জন ভৃত্য। মফস্বলের ভূসম্পত্তি পরিদর্শন করিতে যাইবে, তাই ট্রেণ ধরিতে এখানে আসিয়াছে। এখানকার দীন-বসনা জনতার মধ্যে বালামণিকে পথহারা পরীর মত দেখাইতেছিল। দূর হইতে মনে হইতেছিল, যেন একটি তারা ঝিকমিক করিতেছে। তাহার কাণে হীরক, তাহার কণ্ঠে হীরক, তাহার বক্ষে হীরক। কর-প্রকোষ্ঠ হইতে স্কন্ধদেশ পর্য্যন্ত—তাহার সমস্ত নগ্নবাহুতে হীরক-অলঙ্কার। তাহার চারু ক্ষুদ্র নাসিকা হইতে একটি নথ ওষ্ঠ পর্য্যন্ত ঝুলিতেছে;—তাহাতে যে হীরকগুলি রহিয়াছে, তাহা আরও দুর্লভ ও উজ্জ্বল। তাহার জরির-পাড়ওয়ালা হলদে শাড়ী ও তাহার রেশ্মি কঁচুলি —এই উভয়ের মাঝখানে, গাত্রের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে —আর এই গাত্র সুন্দর ধাতু-স্তম্ভের ন্যায় সুচিক্কণ—সেই সঙ্গে স্তনযুগলের অকলুষিত তলদেশও অল্প অল্প দেখা যাইতেছে; আর একটু উর্ধে, আঁটা সাঁটা পাতলা কাপড়ের মধ্য দিয়া, সলজ্জ স্তনযুগলেরও একটু আভাস পাওয়া যাইতেছে। (সায়ংকালে আমাদের রমণীরা বক্ষের উদ্ধভাগটি খুলিয়া রাখে; কিন্তু নিম্নভাগটি খুলিয়া রাখায় যে কি অসুবিধা, তাহা আমি ত বুঝিতে পারি না; উহাতে বেশী কৌশল খাটাইবার আবশ্যক হয় না—এইমাত্র) তা ছাড়া, এই নর্তকীর সাজসজ্জায় বেশ একটু সংযম ও গাম্ভীর্য্য লক্ষিত হইল। বারাঙ্গনাদিগকে যে ধরণে নমস্কার করিতে হয়, সেই ধরণে আমি উহাকে নমস্কার করিলাম। রত্ন-ভারাক্রান্ত করযুগলে ললাটস্পর্শ করিয়া ভারতীয় ধরণে সে আমাকে প্রতিনমস্কার করিল। তাহার পর, পরিজন-সমভিব্যাহারে গাড়ীতে উঠিল * * * কেবল স্ত্রীলোকদিগের জন্য যে কক্ষটি রক্ষিত, সেই কক্ষে গিয়া বসিল।
ষ্টেশনের সমস্ত কদর্য্য সাজসজ্জা পরিত্যাগ করিয়া, যখন আমি দেশীমন্দিরের অভিমুখে যাত্রা করিলাম, তখনও আমার নেত্রমুকুরে বালামণির ছবিটি প্রতিবিম্বিত। আরও কত সৎকার্য সে করিয়াছে, তাহার বিবরণ আজ অনেকের মুখে শুনিলাম। তাহার একটি সৎকার্যের উল্লেখ করি; - গতমাসে, কতকগুলি য়ুরোপীয় মহিলা, হিন্দু-অনাথা-বালিকাশ্রমের জন্য চঁদা সংগ্রহ করিতে বাহির হইয়া, একটা গৃহের নিকটে আসিয়া যখন দ্বারে আঘাত করিলেন, তখন বালামণি, স্মিতমুখে, একহাজার টাকার নোট তাঁহাদের হস্তে অৰ্পণ করিল। বালামণি জাতিনিৰ্বিশেষে সকলকেই সাহায্য করিয়া থাকে, তাহার গৃহের পথটি দরিদ্রমাত্রেরই সুপরিচিত।