ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/মাদুরায় ব্রাহ্মণদিগের গৃহ
মাদুরায় ব্রাহ্মণদিগের গৃহে।
মাদুরা নগর পূৰ্বে এক জন বিলাস-আড়ম্বর-প্রিয় রাজার রাজধানী ছিল। এখানে হরপার্বতীর উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত একটি মন্দির আছে। “মীনাক্ষী” পার্বতী শিবের গৃহিণী। মন্দিরটি আমাদের “ভ” প্রাসাদ অপেক্ষাও বৃহৎ, শিল্পকর্মে ও খোদাই-কাজে অধিকতর ভূষিত, এবং তাহারই মত বিবিধ আশ্চর্য্য সামগ্রীতে পরিপূর্ণ।
দয়াশীল ত্রিবন্ধুর মহারাজের প্রভাবে ও অনুগ্রহে আমি মন্দিরের অনেকটা অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারিব, অন্তভৌম কক্ষের মধ্যে নামিতে পারিব, দেবীর ঐশ্বর্যবিভব ও সাজসজ্জা দেখিতে পাইব, সন্দেহ নাই।
নগরটি অতিমাত্র ভারতীয়-লক্ষণাক্রান্ত হইলেও, বৈদেশিকদিগের প্রতি সাদর-আহ্বান-বিতরণে বিমুখ নহে। মন্দিরদর্শনের জন্য অনেক বৈদেশিক এখানে আসিয়া থাকে। অন্যান্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যে, মন্দিরগুলিতে বৈদেশিকের প্রবেশ যেরূপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, এখানে সেরূপ নহে। মাদুরায় গিয়া যাহাতে আমি তত্য গৃহস্থ পরিবারবর্গের মধ্যে সাদরে গৃহীত হই, এই উদ্দেশে কতকগুলি অনুরোধপত্র ত্রিবন্ধুরে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। প্রথমেই আমি ব্রাহ্মণদিগের গৃহে উপস্থিত হইলাম। ভারতে, ব্রাহ্মণেরাই সর্ব্বাপেক্ষা বিশিষ্ট ও পরিশুদ্ধ।
গুরুভার, পিণ্ডাকৃতি, উচ্চ-"ভিত"-বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র একতালা গৃহ। এই মাদুরা নগরে ব্রাহ্মণদিগের যত গৃহ, সমস্তই এই আদর্শের। একটা বারাণ্ডা বারাণ্ডার থামের মাথায় বিকটাকার জীবজন্তুর মস্তক। একটা পাথরের সিঁড়ি; সেই সিঁড়ি দিয়া গৃহের অভ্যর্থনাশালায় যাওয়া যায়। সেখান হইতে লতাপাতার কাজ করা অতীব ক্ষুদ্র তিনটি গবাক্ষ দিয়া নীচের রাস্তা দেখিতে পাওয়া যায়। এই ঘরে গৃহস্বামী আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন। তিনি পলিতকেশ বৃদ্ধ; চারিটি যুবক তাহাকে ঘিরিয়া আছে;—ইহারা তাহার পুত্র। ইহাদের দীর্ঘ নেত্র নীলকৃষ্ণ অঞ্জনরেখায় অঙ্কিত। পরিচ্ছদের মধ্যে একটা ধুতি কোমরে জড়াননা; কিন্তু ইহাতে করিয়া তাহাদের উদাত্তভাব, বিশিষ্টতা ও কুলগৌরবের কিছুমাত্র লাঘব হয় নাই। ঘরটি চুকাম-করা, খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কি একটা সুগন্ধি ধূপে আমোদিত; সাজসজ্জাও নিতান্ত অশোভন নহে। আরামকেদারাগুলি খোদিত আব্লুস্ কাঠের। দেয়ালের উপর, গিণ্টিকরা “ফ্রেমে” পুরাতন জলরঙের ছবি সংরক্ষিত;—ছবিগুলি বিষ্ণুর অবতার-মুর্ত্তি। কুমিতলে সুন্দর ভারতীয় গালিচা, এবং ফুলকাটা কাপড়ে আচ্ছাদিত গদী। আমার আগমনে ইহারা একটু বিস্মিত হইল; কেন না, বৈদেশিকেরা এখানে বড় একটা আইসে না; তথাপি, ভদ্রতা ও আতিথ্য প্রদর্শন পূর্ব্বক গৃহের সমস্ত অংশ আমাকে দেখাইতে চাহিল। প্রথমে একটি অন্তঃপ্রাঙ্গণ প্রাচীরবেষ্টিত ও বিষাদময়। একটা “মকুটে মারা” বটগাছের ছায়ায় মেষ ও ছাগল বিশ্রাম করিতেছে। তাহার পর, গৃহের ছাদ;—ছাদে পায়রারা বাস করে ও কাকেরা আসিয়া বসে। সেখান হইতে, মাদুরাব প্রাচীন রাজাদিগের প্রাসাদ দেখা যায়;— উহা সপ্তদশ শতাব্দীর হিন্দু-আরব-ধরণের বহুব্যয়সাধ্য প্রকাণ্ড স্মৃতিসামগ্রী; তা ছাড়া পল্লীপ্রদেশের দূরস্থ তালকুঞ্জ পর্য্যন্ত মন্দিরাদি-সমেত সমস্ত নগরটি দৃষ্টিপথে পতিত হয়। লাল রঙ্গের প্রকাণ্ড মন্দিরচূড়াগুলি চারি দিক হইতে বিহঙ্গ-সঙ্কুল গগনমণ্ডলে সমুথিত। অবশেষে উহারা আমাকে গৃহের পুস্তকাগার দেখাইল,উহা দার্শনিক গ্রন্থে ও ধর্ম্মগ্রন্থে পরিপূর্ণ। ইহাতে সূচিত হইতেছে, আমার অভ্যর্থনাকারিগণ, অতীব বিশিষ্ট ও অতীব উচ্চ-অঙ্গের জ্ঞানানুশীলনে নিরত। উহাদিগকে নগ্নকায় দেখিয়া প্রথমে সহসা যেরূপ মনে হয়, তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রস্থান করিবার পূর্ব্বে আবার সেই অভ্যর্থনাশালার আমাকে আসিতে হইল। সেখানে একটুখানি বসিলাম। সেই যুবকদিগের মধ্যে এক জন একটা দীর্ঘ গিল্টি-করা সেতার লইয়া মৃদুস্বরে দুই চারিটা সুমধুর গৎ বাজাইল। মহিলাদিগকে যে উহারা আমার সম্মুখে আনিবে না,—ইহা জানা কথা। কিন্তু বিদায়গ্রহণ করিবার পূর্ব্বে, তিন চারি বৎসর বয়স্কা ছোট দুইটি বালিকাকে আমার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল। বালিকা দুটি অতি শিষ্ট শান্তভাবে আমার নিকটে আসিল,আদপে ভয় করিল না। উহাদের পরিচ্ছদের মধ্যে, শিকলে বোলানো, হৃৎপিণ্ডাকৃতি একটা সোনার তক্তি—এবং সেই শিকলটা কটিদেশে বেষ্টিত। তক্তিটা যথাযোগ্যরূপে নীচে নামিয়া আসিয়াছে। উহাদের হস্তপদ-গুরুভার বলয় নূপুরে ভূষিত। বালিকা দুটি যেন সৌন্দর্যের প্রতিমা;—অনিন্দ্য-গঠন মনোেমোহিনী যেন দুইটি ক্ষুদ্র দেবীমূর্তি। রং উজ্জ্বল পিত্তলের ন্যায়; দেহ সুনম ও মাংসল; হাসি-হাসি সুগ্নভীর কালো চোখ,—পদ্মরাজি অতুলনীয়; চারিধারে কজ্জলের রেখা।