ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/ভারতের অভিমুখে—যাত্রা-পথে
লোহিত সমুদ্রে, মধ্যাহ্ন। আলোক, আলোক, এত আলোক যে এই আলোক দেখিয়া বিমুগ্ধ হইতে হয়, বিস্মিত হইতে হয়; যেন এক প্রকার আধো-আঁধার হইতে বাহির হইয়া চোখ্ আরও খুলিয়া গিয়াছে, আরও স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাইতেছি। আধুনিক জাহাজের সাহায্যে এই পরিবর্ত্তনটা খুব দ্রুতভাবে সংঘটিত হয়। এই সকল জাহাজের উপর এখন আর বাতাসের কোন হাত নাই; এই সকল জাহাজ, উত্তর দেশের শরৎকাল হইতে, আমাদিগকে হঠাৎ এইখানকার চির-গ্রীষ্মের মধ্যে আনিয়া ফেলে, খাতুর ক্রম-সংক্রমণ আদৌ উপলব্ধি হয় না।
জল ঘোর নীল; রূপার ঝালরগুলা যেন ঝিক্মিক্ করিতেছে—নাচিয়া বেড়াইতেছে। মনে হইতেছে যেন আকাশ,পৃথিবী হইতে আরও দূরে সরিয়া গিয়াছে, মেঘগুলা বেন আরও সুস্পষ্ট আকার ধারণ করিয়া শূন্যে ঝুলিতেছে; আকাশের গভীরতা ক্রমেই প্রকাশ হইয়া পড়িতেছে; দূরত্বের মধ্যে জাহাজ যতই অগ্রসর হইতেছে, ততই আকাশকে আরও বেশী করিয়া উপলদ্ধি করিতেছি।
আরও আলোক, ক্রমাগতই অলোক। বাস্তবিকই নেত্র যেন বিস্ফারিত হইয়া, বেশী বেশী রশ্মি, বেশী বেশী রং গ্রহণ করিতেছে।...তবে কি, নেত্র ইহার পূর্ব্বে ভাল করিয়া কিছুই দেখিতে পাইতেছিল না?—না জানি কোন্ তিমির-রাজ্য হইতে এই মাত্র বাহির হইয়াছে। ঘোর নিস্তব্ধতার মধ্যে, কাহারও আদেশের অপেক্ষা না করিয়া, এই যে শুভ্র আলোক-উৎ— সবের আয়োজন—স্বর্ণাভ আলোক-উৎসবের আয়োজন চতুর্দ্দিকে দেখা যাইতেছে-এ কিসের উৎসব?...
এইখানে,—এই প্রাচ্য ভুখণ্ডের প্রাচীন সমাধিক্ষেত্রের উপর, বিলুপ্ত মানব-সঙ্ঘের এই ধূলি রাশির উপর, এই বিষাদময় উৎসব অবিরাম চলিতেছে; কেবল, উত্তর দেশের অভিমুখে গেলে, এ সব ভুলিয়া যাইতে হয়; তাহার পর, এই সব প্রদেশে ফিরিয়া আসিলেই আবার সেই একই দৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়, আবার বিস্ময়ে মন অভিভূত হইয়া পড়ে। সেই একই উষ্ণ ও অবসাদক্লান্ত উপসাগরের উপর—সেই একই প্রস্তরময় কিংবা বালুকাময় পুরাতন তটভূমির উপর,—সেই সব ধ্বংসাবশেষের উপর,—এবং যে সকল মৃত প্রস্তর-স্তূপ বাইবেল-বর্ণিত জাতিসমূহের গূঢ় রহস্যকে, পূর্ব্বপুরুষদিগের ধর্ম্মসমূহের গূঢ় রহস্যকে আগলাইয়া রহিয়াছে, সেই সব প্রস্তর স্তূপের উপর—এই আলোকরশ্মি অবিরাম পতিত হইতেছে। আমাদের কল্পনা, এই বিষাদময় আলোকের উৎসবকে দূর অতীতে লইয়া গিয়া, প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীর সহিত উহাকে একত্রে বাঁধিয়া দেয়; তাই মনে হয়, এই আলোক-উৎসব যেন অনাদি কাল হইতে চলিয়া আসিতেছে, এবং ইহার বুঝি শেষ নাই।...
কিন্তু, বাইবেল-বর্ণিত এই অতীত,—যাহার আপেক্ষিক প্রাচীনতায় আমাদের বিভ্রম উপস্থিত হয়, যাহার উপর আমাদের এত বিশ্বাস,—জগতের ভীষণ অতীতের তুলনায় এই অতীতটা সে দিনের বলিলেই হয়। এই সমস্ত আলোক, যাহা আমাদের নিকট এত উজ্জ্বল বলিয়া মনে হয়, যাহাতে আমাদের নেত্রের মত্ততা উপস্থিত হয়, উহা আমাদের ক্ষুদ্র সূর্য্যের ক্ষণস্থায়ী ক্রিয়ামাত্র; এই সূর্য্য আমাদের এই ক্ষুদ্রতম পৃথিবীর উপর আলো দিতে দিতে ধীরে ধীরে একদিন নির্ব্বাপিত হইবে; এখন সূর্য্য সেই নির্ব্বাণের পথেই চলিয়াছে। আমাদের পৃথিবী, পাছে শীতল হইয়া পড়ে এই ভয়ে, সুর্য্যের খুব কাছে-কাছে রহিয়াছে; আরও তাহার ভয়, পাছে সেই ভীষণ অন্ধকারের মধ্যে গিয়া পড়ে—যেখানে অপেক্ষাকৃত বড় গ্রহগুলা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আকাশের এই নীলিমা, যাহার উপর চির-পরিবর্ত্তনশীল বিচিত্র-আকারের মেঘগুলা অবিরাম খেলা করিয়া বেড়াইতেছে এবং যাহা অতলস্পর্শ গভীর বলিয়া আমাদের মনে প্রতিভাত হয়, উহা একটা পাতলা অবগুণ্ঠন মাত্র; আমাদের চোখকে ভুলাইবার জন্য, কালো অন্ধকারকে আমাদের নিকট হইতে লুকাইয়া রাখিবার জন্য, এই নীল অবগুণ্ঠন আমাদের সম্মুখে প্রসারিত রহিয়াছে; এ সমস্ত আসলে কিছুই নহে; আসল কথা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার উহার অন্তরালে প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। এই অন্ধকারই নিত্য পদার্থ, এই অন্ধকারই সর্ব্বাধিপতি; ইহার আদি নাই, অন্ত নাই; অনাদি কাল হইতে, ঐ কৃষ্ণবর্ণ শূন্যের মধ্য দিয়া, নিস্তব্ধভাবে কত শত জগৎ স্বকীয় কক্ষ হইতে চ্যুত হইতেছে, এই কৃষ্ণবর্ণ মহাশূন্য কখনও তাহাদিগকে আটকায় নাই,—কখনও তাহাদিগকে আটকাইবে না।
আকাশ ও সমুদ্রের এই সমস্ত উজ্জ্বল নীলিমার মধ্য দিয়া এখনও ৭।৮ দিন চলিতে হইবে, তাহার পরেই আমার যাত্রা শেষ হইবে, আমার গন্তব্যস্থানে আমি উপনীত হইব। ধর্ম্মের পীঠস্থান, মানব-চিন্তার লীলাভূমি—সেই ভারতবর্ষে আমি এখন যাইতেছি; আমার ভয় হইতেছে পাছে সেখানে গিয়া কিছুই না পাই—পাছে সেখানে গিয়া আবার প্রতারিত হই। আত্মবিনোদনের জন্য, কিংবা শুধু একটা মনের খেয়ালে এবার আমি সেখানে যাইতেছি না; আর্য্য-জ্ঞানের রত্নভাণ্ডার যাহাদের হস্তে, তাহাদের নিকট এবার চিত্তশান্তি যাজ্ঞা করিতে যাইতেছি। খৃষ্টধর্ম্মের আশা-ভরসা আমার চিত্ত হইতে তিরোহিত হইয়াছে; আত্মার অনির্দ্দেশ্য দীর্ঘস্থায়িত্বের উপর তাহাদের যে বিশ্বাস আছে, খৃষ্টধর্ম্মের আশ্বাসের পরিবর্ত্তে সেই কঠোরতর বিশ্বাসটি যদি তাঁহারা আমাকে দিতে পারেন,—তাই জানিবার জন্যই আমি তাহাদের নিকট যাইতেছি...
এই সময়ে সূর্য্য অস্ত হইতেছে। কি চমৎকার দৃশ্য! এই সূর্য্যআমাদের এই নিজস্ব সূর্য্য,—যে সূর্য্য, অনাদিকাল হইতে ঘুরিতে ঘুরিতে, আমাদিগকে তাহার দিকে নিয়ত আকর্ষণ করিতেছে—আর এক মুহূর্ত্ত পরেই অন্য অগণ্য সূর্যের মধ্যে হারাইয়া যাইবে। এই সেই অস্তাচলের অধিত্যকা—সেখানে নৈশ আকাশের স্বচ্ছতার মধ্য দিয়া, আমরাও ঘুরিতে ঘুরিতে সেই মহারাত্রির অভিমুখে—সেই অন্তহীন তমোরাশির অভিমুখে এখনি গমন করিব। এক্ষণে সায়াহ্নের কুহক জালে আচ্ছন্ন হইয়া, এই অস্তমান সূর্যের তাম্র পাটল প্রভা নিরীক্ষণ করা যাক্। পূর্ব্বদিকে, সমুদ্রের ঊর্দ্ধে, দিগন্তের উচ্চদেশে, জনশূন্য উজাড় রক্তবর্ণ প্রস্তরের একটি পর্ব্বতমালা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ন্যায় লাল হইয়া উঠিয়াছে। এই পর্ব্বতগুলি—সেনাই, সের্ব্বাল ও হোরেব্। আবার সেই মূসার সময়কার পৌরাণিক কাহিনীর প্রভাব আমাদের মনকে অধিকার করিল—সেই সকল কাহিনী, যাহা বংশপরম্পরাক্রমে, ধর্ম্মভাবের যেন একটা ভূমি প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছে।
কিন্তু এই জলন্ত শিখরগুলি নির্ব্বাপিত হইতে আর বড় বিলম্ব নাই। সূর্য্য জলরাশির পশ্চাতে ঢলিয়া পড়িল, সায়াহ্নের ক্ষণিক মায়া-দৃশ্য অন্তর্হিত হইল; সন্ধ্যার ধূসরতার মধ্যে, সিনাই, সের্ব্বাল, ও হোরেব, বিলুপ্ত হইল,—বিলীন হইল। আর উহাদিগকে দেখা যায় না;—আসলে উহারা কি? ধরাপৃষ্ঠে কতকগুলি পাথর একস্থানে আটকাইয়া পড়িয়াছে এই মাত্র; কিন্তু বাইবেলের “exodus”-পরিচ্ছেদের কবিত্ব-প্রভাবে, উহাদিগকে আমরা কল্পনায় অত্যন্ত বাড়াইয়া তুলিয়াছি!
অনন্ত রাত্রি—প্রশান্ত রাত্রি আসিয়া এখনি সকল পদার্থের যথাযথ পরিমাণ নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিবে। এখনি, অনন্ত আকাশে, সৌররাজ্যের যাত্রীদল দেখা দিয়াছে। উহাদের মধ্যে কাহারও যদি পদস্খলন হয়, তাহা হইলে সকলেই ঐ অন্ধকারাচ্ছন্ন অগাধ শূন্যের মধ্যে পতিত হইবে, আমরাও পতিতহইব—এই ভাবটা আবার আমার মনে জাগিয়া উঠিল। সূর্য্য আমাদিগকে ক্রমাগত টানিতেছে—কিন্তু আমাদের এই ক্ষুদ্র গ্রহদের কি দুর্দ্দশা, সূর্য্যের অভিমুখে ছুটিয়া চলিয়াছে অথচ কস্মিন কালেও সেখানে পৌঁছিতে পারিবে না; এই সকল সূর্য্যেরা তবু কতকটা স্বাধীনভাবে শূন্যের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কিন্তু আমাদের গ্রহগণ, পেঁচাল গতি অনুসরণ করিয়া ক্রমাগতই সূর্য্যের চতুর্দ্দিকে ছুটিতেছে।
মধ্য আকাশ হইতে দিগন্ত পর্য্যন্ত,কোথাও একটি মেঘ নাই, আকাশে চমৎকার স্বচ্ছতা। এক্ষণে আমাদের নেত্রসমক্ষে সেই অসীম শূন্য উদ্ঘাটিত, যেখানে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অসংখ্য জগৎ ক্রমশ পতিত হইতেছে, অগ্নিময়বৃষ্টিবিন্দুবৎ ক্রমাগত পতিত হইতেছে; যাই হোক্, কিন্তু নিশার আগমনে, তারকা-খচিত আকাশ হইতে আমাদের জন্য মধুর শান্তি নামিয়া আসিল।
মনে হয় যেন উপর হইতে, সোৎকণ্ঠ স্নেহ আসিয়া আমাদের অন্তরাত্মার উপর অল্পে অল্পে স্নিগ্নছায়া বিস্তার করিতেছে……আহা, যাঁহাদের নিকটে আমি এখন যাইতেছি সেই ভারতের তত্ত্বজ্ঞানীরা এই স্নেহযত্ন, এই অনুকম্পার সত্যতা সম্বন্ধে যদি আমার ধ্রুব বিশ্বাস জন্মাইয়া দিতে পারেন!