ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/সিংহলে
সিংহলে।
অনুরাধপুর।
এই ত সেই ভারতবর্ষ; সেই অরণ্য; সেই জঙ্গল।
দিনের অভ্যুদয়ে, শাখা-পল্লবময়, তৃণ-গুল্মময় একটি নুতন জগৎ যেন আমার সম্মুখে উদ্ভাসিত হইল। চির-হরিতের অসীম সমুদ্র, অনন্ত রহস্য, অনন্ত নিস্তব্ধতা দিগন্তের শেষ সীমা পর্য্যন্ত আমার পদতলে প্রসারিত হইল। সাগর-সস্তৃত ক্ষুদ্র একটি দ্বীপের ন্যায়, ধরণী-সমুত্থিত এই ক্ষুদ্র শৈলশিখর হইতে, আমি এই হরিতের নীরব অসীমতা সন্দর্শন করিতেছি। এই সেই মেঘান্বরা ভারতভূমি, অরণ্য-সঙ্কুলা ভারতভূমি—জঙ্গলাকীর্ণ। ভারতভূমি; সিংহল মহাদ্বীপের কেন্দ্রবর্তী এই সেই স্থান, যেখানে গভীর শান্তি বিরাজিত,—যাহা তরুশাখার দুৰ্মোচনীয় জটিল বন্ধন-জালে সর্ব্বদাই সুরক্ষিত। এই সেই স্থান, যেখানে প্রায় দ্বিসহজ বৎসরাবধি, অনুরাধপুর নামক একটি পরমাশ্চর্য্য নগর, ঘননিবিড় শাখাপল্লবের নৈশ-অন্ধকারের মধ্যে একেবারে নির্ব্বাপিত।
বৃষ্টি-ঝটিকার উদ্ভব-ক্ষেত্র সেই নীলাকাশ ভেদ করিয়া, দিবার অভ্যুদয় হইতেছে। এই সময়ে আমাদের ফরাসীদেশে দ্বিপ্রহর রাত্রি। ধরণী পুরন্ধী, সূর্যালোকের সাহায্যে, সেই ধ্বংস-রাজ্যের চিত্রটি আর একবার আমাদের সম্মুখে ধারণ করিতে উদ্যত হইয়াছেন—সেই ধ্বংসরাজ্য, যাহা চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া একেবারে ধূলিসাৎ হইয়া গিয়াছে।
এখন সেই অদ্ভুত নগরটি কোথায়? * * * জাহাজের মাস্তুল-মঞ্চ হইতে বৈচিত্র্যহীন সাগর-মণ্ডল যেরূপ দৃষ্ট হয়, আমি সেইরূপ এখান হইতে চারি দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছি;— কুত্রাপি মনুষ্যের চিহ্নমাত্রও দেখিতে পাইতেছি না। কেবলই গাছ-গাছ-গাছ। গাছের মাথাগুলি সারি সারি চলিয়াছে—সব এক সমান—সব প্রকাণ্ড। সেই তরুপুঞ্জের উত্তাল তরঙ্গভঙ্গ, সীমাহীন দূরদিগন্তে মিলাইয়া গিয়াছে। ঐ অদূরে কতকগুলি হ্রদ দেখা যাইতেছে, যেখানে কুম্ভীরগণের একাধিপত্য, এবং যেখানে সায়ংকালে বন্যহস্তিগণ দলে দলে আসিয়া জলপান করে। ঐ সেই অরণ্য—ঐ সেই জঙ্গল, যেখান হইতে বিহঙ্গগণের প্রভাতিক আহ্বান-সঙ্গীত সমুত্থিত হইয়া আমার অভিমুখে প্রবাহিত হইতেছে। কিন্তু সেই পরমাশ্চর্য্য নগরটির চিত্রও কি আর দেখিতে পাইব? *** কিন্তু এ কি দেখি?—কতকগুলি ছোট ছোট পাহাড়—অতীব অদ্ভুত, তরুসমাচ্ছন্ন, অরণ্যের ন্যায় হরিৎবর্ণ—কিন্তু একটু যেন বেশী সুষমা-বিশিষ্ট;—কোনটা বা পিরামিডের ন্যায় চূড়াকার, কোনটা বা গম্বুজাকার—ইতস্ততঃ সমুত্থিত; আর সমস্ত পদার্থ হইতে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হইয়া, পল্লবপুঞ্জের মধ্য হইতে মস্তক উত্তোলন করিয়া রহিয়াছে।
* * * এইগুলি পুরাতন মন্দিরসমূহের চূড়াদেশ—প্রকাণ্ড “দাগোবা।” খৃষ্টের দুই শতাব্দী পূর্ব্বে এইগুলি নির্ম্মিত হয়। অরণ্য ইহাদিগকে ধ্বংস করিতে পারে নাই—স্বকীয় হরিৎ-শ্যামল শব-বসনে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে মাত্র;—উহাদের উপর, অল্পে অল্পে, মৃত্তিকা, শিকড়, ঝোপ-ঝাড়, লতাগুল্ম ও কপিবৃন্দ আনিয়া ফেলিয়াছে।
বৌদ্ধধর্মের প্রথম যুগে যেখানে ভক্তগণ আরাধনা করিত, এই “দাগোবা”গুলি তাহারই মুখ্য নিদর্শন; সেই স্থান—সেই পুণ্য নগরীটি আমার নিম্নদেশে পল্লব-মণ্ডপ-তলে প্রচ্ছন্ন হইয়া নিদ্রা যাইতেছে।
আমি যে ক্ষুদ্র পাহাড় হইতে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করিতেছি, ইহাও একটি পবিত্র দাগোবা। যিনি যীশুর ভ্রাতা ও অগ্রদূত, সেই মহাপুরুষের লক্ষ লক্ষ ভক্তবৃন্দ, তাঁহার মহিমার উদ্দেশেই, এই মন্দিরটি নির্ম্মাণ করে। প্রস্তর-খোদিত কতিপয় হস্তী ও পৌরাণিক দেবমণ্ডলী ইহার তলদেশ আগ্লাইয়া রহিয়াছে। পূর্ব্বে, প্রতিদিনই এখানে ধর্ম্মসঙ্গীতের কলধ্বনি শ্রুত হইত, এবং উহাই তথন প্রার্থনা ও আরাধনার শান্তিময় আনন্দাশ্রম ছিল।
“অনুরাধপুরে অসংখ্য দেবালয়, অসংখ্য অট্টালিকা। উহাদের গম্বুজ, উহাদের মণ্ডপ-সকল সূর্যকিরণে সমুদ্ভাসিত। রাজপথে, ধনুর্বাণধারী এক দল সৈন্য; গজ অশ্ব রথ, লক্ষ লক্ষ মনুষ্য, অবিরত যাতায়াত করিতেছে। তাহার মধ্যে বাজিকর আছে, নর্ত্তক আছে, বিভিন্ন দেশের বাদক আচ্ছ। এই বাদকদিগের ঢাক প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত। কিন্তু এখন এখানে কেবলই নিস্তব্ধতা, তিমির-ছায়া, হরিৎস্ময়ী রজনীর পূর্ণ আবির্ভাব। মানুষ চলিয়া গিয়াছে, অরণ্য ইহার চারি দিক, বেষ্টন করিয়াছে।
পৃথিবীর সুদূর অতীতে, সেই আদিম মহারণ্যের উপর যেরূপ প্রশান্তভাবে প্রভাতের অভ্যুদয় হইত, এই সদ্যোবিনষ্ট নগরীর ধ্বংসাবশেষের উপর এক্ষণে সেইরূপ প্রশান্ত প্রভাত সমুদিত।
* * * *
ভারত-মহাদেশে পদার্পণ করিধার পূর্ব্বে, সিংহল দ্বীপের কোন সদাশয় পরম-কৃপালু মহারাজাব নিকট হইতে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় আমাকে কিছুদিন এখানে থাকিতে হইল। আমি তাহার বাটীতে অতিথি হইয়া থাকিব, এইরূপ কথা ছিল। যতদিন না সেই উত্তর পাই, ততদিন এই স্থানেই থাকিব, স্থির করিলাম; কেন না, উপকূলবর্তী সাৰ্বজাতিক নগরগুলির প্রতি আমার আন্তরিক বিতৃষ্ণা।
যে পথটি ধরিয়া, আমি এখানে আসিয়াছি, তাহার আলোচনা ও উদ্যোগ-আয়োজন অনেকদিন হইতেই চলিতেছিল। এই স্থানের শোভা সৌন্দর্য্য উপভোগের পক্ষে এই পথটিই সর্বাপেক্ষা অনুকূল।
“কান্দি” হইতে পূর্বাহ্নেই ছাড়িতে হইল। এই কান্দি নগর প্রাচীন সিংহল-রাজদিগের রাজধানী ছিল। যাত্রার আরম্ভভগে, সুপারিনারিকেল-ভূমিষ্ঠ প্রদেশের মধ্য দিয়া চলিতে লাগিলাম। বিষুব-রেখাবর্ত্তিপ্রদেশ-সুলভ প্রাকৃতিক প্রাচুর্য্য আমার সম্মুখে এক্ষণে পূর্ণরূপে উদ্ঘাটিত হইল। তাহার পর অপরাহ্নে, দৃশ্যের পরিবর্তন হইল। নারিকেল ও সুপারির প্রসারিত শাখা-পক্ষরাজি অল্পে অল্পে দৃষ্টিপথ হইতে তিরোহিত হইল। আমরা এইক্ষণে নাতি-উষ্ণ-প্রদেশ-সীমায় আসিয়া পড়িয়াছি। এখানকার অরণ্য, অনেকটা অস্মদ্দেশের অরণ্যের ন্যায়। .
অজস্রধারে বৃষ্টি পড়িতেছে; বৃষ্টির জল উষ্ণ ও মুরভিত; ভিজা মাটির রাস্তা দিয়া আমাদের ক্ষুদ্র ডাক-গাড়ীটি চলিয়াছে; প্রায় প্রতি পাঁচ মাইল,অন্তর ঘোড়া বদলি হইতেছে; আমরা ঘোড়াদের ইচ্ছামত চলিয়াছি। ঘোড় চার-পা তুলিয়া ছুটিতেছে, মাঝে মাঝে লাথিও ছুঁড়িতেছে। অনেক বার গাড়ী হইতে আমাদিগকে লাফাইয়া পড়িতে হইয়াছে, দুই একটা “অ-ভাঙ্গা” বুনো ঘোড়া সমস্ত ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া ফেলিতে উদ্যত;—উহারা গাড়ী টানার কাজে সবেমাত্র শিক্ষানবিশী আরম্ভ করিয়াছে। এই দুষ্ট ঘোড়াদের ক্রমাগত বদলি করা হইতেছে; ইহাদের চালাইবার জন্য দুই জন ভারতবাসী নিযুক্ত। এক জন রাশ ধরিয়া থাকে, আর এক জন তেমন বিপদ উপস্থিত হইলে, ঘোড়ার মাথার উপর লাফাইয়া পড়িবার জন্য সর্ব্বদাই প্রস্তুত। আর এক জন তৃতীয় ব্যক্তি আছে, সে ভেঁপু বাজায়; ভেঁপু বাজাইয়া শ্লথ-গতি গরুরগাড়ীগুলাকে পথ হইতে সরাইয়া দেয়;অথবা, নারিকেল-কুঞ্জ-প্রচ্ছন্ন কোন গ্রামের মধ্য দিয়া যখন গাড়ী চলে, তখন গ্রামবাসীদিগকে সতর্ক করিয়া দেয়। আট ঘণ্টার মধ্যে আমাদিগকে যথাস্থানে পৌছাইয়া দিবে, এইরূপ কথা ছিল। কিন্তু অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হওয়ায়, আমাদের ক্রমাগত বিলম্ব হইয়া যাইতেছে।
সন্ধ্যার দিকে, গ্রামের বিরলতা ও অরণ্যের নিবিড়তা ক্রমশই বাড়িতে লাগিল। কিয়ৎকাল পূর্ব্বে, একদল মানুষ যাইতেছে, দেখিয়াছিলাম। মহাপ্রভাবশালী তরুকুঞ্জের মধ্যে উহারা কি ক্ষুদ্র!—উহারা যেন তাহাদের মধ্যে হারাইয়া গিয়াছে। এখন আমাদের ভেঁপুওয়ালার কোন কাজ নাই। লোক নাই ত কাহার জন্য ভেপু বাজাইবে?
তালজাতীয় তরুগণ এইবার স্পষ্টরূপে অন্তর্হিত হইয়াছে। দিবাবসানসময়ে যাত্রা আরম্ভ করিলে মনে হয় যেন, এই অনন্ত গ্রীষ্মের মধ্যে আমাদের য়ুরোপীয় পল্লীগ্রামের কোন বিজন বনময় প্রদেশে আসিয়া পড়িয়ছি। তবে, এখানকার অরণ্যগুলি অপেক্ষাকৃত বিশাল, এবং ইহার লতা-গুল্ম-বন্ধন-জাল আরও জটিলতর। কিন্তু সময়ে-সময়ে যখন শেয়ালকাটার ‘গাছ দেখিতে পাই, সরোবরে রক্তপর প্রস্ফুটিত দেখি, কিংবা যখন দেখি,—একটি অপূর্ব প্রজাপতি আমার যাত্রা-পথের সন্মুখ দিয়া উড়িয়া যাইতেছে, আর বিচিত্র উজ্জ্বল রঙ্গের কোন একটি পাখী তাহার অনুসরণ করিতেছে, তখন উহা বিদেশভূমিকে আবার স্মরণ করাইয়া দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই অবার, আমাদেরই সেই পল্লীগ্রাম,আমাদেরই সেই অরণ্যভূমি—এইরূপ বিভ্রম উপস্থিত হয়।
সূর্যাস্তের পর, গ্রাম পল্লী আর দেখা যায় না, মনুষ্যের চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। কবোষ্ণ বৃষ্টিজলের স্নেহ-স্পর্শ উপভোগ করিতে করিতে, গভীর অরণ্যের অফুরন্ত পথ দিয়া আমরা অবিরত ছুটিয়া চলিয়াছি। চারি দিকেই গভীর নিস্তব্ধতা।
ক্রমে অন্ধকার হইতে লাগিল; তাহার সঙ্গে সঙ্গে এই নিস্তব্ধতাতে ঈষৎ রূপান্তরিত করিয়া কীট-সঙ্গীত সমুথিত হইল। আর্দ্র অরণ্য-ভূমির উপর সহস্র সহস্র ঝিল্লীর পক্ষ-স্পন্দন-জনিত অনুরণন-ধ্বনি উচ্চ হইতে উচ্চতর গ্রামে উঠিতে লাগিল। পৃথিবীর আরম্ভকাল হইতে প্রতিবাত্রিই এই সঙ্গীত ধ্বনিত হইয়া আসিতেছে। *
ক্রমে ঘনঘোর অন্ধকার; আকাশ মেঘাচ্ছন্ন; ঘণ্টার পর ঘণ্টা কতক্ষণ ধরিয়া আমরা অবিরত ছুটিয়া চলিয়াছি। ক্রমে চারিদিকের দৃশ্য ঘোরতর গম্ভীরভাব ধারণ করিল। লতাবন্ধন-জালে আপদ জড়িত দুই সারি বৃক্ষের মধ্য দিয়া আমরা চলিয়াছি। নগর-উপবনে যেরূপ একজাতীয় বড়-বড় বৃক্ষ দেখা যায়, সেইরূপ বৃক্ষ একটার পর একটা আসিতেছে—তাহার আর শেষ নাই।
কতক গুলি স্থূলকায় কৃষ্ণবর্ণ পশু অন্ধকারের মধ্যে অস্পষ্ট লক্ষিত হইতেছে। তাহারা আমাদের পথরোধ করিয়া ছিল। এই বুনো গরুগুলা নিতান্ত নিরীহ ও নির্বোধ; চীৎকার শব্দ করিয়া দুই চারিবার চাবুক আস্ফালন পালন করিবামাত্রই উহারা ইতস্ততঃ সরিয়া পড়িল। আবার পথের সেই বৈচিত্র্যহীন শূন্যতা; আবার সেই নিস্তব্ধতা—যাহা কেবল ঝিল্লীর আনন্দ-রবে মুখরিত।
অরণ্যের এই মহা-নিস্তব্ধতার মধ্যে, নৈশজীবনের স্পন্দন ও বিকাশ বেশ অনুভব করা যায়। এই অরণ্য কত শত মৃগের বিচরণভূমি;কেহ বা শত্রুভয়ে সতর্ক হইয়া চারি দিক নিরীক্ষণ করিতেছে, কেহ বা আহার-অন্বেষণে প্রবৃত্ত। একটু ছায়া নড়িলেই না জানি কত মৃগের কান খাড়া হইয়া উঠে—কত মৃগের চক্ষু-তারা বিস্ফারিত হয়। * * * এই রহস্যময় বনপথটি বরাবর সিধা চলিয়াছে; ইহা ম্লান ধূসরবর্ণ, আর ইহার দুইধারে কৃষ্ণবর্ণ তরু-প্রাচীর। উহার সম্মুখে, পশ্চাতে, চতুর্দ্দিকে যোজন-ব্যাপী দুর্ভেদ্য জটিল শাখাজাল বিস্তৃত হইয়া অরণ্য-ভূমিকে কিরূপ পীড়ন করিতেছে, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়।
রজনীর অন্ধকারে আমাদের চক্ষু এখন অভ্যস্ত হইয়াছে; তাই স্বপ্নের মত অস্পষ্ট কখন-কথন দেখিতে পাই, ইদুর-জাতীয় একপ্রকার জীব মখমল-কোমলপদ বিক্ষেপে নিঃশব্দে গর্ত্ত হইতে বাহির হইয়াই আবার অন্তর্হিত হইতেছে।
অবশেষে প্রায় ১১টায় সময় দেখা গেল, স্থানে স্থানে, অল্প অল্প আগুন জ্বলিতেছে, ভগ্নাবশেষের দীর্ঘায়তন গুরুভার প্রস্তর-ফলকসমূহ পথের দুইধারে বিকীর্ণ; এবং গাছের মাথা ছাড়াইয়া, দাগোবা-সমুহের প্রকাণ্ড ছায়া-চিত্র আকাশপটে অঙ্কিত। এগুলি যে পৰ্বত নয়—ভূগর্ভনিহিত নগরের মন্দির-চূড়ামাত্র—তাহা আমি পূর্ব্ব হইতেই জানিতাম।
আজ রাত্রে, এইখানকার একটি কুটীরে আশ্রয় লইলাম। নন্দনকাননের ন্যায় সুন্দর একটি ক্ষুদ্র বাগানে এই কুটীরটি অবস্থিত। যাইবার সময় ল্যাষ্ঠানের আলোকে দেখিতে পাইলাম, ফুল ফুটিয়াছে।:::*:::*:::*:::*:::
এক্ষণে প্রভাত হইয়াছে। আমি যে স্থানে আছি, তাহার নীচে, অরণ্যের মধ্যে বিহঙ্গগণের জাগরণ-কোলাহল শুনিতেছি। আমি এই মন্দির-চূড়ার উপরে, জঙ্গল-সুলভ তৃণ-গুল্মে পরিবেষ্টিত।
আমি আসিয়া চামচিকাদিগের শান্তিভঙ্গ করিয়াছি—তাহারা এক্ষণে প্রভাতের আলোকে চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। ইহারা ধ্বংশ-স্থানেরই জীব; ইহাদের ডানাগুলা ছাইরঙ্গের। আর, কতকগুলি কাঠবিড়ালী তরুপল্লবের অন্তরাল হইতে আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে; উহাদের কি চটুলতা! কি শোভন গতিভঙ্গি! বড়-বড় গাছগুলা এই মৃত নগরেব শবাচ্ছাদনরূপে বিরাজমান। কিন্তু উহাদের মধ্যে কতকগুলি বৃক্ষ, আমার পাদদেশে, বসন্তোৎসবের সাজসজ্জায় সুসজ্জিত;—রক্তবর্ণ, পীতবর্ণ, গোলাপী বর্ণের ‘ ফুল সকল ফুটিয়া রহিয়াছে। এই সকল সুন্দর দৃষ্পিত তরুশিরের উপর পর্জ্জন্যদেব তাড়াতাড়ি এক-পল্লা বৃষ্টি বর্ষণ করিয়াই দূরত্বের করাল-গর্ভে মিলাইয়া গেলেন। কিন্তু প্রচণ্ড সূর্য্য শীঘ্রই অবাব মেঘ ও বৃষ্টির পশ্চাতে উদিত হইয়া আমার মস্তককে উত্তপ্ত করিয়া তুলিল। যেখানে কতকগুলি মনুষ্যের বসতি আছে, সেই অবণ্যেব নিম্নস্থ একটি ছায়াময় প্রদেশে হরিৎ-শ্যামল রাজ্যের মধ্যে এই বার আমরা প্রবেশ করিব। এখানকার একটি বৃক্ষশাখার গোপন দিয়া আমি নীচে নামিতেছি। * * * * নীচে, লোহিত্ মৃত্তিকার মধ্যে, আঁকা-বাঁকা সর্পের মত অদ্ভুতাকার শিকড়জালের মধ্যে, এই ধ্বংস-জগৎটি অবস্থিত। ধ্বংসাবশেষের ভাঙ্গাচুরা দ্রব্য সকল বিশৃঙ্খলভাবে এক স্থানে স্তূপাকার হইয়া রহিয়াছে।
শত শত দেবতার ভগ্ন প্রতিমা, প্রস্তরময় হস্তী, যজ্ঞবেদিকা, কল্পনাপ্রসূত কত কি মূর্ত্তি—সেই মহাধ্বংসের সাক্ষ্য দিতেছে। প্রায় দুই সহস্র বৎসর পূর্বে মালাবার-প্রদেশবাসী আক্রমণকারীরা এই সুন্দর নগরটিকে ভূমিসাৎ করে।
এই সকল দ্রব্য সামগ্রীর মধ্যে যাহা কিছু সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্র ও পূজার্হ সেই সমস্ত, একালের বৌদ্ধেরা, অবিনশ্বর দাগোবার চারিধার হইতে ভক্তিভাবে সযত্নে কুড়াইয়া রাখিয়াছে। উহারা ভগ্ন-মন্দিরের সোপান-ধাপের দুইধারে পুরাতন দেবতাদিগের ভগ্ন প্রতিমাগুলি সারি-সারি সাজাইয়া রাখিয়াছে। এক্ষণে পুরাতন যজ্ঞবেদিকাগুলি বিলুপ্তমুখশ্রী ও অঙ্গহীন হইলেও, তাহাদেরই যত্নে কোন প্রকারে ভূমির উপর খাড়া রহিয়াছে। এখনও ভক্ত বৌদ্ধেরা, ভক্তিসহকারে প্রতিদিন প্রাতে এই বেদীগুলি সুন্দর ফুল দিয়া সজ্জিত করে, এবং তাহার উপর ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পূজা-প্রদীপ জ্বালাইয়া রাখে। তাহাদিগের চক্ষে অনুরাধপুর পুণ্যতীর্থ; অনেক দূর হইতে যাত্রিগণ এখানে আসিয়া সমবেত হয়, এৱং শান্তিময় তরু-ছায়াতলে বাস করিয়া পূজা অর্চনা করে।
গুরুভার প্রস্তর-ফলক:সমূহ সারি সারি পড়িয়া রহিয়াছে; মন্দিরচূড়া হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া স্তম্ভশ্রেণীগুলি ক্রমশঃ বনের মধ্যে মিলাইয়া গিয়াছে;এই সমস্ত নিদর্শনের দ্বারা সুবৃহৎ ভজনা-শালার আয়তন ও রচনা-প্রণালী কতকটা অনুমান করা যায়। অসংখ্য বহির্দালান পার হইয়া তবে সেই ভজনা-শালায় উপনীত হওয়া যায়। যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব প্রভৃতি নিকৃষ্ট দেবতারা ঐ দালানগুলির রক্ষিরূপে অবস্থিত। দেবতাদের এই পাষাণপ্রতিমা গুলি চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া ভূতলে পড়িয়া রহিয়াছে। ইহা ছাড়া, আরও শত শত ভগ্ন-চূর্ণ মন্দির ও প্রাসাদের চিহ্ন সর্ব্বত্রই দৃষ্ট হয়। বৃক্ষকাণ্ডের সহিত অসংখ্য প্রস্তর-স্তম্ভ এই অরণ্য-গর্ভে নিহিত; এবং সকলে মিলিয়া এক সঙ্গে আবার সেই অনন্ত অসীম হরিৎ-রাজ্যে মিলাইয়া গিয়াছে।
অস্মৎ-যুগের প্রারম্ভে, রাজকুমারী—“সঙ্ঘমিত্তা, যিনি একজন মহাযোগিনী ছিলেন—তিনি মহাবোধি-বৃক্ষের একটি শাখা—যাহার তলায় বসিয়া বুদ্ধদেব বৌদ্ধত্ব প্রাপ্ত হন ভারতের উত্তর-খণ্ড হইতে আনাইয়া এইখানে রোপণ করিয়াছিলেন। সেই শাখাটি এক্ষণে একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষে পরিণত হইয়াছে; এবং বটবৃক্ষের নিয়মানুসারে তাহার শাখা প্রশাখা হইতে অসংখ্য শিকড় নামিয়াছে। এই বৃক্ষের চতুষ্পার্শে পূরাতন বেদিকাসমূহ স্থাপিত; তাহার উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পূজাপ্রদীপ দিবা-রাত্রি জ্বলিতেছে, এবং নানাবিধ সুগন্ধি কুসুম বিকীর্ণ রহিয়াছে। প্রতিদিনই এইখানে টাটকা ফুল ছড়াইয়া দেওয়া হয়। যখন দেখি, এই অরণ্যের মধ্যে, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দ্বারপথগুলি সাদা মার্ব্বেল পাথরে নির্মিত ও ভাস্করের সূক্ষ্ম-কারুকার্যে আচ্ছন্ন; যখন দেখি, স্বাগত-স্মিতমুখে দেবতারা কত কত সোপান-ধাপের উপর দাঁড়াইয়া আছেন; যখন দেখি, এই দ্বারপথগুলি দিয়া কোথাও উপনীত হওয়া, যায় না, তখন মনোমধ্যে একটা অভূতপূর্ব্ব বিষাদের ভাব উপস্থিত হয়।
গৃহগুলি সম্ভবতঃ কাঠের ছিল। কিন্তু এত শতাব্দীর পর, তাহাদের কোন চিহূমাত্রও নাই। কেবল সোপানের পাপ ও দ্বারদেশগুলি রহিয়া গিয়াছে। এক্ষণে এই বিলাসময় সুসমৃদ্ধ দ্বারপথগুলি বরাবর প্রসারিত হইয়া গাছের শিকড়,লতা-গুল্ম ও মৃত্তিকায় গিয়া শেষ হইয়াছে।
কিয়ৎ বৎসর হইতে, অনুরাধপুরের এক কোণে, একটি ক্ষুদ্র গ্রাম বসিয়াছে। সেখানে কতকগুলি লোক বাস করে। গ্রামটি তেমন বর্ধিষ্ণু নয়—উহা একটি গোপ-পল্লী মাত্র। ভগ্নাবশেষ নগরটির ন্যায় এই গ্রামটিও তরুশাখায় আচ্ছন্ন। সুতরাং এখানেও সেই বিষাদের রাজত্ব। সে সকল ভারতবাসী এই ধ্বংস-নগরে আসিয়া আবার বাস করিতেছে, তাহারা অরণ্যের বৃহৎ বৃক্ষগুলিকে ছেদন করে নাই; পরন্তু, আগাছা ও কণ্টক গুল্ম প্রভৃতি কাটিয়া সাফ করিয়া, দিব্য শাদ্বলভূমি বাহির করিয়াছে। সেখানে এখন তাহাদের গো মহিষ ছাগল প্রভৃতি পালিত পশুগণ ছায়াতলে সুখস্বচ্ছন্দে চরিয়া বেড়ায়। মন্দিরসংলগ্ন ভূমিতে বিচরণ করে বলিয়া সেখানকার লোকেরা ইহাদিগকে পরম পবিত্র বলিয়া মনে করে।
যে সকল ভারতবাসী এই পবিত্র ভগ্নাবশেষের মধ্যে জীবনযাপন করে, এই সকল ভগ্ন প্রাসাদসংলগ্ন পুষ্করিণীতে স্নান করে, তাহাদের বিশ্বাস, রাজা ও রাজকুমারদের“ভূত” সন্ধ্যার সময় এখানকার চারি দিকে ঘুরিয়া বেড়ায়; এই জন্য তাহারা জ্যোৎস্না রাতে বড়-বড় দাগোবার ছায়াতলে কিছুতেই দাঁড়াইতে চাহে না। তা ছাড়া, এই সুচ্ছায় স্থানঠিকে তপস্যা ও ধ্যান ধারণার অনুকূল, পবিত্র আশ্রম বলিয়া উপলব্ধি হয়। দেবালয়-সুলভ একটি শান্তির ছায়া এই সকল পথের উপর, এই সকল গালিচা-বৎ তৃণভূমির উপর বিরাজমান। একজাতীয় বড়-বড় ফুল ইহার উপর বৃষ্টিবিন্দুর ন্যায় ঝরিয়া-ঝরিয়া পড়িতেছে।
দুই সহস্র বৎসর পূর্বেকার ভগ্ন পাষাণমূর্তিদিগের সম্মুখে, অরণ্যের মধ্যে, ছোট-ছোট প্রদীপ অষ্ট প্রহর অলিতেছে; বহু পুরাতন পাষাণের উপর টাটকা ফুল প্রতিদিন নিত্য-নিয়মিত স্থাপিত হইতেছে—এই দৃশ্যটি কি মর্মস্পর্শী!
ভারতবর্ষে, দেবতাদিগকে ফুলের তোড়া উৎসর্গ করা হয় না; পরন্তু যুথী জাতি মল্লিকা মালতী প্রভৃতি শুভ্রবর্ণ ও সুগন্ধি পুষ্পরাশি পূজা-বেদিকার উপর অজস্র বিকীর্ণ হইয়া থাকে, —তাহার উপর দুইচারিটি বঙ্গদেশীয় গোলাপ ও রক্তজবাও ছড়াইয়া দেওয়া হয়।
এই পূজোপহার ভগ্ন চূর্ণ মন্দিরের প্রস্তর-ফলকের উপর স্থাপিত হয়— প্রস্তরফলকগুলি ধীরে-ধীরে মৃত্তিকা-গর্ভে ক্রমশঃ বিলীন হইয়া যাইতেছে।সিংহলে।
২। শৈল-মন্দির।
বৃহদাকার কোন জন্তু-বিশেষ ও বৌদ্ধমন্দিরের “দাগোবা”—এই দুয়ের সম্মিলনে যেন এই মন্দিরটি নিশ্মিত;—শ্যামল স্তপের উপর সৌধ-ধবল ক্ষুদ্র একটি “দাগোবা” যেন স্থাপিত হইয়াছে। যেন হাতী তাহার কালো পিঠের উপর চূড়াকার একটা হাওদা বহন করিতেছে।
আমরা পৌছিয়া দেখিলাম, জঙ্গলটি অস্তোন্মুখ সূর্যের কিরণতলে প্রসারিত; চারি দিক নিস্তব্ধ; মন্দিরের সমীপে জন-প্রাণী নাই; ভূমির উপর চামেলী প্রভৃতি এক রাশি ফুল ছড়ানো রহিয়াছে; ফুলগুলি শুখাইয়া গিয়াছে, কিন্তু এখনও তার গন্ধ যায় নাই। এইগুলি পূর্ব্বদিনের পুন্য।দেবতারা এখানেও সে বিস্মৃত নহেন, এই পুষ্পাঞ্জলিই তাহার সাক্ষী।
কোন বহদাকার জন্থর ন্যায় এই শৈলমণ্ডলের গঠন-ভঙ্গী; উহার পাদদেশ সরোবরের জলে বিধৌত; সরোবরটি কুম্ভীরের আবাস ও পঙ্কজশোতিত। নিকটে আসিলে লক্ষ্য করা যায়, উহাদের মসৃণ গাত্রে, কতকগুলি • অস্পষ্ট উৎকীর্ণ-চিত্র মুদ্রিত রহিয়াছে। এত সূক্ষ্ম ও অস্পষ্ট যে, ছায়ার ন্যায় দৃষ্টিপথ হইতে ক্রমাগত সরিয়া সরিয়া যায়। কিন্তু চিত্রগুলি এরূপ নিপুণভাবে অঙ্কিত যে, প্রকৃত বলিয়া ভ্রম হয়। হস্তীর শুণ্ড, কর্ণ, পদ, অঙ্গাদির গঠন—ইহাই চিত্রের বিষয়। শৈলের প্রস্তরগুলি স্বভাবতই এমন আশ্চর্য্যভাবে বিন্যস্ত ও তাহাদের গায়ের এরূপ স্বাভাবিক রং যে, উহাতে হস্তীর গঠন ও বর্ণ যেন পূর্ব্ব হইতেই প্রস্তুত হইয়াছিল। কেবল, শিল্পী অতি অপূর্ব্ব কৌশলে উহাদিগকে আপন কাজে লাগাইয়াছে,এইমাত্র। স্থানে স্থানে, এই গোলাকার শৈলের ফাটলে ফাটলে ছোট-ছোট গাছের চারা বাহির হইয়াছে। পুরাতন চামড়ার রংএর মত এই শৈল-প্রস্তরের রং—এই রংএর গায়ে এই চারাগুলি এত পরিস্ফুট ও উজ্জ্বল দেখাইতেছে যে, সত্যকার উদ্ভিজ্জ বলিয়া মনে হয় না। 'পেরিউয়িঙ্ক’এর গাছ খুব লাল, ‘হিবিসকাস’ও খুব লাল, সুপারীর চারাগুলি অত্যন্ত সবুজ। মনে হয়, যেন খাগড়ার ডাঁটার উপর পালকের থোপনা ঝুলিতেছে।
শৈলমগুলের পশ্চাদ্দেশে একটি প্রাচীন ধরণের ছোট বাড়ী প্রচ্ছন্ন। উহার মধ্যে মন্দির-বক্ষক বৌদ্ধ-পুববাহিতেরা বাস করে। উহাদিগের মধ্যে এক জন, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য বাহির হইয়া আসিলেন:যুবা পুরুষ, বৌদ্ধ পুরোহিতের অনুরূপ পীত রংএর বহির্বাসে গাত্র আচ্ছাদিত, কেবল একটি স্কন্ধ ও একটি বাহু অনাবৃত। দেবালয়ের দ্বার উদঘাটন করিবার জন্য এক ফুটের অধিক লম্বা, কারুকার্যে অলঙ্কৃত একটি চাবি তাঁঁহার সঙ্গে। ইহার মুখ সুন্দর ও গম্ভীর, ইহার চোখ দুটিতে যোগিজনসুলভ রহস্যময় ধ্যানের ভাব যেন পরিব্যক্ত। হস্তে চাবিটি লইয়া যখন ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, তখন সূর্যের কনক-কিরণ তাঁহার উপর পতিত হওয়ায় মনে হইল, যেন আমাদের ‘পিটার’মুনির তাম্রপ্রতিমাটি রক্ত বর্ণে রঞ্জিত না হইয়া, পীতবর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে। লাল ‘পেরি-উইঙ্কলে’র ঝোপের মধ্য দিয়া শৈল-খোদিত একটা সিঁড়ি বাহিয়া, আমরা উপরে উঠিলাম। চতুর্দিকের জঙ্গল-পরিধিটি যেন আরও বর্ধিত হইল।
মুখ্য শৈলখণ্ডের মধ্য-পথে কঠোর শৈল-গর্ভ ভেদ করিয়া, পাথর কাটিয়া দেবালয়টি নির্ম্মিত। প্রথমে একটি গহ্বর; সেখানে প্রস্তরবেদিকার উপর, যূথী জাতি মল্লিকা প্রভৃতি টাটকা ফুল বিকীর্ণ রহিয়াছে। গম্বরের শেষ সীমায় দেবালয়ের প্রবেশ-দ্বার। দুইটি তাম্রকবাটে দ্বারটি রুদ্ধ। উহাতে, কারুকার্য্যবিশিষ্ট একটি প্রকাণ্ড তালা লাগানো আছে।
ঝনৎকার-সহকারে ধাতব কবাটদ্বয় উদ্ঘাটিত হইবামাত্র, রং-করা কতকগুলি বড়-বড় পুতুল বাহির হইয়া পড়িল। বহুমূল্য সুগন্ধি-নির্য্যাসের চৌবাচ্চা যেন সহসা অনাবৃত হইল। প্রতিদিন, গোলপ-নির্য্যাসে ও চন্দন-রসে ভূমি পরিসিক্ত ও যুথী-জাতি-মল্লিকা প্রভৃতি সুগন্ধি শুভ্র পুষ্পস্তবকে সমাচ্ছন্ন হওয়ায়, তত্র বায়ু সুরভিত ও কুট্টিম-তল একেবারে সাদা হইয়া গিয়াছে। যে দেবতারা এই সুড়ঙ্গ-গর্ভের অন্ধকারে বাস করেন, তাহারা এই সুরম্য সুমধুর সৌরভের মধ্যে নিত্য নিমগ্ন।
এই দেবালয়ে অনেকগুলি পুত্তলিকা; কক্ষটি আলমারীর ন্যায় সংকীর্ণ, কষ্টে-সৃষ্টে ৪।৫ জনের দাঁড়াইবার স্থান হয়। দেবীগুলি ১২ ফুট উচ্চ, শৈলপ্রস্তরের মধ্য হইতেই খুদিয়া বাহির করা, এবং বিবিধ সাজসজ্জায় বিভূষিত। বৌদ্ধপুরোহিতের পরিচ্ছদের ন্যায় ইহাদের মুখ পীতবর্ণ, এবং ইহাদের মুকুটগুলি খিলানে গিয়া ঠেকিয়াছে। মধ্যস্থলে অতিমানুষ-বিরাটআকারের একটি বুদ্ধমূর্ত্তি সেই পরিচিত চিরধ্যানের ভঙ্গীতে আসনস্থ। পুত্তলিকার আকারে ছোট ছোট দেবতারা ইহার সমীপে ঘেঁসাঘেঁসি বসিয়া আছেন। আর যে বিরাট দেবীমূর্ত্তিগুলি মণ্ডলাকার চারি দিকে অবস্থিত, উহারা যেন এই পুতুলগুলির দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। উহারের অলঙ্কারগুলি খুব উজ্জ্বল রং এখনও বেশ টাটকা রহিয়াছে, প্রস্তরময় পরিচ্ছদগুলি লাল নীল রংএ রঞ্জিত। এ সব সত্ত্বেও, ঐ আয়ত-নেত্র মহোদয়গণকে পুরাকালের লোক বলিয়াই মনে হয়।
আমি এখানে হঠাৎ আসায়, এই দেবতাদিগের গুহায় আজ একটু আলোক প্রবেশ করিয়াছে; দেবতারা,সম্মুখস্থ বিমুক্ত দালানের মধ্য দিয়া যেথানে তাহাদিগের পূর্ব্ব শতাব্দীর ভক্তগণ বাস করিতেন—সেই জঙ্গলের দূরদিগন্তদেশ পর্য্যন্ত এক্ষণে অবলোকন করিবার অবসর পাইলেন।
আমি তাহাদের মুখ-পানে একবার চাহিয়া দেখিলাম, পরক্ষণেই মন্দির-রক্ষক পুরোহিতেরা দেবালয়ের সেই পুণ্য-কক্ষটি আবার বন্ধ করিয়া দিল; শৈলগহ্বরবাসী দেবতারা স্বকীয় সুরভিত অন্ধকার ও নিস্তব্ধতার মধ্যে আবার নিমগ্ন হইলেন।
আমি বিদেশী-আমার নিকটে, বৌদ্ধদিগের এই সকল সাঙ্কেতিক মূর্তি, বৌদ্ধধর্ম্মের শান্তি, এখনও প্রহেলিকাবৎ দুর্জ্ঞেয়।
আমি চলিলাম। পীতবসনধারী রক্ষকেরাও স্বকীয় আশ্রম-নিবাসে ধীরে ধীরে প্রস্থান করিলেন।
এই অপূর্ব্ব মন্দিরপুরোহিতদিগের আর কোন পার্থিব চিন্তা নাই। দেবালয়ে ফুল সাজানই উহাদের একমাত্র কাজ। এই বিজন আশ্রমে থাকিয়া, সুখ-দুঃখ-বিবর্জ্জিত হইয়া, যাহাতে দীর্ঘকাল জীবনযাপন করিতে পারে, এবং এই নশ্বর জীবনের পরেও, যাহাতে জন্ম-বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া ব্যক্তিত্বহীন যোরতমসাচ্ছন্ন অনন্তের মধ্যে আপনাকে বিলীন করিতে পারে,—ইহাই তাহাদের একমাত্র আশা।
এই শৈল-মন্দিরের জঙ্গল ত্যাগ করিয়া, যখন আবার সেই অরণ্য-সুপ্ত অনুরাধপুরে প্রবেশ করিবার জন্য যাত্রা করিলাম, তখন সূর্য অস্তোন্মুখ। রাত্রিকালে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বিচরণ করিয়া, কল্য প্রভাতেই আবার এখান হইতে প্রস্থান করিব।
‘চন্দ্র’-পথ ও ‘রাজ’-পথ -এই দুটি রাস্তা সবচেয়ে বড়। বালুকাচ্ছন্ন রাস্তাটি আয়তনে উহাদের চতুর্থাংশ। “‘চন্দ্র’-পথের দুই ধারে এগারো হাজার কোঠা বাড়ী দৃষ্ট হয়। সদর-দরজা হইতে দক্ষিণের দ্বার পর্যন্ত দূরত্বে আট ক্রোশ; এবং উত্তর-দ্বার হইতে দক্ষিণ-দ্বার পর্যন্ত ঠিক আর আট ক্রোশ।”
অরণ্যের বৃক্ষতলে কত রাশি-রাশি প্রস্তর, প্রাচীন ধরণের কত পাষাণ-প্রতিমা—তার আর শেষ নাই। কিরীট-ভূষিত দেব দেবী; কুম্ভীরের দেহ, হস্তীর শুণ্ড ও পক্ষীর পুচ্ছবিশিষ্ট বিকটাকার বিবিধ মূর্তি। আর, থামের পর থাম চলিয়াছে;—কতকগুলি স্তম্ভ শ্রেণীবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান, কতকগুলি ভগ্ন ও স্বস্থান-ভ্রষ্ট। তা ছাড়া, ভগ্ন-গৃহের, কত যে দেহলী, তার আর সংখ্যা নাই। দ্বারদেশের সোপান-ধাপের প্রত্যেক ধারে এক-একটি ক্ষুদ্র স্মিতাননা দেবী-মূর্ত্তি, লতা পাতা শিকড়-জালের মধ্যে আসিবার জন্য যেন ইঙ্গিতে আহবান করিতেছে। এই সকল গৃহের গৃহস্বামীরা সেই তমসাচ্ছন্ন পুরাকালে অতীব আতিথেয় ছিলেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু বহু শতাব্দী হইতে ইহাদের ভস্ম পর্যন্ত বিলুপ্ত হইয়াছে।
কনক-রাগ-রঞ্জিত সায়াহ্নে, আমার আবাস-গৃহ হইতে বহুদূরে, রাজাদের প্রাসাদ-অঞ্চলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেখানে বৃহৎ ভিত্তিবেষ্টন ও প্রস্তরখোদিত সোপান-ধাপ ভিন্ন আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। চারিদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। একটি কীটের শব্দ নাই, একটি পাখীর ডাক নাই। এইখানে একটি বৃহৎ চতুষ্কোণ পদ্ম-পুষ্করিণীর ধারে আমি বিশ্রাম করিতেছি। পুষ্করিণীর ধার পাথর দিয়া বাঁধানো; ইহা গজরাজদিগের স্নানাগার। অরণ্যের মধ্যে এইটুকুই তরুশূন্য মুক্ত পরিসর।
এই পুষ্করিণীর জলে ক্রমাগত বুদবুদ উঠিয়া এক একটা চক্র রচনা করিতেছে; এই কবোষ্ণ জলের মধ্যে সর্প কুম্মের সহিত যে সকল রূম্ভীর সকলে, তাহাদের নিশ্বাসবায়ুতে এই জলবুদ্বুদগুলি উৎপন্ন হইতেছে। এই অঞ্চলের মধ্যে ঝোপ-ঝাড় কিছুমাত্র নাই। অরণ্যস্থিত ধ্বংস- রাজ্যের দূর প্রান্ত পর্যন্ত চারি দিকে আমার দৃষ্টি অবাধে সঞ্চরণ করিতেছে। পশ্চিম দিগন্তে হঠাৎ যেন একটা আগুন জ্বলিয়া উঠিল। গাছের ফাকে রশ্মি প্রবেশ করিয়া আমার চক্ষু যেন ঝলসিয়া দিল;—উহা অস্তমান সূর্য্য ভিন্ন আর কিছুই নহে। পৃথিবীর যে অক্ষাংশবৃত্তে আমরা অবস্থিত, তাহাতে শীঘ্রই রাত্রি আসিয়া পড়িবে।
আরও বেশী দেখিবার জন্য আমি তাড়াতাড়ি আরও দূরে চলিয়া গেলাম। আজ সন্ধ্যায় যতক্ষণ পারি ভ্রমণ করিব; কেন না, আজ এখানে আমার শেষ দিন।
দিবাবসানে, আমি যে নূতন ভূভাগে প্রবেশ করিলাম, তাহা আমার নিকট অতীব রমণীয় বলিয়া বোধ হইল। ভূমির মৃত্তিকা সুকুমার, একটু শুষ্ক, একটু বালুকাময়, ছোট ছোট তৃণে আচ্ছন্ন; শৈশবে যে অরণ্য-ভূমির সহিত আমি পরিচিত ছিলাম, ইহা কতকটা সেইরূপ। ইহা ছাড়া আরও কতকগুলি জিনিস দেখিয়া জন্মভূমি বলিয়া আমার যেন আরও বিভ্রম উপস্থিত হইল। সেই সেখানকারই মত কৃষক ও গোমেষা- দির পদক্ষুন্ন মেঠো পথ; আমাদের দেশের ওক্গাছের ন্যায়, বন-শ্যামল- ক্ষুদ্র-পল্লব-যুক্ত ও ধূসরবর্ণের শাখা-প্রশাখা-বিশিষ্ট সেই তরুগণ, সেই, মেঠো নিস্তব্ধতা, সেই সন্ধ্যার বিষন্নতা * * কিন্তু এই ভগ্নাবশেষগুলি, এই বৃহৎ প্রস্তরগুলি, নিত্য নিয়ত আমার নেত্র-সমক্ষে থাকায়, বিশেষতঃ এই পাষা-প্রতিমাগুলির রহস্যময় মুখশ্রী আমার মনে সতত জাগরূক থাকায়, এই স্বদেশসম্বন্ধীয় বিভ্রমটি অধিকক্ষণ স্থায়ী হইতে পারে না। ক্রমশঃ অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছে। যে সকল নিঃসঙ্গ বুদ্ধ-মূর্ত্তি ধ্যানাসনে উপবিষ্ট হইয়া স্মিতমুখে শূন্যের দিকে চাহিয়া আছে, তাহাদের ছায়াও যেন এই অন্ধকারে ভয়-বিচলিত হইয়া উঠিয়াছে।
এখান হইতে ফিরিয়া, কুকুর ও নেকড়েঘদিগের মধ্য দিয়া, এক্ষণে যে প্রদেশে প্রবেশ করিতেছি, উহা যেন আরও বিষাদ-মধুর—একেবারেই যেন আমাদের দেশের মত। এই চতুর্দিকস্থ ভারতীয় অরণ্যের ভাবটি যদিও আমার অন্তরের অন্তস্তলে গৃঢ়ভাবে জাগিতেছে, তবু যেন আমার মনে হইতেছে, আমি Saintonge কিংবা Aunisএর ওকবৃক্ষের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি; তাই আমি এই অরণ্যের মধ্য দিয়া বিশ্রভাবে চলিতেছি।
আমার বিশ্বাস ছিল, আমি এখানে সম্পূর্ণরূপে একাকী, তাই হঠাৎ আমার পার্শ্বে একটি প্রকাণ্ড মনুষ্যমূর্ত্তি দেখিয়া আমি শিহরিয়া উঠিলাম। তাহার হস্তদ্বয় কটিদ্বেশে লগ্ন ও মস্তক আনত বুদ্ধের এই পাষাণ প্রতিমাটি দুই সহস্র বৎসর হইতে এইখানেই বসিয়া আছে!
তাহার মুখের কাছে আসিয়া, অন্ধকারের মধ্যে দেখিলাম, সেই তার চির-নত দৃষ্টি, সেই তার চিরন্তন স্মিত-হাস্য!
এই সময়ে বিশেষতঃ এই চন্দ্রালোকে, যখন মন্দিরের চূড়াগুলি জঙ্গলের সুদূরপ্রান্ত পর্যন্ত, স্বকীয় ছায়া প্রসারিত করে, তখন ফি এক পবিত্র ধর্মভাব-রঞ্জিত শান্তিরসের আবির্ভাব হয়। আজ এই সন্ধ্যাকালে চন্দ্রমা সুনীলকিরণ বর্ষণ করিতেছেন। আজ একটি রাত্রি আমি এই অরণ্যে যাপন করিলাম, আর সৌভাগ্যক্রমে আজিকার রাত্রিতেই দিগ্বিদিক স্বর্গীয় আলোকে প্লাবিত হইল। আমাদের জুলাই মাসের তরল স্বচ্ছ উষ্ণরাত্রির কথা মনে পড়িতেছে। কেবল প্রভেদ এইমাত্র মনে হয়, এখানে গ্রীষ্মকালের যেন অন্ত নাই। গাছের ফাঁকে-ফাঁকে, পদক্ষুন্ন-পথবিশিষ্ট সুন্দর শাদল-ভূমির উপরে—আকাশের যে অংশ তরুশাখায় ঢাকা পড়ে নাই, সেই নভোদেশে—এমন কি সর্ব্বত্রই এখন আলোকে আলোকময়।
এই সময় কীটদিগের সুতীব্র নৈশ সঙ্গীতে চতুর্দিক অনুরণিত হইলেও, যতই আমি অরণ্য-গভীরে প্রবেশ করিতেছি, ততই যেন নিস্তব্ধতার মধ্যে ক্রমশ মগ্ন হইয়া যাইতেছি। আমি এখানে একাকীই বিচরণ করিতেছি। জ্যোস্নালোকে যে ছায়া দেখিয়া এখানকার লোকেরা ভয় পায়, আমি সেই মন্দির-চূড়ার প্রকাণ্ড ছায়ার অভিমুখে একাকীই অগ্রসর হইতেছি। পুরোহিত ও রাজাদিগের অপছায়ার ভয়ে, আমার পথ-নেতা আমার সঙ্গে আসে নাই। যখন আমি এখানকার একটি মন্দিরে আসিয়া পৌঁছিলাম, তখন উহার প্রকাণ্ড দাগোবার নিকট যাইবার উদ্দেশে, যে পার্শ্বে জ্যোৎস্না পড়িয়াছে, আমার স্বাভাবিক প্রবৃত্তির উচ্ছাসে, আমি সেই অংশটিই আপনা হইতেই বাছিয়া লইলাম।
এই পরিসর-স্থানটুকু প্রেতাত্মার বিচরণভূমি বলিয়াই যেন বোধ হয়। চারি দিকেই সারি সারি স্তম্ভ। এইখানে বিচরণ করিতে করিতে হঠাৎ একটা পাথরের টালির উপর পা পড়ায়, সেই শব্দে চারি দিক প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। তখন দেখিলাম, ভগ্নাবয়ব দেবদেবীর মূর্তির মধ্যে, বেদিকা প্রভৃতির ভগ্নাবশেষের মধ্যে আমি আসিয়া পড়িয়াছি;—সমস্তই নীল আলোকে প্লাবিত।
নিস্তব্ধ অনুরাধপুরের মধ্যে, এখানকার নিস্তব্ধতায় কি যেন একটু বিশেষত্ব আছে; এখানকার লোকদিগের ন্যায় ভয়গ্রস্ত হইয়া আমি থমকিয়া দাড়াইলাম; দাগোবার চারি দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতে সেই ভীতিজনক ছায়াময় প্রদেশে প্রবেশ করিতে আমার আর সাহস হইল না।
যাহা হউক, যে সকল রাজা—যে সকল পুরোহিত এই মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা এখন কোথায়?—কোন্ নির্ব্বাণের মধ্যে, কোন্ ধূলিরাশির মধ্যে তাহারা এখন অবস্থিত? তবে সেই দূর দেশ হইতে তাহাদের অপচ্ছায়া এখানে আসিবে কি করিয়া?
তা ছাড়া আমার মনে হইতেছে, যে ধর্ম্মে তাহারা বিশ্বাস করিতেন, সেই বৌদ্ধ ধর্ম্ম- এখন মৃত,—এখানকার ভগ্নাবশেষের মধ্যে—পুত্তলিকা- দিগের পুরাতন ভস্মের মধ্যে উহা বিলীন হইয়া গিয়াছে।