ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/ত্রিবঙ্কুর-মহারাজের রাজ্যাভিমুখে
ত্রিবঙ্কুর-মহারাজের রাজ্যাভিমুখে।
এখন সন্ধ্যা। এই সময়ে সূর্যাস্তের পরেই সুস্নিগ্ধ প্রশান্তি ও মধুর শৈত্য কোথা হইতে যেন সহসা আবির্ভূত হয়। কিয়ৎকালের জন্য আমি এই ক্ষুদ্র অনাদৃত পলঙ্কটা-গ্রামে বিশ্রাম করিতেছি। এইখানেই আজ রাত্রিযাপন করিতে হইবে।
এই দিবাবসানসময়ে, এই তরুতলে, এই নিস্তব্ধতার মধ্যে, আমি আজ সর্ব্বপ্রথমে বাস্তবিকই দূরদেশে আসিয়াছি বলিয়া অনুভব করিতেছি।
আমি ফ্রান্স হইতে ডাক-জাহাজে করিয়া, হরিৎ-শ্যামল আর্দ্রভূমি সিংহলদ্বীপে প্রথম উপনীত হই। সেইখানে সপ্তাহকাল থাকিয়া, পরে উপকূলগামী একটা জঘন্য জাহাজে উঠিয়া, গতরাত্রে ম্যানার-উপসাগর পার হইয়াছি। সেইখানকার সমুদ্র যেন অষ্টপ্রহর টগবগ করিয়া ফুটিতেছে। তাহার পর, সমস্তদিন শকটে আরোহণ করিয়া, খুব শীঘ্র এই গ্রামে আসিয়া পৌছিয়াছি। ত্রিবঙ্কুরাধিপতি আমার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি লোক পাঠাইয়াছিলেন। তিনি আমার জন্য, সুনিবিড় তরুপল্লবের ছায়াতলে একটি ছোট শাদা বাড়ী ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন—সেইখানে আমাকে লইয়া গেলেন।
আগামী কল্য গরুর গাড়ি, করিয়া ত্রিবন্ধুর-রাজ্যের অধিকারভুক্ত একটি প্রদেশে উপনীত হইব। সেইখান হইতে আমার যাত্রা আরম্ভ হইবে। লোকে এই প্রদেশটিকে “খয়রাৎ-মহল”ও বলিয়া থাকে। আমার এই প্রদেশটিকে সুখশান্তির আশ্রম বলিয়া মনে হয়। বর্ত্তমানশতাব্দীসুলভ বিলাসবিভবের সহিত ইহার কোন সম্পর্কই নাই;—পার্শ্ববর্ত্তী প্রদেশসমূহ হইতে একেবারে বিচ্ছিন্ন, লোকবিরল, তাল নারিকেল প্রভৃতি তরুমণ্ডপের ছায়াতলে অবস্থিত। রাত্রি হইয়া আসিতেছে; গ্রীষ্মকালের অতি সুন্দর রাত্রি, কিন্তু চন্দ্রহীন। সেই লোকটি ব্রাহ্মণমন্দিরের দীপালোক দেখাইবার জন্য আমাকে শকটে করিয়া লইয়া গেল। এই মন্দিরটি “তৃণবল্লী”-নামক পার্শ্ববর্ত্তী নগরে অবস্থিত। দাক্ষিণাত্যের মন্দিরগুলির মধ্যে ইহা সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ। শকটের বাহনেরা সহজ দুলকি-চালে চলিতেছে। আমরা রহস্যময় তরুপুঞ্জের মধ্য দিয়া চলিয়াছি; আমাদের মস্তকোপরি শ্যামল পল্লবজাল প্রসারিত; সেই সকল বৃক্ষের শাখাপ্রশাখা হইতে শিকড় বিস্তৃত হইয়া আবার তাহাদের সহিত যেন মিলিবার চেষ্টা করিতেছে। তরঙ্গিত শিকড়- জাল সুদীর্ঘ কেশগুচ্ছের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে। পল্লবপুঞ্জের উপরে, পল্লবের ফাঁকে-ফাঁকে আকাশের অযুত তারা, এবং নিম্নতলে এমন কি, তৃণভূমির উপরেও—অসংখ্য জোনাকি ঝিক্মিক্ করিতেছে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে, প্রতি সন্ধ্যায়, আতসবাজির স্ফুলিগবৎ এই কীটগুলি জ্বলিতে থাকে। তারকা ও জোনাকির স্ফুলিঙ্গঙ্গজ্যোতি এরূপ পরস্পরের সহিত মিশিয়া গিয়াছে যে, উহার মধ্যে কোন্টি জ্যোতিষ্ক ও কোটি জ্যোতিরিঙ্গণ, তাহা নিরূপণ করা দুষ্কর।
সিংহলের অবসাদজনক আর্দ্রবায়ু ত্যাগ করিয়া, এইখানে আবার স্বাস্থ্যকর শুষ্কবায়ুর মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি। ফ্রান্সের গ্রীষ্মকালীন সুন্দর রাত্রির মত,এখানে আবার সেইরূপ সুখস্পর্শ অনিল, নিশ্বাসের সহিত গ্রহণ করিতেছি; এবং জুনমাসে ফ্রান্সের পল্লীগ্রামে যেরূপ শুনা যায়, এখানেও সেইরূপ ঝিল্লীসঙ্গীত চারিদিক হইতে শুনিতেছি। কিন্তু এই সকল পথে যে পথিকলোকের সহিত সাক্ষাৎ হইতেছে, তাহারা আমাদের চক্ষে অদ্ভুত; —এই সকল তাম্রমূর্ত্তি পথিকেরা নিঃশব্দে খালি-পায়ে চলিয়াছে। তাহাদের স্কন্ধের উপর মলমলের উত্তরীয়। মধ্যে-মধ্যে, দূর হইতে যখন ঢাক-ঢোলের শব্দ অথবা শানাইযন্ত্রসমুখিত আর্তনাদের আলাপ শুনিতে পাই, তখনি ঠিক বুঝিতে পারি, এটি পৃথিবীর কোন্ বিভাগ; তখনি ইহাকে ভারত বলিয়া, ব্রাহ্মণের দেশ বলিয়া চিনিতে পারি; আর তখনি বুঝিতে পারি, আমাদের দেশ হইতে এই স্থানটি কতটা দূর॥
তরুতিমিরের মধ্যে, ছোট ছোট শাদা বারাণ্ডাওয়ালা বাড়ী পথের দুইধারে দেখা দিতে শুরু করিয়াছে; যেখানে আমাদের যাইবার কথা, সেই তৃণবল্লী-নগরে ইহারই মধ্যে আমরা আসিয়া পড়িয়াছি। পথের দুইধারে তালজাতীয় বৃক্ষশ্রেণী;—ভঙ্গুর বৃন্তের উপর ভর করিয়া আকাশে যেন কালে-কালো পাখা বিস্তার করিয়া আছে। এই তরুপথটি যেখানে শেষ হইয়াছে, সেইখানে একটি ছায়াচিত্র অঙ্কিত দেখিলাম। এই ছায়াচিত্রটি একটু বিশেষ ধরণের, অতীব নয়নাকর্ষক। ইহা একটি প্রকাণ্ড মন্দির। ভারতবর্ষে যে কখনো আসে নাই, সে-ও ইহাকে মন্দির বলিয়া চিনিতে পারে; কেন না, চিত্র-প্রতিমূর্তি-আদি দেখিয়া, পূর্ব্ব হইতেই উহাদের আকারসম্বন্ধে সকলেরই কিছু-না-কিছু অস্পষ্ট ধারণা থাকে। কিন্তু ঈদৃশ প্রকাণ্ড মন্দির সহসা নৈশগগনে সমুথিত দেখিব, ইহা কখন কল্পনা বা প্রত্যাশা করি নাই। ইহা যেন রাশীকৃত দেবমূক্তির একটা প্রকাণ্ড শুপ; ইহার চূড়াদেশও বিকটাকার মূর্তিতে আকীর্ণ। অসংখ্য তারকাদীপ্ত: আকাশপটের উপর এই ছায়চিত্রের কৃষ্ণবর্ণ-রেখাপাত হইয়াছে।
একটু পরেই আমাদের গাড়ি, একটি প্রস্তরময় পিলানমণ্ডপের মধ্য দিয়া সেকেলেধরনের গুরুভার সমচতুষ্কোণ স্তম্ভশ্রেণীর মধ্যে প্রবেশ করিল। মন্দিরের এই অগ্রবর্তী প্রদেশটি অতিক্রম করিয়া, আবার যখন আমাদের মস্তকোপরি তারকা-মণি-খচিত গগনাম্বর প্রসারিত হইল, তখন দেখিলম, একটা বিপুল ঘেরের সম্মুখে আসিয়া পড়িয়াছি। তাহার সীমা লঙ্ঘন করিবার আমাদের অধিকার নাই। সেই প্রকাণ্ড মন্দিরটি একেবারে আমাদের সম্মুখে—খুব নিকটে। সেই বিসদৃশপরিমাণযুক্ত মহাভারাক্রান্ত প্রকাণ্ড মন্দিরচূড়ার নিম্ন দিয়া একটি পথ গিয়াছে—তাহার মধ্যে আমাদের প্রবেশাধিকার নাই। কিন্তু সেই প্রবেশপথের মুখটি এত বড় যে, সেখান হইতে অভ্যন্তরস্থ দেবমণ্ডপের সুদূর পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত আমার দৃষ্টিগোচর হইতেছে। সেই পবিত্র অন্ধকারের মধ্যে, মন্দিরমণ্ডপের দুই ধারে অসংখ্য রহস্যময় দীপাবলী সারি-সারি সজ্জিত। সেখান হইতে দেখিতে নিষেধ নাই; কিন্তু তাহাও বেশিক্ষণের জন্য কিংবা খুব নিকটে গিয়া দেখা নিষিদ্ধ।
এই সুদূরপ্রসারিত প্রবেশপথের প্রত্যেক দিকে মণ্ডলাকারে-বিন্যস্ত স্তম্ভশ্রেণীর নিম্নে, ছোট-ঘোট মশালের আলোকে, দেবতাদের ব্যবহারের জন্য ফুলের দোকান, মালার দোকান, মিষ্টান্নের দোকান বসিয়াছে। এই মশালের আলোকে, দোকানদারদিগকে এবং মন্দিরের প্রস্তরময় তলদেশটি বেশ দেখিতে পাওয়া যাইতেছে। সেই প্রস্তরে বিকটাকার বিবিধ মূর্ত্তি, অদ্ভুতকার জীবজন্তুর মূর্তি খোদিত, কিন্তু সেই মূর্তিগুলি ক্ষয়গ্রস্ত ও বিলুপ্তমুখশ্রী। ঐ সকল দোকানদারেরাও দেবমূর্ত্তিবৎ অচল। উহাদের শ্যামল নগ্নগাত্র ঐ সকল লাল পাথরের উপর ঠেস দিয়া রহিয়াছে; নেত্রগুলি জলজল করিতেছে; এবং উহাদের রমণীসুলভ সুদীর্ঘ কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ স্কন্ধের উপর লইয়া পড়িয়াছে। উপরে থামগুলির মাথায়, খিলানমণ্ডলের সমীপবর্ত্তী স্থানে অন্ধকার একাধিপত্য করিতেছে।
মণ্ডপের সুদূর পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত আমি অলক্ষিতভাবে এখান হইতে সমস্ত দেখিতেছি। অফুরন্ত সারি সারি স্তম্ভ অস্পষ্টরূপে উপলব্ধি হইতেছে। ক্ষীণপ্রভ দীপাবলী ঘনঘোর অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন হারাইয়া গিয়াছে। সুদূর প্রান্তে শুভ্রবসন মনুষ্যমূর্ত্তিসকল বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করিতেছে। এবং ঐ স্থানটি স্তুতিপাঠে ও গানকীর্তনে মুহুর্মুহু অনুরণিত হইতেছে।
যে নিষিদ্ধ দ্বার দিয়া আমি লুকাইয়া দেখিতেছি, তাহার গঠন অতি অপূর্ব;একেবারেই বাস্তুবিদ্যার অপরিজ্ঞাত। দ্বারের প্রকোষ্টটি খুব বড়। কিন্তু এতাদৃশ প্রকাণ্ড গগনস্পর্শী চূড়ার তুলনায়, মন্দিরের দ্বারটি বড়ই নীচু, এমন কি গুপ্তপথ বলিয়া ও মনে হইতে পারে; মনে হয়, উহা যেন সুরঙ্গপথের দ্বার—রহস্যরাজ্যের প্রবেশপথ।
জীবনের মধ্যে এই সর্ব্বপ্রথম ব্রাহ্মণদিগের একটি মন্দির দেখিয়া আমার মনে হইল, আমি এমন একটা কিছু দেখিলাম, যাহা পৌত্তলিকতার বিষাদ-অন্ধকারে আচ্ছন্ন;—ভীষণ বৈরভাবাপন্ন লোকের দ্বারা পূর্ণ। আমি এইরূপ. দেখিব বলিয়া প্রত্যাশা করি নাই; আর ইহাও ভাবি নাই, মন্দিরে আমার প্রবেশনিষেধ হইবে। আমি কতকটা আশা করিয়াছিলাম, ভারতবর্ষে গিয়া, মহাপূৰ্বপুরুষগণ-অবলম্বিত ধর্ম্মের অন্তস্তলে কিঞ্চিৎ জ্ঞানালোক প্রাপ্ত হইব। কিন্তু এখন আমার সেই চিরপোষিত আশা অতীব শূন্যগর্ভ ও নিতান্ত “ছেলেমানষি” বলিয়া মনে হইতেছে।
আহা! খৃষ্টধর্মের মধ্যে কেমন একটি মন-ভুলানিয়া মধুময় শান্তির ভাব বিরাজিত-সেই ধর্ম্ম, যাহার দ্বার সকলেরই নিকট অবারিত এবং যাহা শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তিদিগেরও হিতসাধনে সতত নিযুক্ত।...
এখন আমাকে সকলে এইরূপ আশ্বাস দিতেছে, ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশে, দেবালয়ের মধ্যে এতটা দারুণ কঠোরতা লক্ষিত হইবে না, এমন কি-সেখানকার দেবালয়ে হয় তো আমি প্রবেশ করিতেও অনুমতি পাইব। যাহা হউক, এইবার এইখান হইতে সরিয়া পড়াই ভাল-বেশিক্ষণ থাকাটা সুবুদ্ধির কাজ নহে। কিন্তু যদি ইচ্ছা করি, গাড়িতে থাকিয়া আস্তে-আস্তে এই বৃহৎ মন্দিরের চারিদিক প্রদক্ষিণ করিতে পারি—তাহাতে কোন বাধা নাই।
মন্দিরের ঘেরটা সমচতুষ্কোণ,—এত বৃহৎ যে, ইহার মধ্যে একটা নগরের সমাবেশ হইতে পারে। ইহার চতুঃসীমার মধ্যস্থল হইতে একটি প্রকাণ্ড স্তূপ সমুখিত—উহার নিম্নদেশে একটি ‘দ্বার ফুটানো আছে। এই সকল মূক প্রাচীর—যাহার ধার দিয়া আমরা নিস্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে চলিয়াছি,“উহা দুর্গপ্রাচীরের ন্যায় কঠোরভাবে খাড়া হইয়া আছে। যে বিজন পথটি আমরা অনুসরণ করিতেছি, উহা সেই পবিত্র গণ্ডিরই সামিল,—যাহার মধ্যে নীচজাতীয় লোকের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এইখানে আর-একপ্রকার প্রকাণ্ড স্তূপের পাশ দিয়া আমরা চলিয়া গেলাম—উহা দৈবক্রমে ঐস্থলে আটকাইয়া পড়িয়াছে। উহাও দেখিতে দেবমন্দিরের ন্যায়—কতকগুলি বিরাট্ চাকার উপর স্থাপিত; পর্ব্ব-উৎসবের দিনে দেবতাদিগকে হাওয়া খাওয়াইবার জন্য সহস্র-সহস্র লোক এই রথগুলিকে টানিয়া লইয়া যায়; রথের চাকা বসিয়া গিয়াছে, তাই আজ রাত্রে দেবতারা মর্ত্ত্যদিগেরই ন্যায় এইখানেই নিদ্রা যাইবেন।
আমাদের দুই ধারে সারি-সারি তালজাতীয় উচ্চবৃক্ষ—উহাদের কালোকালো পাখা ঝুঁকিয়া রহিয়াছে; যে সময়ে আমরা এই তরুবীথির মধ্য দিয়া চলিয়া আসিলাম, সেই সময়ে ভক্তির প্রচণ্ড উন্মত্ত উল্লাস চারিদিকে উচ্ছসিত হইতেছিল, সেই সময় ধর্ম্মের কতকগুলি বিশেষ অনুষ্ঠানের উদ্যোগ চলিতেছিল। এই প্রশান্ত সুন্দর রাত্রিতে, গহ্বর-গভীর ঢাকের শব্দ, তূরীর পৈশাচিক নিনাদ আমাদের পশ্চাতে শুনা যাইতেছে; সে এরূপ বিকট শব্দ যে, শুনিয়া সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠে।
এখনো আমরা পলঞ্চটাগ্রামে। মশকপতঙ্গাদি তাড়াইবার জন্য তাম্রমুর্তি ভৃত্যগণ সমস্ত রাত বড়-বড় হাতপাখায় আমাকে বাতাস করিয়াছে।
এক্ষণে এই বহুপুরাতন সৌধধবল ক্ষুদ্র বাড়ীর মধ্যে অরুণ-কিরণ প্রবেশ করিয়াছে; হাস্যময়ী উষার প্রভায় গৃহটি উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছে। সূর্যোদয়ে সূর্যের দীপ্যমান মহিমার মধ্যে আমি জাগ্রত হইলাম।
শিশিরসিক্ত বারণ্ডাটি এখনো বেশ ঠাণ্ডা। এটি সুন্দর বসিবার স্থান। ঝরাটি সৌধপ্রলেপে তুষারশুভ্র। উহার মোটা-মোটা খাটো-খাটো অসমান (অনিচ্ছাকৃত) থামগুলি চামেলি-লতায় ঘেরা। চতুর্দ্দিকে মাঠ-ময়দান, গ্রাম্য নিস্তব্ধতা, বিমল প্রাভাতিক শান্তি। যদিও অত্রস্থ প্রকৃতিসুন্দরী একটু তাপদগ্ধা, শরতের প্রভাবে গুফতানিবন্ধন একটু অবসাদক্লিষ্টা, তথাপি এখানকার আলোকরশ্মি দক্ষিণফ্রানসের সুন্দরতম প্রভাতকিরণের ন্যায় দিব্য প্রশান্ত। এখানে বড় বড় তালজাতীয় বৃক্ষ নাই; অথবা সিংহলের ন্যায় উদ্দাম উদ্ভিজ্জের প্রাচুর্য নাই। অস্মদ্দেশীয় অরণ্যের ন্যায় এখানকার বৃক্ষগুলি অনতি-উচ্চ ও বিরলপল্লব। ছিন্নতৃণ মাঠ-ময়দান, ফলের বাগান, ছাঁটা-ঘাসের উপর অঙ্কিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পায়ে-চলা পথ, দূরে বৃক্ষশাখার মধ্য হইতে পরিদৃশ্যমান চুন্ামকরা ছোেট ছোট প্রাচীর, সুধাধবল, ছোট-ছোট বাড়ী—এই সকল আমি অবলোকন করিতেছি, এবং আমার শৈশবের সুপরিচিত দৃশ্যগুলি আবার আমার চতুর্দ্দিকে দেখিয়া বিস্মিত হইতেছি।
যে চড়াইপাখি আমাদের গৃহছাদে নীড় নির্ম্মাণ করে, সেই নিতান্ত গ্রাম্য পাখীগুলাও এখানে আছে দেখিতেছি। কেবল এইমাত্র প্রভেদ, ভারতের জীবজন্তুমাত্রেরই মানুষের উপর যেরূপ অগাধ বিশ্বাস, ইহাদেরও তদ্রুপ; মানুষ নিকটে গেলে উহারা পলায় না।
আমি দেখিতে পাইতেছি, স্বদেশসাদৃশ্যজনিত বিস্ময় যেন আমার জন্য এদেশে স্থানে স্থানে সঞ্চিত রহিয়াছে। এই ভরপূর শীতের সময়ে, আমাদের গ্রীষ্মদেশের শোভাসৌন্দর্য্য এখানে সম্ভোগ করিতেছি।...
আমি যে ভারতবর্ষে আছি, এই জ্ঞানটি আমার অন্তরের অন্তস্তলে জাগরূক থাকিলেও, যখনি আমি এখানকার কোন অনাদৃত জনবিরল স্থানে আসিয়া উপস্থিত হই, তখনি একপ্রকার মধুর বিস্ময়সহকারে জন্মভূমিসম্বন্ধীয় বিবিধ বিভ্রমের হস্তে আপনাকে ছাড়িয়া দিই।
এই সকল ছোট-ছোট শাদা প্রাচীর, চামেলি-লতা,হলদে-রং-ধরা ঘাস, শরৎঋতুসুলভ বিচিত্র রং— এই সমস্ত স্বদেশকে স্মরণ করাইয়া দেয় ও মন ব্যাকুল হইয়া উঠে। তখন সেই Aunis,—সেই La Saintonge-র মাঠ-ময়দান, আঙুর পাকিবার সময়ে,—সেই কনকোজ্জ্বল-ঋতুকালে, Pleron-দ্বীপের সেই শান্তিময় বাড়ীগুলি, আমার মনে পড়ে।
কিন্তু আবার, মধ্যে মধ্যে অনেক ছোটখাটো জিনিষ পথিমধ্যে উপস্থিত হইয়া আমার এই স্বপ্নের ব্যাঘাত করে। ঐ দেখ, ছয়বৎসরবয়স্কা একটি ছোট বালিকা, আমাকে একটা সংবাদ দিবার জন্য, নিজগ্রাম হইতে প্রেরিত হইয়া এইখানে আসিয়াছে। ইহার কালো রহস্যময় চোখদুটি দীর্ঘায়ত; ইহার নাক্ ফুঁড়িয়া চুনি-বসানো একটি সোনার মাক্ড়ি আছে; চুনিগুলি দেখিতে শোণিতবিন্দুর ন্যায়।
দূরে, আমাদের বাড়ীর সংলগ্ন শান্তিময় প্রাকৃতিক দৃশ্যটিকে উদ্বেজিত করিয়া কি-একটা অদ্ভুত জিনিষ গাছের মধ্য হইতে বাহির হইয়াছে;—ব্রাহ্মণিক দেবালয়ের একটি কোণ,—দেবতা ও রাক্ষসাদির মন্দিরস্থ একটি কোণ। মন্দিরটি বিষ্ণুদেবের—গাছপালায় ঢাকা পড়িয়াছে।
তরুগণের ছায়াসত্ত্বেও, মধ্যাহ্নের সূর্য্য আমাদের এই শাদা বাড়ীটির উপর বাস্তবিকই একটু অতিরিক্ত-পরিমাণে আলোক ও উত্তাপ বর্ষণ করিতেছে।
ছোট-ছোট ফলবাগানের উপর আলো পড়িয়াছে—খুব উজ্জ্বল আলো পড়িয়াছে। আমাদের সেপ্টেম্বরমাসের দীপ্ততম মধ্যাহ্নও এখানে হার মানে।
চারিদিক্ই নিস্তব্ধ। মেঠো-ঘাসের পথে আর কোন পথিক নাই। বড়বড় হাতপাখাগুলা এখন ঘুমাইতেছে; যে সকল ভারতীয় ভৃত্য ঐ সকল পাখা ব্যজন করিয়া থাকে, তাহারাও ঘুমাইতেছে। সব চুপ্চাপ। কোথাও টুঁ শব্দ নাই। কেবল কতকগুলা দাঁড়কাক—যাহাদের দিবানিদ্রা নিষিদ্ধ—তাহারাই আমার কামরায় প্রবেশ করিয়া আমার চারিদিকে কা-কা-শব্দ করিতেছে। এই সকল নিষ্পন্দ পদার্থের মধ্যে, উহাদেরি নাচুনি-চালের পদশব্দ এবং উড়িবার পক্ষসঞ্চালনশব্দ ভিন্ন আর কিছুই শোনা যায় না।…
হঠাৎ মনে পড়িল—খৃষ্টজন্মোৎসবের দিন আসন্ন; অমনি এখানকার এই চিরনির্ম্মল আকাশ—চীরগ্রীষ্মঋতু আমার কল্পনার উপর যেন ঘনঘোর বিষাদ ঢালিয়া দিল।
এইবার একে-একে আমার যাত্রার গাড়িদুটি আসিয়া পৌঁছিল। এখান হইতে ত্রিবঙ্কুরে যাইতে প্রায় দুইদিন লাগিবে। সেইখানে যাইবার জন্য আমার মন উৎসুক হইয়া উঠিয়াছে। এই দেশীয় শকটগুলি সুদীর্ঘ “কফিনে”র (শবাধার) ন্যায়। পিছন দিক্ দিয়া উহাতে ঢুকিতে হয়; এবং পর্য্যটনকালে বাধ্য হইয়া উহার মধ্যে শুইয়া থাকিতে হয়। উহাদের বৃষবাহনেরা দুল্কিচালে নাচিতে নাচিতে চলে। আমার গাড়ির বৃষযুগল শাদা; উহাদের শিং নীলরঙে রঞ্জিত। ভৃত্যদের গাড়ির বৃষদুটি কপিশ রঙের; এবং উহাদের শিং তাঁবা দিয়া বাঁধানো।
এখনও সূর্য্য অস্ত যায় নাই। ইত্যবসরে, আমাদের চারিটি নিরীহ শান্ত অলস বৃষ তৃণভূমির উপর সটান শুইয়া পড়িয়াছে।