ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/ত্রিবঙ্কুর-রাজ্যে
তিনঘটিকার সময় এখান হইতে যাত্রা করিলাম। এখন সূর্য্যের তাপ আরও প্রখর হইয়া উঠিয়াছে। শকটের ভিতরে মাদুর ও শতরঞ্জি পাতা। ছাদ এত নীচু যে, সিধা হইয়া বসিবার যো নাই; কাজেই, আহত ব্যক্তির ন্যায় পা ছড়াইয়া শুইয়া রহিলাম। গাড়ির বলদেরা দুল্কি-চালে নাচিতে-নাচিতে চলিতে লাগিল। এইভাবে দুইরাত্রি অবিরাম চলিলে আমার নিদ্রার বিলক্ষণ ব্যাঘাত ঘটিবে। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় আমার বাহন ও বাহক বদলি হইবে। সমস্ত পথটায়, ডাকের গাড়ির বন্দোবস্ত আছে। এখন যেখানে আমি আছি—এই পূর্ব্বভারত, আর যেখানে যাইতেছি—সেই ত্রিবঙ্কুররাজ্য, এই উভয়ের মধ্যবর্ত্তী এই যে যাতায়াতের পথ—এটি দক্ষিণদিক্ দিয়া চলিয়া গিয়াছে। এই সুখের “খয়রাৎ-মহলে” এখনও রেলপথ হয় নাই যে, তদ্দ্বারা পরান্নজীবিদিগের আমদানি হইবে, কিংবা উহার ধনধান্য বিদেশে চলিয়া যাইবে। উত্তর দিক্ দিয়া, খালপথে নৌকাযোগে, ক্ষুদ্ররাজ্য কোচিনের সহিত উহার যোগাযোগ আছে। এই খাল-বিল অনেকগুলি। তা ছাড়া, আত্মরক্ষণ-উপযোগী ইহার কতকগুলি প্রাকৃতিক সুবিধা ও আছে,—তদ্দ্বারা বাহিরের সংস্পর্শ হইতে স্থানটি সুরক্ষিত।
ইহার পশ্চিমে বন্দরহীন সমুদ্র, দুরধিগম্য সৈকতবেলাভূমি—যাহার উপর ফেনময় তরঙ্গরাজি অবিরাম ভাঙিয়া পড়িতেছে। যাহা ভারতের একপ্রকার মেরুদণ্ড বলিলেও হয়,—সেই “ঘাটের”র গিরিমালা পূর্ব্বদিকে অবস্থিত;—উহার শৈলচূড়া, উহার অরণ্য, উহার ব্যাঘ্রাদি হিংস্রজন্তু, কতকটা প্রহরীর কার্য্য করিতেছে।
আমার গাড়ীর বলদদুটি কখন দুল্কি-চালে, কখন বা ছুটিয়া চলিতেছে। যেই একটা গ্রাম পার হইতেছি, অমনি আবার দীর্ঘপথ আরম্ভ হইতেছে —বৈচিত্রহীন, অফুরন্ত। সূর্য্য জলন্ত কিরণ বর্ষণ করিতেছে। পথের দুই ধারে যে বৃক্ষগুলি সারি-সারি চলিয়াছে, উহা দেখিতে কতকটা আমাদের আখ্রোট্ ও “অ্যাশ্”-গাছের মত। যেগুলিকে আখ্রোট্-গাছের মত বলিতেছি উহা আসলে তরুণ বটবৃক্ষ,—কালসহকারে প্রকাণ্ড হইয়া উঠিবে। শিকড়ের জটা স্থানে-স্থানে বাহির হইতে সুরু করিয়াছে; উহার ফ্যাঁক্ড়াগুলি মাটির দিকে নামিতেছে; তাহা হইতে আবার নূতন ফ্যাঁক্ড়া বাহির হইয়া চারিদিকে বিস্তৃত হইবে।
এই দুই-সারি, বৃক্ষের মধ্য দিয়া আমরা সুবিস্তৃত কান্তারভূমি অতিক্রম করিয়া চলিয়াছি। মধ্যে-মধ্যে বিরলসন্নিবেশ তাল-নারিকেল দৃষ্ট হইতেছে।
দেখিবার জন্য ও নিশ্বাস ফেলিবার জন্য গাড়ির পার্শ্বদেশে ছোট-ছোট রন্ধ্র-জান্লা আছে। পশ্চাদ্ভাগে ছোট একটি গোল দরজা, তাহার মধ্য দিয়া, মাথা হেঁট করিয়া, এই সচক্র শবাধারের মধ্যে প্রবেশ করিতে হয়।
আমার গাড়ির প্রায় গা ঘেঁষিয়া, ঠিক পিছনে, আমার চাকরবাকরদিগের ও জিনিষপত্রের গাড়িটি চলিয়াছে। যে দুইটি দীর্ঘকায় নিরীহ বলদ ঐ গাড়ি টানিতেছে, উহারা আমার খুব নিকটবর্ত্তী; আমি গাড়ির মধ্যে শুইয়া সর্ব্বদাই দেখিতে পাই, বলদ-দুটি যেন আমার পা ছুঁইয়া রহিয়াছে। উহার কি নিরীহ জানোয়ার! চালক উহাদের শুধু নাকে দড়ি দিয়া চালাইতেছে; পাছে অনিচ্ছাক্রমেও কাহারো অনিষ্ট হয় তাই যেন উহাদের শিং-দুটি ও পিছনদিকে পিঠের দাঁড়ার উপর বাঁকিয়া পড়িয়াছে। গাড়ির চালক নগ্নপ্রায়, তাম্রবর্ণ; আশ্চর্য্যরূপে দেহভার রক্ষা করিয়া, সঙ্কীর্ণ যুগকাষ্ঠের উপরে উবু হইয়া বসিয়া, বাহুদুটি হাঁটুর উপর রাখিয়াছে; আর, একটা বেতের চাবুক দিয়া বলদদিগকে প্রহার করিতেছে; কিংবা বানরগুলা রাগিলে যেরূপ শব্দ করে, সেইরূপ মুখের শব্দ করিয়া উহাদিগকে উত্তেজিত করিতেছে।
কান্তারভূমি, একটার-পর-একটা ক্রমাগত আসিতেছে; যতই অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতেছি, ততই যেন কষ্টকর—এমন কি—অসহ্য হইয়া উঠিতেছে। দূর-দূরান্তরে, কোথাও বা ছোটখাটো ধানের ক্ষেত, কোথাও বা ছোটখাটো কার্পাসের ক্ষেত দেখা যাইতেছে; নতুবা আর সমস্তই মরু—কেবলই মরু—সায়াহ্নসূর্য্যের বিষাদম্লান কিরণচ্ছটায় আলোকিত।
দিগন্তগগনে “ঘাটে”র গিরিমালা অঙ্কিত; উহা যেন ত্রিবঙ্কুররাজ্যের প্রাকারাবলী। আজ আমরা রাত্রে, একটি যার-পর-নাই সঙ্কীর্ণ সুঁড়িথ দিয়া ঐ প্রাকার উল্লঙ্ঘন করিয়া যাইব।
সিংহলের বৃষ্টিবর্ষা ও হরিৎ-শ্যামল ক্ষেত্রাদি দেখিয়া-আসিয়া তাহার পর এই সকল শুষ্কভূমি দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়—উহাতে একটি তৃণও জন্মায় না। শাদাটে রঙের গুঁড়ি—এইরূপ কতকগুলি অদ্ভুত তালজাতীয় বৃক্ষ ইতস্তত একাকী দণ্ডায়মান;—উহাদিগকে উদ্ভিজ্জরাজ্যের সামিল বলিয়াই মনে হয় না। সোজা, মসৃণ, প্রকাণ্ড-উচ্চ খোঁটার মত, তলদেশ স্ফীত, তাহার পরেই চরকা-কাঠির ন্যায় হঠাৎ সরু হইয়া ঊর্দ্ধে উঠিয়াছে। উহাদের অতিদীর্ঘ কাণ্ডের অগ্রভাগে, জ্বালাময় গগনের উচ্চদেশে, শুষ্ক-কঠোর ছোট ছোট একএকগুচ্ছ তালপত্র রহিয়াছে। এই শুষ্কশীর্ণ তরুদিগের ছায়া-চিত্রগুলি, বরাবর রাস্তার দুইধারে, বিষাদম্লান দিগন্তরেখা পর্য্যন্ত—স্থানে স্থানে দেখিতে পাওয়া যায়। দুই-সারি তরুণ বটবৃক্ষের মধ্য দিয়া এই যে পথটি গিয়াছে, ইহার মধ্যে জনমানব দৃষ্টিগোচর হয় না। মনে হয়, যেন এই পথটি ধরিয়া চলিলে আমরা কোথাও গিয়া উপনীত হইব না। অবসাদজনক উত্তাপ, তালে-তালে অল্প-অল্প ঝাঁকানি, ক্রমাগত গাড়ির একঘেয়ে ক্যাঁচ্ক্যাঁচ্ শব্দ। এই সবে আমার তন্দ্রা আসিল—আমার চিন্তাপ্রবাহ ক্রমশ তমসাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।
প্রায় ৫ ঘটিকার সময় রাস্তার উপর দিয়া অদ্ভূত-ধরণের চারিজন পথিক চলিয়া গেল। আমার চক্ষু এখনো তন্দ্রাবেশে প্রায় অর্দ্ধনিমীলিত; তা ছাড়া, এই একঘেয়ে পথে কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না—তাই হঠাৎ যখন চারিটি মনুষ্যমূর্ত্তি দেখিলাম, তখন ইহাই একটি গুরুতর ঘটনা বলিয়া আমার নিকট প্রতিভাত হইল। ইহারা দীর্ঘকায় পুরুষ—লম্বা পা ফেলিয়া দ্রুত চলিতেছে; নগ্ন গাত্র, একটা শাদা ও লালরঙের ধুতি-পরা, মাথায় একটা লাল পাগ্ড়ি। এই বিজন কান্তারের মধ্য দিয়া এই অজ্ঞাত ব্যক্তিগণ, এইরূপ উজ্জ্বলবেশে, এত দ্রুতপদে, না জানি কোথায় যাইতেছে?
পরে, অল্পে অল্পে, ধীরে ধীরে, এই “ঘুপসি” দম্-আট্কানিয়া শয্যাকক্ষের মধ্যে নিদ্রাদেবী আবির্ভুত হইয়া আমার ‘সংজ্ঞা হরণ’ করিলেন—চারিদিকে কি হইতেছে, আমি আর কিছুই জানিতে পারিলাম না।
একঘণ্টা পরে, সন্ধ্যার সময়, জাগিয়া-উঠিয়া মুমূর্ষু দিবসের অন্তিম ছবিটি দর্শন করিলাম।
দেখিলাম, “ঘাটের” গিরিমালা হঠাৎ যেন আমার পার্শ্ববর্ত্তী হইয়াছে—যেন এক লম্ফে ৪॥০ক্রোশ পথ লঙ্ঘন করিয়া আসিয়াছে। পশ্চিমদিকের সমস্ত সমভূমি এই গিরিমালায় অবরুদ্ধ।
অস্তমান সূর্য্যের লোহিত কিরণে দিগন্তপট এখনো অনুরঞ্জিত। ঐ লোহিত দিগন্ত-পটের উপর, এই সুনীল গিরিকায় কেমন পরিস্ফুটরূপে প্রকটিত। উহার শৈলচূড়াগুলির আকার ভারতবর্ষীয় ধরণের; দেখিতে কতকটা মন্দিরাদির চূড়া ও গম্বুজের মত।
সরু-সরু খুঁটির মত তালগাছ, আর কঠোরদর্শন মুসব্বর-তরু—এখানকার এই একমাত্র বৃক্ষ, মৃত্তিকা হইতে ঊর্দ্ধে উঠিয়াছে; যাহা-কিছু আলো এখনো অবশিষ্ট আছে, সেই আলোকে, ম্লানাভ সোনালি-রঙের আকাশের গায়ে, তাহাদের কালো-কালো কাঠিগুলা সর্ব্বত্র প্রসারিত।
হঠাৎ অন্ধকার হইয়া পড়িল। এই অন্ধকার একটু বিষাদরঞ্জিত, কেন না, আজ রাত্রে চাঁদ উঠিবে না।
প্রভাত পর্য্যন্ত এই সঙ্কীর্ণ শবাধারের মধ্যে ঝাঁখানি খাইতে খাইতে কিছুই স্পষ্ট দেখিতে পাই নাই; চক্ষের সমক্ষে সবই যেন বিশৃঙ্খলভাবে প্রতিভাত হইতেছিল।
পথে যাইতে যাইতে, অন্য গরুর গাড়ি যখনি আমাদের সম্মুখে আসিয়া পড়ে, তখনি গোকণ্ঠের ঘণ্টিকাধ্বনি ও লোকজনের কি ভয়ানক চীৎকারই শুনিতে পাওয়া যায়। সেই গাড়িগুলা এত মন্থরগতি যে, আমাদের পথ হইতে সরিয়া যাইতেও তাহাদের অনেক বিলম্ব হয়। মধ্যে মধ্যে বাহন ও চালক “বদ্লি করিবার জন্য, কোন গ্রামের নিকট আমাদের গাড়ি আসিয়া থামিতেছে। গ্রামগুলি রাস্তার ধারে অবস্থিত। গাড়ি হইতে অস্পষ্টরূপে, নিদ্রিত ব্রাহ্মণদিগের আবাস কুটীর দেখা যাইতেছে; সম্মুখে, দেয়ালের কুলুঙ্গিতে, ভূতপ্রেত তাড়াইবার জন্য, ছোট-ছোট নারিকেলতৈলের প্রদীপ জ্বালাইয়া রাখা হইয়াছে।
ভৃত্যেরা আমাকে অভিবাদনপূর্ব্বক জাগাইয়া দিল। এখন প্রভাত; শীতল শান্ত ঊষার ইহাই মধুরতম মুহূর্ত্ত। আমরা এখন নাগরকৈল-গ্রামে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। আজ সমস্তদিন এইখানে থাকিয়া, সূর্য্যাস্ত-সময়ে আবার যাত্রা আরম্ভ করিব। যে পর্ব্বতমালা গতকল্য আমাদের সম্মুখে, অস্তমান সূর্য্যের কিরণ-উদ্ভাসিত লোহিতগগনে অঙ্কিত দেখিয়াছিলাম, আজ তাহা আমাদের পিছনে পড়িয়াছে। এখন দিগন্তদেশ ম্লান-পাটলবর্ণে রঞ্জিত। রাত্রিতে আমরা এই পর্ব্বতমালা পার হইয়া আসিয়াছি,—এখন আমরা ত্রিবঙ্কুররাজ্যে। এই বারাণ্ডা-ওয়ালা বাড়ীটি একটি পান্থশালা; ইহার সম্মুখে আমাদের গাড়ি আসিয়া থামিল। শুভ্রবসনধারী একজন ভারতবাসী দুই হস্তে স্বকীয় ললাট স্পর্শ করিয়া আমার সম্মুখে নতশির হইলেন। ইনি পান্থশালার অধ্যক্ষ। মহারাজের আদেশানুসারে, ইনি আমার বাসের জন্য এই বাড়ীটি ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন।
ভারতীয় অন্যান্য গ্রামের পান্থশালার ন্যায়, এ পান্থশালাটিও সাদাসিধা একতালা গৃহ। তিন-চারিটি শাদা-ধব্ধবে চুনকাম-করা কামরা—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, প্রায় খালি, শুইবার জন্য শুধু কতকগুলি বেতে-ছাওয়া খাট পাতা। সূর্য্যের প্রখর-উত্তাপ-প্রযুক্ত গৃহের ছাদ গৃহ হইতে চারিদিকে খানিকটা বাহির হইয়া আসিয়াছে, আর কতকগুলো মোটা-মোটা খাটো থাম ঐ ছাদকে ধারণ করিয়া আছে।
তাহার পর স্নান; স্নানের পর প্রাতরাশ। এই সময়ে, ব্যগ্রতা-বিরহিত ভৃত্যেরা তালপত্রের পাখা দিয়া আমাকে অলসভাবে বাতাস করিতে লাগিল। তাহার পর মধ্যাহ্নের বিষন্নতা; আলোক-উদ্ভাসিত মহানিস্তব্ধতা। মধ্যে মধ্যে কাকেরা আমার কক্ষ-কুট্টিমের তক্তার উপর আসিমা নাচিয়া বেড়াইতেছে।
দুই ঘটিকার সময় ত্রিবঙ্কুর-মহারাজের দেওয়ানের নিকট হইতে পত্র পাইলাম। তিনি লিখিয়াছেনঃ- আমার যাত্রাপথের ধারে, নৈজেতাবারে-নামক একটি গ্রামে, আমার ব্যবহারের জন্য একটি ঘোড়ার গাড়ী প্রস্তুত থাকিবে। সেখানে যাইতে হইলে, এখান হইতে ১১টা রাত্রে ছাড়িতে হইবে। কিন্তু আমি এখনি ছাড়িব বলিয়া স্থির করিলাম। আজ রাত্রেই সেইখানে গিয়া পৌঁছিব। সূর্য্যাস্তকাল পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিয়া তাহার পর যাত্রা করা—এবং প্রভাত পর্য্যন্ত গাড়িতেই নিদ্রা যাওয়া— ইহাই এখানকার প্রচলিত রীতি। কিন্তু আমি তাহা করিলাম না।
আমি যাত্রা করিতে উদ্যত হইলাম। এই সময়ে সূর্য্যের প্রখর উত্তাপ। পান্থশালার অধ্যক্ষ আমাকে দুই হাতে সেলাম করিতে লাগিল। নীরব যাচ্ঞা মুখে প্রকটিত করিয়া, তাম্রবর্ণ ভৃত্যবর্গ আমার গাড়ির সম্মুখে সারি দিয়া দাঁড়াইল। উহাদের মধ্যে একটি নগ্নপ্রায় দরিদ্র বৃদ্ধা ছিল। ভারতের প্রায় সমস্ত পান্থশালাতেই, স্নানাগারের জলাধারে জল ভরিয়া রাখাই ইহাদের কাজ। ত্রিবঙ্কুরের রৌপ্যমুদ্রা, আজ এই সর্ব্বপ্রথম, এই সব লোকদিগকে আমি নিজহাতে বিতরণ করিলাম। এই ক্ষুদ্র মুদ্রাগুলি, মোটা-মোটা ঝজ্ঝকে গুটিকার মত। আমাদের বলদেরা, এই অবসাদজনক উত্তাপের মধ্যে দুল্কি-চালে চলিতে লাগিল।
ক্রমে ক্রমে, অপেক্ষাকৃত শাখাপল্লববহুল প্রদেশে—এমন কি, স্বকীয় উদ্ভিজ্জ প্রাচুর্য্যে সিংহলেরও সমকক্ষ—এরূপ একটি প্রদেশে উপনীত হইলাম। এই জঙ্গলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুষ্পবৃক্ষে পরিপূর্ণ। উচ্চ তালবৃক্ষের কাণ্ডগুলি গতকল্য পীতাভ ও শুষ্ক দেখিয়াছিলাম; আজ দেখি, এখানে প্রচুর পত্রভূষণে সুশোভিত। বড় বড় হরিৎ-শ্যামল শাখা-পক্ষ বিস্তার করিয়া, নারিকেল-তুরুপুঞ্জ আবার আবির্ভূত হইয়াছে। ভূতল পর্য্যন্ত শিকড়কুন্তল বিস্তার করিয়া, মার্গপার্শ্বস্থ বটবৃক্ষগুলি আমাদের মাথার উপর ছত্রাকারে প্রসারিত। দেখিলে মনে হয়, এই প্রদেশটিতে তরুসমাচ্ছন্ন বিজনতা ও দুর্ভেদ্য জটিল অরণ্য ভিন্ন বুঝি আর কিছুই নাই। কিন্তু এখন ছায়াময় পথে অনেক লোকজন দেখা যাইতেছে। আমাদেরই মত, গরুর গাড়ি চড়িয়া কতকগুলি লোক যাইতেছে। গরুর পাল লইয়া রাখাল এবং দ্রব্যসামগ্রীভরা চুপ্ড়ি মাথায় করিয়া অগণ্য স্ত্রীলোক সারিসারি চলিয়াছে।
ইতস্তত একএকটি ছোট প্রস্তরমন্দির;—বহু পুরাতন—খিলান চ্যাপ্টা-পাথরে গঠিত; ইহাদিগকে মিশরদেশীয় স্মৃতিমন্দিরের ক্ষুদ্র নমুনা বলিয়া মনে হয়।
আবার, প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের তলে, মুসলমান ফকিরের একটি সমাধিস্থান; উহা শুধু বার্দ্ধক্যের বলে পূজাস্পদ হইয়া উঠিয়াছে। উহা টাট্কা ফুলের মালায় সজ্জিত। আর, একটি গজমুণ্ডধারী গণেশমূর্ত্তি দেখিলাম; সেঁউতি ও গোলাপের মালা গাঁথিয়া, কোন ভক্তজন উঁহার কণ্ঠে পরাইয়া দিয়াছে।
ইহা বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয়—অথবা আমার চক্ষেরই ভ্রম—রাস্তায় এতগুলি স্ত্রীলোক দেখিলাম, কিন্তু উহাদের মধ্যে একটিকেও দেখিতে ভাল নয়, অথচ পুরুষেরা অধিকাংশই দেখিতে সুন্দর। পুরুষের মুখে তাম্রবর্ণ যেরূপ মানাইয়াছে, রমণীর মুখে সেরূপ মানায় নাই। পুরুষের ওষ্ঠস্থূলতা পুরুষের গোঁফে ঢাকিয়া যায়, কিন্তু স্ত্রীলোকদিগের অনাবৃত ওষ্ঠের স্থূলতা আরও বেশি বলিয়া মনে হয়। যাহাদের দেহগঠন গ্রীশীয় রমণীমূর্ত্তির ন্যায় অনিন্দ্যসুন্দর—এরূপ কতকগুলি বালিকা ছাড়া প্রায় আর সকলেরই উদরদেশ অকালবৈরূপ্য প্রাপ্ত হইয়াছে। তা ছাড়া, এমন কোন বস্ত্রাবরণও নাই, যাহাতে ঐ অধোলম্বিত উদর কোনপ্রকারে ঢাকিয়া রাখা যাইতে পারে। উহারা নাক ফুঁড়িয়া সোনার নথ ও কান ফুঁড়িয়া কানবালা পরিয়া থাকে। কানবালাগুলি ওজনে এত ভারি যে, উহাতে কান একেবারে ঝুলিয়া পড়ে। তবে কিনা, উহারা ‘পারিয়া’-রমণী; উচ্চশ্রেণীর মহিলারা মাল-বোঝাই গরুর গাড়িতে কখনই যাতায়াত করে না। এই উচ্চশ্রেণীর স্ত্রীলোকদিগকে কিন্তু এখনও আমি দেখি নাই।
রাস্তায় এই মজুর-রমণীদিগের জন্য দূরদূরান্তরে একএকটি বিরামস্থান স্থাপিত হইয়াছে। নিরেট পাথরের বেদী, উচ্চতায় একমানুষ-সমান, এই বেদীর উপর উহারা নিজ-নিজ বোঝা নামাইয়া রাখে। তাহার পর, আবার যখন ঐ বোঝাগুলি মাথায় উঠাইয়া লয়, তখন তাহাদিগকে ভূমি পর্যন্ত আর মাথা নোয়াইতে হয় না।
চারিদিকে কি রমণীয় নিস্তব্ধতা! এই সকল বিহঙ্গনীড়বৎ তরুপ্রচ্ছন্ন বিরল গ্রামগুলির মধ্যে কি স্বর্গীয় প্রশান্তি!
একটি বটবৃক্ষের তলে, মহাদেবের একটি পুরাতন মূর্ত্তির সন্নিকটে, বেগুনি-রঙেব পরিচ্ছদ-পরা, শাদা লম্বাদাড়ি, ইরাণীর ন্যায় মুখশ্রী, একটি লোক শান্তভাবে বসিয়া কি একটা গ্রন্থ পাঠ করিতেছে; ইনি একজন প্রধান-পাদ্রি—একজন সিরিয়াদেশীয় প্রধান-পাদ্রি! প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, এই রহস্যময় ব্রাহ্মণ্যের দেশে একি অদ্ভুত দৃশ্য!
কিন্তু একটু বিবেচনা করিয়া দেখিলেই প্রতীতি হইবে, ইহাতে বিস্মিত হইবার কোন কারণ নাই। আমি পূর্ব্বেই জানিতাম, ত্রিবঙ্কুর-মহারাজের রাজ্যে প্রায় পাঁচলক্ষ খৃষ্টানপ্রজার বসতি। এই সকল খৃষ্টানদের পূর্ধ্বপুরুষগণ যে সময়ে এখানে গির্জা প্রতিষ্ঠা করে, য়ুরোপ তখনও পৌত্তলিকধর্মাবলম্বী। ইহারা ‘সেণ্ট-টমাসে'র শিষ্য বলিয়া পরিচয় দেয়। সেণ্ট-টমাস্ প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। কিন্তু সম্ভবত ইহারা 'নেষ্টোরীয়’-সম্প্রদায়ের খৃষ্টান, সিরিয়াদেশ হইতে আসিয়াছে। এই সম্প্রদায়ের কর্তৃপক্ষীয়েরা বরাবর এখানে পাদ্রি-প্রচারক পাঠাইয়া থাকে। অন্তত ইহারা যে বহুপুরাতন, লোকপূজ্য মহৎ বংশ হইতে প্রসূত, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তা ছাড়া রাজ্যের উত্তরপ্রদেশে
কগুলি, ইহুদিও আছে। 'জেরুসেলেমে’র মন্দির দ্বিতীয়বার ধ্বংস হইবার পর, উহারা এদেশে আসিয়া উপনিবেশ স্থাপন করে। ইহাদিগকে কিংবা খৃষ্টানদিগকে কেহ কখন উৎপীড়ন করে নাই। কেন না, এদেশে ধর্ম্মসম্বন্ধীয় মতসহিষ্ণুতা সর্ব্বকালেই বিদ্যমান। এই স্থানটি মনুষ্যরক্তপাতে যে কখন কলুষিত হইয়াছে, এরূপ একটি দৃষ্টান্তও প্রাপ্ত হওয়া যায় না।
আমাদের বলদেরা দুল্কি-চালে অনবরত চলিয়াছে। সন্ধ্যার সময় সূর্য্য অস্ত গেল। সেই সঙ্গে সিংহলের ন্যায় এখানকার বাতাসও গ্রীষ্মদেশসুলভ আর্দ্রতায় পূর্ণ হইল। কবোষ্ণ বৃষ্টিধারার পরম মিত্র নারিকেলবৃক্ষগুলি, অন্যান্য বৃক্ষকে অপসারিত করিয়া ক্রমে ক্রমে এখানে নিজ প্রভুত্ব বিস্তার করিয়াছে। আমরা এখন, সুবৃহৎ-শাখাবৃক্ষ-বিস্তারিত অফুরন্ত তালবৃক্ষের খিলানমণ্ডপতলে প্রবেশ করিয়াছি। ইহা পশ্চিমভারতের উপকূলবর্ত্তী প্রদেশের—মালাবার-উপকূলের শত-শত যোজন পর্য্যন্ত প্রসারিত। ‘ঘাট’-পর্ব্বতমালার অনুবন্ধী ক্ষুদ্র গিরিসমূহের পাদদেশ দিয়া আমরা যতই চলিতেছি, ততই শৈলচূড়াসমূহে, শৈলবিলম্বিত অরণ্যে, ঝটিকাসঙ্কুল নিবিড় জলদজালে, অত্রত্য নভোমণ্ডল ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিতেছে।
চারিঘণ্টা ধরিয়া অনবরত ঝাঁকানি খাইতেছি, তাহার সঙ্গে তালে-তালে বলদেরা দুলকি-চালে চলিতেছে। শুইয়া-শুইয়া আমি শ্রান্ত-ক্লান্ত-অবসন্ন; আর সহ্য হয় না। কি করি, আমার এই শবাধারের সম্মুখস্থ রন্ধ্র পথ দিয়া গলিয়া বাহির হইলাম এবং চালকের পার্শ্বে, যুগকাষ্ঠ-আসনের উপর, বানরেরা যেভাবে বসে, সেইভাবে একটু বসিলাম। দিবালোক অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে। এই সকল মেঘের মধ্যে, এই সকল তালগাছের মধ্যে, সন্ধ্যা সবেমাত্র দেখা দিয়াছে। মার্গস্থ বটবৃক্ষের হরিৎ-শ্যামল সুরঙ্গপথ আমাদের সম্মুখ দিয়া বরাবর সমান চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু স্থানে স্থানে, অরণ্যের মধ্যে, সন্ধ্যাছায়ায়, কতকগুলি পদার্থ অতীব অদ্ভুত কিম্ভূত-কিমাকার বলিয়া মনে হইতেছে। মনে হইতেছে, যেন কতকগুলা শ্যামল-কায় বিকটাকার গঠনহীন পশু, কখন বা একাকী নিঃসঙ্গ, কখন বা দলে দলে একত্র, অথবা পরস্পর উপর্য্যুপরি সমারূঢ় রহিয়াছে। এইগুলা শৈলস্তূপ ভিন্ন আর কিছুই নহে, কিন্তু কি অদ্ভুত, বিচিত্র! এই শৈলস্তুপগুলি স্থূলচর্ম্মী পশুদিগের ন্যায় বর্তুল ও তাহাদিগের চর্মের ন্যায় মসৃণ ও চিকচিকে। উহাদের পরস্পরের মধ্যে যেন কোনপ্রকার যোগসূত্র নাই; প্রত্যেকেই যেন পৃথকভাবে এখানে অধিষ্ঠিত। কোন সাধারণ হত্যাকাণ্ডের পর,: হতব্যক্তিদিগের দেহগুলি যেরূপ ভাবে থাকে, উহারা সেইরূপ নিষ্পেষিত, বিনিক্ষিপ্ত, ছিন্নবিচ্ছিন্ন ভাবে রহিয়াছে। সেই সঙ্গে, মোটামোটা গাছের ডাল, মোটামোটা গাছের শিকড়গুলা হস্তিশুণ্ডের সাদৃশ্য ধারণ করিয়াছে।•••যেন অত্রতা প্রকৃতিদেবী স্বকীয় শৈশবদশায়, বিবিধ শৈশবচেষ্টার বিকাশকালে, নির্জনে কোন জন্তুবিশেষের অকার লইয়াই ব্যাপৃত ছিলেন। যেন হস্তিমূর্ত্তির কল্পনা-অঙ্কুরটি বহুকাল হইতে এইখানে বিদ্যমান। এমন কি বিধাতা যখন গোড়ায় এই শৈলগুলি নির্মাণ করেন, তখনও বোধ হয় তাহার চিন্তার মধ্যে এই কল্পনাটি গৃঢ়ভাবে বিদ্যমান ছিল।
বাস্তবিকই মনে হয়, হস্তী কিংবা হস্তীর ভ্রূণনিচয় যেন এখানে সর্ব্বত্রই দেখিতেছি। আমাদের চতুর্দ্দিকে, অরণ্যের অন্ধকার যতই ঘনাইয়া উঠিতেছে, ততই যেন এইরূপ সাদৃশ্য আমাদের মনে অধিকতররূপে প্রতিভাত হইতেছে;—আমাদের মনকে যেন একেবারে অধিকার করিয়া বসিতেছে।
এখন আটটা রাত্রি। ঝটিকা আসন্ন বলিয়া অশঙ্কা হইতেছিল, কিন্তু জানি না, কি করিয়া সমস্ত আবার কোথায় বিলীন হইয়া গেল। স্বচ্ছ আকাশ, তারাময়ী রজনী। ঝিল্লী ও শলভগণ উল্লাসভরে গান করিতেছে। কীটগণের হর্ষকোলাহলে সমস্ত তরুপল্লব অনুরণিত।
আমাদের সম্মুখে মশালের আলো দেখা যাইতেছে। তরুপল্লবের মধ্য দিয়া একদল লোক আমাদের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। ঢাকঢোল ও করতালের ধ্বনি, এবং মনুষ্যকণ্ঠনিঃসৃত ঐকতান গান শুনিতে পাওয়া যাইতেছে।
ইহারা বরযাত্রীর দল;—বট ও তাল গাছের নীচে দিয়া মহাসমারোহে চলিয়াছে। ইহাদের মধ্যে একজন, রাজা কিংবা দেবতার ন্যায় পরিচ্ছদ পরিধান করিয়াছেঃ—সোণালী জরির লম্বা জামাজোড়া, মাথায় সোণার মুকুট।
ইহা একটি বিবাহের উৎসব; বর স্বীয় আত্মীয়বর্গকে লইয়া, ধর্ম্মবিধি অনুসারে, রাস্তা দিয়া যাত্রা করিতেছে।
এখন এগারটা। আমার শকটের মধ্যেই আমি নিদ্রা গেলাম। আমার ভৃত্য শকটের একটি ক্ষুদ্র জান্লা খুলিয়া, হাত-লণ্ঠনের আলোয় একখানা পত্র আমার সম্মুখে আনিয়া ধরিল। সেই পত্রে ত্রিবাঙ্কুররাজচিহ্ন মুদ্রাঙ্কিতঃ—দুইটি হস্তী ও একটি সামুদ্রিক শঙ্খ। এক্ষণে আমরা ‘নৈজতাবরে’-গ্রামে আছি! এই পত্রখানি দেওয়ানের নিকট হইতে আসিয়াছে। তিনি এই পত্রযোগে, মহারাজের পক্ষ হইতে, আমাকে স্বাগতসম্ভাষণ করিয়াছেন, আর গাড়ি প্রস্তুত আছে, এই কথা জানাইয়াছেন। দেশীয় শকট হইতে বাহির হইয়া, এই শোভন-সুন্দর ঝাঁকুনিহীন গাড়িতে উঠিলাম। আহ্লাদের বিষয়। দুইটি উৎকৃষ্ট অশ্ব আমাকে লইয়া দীর্ঘপদবিক্ষেপে দুল্কি-চালে চলিতেছে, ইহাতেই আমার আনন্দ। মহারাজের চিহ্নিত পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া ‘কোচোয়ান’ স্বকীয় আসনে বসিয়া আছে;—তাহার দীর্ঘ চাপ্কান, জরির পাগ্ড়ি, অন্ধকারে ঝক্মক্ করিতেছে। পিছনের পায়দানে দুইজন চটুল সহিস্; উহারা গাড়ির আগে-আগে এইরূপ ভাবে দৌড়িয়া চলে, যেন উহাদের উড়িবার একজোড়া ডানা আছে। তা ছাড়া, পথের অগণ্য গরুর গাড়ি সরাইয়া দিবার জন্য উহারা কি ভয়ানক চীৎকার করে! একটা ছোট সিন্দুকের ভিতরে ক্রমাগত ঝাঁকানি খাইয়া, তাহার পর খোলা গাড়িতে তারা দেখিতে দেখিতে সারি-সারি তাল-নারিকেলের মধ্য দিয়া সহজভাবে ও দ্রুতগতি চলিতে কি উন্মাদক আনন্দ! রজনীর সুমধুর বায়ুরাশি ভেদ করিয়া, সমস্তক্ষণ পুষ্পসৌরভ আঘ্রাণ করিতে করিতে আমরা যেন অফুরন্ত কোন একটি পরী-উদ্যানের মধ্য দিয়া চলিয়াছি।
আবার বাদ্যধ্বনি; আবার মশালের রক্তিম অনলশিখা। এত অধিক রাত্রি, আর এই ঘোর নিস্তব্ধ সময়, তবু এখনো আর একদল বরযাত্রী এই পথ দিয়া চলিয়াছে। এবার বরটি অশ্বারূঢ়! উহার জরির জামাজোড়া অশ্বের পশ্চাদ্ভাগ পর্য্যন্ত বিস্তৃত। বেশভূষায় বরটিকে রাজার মত দেখিতে হইয়াছে। এখন রাত্রি প্রায় একটা। যে সকল তালবৃক্ষের পরস্পরবিজড়িত শাখাপক্ষপুঞ্জ আমাদের মাথার উপর দিয়া ছুটিয়া চলিয়াছিল, এক্ষণে হঠাৎ যেন তাহাদের গতিরোধ হইল। এটি অরণ্যের একটি ফাঁকা জমি। আমরা ক্রমে একটা পাকা-রাস্তার উপরে আসিয়া পড়িলাম।
মনে হইতেছে, যেন এই রাজপথটি গভীর নিদ্রায় নগ্ন। চন্দ্রহীন রাতে, গ্রীষ্মপ্রধান দেশে, তারকারাজি যে শীতল-শান্ত ভস্মাভ আলোক বিকীর্ণ করে, সেইরূপ আলোকে এই রাস্তাটি আলোকিত। যে সকল বাড়ী দিবসে ধব্ধবে শাদা দেখাইবার কথা, এই রাত্রিকালে তাহারা একটু যেন নীলাভ বলিয়া মনে হইতেছে। বারাণ্ডার ঊর্দ্ধে আর একটি তলা আছে, তাহাতে মিশ্রধরণের ছোট-ছোট থাম; এবং কৌণিক খিলানের আকারে, ত্রিপত্রের আকারে, ঝালোরের আকারে খুব ছোট-ছোট রন্ধ-গবাক্ষ। নীচে, রুদ্ধদ্বারের দুই পার্শ্বে, দেয়ালের কুলুঙ্গিতে, ভূতপ্রেতের প্রবেশনিবারণার্থ সলিতা-বিশিষ্ট ছোট-ঘোট প্রদীপ জোনাকির মত মিট্মিট্ করিয়া জ্বলিতেছে।
কতকগুলি পরিচিত জীবজন্তু নিষ্পদভাবে সিঁড়ির ধাঁপের উপর শুইয়া আছে। উহাদের প্রতি কে-যেন-কি অনিষ্টাচরণ করিবে, এইরূপ কোন অনির্দ্দিষ্ট আশঙ্কায়, উহারা যেন মানব-আবাসের যতদূর-সম্ভব নিকটবর্ত্তী স্থানে আশ্রয় লইয়াছে।—গরু, ভ্যাড়া, ছাগল, ঘোড়, এই সকল জীব জন্তু। আমাদের গমনকালে উহারা জাগিয়া উঠিল না। বালুকাময় রাস্তা দিয়া আমাদের গাড়ি চলিয়াছে। গাড়ির চাকার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শুনা যাইতেছে না। এই সকল বাড়ী, নিদ্রিত পশুর পাল, নিষ্পন্দ পদার্থসমুহ, যেন কোন দূরবর্ত্তী রং-মশাল-আলোকের আভার ন্যায়, একপ্রকার অস্পষ্ট নীল আলোকে পরিস্নাত।
আমাদের সম্মুখে একটা প্রকাণ্ড ঘের, একটা উত্তুঙ্গ তোরণ—শ্রেণীবদ্ধ, লণ্ঠনের আলোকে দেখা যাইতেছে। এই তোরণের মধ্য দিয়া একটা বিস্তৃত জনশূন্য, তরুবীথি সিধা চলিয়া গিয়াছে। প্রাচীরের ঊর্দ্ধে তালবৃক্ষাদি ও প্রাসাদের ছাদ, এবং দূরপ্রান্তে, তরুবীথির কেন্দ্রস্থলে ও পশ্চাদ্ভাগে, ব্রাহ্মণ্যিক মন্দিরের চূড়াসকল দেখা যাইতেছে। স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে, এইবার আমরা ত্রিবঙ্কুর-মহারাজের রাজধানী—প্রকৃত ‘ত্রিবন্দ্রম’-নগরে প্রবেশ করিতেছি। পূর্ব্বে যেখানে নিদ্রিত-জীবজন্তু-সমাচ্ছন্ন নীলাভ রাজপথ দেখিয়াছিলাম, উহা ইহারই সংলগ্ন উপনগরমাত্র।…
আমি জানিতাম না, এই পুণ্য ঘেরের মধ্যে কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদিগেরই বাসাধিকার আছে। আমি মনে করিয়াছিলাম, বুঝি আমার গাড়ি পূর্ব্বোক্ত বৃহৎ তোরণের মধ্য দিয়া প্রবেশ করিবে; কিন্তু তাহা না করিয়া হঠাৎ ডানদিকে ফিরিল; আবার আমরা তরু-অন্ধকারে নিমজ্জিত হইলাম। আরো দূরে লইয়া-গিয়া, নানা রাস্তা অনুসরণ করিয়া, উপবনের অলিগলির মধ্য দিয়া, অবশেষে উদ্যানমধ্যস্থিত একটা সুন্দর অট্টালিকার সম্মুখে আমাকে আনিয়া উপস্থিত করিল। কিন্তু হায়! অট্টালিকার মুখশ্রীটি ভারতীয়-ধরণের নহে।
এইখানেই আমার জন্য ঘর নিদ্দিষ্ট হইয়াছে। এইখানেই, মহারাজার পক্ষ হইতে আমার প্রতি যার-পর-নাই আদর অভ্যর্থনা ও আতিথ্য বিতরিত হইবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উহার বাহ্য ‘কাঠাম’টি—আতিথ্যের স্থানটি—য়ুরোপীয়-ধরণের। বরাবর ইহাই আমার নিকট অসঙ্গত ও বিসদৃশ বলিয়া মনে হয়। আমার মনে হয়, এই পরমাশ্চর্য্য প্রাচীন হিন্দুস্থানের উদার হৃদয়ের ইহাই একটি মার্জ্জনীয় ত্রুটি।
ত্রিবঙ্কুরে এই-যে প্রথম রাত্রি আমি অতিবাহিত করিতেছি, এই রাত্রির শেষভাগে আমার ছাদের উপর একটা ভীষণ কোলাহল উপস্থিত। হুড়াহুড়ি, দৌড়াদৌড়ি, তাহার পর লড়ালড়ি। আমার নিবাসগৃহ চারিদিকে খোলা,—এই মনে করিয়া আমার মনের মধ্যে সর্ব্বদাই একটা অস্পষ্ট উদ্বেগের ভাব ছিল। এখন যেন আমি আধো-ঘুমন্ত অবস্থায় দেখিতে পাইলাম, কতকগুলা বড়-বড় বিড়াল লম্ফঝম্ফ দিয়া কর্কশস্বরে চীৎকার করিতেছে। রাত্রির নিস্তব্ধতাহেতু ও গৃহের মধ্যে কাঠের কাজ অধিক থাকায়, বেশি শব্দ হইতেছে বলিয়া মনে হইতেছিল। আসলে উহা পার্শ্ববর্ত্তী স্থানের বনবিড়ালের পদশব্দ ভিন্ন আর কিছুই নহে। সমস্তদিন উহারা উদ্যানস্থ বৃক্ষের উপরে নিদ্রা যায়; রাত্রিকালে শিকারে বাহির হইয়া আত্মবিনোদন করে এবং ধৃষ্টতাসহকারে মনুষ্যরাজ্য আক্রমণ করে।
অতি প্রত্যুষে, ত্রিবন্দ্রমে আমার মনে একটা বিষাদের ভাব আসিয়া উপস্থিত হইল। ঊষার প্রথম প্রারম্ভেই, ভীষণ একটা শোকসূচক কোলাহল উত্থিত হইল। শব্দটা যেন একটু দূর হইতে আসিতেছে,—ব্রাহ্মণ্যের সেই পূতভূমি হইতে আসিতেছে বলিয়া মনে হইল। হাজারহাজার লোক একসঙ্গে চীৎকার করিয়া উঠিতেছে; উহা যেন সমস্ত মানবমণ্ডলীর আর্তনাদ; বিশ্বমানব যেন জাগ্রত হইয়াই আবার সেই চিরন্তন পৃথিবীর দুঃখকষ্ট অনুভব করিতেছে—মৃত্যুচিন্তার ভারে নিষ্পেষিত হইতেছে। তাহার পরেই, বিহঙ্গেরা নব-ভানুকে অভিবাদন করিতে প্রবৃত্ত হইল; কিন্তু বসন্তকালে উহারা আমাদের ফল-বাগানে যেরূপ মৃদু-লঘু-ধরণে সুমধুর প্রভাতী গাহিয়া থাকে, ইহাদের সঙ্গীত সেরূপ নহে।
এখানে, ‘নকুলে’ টিয়াপাখীর স্থূল কণ্ঠস্বরে—বিশেষত কাকের শোকবিষাদময় চীৎকারে, ছোট-ছোট পাখীর কলধ্বনি আচ্ছন্ন হইয়া যায়। প্রথমে, সঙ্কেতস্বরূপ পৃথক্ভাবে দুইএকটা কা-কা-শব্দ শুরু হয়, তাহার পর শতকণ্ঠে−সহস্রকণ্ঠে কা-কা-শব্দের ভীষণ সমবেত-সঙ্গীত বাহির করিয়া, কাকেরা পূতিগন্ধি শবদেহের জয়ঘোষণা করে।...…কাক, কাক, সর্ব্বত্রই কাক, ভারতভূমি কাকে আচ্ছন্ন; বরাবর দেখিতেছি,—ত্রিবঙ্কুরে, এই চিত্তবিমোহন শান্তিময় রাজ্যে,—ঊষার আরম্ভ হইতেই উহাদের চীৎকারে তালতরুমণ্ডপ পূর্ণ হইয়া উঠে, এবং যাহারা উহার সুন্দর পত্রপুঞ্জের নীচে বাস করে ও জাগ্রত হয়, তাহাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস সহসা স্তম্ভিত হইয়া যায়। কাকেরা যেন এই কথা বলেঃ—“সমস্ত মাংস কখন্ পচিয়া উঠিবে, তাহারই প্রতীক্ষায় আমরা এখানে আছি, আমাদের খাদ্য নিশ্চিত মিলিবে, আমরা সমস্তই আহার করিব।”...…
তাহার পর, তাহারা চারিদিকে উড়িয়া যায়, আর তাহাদের সাড়াশব্দ থাকে না। আবার মনুষ্যের দূর-কোলাহল শ্রুত হয়;−অতীব প্রবল, অতীব গভীর; বেশ বুঝিতে পারা যায়, অসংখ্য ব্রাহ্মণ কোন বৃহৎ মন্দিরে সমবেত হইয়া স্বকীয় দেবতাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতেছে। তাহার পরেই, ‘ত্রিবন্দ্রম’-নগর যে তালকুঞ্জের মধ্যে অবস্থিত, তাহার চারিদিক্ হইতে ঢাক-ঢোল, করতাল-শঙ্খের মিশ্রিত কল্লোল এখানে আসিয়া পৌঁছে। অরণ্যের মধ্যে যে সকল ছোট-ছোট দেবালয় ইতস্তত বিকীর্ণ রহিয়াছে,− সেই সকল মন্দিরে ইহাই দিবসের প্রথম পূজা।
অবশেষে সূর্য্যের উদয় হইল। সম্পূর্ণ-অবারিত এই সকল গৃহে সূর্য্যরশ্মি প্রবেশ করিল। অত্রত্য গৃহ ও নৈশপদার্থের মধ্যে স্তম্ভ ও পাতলা ‘চিক্’ ভিন্ন আর কোন অন্তরাল নাই। এই আলোকে, এই সুন্দর চমৎকার আলোকে, এই সুমধুর সময়ে, ঊষার সমস্ত বিষন্নতা কোথায় যেন অন্তর্হিত হইল। আমি উদ্যানে নামলাম।
তাল-বনের মধ্যস্থলে একটি ফাঁকা জায়গায় এই উদ্যানটি অবস্থিত। ইহার মধ্যে কত শাদ্বলভূমি, কত গোলাপি-রঙের ফুলের বৃক্ষ, কত পর্ণতরু (Fern); উত্তপ্ত আর্দ্রস্থানেই এই পর্ণতরুগুলি জন্মায়। এরূপ অপূর্ব্ব পত্রপুঞ্জ ভারতবর্ষ ভিন্ন আর কোথাও দেখা যায় না। এইজাতীয় সর্ব্বপ্রকার বৃক্ষই এখানে আছে। কোন কোন পাতায় ফুলের মত রং; কোনটা ঘোর লাল, কোনটা বেগ্নি, কোনটা ফিঁকে-রক্তবর্ণ; কোনটায় সরীসৃপজাতীয় জীবদিগের পৃষ্ঠের ন্যায় ডোরাকাটা; আবার কোনটার গায়ে, প্রজাপতির পাখায় যেরূপ থাকে, সেইরূপ চোখ আঁকা।
প্রাতে ৭টায়—যে সময়ে তরুবীথিমণ্ডপতলে নিশার শৈত্য একেবারে চলিয়া যায় নাই—সেই সময়েই এখানকার লোকদিগের দেখাশুনা করিবার, লোক-লৌকিকতা করিবার সময়।—অষ্মদ্দেশীয় রীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি সংবাদ পাইলাম, কাল এই সময়ে, রাজার সহিত পরিচিত হইবার জন্য, আমাকে ব্রাহ্মণগণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করিতে হইবে।
মধ্যাহ্নের কাছাকাছি,—এত তালবৃক্ষ, এত ছায়া সত্ত্বেও, উর্দ্ধগগনাবলম্বী সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে জীবনপ্রবাহ যেন সহসা স্তম্ভিত হইয়া গেল। সর্ব্বত্রই ঘুমন্ত ভাব, সর্ব্বত্রই নিস্পন্দতা; সেই চিরন্তন বায়সেরাও নিস্তব্ধ,−পত্রপুঞ্জের নীচে ভূতলে উপবিষ্ট।
আমার বারণ্ডা হইতে যে রাস্তাটি দেখিতে পাইতেছি, উহা হরিতের নৈশ অন্ধকারে মিলাইয়া গিয়াছে; সন্ধ্যা পর্যন্ত উহা লোকশূন্য থাকিবে। এখনও দুইচারিজন পথিক দৃষ্টিগোচর হইতেছে; উহারা নিজ নিজ কুটীরে ফিরিয়া যাইতেছে; ভারতবাসী অথবা ভারতবাসিনী; পরিধানে একইরকম লালধুতি; উজ্জলশ্যামবর্ণ তাম্রাভ গাত্র−নগ্নপদে নিঃশব্দে চলিতেছে। লোকদিগের লাল্চে-রঙের কাপড়; এবং উহারা লালমাটির উপর দিয়া চলিতেছে; এদিকে তালপুঞ্জের অত্যুজ্জ্বল হরিদ্বর্ণ;−এই বৈপরীত্যসংযোগে লালরঙের আরো যেন খোল্তাই হইয়াছে। কখন-কখন, কোন নিঃশব্দ গুরুপদক্ষেপে পথভূমি কাঁদিয়া উঠিতেছে। উহা হস্তীর পদক্ষেপ। মহারাজার হস্তিগণ, কোনো মেঠো কাজ সমাধা করিয়া, চিন্তামগ্ন হইয়া, ফিরিয়া আসিতেছে; উহারা হস্তিশালায় গিয়া এইবার নিদ্রা যাইবে। ইহার পর, আর কিছুই শুনা যায় না। কেবল যে সকল জীব স্বকীয় স্বাভাবিক গতির উন্মত্ত উচ্ছ্বাসে সর্ব্বদাই চঞ্চল, সেই তরুনিবাসী চটুল কাঠবিড়ালীরা চারিদিক্কার নিস্তব্ধতায় সাহস পাইয়া আমার কক্ষে প্রবেশ করিয়াছে।
সায়াহ্নে, যখন মনুষ্যের চেষ্টা-উদ্যম আবার আরম্ভ হইল, তখন আমার গৃহ হইতে বাহির হইয়া মহারাজার গাড়িতে আমি আরোহণ করিলাম। অশ্বদিগের দ্রুতগতিতে আমার মনে যেন একটা শৈত্যবিভ্রম উপস্থিত হইল।
এখন, ত্রিবন্দ্রম-নগরের আর-এক নূতন বিভাগ আমার চতুষ্পার্শ্বে প্রসারিত। এখন আর বৃক্ষের আধিপত্য নাই,—শাদ্বলভূমি উহাদের স্থান অধিকার করিয়াছে,—কতকগুলি বালুকাকীর্ণ সুন্দর বীথি প্রস্তুত হইয়াছে। আধুনিক-ধরণের রাজধানীতে যে সকল দ্রষ্টব্য বস্তু থাকা আবশ্যক, সে সমস্তই উদ্যানসমূহের অভ্যন্তরে বিকীর্ণ রহিয়াছে:— মন্ত্রণাভবন, আতুরাশ্রম, কর্জ্জ-কুঠী, বিদ্যালয়। এ সব জিনিস তত বেসুরো-বেখাপ্পা বলিয়া মনে হইত না,—যদি একটু ভারতীয়-ধরণে গঠিত হইত; কিন্তু, আমাদের এই বর্ত্তমান যুগে, পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এই একই প্রকারের রুচিদোষ দৃষ্ট হয়। এ ছাড়া, এখানে প্রটেসটাণ্ট, ল্যাটিন ও সিরিয়া সম্প্রদায়ের বিবিধ খৃষ্টান গির্জাদিও আছে। এই সিরিয়া সম্প্রদায়ের গির্জাগুলি সর্ব্বাপেক্ষা পুরাতন এবং উহাদের সম্মুখভাগের আকৃতিটি নিতান্ত সাদাসিদা-ধরণের। কিন্তু সে যাহাই হোক, এ সমস্ত দেখিতে আমি ত্রিবঙ্কুরে আসি নাই। এখন আমি বুঝিতেছি, ব্রাহ্মণভারতের—রহস্যগভীর ভারতের সংস্পর্শে আসা কতটা কঠিন,—যদিও সেই জীবন্ত ভারত, সেই অপরিবর্ত্তনীয় ভারত আমার খুব নিকটেই রহিয়াছে বলিয়া আমি অনুভব করিতেছি এবং উহার মহারহস্য আমার চিত্তকে সততই বিক্ষুব্ধ করিতেছে।
নগরের এই নব অঞ্চলটির বাহিরে, যে সুবিস্তৃত পরিসরের মধ্যে সমস্ত নীচজাতীয় হিন্দুরা বাস করে, তাহার উপর তালতরুর হরিৎ খিলান প্রসারিত। বাঁশের ছোট-ছোট বাড়ী, পাথর ও খড়-পাতার ছোট-ঘোট পুরাতন দেবালয়, সেই চিরন্তন নারিকেলপুঞ্জের মধ্যে অর্দ্ধপ্রচ্ছন্ন; এই স্থানটি ছায়ার রাজ্য এবং ইহার বীথিগুলি তমসাচ্ছন্ন উদ্ভিজ্জের ঢাকাবারা -পথ বলিয়া মনে হয়।
কেবল একটিমাত্র রীতিনত রাস্তা আছে, সেই রাস্তা দিয়া, নক্ষত্রপরিদৃশ্যমান একটা মুক্তস্থানে আসিয়া পড়িলাম এবং এই রাস্তা দিয়াই ব্রাহ্মণদিগের পবিত্র গণ্ডির দ্বারদেশে উপনীত হওয়া যায়। এই রাস্তাটি বণিকবীথি; নিস্তব্ধপ্রায় এই সে নগর, ইহার যাহা-কিছু চলাচল, যাহা-কিছু কোলাহল সমস্তই এইখানে কেন্দ্রীভূত। সায়াহ্নের এই সময়ে, এই রাস্তাটি লোকাকীর্ণ; এইখানে ঘোড়াদিগকে একটু আস্তে-আস্তে চালাইতে হইল। লোকদিগকে দেখিলে মনে হয়, যেন সব দেবমূর্ত্তি, এমনি সুন্দর মুখশ্রী, এমনি শোভন-গম্ভীর দাড়াইবার ভঙ্গি, এমনি সুগভীর অতলম্প চোখের দৃষ্টি।
এই লোকদিগের বাহু ও গাত্র সেন তানধাতুতে খোদা—গঠন-উৎকর্যে ও সুচারু ভঙ্গিমায় পুবতন গ্রীসের উৎকীর্ণ-চিত্রমূর্তির সদৃশ।
সূক্ষ্মরুচি ও মহাগৌরবান্বিত উন্নতপদীর ব্রাহ্মণেরা সাজসজ্জা তুচ্ছ করিয়া, নিকৃষ্টবর্ণের লোকদিগের অপেক্ষা—এমন কি, পারিয়াদিগের অপেক্ষা ও স্বল্পপরিচ্ছদে যাতায়াত করিতেছে। শাদা কাপড়ের ধুতি কোমরে জাড়ানো এবং তাহাই নগ্নবক্ষের উপর, চাপসের মত বক্রভাবে গিয়া কাঁধের উপর পড়িয়াছে; সেই নগ্নবক্ষে ছোট একটা শণ-সূতার দড়ি ভিন্ন আর কিছুই নাই; ইহাই বর্ণভেদের বাহচিহ্ন; জন্মবামাত্রই পুরোহিত উহা গলায় বাঁধিয়া দেয়; উহা কস্মিকালেও ত্যাগ করিবার জো নাই; এই পবিত্র যজ্ঞসূত্র ব্রাহ্মণের জীবন-মরণের সাথী। উহাদের ললাটদেশে, গভীর কৃষ্ণবর্ণ নেত্রদ্বয়ের মাঝখানে স্বকীয় ইষ্টদেবতার সাঙ্কেতিক নাম অঙ্কিত থাকে, ধর্ম্মানুষ্ঠানের অঙ্গস্বরূপ এই চিহ্নটি প্রতিদিন প্রাতঃস্নানের পরে উহাদিগকে নুতন করিয়া সযত্নে ললাটে অঙ্কিত করিতে হয়। একটা লাল ফোঁটা ও তিনটা শাদা রেখা—ইহাই শৈবদিগের সাম্প্রদায়িক চিহ্ন; বৈষ্ণবদিগের একপ্রকার শাদা ও লাল রঙের ত্রিশূলরেখা, যাহা ভ্রূদ্বয়ের মধ্যস্থল হইতে আরম্ভ করিয়া কেশ পর্য্যন্ত উথিত হয়। এই সাঙ্কেতিক চিহুগুলি আমাদিগের নিকটে নিতান্তই একটা প্রহেলিকা।
স্ত্রীলোক খুব অল্প কিংবা নাই বলিলেই হয়—যদিও প্রথমদৃষ্টিতে, গ্রন্থিবদ্ধ বা স্কন্ধের উপরে বিলম্বিত সুচিক্কণ দীর্ঘ কেশগুচ্ছ দেখিয়া পুরুষদিগকে স্ত্রীলোক বলিয়া সর্ব্বত্রই ভ্রম হয়। যে সকল স্ত্রীলোক দেখা যায়, তাও আবার অতি নীচবর্ণের-তাহাদের মুখশ্রী রাস্তার মজুরবমণীদিগের ন্যায় নিতান্ত ইতরধরণের। অবশ্য ব্রাহ্মণদিগের পত্নী ও কন্যাগণ এই পবিত্র গণ্ডির মধ্যে বাস করে। সন্ধ্যার সময় উহারা দলে দলে চাবিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়।
এই সমস্ত বাড়ী,—যাহা গতরাত্রে, নীলাভ-প্রশান্ত-কিরণ তলে, নিদ্রামগ্ন ও নিমীলিতনেত্র বলিয়া মনে হইয়াছিল—এক্ষণে উহা জীবন-উদ্যমে পূর্ণ। এখন উহাতে বাজার বসিয়াছে; ফল, শস্য-দানা, রঙিন ফুলের ছাপ-দেওয়া মিহি কাপড়; সোনার মত ঝকঝকে পিতলের সামগ্রী:— এই পিতলের সামগ্রীর মধ্যে, বহুলবিশিষ্ট পাতলা-গঠনের প্রদীপ—খুব উচ্চ পায়ার উপর বসানো-(যেরূপ ‘পম্পে’তে দেখিতে পাওয়া যায়); বিবিধপ্রকার পূজার বাসন ও পাত্র, এবং হস্তীর উপর আরূঢ় দেবদেবীর মূর্তি। তাহার পর, আমার প্রদর্শকমহাশয় আমাকে কতকগুলি কুম্ভকারের কর্ম্মস্থান দেখাইলেন। এই সকল কারখানা বর্ত্তমান মহারাজার স্থাপিত। এখানে সুন্দর প্রাচীন-ধরণে মৃৎপাত্রাদি প্রস্তুত হয়। আর কতকগুলি কারখানা দেখিলাম, যেখানে রাজপুতানা ও কাশ্মীরপ্রচলিত রঙের অনুকরণে পশমের গালিচাদি তৈয়ারি হয়। অবশেষে কতকগুলি শিল্পশালা দেখিলাম, যেখানে ধৈর্যশালী খোদকেরা নিকটস্থ অরণ্যহস্তীদিগের দন্ত খুদিয়া দেবদেবীর ছোট-ঘোট সুন্দর মূর্তি অথবা চামরের ও ছাতার ডাণ্ডি নির্মাণ করিতেছে।
কিন্তু এ সব দেখিবার জন্য আমি ত্রিবঙ্কুরে আসি নাই। রাজপ্রাসাদগণ্ডির বাহিরে ও নিষিদ্ধপ্রবেশ বৃহৎ দেবালয়ের অভ্যন্তরে যে সকল ব্যাপার হইয়া থাকে—যাহা নিতান্তই ভারতীয়—যাহা ভারতের একেবারে নিজস্বজিনিস—কেবল তাহাই দেখিবার জন্য আমার মন নিয়ত আকৃষ্ট হয়।...
ত্রিবঙ্কুরে একটি পশু-উদ্যান আছে; আমাদের য়ুরোপীয় রাজধানী সমূহের পশু-উদ্যানগুলির ন্যায় এটিও সযত্নৱক্ষিত;—ইহাতে হরিণদিগের বিচরণভূমি আছে, কুম্ভীরের চৌবাচ্ছা আছে?—এইরূপ স্থান অতি বিরল; শ্বাসরোধী নিবিড় তালপুঞ্জের ছায়া হইতে বাহির হইয়া এই স্থানটিতে আসিয়া অরণ্য ও জঙ্গলের দূরদৃশ্য একটু দেখিতে পাওয়া যায়। এখানে কতকগুলি শালভূমি আছে, তাহার চারিধারে দুর্লভ গাছের চারা ও বড় বড় বিদেশী ফুলের গাছ লাগানো হইয়াছে। এই অংশটি এমনি ভাবে নির্মিত যে, এখানে বেশ নিরাপদে বিচরণ করা যায়; কেন না, এখানকার তৃণাদি উদ্ভিজ্জ সযত্নে ছাঁটা, এবং যে সকল ব্যাঘসর্পদি হিংস্রজন্তু এখান হইতে হদ্দ ছয়তক্রোশ দূরে, জঙ্গলের মধ্যে মুক্তভাবে বিচরণ করে—এখানে তাহারা পিঞ্জরবদ্ধ। সূর্য্য এখন আর জগৎকে দগ্ধ করিতেছে না—রাত্রিও আসিয়া পড়ে নাই; এই অল্পস্থায়ী মনোহর সময়টিতে একদল ঐক্যতানবাদক, উদ্যানের দ্বারহীন চারিদিক খোলা একটি ক্ষুদ্র বিনোদমন্দিরে বাজাইবার জন্য উপস্থিত হইয়াছে। উহারা সকলেই ভারতবর্ষীয়; উহারা য়ুরোপীয় সুর অতি বিশুদ্ধভাবে বাজায়। উদ্যানের বালুকাকীর্ণ সুঁড়িপথগুলিতে, শ্রোতৃবর্গের মধ্যে—কতকগুলি পালা-পাতলা নগ্নগাত্র ব্যক্তি অবস্থিত; শ্বেতজাতীয় দুই-চারিটি খোকাখুকি-(শ্বেতজাতির মধ্যে দুইচারিজনমাত্র এখানে আছে) রং খুব ফ্যাকাসে—ভারতীয় ধাত্রীর ক্রোড়ে অবস্থিত। তা ছাড়া, দেশীয় শিশুও কতকগুলি ছিল—রাজাদের ছেলে; কিন্তু কি দুঃখের বিষয়, এখন তাহারা আর নিজেদের জাতীয় পরিচ্ছদ পরিধান করে না, পরন্তু উদ্ভট-অদ্ভুত পাশ্চাত্যপুতুলের ছদ্মবেশ ধারণ করে; তাম্রবর্ণসত্ত্বেও এই নরপুত্তলিকাগুলি অতি সুন্দর, আর চোখগুলিও খুব বড়-বড় ও কালো মখমলের মত। এই পশু-উদ্যানটি একটু উচ্চভূমির উপর অধিষ্ঠিত হওয়ায়, দূরস্থ ভারতসমুদ্র অল্প অল্প দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু এ সমুদ্রে জাহাজ নাই; অন্য দেশে সমুদ্র বাহ্যজগতের সহিত গতিবিধির পথ বলিয়াই পরিচিত; কিন্তু এ অঞ্চলের সমুদ্রটি একেবারেই অব্যবহার্য্য ও মনুষ্যের প্রতিকুলাচারী;—যোগ নিবদ্ধ করা দূরে থাকুক, বাহ্যজগৎ হইতে উহা যেন এই দেশকে আরও বেশি পৃথক্ করিয়া রাখে। কেন না,এই উপকূলের কোথাও একটি বন্দর নাই; এমন কি, একখানি নৌকাও নাই, ধীবরও নাই, কেবল চারিদিকে দুর্লঙ্ঘ্য বীচিমালা। ত্রিবন্দ্রমের এই ‘সৌখীন’ দিবাবসান-সময়ে, যখন কেবলমাত্র দুইচারিটি বেচারি খোকা-খুকির জন্য ঐকতানবাদ্য বাদিত হয়, তখন ঐ দূরস্থ সমুদ্রের উপচ্ছায়া প্রবাসীর মনে কষ্ট ও বিষাদের ভাব আরো যেন বাড়াইয়া তুলে।
এক্ষণে সূর্য্যদেব অস্ত গেলেন—বড় শীঘ্র অস্ত গেলেনঃ —ক্ষণেকের জলন্ত মহিমা; দেখিলে মনে হয়, যেন রক্তবর্ণ ভূমির উপর গোলাপি রংমশালের আলো, এবং তৃণপুঞ্জের উপর—দিগন্তর্যাপী দুর্ভেদ্য বনভূমির উপর-সবুজ রংমশালার আলো পতিত হইয়াছে। তাহার পর অতি শীঘ্র (সহসা বলিলেও হয়) রাত্রির আবির্ভাব হইল। এখানে দীর্ঘবিলম্বিত গোধূলি নাই—ঠিক সেই একই সময়ে রাত্রি আসিয়া পড়ে—আমাদের দেশের ন্যায় এই সময়টি ঋতুর উপর কোন প্রভাব প্রকটিত করে না। উদ্যানে রাত্রিটা যেন আরো বেশি করিয়া দেখা দিয়াছে—কেন না, ইহার ঝোপঝাড়ের সুঁড়িপথে, তালপুঞ্জের নীচে—চতুর্দিকের সকল স্থানই ইহারই মধ্যে ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এই সময়ে ব্রহ্মার মন্দির হইতে একটা কোলাহল উখিত হইল; আর সমস্ত অন্যান্য ইতস্ততোবিকীর্ণ মন্দির হইতে, প্রাতঃকালের ন্যায়, আবার শঙ্ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। নারিকেল-তৈল-সিক্ত শতসহস্র প্রদীপ বনভূমিতলে প্রজ্বলিত হইল এবং এই লাল আগুনের আলোকচ্ছটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পথসমূহে প্রসারিত হইল।
প্রাতঃকাল, সাতটা; রাজাদিগের সহিত দস্তুরমত দেখাসাক্ষাৎ করিবার ও তাঁহাদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করিবার ইহাই নির্দিষ্ট সময়। যে সময়ে, চিরনিদাঘ ত্রিবন্ধুরের দীপ্যমান প্রখর সূর্য্যরশ্মি দিগন্ত হইতে সুদীর্ঘ সরলরেখায় প্রসারিত হইয়া, পত্রাবরণ ভেদ করিয়া, তালকুঞ্জের মধ্যে প্রবেশ করিল এবং নারিকেল ও সুপারি তরুর শিখরদেশ স্বর্ণাভ গোলাবিরঙে রঞ্জিত করিল, সেই সময়ে, আমি মহারাজার অতিথিস্বরূপে, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য গাড়িতে উঠিলাম। প্রথমে তালজাতীয় তরুমণ্ডপের নীচে দিয়া আমাদের গাড়ি চলিতে লাগিল। একটু পরেই, একটা প্রকাণ্ড সিংহদ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। এখানে পৌছিবার প্রথম রাত্রেই, যে তোরণটি পার হইয়াছি বলিয়া মনে করিয়াছিলাম,—ইহা সেই তোরণ। ইহার ভিতর দিয়া একটা চতুষ্কোণ প্রাচীরের মধ্যে আসিয়া পড়িলাম। ইহা যেন একটি নগরের মধ্যে নগর। ইহার মধ্যে নীচজাতীয় লোকেরা প্রবেশ করিতে পায় না।
এইবার আমার গাড়ি তোরণের মধ্য দিয়া একেবারে সিধা চলিয়া গেল। সেইখানে কতকগুলি অস্ত্রধারী সৈনিক তোরণ রক্ষা করিতেছিল। প্রবেশ করিবামাত্র পুণ্যস্থানের বিবিধ নিদর্শন আমার দৃষ্টিপথে পতিত, হইল। আমরা একটা বিস্তীর্ণ সরোবরের ধার দিয়া চলিতে লাগিলাম। সেই সরোবর-জলে আ-কটি-মজ্জিত হইয়া ব্রাহ্মণেরা প্রাতঃস্নান করিতেছে; প্রাচীন প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে পূজার মন্ত্রাদি পাঠ করিতেছে; উহাদের লম্বিত কেশগুচ্ছ বাহিয়া জলবিন্দু ঝরিতেছে; উহাদের আর্দ্র গাত্র সূর্য্যকিরণে, অভিনব পিত্তলসামগ্রীর ন্যায় ঝিকমিক করিতেছে;—মনে হইতেছে, যেন উহারা কতকগুলি জলদেবতা। উহারা স্বকীয় ধ্যানে এমনি নিমগ্ন,আমাদের গাড়ি উহাদের পার্শ্ব দিয়া চলিতেছে, সৈনিকগণ আমাদের সম্মানার্থ তূরীনাদ করিতেছে, জয়ঢাক পিটাইতেছে, তথাপি সেদিকে উহাদের দৃকপাত নাই।
ইতরসাধারণের অপ্রবেশ্য এই ঘেরটির মধ্যে রাজপরিবারবর্গের নিবাসগৃহ, পাঠশালাসমূহ, আর সেই সর্ব্বপ্রধান মন্দিরটি অধিষ্ঠিত—যাহা আর চারিটি বিরাট অট্টালিকার উপর—সেই দেবমন্দিরের গগনভেদিচূড়াচতুষ্টয়ের উপর—আধিপত্য করিতেছে। এই প্রাসাদের সম্মুখভাগের আকৃতি ও প্রাসাদপ্রাচীরের বহির্ভাগটি যেন একটু বিষাদময়। প্রাসাদদ্বারের উপর দুইটি যুগল কাল্পনিক মূর্তি অধিষ্ঠিত; এই মূর্ত্তি-দুটি ভারতীয়ধরণের। আরো কিছু দূরে, পূর্বদিকের শেষপ্রান্তে, কতকগুলি ‘দ্রাগন’মূর্ত্তি অধিষ্ঠিত—উহা স্পষ্ট চীনদেশীয় বলিয়া মনে হয়।
সমস্তই অতি উজ্জ্বল বর্ণে রঞ্জিত; এবং বহুবর্ষাবধি ধূলিরাশি সঞ্চিত হইয়া উহাদিগকে পোড়-পোড়া’ ও আরক্তিম করিয়া তুলিয়াছে। কেন, পথগুলির ন্যায়, এদেশে ধূলিও লাল।
মহারাজার প্রাসাদদ্বারের সম্মুখে, অশ্বারোহী রক্ষিগণ আবার আমার সম্মানার্থ স্কন্ধ হইতে অস্ত্রাদি নামাইয়া লইল। সৈনিকগুলিকে দেখিতে খুক জাঁকালো, বেশ কায়দা-দোস্ত, লাল পাগড়ি-পরা; এবং উহারা আধুনিক নিয়মানুসারে, ‘পুনঃপুনঃ আওয়াজকারী’ নবপ্রচলিত বন্দুকের যথাযথ প্রয়োগ ও চালনা করিতে পারে।
মহারাজা স্বয়ং অভ্যর্থনার জন্য দ্বারদেশে আসিয়া উপস্থিত। আমার ভয় ছিল, পাছে আমার সম্মুখে যুগোপীয়-বৃহৎ-কোর্ত্তাধারী কোন রাজমূর্তির আবির্ভাব হয়। কিন্তু না—মহারাজা সুরুচির পরিচয় দিয়া খাটি ভারতীয় বেশেই আসিয়াছিলেন। শাদা রেশমের পাগড়ি, মখমলের পরিচ্ছদ— বোদামগুলি স্বচ্ছ হীরকের।
যে দরবারশালায় প্রথম আমার অভ্যর্থনা হইল, উহার কুট্টিমতল চীন-বাসনের দ্রব্যে মণ্ডিত; চাঁদোয়া হইতে কতকগুলি বেলোয়ারি ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিতেছে; মধ্যস্থলে খোদাই-কাজ-করা একটা রৌপ্য-সিংহাসন, উহার চারিধারে কালো-রঙের আদাব,;—পুরু আব্লুস কাঠে খোদাইকাজ-করা ভারতীয়-ধাঁচার কালো আরাম-কেদারা; কি করিয়া এরূপ মূল্যবান্ কঠিন কাষ্ঠে খোদাই-কাজ করা যাইতে পাবে—এ কেবল আশিয়াখণ্ডের লোকেরাই জানে।
ফরাসী-সরকারের একটি সম্মানভূষণ মহারাজকে প্রদান করিবার ভার আমার উপর অর্পিত হইয়াছিল;—এই সহজ কাজটি সম্পন্ন কবিয়া, তাঁহার সহিত য়ুরোপের বিষয় লইয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিলাম। এই যুরোপদর্শন তাঁহার পক্ষে অসম্ভব; কেন না, বর্ণাশ্রম প্রথার দুর্লঙ্ঘ্য শাসনে, ভারতবর্ষ ছাড়িয়া তাঁহার কোথাও যাইবার যো নাই। প্রধানত সাহিত্যের বিষয় লইয়াই তাঁহার সহিত কথাবার্তা চলিল; কেন না, মহারাজা মার্জিতরুচি ও সুশিক্ষিত। পরে, তিনি হস্তিদন্তের আশ্চর্য্য আশ্চর্য বিচিত্র দ্রব্যসামগ্রী দেখাইবার নিমিত্ত, আমাকে একটি উচ্চ শিল্পাগারে লইয়া গেলেন। এই শিল্পসামগ্রীগুলি তিনি সযত্নে সংগ্রহ করিয়াছেন। এইবার বিদায়কাল উপস্থিত হইল। আমি মহারাজার নিকট বিদায় লইলাম।
আবার সেই তালজাতীয় তরুপুঞ্জের হরিৎ অন্ধকাবের মধ্য দিয়া আমার গাড়ি চলিতে লাগিল। এই অমায়িক রাজার সহিত, আর-একটু গভীরভাবে বিবিধ বিষয়ের আলোচনা করিতে পারিলাম না বলিয়া দুঃখ রহিয়া গেল। কেন না, আমাদের মনের গঠন ও তাঁহার মনের গঠন ভিন্ন হইবারই কথা।
যে কয়েকদিন আমি এখানে থাকিব, তাহার মধ্যে অবশ্যই আবার আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হইবে। কিন্তু এই প্রথম সাক্ষাৎকারেই আমি বুঝিয়াছি, এখানকার বৃহৎ মন্দিরটির ন্যায়, তাঁহার মনের অন্তরতম প্রদেশটিও আমার নিকট দুর্ভেদ্যরহস্যরূপেই থাকিয়া যাইবে। আমাদের উভয়ের মধ্যে, কি জাতি, কি কুল, কি ধর্ম্ম,সকল বিষয়েই মূলগত পার্থক্য বিদ্যমান। তা ছাড়া, আমাদের ভাষা এক নহে। বাধ্য হইয়া একজন তৃতীয় ব্যক্তিকে আমাদের মধ্যে রাখিতে হয়;—ইহাই ত একটা বিষম বাধা; দোভাষী যতই সাহায্য করুক না কেন, তবু যেন আমাদের মধ্যে একটা পর্দার ব্যবধান থাকিয়া যায়; এইজন্য আমাদের কথাবার্তা বেশিদূর অগ্রসর হইতে পায় না,—একস্থানে সহসা থামিয়া যায়।
দুইতিনদিনের মধ্যে, আমি মহারাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে পাইব। মহারাণী পৃথক্ প্রাসাদে থাকেন। ইনি মহারাজের পত্নী নহেন,ইনি তাঁহার মাতুলানী। ত্রিবঙ্কুরের প্রধান গোষ্ঠাবর্গ যে জাতির অন্তর্গত, সে জাতিটি বহু প্রাচীন; উহা এক্ষণে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ হইতে একেবারে অন্তর্হিত হইয়াছে। এই জাতির মধ্যে, কেবল পত্নীর দিক্ দিয়াই লোকের নাম, উপাধি ও সম্পত্তি উত্তরবংশে সংক্রামিত হয়। তা ছাড়া পত্নীর স্বেচ্ছামত স্বামিপরিত্যাগের অধিকার আছে। |
রাজপরিবারের মধ্যে, অভিজাতা প্রধান মহিলার জ্যেষ্ঠকন্যা—মহারাণী এবং জ্যেষ্ঠপুত্র—মহারাজা হইয়া থাকেন। কিন্তু বর্তমান মহারাণী কিংবা তাহার ভগিনীগণের সেরূপ কোন বংশসূত্র না থাকায়, বর্তমান রাজবংশ শীঘ্রই বিলুপ্ত হইবার কথা। এই রাজত্বে, মহারাজার সন্তানদিগের কোন উত্তরাধিকারস্বত্ব নাই; শুধু অধিকার নাই তাহা নহে—“রাজকুমার” কিংবা “রাজকুমারী” এই উপাধিলাভেও তাহারা বঞ্চিত।
এই ‘নায়ের’জাতীয় মহিলাদিগের মুখশ্রী অতীব সুন্দর। অসুদ্দেশীয় কুমারীদিগের ন্যায় উহার কেশের কিয়দংশ ফিতা দিয়া বাঁধিয়া রাখে, এবং অবশিষ্ট অংশ একপ্রকার গোলাকৃতি “চাপাটির” আকারে রচনা করিয়া তাহাই মস্তকের চূড়াদেশে ধারণ করে; তাহার কতকটা সম্মুখভাগে ও কতকটা পার্শ্বদেশে কপালের দিকে ঝুলিয়া পড়ে; দেখিলে মনে হয়,—কোঁঁচকানো-কিনারা একপ্রকার টুপি যেন বেশ একটু ঢং করিয়া মাথায় পরিয়াছে। কিন্তু উহাদের কেশরচনায় যেরূপ বিলাসলীলা প্রকাশ পায়, উহাদের দেহের সমস্ত সাজসজ্জায় তেনি আবার তাপসসুলভ একটা কঠোর গাম্ভীর্য্য দেদীপ্যমান।
এখন সূর্যের প্রখর তাপ কমিতে আরম্ভ হইয়াছে; এই অপরাহ্ন চারঘটিকার সময় গায়ক-বাদকের দল আসিয়া পৌছিল; তাহারা দলে-দলে গরুর গাড়িতে আসিয়াহে। মহারাজা নিজ প্রাসাদের গায়ক-বাদকদিগকে কিয়ৎকালের জন্য আমার নিকট পাঠাইয়াছেন।
উহাদের মুখাবয়ব-রেখা সূক্ষ্ম ও সুকুমার, সমস্ত মুখশ্রী কলা-গুণিজনসুলভ। নিঃশব্দে নগ্নপদে উহার প্রবেশ করিল;—মার্জারবৎ মখমলকোমল-পদসঞ্চারে প্রবেশ করিল। দস্তুরমত সম্মানপ্রদর্শনার্থ একটু নতশির হইয়া, তাহার পর ভূতলে গালিচার উপর উপবেশন করিল। মাথায় ক্ষুদ্র জরির পাগড়ি; উহাদের গাত্রপুরাকালীন গ্রীসীয়ধারণে—রেশমি বস্ত্রে আচ্ছাদিত;—উদরের একপার্শ্ব অনাবৃত রাখিয়া উহা স্কন্ধের উপর দিয়া লুটাইয়া পড়িয়াছে। বাহুদ্বয় ধাতব বলয়ে বিভূষিত। উহাদের ফিনফিনে পালা পরিচ্ছদের মধ্য হইতে আতর-গোলাপের গন্ধ ভুরভুর করিয়া বাহির হইতেছে। উহারা তাম্রতন্ত্রীযুক্ত বড় বড় বাদ্যযন্ত্র সঙ্গে আনিয়াছেঃ প্রকার বিরাট “ম্যাণ্ডলিন্” কিংবা “গিতার”। যন্ত্রগুলির ডাণ্ডি বাঁকিয়াগিয়া একপ্রকার বিরাট্-আকৃতি জন্তুবিশেষের মস্তকে পর্য্যবসিত হইয়াছে।এই “গিতার”-গুলি বিভিন্নপ্রকারের এবং উহা হইতে বিভিন্নপ্রকারের স্বর নিঃসৃত হইবার কথা। কিন্তু সকলগুলিরই স্বরকোষ প্রকাণ্ড এবং স্বরের রেস্ বৃদ্ধি করিবার জন্য যন্ত্রগুলির গায়ে ফাঁপা তুম্বসকল রহিয়াছে;—মনে হয়, যেন একটি তরুকাণ্ডের গায়ে বড়-বড় ফল ফলিয়া রহিয়াছে। এই যন্ত্রগুলি রং-করা, গিণ্টি-করা, হাতীর-দাঁতের কাজ-করা, বহু পুরাতন, সম্পূর্ণরূপে শুষ্কীকৃত, শব্দযোনি ও বহুমূল্য দুর্লভ জিনিষ। কেবলমাত্র উহাদের বিচিত্র আকৃতি ও অদ্ভুত গঠন দেখিয়াই আমার মনে রহস্যময় ভাব—ভারতসংক্রান্ত রহস্যময় ভাব জাগিয়া উঠিল। বাদকেরা হাসিমুখে যন্ত্রগুলি আমাকে দেখাইতে লাগিল। উহাদের মধ্যে কতকগুলি যন্ত্র অঙ্গুলীর দ্বারা, কতকগুলি ছুড়ের দ্বারা ও কতকগুলি ঝিনুকের দ্বারা বাজাইতে হয়। আর-একপ্রকার যন্ত্র আছে—তাহার তারের উপর কালো ডিম্বাকার একটুকরা আবলু্শ্-কাষ্ঠ বুলাইয়া বাজাইতে হয়। বাদনের কি সূক্ষ্ম ভেদ! এই সকল সূক্ষ্মভেদ আমাদের পাশ্চাত্য সঙ্গীতবিদ্যার অগোচর!
তা ছাড়া, কতকগুলি “টম্টম্”বাদ আছে, সেগুলি বিভিন্ন সুরে বাঁধা। আবার, কতকগুলি বালক-গায়ক আসিয়াছে; উহাদের পরিচ্ছদ বিশেষরূপে জমকালে ও বিলাস-জৃন্তৃত। আমার জন্য, সঙ্গীতকার্য্যের যে অনুক্রম-পত্র ছাপা হইয়াছে, উহার একখণ্ড আমার হস্তে উহারা অর্পণ করিল। গায়ক-বাদকদিগের শ্রুতিমধুর অদ্ভুত নাম উহাতে লেখা রহিয়াছে—সকল নামগুলিই প্রায় দ্বাদশ-পদাক্ষরের।
পাঁচটা বাজিল। গায়ক-বাদকের দল সব-সুদ্ধ প্রায় পঁচিশ জন। উহারা গালিচার উপর আসীন। যে বৈঠকখানা-ঘরে উহারা বসিয়াছে, সেই ঘরের মধ্যে এখনি যেন সন্ধ্যার ছায়া পড়িয়াছে। দোলার দোলনবৎ অলসভাবে “পাঙ্খা” চলিতেছে। এইবার সঙ্গীতের আলাপ শুরু হইবে; কেন না, যন্ত্রের অগ্রপ্রান্তস্থ পশুমুর্তিগুলা খাড়া হইয়া উঠিয়াছে। এই প্রকাণ্ড যন্ত্রগুলি হইতে না-জানি-কি ভয়ানক শব্দ—এই “টমটম”-গুলি হইতে না-জানি-কি ভীষণ কোলাহলই সমুথিত হইবে। আমি প্রতীক্ষা করিয়া আছি-একটা তুমুল শব্দ শুনিব বলিয়া প্রস্তুত হইয়া আছি। গায়কৰাদকদিগের পশ্চাদ্ভাগে একটা খিলানাকৃতি দ্বার উন্মুক্ত; তাহার পরেই একটা শাদা প্রবেশ- দালান। সেই দালানে অস্তমান সূর্য্যের একটি কনকরশ্মি প্রবেশ করিয়া মহারাজার একদল সৈন্যের উপর নিপতিত হইয়াছে। শোভার্থ সজ্জিত এই সৈনিকমূর্ত্তিগুলি ব্যাথায় লাল পাগ্ড়ি পরিয়া, রক্তিম সূর্য্যালোকে দণ্ডায়মান। এদিকে, গায়কবাদকের দল ঘোর-ঘোর অস্পষ্ট ছায়ার মধ্যে নিমজ্জিত।
উহাদের সঙ্গীত কি আরম্ভ হইয়াছে? হাঁ, বোধ হয় আরম্ভ হইয়াছে। কেন না, দেখিতেছি, উহারা গম্ভীরভাব ধারণ করিয়াছে। কিন্তু কৈ, কিছুই ত শুনা যাইতেছে না।... না না—ঐ যে...একটি ক্ষুদ্র তার-গ্রামের সুর-কদাচিৎ শ্রুতিগ্রাহ্য—“লোহেন্গ্রিন”-গীতিনাট্যের উদঘাটক আলাপ- চারীর ন্যায় অতি-বিলম্বিত লয়ে বাদিত হইতেছে। পরে, উহা “দুন্”-লয়ে বাজিতে লাগিল, তান-পল্লবে জটিল হইয়া উঠিল; কিন্তু শব্দের মাত্রা, আদৌ বৃদ্ধি না পাইয়া, শুধু ছন্দোময় গুঞ্জনে পরিণত হইল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, এই সকল শক্তিমান তন্ত্রীসমূহ হইতে নিঃশব্দপ্রায় সঙ্গীত বাহির হইতেছে!—যেন করপুট-বন্দী মক্ষিকার গুন্গুন্শব্দ, যেন জানলা-শাসির গায়ে পতঙ্গের ঘর্ষণশব্দ অথবা যেন Dragon-fly মক্ষিকার কাতরধ্বনি বলিয়া মনে হয়। উহাদের মধ্যে একজন মুখের মধ্যে একটি ছোট ইস্পাতের জিনিষ রাখিয়া তাহার উপর গণ্ডদেশ ঘর্ষণ করিয়া ফোয়ারার জলচ্ছ্বাসের ন্যায় একপ্রকার ছন্ছন্ শব্দ বাহির করিতেছে। একটা বৃহৎ “গিতারের উপর এবং অন্যান্য বিচিত্র যন্ত্রের উপর বাদক যেন অতি ভয়ে-ভয়ে ও সন্তর্পণে হাত বুলাইয়া প্রায় একই সুর ক্রমাগত বাহির করিতেছে। পেচকের চাপা কণ্ঠস্বরের ন্যায়, ক্রমাগত হুহু!-হুহু!- এইরূপ শব্দ নির্গত হইতেছে। আবার সুদূর সমুদ্রতটের উপর বীচিভঙ্গ-শব্দের ন্যায় একপ্রকার চাপা আওয়াজ কোন-এক যন্ত্র হইতে বাহির হইতেছে। একপ্রকার “টম্টম্”-জাতীয় যন্ত্র আছে, তাহার কিনারার উপর বাদক অঙ্গুলীর আঘাত করিয়া বাজাইতেছে।•••তাহার পর, হঠাৎ অতর্কিতপূর্ব্ব কতকগুলি ঝাঁকানি আরম্ভ হইল, কিন্তু তাহার প্রচণ্ড প্রকোপ মুহূর্ত্তদ্বয়স্থায়ী। সেই সময় “গিতার”-তন্ত্রীগুলি যার-পর-নাই সজোরে কম্পিত হইতে থাকে এবং ‘ টম্টম্’-গুলি হইতেও তখন গম্ভীর চাপ আওয়াজ বাহির হইতে থাকে। কোন ফাঁপা মাটির উপর গুরুপদক্ষেপে হাতী চলিয়া গেলে যেরূপ শব্দ হয়, উহার সেইরূপ শব্দ; অথবা কোন গৃঢ়মার্গ অন্তর্ভৌম জল-প্রবাহনিঃসৃত কল্লোলের ন্যায়; - কিন্তু শীঘ্রই সমস্ত প্রশমিত হইল। আবার সেই পূর্ব্ববৎ নিঃশব্দপ্রায় বাদনক্রিয়া।
একজন ব্রাহ্মণযুবক—যার চোখদুটি অতি সুন্দর—সে ভূমির উপর আসনবদ্ধ হইয়া বসিয়া আছে; তাহার জানুর উপর একটি জিনিষ রহিয়াছে। অন্যান্য দ্রব্যাদি যেরূপ সুশোভন ও সুরুচিসূচক, এ জিনিষটা ঠিক তার বিপরীত। ইহা নিতান্ত রূঢ় গ্রাম্যধরণের। একটা সামান্য মাটির হাঁড়ি, তাহার মধ্যে কতকগুলো নুড়ি। হাঁড়ির বৃহৎ মুখটাতাহার নগ্ন সুবক্র বক্ষের উপর স্থাপিত। ঐ মুখের কিয়দংশ যে পরিমাণে খুলিয়া রাখিতেছে কিংবা বুকে চাপিয়া বদ্ধ করিতেছে, তদনুসাবে নিঃসৃত শব্দেরও তারতম্য হইতেছে। এবং অঙ্গুলীর দ্বারা সেই হাঁড়িটা এত তাড়াতাড়ি বাজাইতেছে যে, দেখিলে আশ্চর্য হইতে হয়। উহার শব্দ কখন লঘু, কখন গভীর, কথন খটখটে। এক-এক সময়ে যখন নুড়িগুলা নড়িয়া উঠে, তখন শিলা-বৃষ্টির ন্যায় পট্পট্শব্দ শ্রুত হয়। পূর্বোক্ত শব্দময় নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া যখন কোন একটি “গিতার” হইতে স্বতন্ত্রভাবে তান উথিত হয়, তখন কোন স্বর হইতে স্বরান্তরে গড়াইয়া যাইবার সময় ধ্বনিটা যেন আর্তনাদ করিয়া উঠে। সেই আবেগময় তানটি সজোরে পূর্ণস্বরে বাদিত হয় এবং তীব্র যাতনায় যেন একেবারে অধীর ও সংক্ষুব্ধ হইয়া উঠে। তখন টম্টম্গুলির বাদ্য, এই কম্পমান আর্তনাদকে আবৃত না করিয়া, এক প্রকার রহস্যময় তুমুল শব্দ বাহির করিতে থাকে। উহা মানবহৃদয়ের দুঃখযাতনার পরাকাষ্ঠা এরূপ তীব্রভাবে প্রকাশ করে—যাহা আমাদের উচ্চতম পাশ্চাত্য-সঙ্গীতের সাধ্যাতীত।•••
—“হস্তীরা আসিয়া পৌঁছিয়াছে”—একজন বলিয়া উঠিল। আমি মুগ্ধ হইয়া সঙ্গীত শুনিতেছিলাম—এই বাক্যে আমার সেই মোহ ছুটিয়া গেল।•••হাতী আবার কোথা হইতে আসিল?—ও! মনে পড়িয়াছে; •• ভারতীয় সাজসজ্জায় সজ্জিত হাওদা-সমেত একটি হস্তী দেখিবার জন্য আমি ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলাম; এবং তদনুসারে আমার জন্য রাজার হস্তিশালা হইতে হস্তী সজ্জিত করিয়া আনিবার আদেশ হয়।
সঙ্গীত থামিয়া গেল। কেন না, হাতী দেখিবার জন্য এখন আমাকে ঘরের বাহির হইতে হইবে। বাড়ীর দ্বারদেশ পার হইয়াই হঠাৎ দেখিলাম —আমার সম্মুখে তিনটা বড়-বড় হস্তী দণ্ডায়মান। অস্তমান সূর্যের আলোকে উদ্ভাসিত এই তিনটা হার্তী দ্বারদেশের সন্নিকটে আমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করিতেছিল। উহাদের সর্ব্বশরীর সাজসজ্জায় এরূপ আবৃত যে, সম্মুখে আসিয়া প্রথমে আব কিছুই লক্ষ্য হয় না;—লক্ষ্য হয় শুধু উহাদের সুদীর্ঘ আত্মরক্ষণের অস্ত্র দন্তদয়, উহাদের কালো-ফুট্কি-যুক্ত গোলাপি-রঙের প্রকাণ্ড শুণ্ড, আর উহাদের কর্ণদ্বয়—যাহা হাতপাখার ন্যায় ক্রমাগত আন্দোলিত হইতেছে। সবুজ ও লাল রঙের দীর্ঘ পরিচ্ছদ; স্তম্ভযুক্ত হাওদা, ঘটিকার হার এবং জরির টুপি—যাহা উহাদের বিস্তৃত ললাট পর্য্যন্ত নাবিয়া আসিয়াছে। তিনটা হাতীই প্রকাণ্ড, ৭০ বৎসর বয়ঃক্রম, বেশ বলিষ্ঠ, আর এমন বশ্য—এমন শান্ত। উহাদের বুদ্ধিব্যঞ্জক ক্ষুদ্র চক্ষুর দৃষ্টি আমার উপর ন্যস্ত হইল। আর এমন শায়েস্তা,—যাহাতে আমি ধীরে-সুস্থে আরোহণ করিতে পারি, তজ্জন্য অনেকক্ষণ জানু পাতিয়া বসিয়া রহিল।
আবার যখন আমি সেই মক্ষিকাগুঞ্জনবৎ সঙ্গীতের নিকট ফিরিয়া আসিলাম, তখন শুভ গোধূলি সঙ্গীতশালায় প্রবেশ করিয়াছে।
মধ্যে মধ্যে যখন সেই স্তব্ধ প্রায় সমবেত সঙ্গীতের বিরাম হইতেছে — সেই অবকাশকালে প্রত্যেক যন্ত্র আবার পৃথকভাবে খুব উচ্চৈঃস্বরে সজোরে তান ধরিতেছে। বাদক কোনটাকে ছড়ের দ্বারা, কোনটাকে হস্তের দ্বারা প্রপীড়িত-কোনটাকে বা মিজ্রাফের দ্বারা সন্তাড়িত করিতেছে; এবং সর্ব্বাপেক্ষা বিস্ময়জনক, কোনটাকে তারের উপর ডিম্বাকৃত কাষ্ঠখণ্ড বুলাইয়া কাঁদাইয়া তুলিতেছে। কিন্তু সে যাহাই হউক, এই বিষাদময় সুরগুলি, মঙ্গলিয়া কিংবা চীনদেশীয় সঙ্গীতের ন্যায়, আমাদের নিকট নিতান্ত দূরদেশীয় কিংবা দুর্ব্বোধ বলিয়া মনে হয় না। আমরা উহাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারি। সেই একই মানবজাতির সুতীব্র মর্ম্মবেদনা উহারা প্রকাশ করিতেছে—যে জাতি কালসহকারে আমাদের হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দূরে চলিয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু মূলত ভিন্ন নহে। “জিগান্”-নামক য়ুরোপীয় বেদিয়ারা আমাদের মধ্যেও এইরূপ জ্বরজ্বালাময় সঙ্গীত আনয়ন করিয়াছে।
শেষে কণ্ঠসঙ্গীত। একটির পর একটি—সেই সমস্ত সুকুমার বালক-গুলি (সুন্দর-পরিচ্ছদ-পরিহিত -বড় বড় চোখ) খুব তাড়াতাড়ি দ্রুতলয়ে কতকগুলি গান গাহিল। উহাদের বালকণ্ঠস্বর ইহারই মধ্যে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে—চিরিয়া গিয়াছে। জরির পাগড়ি-পরা একটি লোক উহাদের অধিনেতা ও শিক্ষক। সে মাথা নীচু করিয়া —পাথীকে যেরূপ সর্পেরা দৃষ্টির দ্বারা মুগ্ধ করে, সেইরূপ সমস্তক্ষণ উহাদের চোখের পানে একদৃষ্টে তাকাইয়া ছিল। মনে হইল যেন সে বৈদ্যুতিক শক্তির দ্বারা উহাদিগকে আয়ত্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে;—ইচ্ছা করিলে যেন সে উহাদের ভঙ্গুর ক্ষীণ কণ্ঠযন্ত্রটিকে চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া ফেলিতে পারে। “কনিষ্ঠ-গ্রামের” সুরে উহারা যে গান ধরিয়াছিল, সেই গানটিতে, কুপিত কোন দেবতাকে প্রার্থনার দ্বারা প্রসন্ন করা হইতেছে।
সর্বশেষে, ঐ দলের যে প্রধান গায়ক, এইবার তাহার গাহিবার পালা। ত্রিশবর্ষবয়স্ক যুবাপুরুষ, দেখিতে বলিষ্ঠ, সুন্দর মুখশ্রী। কোন যুবতী কামিনীর বল্লভ আর তাহাকে ভালবাসে না বলিয়া সেই কামিনী আক্ষেপ করিয়া যে গান করিতেছে, সেই গানটি ঐ গায়ক এইবার আমাকে শুনাইবে।
সে বরাবর ভূতলেই বসিয়া ছিল। প্রথমে সে গানটি মনে-মনে ঠিক করিয়া লইল, পরে, তাহার দৃষ্টি একটু ঘোর-ঘোর ভাব ধারণ করিল। তাহার পরেই সে একেবারে সজোরে গলা ছাড়িয়া দিল। প্রাচ্যদেশীয় শানাই প্রভৃতি যন্ত্রের ন্যায় তাহার কণ্ঠস্বর অতীব তীক্ষ। তার-গ্রামের কতকগুলি সুরের উপর, পুরুষোচিত বল-সহকারে (একটু কর্কশ) উহার কণ্ঠস্বর স্থায়ী হইল। খুব তীব্রভাবে (আমার পক্ষে নূতন) কত মর্ম্ম-বেদনাই প্রকাশ করিল। তাহার মুখে কত দুঃখের ভঙ্গী-তাহার সরু-সরু হস্তে কত কষ্টের সঙ্কোচন প্রকটিত হইতে লাগিল। এই সমস্তই উচ্চাঙ্গ-কলার মধ্যে ধর্ত্তব্য।
ইহারা মহারাজের খাস্ গায়ক-বাদক। মহারাজা প্রতিদিন রুদ্ধ-প্রাসাদের ঘোর নিস্তব্ধতার মধ্যে, উহাদের সঙ্গীত শুনিয়া থাকেন। তাহার চারিপার্শ্বে ভৃত্যবর্গ মার্জ্জারবৎ নিঃশব্দপদসঞ্চারে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং জোড়হস্তে নতশিরে ক্রমাগত প্রণাম করে।••• জীবনের দুঃখযন্ত্রণা, প্রেমের দুঃখযন্ত্রণা, মৃত্যুর দুঃখযন্ত্রণা—এই সম্বন্ধে মহারাজার কল্পনা ও চিন্তাপ্রবাহ আমাদিগের হইতে না-জানি কত ভিন্ন।••• আদব-কায়দার সহিত বিদেশীয় ভাষায়, বাধ-বাধ-ভাবে আমাদের মধ্যে যে কথাবার্তা অল্পক্ষণ হইয়াছে, তাহাতে যত-না আমি তাহার অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিয়াছি—তাহা অপেক্ষা এই উচ্চাঙ্গের দুর্লভ সঙ্গীত (যাহা তাহার খাস জিনিষ) শ্রবণ করিয়া তাহার মনোভাবের একটু বেশি আভাস পাইয়াছি, সন্দেহ নাই।
এক্ষণে তিনসহস্র ব্রাহ্মণ মহারাজের নিমন্ত্রিত অতিথি। উঁহারা উচ্চ-বর্ণের জন্য রক্ষিত সেই ঘেরের মধ্যে বাস করিতেছেন এবং উঁহাদের সমাগমে পবিত্র পূষ্করিণীগুলিও সমাচ্ছন্ন। উহারা চতুর্দ্দিকের গ্রামপল্লী ও অরণ্য-প্রদেশ হইতে আসিয়াছেন, ফলমূলশস্যাদি আহার করিয়া জীবনধারণ করেন, পার্থিববিষয়ের প্রতি বীতরাগ এবং রহস্যময় ধ্যানধারণায় দিবারাত্রি নিমগ্ন। একটা যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য উহারা এখানে সমবেত হইয়াছেন। এই যজ্ঞ পনর দিন ধরিয়া চলিবে এবং ইহা ছয় বৎসর অন্তর অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। পূর্ব্বকালে, কোন পার্শ্ববর্তী দেশ জয় করিবার জন্য যে যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধকালে ঐ ভূমিতে যে রক্তপাত হয়, তাহারি প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ এই ব্রাহ্মণেরা সুদীর্ঘ প্রার্থনা মন্ত্রাদি পাঠ করিয়া থাকেন। অগণিত বৎসর অতীত হইয়াছে সত্য, কিন্তু তাহাতে কিছুই আসে যায় না। সেই রক্তপাতের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ এখনো ভগবানের নিকট উচ্চকণ্ঠে ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে হইবে, তূরীভেরী বাজাইতে হইবে, পবিত্র শঙ্খধ্বনি করিতে হইবে। রাজচিহ্নস্বরূপ এই শঙ্খ, ত্রিবন্দ্রম-অধিপতির ছত্রচামরাদিতে অঙ্কিত।
পাণ্ডবদিগের প্রতিমূর্ত্তি—ত্রিশফুট উচ্চ, মস্তকের উপর কিরণমণ্ডল বিরাজিত, ভীষণদর্শন; উহাদের রোষকযায়িত নেত্রের রুদ্রদৃষ্টি মানবগণের উপর নিপতিত। এই উৎসব উপলক্ষে, উহাদিগকে মন্দিরের গুপ্তকক্ষ হইতে বাহির করিয়া, রসারসি দিয়া, বহু আয়াসে মন্দিরের মুক্তপ্রাঙ্গণে—সুর্য্যালোকের মধ্যে টানিয়া আনা হইয়াছে। উদ্দেশ্য—যাহাতে সাধারণ লোকেরা উহাদিগকে দর্শন করিয়া ভীত হয়। ইহাদিগের নিকট যখন প্রার্থনাদি হয়, তখন ব্রাহ্মণেরা স্বয়ং অন্তরের অন্তস্তল হইতে সেই অদৃশ্য অনির্বচনীয় পরব্রহ্মেরই আরাধনা করিয়া থাকেন। যজ্ঞোৎসবের এই পনর দিন, অসংখ্য অনুষ্ঠান, সাগ্রহ প্রার্থনা, ভয়-আনন্দের জীবন-উচ্ছাসে-ব্রাহ্মণ-গণ্ডির প্রাচীরাভ্যন্তরস্থ ভূমি তীব্ররূপে স্পন্দিত হইতে থাকে। দূরস্থ লোকদিগের তুমুল কোলাহলে আমি প্রপীড়িত হইতেছি—আকৃষ্টও হইতেছি। কিন্তু সেখানে আমার প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ;—মহারাজের অনুগ্রহ এস্থলে কিছুই করিতে পারে না;— সর্ব্বপ্রকার মানবচেষ্টা এখানে নিষ্ফল।
যে বিশাল তালবনে এই নগরটি সমাচ্ছন্ন—সেই তালবনের মধ্যে যে সময়ে দীক্ষিত ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞোৎসব করিতেছেন, সেই একই সময়ে, তাহারি অনুকরণে, মধ্যবর্তী ও নীচবর্ণের লোকেরাও নিজ নিজ গৃহে এই অনুষ্ঠানে ব্যাপৃত। আমার ন্যায় তাহারাও ব্রাহ্মণসংসর্গ হইতে বর্জিত। সেখানেও, চতুর্দিকে, সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দেবতার নিকট এইরূপ অনুশোচনা ও ক্ষমাপ্রার্থনা চলিতেছে।
যুদ্ধে-নিহত বীরপুরুষদিগকে যেখানে গোর দেওয়া হইয়াছে, সেই-সব সমাধিস্থানে-সেই-সব চৈত্যবৃক্ষতলে— এইরূপ পূজা-অর্চনা হইতেছে।
রাত্রি হইবামাত্র, সেই বনের প্রত্যেক ছায়াচ্ছন্ন মার্গে, এবং যেখানে যেখানে সমাধিস্তম্ভ সমুখিত হইয়াছে এইরূপ প্রত্যেক চতুষ্পথে, ছোট- ছোট প্রদীপ জ্বালান’ হয়, বাদ্যোদ্যম হইতে থাকে, এবং বিবিধ নৈবেদ্য-সামগ্রী প্রদত্ত হয়। ক্ষুদ্র দেবালয় কিংবা সামান্য যজ্ঞবেদি-যাহা তক- অধিষ্ঠাত্রী নিকৃষ্ট দেবতাদিগের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত—সেখানেও সহস্র সহস্র ক্ষুদ্র কম্পমান অগ্নিশিখা জ্বলিতেছে। এখানে আমি অবাধে প্রবেশ করিতে পাইলাম। সহসা, পরস্পরসংশ্লিষ্ট তালবনের নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে গিয়া পড়িলাম। যেখান হইতে, বাদ্যের শব্দ শোনা যাইতেছে আলো দেখা যাইতেছে, আমি সেই দিকেই আকৃষ্ট হইয়া, পথভ্রান্ত পথিকের ন্যায় ইতস্তত বিচরণ করিতে লাগিলাম।
প্রথমেই একটি সামান্য ক্ষুদ্র দেবালয়;—বহুপুরাতন, লুপ্তমুখশ্রী-প্রস্তরস্তম্ভ-যুক্ত, অতীব নিম্ন, তরুপুঞ্জের পাদদেশে প্রতিষ্ঠিত; তরুগণ তাহাকে ছাড়াইয়া অতি ঊর্ধে অন্ধকারের মধ্যে মিলাইয়া গিয়াছে। দেবালয়টি ফুলের মালায় ও ফুলের অলঙ্কারে বিভূষিত। নারিকেলতৈলের ছোট ছোট দীপ চারিদিকে ঝুলিতেছে এবং তাহা হইতে যেন অসংখ্য জোনাকির আলো বিকীর্ণ হইতেছে। দুই তিনটি ক্ষুদ্র দালানের পশ্চাদ্ভাগে মন্দিরের বিগ্রহটি সমাধীন,—ভীষণদর্শন, মস্তকে উচ্চমুকুট, বহুবাহুবিশিষ্ট, মুখমণ্ডল শুকপক্ষীর ন্যায় হরিদ্বর্ণ। দেবালয়ের সুপরিচিত ও পবিত্র শাদা-শাদা ছাগশিশু চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। পুষ্পমালল্য বিভূষিত, অর্ধনগ্ন ভক্তের দল দ্বারের সম্মুখে ভিড় করিয়া হুড়াহুড়ি করিতেছে। শোকবিষাদময় তূরীরবে ও পবিত্র শঙ্খধ্বনিতে ঢাক-ঢোলের শব্দ ও বংশীধ্বনি আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে।
উহারা স্বাগত-স্মিতহাস্যে আমাকে অভ্যর্থনা করিল; তীব্রগন্ধি জুঁই-ফুলের মালা আমার কণ্ঠে পরাইয়া দিল। রাত্রির ‘গুমট্’-উত্তাপে, সুগন্ধি-রস-পাকের কটাহ-সমুথ্থিত ধূমের ন্যায়, এই জুঁইফুলের গন্ধ আমার, ‘মাথায় চড়িল'। তাহার পর লোক সরাইয়া আমার জন্য একটু জায়গা করা হইল। তালবনের চতুষ্পথবর্ত্তী শতবর্ষবয়স্ক একটি ডুমুরগাছের তলায় আমি দাড়াইলাম। প্রাচীনধরণের মস্তকহীন ক্ষুদ্রস্তম্ভ-পরিধৃত একটি প্রস্তরবেদীর চতুর্দিকে সমবেত লোকেরা আনন্দে উন্মত্ত হইয়া বাদ্য শ্রবণ করিতেছে। এখানেও দীপালোক, গোলাপ ও জুঁইফুলের মালা, ফলশস্যাদির নৈবেদ্য। পুরোহিতের মত একজন নীচবর্ণের লোক, মুখের রং কালো, খুব উচ্ছাসের সহিত মন্ত্রাদি পাঠ করিতেছে; আর মধ্যে মধ্যে ঢাক-ঢোল বাজিয়া উঠিতেছে। বৃক্ষসমূহের পশ্চাতে, ছায়ার মধ্যে, প্রচ্ছন্নপ্রায় রমণীগণ দাঁড়াইয়া আছে। এবং সকলে মিলিয়া দীর্ঘস্বরে চীৎকার করিয়া মুহুর্মুহু কি-একপ্রকার শব্দ করিয়া উঠিতেছে। কতকগুলি বালক ঘাসের আগুন জ্বালাইয়া ক্রমাগত উস্কাইতেছে; আর বাদকেরা মধ্যে মধ্যে আসিয়া তাহাদের বাদ্যযন্ত্রগুলি সেই আগুনের উপর সঞ্চালিত করিয়া, যথোপযুক্ত শব্দ বাহির করিবার জন্য, তাতাইয়া লইতেছে। পুরোহিতের উন্মত্ত উচ্ছসি উত্তরোত্তর বর্ধিত হইতে লাগিল;—ক্রমে সে ভূতাবিষ্ট হইল। সে বিকট চীৎকার করিয়া, বৃক্ষের উপর—প্রস্তরের উপর মাথা ঠুকিতে উদ্যত হইল; লোকেরা চারিদিকে শৃঙ্খলের ন্যায় বাহুবেষ্টন করিয়া তাহাকে আটকাইয়া রাখিল; তাহার পরেই সে অবসন্ন স্পন্দহীন হইয়া মূৰ্ছিত হইল; কণ্ঠ হইতে ঘর্ঘর শব্দ বাহির হইতে লাগিল।•••
এই দেবতা—যিনি আমাদের হইতে বহুদূরে—যাহাকে এখানকার লোকেরা ঘোর বাদ্যধ্বনি-সহকারে পূজা করিতেছেন-ইনি রহস্যময় ব্রাহ্মণদিগের দেবতারই রূপান্তরমাত্র,—সেই দেবতা, যাঁহাকে ব্রাহ্মণেরা মন্দিরের নিভৃতকক্ষে আধ্যাত্মিকভাবে আরাধনা করিয়া থাকেন।
আমরা যে-দেবতাকে ভজনা করি—তিনি সেই দেবতারই রূপান্তর- মাত্র...কেন না, ব্রহ্ম, জিহোবা, আল্লা—যে নামেই অভিহিত হউন না, “মিথ্যা-দেবতা” কেহই নাই। যে তত্ত্বজ্ঞানীরা অভিমান করেন—কেবল তাঁহাদের দেবতাই সত্য, তাহাদের বৃথা-গর্ব্ব শিশুজনোচিত বলিয়া আমার মনে হয়। আসল কথা, সেই অপরিমেয় অনধিগম্য পুরুষ আমাদের জ্ঞানকে এতদূর অতিক্রম করেন যে, আমরা তাঁহার স্বরূপসম্বন্ধে যে-কোন ধারণাই করি না কেন, তাহাতে ভ্রান্তি হইবার কথা; একটু কম ভ্রম হইল, কি একটু বেশি ভ্রম হইল, তাহাতে কিছুই আসে যায়-না। যাহারা জীবন-মৃত্যুর কষ্টবন্ত্রণায় আর্ত্তনাদ করিতে করিতে অরণ্যের একটা হীনবিগ্রহের পদতলে প্রার্থনা করে—যতই তাঁহারা ক্ষুদ্র হউক, যতই তাহারা অনুন্নত হউক, তাহাদের প্রার্থনাও তিনি শ্রবণ করেন।
ভারতে, কাকের কা-কা-ধ্বনি যেন সমস্ত শব্দরাশির ভিত্তি-স্বরূপ। তাই, ক্রমে সেই ধ্বনি অভ্যস্ত হইয়া যায়—আর গ্রাহের মধ্যে আইসে না। মন্দিরের কোলাহল থামিয়া গেলে, পার্শ্ববর্তী কাকদিগের ভীষণ বৈতালিক সঙ্গীত যখন আরম্ভ হয়, আমি জাগ্রত হইয়া আর তাহা উপলব্ধি করিতে পারি না। আমার ছাদের সম্মুখেই একটা বৃহৎ বৃক্ষ,—সেই বৃক্ষশাখাই তাহাদের প্রিয় দাঁড়। সেই বৃহৎ তরুর গোলাপিরঙের কুসুমগুচ্ছ অনেকটা আমাদের Chestnut-তরুর পুষ্পের ন্যায়। অরুণোদয় পর্যন্ত ইহার শাখাগুলি এই কৃষ্ণবর্ণ বিহঙ্গদিগের ভারে বক্র হইয়া থাকে।
আজ প্রাতে, সূর্যোদয়ে, যখন পল্লবপুঞ্জের তলদেশ-হরিৎ-শাখা- মণ্ডপের তলদেশ-নবভানুর কিরণচ্ছটায় উদ্ভাসিত হইল, আমি সেই সময়ে ব্রাহ্মণঘেরের মধ্যে মহারাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য একটা গাড়িতে উঠিলাম।
সিংহদ্বার পার হইয়া, প্রথমেই আবার সেই পবিত্র পুষ্করিণীগুলি দেখিতে পাইলাম। এই সব পুষ্করিণীর জলে ব্রাহ্মণেরা প্রতিদিন প্রভাতে অর্ধনিমজ্জিত হইয়া স্নান করে—পূজার্চ্চনা করে।
এই প্রাচীরবেষ্টিত নগরের মধ্যে এইবার আমি পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকদূর অগ্রসর হইয়াছি। এই নগরস্থ উদ্যানের মধ্যে, তালপুঞ্জের মধ্যে, শুধু যে রাজপরিবারেরই বাসস্থান, তাহা নহে; তা ছাড়া, রাস্তার দুধারে ছোট ছোট মাটির ঘর রহিয়াছে, তাহাতে শুধু উচ্চবর্ণের লোকেরা বাস করে। আয়তনয়না ব্রাহ্মণগৃহিণীরা, এই রমণীয় উসাকালে, নিজ নিজ গৃহের সম্মুখস্থ ভূমির শোভাসম্পাদনে প্রবৃত্ত হয়। সেই লাল মাটি উত্তমরূপে পিটাইয়া ও ঝাটাইয়া, একটা শাদা গুড়া দিয়া তাহার উপর নানাবিধ অদ্ভুত নকসা কাটিতে থাকে। কিন্তু এই নক্সাগুলি এত ক্ষণস্থায়ী যে, একটু বাতাস উঠিলেই বিলুপ্ত হয়—অথবা মানুষের, ছাগলের, কুকুরের, কাকের পদসঞ্চারে মুছিয়া যায়। অগ্রে তাহারা একটু একটু চিহ্ণ দিয়া রাখে,—পরে সেই চিহ্ণ-অনুসারে খুব তাড়াতাড়ি নক্সাগুলি রচনা করে। অতীব শোভনভাবে আনত হইয়া, গুড়ার আধারপাত্রটি হস্তে লইয়া, মাটির উপর ঘুরিয়া ফিরিয়া দ্রুতভাবে বেড়াইতে থাকে। সেই চূর্ণপাত্র হইতে শাদা-শাদা চূর্ণধারা, অফুরন্ত ফিতার ন্যায় অনবরত পড়িতে থাকে। গোলাপপাপড়ির অনুকরণে জটিল নকসা, জ্যামিতিক আকৃতির চিত্রাবলী, উহাদের নিপুণ অঙ্গুলি হইতে আশ্চর্য্যরূপে বাহির হইতে থাকে। নকসা- রচনা শেষ হইলে, অঙ্কিত রেজালের প্রধান-প্রধান সন্ধিস্থলে উহারা নানাবিধ পুষ্প বসাইয়া দেয়। এইরূপে, সেই ছোট রাস্তার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিভূষিত হইলে, অন্তত ঘণ্টাখানেকের জন্য মনে হয়, যেন একটা চিত্র বিচিত্র অদ্ভুত গালিচায় রাস্তাটি আচ্ছাদিত হইয়াছে।
তা ছাড়া, এই অঞ্চলটির সর্বত্রই কেমন-একটা প্রাচীনধরণের শোভন পারিপাট্য, বিমল শান্তি ও সরল গাম্ভীর্য্য বিরাজমান।
মহারাণীর উদ্যানের সিংহদ্বারের সম্মুখে, সেই একইধরণের কায়দাদুরস্ত লালপাগড়িওয়ালা সিপাই-সান্ত্রী। উহারা তূরীভেরী বাজাইয়া, অস্ত্রশস্ত্র স্কন্ধ হইতে নামাইয়া, উচিত সম্মানপ্রদর্শনে সতত তৎপর। মহারাণীর পতি রাজা, বহিঃসোপানের নিম্নতলে, চাতালে নামিয়া-আসিয়া, বিশিষ্ট শিষ্টতার সহিত পূর্ণ উপচারে আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন। মহারাজের ন্যায় ইনিও সুরুচির অনুসরণ করিয়া, ভারতীয় বেশেই আসিয়াছিলেন। সবুজরঙ্গের মখমলের পোষাক, মাথায় শাদা রেশমের পাগড়ি, আর সর্বাঙ্গে হীরক ঝকমক করিতেছে। এই সমস্ত বেশভূষা সত্ত্বেও ইনি একজন কৃতবিদ্য পণ্ডিত।
প্রাসাদের প্রথমতলস্থ দরবারশালায় মহারাণী আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন। এই দরবারশালাটি য়ুরোপীর আসবাবে সজ্জিত। কিন্তু মহারাণী স্বয়ং স্বদেশীয় পরিচ্ছদ ধারণ করায় তাঁহাকে মূর্তিমতী ভারতলক্ষ্মী বলিয়া মনে হইতেছিল। তাহার পার্শ্বমুখের অবয়বরেখা সরল, মুখশ্রী অতি বিশুদ্ধ, চোখদুটি বেশ বড় বড়,—তাঁহার সমস্ত শ্রীসৌন্দর্য্য স্ববংশ- সুলভ। মায়ের-জাতির প্রথা-অনুসারে, তিনি তাঁহার কৃষ্ণ কেশকলাপ প্রথমে ফিতাবন্ধনের আকারে বিন্যস্ত করিয়া, পরে সেইগুলি একত্র সম্মিলিত করিয়া ছোট একটি মসৃণ টুপির মত মস্তকে ধারণ করিয়াছেন। উহা সম্মুখদিকে ঝুকিয়া, ললাটের উপর ছায়াপাত করিয়াছে। হীরক- মাণিক্য-খচিত কানবালার ভারে কর্ণদ্বয়ের নিম্নাংশ অতিমাত্র প্রসারিত। মখমলের ‘চোলি’-পরা, নগ্ন বাহুদ্বয়ে বহুমূল্য মণিখচিত বাজুবন্ধ; পবিধানে জরির পাড়ওয়ালা শাড়ী;—তাহাতে সুন্দর নকসা কাটা। প্রস্তর প্রতিমা যেরূপ পরিচ্ছদে আবৃত হয়, তাঁহার পরিচ্ছদ তদনুরূপ। যে দেশে নিম্নশ্রেণীর মধ্যেও বেশভূষায় মার্জিতরুচি পরিলক্ষিত হয়, সেখানে পুরাতন রাজবংশের সম্ভ্রান্ত রমণীদিগের কিরূপ বেশভূষা, তাহা সহজেই কল্পনা করা যাইতে পারে। কিন্তু এই মহারাণীর সৌন্দর্য্য, বেশভূষা অতিক্রম করিয়া, সর্বোপরি তাহার করুণা মুখশ্রীতে, তাঁহার মৌনমাধুর্য্যে, তাঁহার নারীজনোচিত শালীনতায় আরো যেন ফুটিয়া উঠিয়াছে।
তা ছাড়া, তাঁহার স্মিতহাস্যের অন্তরালে যেন একটা চাপা বিবাদের ভাব প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে, বেশ বুঝা যায়। তাঁহার তাপসীকল্প জীবন, কিসের দুঃখে তমসাচ্ছন্ন, তাহা আমি অবগত আছি। ব্রহ্মা তাঁহার অদৃষ্টে একটিও কন্যারত্ন লেখেন নাই; তাঁহার একটি ভাগিনেয়ীও নাই যাহাকে তিনি দত্তকস্বরূপে গ্রহণ করিতে পারেন। তাই তাঁহার বংশলোপ হইবার উপক্রম হইয়াছে। বহুশতাব্দী হইতে আজ পর্যন্ত যাহা কখন ঘটে নাই, এইবার তাহা ঘটিতে চলিল। এইবার ত্রিবন্ধুরে একটা বিষম বিপ্লব উপস্থিত হইবে।••• . মহারাণীর সহিত যুরোপসম্বন্ধে আমার কথাবার্ত্তা হইল। এই প্রসঙ্গে তাঁহার কল্পনা বিলক্ষণ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছিল। আমি বুঝিলাম, ঐ সুদূরভূখণ্ড সম্বন্ধে জ্ঞানলাভকরাই তাঁহার জীবনের একটি চিরপোষিত স্বপ্ন। কিন্তু, মঙ্গলগ্রহের কিম্বা চন্দ্রলোকের কাল্পনিক দেশসমূহের ন্যায় এই য়ুবোপ তাঁহার পক্ষে দুরধিগম্য। কেন না, ত্রিবঙ্কুরে, কোন সম্ভ্রান্ত উচ্চকুলের রমণী, বিশেষত কোন রাজরাণী য়ুয়োপযাত্রা করিলে, তাঁহাকে জাত্যংশে পতিত হইয়া “পারিয়া’’র সামিল হইতে হয়।
আর যে-কয়েকদিন আমি ত্রিবঙ্কুরে অবস্থিতি করিব, ইহার মধ্যে মহারাজার দর্শনলাভ আমার ভাগ্যে কখন কখন ঘটিতে পারে, কিন্তু এই লক্ষ্মীস্বরূপা মহারাণীর দর্শনলাভ আমার ভাগ্যে আর কখনই ঘটিবে না। তাই, এখান হইতে বিদায় হইবার পূর্ব্বে, যে মূর্ত্তিটি একালের বহিয়া মনে হয় না, সেই মূর্ত্তিটি আমার নেত্রের উপর ভাল করিয়া মুদ্রিত করিয়া লইতে আমি অভিলাষী হইয়াছি। ইতপূর্ব্বে আমি এইরূপ রাণীদিগকে কেবল ভারতের পুরাতন ক্ষুদ্র চিত্রপটেই দর্শন করিয়াছি। মহারাণীর নিকট বিদায় লইয়া, এই ব্রাহ্মণগণ্ডির মধ্যেই, মহারাণীর এক ভগিনীর পুত্রদ্বয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। তাঁহারাই সিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী। তাঁহাদের পরেই এই রাজবংশ লোপ পাইবে। উহাদের মধ্যে একজনের পদবী “প্রথম রাজকুমার”, অপরটির পদবী “দ্বিতীয় রাজকুমার”। এই উদ্যানের মধ্যে, তাহাদের পৃথক্ আবাসগৃহ। এই যুবকদ্বয়ের উষ্ণীষে মরকতমণির শ্রীপক সংযোজিত। ইহারা ব্যাঘ্রশিকার করেন, ব্রাহ্মণ্যের অনুষ্ঠানাদি করেন, অথচ আধুনিক কালের সমস্ত বিষয়েরই খোঁজখবর রাখেন, এবং সাহিত্য ও ভৌতিকবিজ্ঞানের অনুশীলন করেন। ইহাদের মধ্যে একজন, আমার অনুরোধক্রমে, প্রথমে আমাকে হাওদাখানায় লইয়া গেলেন। সেইখানে হাতীদের সাজসজ্জা ও সরঞ্জাম রক্ষিত। তাহার পর, তাঁহার স্বগৃহীত কতকগুলি ফোটোচিত্র আমাকে দেখাইলেন; তিনি নিজহস্তে সেগুলি পরিস্ফুট করিয়াছেন। এবং পরে, পদকপুরস্কারলাভের আশায় ঐগুলি সখ্ করিয়া তিনি য়ুয়োপের কোন প্রদর্শনীতে পাঠাইয়া দেন।
আজ সন্ধ্যার সময়, সূর্যাস্তকালে, ভারতসমুদ্র দেখিতে আমার ইচ্ছা হইল। ত্রিবন্ধুর হইতে সমুদ্র প্রায় দেড়ক্রোশ দূরে। সেখানে উহার বীচিমালা বিজন তটভূমির উপর অনবরত ভাঙিয়া পড়িতেছে।
মহারাজার একটা গাড়িতে উঠিয়া, প্রথমে সমস্ত প্রাচীরবেষ্টিত নগরটি অতিক্রম করিতে হইল। ব্রাহ্মণগৃহসমূহ্নের পার দিয়া যে সব রাস্তা গিয়াছে, দেই সব নিস্তব্ধ রাস্তা দিয়া, প্রাসাদ ও উদ্যানের লাল প্রাচীরের সম্মুখ দিয়া, বৃহৎ মন্দিরটির ধার দিয়া, আমার গাড়ি চলিতে লাগিল। মন্দিবের এত নিকটে আমি ইতপূর্ব্বে কখন আসি নাই।
শীঘ্রই নগর পার হইলাম এবং নগর পার হইয়াই, নিস্তব্ধ সৈকতভূমির মধ্যে, স্তুূপাকার বালুকারাশির মধ্যে আসিয়া পড়িলাম। রক্তবর্ণ প্রকাণ্ড সুর্য দিগন্তে মগ্নপ্রায়,—তাহারি ভাঙা-ভাঙা রশ্মিচ্ছটা চারিদিকে প্রসারিত। অম্মদ্দেশের সমুদ্রোপকূলস্থ বৃক্ষের ন্যায়, বাতাহত ও অলুলিতশাখ কতক-গুলি বিরল তালজাতীয় বৃক্ষ, সাগরবায়ুর অবিশ্রান্ত প্রনাহবেগে, ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। বহুশতাব্দীসঞ্চিত এই সব বালুকারাশি, এই সমস্ত প্রস্তর, প্রবাল ও শম্বূকের চূর্ণরাশি, সহস্র-সহস্র চূর্ণীকৃত জীবদেহের ধুলিরাশি। এই ভীষণ স্থানের সান্নিধ্য ঘোষণা করিতেছে। তাহার পরেই, সেই অন্তহীন মহাকণ্ঠস্বর শ্রুত হইল। এবং এই বালুকাস্তুপের মধ্যে, একটা পথের বাঁক ফিরিবামাত্র, সেই সচল অনন্তমূর্ত্তি আমার সম্মুখে সহসা আবিভূত হইল।
পৃথিবীর অন্যান্য প্রদেশে, মনে হয় যেন, মানবজীবন স্বভাবতই সমুদ্রের অভিমুখে প্রবাহিত হয়। সেখানে লোকেরা সমুদ্রের ধারে আবাসগৃহ নির্ম্মাণ করে, সমূদ্রের যতটা নিকটে হওয়া সম্ভব—তাহাদের নগর পত্তন করে; তাহাদের নৌকাদির জন্য অল্পস্বল্প স্থান এবং বেলাভূমির একটু আধটু কোণ খালি রাখিতেও তাহারা যেন কুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু এখানকার লোকেরা সমুদ্রকে শূন্য শ্মশান ও সাক্ষাৎ মৃত্যু মনে করিয়া, যতটা পারে, তাহা হইতে তফাতে সরিয়া যায়। এদেশে সমুদ্র - একটা দূরতিক্রমণীয় অতলস্পর্শ রসাতলবিশেষ —যাহা কোন কাজে আইসে না, যাহা কেবল মনুষ্যের অন্তরে ভয়ের উদ্রেক করে।সমুদকে দুর্গম স্থান মনে করিয়া কেহ তাহার নিকটে যাইতে সাহস করে না। আমি এই অনন্ত বীচিমালার সম্মুখে, বালুরাশিব অফুরন্ত রেখাব উপবে, একটি পুরাতন প্রস্তরমন্দির ছাড়া মনুষ্যের আর কোন নিদর্শন দেখিতে পাইলাম। মন্দিরটি রূঢ়-ধরণে গঠিত, স্থল ও খর্ব্বকার, থামগুলি লুপ্তমুখশ্রী, কতকটা তরঙ্গশীকরে, কতকটা লবণাক্ত জলে ক্ষয় হইয়া গিয়াছে। যে সমুদ্র-কর্তৃক ত্রিবন্ধুর কারারুদ্ধ, সেই দুরবৃত্ত সমুদ্রকে মন্ত্রবশীভূত ও প্রশমিত করিবার নিমিত্তই যেন এই মন্দিরটি এখানে অধিষ্ঠিত। এই সন্ধ্যাকালে সমুদ্রটি বেশ প্রশান্ত। কিন্তু গ্রীষ্মের আরম্ভ হইতে, এই সমুদ্র কিছুকালের জন্য আবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করিবে।
মহারাজা-বাহাদুরের উপদেশ-অনুসাবে দেওয়ান আমার জন্য যতপ্রকার অনুষ্ঠান-আয়োজনের কল্পনা করিয়া আমাকে অনুগৃহীত করিয়াছেন, তন্মধ্যে উচ্চবর্ণের বালিকা-মহাবিদ্যালয়ে আমার অভ্যর্থনার্থ যে আয়োজন হইয়াছে, তাহাই আমি বিশেষ অনুগ্রহ বলিয়া মনে করি। উহা আমি কখন ভুলিতে পারিব না।
সূর্য্যোদয় হইবামাত্র আমি গৃহ হইতে যাত্রা করিলাম। কিন্তু বলিতে কি, আমার মনে মনে একটু আশঙ্কা ছিল;—না জানি, সেখানে গিয়া কি দেখিব। হয় ত এমন-কিছু দেখিব, যাহা শুধু কঠোর গ্রাম্য-গুরুমহাশয়কে স্মরণ করাইয়া দিবে; কিংবা এমন-কিছু দেথিব, যাহা অতীব নীরস, বিরক্তিকর ও ক্লান্তিজনক। পাছে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বে সেখানে উপনীত হই, এইজন্য তালবনের মধ্যে ঘোড়াদের ছাড়িয়া রাখিয়াছিলাম। এই তালবনে, প্রথমে একটি, তারপর দুইটি, পরে তিনটি ক্ষুদ্র বালিকা আমার দৃষ্টিপথে পতিত হইল -বেশ সুশ্রী, জম্কাল বেশভূষায় ভূষিত হইয়া ঝম্মক্ করিতেছে; দশবর্ষবয়স্কা, নগ্ন পদ, কেশকলাপে শাদা ফুল;—পরিধানে জরির পাড়-দেওয়া রেশ্মি শাড়ী; কণ্ঠ ও বাহুস্থিত মণি-মাণিক্য-নব ভানুর কিরণে উদ্ভাসিত। আমার ন্যায় উহারাও ব্রাহ্মণঘেরের অভিমুখে, চলিয়াছে। আমার গাড়ি দেখিয়া, উহারা প্রাণপণে দ্রুত চলিতে লাগিল; এবং চলিবার সময়, উহাদের মহার্ঘ বস্ত্রের অঞ্চলপ্রান্ত পায়ে জড়াইয়া যাইতে লাগিল......তবে কি উহাদের এই পরীসুলভ কিংবা অপ্সরাসুলভ সাজসজ্জা আমারই জন্য?...
এই সব ভারতীয় পরীবালিকাগুলি উহাদের বিদ্যালয়ে গিয়া সম্মিলিত হইল। বিদ্যালয় সহসা যেন কিরণচ্ছটায় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। বোধ হইল, এখন উহাদের ছুটির সময়। কিন্তু তথাপি উহারা আমার জন্য একটি দিনের প্রাতঃকাল ছাড়িয়া দিতে সম্মত হইয়াছে। উহাদের মধ্যে একজন একটা ফুলের তোড়া উপহার দিবার জন্য আমার নিকট আসিল। ফুলের তোড়াটি বেশ সুগন্ধ ও সুসজ্জিত; ফুলগুলি জরির তারে জড়িত।
যে শিক্ষা অম্মদ্দেশে সর্ব্বোচ্ছেদকারী মহা অনর্থ হইয়া দাড়াইয়াছে, সেই শিক্ষা স্বরাজ্যে বিস্তার করা মহারাজার একান্ত ইচ্ছা। কিন্তু যতদিন ধর্ম্মবিশ্বাস অক্ষত থাকিবে, যতদিন ধর্ম্ম সর্ব্বোপরি বিরাজমান থাকিয়া মঙ্গলকিরণ বর্ষণ করিবে, ততদিন ত্রিবন্ধুরে কিছুকালের জন্য শিক্ষা হইতে শুভফলই প্রসূত হইবে সন্দেহ নাই।
উচ্চকুলোদ্ভবা বালিকাদিগের এই মহাবিদ্যালয়-যাহা অসুদ্দেশীয় বিদ্যালয়ের সমতুল্য, অথবা তাহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ—এই বিদ্যালয়টি মহারাজ আমাকে দেখাইবেন মনে করিয়া, যাহাতে আমার চক্ষে ইহা একটি দুর্লভদর্শন দ্রষ্টব্যজিনিষ বলিয়া প্রতীয়মান হয়, তজ্জন্য তিনি বিশেষ আয়োজন করিয়াছিলেন; বালিকাগণের অভিভাবকদিগকে বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, যেন বয়োজ্যেষ্ঠদিগের গুরুভার অলঙ্কারে ভূষিত করিয়া উহাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠান হয়। তাই, মন্দিরের দেবীগণ যেরূপ অলঙ্কার ধারণ করেন, সেইরূপ সুগঠিত মণিমাণিক্যের পুরাতন অলঙ্কারগুলি এই সকল তরুণ বাহুতে—তরুণ কণ্ঠে অধিষ্ঠিত হইয়া ঝিক্মিক্ করিতেছিল।
এই বিদ্যালয়ের পড়িবার ঘরগুলি আমাদের য়ুরোপীয় ইস্কুলের পড়িবার ঘরের ন্যায়;—স্বল্প-উপকরণ ও মুক্ত-পরিসর। শুধু কতকগুলি বড়-বড় মানচিত্র শাদা দেয়ালের গায়ে ঝুলিতেছে। কচি-কচি মেয়েগুলি হইতে, বয়স্ক বালিকা পর্য্যন্ত—এই সমস্ত অপূর্ব্ব ছাত্রীবৃন্দ—আমার চক্ষে কতকগুলি পুতুল বলিয়া মনে হইল। কচি মেয়েগুলির ড্যাবা ড্যাবা চোখের বিস্ফারিত তারা চারিদিকে ঘুরিতেছিল। শাড়ী ও জরির চোলী—এই দুয়ের মধ্যবর্ত্তী স্থানে, উহাদের তাম্রাভ নগ্নগাত্র দেখা যাইতেছিল। বড়-বড় বালিকাগুলির মাথার উপরিভাগে “ভর্জিন্”-ধরণে ফিতা বাঁধা, তাহার উপর ভারতীয় শাদা মল্মলের অবগুণ্ঠনবস্ত্র। যে বয়সে বালিকারা স্বীয় শরীরকে দেবালয়বৎ সযত্নে রক্ষা করিতে প্রথম আরম্ভ করে—সেই বয়সের বালিকাদিগের দৃষ্টিতে যে উদ্বেগ ও গাম্ভীর্য্যের ভাব লক্ষিত হয়, এই বালিকাদিগের মুখে ইহারি মধ্যে সেই ভাব পরিব্যক্ত।...উহাদের প্রবন্ধরচনা, উহাদের ঐতিহাসিক রচনা আমাকে দেখান হইল। ঐ ক্ষুদ্র দেবীগুলি যে-সব সুন্দর ছবি আঁকিয়াছে, তাহাও আমাকে দেখান হইল। যে-সব আদর্শ আমাদের শিশুরা নকল করে—য়ুরোপ হইতে আনীত সেই-সব আদর্শচিত্র দেখিয়াই এই ছবিগুলি আঁকা। এই সব চিত্ররচনার নীচে উহাদের নাম লেখা। নামগুলি কতিপয়-পদাক্ষর-বিশিষ্ট—গানের কলির ন্যায় অতীব সুশ্রাব্য।
ছয়সাত-বৎসর-বয়স্কা একটি বালিকা, একটা “ঈগ্ল্”-পক্ষীর ছবি আঁকিয়াছে—উহার পালকরাশি অতীব জটিল; পাখীটা বৃক্ষশাখায় বসিয়া আছে। বেশ বুঝা যাইতেছে, বালিকা মাপ-জোক্ না করিয়াই, মধ্যস্থল হইতে আঁকিতে আরম্ভ করে। সমস্ত মাথাটা কুলায়-কাগজের এরূপ উচ্চতা ছিল না; তাই, ঈগ্লের মাথাটা চ্যাপ্টা করিয়া আঁকিয়াছে—কাগজপ্রান্তের একেবারে গা-ঘেঁষিয়া আঁকিয়াছে; কিন্তু তবুও একটি পালক বাদ দেয় নাই,—একটি খুঁটি-নাটি বাদ দেয় নাই। ছবির নীচে, বেশ সুস্পষ্টরূপে—জোর-কলমে—নিজের নাম স্বাক্ষর করিয়াছে,—“অপ্সরা”।
জরির কাজ-করা মখ্মল্; বাষ্পবৎ স্বচ্ছ অবগুণ্ঠন; হীরা, মাণিক, স্বচ্ছ-পান্না; সরু-সরু ক্ষুদ্র বাহুতে বড়-বড় বালা সূতা দিয়া আবদ্ধ; দুষ্প্রাপ্য পুরাতন পোর্টুগীমুদ্রায় গ্রথিত কণ্ঠহার;—যে সময়ে গোয়ার সমৃদ্ধ অবস্থা,—এই মুদ্রাগুলি সেইসময়কার;—চন্দনকাষ্ঠের সিন্দুকের মধ্যে না জানি কত শতাব্দী ধরিয়া ঘুমাইয়া ছিল!
সর্ব্বশেষে গান, বহু বেহালার সমবেতবাদ্য, তাহার পর নৃত্য। নৃত্য অতীব জটিল ও বিলম্বিত—একটু ধর্ম্মভাবান্বিত; তালে-তালে পা পড়িতেছে, বাহুসঞ্চালনে মণি-মাণিক্য ঝিক্মিক্ করিয়া উঠিতেছে।…
এই বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বেশ সুন্দর-সুশ্রী; সচরাচর এরূপ দৃশ্য দেখা যায় না। আর উহাদের কি সুন্দর চোখ!—এরূপ চোখ একমাত্র ভারতবর্ষেই দেখা যায়। অহো! রহস্যের এই কুসুমকলিকাগুলি কি-এক অপূর্ব্ব অতীন্দ্রিয় অকলুষ সৌন্দর্য্যের ছবি আমার মনে অঙ্কিত করিয়া দিল!
কাল আমি ত্রিবঙ্কুর ছাড়িয়া যাইব। এখানে যে আদরযত্ন পাইয়াছি, আমি তার যোগ্য নহি। রাজাকে একটি “ক্রুশ” উপহার দিবার যে ভার গ্রহণ করিয়াছিলাম, আমি সেই প্রীতিকর কাজটি সুসম্পন্ন করিয়াছি। মহারাজার একটা নৌকা করিয়া জলাভূমির রাস্তা দিয়া আমি উত্তরদিকে যাত্রা করিব। কোচিনের ক্ষুদ্র রাজ্যে পৌঁছিতে দুই দিন দুই রাত্রি লাগিবে। সেখানে কিছুকাল অবস্থিতি করিব। তাহার পর, কোচিন ছাড়াইয়া, ৩০।৪০ঘণ্টার পথ অতিক্রম করিয়া, আবার সেই সব প্রদেশে আসিয়া পড়িব, যেখান দিয়া রেলপথ গিয়াছে এবং যেখান দিয়া আমি অনেকবার যাতায়াত করিয়াছি। যে রেলপথ কালিকট্ হইতে মাদ্রাজে গিয়াছে, সেই মহারেলপথটি আবার আমি ধরিব।
ত্রিবন্দ্রমে আজ আমার শেষ রাত্রি। তাই আজ সহরের অলিগলির মধ্যে ইচ্ছা করিয়া একটু বিলম্ব করিতেছি;—সেই সব পথ, যেখানে তমসাচ্ছন্ন নিবিড় পল্লবপুঞ্জের মধ্যে নারিকেলতৈলের রুদ্ধশ্বাস দীপগুলি মহাপ্রভাবশালী তালপুঞ্জের নৈশ অন্ধকার ভেদ করিতে না পারিয়া যেন হতাশ হইয়া পড়িয়াছে। দিনমান অপেক্ষা রাত্রিকালেই উদ্ভিজ্জজীবনের প্রভাব এখানে যেন একটু বেশি করিয়া অনুভব করা যায়;—হরিৎশোভার মহিমাসাগরে যেন ডুবিয়া যাইতে হয়।
কাল আমি চলিয়া যাইব। এখানে কিছুই আমি দেখিতে পাইলাম। ভারতের হৃদয়দেশে প্রবেশ করিতে পারিলাম না। এই প্রদেশ—যাহা ব্রাহ্মণ্যের কেন্দ্রস্থল বলিলেও হয়—এখানে আসিয়াও আমি ব্রাহ্মণ্যের কিছুই জানিতে পারিলাম না। যথোচিত সাদর অভ্যর্থনা পাইলেও, আমরা য়ুরোপীয়, আমাদের নিকট সে সমস্ত রহস্যের দ্বার এখনো রুদ্ধ।
বেড়াইতে বেড়াইতে আমি অবশেষে বণিক্দের সেই বড় রাস্তায় আসিয়া পড়িলাম। অনাবৃত আকাশ। উপরে তারা ঝিক্মিক্ করিতেছে। সোজা বড় রাস্তা—প্রাসাদ ও মন্দিরের ঘের পর্য্যন্ত আসিয়া মিলিত হইয়াছে। সরু-সরু উচ্চ দণ্ডের উপর স্থাপিত সেকেলে ধরণের দীপগুলি হইতে যে আলোক বিকীর্ণ—সেই আলোকের মধ্যে, স্ত্রীজনসুলভ দীর্ঘকেশধারী পুরুষজনতা চলাফেরা করিতেছে। এই সব লোক,—খোদিত পিত্তলসামগ্রী, ছাপ্-দেওয়া ছিটের কাপড়, পুতুল, দেব-দেবীর মূর্ত্তি—এই সমস্ত দ্রব্যের ক্রেতা-বিক্রেতা। ইহাদের কপিল গাত্র, কৃষ্ণবর্ণ কেশকলাপ, কৃষ্ণবর্ণ জ্বলন্ত চক্ষু। শস্যের দানা, মিষ্টান্ন, উদ্ভিজ্জমূল প্রভৃতি ব্রাহ্মণদিগের মিতাহারোপযোগী সামান্য খাদ্যসামগ্রী বিক্রয়ার্থ সজ্জিত রহিয়াছে। অসংখ্য ছোট ছোট দোকান;—উত্তুঙ্গ প্রদীপসমূহের আলোকে আলোকিত। কোন-কোন দীপের তিনটি শিখা। কোন পশুমূর্ত্তি অথবা দেবমূর্ত্তি এই দীপগুলিকে ধারণ করিয়া আছে।
রাজপথ হইতে দূরে সেই পবিত্র ঘেরের সিংহদ্বার এবং উহা ছাড়াইয়া আরো দূরে মুক্তদ্বার মহামন্দির ও তাহার গভীর অভ্যন্তরপ্রদেশ দেখা যাইতেছে। বিন্দুচিহ্নের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য দীপশিখা সারি-সারি জ্বলিতেছে। ইহা বিষ্ণুর মন্দির;—যেন এই প্রদেশেরই সুগম্ভীর ধ্যানমগ্ন অন্তরাত্মা।
যতদূর দৃষ্টি যায়—মন্দিরের ভিতরটা সমস্তই আলোকিত। ওখানে পুরোহিত ছাড়া আর কাহারও যাইবার অধিকার নাই। দীপালোকের রেখা দেখিয়া বুঝা যায়—মন্দিরের দালান কতদূর পর্য্যন্ত প্রসারিত। মধ্যস্থলে, গোলাপপাপ্ড়ির অনুকরণে একটা জ্যামিতিক নক্সা পরিলক্ষিত হইতেছে—বোধ হয়, উহা একটা প্রকাণ্ড বেলোয়ারির ঝাড়;—কিন্তু এতদূরে যে, ঠিক্ করিয়া কিছুই নিরূপণ করা যায় না। মন্দিরে সারাদিনই পূজার্চ্চনা চলিতেছে। আজ এই সান্ধ্যপূজার সময়, মানবকোলাহলের সহিত মিশ্রিত হইয়া সঙ্গীতধ্বনি—তূরীনিনাদ আমার নিকট পর্য্যন্ত আসিয়া, পৌঁছিতেছে। এই সিংহদ্বার যদিও কখনই রুদ্ধ থাকে না—তবু উহা দুর্লঙ্ঘনীয়। নভোব্যাপ্ত স্বচ্ছ তমোজালের মধ্য হইতে একটি প্রকাণ্ড “পিরামিড্” সিংহদ্বারের উপর দেখা যাইতেছে—উহা রাশীকৃত দেবমূর্ত্তির যেন, একটা স্তূপ। উহার খাঁজকাটা চূড়াদেশ—মনে হয় যেন তারকারাজির সহিত সংলগ্ন। চারিটা সিংহদ্বারের উপর এইরূপ চারিটা “পিরামিড’’ অধিষ্ঠিত। প্রতিদিন সান্ধ্যপূজার সময়, প্রত্যেক পিরামিডের উপর, দীপাবলী হইতে প্রসারিত একটা আলোকরেখা পরিলক্ষিত হয়;—এই আলোকরেখা তমসাচ্ছন্ন খোদিত মূর্ত্তিরাশির মধ্য দিয়া লতাইয়া-লতাইয়া চূড়াদেশ পর্য্যন্ত উঠিয়াছে;—মনে হয় যেন এই সব প্রস্তরময় দেবমূর্ত্তির মধ্য দিয়া একটা স্বর্গের পথ উপরে উঠিয়াছে।
যে সময়ে রাজপথ জনশূন্য হইয়া পড়ে, সেই সময় এখন উপস্থিত। এই সময়ে আদিম-কালসুলভ কাঠের দোকানগুলিতে দোকানদারেরা বেচাকেনা বন্ধ করিবার উদেবাগ করিতেছে এবং ভূতযোনি যাহাতে গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিতে না পারে, এই উদ্দেশে প্রাচীরের বহির্ভাগে, কুলঙ্গিতে ছোটছোট প্রদীপ জ্বালাইয়াছে।
দোকানদারের হিসাবনিকাশ করিতেছে। ত্রিবঙ্কুরের গোল-গোল টাকা ও পয়সা উহারা থলিয়া হইতে চাল-ডালের মত মুঠা-মুঠা তুলিয়া একপ্রকার গণনা-যন্ত্রের মধ্যে নিক্ষেপ করিতেছে। কতকগুলা তক্তা—তাহাতে সারি-সারি গর্ত্ত; এই প্রত্যেক কাঠের গর্ত্তের মধ্যে একএকটি মুদ্রা ধরে। যখন তক্তার সমস্ত আধারগর্ত্তগুলি পূর্ণ হইয়া যায়, তখন তাহারা সেই মুদ্রার মোট সংখ্যা ঠিক্ জানিতে পারে; তার পর ঐ সব মুদ্রা একটা বাক্সর মধ্যে ঢালিয়া, আবার অন্য মুদ্রার গণনা আরম্ভ করে। অপর কতকগুলি লোক একতাড়া শুষ্ক তালপত্রে তাহার অঙ্কগুলি লিখিয়া হিসাব করিতে থাকে। এই শুষ্ক তালপত্রগুলি কতকটা পুরাকালের “পেপাইরস্”-পত্রের ন্যায়। আমার মনে হইল, আমি যেন সেই পুরাকালের মধ্যেই অবস্থিতি করিতেছি।
রাত্রি অধিক হইয়াছে। জীবন-কোলাহল সহসা স্তম্ভিত হইল। প্রাচীরের ও মন্দিরের প্রদীপগুলি ছাড়া আর সমস্তই অন্ধকারের মধ্যে বিলীন হইল। রমণীরা নিজ নিজ গৃহে প্রবেশ করিয়াছে—কোথাও আর তাহাদিগকে দেখা যায় না। পুরুষের শাদা মসিনা-সূত্র-বস্ত্রে অথবা মল্মলে আবৃত হইয়া, কেশকলাপ মুক্ত করিয়া, ছাগাদির সহিত গৃহদ্বারের সম্মুখে বারাণ্ডার নীচে, ছাতের উপর, মৃতবৎ সটান শুইয়া পড়িয়াছে। গৃহকুট্টিমের নীচে অথবা ভূগর্ভস্থ কক্ষে শয়ন করিতে ভারতবাসীর অত্যন্ত বিতৃষ্ণা। তাই তাহার অবসাদজনক গ্রীষ্মরাত্রে, বিবিধ কুসুমের সুরভি উচ্ছ্বাসে পরিষিক্ত ও নীল ধূলায় পরিলিপ্ত হইয়া বহির্দ্দেশে শয়ন করে।
প্রভাতে, বায়সদিগের অশুভ কোলাহলের মধ্যে, মন্দিরের প্রাতঃপূজা যখন শেষ হইল, সেই সময়ে একটা গাড়ীতে উঠিয়া আমি যাত্রা করিলাম। প্রথমেই ত্রিবন্দ্রমের বন্দরে উপনীত হইলাম। এই মধুর রমণীয় সূর্য্যোদয়কালে, আর একবার—এবং এই শেষবার—নারিকেলবনাচ্ছন্ন ত্রিবন্দ্রমনগরের মধ্য দিয়া চলিতেছি।
আজ রাত্রে একটা ঝড় উঠিয়া, রাস্তার রক্তিম ধূলা, ছোট-ছোট মেটে দেয়ালের উপর—সুধালিপ্ত গৃহছাদের উপর ন্যস্ত করিয়াছে; তাহাতে করিয়া, যেন একপ্রকার লাল আলোকে, গৃহগুলি দৃষ্ট হইতেছে। আবার স্থানে-স্থানে, স্তবকে-স্তবকে পুষ্পরাশি তরুসমূহের চূড়াদেশ হইতে ভূতল পর্য্যন্ত ছাইয়া পড়িয়াছে।
প্রভাতে মহারাজার সিপাই-সান্ত্রি বিভিন্ন স্থানে বদ্লি হইয়া দলে-দলে যাতায়াত করিতেছে;—অস্ত্রশস্ত্রে ও উষ্ণীষে তাহাদের দেখিতে খুব জম্কাল। একদল লোক শান্তভাবে গির্জ্জার অভিমুখে চলিয়াছে; কেন না, আজ রবিবার। ইহারা ক্ষুদ্র বালিকা, মলমলচাদরে অবগুণ্ঠিতা—হস্তে একএকখানি গ্রন্থ। ইহাদের অধিকাংশই প্রাচীনখৃষ্টানবংশীয়; ইহাদের পূর্ব্বপুরুষ, আমাদের বহুশতাব্দী পূর্ব্বে, খৃষ্টভক্ত। এই সিরীয় অথবা ক্যাথলিক্ খৃষ্টানদের গির্জ্জা হইতে ঘণ্টাধ্বনি শুনা যাইতেছে। এই গির্জ্জাগুলি হিন্দুমন্দিরের সন্নিকটে এবং সেই একই হরিৎশোভার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। দেখিলে মনে হয়, শান্তি, সুশৃঙ্খলা, নির্ব্বিঘ্নতা ও পরধর্ম্মসহিষ্ণুতা এখানে পূর্ণভাবে বিরাজমান।
নৌকারোহণের ঘাট;—ইহাই ত্রিবন্দ্রমের বন্দর। কিন্তু বন্দর বলিলে যাহা বুঝায়—এ সেরূপ বন্দর নহে;—অর্থাৎ সমুদ্রের বন্দর নহে। কেন না, এখান হইতে সমুদ্র অনধিগম্য। এই বন্দরটি বিস্তৃত বিলের ধারে অধিষ্ঠিত। শতশত অচল-স্থির নৌকার মধ্যে একখানি নৌকা আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। এটি রাজার নৌকা। ইহা দেখিতে কতকটা সেকেলে সুদীর্ঘ রণতরীর ন্যায়; ইহার চোদ্দটা দাঁড়; পশ্চাদ্ভাগে একটি কাম্রা;—এই কাম্রার মধ্যে পা-ছড়াইয়া ঘুমানো যায়। চৌদ্দজন দাঁড়ী চোদ্দটা সরু বাঁশের দাঁড় যন্ত্রের ন্যায় একসঙ্গে ফেলিতেছে। এই যন্ত্র—তাম্রাভ মানবদেহ;—সুনম্যতা ও বল যেন মূর্ত্তিমান্।
নিবিড় তালবনের মধ্যে, সূর্য্যালোকে, এই বিলটি আমাদের সম্মুখে উদ্ঘাটিত হইল। এই গভীর বিলটি বরাবর সোজা চলিয়াছে। যাত্রারম্ভের সময়, দাঁড়ীরা গান গাইয়া, চীৎকার করিয়া, আপনাদিগকে উত্তেজিত করিয়া তুলিল। কীটাণুসঙ্কুল এই আবিল জলরাশি আমরা ভেদ করিয়া চলিলাম। ত্রিদিবসব্যাপী নিঃশব্দ জলযাত্রার আজ এই প্রথম আরম্ভ।
বিলের দুইধারে তালতরুপুঞ্জ অফুরন্ত পর্দ্দার ন্যায় একটার পর একটা ক্রমাগত আসিতেছে। মধ্যে মধ্যে বহুকাণ্ডবিশিষ্ট বটবৃক্ষ। শাখায়-শাখায় অপরিচিত কুসুমগুচ্ছ মাল্যাকারে বিলম্বিত; এবং বিন্দুলাঞ্ছিত আলুলিতদল একপ্রকার পদ্ম, “কাঠিতে-জড়ানো সূতার গুটির ন্যায় খাগড়াবনের মধ্যে গজাইয়া উঠিয়াছে।
ত্রিবন্দ্রম-অভিমুখে নৌকাসকল প্রতিমূহূর্ত্তে আমাদের নৌকার সম্মুখ দিয়া যাইতেছে। এই শান্তিময় নিস্তব্ধপ্রদেশের এই বিস্তীর্ণ জলাশয়টি লোকযাতায়াতের মহামার্গ। এই নৌকাগুলি প্রকাণ্ড, আকারে “গণ্ডোলা”র ন্যায়,—অতীব মন্থর ও নিঃশব্দচারী। সুনম্য-সুন্দর-অঙ্গভঙ্গি-সহকারে মাল্লারা লগি মারিয়া নৌকা চালাইতেছে। এই নৌকাগুলিরও পশ্চাদ্ভাগে একএকটি কাম্রা,—এই কাম্রাগুলি ভারতবাসী স্ত্রী-পুরুষে পরিপূর্ণ। আমরা চৌদ্দদাঁড়ের নৌকা করিয়া ব্যস্তভাবে কোথায়-না-জানি চলিয়াছি,— এই মনে করিয়া, ঐ সকল বড়-বড় কালো-চোখের কুতুহলী দৃষ্টি আমাদের উপর নিপতিত।
মধ্যে মধ্যে, একরকম চমৎকার পাখী—“মাছরাঙা”,—খুব উজ্জ্বল, খুব নীলবর্ণ, একপ্রকার আনন্দের চীৎকার করিতে করিতে জলের গা ঘেঁসিয়া উড়িয়া যাইতেছে। নীলপদ্ম ও রক্তপদ্ম চারিদিকে ফুটিয়া আছে।
আমাদের যাত্রাপথের এই অফুরন্ত জলরাশি, বিশেষ বিশেষ সময়ে, বিশেষ বিশেষ ভাব ধারণ করিতেছে:—কখন সঙ্কীর্ণ ও ছায়াময়;—মাথার উপর, দুই ধারের নারিকেলগাছগুলা সম্মিলিত হইয়া মন্দিরমণ্ডপে পরিণত হইয়াছে; শাখাগুলি যেন তাহার খিলান!—তাহার পর, এই জলরাশি ক্রমশঃ বিস্তৃত হইয়া, উচ্ছলিত হইয়া, সুদূর প্রদেশ পর্য্যন্ত প্লাবিত করিতেছে। দুইধারে, যবনিকার ন্যায় নিবিড় তালপুঞ্জ;—তাহার মধ্যে, এই বিলটি উদ্ভিজ্জশ্যামল ক্ষুদ্রদ্বীপসঙ্কুল সাগরবৎ প্রতীয়মান হইতেছে।
সূর্য্য ক্রমশঃ উর্দ্ধে উঠিল। এই ছায়াসত্ত্বেও, এই আলোড়িত জলরাশিসত্ত্বেও, গ্রীষ্মদেশসুলভ উত্তাপ ক্রমশঃ যেন ঘনাইয়া উঠিতেছে। তথাপি, আমাদের দ্রুতগতির কিছুমাত্র লাঘব নাই; আমাদের দাঁড়ীরা সমান জোরে দাঁড় ফেলিতেছে। মাঝি মধ্যে মধ্যে হাঁকডাক্ দিয়া দাঁড়ীদিগকে উত্তেজিত করিতেছে; সেই হাঁকডাকে তাহাদের সমস্ত মাংসপেশী একএক চাবুকের ঘায়ে যেন খাড়া হইয়া উঠিতেছে; এবং তাহারাও তাহার প্রত্যুত্তরে বানরের ন্যায় তীব্রস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিতেছে। আমাদের নৌকার পার্শ্ব দিয়া—তৃণরাশি, পদ্মের বৃন্তসমূহ, বিকশিত খাগড়াগুচ্ছ, আমাদেরি ন্যায় দ্রুতভাবে চলিয়াছে।
বেলা দশটা। এখন আমার নৌকা আর তাল-নারিকেলের নীচে দিয়া যাইতেছে না,—একটা গলির মত সঙ্কীর্ণ পথে, একপ্রকার শাদা ফুলের ঝোপ্ঝাড়ের মধ্য দিয়া চলিয়াছে। আমার সম্মুখে,—দুইধারে সমান সারিসারি তাম্রমূর্ত্তি-মানবেরা যন্ত্রের ন্যায় অঙ্গচালনা করিতেছে। এইভাবে ১৮ক্রোশ পথ উহারা অতিক্রম করিয়াছে। কেবল, অল্পস্বল্প স্বেদবিন্দু মুক্তাফলের ন্যায় উহাদের গাত্রে দেখা দিয়াছে; তাহাতে, উহাদের দেহযষ্টি খাঁটি ধাতবপদার্থের ন্যায় ঝিক্মিক্ করিতেছে। প্রখরভীষণ সূর্য্যকিরণে উহাদের দেহপঞ্জরের রেখাবলি আরো যেন পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। তটজাত ঝোপের অবসাদক্লিষ্ট শুভ্র কুসুমসমূহ বৃন্তচ্যুত হইয়া, উপর হইতে নীল জলরাশির উপর পতিত হইতেছে। উহাদের অতিপ্রচুর অনাবশ্যক ফলরাশিও বিকীর্ণ হইয়া, ছোট ছোট সোনার “আপেলের’’ ন্যায় চারিদিকে জলের উপর ভাসিতেছে।
আমাদের মাঝিমাল্লারা অবিশ্রান্ত বাহিয়া চলিয়াছে। এইবার উহারা গান ধরিয়াছে। স্বাস্থ্যকর-শ্রমপ্রভাবে তন্দ্রাভিভূত স্বপ্নদর্শী ব্যক্তির ন্যায় উহারা অলস-অবশভাবে গান গাহিতেছে। একপ্রকার ভাবশূন্য স্মিতহাস্যে উহাদের দশনদীপ্তি প্রকটিত হইতেছে।
এইবার একটি অধ্যুষিত প্রদেশ দিয়া আমরা চলিয়াছি। কতকগুলি গ্রাম; কতকগুলি মন্দির; কতকগুলি হিন্দুধরণে নির্ম্মিত প্রাচীন গির্জ্জা; সিরীয় খৃষ্টানেরা এদেশে আসিয়া, এইরূপ গঠনপ্রণালী স্বেচ্ছাপূর্বক অবলম্বন করিয়াছে।
সন্ধ্যার মুখে, আবার বিলটি—দুইধারের পর্ণতরুভূষিত উচ্চ পাড়ের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িল।
হঠাৎ অন্ধকার;—অন্তর্ভৌম শৈত্য। আমরা একটা সুরঙ্গের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি। যাহাতে দূরস্থ অন্যান্য বিলের সহিত—উত্তরস্থ বিলসমূহের যোগাযোগ ঘটে, এই উদ্দেশ্যে মহারাজা এই সুরঙ্গটি কাটাইয়াছেন। আজ সন্ধ্যায় এবং কাল সমস্তদিন আমরা এই অন্তর্ভৌম খালের মধ্য দিয়া যাইব। দাঁড়পতনের শব্দ এখন যেন দশগুণ বর্দ্ধিত হইল। অন্ধকারের ন্যায় কালো-কালো চলন্ত নৌকাগুলা যখন আমাদের নৌকার সম্মুখে আসিয়া পড়ে, তখন আমাদের মাল্লার চীৎকার করিয়া উঠে;— সেই শোকগম্ভীর প্রতিধ্বনির অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত পুনরাবৃত্তি হইতে থাকে।
এখন মধ্যাহ্ন। এইবার মাঝিমাল্লারা বদ্লি হইবে। অন্তর্ভৌম খাল অতিক্রম করিয়া আবার আমরা তালীবনসঙ্কুল ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জের গোলকধাঁধার মধ্যে আসিয়া পড়িলাম। সুশ্যামল-তরুপল্লব-নিমজ্জিত একটি গ্রামের সম্মুখস্থ তটভূমিতে আসিয়া আমাদের নৌকা ভিড়িল! এইখানে চাল্লিশজন নূতন মাল্লা আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। মহারাজার নৌকার জন্য, সমস্ত পথ এইরূপ লোকবদ্লির বন্দোবস্ত আছে।
এই নূতন মাল্লারা স্ব স্ব স্থানে উপবিষ্ট হইলে পর, একপ্রকার উন্মত্ত অঙ্গচালনা ও কোলাহল আরম্ভ হইল। শিশুসূলভ আনন্দের উচ্ছ্বাসে উচ্ছসিত হইয়া উহারা যাত্রা আরম্ভ করিল, খুব উত্তেজিত হইয়া দাঁড় ফেলিতে লাগিল, এবং শুভ্র দন্তপংক্তি আ-প্রান্ত বিকশিত করিয়া হাসিতে লাগিল—গাহিতে লাগিল। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ খৃষ্টান;—খৃষ্টসন্ন্যাসীরা যে বক্ষ-আবরণ পরিধান করে, সেই “স্ক্যাপুলারি” ইহাদের নগ্নবক্ষে ঝুলিতেছে। অপর মাল্লাদের ললাটে শৈবচিহ্ন, এবং বাহু ও বক্ষদেশে ভস্মধূসর তিনটি করিয়া সমতল রেখা অঙ্কিত।
আবার সেই তালজাতীয় তরুপুঞ্জ,—সেই একঘেয়ে তালীবনেরপ্রাচুর্য্যমহিমা!...উহা দেখিয়া-দেখিয়া চিত্ত উদ্বেজিত ও ক্লান্ত হইয়া পড়ে। মনে করিয়া দেখ,—তিনশতক্রোশব্যাপী সমস্ত প্রদেশটি উহাদের নিবিড় শাখাপুঞ্জে সমাচ্ছন্ন। ইহাতে, মনের মধ্যে কেমন একপ্রকার যাতনা উপস্থিত হয়। পুরাকালের লোকেরা যাহাকে “অরণ্যভীতি” বলিত—ইহা তাহারি একটা বিশেষ-আকার বলিলেও হয়।
সেই তালজাতীয় তরু; ক্রমাগত সেই তালজাতীয় তরু—তাহার আর অন্ত নাই। তন্মধ্যে কতকগুলি গগনস্পর্শী তালতরুর শাখাপত্র একত্র পুঞ্জীভূত। তাহাদের উত্তুঙ্গ কাণ্ডের চূড়াদেশ হইতে যেন কতকগুলা, পালোকের থোপ্না নীচে ঝুলিয়া পড়িয়াছে। আবার কতকগুলি তরুণ তরু আর্দ্রতপ্ত ভূমি হইতে গজাইয়া উঠিয়াছে; তাহাদের শাখাপত্র আরো বিশাল। সমস্তই কি হরিৎ-শ্যামল!—কি অভিনব উজ্জ্বলকান্তি! সূর্য্যকিরণে ঐ সকল স্নিগ্ধমসৃণ পত্রপুঞ্জ ঝিক্মিক্ করিয়া জ্বলিতেছে; এবং উহাদের তলদেশে, এই মধ্যাহ্নসময়ে, বিলের জলরাশি টিনের দর্পণের ন্যায় ঝক্মক্ করিতেছে।
সূর্য্য এখন মাথার উপর। শ্বেতাঙ্গ লোকদিগের যাহাতে সদ্য মৃত্যু হইবার কথা—সেই মধ্যাহ্নসূর্য্যের প্রখর কিরণে, আমার এই নৌকার মধ্যে, কি অপর্য্যাপ্ত জীবনী শক্তি ব্যয়িত হইতেছে! দাঁড়ীরা, বাহুপেশী প্রসারিত ও আকুঞ্চিত করিয়া দুইঘণ্টাকাল সমানভাবে দাঁড় টানিতেছে। বাহুর শিরাগুলা ফুলিয়া খাড়া হইয়া উঠিতেছে; আর সেই সঙ্গে উহার গলা ছাড়িয়া তীক্ষ্ণস্বরে গান গাহিতেছে। এক-একসময়ে, যেন একটা মত্ততার আবেশ আসিয়া উহাদের চিত্তকে অধিকার করে;—তখন, উহারা হাঁপাইতে-হাঁপাইতে ঝোঁকে-ঝোঁকে গান গায়িতে থাকে, জলরাশিকে অতীব ভীষণভাবে আক্রমণ করে;—জল ফেনাইয়া উঠে; দাঁড়গুলা ভাঙ্গিবার উপক্রম হয়। তখন কৃষ্ণচর্ম্মের উপর অঙ্কিত শৈবচিহ্নগুলি স্যন্দমান স্বেদজলে মুছিয়া যায়।
সন্ধ্যার মুখে, বিলটি আবার দুইধারের গালিচা-বৎ তৃণভূষিত উচ্চপাড়ের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িল। আমাদের চতুর্দ্দিকে শত শত নৌকা বিশ্রাম করিতেছে এবং আমাদের মাথার উপর, খোদাই-কাজ-করা একটা প্রস্তরসেতু প্রসারিত। যে স্থানে আমরা আসিয়াছি, ইহা “কিলোন্”-নামক ত্রিবঙ্কুরের একটি বৃহৎ নগর;—ত্রিবন্দ্রমের ন্যায়, বাগান-বাগিচার মধ্যস্থিত একটা মুক্ত পরিসরভূমি। এখানে তালজাতীয় বৃক্ষ আর দেখা যায় না। অন্য বৃক্ষ তাহাদের স্থান অধিকার করিয়াছে। এই বৃক্ষগুলি আমাদের বৃক্ষ হইতে ভিন্ন। এমন কি, এখানে শাদ্বলভূমি ও গোলাপগুল্মও দৃষ্ট হইতেছে। একটা বৃহৎ সোপান জলের মধ্যে নাবিয়া গিয়াছে; অদূরে শাদা-শাদা স্তম্ভশ্রেণী দৃষ্ট হইতেছে। ঐ গৃহে অনেকদিন কেই বাস করে নাই। শুনিলাম, দেওয়ানের আদেশক্রমে ঐখানেই আমাদের জন্য সান্ধ্যভোজের আয়োজন হইয়াছে। রাত্রির প্রারম্ভেই, আমরা ঐ বাটীতে উঠিলাম। উঠিবামাত্র, ঐ শুভ্রগৃহের ন্যায়—শুভ্রবসনধারী ভারতীয় ভৃত্যগণ সোপানপংক্তির উপর দৌড়িয়া আসিল এবং স্বাগত-অভ্যর্থনা করিয়া রূপার থালায় রক্ষিত একটা ফুলের তোড়া আমাকে উপহার দিল। দুইএকঘণ্টাকাল মাত্র এখানে আমার থাকিবার কথা। ততক্ষণ আমার মাঝিমাল্লারা বিশ্রাম করিতে পাইবে।
সান্ধ্যভোজের পর, এই বিজন উদ্যানে বসিয়া চিন্তা করা ভিন্ন আমার আর কোন কাজ নাই। মনে হয় যেন, ফ্রান্সের একটা পুরাতন উদ্যানে আসিয়া পড়িয়াছি।
উদ্যানটির একটু “পোড়ো” অবস্থা; ইহার সরু পথগুলির ধারে-ধারে বঙ্গদেশীয় গোলাপগুল্ম। আমার সম্মুখে; অস্তাচলদিগন্তে, নির্ব্বাপিতরশ্মি নভোদেশ এখনো তামসী রক্তিমা ধারণ করিয়া আছে—সেই ম্লানাভ আলোকচ্ছটা যাহা অম্মদ্দেশের উষ্ণতম গ্রীষ্মসন্ধ্যায় কখন-কখন পরিলক্ষিত হয়।
এই শান্তিময় নিস্তব্ধতার মধ্যে, শৈশবের চিরাভ্যস্ত ও সুমধুর স্মৃতির আবেশ আসিয়া আমার চিত্তকে অধিকার করিল;—তখন,—সর্ব্বসময়ে ও সর্ব্বত্র আমি প্রায় যাহা করিয়া থাকি, এখন তাহাই করিলাম;—এই স্মৃতির প্রবাহ-মুখে আপনাকে একেবারে ছাড়িয়া দিলাম। এই বিষাদময় স্মৃতি লইয়া আমি যদৃচ্ছাক্রমে আত্মবিনোদন করিতে পারি—তাহাতে কিছুমাত্র আমার ক্লান্তি হয় না।…বনবেষ্টিত “পোড়া”-ধরণের এই উদ্যানের ন্যায়, স্বদেশের কোন-একটি উদ্যানে, প্রকৃতির ভাব আমার মনে সর্ব্বপ্রথমে প্রতিভাত হয়; এবং আমাদের সেই সমতল-দিগন্তপ্রদেশে, অগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের জ্বালাময়ী সন্ধ্যার এইরূপ রক্তিম আলোকে, “গ্রীষ্মপ্রধানদেশের’’ প্রথম স্বপ্ন আমার মনে সমুদিত হয়।
সেই সেকালের গ্রীষ্মবায়ুর মধ্যে, এই একই যুথির সৌরভ বিচরণ করিত; এমন কি, তাম্রাভ আকাশের নীচে, উত্তাপ ও সন্ধ্যালোকপ্রভাবে ধূসরীকৃত—এইরূপ কৃষ্ণবর্ণ বাদুড় ও পেচকগুলা সেখানেও যাতায়াত করিত।…তবে কিনা, এখানে যে বাদুড়গুলা গৃহের মধ্যে বিচরণ করে, তাহা আমাদের চামচিকার অপেক্ষা অনেক বড়; আমাদের চাম্চিকার ন্যায়, ইহারাও নিঃশব্দচারী ও বিচিত্রগতি; কিন্তু ইহারা সেই বৃহৎ-আকারের বাদুড়, যাহাকে “ভ্যাম্পায়ার” বলে; এবং ইহাদের ডানা এত বিস্তৃত যে, উহারা সম্মুখে আসিলে পথ হইতে সরিয়া দাঁড়াইতে হয়!…তাহার পর সুদূরে—এই উদ্যানের চারিদিকে তমোবেষ্টনের ন্যায় যে তরুপুঞ্জ রহিয়াছে, তাহারি মধ্য হইতে সহসা তূরীনিনাদ ও পবিত্র শঙ্খধ্বনি সমুত্থিত হইল। এখন পূজার সময়;—তাই মানবকোলাহলও শুনিতে পাইলাম;—মন্দিরের অভ্যন্তর হইতে লোকেরা দেবতার নিকট যে স্তবস্তুতি করিতেছে—ইহা তাহারই শব্দ।...
তাহার পর, নিস্তব্ধতা আবার যেন ঘনাইয়া আসিল;—মুহূর্ত্তের মধ্যে যেন একটা বিশেষ আকার ধরিয়া পুনরাবির্ভূত হইল। কি-যেন একটা অননুভূতপূর্ব্ব বিষাদের ভারে আমি অভিভূত হইয়া পড়িলাম। স্মরণ হইল, আজ ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দ, ৩১শে ডিসেম্বরের রাত্রি। আমার শৈশবের শতাব্দীটি কালের অতল রসাতলে এখনি নিমগ্ন হইবে।...আমাদের নিকটে যাহা অনন্তবৎ—সেই তারকারাজি নভস্তলে ফুটিয়া উঠিয়াছে। গুরুভার অনন্তের ভাব আসিয়া, আমার ন্যায় ক্ষণজীবি প্রাণীর চিত্তকে বিদলিত করিল। এই পুরাতন শতাব্দী—যাহা অস্তোন্মুখ, এবং এই উদীয়মান নব শতাব্দী—যাহাতে আবার আমি ভাসিয়া চলিব—এই উভয়েরই উত্থানপতন মহাভীষণ অনন্তের তুলনায় অতীব নগণ্য বলিয়া মনে হয়। সকল পদার্থই শীঘ্র চলিয়া যাইতেছে−মরিয়া যাইতেছে—এইরূপ, একটা ভাব আসিয়া মনোমধ্যে উৎকট যন্ত্রণা উপস্থিত হইল। বৃহৎ বন ও বৃহৎ মন্দিরসমূহে আমি পরিবেষ্টিত−সঙ্কীর্ণ ব্রাহ্মণভারতের মধ্যে—ছায়ান্ধকারের মধ্যে আমি আবদ্ধ—এই কথা মনে হওয়ায়, মনোমধ্যে একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব ও সুমধুর উদ্বেগ উপস্থিত হইল। এই সব গোলাপযুথিকাশোভিত উদ্যান দর্শনে বারংবার স্বদেশবিভ্রম হইলেও, প্রবাসের ভাব মন হইতে একেবারে দূর হয় না। যখনি যে দেশে গিয়াছি—এইরূপ অসম্বদ্ধ ও অনির্ব্বচনীয় ভাবসমূহ আমার চিত্তমধ্যে উদয় হইয়াছে। তবে কিনা, সকল জিনিষেরই মত, তাহার তীব্রতা কালসহকারে হ্রাস হইয়া আসে। কিন্তু আজ রাত্রে, আমার এই দৈহিক শ্রান্তির মধ্যে, অবসাদময় উষ্ণতার মধ্যে, তন্দ্রাবস্থার মধ্যে, ঐ সমস্ত ভাব আবার যেন সহসা ঘনাইয়া আসিল।...
রাত্রি নয় ঘটিকার সময়, এই সুন্দর পরিষ্কার তারার আলোকে, আবার আমরা যাত্রা করিব। আমার মাঝিমাল্লারা বিশ্রাম করিয়াছে। এখন আরো তিনক্রোশ তাহাদিগকে নৌকা বাহিতে হইবে। তাহার পর, আমরা একটা গ্রামে গিয়া পৌঁছিব—সেইখানে মাঝিমাল্লা বদ্লি হইবে।
আমাদের যাত্রাকালে, মন্থরগামী নৌকাসকল, আবার আমাদের নৌকার পাশ দিয়া যাইতে লাগিল;−কালো-কালো ছায়াচিত্র;−জলে প্রতিবিম্ব পড়ায় আরো বড় দেখাইতেছে—যেন অতি-উচ্চ “গণ্ডোলা”—কিন্তু উপচ্ছায়ার মত ঝাপ্সা।
একটু পরেই, গোলকধাঁধার মত এই বিলগুলি সমুদ্রের ন্যায় বিশাল হইয়া উঠিল—অগ্নিশিখায় পূর্ণ হইল। এই অগ্নিশিখাগুলি ধীবরদিগের লণ্ঠান;−মৎস্যদিগকে ডাকিয়া আনিবার জন্য বড়-বড় মশাল; সুদীর্ঘ খাগ্ড়ার গুচ্ছে আগুন জ্বালাইয়াছে, এবং যাহাতে না নিবিয়া যায়, এইজন্য উহা ক্রমাগত দুলাইতেছে। এই সকল মশালের আলোকচ্ছটা, দীর্ঘরেখায় জলের উপরে প্রতিবিম্বিত হইতেছে।...নিশার মৃদুমন্দ নিশ্বাসে, লঘুলহরীর ক্ষীণ রেখা জলের উপর কদাচিৎ অঙ্কিত হইতেছে। এই একঘেয়ে দাঁড়পতনের শব্দে সহজেই নিদ্রাকর্ষণ হয়; কিন্তু মনের মধ্যে এই ভাবটি সর্ব্বদাই জাগরূক থাকে যে,−আমার চতুর্দ্দিকে, সর্ব্বত্রই জীবন উদ্যম—সুতীব্র জীবন-উদ্যম স্ফূর্ত্তি পাইতেছে। তবে এ কথা সত্য,−এ জীবনস্ফূর্ত্তি নিতান্ত আদিমকালসুলভ;—আমাদের হ্রদবাসী পূর্ব্বপুরুষের জীবন হইতে অধিক ভিন্ন নহে।
দাড়ীরা সমস্ত রাত্রি অবিরাম তালে-তালে দাঁড় ফেলিয়াছে। এই কবোষ্ণ রাত্রির অবসানে, নব শতাব্দীর নবরক্তিম প্রথম সূর্য্য একপ্রকার মৎসজীবি-জগতের উপর সমুদিত হইল;—যে জগতের লোক শিকারে রত,—যাহারা এই অকলুষ তরুণ আলোকে আহার্য্য-আহরণের প্রত্যাশায় চারিধারে বসিয়া আছে। বিশাল-বিস্তীর্ণ বিল; দুই ধারের তালজাতীয় নিবিড় তরুপুঞ্জ তটের উপর ঝুঁকিয়া রহিয়াছে; অসংখ্য জেলে-নৌকা;−অনেক সময়ে আমাদের নৌকার গা ঘেঁষিয়া যাইতেছে—আমাদের পথরোধ করিতেছে। কোন নৌকা একস্থানে স্থির হইয়া আছে, আবার কোন নৌকা, যতদূর সম্ভব—নিঃশব্দে মণ্ডলাকারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। লোকগুলা,—জাল, ছিপ, বল্লম হস্তে লইয়া, ভাসন্ত তক্তার উপর, সজাগসতর্কভাবে দাঁড়াইয়া আছে; জলের মধ্যে কোথাও কিছু নড়িলেই ব্যগ্রভাবে নিরীক্ষণ করিতেছে। পানিভেলা, বক এবং অন্যান্য ছোট ছোট পাখীরাও জলের ধারে কাদার উপর বসিয়া অন্বেষণের তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছে; এবং অনেক বষির কাঁটায়, প্রসারিত মৎস্যজালে, ত্রিমুখ শূল-অস্ত্রে, শত শত মৎস্যের মুখ আট্কাইয়া রহিয়াছে। এই বিলটি—এই সব শীতলমাংস নিঃশব্দচারী ক্ষুদ্রজীবের অফুরন্ত জলাধার। তাই, এত অসংখ্য মৎস্যভোজী এইখানে আকৃষ্ট হয় এবং মৎস্য আহার করিয়া প্রাণধারণ করে। নবোদিত শতাব্দী এ সমস্ত কিছুই পরিবর্ত্তন করিতে পারিবে না,—এই ব্যাপার অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে।
তটভূমি নিকটবর্ত্তী হইলে দেখা যায়,—মহাপ্রভাবশালী নারিকেলপুঞ্জের নীচে নিম্নশ্রেণী ইতর লোকদিগের বাস। এই দীনহীন মানবকুলের অস্তিত্ব বৃক্ষগণের অস্তিত্বের উপর একান্ত নির্ভর করে। নারিকেলপত্রের ডাঁটাগুলা একটা গুঁড়ি হইতে অন্য গুঁড়িতে প্রসারিত হইয়া বেড়ার কাজ করিতেছে; মৎস্যের জাল, রসারসি—সমস্তই নারিকেল-ছোব্ড়ায় প্রস্তুত।
এই অতীব প্রয়োজনীয় বৃক্ষগুলি শুধু যে ছায়াদান করে—ফল দান করে,—তৈল দান করে, তাহা নহে; যাহারা উহাদের হরিৎশ্যামল অনন্ত ছায়াতলে বাস করে, তাহাদের যাহা-কিছু আবশ্যক, সমস্তই উহারা যোগাইয়া থাকে।
রঙিন রেশমের তল্তলে গদির মত, চৌকোণা এক-এক টুক্রা ধানের ক্ষেত যে ইতস্তত দেখা যায় মনে হয়,—এ প্রদেশে সে সকল ক্ষেত না থাকিলেও চলে—খাদ্যের কোন অভাব হয় না।
বিলটি ক্রমশই বিস্তৃত আকার ধারণ করিতেছে। এইবার একটু অনুকূল বাতাস উঠিয়াছে। বাহুদ্বয়ের সাহায্যার্থ,—মাল্লারা, ৪।৫গজ উচ্চ একটা দর্ম্মা একটা মাস্তুলের উপর চড়াইয়া দিল; নিরীহ-ধরণের এই ক্ষুদ্র সমুদ্রটির উপর পাল ও দাঁড়যোগে আমাদের নৌকা আরো দ্রুত চলিতে লাগিল। বিলের দুই কূলে বন; এই বনরাজি দূর হইতে নীলাভ বলিয়া প্রতীয়মান হয়। বায়ুবেগে, নৌকায় প্রসারিত পালটি ফুলিয়া উঠিতেছে; এই বায়ুর সাহায্য পাইয়া মাল্লারা নিজ বাহুবেগ অনেকটা কমাইয়া দিয়াছে এবং আর-এক ধরণের তান উঠাইয়া একপ্রকার ঘুমের গান মুখ দিয়া গাহিতে আরম্ভ করিয়াছে। মনে হয়, যেন গির্জ্জা-ঘড়ির সুর-সংবুলিত ঘণ্টাধ্বনি দূর হইতে আসিতেছে—আর যেন, তাহা ফুরায় না।
ফ্রান্সে, এ সময়ে প্রায় মধ্যরাত্রি—এই সময়ে বিংশতি শতাব্দী প্রথম পদার্পণ করিয়াছে। এই নববর্ষের উৎসব আজ সেখানে অন্ধকারের মধ্যে, বরফের মধ্যে, পূর্ণ উপচারে অনুষ্ঠিত হইবে।
বাতাস পড়িয়া গেল। মধ্যাহ্নের শুভ্রোজ্জ্বল নিস্তব্ধতা—অগ্নিকুণ্ডবৎ উষ্ণতা। নারিকেলতরুশোভিত তটভূমিতে আমাদের নৌকা আসিয়া ভিড়িল। প্রাতঃকালের মাঝিমাল্লারা এইখানে বদ্লি হইল,—অতীব নতভাবে উহার প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল। নূতন মাল্লারা আর-একটু উজ্জ্বল-তাম্রবর্ণ; উহাদের বহুল কণ্ঠমালা,—কানবালা; গাত্রে নানাবিধ পৌরোহিতিক নক্সা ধূসরবর্ণে অঙ্কিত। এক্ষণে উহারা ভীষণবেগে দাঁড় টানিতে আরম্ভ করিল। বায়ু ভারাক্রান্ত বলিয়া বোধ হইতেছে। উষ্ণবাস্পগর্ভ পরিম্লান আকাশমণ্ডল, বিস্তীর্ণ আবিল জলাশয়, সমস্ত জীব, সমস্ত পদার্থ,—অতিরিক্ত আলোকপ্রভাবে যেন বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। নেত্রাভিঘাতী অত্যুজ্জ্বল একটা শাদা-রঙের ব্যাপক প্রলেপে যেন সমস্তই একাকার। আবার এই সমস্ত একাকারের মধ্যে, নৌকার চতুষ্পার্শ্বে, উজ্জ্বলকান্তি কাটা-ছোলা হীরার টুক্রাগুলির মত—জলবিন্দু উচ্ছ্বসিত হইতেছে,—দাঁড়ের গা দিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে; এবং দাঁড়ীদেরও ললাট ও বক্ষ বাহিয়া স্বেদবিন্দু স্যন্দিত হইতেছে।