ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/কোচিন
প্রায় তিনঘটিকার সময়, ত্রিবঙ্কুর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া, ক্ষুদ্র কোচিনরাজ্যে প্রবেশ করিলাম। কিন্তু, কি জলরাশির উপর, কি তালীবনের মধ্যে—কোথাও কিছু রূপান্তর লক্ষিত হইল না। কেবল, দিবাবসানে, বৃহৎ নদীর ন্যায় পরস্পর-দূরবর্ত্তী দুই কূলে, নগরাদি দেখা যাইতে লাগিল।
অপেক্ষাকৃত নিকটতর দক্ষিণকুলে রাজার রাজধানী—“এরাকুলম”- নগর। এইখানে রাজা বাস করেন। বিলের বরাবর ধারে-ধারে, প্যাগোদা-মন্দিরের ন্যায় চারিটা সীরীয় খৃষ্টসম্প্রদায়ের গির্জ্জা, একটা বৃহৎ দেবমন্দির, কতিপয় সৈন্যনিবাস, কতকগুলি পাঠশালা;—এই সমস্ত, লালমাটীর উপর অধিষ্ঠিত ও রক্তিমবর্ণ। একটি মনুষ্য নাই। কিনারায় একখানি নৌকা নাই। এই সমস্ত প্রাণহীন নিষ্প্রভ ঐশ্বর্য্য-আড়ম্বরের পশ্চাতে বিষয়বিতৃষ্ণ ব্রাহ্মণদিগের আবাসগৃহগুলি অরণ্যের বিষাদ-অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া,—সর্ব্বগ্রাসী তালজাতীয় তরুপুঞ্জের মধ্যে, ঝোপ্ঝাড়ের মধ্যে, নীলিম ছায়ার মধ্যে—ক্রমশ বিলীন হইয়া গিয়াছে।
আরো দূরে, জলাশয়ের অপর পারে, বাম কূলে,—জীবন-উদ্যমের উদ্দাম স্ফূর্ত্তি। প্রথমেই হিন্দু বণিক্দিগের নগর—“মাতাঞ্চেরি”—শত-শত ক্ষুদ্র গৃহ উদ্ভিজ্জশ্যামল ভূমির উপর অধিষ্ঠিত। একটি উপসাগর-সূত্রে, মহাসমুদ্রের সহিত এই নগরীর যোগাযোগ রক্ষিত হইয়াছে। এই উপসাগরে অসংখ্য নৌকা নোঙর করিয়া আছ; এগুলি সেকেলে-ধরণের নৌকা;—পাল ও অদ্ভুত মাস্তুল বিশিষ্ট। এই নৌকাগুলি আরবসমুদ্রের উপর দিয়া ক্রমাগত যাতায়াত করে, মস্কটের সহিত বাণিজ্য করে, পারস্য-উপসাগরের অভ্যন্তর পর্য্যন্ত প্রবেশ করে এবং বসোরা-নগরে মসলা-সামগ্রী ও শস্যাদি লইয়া যায়। তার পর, আরো দূরে—পোর্টূগী ও ওলন্দাজদিগের পুরাতন কোচিন। এখন ইহা অন্য প্রভুদের হস্তে। উহাদের একটা বন্দর আছে,—সেইখানে আধুনিক জাহাজগুলার ধোঁয়া-চোং হইতে কৃষ্ণবর্ণ ধূমরাশি নিরন্তর উচ্ছ্বসিত হইতেছে।
এই বিলের মাঝখানে,—ঐ পরস্পর-বিসদৃশ তিনটি নগরের সংস্রব হইতে দূরে,—একটি তরুসমাচ্ছন্ন দ্বীপ আছে; এখন সেই দ্বীপের অভিমুখে আমার নৌকা চলিতে লাগিল। হরিৎ-শ্যামল উদ্ভিজ্জরাশির মধ্যে নিমজ্জিত কতকগুলা শাদা-শাদা সোপানপংক্তি, একটা শাদা ঘাট, একটি শাদা রঙের পুরাতন প্রাসাদ। আমি যে রাজার অতিথি, সেই রাজার আদেশক্রমে বোধ হয়, ঐখানেই আমার বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। উহার যেরূপ জীর্ণ ও “পোড়ো” অবস্থা, তাহাতে মনে হয়, ঐ সকল শাদ্বলভূমির উপর, ঐ সকল শাখাপল্লবের মধ্যে—কোন নিদ্রামগ্ন ঔপন্যাসিক রূপসী বাস করে। সন্ধ্যা নিকটবর্ত্তী হওয়ায়, এই বিজন দ্বীপটি আরো বিষন্ন আকার ধারণ করিল।
কিলোন্-নগরীর ন্যায়, এখানেও শুভ্রবসনধারী ভারতীয় ভৃত্যগণ আমাকে একটি গোলাপের তোড়া দিবার জন্য, শাদা সিড়ির উপর দৌড়িয়াআসিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত হইল। আমি এখন, একটি সুন্দর পুরাতন উদ্যানের মধ্য দিয়া চলিতেছি;—সেকেলেধরণের সোজা-সোজা রাস্তা; ধারে-ধারে জুঁইগাছ, গোলাপগাছ।
এই দ্বীপের মধ্যে একটিমাত্র বাড়ী, আর সেই বাড়ীর মধ্যে আমি একা। যে শতাব্দীতে, কৌচিনরাজ্য ওলন্দাজদিগের অধিকারে ছিল, তখন এই বাড়ীটিতে ওলন্দাজ শাসনকর্ত্তা বাস করিতেন। ইহা দুর্গের ন্যায় পিণ্ডাকৃতি; এবং ইহার অলিন্দ, বারান্দা—সুন্দর মস্জিদ্ধরণের খিলানে বিভূষিত। অভ্যন্তরে, সেকালের স্তম্ভময়ী বিলাসিতা। চুনকাম-করা প্রকাণ্ড বড় বড় ঘর;—তাহাতে প্রাচীনকালের মাদুর বিছানো; এপ্রকার সূক্ষ্মধরণের মাদুর আজকাল আর দেখা যায় না। পুরাতন সুদুর্লভ কাঠ-কাঠরার কাজ; অতি পুরাতন য়ুয়োপীয় আদর্শে নির্ম্মিত খোদাই-কাজ-করা ঘরের আস্বাব; দেয়ালে জল-রঙের ছবি;—এই ছবিগুলা সপ্তদশ-শতাব্দীর আমষ্টার্ডামের চিত্রকলার নমুনা। কি রাত্রে, কি দিনে,—দর্জাগুলা কখনই বন্ধ করা হয় না। এই প্রত্যেক দর্জার সম্মুখে এক-একটা দাঁড়ানো-পর্দ্দা;—তাহাতে ম্লান-মনোহর পীতবর্ণ রেশমের কাপড় টানা।
ভৃত্যেরা আমাকে জানাইল,—“আমি যে রাজার অতিথি, তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে না; কেন না, তাঁহার অশৌচ—এখন তিনি শ্রাদ্ধশান্তি করিতেছেন। কোচিন-রাজ্যের অল্পবয়স্ক যুবরাজ—নিতান্ত শিশু—সম্প্রতি স্বকীয় কৃষ্ণবর্ণ কুসুমনেত্র চিরতরে নিমীলিত করিয়াছেন; তাই, প্রাসাদের সমস্ত লোক এখন শোকমগ্ন।
এই রাজকীয় বিজনতার মধ্যে না আসিয়া, মাতাঞ্চেরি-নগরে অবস্থিতি করিলে আমার পক্ষে ভাল হইত। সেখানে একটা ক্ষুদ্র পান্থনিবাসে থাকিলেও, আজ আমি সায়াহ্নে, তত্রত্য জনতার মধ্যে মিশিয়া, তাহাদের প্রকৃত জীবন প্রত্যক্ষ করিতে পারিতাম!…এখানে ও ত্রিবঙ্কুরে—আমি ভারতবর্ষে থাকিয়াও যেন নাই। বিশিষ্টদর্শন নিঃশব্দচারী ভূত্যেরা, মার্জ্জারবৎ-পদসঞ্চারে, খাঁজ-কাটা-খিলান-বিলম্বিত সমস্ত দীপগুলি জ্বালিয়া দিল। নূতন-ধরণে পুষ্পপল্লবে সুসজ্জিত টেবিলের ধারে বসিয়া আমার “কয়েদির ভোজ” শেষ হইলে পর,—নবশতাব্দীর প্রথম সন্ধ্যার অভ্যুদয় দেখিবার জন্য আমি উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। যেখানে নির্ব্বাপিতপ্রায় জ্বলন্ত অঙ্গারের রং এখনো পর্য্যন্ত রহিয়াছে—সেই পশ্চিম দিগন্তপটের উপর, এই দ্বীপতরুগুলি, ঘোর-কৃষ্ণবর্ণ কত-কি দুর্ব্বোধ্য চিত্রাক্ষর অঙ্কিত করিতেছে। এখনো, উদ্যানবীথির ঊর্দ্ধদেশে—উত্তপ্ত নভস্তলে, সেই সন্ধ্যাচর জীব—পেচক ও বৃহৎ-জাতীয় বাদুড় বিচিত্র চক্রগতিতে উড়িয়া বেড়াইতেছে।
তাহার পর, সমস্ত আকাশে, মিট্মিট্ করিয়া তারা জ্বলিতে লাগিল—সহসা রাত্রি আসিয়া পড়িল।
প্রভাতে রক্তিমভানু আবার যখন উদিত হইল, দেখিলাম—বৃহৎ সোপানের তলদেশে আমার নৌকা প্রস্তুত রহিয়াছে। নৌকায় উঠিয়া, বিলের মধ্য দিয়া, মাতাঞ্চেরি-নগরের অভিমুখে চলিলাম। অবশেষে সহরের ইহুদিবিভাগে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। অষ্টম শতাব্দীতে, জেরুশালেমের দ্বিতীয় মন্দিরটি যখন ধ্বংস হইয়া যায়, সেই সময়ে প্রায় দশসহস্র ইহুদি ও ইহুদিনী এই ম্যালাবার-প্রদেশে আসিয়া, ক্র্যাঙ্গানোরে (তৎকালীন নাম “মহোদ্রপত্না”) বাসস্থাপন করে। পরধর্ম্মসহিষ্ণু হিন্দুরা উহাদিগকে সাদরে গ্রহণ করিয়াছিল। এখনও পর্য্যন্ত এই ক্ষুদ্র ঔপনিবেসিকমণ্ডলী, পার্শ্ববর্ত্তী হিন্দুগণ হইতে—সমস্ত জগৎ হইতে স্বতন্ত্র থাকিয়া, পুরুষপরম্পরাগত স্বকীয় ঐতিহ্য ও কুলপ্রথা অক্ষুন্ন রাখিয়াছে। মনে হয়, যেন উহারা কোন জাদুঘরে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক কৌতুকসামগ্রী।
মাতাঞ্চেরীর এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত অতিক্রম করিয়া, প্রথমেই ‘শাদা-ইহুদি”দিগের সহরে (এ দেশে উহাদিগকে “শাদা-ইহুদি” বলে) উপনীত হইলাম। মাতাঞ্চেরি—একটি বৃহৎ বিপণি বলিলেও হয়—খাঁটি দেশীয় বিপণি,—যেখানকার সমস্ত মানবমূর্ত্তি—সমস্ত মানবদেহ বিশুদ্ধ পিত্তলবর্ণের; সমস্ত দোকানগুলি কাঠের,—বারণ্ডার পশ্চাতে মুক্ত পরিসর—সেই উত্তুঙ্গ সুনম্য তালতরুর তলদেশে অবস্থিত। ক্রোশখানেক ধরিয়া এইরূপ বাজার চলিয়াছে। এইরূপ ভারতীয় দৃশ্যে চক্ষু যখন অনেকক্ষণ অভ্যস্ত হইয়াছে—এমন সময়ে একটা বাঁক ফিরিয়াই একটা পুরাতন “অন্ধকেরে” রাস্তায় হঠাৎ আসিয়া পড়িলাম; যেন ইহা স্থানভ্রষ্ট হইয়া কোনপ্রকারে এখানে আসিয়া পড়িয়াছে। কোন স্থানচ্যুত জিনিষ দেখিলে মনে যেমন একপ্রকার অশান্তি উপস্থিত হয় আমার মনে সেইরূপ অশান্তি উপস্থিত হইল। খুব ঘেঁষাঘেঁষি সারি-সারি পাথরের বাড়ী। শীতপ্রধান দেশের ন্যায়, বাড়ীর সম্মুখভাগের মুখশ্রী বিষাদময়, প্রবেশপথগুলি সঙ্কীর্ণ। তাতে আবার, প্রত্যেক গৃহের দ্বারদেশে, গবাক্ষে, বিষাদতমসাচ্ছন্ন এই ক্ষুদ্র রাজপথে, সর্ব্বত্রই ইহুদিমুখ দেখা যাইতেছে। এই আকস্মিক দৃশ্যপরিবর্ত্তনের ন্যায় ইহুদিমুখও আমার চিত্তকে উদ্বেজিত করিয়া তুলিল। এই বিষাদময় জীর্ণদশা, এখানকার এই সমস্ত পরিদৃশ্য,—পার্শ্ববর্ত্তী তালপুঞ্জের সহিত, আকাশের সহিত, যেন একটুও খাপ্ খায় না। এই অপ্রত্যাশিত রাস্তাটিতে সহসা আসিয়া, মনে হয় যেন আমি এখন আর ভারতের মধ্যে নাই;—এমন কি, মনে হয়, প্রাচ্যভাব যেন এখান হইতে একেবারেই অন্তর্হিত হইয়াছে। যেন লাইড্ কিংবা আমষ্টার্ডামের রাস্তার একটা টুক্রা স্থানচ্যুত হইয়া এখানে আসিয়া পড়িয়াছে;—কেবল, গ্রীষ্মপ্রধান দেশের প্রখর উত্তাপে উহা তাপদগ্ধ হইয়াছে,—ফাটিয়া গিয়াছে। বেশ মনে হয়, ওলন্দাজেরাই সহরের এই ভাগটি নির্ম্মাণ করিয়াছে; কেন না, সেই যুগের ওলন্দাজেরা, আপনাদের নিজের দেশেও, জলবায়ুভেদে কিরূপ গৃহ নির্ম্মাণ করিতে হয়, তাহা জানিত না। তাহার পর, ওলন্দাজেরা এ দেশ হইতে চলিয়া গেলে, ক্র্যাঙ্গানোরের ইহুদিরা সেই সব শূন্যগৃহ অধিকার করে। এখানে কেবলি ইহুদি—ইহুদি ছাড়া আর কিছুই নাই। এই সব ইহুদিগের রং ফ্যাকাশে; ভারতের জলবায়ুপ্রভাবে এবং খুব-ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ীতে বাস-করা-প্রযুক্ত, ইহারা রক্তহীন হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু দ্বিসহস্রবৎসরকাল ম্যালাবার-প্রদেশে বাস করিয়াও উহাদের মৌলিক ছাঁচ কিছুমাত্র রূপান্তরিত হয় নাই;—এমন কি, (প্রচলিত মতের উল্টা) উহাদের মুখ তাপদগ্ধ হইয়া একটুও মলিন হয় নাই। জেরুশালেমে, কিংবা তিবেরিয়াদে যেরূপ মূর্ত্তি—যেরূপ লম্বা আলখাল্লা সচরাচর দেখা যায়,—এখানেও ঠিক্ তাই। যুবতীদের সূক্ষ্মচারু মুখশ্রী; দীনদর্শন বৃদ্ধদিগের শুকচঞ্চুবৎ বক্র নাসিকা; শিশুদিগের শাদা ও গোলাপি রং; রসপ্রধান দৈহিক প্রকৃতি—মুখে একটু ধূর্ত্তামির ভাব পরিস্ফুট, —“কাননে”র জাত্-ভাইদিগের মত, ইহাদেরও কানের উপর চুলকোঁক্ড়াইবার কাগজ রহিয়াছে।
রাস্তা দিয়া যদি কোন বিদেশী পথিক চলিয়া যায়, অমনি তাহাকে দেখিবার জন্য, এই সকল লোক দ্বারদেশে নামিয়া আসে; কেন না, মাতাঞ্চেরিতে বিদেশী লোক প্রায় কখন আইসে না। বিদেশী দেখিলেই, উহাদের মুখে স্মিতহাস্য ও আতিথ্যের ভাব ফুটিয়া উঠে। যে-কোন গৃহেই আমি প্রবেশ করি না কেন—প্রায় সকল গৃহেই উহারা সৌজন্যসহকারে আমাকে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত।
এইরূপ কিংবদন্তী—পূর্ব্বে দশসহস্র ইহুদি এখানে আইসে; তন্মধ্যে এখন কয়েকশত মাত্র অবশিষ্ট। দ্বিসহস্রবৎসর কাল অবসাদজনক উত্তাপের মধ্যে বাস করায়, এই চিরস্থায়ী ইহুদিজাতি ক্রমশই বিকৃত হইয়া পড়িতেছে। বোধ হয়, ইহারা এখন গুপ্ত ব্যবসায়ের দ্বারা—কুসীদবৃত্তির দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে; এবং যখন উহার ধনাঢ্য হইয়া উঠে—তখন, যেন ধনশালী নহে—এইরূপ ভাণ করিয়া থাকে। দুইতিনজন বিশিষ্ট ইহুদির আতিথ্য গ্রহণ করিয়া, কিয়ৎকাল আমি তাহাদের গৃহে বসিয়াছিলাম। সেই সব গৃহের আভ্যন্তরিক অবস্থা এইরূপ:—অর্দ্ধ-অন্ধকারের মধ্যে একটা সুঁড়িপথ; পচাধসা জিনিষপত্র এলোমেলোভাবে ছড়ান রহিয়াছে; কতকগুলা পুরাতন কীটদষ্ট আস্বাব—প্রায় সমস্তই য়ুরোপীয় —বোধ হয় ওলন্দাজদিগের আমল হইতেই চলিয়া আসিতেছে। দেয়ালে মূশার কতকগুলি প্রতিকৃতি ও কতকগুলি উৎকীর্ণ-লিপি বিলম্বিত।
রাস্তার প্রান্তভাগে ইহুদি-গির্জ্জা; ঘণ্টাঘরটির অতীব শোচনীয় অবস্থা; —গ্রীষ্মে সূর্যের উত্তাপে ফাটিয়া গিয়াছে;—বয়ঃপ্রভাবে বাঁকিয়া গিয়াছে। প্রথম-দরজা পার হইয়াই একটা প্রাঙ্গণের মধ্যে আসিয়া পড়িলাম;— প্রাচীর স্থূল এবং কারাগারের প্রাচীরের ন্যায় উচ্চ। পবিত্র বেদিটি মধ্যস্থলে রহিয়াছে;—অষ্টঘটিকার প্রাতঃসূর্য্যের বিমল আলোকে পরিপ্লাবিত; এবং ঐ সুধালিপ্ত বেদি হইতে ধবল কিরণ বিকীর্ণ হইয়া নেত্র ঝলসিয়া দিতেছে। পৃথিবীর মধ্যে আর কোথাও এরূপ একটি ইহুদিগির্জ্জা দেখা যায় না—যাহার সাজসজ্জা এত পুরাতন এবং সাজাইবার ধরণটিও এরূপ অপূর্ব্ব—এরূপ নূতন। এখানকার বিচিত্র বর্ণবিন্যাস কালপ্রভাবে ক্ষীণ ও স্নানাভ হইয়া, অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্যে চিত্তকে মুগ্ধ করে। সবুজ দরজা—তাহাতে অদ্ভুত পুষ্পসকল চিত্রিত; গৃহের কুট্টিমটি চমৎকার —নীল চীনে মাটি দিয়া ধাঁধানো; দেয়ালগুলা দুধের মত শাদা। গির্জ্জার অভ্যন্তরে লালরঙের—সোনলিরঙের আগুন যেন চারিদিকে জ্বলিয়া উঠিয়াছে। কতই তাঁবার থাম্—কতই তাঁবার গরাদে—তার আর অন্ত নাই;—মানব-হস্তের ঘর্ষণে উহা দর্পণবৎ মসৃণ হইয়া উঠিয়াছে। অনেকগুলা বিচিত্র রঙের বহু-পুরাতন ঝাড়লণ্ঠন চাঁদোয়া-ছাদ হইতে লম্বমান;—এইগুলি, বোধ হয়, সেই ঔপনিবেশিক যুগে য়ুরোপ হইতে আসিয়াছিল।
পাণ্ডুমুখশ্রী, আলখাল্লা-পরা’, দীর্ঘনাসিক কতিপয় ব্যক্তি বিড়্বিড়্ করিয়া কি প্রার্থনামন্ত্র পাঠ করিতেছিল,—হস্তে হিব্রুগ্রন্থ;—আমাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য হঠাৎ থামিল। একজন পুরোহিত,—মনে হয়, শতবর্ষ বয়ঃক্রম—কাঁপিতে-কাঁপিতে আমাকে সংবর্দ্ধনা করিলেন, অতিসুক্ষ্মখোদাই-কাজ-করা সেই তাম্রস্তম্ভগুলি আমাকে দেখাইলেন, এবং উহা কিরূপ মসৃণ, স্পর্শ করিয়া দেখিবার জন্য আমাকে অনুরোধ করিলেন; তাহার পর, নীল চীনেমাটিতে বাঁধানো কুট্টিমের সমস্ত বৃত্তান্ত আমার নিকট বিবৃত করিলেন। কুট্টিমটি বাস্তবিকই অমূল্য—এত দুর্লভ জিনিষ যে, উহাতে পা রাখিতে ভয় হয়। প্রায় দশসহস্র বৎসর হইল, এই চীনেমাটি চীনদেশ হইতে ফর্মাস দিয়া আনানো হয়, উহার জাহাজভাড়ায় বহু অর্থব্যয় হইয়াছিল। তাহার পর, আমাকে পুণ্য-মঞ্জুষাটি (Tabernacle) দেখাইলেন; উহা একখণ্ড জরির-পাড়-লাগানো বস্ত্রে আচ্ছাদিত ছিল। উহার অভ্যন্তরে কতকগুলি রত্নখচিত মুকুট, রহিয়াছে,—যাহার নক্সা-কল্পনা সলোমন-রাজার মুকুট নক্সার ন্যায় অতীব আদিমকালের। অবস্থাবিশেষে শতবর্ষবয়স্ক বর্ষীয়ান্ পুরোহিতদিগকে এই মুকুটে বিভূষিত করিবার জন্যই ঐগুলি রক্ষিত হইয়াছে। তা ছাড়া, উহার মধ্যে কতকগুলি ধর্ম্মগ্রন্থ আছে;—অনির্দ্দেশ্য অতীতের কতকগুলা গোটানো পার্চমেণ্ট-কাগজ,—রূপালি-জরির পাড়ওয়ালা কালো রেশ্মি কাপড়ে আচ্ছাদিত।
অবশেষে, উহাদের যেটি বহু আদরের পবিত্র স্মৃতিসামগ্রী—সেইটি আমার নিকট লইয়া আসিল। ইহা একটি বহুমূল্য দলিল; তাম্রফলকে উৎকীর্ণ লিপিমালা। ইহুদিদিগের ভারতবর্ষে আসিবার প্রায় চারিশত বৎসর পরে, ৩১৯ খৃষ্টাব্দে, ম্যালাবারের অধিপতি এই শাসনপত্রে লিখিত কতকগুলি অধিকার উহাদিগকে প্রদান করেন।
এই তাম্রফলকে এই মর্ম্মের কথাগুলি উৎকীর্ণ রহিয়াছে:—
যিনি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করিয়াছেন, যিনি রাজাদিগকে রাজপদে অধিষ্ঠিত করিয়াছেন—সেই পরমেশ্বরের প্রসাদে, আমি রবিবর্ম্মা মালাবারের সম্রাট, আমার ৩৬ বৎসরের রাজত্বকালে, ক্যাঙ্গানোরস্থ মাদেরকাৎলাদুর্গের মধ্যে অবস্থিত হইয়া, সচ্চরিত্র জোসেফ-রব্বন্কে নিম্নলিখিত স্বত্ব ও অধিকার প্রদান করিলাম -
১। পবিত্রবর্ণের লোকদিগের মধ্যে তিনি নিজ ধর্ম্ম প্রচার করিতে পারিবেন:
২। তিনি সর্ব্বপ্রকার সম্মান সম্ভোগ করিতে পারিবেন; তিনি অশ্বারোহণ ও গজারোহণ করিতে পারিবেন; সমারোহপূর্ব্বক নগরযাত্রা করিতে পারিবেন: নকিবের। তাঁহার উপাধি প্রভৃতি তাহার সম্মুখে ফুরাইতে পারিবে; দিবাভাগেও তিনি আলোক ব্যবহার করিতে পারিবেন—তিনি সর্ব্বপ্রকার সঙ্গীত করিতে পারিবেন; বৃহৎ ছত্র ব্যবহার করিতে পারিবেন; এবং তাহার সম্মুখে প্রসারিত শাদা গালিচার উপর দিয়া চলিয়া যাইতে পারিবেন। তিনি চতুর্দোলা-সিংহাসনে বসিয়া, লোকজন সম্মুখে রাখিয়া সবৈভবে যাত্রা করিতে পারিবেন।
জোসেফ-রব্বন্কে এবং ৬২ জন ইহুদি ভূম্যধিকারীকে এই সকল অধিকার আমি প্রদান করিলাম। জোসেফ -রব্বন্ নিজ অধীনস্থ প্রজাদিগকে শাসন করিতে পারিবেন; এবং যতদিন জগতে দিবাকরের উদয় হইবে, ততদিন ঐ প্রজারা তাঁহার ও তাঁহার উত্তরাধিকারিগণের আদেশপালন করিতে বাধ্য।
ত্রিবন্ধুর, তেসেনোর, কদ্রমোর, কালিকিলোন, ক্রেঙ্গুট-জামোরিন্, পালিয়াখাচেন, ও কালিস্ত্রিয়া—এই সকল রাজাদের সম্মুখে এই শাসনপত্র আমি লিখিয়া দিলাম।
লেখক কলম্বী-কেলাপুরের হস্তাক্ষরে এই শাসনপত্র লিখিত হইল। এবং যেহেতু কোচিনের রাজা পরম্পদপা আমার উত্তরাধিকারী—সেইজন্য এই রাজাদিগের মধ্যে তাঁহার নাম ধরা হইল না।
স্বাক্ষরিত:চেরুম্ মল রবিবা— মালাবারের। ইহুদিগির্জ্জার উপরে, ফাটা ঘণ্টাঘরের পার্শ্বে, উহারা আমাকে একটা উচ্চ ঘর দেখাইল। ঘরটি যার-পর-নাই জীর্ণ ও ভগ্নদশাপন্ন, -দেয়াল ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে ও লোহার কড়িগুলা ভাঙাচোরা; তক্তায় গর্ত্ত; কালো চাঁদোয়া-ছাদে বাদুড়-চাচিকারা ঘুমাইতেছে। দুর্গপ্রাকারের রন্ধের ন্যায়, প্রাচীরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গবাক্ষ; -তাহার মধ্য দিয়া ওলন্দাজসহরের কিয়দংশ দৃষ্টিগোচর হয়—সেই অংশটি এখন ইহুদিদিগের হস্তগত; -সমস্তই ধূসরবর্ণ, বিষাদমগ্ন ও হৃতসার-মহাপ্রবল তালপুঞ্জের নীচে অধিষ্ঠিত। এই ঘননিবিষ্ট তালপুঞ্জের বিশাল চূড়াগুলি সুদূর পর্য্যন্ত প্রসারিত; -সহসা একস্থানে অরণ্যের আকার ধারণ করিয়াছে;উহাদের স্থিরস্নিগ্ধ শ্যামলশোভায় দিগন্ত আচ্ছন্ন। আবার, অপর দিকে দেখা যায়,—একটা পুরাতন দেবমন্দিরের সুধালিপ্ত ছাদ, বৃহৎ ও নিম্ন তাম্রগম্বুজ, -মনে হয়, যেন উত্তপ্ত ধরাতলের উপর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।
এই উচ্চ ঘরটি—এই লুতন্তুসমাকীর্ণ ভগ্নাবশেষটি শাদা-ইহুদি-শিশুদিগের পাঠশালা। এই অনুষ্ণ মধুর প্রভাতে, ২০জন শিশু হিব্রু পড়িতেছে। সিদ্ধপুরুষ (Elie) এলির মত দেখিতে একজন ইহুদি-পুরোহিত একটা ফলকের উপর হিব্রু-বাক্য লিখিয়া উহাদিগকে দেখাইতেছে। উহাদের পাশ্চাত্য ভ্রাতৃগণ আজকাল যে হিব্রুভাষাকে অবহেলা করে, সেই হিব্রু ভাষাতেই এই প্রবাসী শিশুরা এখনো কথা কহে।
শাদা-ইহুদি-অঞ্চলের পরেই, কালো-ইহুদি-টোলা। এই কালো-ইহুদিরা শাদা-ইহুদিদিগের প্রতিদ্বন্দ্বী। আমাকে জানাইয়া দিল—ইহার পর যদি আমি কালো-ইহুদি ও তাহাদের গির্জ্জা দেখিতে না যাই, তাহা হইলে উহারা মনঃক্ষুন্ন হইবে। আমি উহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাই কি না, দেখিবার জন্য এখনি কতকগুলি কালো-ইহুদি রাস্তার মাথায় দাঁড়াইয়া আছে। আবার উর্দ্ধে গবাক্ষদেশে, অর্দ্ধোত্তোলিত “ন্যাকড়া-কানি”র পর্দার পিছনে কতকগুলি শাদা-ইহুদি-মুখও দেখা যাইতেছে; -একটু যেন বেশি শীর্ণ, কিন্তু সুশ্রী। উহারাও কৌতূহলের সহিত দেখিতেছে-আমি কোন্ দিকে যাই।
কালো-ইহুদি-বেচারাদ্বিগের ওখানেই তবে যাওয়া যাক্। 'কালোইহুদিরা বলে, শাদা-ইহুদিদিগের আসিবার কিয়ৎ-শতাব্দী পূর্ব্ব্ব তাহারা জুডিয়া হইতে এদেশে আসিয়াছে। আবার, শাদা-ইহুদিরা অবজ্ঞাসহকারে এই কথা বলে যে, কালো-ইহুদিয়া আদিমনিবাসী পারিয়া-জাতির অন্তভূক্ত, শাদা-ইহুদিরা এদেশে ধর্ম্ম প্রচার করিয়া উহাদিগকে স্বধর্ম্ম্মভুক্ত করিয়াছে।
শাদা প্রতিবেশীদিগের অপেক্ষা ইহাদের রং একটু মলিন বটে, কিন্তু একেবারে কালো নহে। আসলে উহারা ভারতীয় ও ইহুদির সংমিশ্রণজাত “মেটে-ফিরিঙ্গি"। উহারা আমাকে আগ্রহসহকারে গ্রহণ করিল। উহাদের গির্জ্জা অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বী গির্জ্জাটিরই অনুরূপ;—কিন্তু তেমন সমৃদ্ধ নহে। সেই সুন্দর তাম্রময় স্তম্ভশ্রেণী এখানে নাই; বিশেষত এখানকার কুটিম সেই চমৎকার চীনে-মাটিতে বাঁধানো নহে। এই সময়ে শিশুদের জন্য কি-একটা অনুষ্ঠান হইতেছিল। সমবেত শিশুগণ ধর্ম্মগ্রন্থের মধ্যে নাক গুজিয়া ভল্লুকের মত দাঁড়াইয়া, শরীর দোলাইতেছিল;—ইহুদিঅনুষ্ঠানাদির ধরণই এইরূপ। পুরোহিত, প্রতিদ্বন্দ্বী শাদা-ইহুদিদিগের অহঙ্কারের কথা উল্লেখ করিয়া আমার নিকট অনেক দুঃখ করিতে লাগিলেন। উহারা কালো-ইহুদিগের সহিত পরিণয়-সম্বন্ধ স্থাপন করিতে সম্মত নহে; এমন কি, কালো-ইহুদিদিগের সহিত ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া একত্র বসিতেও কুণ্ঠিত। আরো দুঃখের বিষয় এই, উহারা যখন এই বিষয়ের দুঃখ জানাইয়া প্রধান-পুরোহিতকে পত্র লিখিয়াছিল, তাহার প্রত্যুত্তরে তিনি সাধারণভাবে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা আরো মর্ম্মঘাতী:— “এক নীড়ে একত্র বাস করিতে গেলে, এক-পালোকের পাখী হওয়া চাই।”
ইহুদি-গির্জ্জার উপর হইতে-তম্রগম্বুজ, প্রস্তর প্রাচীর ও সুধালিপ্তছাদ বিশিষ্ট যে দেবমন্দিরটি দেখিয়াছিলাম—সমস্ত উপকুলের মধ্যে, সেই মন্দিরটি সর্ব্ব্বাপেক্ষা আদিম ও উগ্রদর্শন। তা ছাড়া, এরূপ দুর্গম যে, বলা বাহুল্য, আমি উহার নিকটে ঘেঁষিতে সাহস করি নাই। সূর্য্যকরোজ্জ্বল প্রাঙ্গণ—শূন্য, শোকগম্ভীর;—উত্তপ্ত প্রস্তররাশির মধ্যে, লৌহ ও তাম্র-গঠিত কতকগুলা অদ্ভুত সামগ্রী খাড়া হইয়া রহিয়াছে;—এইগুলি বহুশাখাবিশিষ্ট একপ্রকার দীপাধার;—বহুশতাব্দীব্যাপী ঝঞ্চাবাতের প্রভাবে উহাতে মর্চ্চে ধরিয়াছে।
পার্শ্বে ই কোচিন-রাজাদিগের পুরাতন প্রাসাদ। সরু-সরু দীর্ঘ ঢাকাবারাণ্ডার পথ দিয়া মন্দিরের মধ্যে যাওয়া যায়। কিছুকাল হইল, কোচিন-রাজারা এই প্রাসাদ ত্যাগ করিয়া, অপরকুলস্থ এর্নাকুলমের নূতন আবাসগৃহে উঠিয়া গিয়াছেন। এই প্রাসাদটি দেখিলে মনে হয়—একটা গুরুভার চতুষ্কোণ পুরাতন দুর্গ। ইহার নির্ম্মাণকাল ঠিক নির্ণয় করা অসম্ভব;—বিশেষত এই প্রদেশে, যেখানে গল্প ও রূপকের সহিত ইতিহাস মিশিয়া গিয়াছে। যাহাই হউক, প্রাসাদটি দেখিলে, অতি পুরাকালের ভাব মনোমধ্যে অঙ্কিত হয়। দ্বারদেশে আসিবামাত্র মনে হয়, কি-যেনএকটা অজ্ঞাতপূর্ব্ব প্রবলপরাক্রম অনার্য্য বর্ব্বরদেশে প্রবেশ করিতেছি। খুব্রি-কাটা ছোটছোট কত গবাক্ষ; নীচে প্রস্তর হইতে খুদিয়া-বাহির করা কত আসনবেদিকা;—ইহাতেই বুঝা যায়, ইমারতের মালমসল্লা কতটা ঘন-সন্নিবিষ্ট। সমস্ত সিঁড়ি—অমন কি,—যে সিঁড়িটি দিয়া দরবারশালায় উঠা যায়, তাহাও অতি সঙ্কীর্ণ, তমসাচ্ছন্ন, শ্বাসরোধী;—একজনমাত্র উঠিতে পারে, এরূপ পরিসর; উহাদের নির্ম্মাণে কি-যেনএকটা শিশুসুলভ বর্ব্বরতা লক্ষিত হয়। বড়-বড় দালানঘর খুব দীর্ঘ, নীচু, “অন্ধকেরে"—কারাগারের মত কষ্টজনক।
ঘরে চাঁদোয়া-ছাদগুলা খুব নীচু—খুব কাজ-করা—দুর্লভ কাষ্ঠে নির্ম্মিত;—কোথাও ঘর-কাটা নক্সা, কোথাও গোলাপ-পাপ্ড়ির নক্সা, কোথাও থিলান-কাটা নক্সা,—সমস্তই মলিন, কোন-কোন অংশ রংদিয়া চিত্রিত। আবার এদিকে দেয়ালগুলা একেবারে সমতল—এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত একসমান;—অর্ধ-অন্ধকারের মধ্যে প্রথমদৃষ্টিতে মনে হয়, দেয়ালগুলা বুঝি নানারঙের রঙিন কাপড়ে মোড়া; কিন্তু আসলে তাহা নহে,—উহাতে নানা রঙের ছবি চিত্রিত হইয়াছে। প্রাসাদের সৰ্বত্রই, দেয়ালের গায়ে এইরূপ বর্ণচিত্র;—কোথাও বা কালপ্রভাবে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, কোথাও বা সমাধিমন্দিরস্থ বর্ণচিত্রের ন্যায় অক্ষুন্ন রহিয়াছে।
দেয়ালের এই বর্ণচিত্রগুলি দেখিলে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইতে হয়;ইহাতে একটি বিশেষ কলানৈপুণ্য প্রকাশ পায়। কি শাখাবহুল প্রাচুর্য্য! কি উদ্দাম বিলাসলীলা! রাশি-রাশি নগ্নমূর্ত্তি,—ভারতরমণীর রূপ অতিরঞ্জিতভাবে চিত্রিত হইলেও, মানবদেহপঞ্জরের সমস্ত খুঁটিনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুকৃত হইয়াছে। কটিদেশ অতীব ক্ষীণ, বক্ষোদেশ অতীব পরিপুষ্ট ও প্রলম্বিত। সুগোল বাহু, সুবক্র নিতম্ব, অতি পীন পয়োধর—এই সমন্তের ছড়াছড়ি-জড়াজড়ি;—উহার মধ্যে কোনপ্রকার শৃঙ্খলা নাই। হস্তে বলয়, পায়ে নূপুর; ললাটে সিথি, কণ্ঠে হার। এই সব মূর্ত্তির সহিত পশুমূর্ত্তিও মিশ্রিত।
কোথাও একটি আস্বাব নাই;—সমস্তই শূন্য। সমস্ত দেয়াল বর্ণচিত্রে আচ্ছন্ন—এ ছাড়া আর কিছুই নাই। যে ঘরগুলা পরিত্যক্ত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন-সেখানেও এই মানবমূর্তি ও পশুমূর্তির ছড়াছড়ি। মাঝের ঘরটি খুব বিশাল-খুৰ উচ্চ; এইখানে রাজাদিগের অভিষেক-অনুষ্ঠান হইয়া থাকে। এই ঘরের দেয়ালে যে-সব কিরণমণ্ডলভূষিত সারি-সায়ি দেবীমূর্ত্তি—উহারা আসন্নপ্রসবা এবং অসংখ্য বিবস্ত্র দর্শকের মধ্যে অবস্থিত।
রাজাদের শয়নকক্ষটিতে এখনো কিছু কিছু আব আছে—নৌকাআকৃতি, দুর্লভ কাষ্ঠে নির্মিত একটি পর্য্যঙ্ক,—তাহাতে জরির রেশ্মি গদি —লাল রেশ্মি রঞ্জু দিয়া দোয়া-ছাদে লট্কান। ভোজনান্তে রাঙ্গাকে ঘুম পাড়াইবার জন্য ভৃত্যের এই পর্যাঙ্কটি দোলাইরা থাকে। এই রাজশয্যার চতুর্দিকে, প্রাচীরের বর্ণচিত্রগুলিতে নিরঙ্কুশ লাম্পট্যলীল প্রকটিত। দেবদেবী, মানব, পশু, বানর, ভল্লুক, হরিণ-সকলেরই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কামাবেশে সবেগে আক্ষিপ্ত, চক্ষু উন্মত্তের ন্যায় বিস্ফারিত, আবেশভরে পরম্পরকে জাপাইয়া ধরিয়াছে—পরস্পরের সহিত জড়াজড়ি করিয়া আছে। একটা পিছনের ঘর—অতিব্যবহারে মলিন ও হতশ্রী সেখানে দিবারাত্রি একটা পিতলের দীপ জলিতেছে ও ধূমায়িত হইতেছে-:এ ঘরটিতে আমার পদার্পণ করিবার অনুমতি নাই—কেন না, উহারি প্রান্তভাগ—সেখানটা অন্ধকার—সেইখান দিয়া মন্দিরে যাইবার পথ।”
মধ্যাহ আসন্ন। এখন একটা গৃহের মধ্যে আশ্রয় লওয়া নিতান্তই আবশ্যক। আমার ছায়াচ্ছন্ন দ্বীপটি এখান হইতে বেশি দূরে। এখন আমি কোচিনে গিয়া কোনো পান্থশালায় আশ্রয় লইব।
দুইটি চটুল -অশ্ব-যোজিত একটা ক্ষুদ্র ভাড়াটে গাড়ি করিয়া আবার আমি মাতাঞ্চেরির ভারতীয়-ধরণের রাস্তা দিয়া চলিতে লাগিলাম। আজ প্রাতে যেখানে ম্যালাবারের বিভিন্নবেশধারী নানাজাতীয় লোক পিপীলিকার সারির ন্যায় চলিতেছে দেখিয়াছিলাম—সেইখানে এখন মধ্যাহের নিষ্পন্দতা।
সেখান হইতে শীঘ্রই কোচিনে পৌছিলাম। এক দিকে বিল, অপর দিকে সমুদ্র—ইহারই মাঝখানে, বালুভূমির উপর, কোচিন স্থাপিত;পুরাতন ঔপনিবেশিক নগর—একটু স্থাবরভাবাপন্ন—এখনো যেন সেখানে ওলন্দাজি ছাপ মুদ্রিত। যে ক্ষুদ্র গৃহে আমি আশ্রয় লইয়াছি, সেখান হইতে সমুদ্রের বেলাভূমি পরিদৃশ্যমান-বিরাট-অনন্ত পরিদৃশ্যমান।
আমার সম্মুখে সেই নীল মহাসমুদ্র,আরবসাগর। মাথার উপর মধ্যাহ্সূর্য্য—তাহার প্রখর কিরণে বালুকারাশি ও তটভূমি একপ্রকার শুভ্র ও গোলাপি রঙে উদ্ভাসিত। কাকচীলেরা চীৎকার করিয়া আকাশে ' উড়িতেছে। নিয়মিত সময়ান্তরে, তরঙ্গমালা স্ফীত হইয়া, তটভূমির উপর সবেগে ভাঙিয়া পড়িতেছে। বহিঃসমুদ্রের সুনীল মসৃণ ঝিকিমিকি জলের মধ্য হইতে শিকার-অন্বেষী দুবৃত্ত হাঙরদিগের ডানা ও পৃষ্ঠদেশের কিয়দংশ উকি মারিতেছে। নেত্রাভিঘাতী দীপ্ত প্রভার মধ্যে দিগন্ত মিলাইয়া গিয়াছে। যে আবাসগৃহে আমি আজ নিদ্রা যাইব—তাহার কোনো দিক বদ্ধ নহে; ইহার পশ্চাদ্ভাগে, নারিকেলবন যেন হঠাৎ আরম্ভ হইয়াছে; আমার ঘরের জালা দিয়া, যেন একপ্রকার সবুজ আলোকে নিম্নদেশটি দেখা যাইতেছে। উচ্চ তালতরুর খিলান-আকৃতি সুদীর্ঘ সবৃন্ত-পত্রগুলি স্বচ্ছ প্রভায় উদ্ভাসিত এবং তালীবনের হরিদ্বর্ণ গভীর প্রদেশ যেন ভাস্বর হইয়া উঠিয়াছে। ঐ দেখ, একজন ভারতীয় যুবক একপ্রকার পানীয় আহরণ করিবার জন্য পদাঙ্গুলির সাহায্যে স্তম্ভবৎ মসৃণ তালত বাহিয়া কপিসুলভ চটুলতা ও দ্রুততা সহকারে নিঃশব্দে উপরে উঠিতেছে। যে শেষ প্রতিবিম্বটি গ্রহণ করিয়া আমার নেত্র নিমীলিত হইল, সেটি ঐ চতুভুজপ্রায় মনুষ্যমূর্তির প্রতিবিম্ব। লোকটা এত শীঘ্র গাছের উপর উঠিয়া গেল যে, তাহার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
এই সমুদ্রটি এমন ভাস্বর, এমন গভীর—ইহাকে আজ আমি নিকটে পাইয়াছি, হৃদয়ের মধ্যে যেন অনুভব করিতেছি; ইহার বিপুল স্পন্দন শুনিতে পাইয়া আজ আমার কি আনন্দ!—এই সেই অবারিত মার্গ, যেখান দিয়া সর্ব্বত্র যাতায়াত করা যায়; সেই মার্গ, যেখান হইতে সুদূর পরিলক্ষিত হয়; যেখানে প্রতি নিশ্বাসে মুক্তবায়ু গ্রহণ করা যায়। সেই মাৰ্গ, যাহা আমার চিরপরিচিত। বাস্তবিক ইহার সান্নিধ্যে আমার জীবন যেন উজ্জ্বল হইয়া উঠে; উহাকে পাইলে আমি যেন আপনাকে ফিরিয়া পাই; মনে হয়, যেন এই দূর্ব্বোদ্ধ দুরবগাহ ভারত হইতে—এই ছায়াচ্ছন্ন তরুসমাকীর্ণ বন্ধ ভারত হইতে ক্ষণেকের জন্য বাহির হইয়াছি। কিয়ৎকাল বিশ্রামের পর, আমি আবার সেই দ্বীপটির মধ্যে—সেই আমার সুপ্ত প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।,
যখন সূর্য্য অন্তপ্রায়, সেই সময়ে এখান হইতে চিরবিদায় লইবার জন্য আমি উদ্যেগ করিলাম। সেই চল্লিশ দাড়ের নৌকায় উঠিয়া কোচিনরাজ্যের দক্ষিণতম নগর “ত্রিচূড়"-অভিমুখে যাত্রা করিলাম। এখান হইতে আরো একরাত্রির পথ যাইতে হইবে।
প্রত্যেক জলযাত্রার আরম্ভে আমার নৌকা ইতপূর্ব্ব্বে যেরূপ বেগে চলিয়াছিল, এবার সেইরূপ বেগে চলিল। বিশ্রামের পর দাড়ীরা নববলে বলীয়ান্ হইয়া, কোদালি-কোদালি মাটি উঠাইবার মত, 'প্রত্যেক দাড়ের আঘাতে রাশি-রাশি জল উঠাইয়া চলিতে লাগিল। দাড়ীদের সাহায্যার্থে আমরা পাল তুলিয়া দিলাম। তালীবনসমাচ্ছন্ন দুই কুলের মধ্যবর্তী বিলের মধ্যে আবার প্রবেশ করিলাম।
বলা বাহুল্য—আমাদের অস্তগামী সূর্য্য রক্তিম স্বর্ণ-আভার মধ্যে অবতরণ করিয়া নিৰ্বাপিত হইল; এবং পরক্ষণেই,ঐ অদূরে, চির-উদ্ভিজ্জের পশ্চাতে অদৃশ্য হইয়া পড়িল। আমাদের এই প্রশান্ত জগতের উপর, অতীব মধুর বর্ণে রঞ্জিত নির্মেঘ অমল আকাশ প্রসারিত। আমরা এখন মৎস্যজীবীর রাজ্যে—জেলে-নৌকার মধ্যে—মৎস্যজালের মধ্যে আসিয়৮ পড়িয়াছি। এই ভারতীয় বিলের চারিধারে, তালীবনের পর্দা থাকায় সেই আদিমকালের হূদবাসী মৎস্যজীবীর জীবন এখানে বেশ সুরক্ষিত রহিয়াছে।
কল্যকার মত আজও আমার মাঝিমাল্লারা মুখ বুজিয়া সমস্বরে তান ধন্ধিয়াছে; এই তান,—এই প্রশান্ত সময়ের সহিত বেশ খাপ খাইয়াছে। পবনদেবের কৃপায় আমাদের নৌকা পালভরে চলিতেছে; দাড়ীরা ঔদাস্তের সহিত অলসভাবে দাঁড় ফেলিতেছে। অন্য নৌকাতেও জেলেরা গান ধরিয়াছে; যে স্বরে গান গাহিতেছে, তাহা মানবকণ্ঠ পর বলিয়া মনে হয় না,মনে হয় যেন গির্জ্জাঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি দূর হইতে ও চারিদিক্ হইতে এই শব্দযোনি জলরাশির উপর আসিয়া পৌছিতেছে।
যে-সব সাদাসিধা সরলপ্রাণ বিশ্বস্তচিত্ত অসংখ্য লোক আমাকে ঘিরিয়া আছে—মনে হয় যেন উহারা হরিৎ-শ্যামল তালীবনের ছায়াময় সমাধিগর্ভ হইতে সশরীরে পুনরুত্থান করিয়া, এই “খয়রাৎ-ডাঙায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে!—বিভিন্ন পুরাতন আচার-অনুষ্ঠানে আবদ্ধ খৃষ্টান, হিন্দু কিংবা ইহুদি; কিন্তু ইহারা সকলেই সমান শ্রদ্ধার পাত্র, একই সত্য উহাদের সকলেরই পশ্চাতে প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে।...যে ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম্ম এমন কঠোরভাবে রক্ষিত, তাহারও মধ্য হইতে যদি আমি দুরধিগম্য সত্যের দুইএক টুকরা পাইতে পারি—এই শিশুসুলভ আশা আমার চিত্তকে অধিকার করিয়াছিল!...কিন্তু না;—যেমন অন্যত্র, তেনি এখানেও, চিরবিদেশী ও চিরপান্থ হইয়াই আমাকে থাকিতে হইল;—প্রাণী ও পদার্থসমূহের বাহভাবদর্শনে নেত্রের তৃপ্তিসাধন ভিন্ন আমি আর কিছুই করিতে পারিলাম। তা ছাড়া, আমার যাত্রা শেষ হইয়াছে—আমি চলিলাম; গান গাইতে-গাইতে ও দোলাইতে-দোলাইতে, একখানি সুন্দর নৌকা করিয়া মাঝিমাল্লারা আমাকে লইয়া চলিল। ইহাতেও আমার আনন্দ; এইটুকুই আমার সৌভাগ্য; এবং ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট।...
দিগবলয়ের চারিধারে অরণ্যের নীল যবনিকা;—এই নীলিম ক্রমশ গভীর হইতে গভীরতর হইয়া উঠিল; অস্তাচলদিগন্তের ক্ষণস্থায়ী নীলিমা ক্রমে ঘোর কৃষ্ণবর্ণে পরিণত হইল। ইতস্তত, অপেক্ষাকৃত বিশাল একএকটি তালবৃক্ষের নিঃসঙ্গ ছায়াচিত্র বৈচিত্র্যহীন অরণ্যরেখার উপরিভাগ পরিস্ফুটরূপে অঙ্কিত। সম্মুখে তারকাবলী। মুমুধু সোনালি-গোলাপি আভার মধ্যে শুক্রগ্রহ প্রজ্বলিত হইয়া উঠিয়াছে; এবং তাহার পার্শ্বে নবইন্দু সমুদিত। এরূপ চন্দ্র সব-সময়ে দেখা যায় না কোন বিশেষ সময়ে, গ্রীষ্মপ্রধান দেশের বিমল-স্বচ্ছ নভোমণ্ডলেই দৃষ্ট হয়;—একটি ভাস্বর শীর্ণসূত্র বক্রাকারে অঙ্কিত; কিন্তু সমস্তই বেশ পরিস্ফুট ও দৃষ্টিগ্রাহ;— মনে হয় যেন পশ্চাৎ হইতে আলোকিত; বেশ বুঝা যায়, উহা একটা সামান্য চক্রমাত্র নহে, পরন্তু এমন একটি গোলক, যাহা নিরাধার হইয়া মহাশূন্যে ঝুলিতেছে। কোন-একটা পদার্থ বিনা-অবলম্বনে রহিয়াছেমনে করিতে গেলে,—আমাদের অর্জিত সংস্কার যাহাই হউক-ভারসাম্য ও গুরুত্বের যে স্বাভাবিক সংস্কার আমাদের মনোমধ্যে নিহিত আছে, সেই স্বাভাবিক সংস্কারের বশে আমাদের চিত্ত একটু আকুল হইয়া উঠে।
অন্ধকার হইয়া আসিল। মৎস্যদিগকে আকর্ষণ করিবার জন্য জেলেরা তাহাদের মশাল জলিল; গান থামিল; এবং সমস্তই নিদ্রামগ্ন বলিয়া মনে হইতে লাগিল। কেবল, আমার চল্লিশ জন দাড়ীর দাড় জলের উপর যন্ত্রবৎ অবিরাম পড়িতেছে;—প্রভাত হইতে আরম্ভ করিয়া,তাহারা আমাকে ক্রমাগত উত্তরাভিমুখে লইয়া যাইতেছে।
তালীবনের পশ্চাতে হঠাৎ যেন একটা আগুন জ্বলিয়া উঠিল; ইহা সুর্য্যের উদয়। সারারাত্রি আমার নৌকা চড়ায় ঠেকিয়া ঠেকিয়া অবশেষে লালমাটির একটি ছোট পাহাড়ের নীচে আসিয়া লাগিল। এইখানে বিল শেষ হইয়াছে। ইহাই ত্রিচূড়ের ঘাট;—শতশত নৌকায় সমাচ্ছন্ন। উহাদের সম্মুভাগ “গণ্ডোলার মত। এই নৌকাগুলি এখনও নিদ্রামগ্ন।
ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম্মে অতীব নিষ্ঠাবান্ ও অতীব রক্ষণশীল বিচূড়নগর এখান হইতে আরো অর্ধক্রোশ দূরে-তরুপুঞ্জের মধ্যে নিমজ্জিত। বয়েল-গাড়ি করিয়া যখন আমি সেখানে পৌঁছিলাম, তখন সেখানকার লোকেরা সত্রে জাগিয়াছে। এই সব চুনকামকরা কাঠের বাড়ীর উর্ধে তালবৃক্ষসকল বায়ুবেগে আন্দোলিত হইতেছে। একটা ঠাণ্ডা ঝোড়ো বাতাস উঠিয়া, রক্তিম মেঘপুঞ্জের ন্যায় ধূলিরাশি উড়াইয়া, গাছপালাদিগকে হেলাইতেছে। পেটাই তাঁবার ও শস্যদানার ছোট-ছোট দোকান; আলুলিকুন্তল বটবৃক্ষশ্রেণী, সমস্তই মালাবারপ্রদেশের অন্যান্য নগরেরই মত। এই সকল নগর,—আধুনিক পদার্থসমূহ হইতে বহু দূরে-তরুপুঞ্জের মধ্যে নিমজ্জিত হইয়া, বহুকাল হইতে স্বকীয় জীবন রক্ষা করিয়া। আসিতেছে। ত্রিচূড়ের মন্দিরটি অতীব প্রকাণ্ড ও ভীমদর্শন। এই ত্রিচূড়নগরের অপর মাম—"তিবু শিবায়-পেরিয়া-বুর"—অর্থাৎ শিবের পবিত্র মহানগরী।
এই মন্দিরের সম্মুখস্থ ভূমিতে আমি অবতরণ করিলাম। ইহা মন্দিরও বটে, দুর্গও বটে। এক সময়ে ইহা সেই দুর্দান্ত মহিশূরসুন টিপুর অবরোধ সহ্য করিয়াছিল। দুর্গের ঢালুমাটির উপর দিয়া মন্দিরে উঠিতে হয়। এখন এই ভূমির উপর অলস মেষদল ও গয়াদি নিদ্রা যাইতেছে। ব্রাহ্মণেরা মন্দিরের একটা দ্বারদেশে বসিয়া ধান ও প্রাতঃসূর্যের উদয় নিরীক্ষণ করিতেছে। আমি আসিতেছি দেখিয়া শশব্যস্ত হইয়া উহার আমার দিকে অগ্রসর হইল। এই বিদেশী না-জানি কি মনে করিয়া এখানে আসিতেছে!...কিন্তু আমি তাহাদিগকে বলিলাম,—আমি সব জানি, আমি কেবল মন্দিরচূড়ার কারুকার্য দেখিবার জন্য এখানে আসিয়াছি;—যথাযোগ্য দূর হইতে আমি উহা দর্শন করিব। তখন তাহারা হাসিমুখে আমাকে অভিবাদন করিল এবং নিশ্চিন্তমনে আবার মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিল। গুরুভার প্রাচীরগুলা সুধালেপের দ্বারা ধবলীকৃত; কিন্তু যাহার উপর খোদাই-কাজ-করা চারিটা চূড়া আছে,—চারিদিকের সেই চারিটা দ্বার, ভারতীয় প্রস্তরের ন্যায় শ্যামলবর্ণ। দূর-অতীতের এই পুরাতন শ্যামল চূড়াগুলি প্রচুর অলঙ্কারে ভূষিত;—বহুল ক্ষুদ্রস্তম্ভ ও বর্বর মূর্তিসমূহে পরিপূর্ণ।
এই যে শীতকালের ঝড়ঝটিকা এখানকার সকল পদার্থকেই উৎপীড়ন করে—আলুলিতকুন্তল বৃহৎ বটবৃক্ষদিগকে বাঁকাইয়া দেয়—পথে-ঘাটে লাল ধূলা উড়াইয়া দেয়—ইহার প্রভাব কি এই শিবপুরীতে কিছুমাত্র প্রকটিত হয় নাই? পথের ধারে-ধারে সর্ব্ব্বত্রই বর্ষীয়ান্ তরুগণের তলদেশে পূজা-অর্চনার জন্য একএকটি শান্তিময় নিভৃত স্থান রহিয়াছে। আমাদের ‘দেশে, যেখানে মৃত্তিকাপের উপর ক্রুশ-দণ্ড স্থাপিত হয়—সেই সব চত্বরভূমির উপর-চৌমাথা রাস্তার উপর, এখানে ছোট-ছোট প্রস্তরবেদিকা, বিগ্রহশিলা, প্রতিমাদি প্রতিষ্ঠিত।
রাস্তার পথিক খুবই কম। স্বকীয় নগ্নতার সৌন্দর্য্যে গর্বিত, কেশগুচ্ছ আকটিবিলম্বিত—শিব কিংবা বিষ্ণুর তিলকচিহ্নে ললাট চিত্রিত —স্বপ্নময় ঢুলুঢুলু নেত্র—এইরূপ কতকগুলি লোক মন্দিরাভিমুখে চলিয়াছে; প্রায় সকলেরই বক্ষদেশে, উচ্চবর্ণের চিহ্রস্বরূপ উপবীত রহিয়াছে। কতকগুলি রমণী ইন্দারায় জল লইতে আসিয়াছে। তাহাদের বঙ্কিম দেহভঙ্গী;—স্কন্ধের উপর ঝকঝকে তাঁবার কলস রহিয়াছে। স্তনযুগলের একটিতে বক্ষের বসন ফুলিয়া উঠিয়াছে;অপরটি (প্রায়ই ডানদিকার) নগ্ন রহিয়াছে। এই সব তরুণীর তরুণ বক্ষোদেশ য়ুরোপীয় জাতিদিগের অপেক্ষা একটু বেশি পরিপুষ্ট,—নিতম্বের তুলনায় একটু বেশি অতিরিক্ত কিন্তু উহার গঠন অনিন্দ্যসুন্দর। বহু পুরাকাল হইতে হিন্দুরা তাহাদের প্রস্তর ও ধাতুময় মূর্ত্তিসকল যেরূপভাবে গঠন করে—উহাতে নারীসৌন্দর্য্যের উপকরণগুলি যেরূপভাবে অতিরঞ্জিত করে—এই রমণীরাই সেই-সব প্রতিমূর্ত্তির জীবন্ত আদর্শ। পথিমধ্যে তাহাদের সহিত কখন সাক্ষাৎ হইলে, তাহাদের নয়নকোণের চোরা-চাহুনি তোনার দৃষ্টির উপর নিপতিত হয়;—তাহাদের সেই দৃষ্টি বড়ই মধুর, কিন্তু নিতান্ত উদাসীন-নিতান্ত অন্যধরণের;—যেন উহা কালো বিদ্যুতের অনিচ্ছাকৃত সোহাগ-আলিঙ্গন; কিন্তু পরক্ষণেই সেই দৃষ্টি আবার নিম্নদিকে নত হইয়া পড়ে। বিদেশী পথিকের নিকট এদেশের —বহৎ মন্দির যেরূপ দুজ্ঞেয়, সমস্ত পদার্থই যেরূপ দুজ্ঞেয়—এই, রমণীরাও সেইরূপ দুয়ে।
সীমান্তদেশে পৌঁছান পর্য্যন্ত আমি কোচিনরাজের অতিথি হইয়াছিলাম, তিনি আমাকে যেখানে লইয়া গিয়াছেন, আমি সেইখানেই গিয়াছি। প্রভাতে ত্রিচূড় দিয়া যাত্রা করিবার সময়, তিনি কৃপা করিয়া সমস্তই পূর্ব্ব হইতে বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমার পথপ্রদর্শক, আহারসামগ্রী—সমস্তই প্রস্তুত ছিল। এমন কি, যে তিনঘণ্টার পথ অতিক্রম করিয়া, গ্রাম-জঙ্গল বনের মধ্য দিয়া, বয়েল-গাড়িতে আমায় “সোরানুরে” যাইতে হইবে—সেই গাড়িরও বদোবস্ত তিনি করিয়া রাখিয়াছিলেন।
বিদেশী পর্যটকেরা সেখানে কখনই যায় না,—সোরানুর ছাড়াইলেই আহা! আমি সেই চিত্তবিমোহন ভারতখণ্ডের বাহিরে চলিয়া যাইব; মাদ্রাজ যাইবার জন্য, আবার সেই সাধারণ রেলপথ ধরিয়া ডাকগাড়ির ট্রেণে আমার উঠিতে হইবে।