ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/তাঞ্জোরের অদ্ভুত শৈল
তাঞ্জোরের অদ্ভুত শৈল
তাঞ্জোর প্রদেশের অনন্তপ্রসারিত সমভূমির উর্ধে, নারিকেলাদিতরুসমাচ্ছন্ন বনভূমির উদ্ধে, একটি শৈলস্তপ খাড়া হইয়া উঠিয়াছে—নিঃসঙ্গ, বিরাটাকৃতি; উহা যুগযুগান্তর হইতে এই প্রদেশটিকে নিরীক্ষণ করিতেছে; কালক্রমে কত বন গজাইয়া উঠিল, কত নগর সমুখিত হইল, কত দেবালয় নির্ম্মিত হইল-~-সমস্তই দেখিয়াছে। ভূতত্বের হিসাবে ইহা একটি অদ্ভুত ব্যাপার;—আদিযুগের প্রলয়-প্লাবন-সত যেন একটি আজগুবি খেয়ালকল্পনা; দেখিতে মুকুটের চূড়ার মত; অথবা যেন দৈত্যদিগের জাহাজের অগ্রভাগ, উদ্ভিজ্জের হরিৎ-সাগরে অর্ধ-মজ্জিত। প্রায় পাঁচ শত হাত উচ্চ। চারিদিককার বিস্তৃত সমতল ভূমির মধ্যে উহা কিরূপে সমুদ্ভূত হইল, আশপাশের কোন লক্ষণ দেখিয়া তাহা বুঝা যায় না। উহার গাত্র এরূপ মসৃণ যে, এই উদ্ভিজ্জ-প্রবল দেশেও, উহাতে কোনও গাছের চারা লগ্ন হইতে পারে নাই। এই হেতু, স্বভাবতই পুরাকালের ভারতবাসী সেই মহাযোগী ঋষিগণ এই শৈলটিকে স্বকীয় আরাধনার স্থান করিয়া লইয়াছেন। বহুকাল ধরিয়া, ধৈর্য্যসহকারে তাহার এই শৈল-প্রস্তর কাটিয়া, অলিন্দ-সোপানাদি-সমন্বিত দেবালয় নির্মাণ করিয়াছেন। উহার শীর্ষদেশে কনক-মণ্ডিত চূড়া ঝম করিতেছে। যুগযুগান্তর কাল হইতে, প্রতিরাত্রে ঐ চূড়ার উপর পূত অগ্নি জ্বালানো হইয়া থাকে। সাগরস্থ দীপস্তম্ভের ন্যায়, তাঞ্জোরের দূর দিগন্ত হইতেও উহা সকলের দৃষ্টিগোচর হয়।
আজ প্রাতঃকালে সূর্যোদয়ে, শৈলের পদ প্রান্তস্থ নগরটি অন্য দিন অপেক্ষা আজ যেন একটু বেশী চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। আগামী কল্য ব্রাহ্মণদিগের একটা মহা পূজা-পার্ব্বণের দিন। গত কল্য হইতে উহারা বিষ্ণুপূজার জন্য অসংখ্য হলদে ফুলের মালা প্রস্তুত করিতেছে। রমণীরা, বালিকরা, উৎসবের সাজসজ্জায় ভূষিত হইয়া, যাহার যাহা-কিছু উত্তম অলঙ্কার ছিল—বলয়, নথ, কান্-বালা—সমস্ত পরিধান করিয়া, তাম্রকলসে জল ভরিবার জন্য, উৎসবের চারিধারে আসিয়া মণ্ডলীবদ্ধ হইয়াছে। শকটের বলদদিগের সিং রং-করা—সোনার-গিটি করা। তাহাদের কণ্ঠহার, ছোট ছোট ঘণ্টা ও কাচের গুটিকায় বিভূষিত। মালার দোকানদারেরা, দোকানে রাশি রাশি মালা সাজাইয়া রাখিয়াছে—একপ্রকার ছোট ছোট লাল ফুল, বঙ্গীয় গোলাপ, গাঁদা—এই সকল পুষ্প মুক্তার মত গাঁথিয়া, কতিপয় হার-বিশিষ্ট মালা রচিত হইয়াছে। এই মালাগুলি অজাগর অপেক্ষাও স্থূল। ইহার ঝুলগুলিও ফুলের, “জড়ি দিয়া জড়ানো। কল্য, যাহারা পূজা-উপলক্ষে আসিবে, এবং মন্দিরস্থ দেবতারা—সকলেই এই হদে ও গোলাপী রঙের মালাগুলি কণ্ঠে ধারণ করিবে। এই উৎসবের কর্মকর্তারা, আজ প্রত্যুষেই গাত্রোত্থান করিয়া, স্বকীয় আবাসগৃহের মুখে ও সযত্নসন্মাঙ্খিত কুটিম-ভূমির উপরে, ফুলের ও নানাপ্রকার রেখার নক্সা চিত্র করিবার জন্য ব্যস্ত; একটা ছোট সাদা গুড়ার পাত্র হস্তে লইয়া, চিত্র বিচিত্র নক্সার আকাকে সেই গুড়া ছড়াইয়া দিতেছে। এই সাদা নক্সাগুলি এমন সুন্দর, এবং নকসার প্রত্যেক সন্ধিস্থলে, হলদে ফুল এমন সুন্দরভাবে সন্নিবেশিত যে, রাস্তায় চলিতে আর সাহস হয় না। কিন্তু এইবার বাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়াছে; তাহার সঙ্গে লাল ধূলাও উড়িয়াছে। ভারতের এই দক্ষিণপ্রদেশে এই ধূলায় সব জিনিষ লাল হইয়া যায়। লোকেরা যে এত ধৈর্য্য ধরিয়া চিত্র বিচিত্র রঙে ভূমি রঞ্জিত করিল, এখন ইহার আর কিছুই থাকিবে না।
নগরের বাড়ীগুলিতে লাল ইটের রং। গৃহ-দ্বারের উপর ত্রিশূল-চিহ্ন অঙ্কিত—সমস্তই খুব নীচু। মোটা-মোটা খাটো দেয়াল, পোস্তা-গাঁথুনি, খিলান-গাঁথুনি,–এই সমস্ত, ফ্যারোয়া’দিগের মিসর-দেশকে মনে করাইয়া দেয়। এখানে মনুষ্যালয় অপেক্ষা দেবালয়ই অধিক। প্রত্যেক দেবালয়ের সম্মুখস্থ ত্রিকোণাকার গাঁথুনির উপর ছোট ছোট লালচে রঙ্গের বিকটাকার মূর্তি সন্নিবেশিত, এবং তাহাদিগের সঙ্গে এক-ঝাক দাঁড়কাক বসিয়া আছে। তাহারা পান্থাদিগের গতিবিধি নিরীক্ষণ করিতেছে;—কিরূপ শীকার জোটে, পচা-বসা কিরূপ জিনিষ মেলে তাহারই জন্য অপেক্ষা করিতেছে; এই চিরঅবারিত-দ্বার প্রত্যেক দেবালয়ের অভ্যন্তরে এক একটি ভীষণ মূর্ত্তি অধিষ্ঠিত; গজমুণ্ডধারী গণেশের মূর্ত্তিই প্রায় সর্ব্বত্র দেখিতে পাওয়া যায়। টাটটা হলদে ফুলের রাশি-রাশি মালা তাঁহার কণ্ঠে বুলিতেছে;—এই সকল মালায় তাহার চারিটি বাহু ও লম্বমান শুণ্ডটি ঢাকিয়া গিয়াছে।
মন্দিরের পর মন্দির; ব্রাহ্মণদিগের স্নানার্থ পুণ্য পুষ্করিণী; প্রাসাদ; বাজার। মুসলমানের মজিদও এই তাল-নারিকেলের দেশে অল্প-স্বল্প প্রবেশ-লাভ করিয়াছে। এক সময়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য-দেশে মুসলমানধর্ম্মের জয়-পতাকা উড্ডীন হইয়াছিল—ইহাই বোধ হয় তাহার কারণ। মসজিগুলি সাদাসিধা; গায়ে, আরবীয় শিল্পরীতির অনুযায়ী না-কাটা, সরু-সৰু “মিনারের মাঝখান হইতে উহা আকাশ ফুড়িয়া সোজা উঠিয়াছে। যে ধূলা এখানকার সব জিনিস লাল করিয়া দেয়, সেই লাল ধূলা-সত্ত্বেও, এই মজিগুলি, ‘হেজাজে’র মসজিদের মত, কোন উপায়ে স্বকীয় তুষার-শুভ্রতা রক্ষা করিয়াছে।
পিপীলিকাশ্রেণীর ন্যায় লোকের গতিবিধি—লোকের প্রবাহ চলিয়াছে। কাল উৎসবের দিন। আমি শৈল-মন্দিরের অভিমুখে যাত্রা করিলাম। মন্দিরের সম্মুখভাগটি নগর ছাড়াইয়া উর্দে উঠিয়াছে। তিন চারিটি প্রকাণ্ড শৈলস্তপে মন্দিরটি গঠিত; উহাতে একটুও চীড়, নাই, ফাটল নাই, জীর্ণতার রেখামাত্রও নাই। এই স্তুপগুলি পরস্পর-উপযুপরিনিক্ষিপ্ত, জন্তুর পার্শ্ব-দেশের ন্যায় ঈষৎ-বর্তুল, বৃষ্টির জলধারায় মসৃণীকৃত; উহাদের গাত্র এত ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে যে, দেখিলে ভয় হয়। দাঁড়কাকের মেঘে চারি দিক্ আচ্ছন্ন;—উহারা অর্ধচন্দ্রাকারে ঘোর-পাক দিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। জটিল-নক্সা কাটা উচ্চ প্রস্তর-স্তম্ভের মধ্যে, ছোটছোট মন্দির-চূড়ার মধ্যে, (সমস্তই ক্ষয়গ্রস্ত ও বহুপুরাতন) একটা টী কতকগুলি সুলক্ষণাক্রান্ত পবিত্র হস্তিশাবক (আরাধ্য হস্তিবংশ-প্রসূত) প্রবেশ-পথটি প্রায় রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ছোট-ছোট ঘণ্টা-গাঁথা মালায় উহাদের দেহ আচ্ছাদিত। সেই প্রবেশ-পথে উহারা শিশু-সুলভ ক্রীড়াচ্ছলে, আমার গায়ে শুড় বুলাইয়া দিল। এইবার আমার আরোহণ আরম্ভ হইল। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে গিয়া পড়িলাম। সেই সঙ্গে চারি দিক হইতে বাদ্যধ্বনি শুনা যাইতে লাগিল;—শৈল-গহবরের মধ্যে সেই ধ্বনির গভীরতা যেন আরও বৃদ্ধি হইল;—মনে হইতে লাগিল, যেন উহা পাতাল-গর্ভ হইতে নির্গত হইতেছে।
বলা বাহুল্য, আমি এক্ষণে মন্দিরের কাছে আসিয়া পড়িয়াছি। কত গুপ্ত,কক্ষ, কত অলিন্দ, কত প্রবেশ-দালান, কত সিঁড়ি;—ইহার মধ্যে কতকগুলি কেবলমাত্র পুরোহিতদিগের ব্যবহার্য্য;—এই সিঁড়িগুলি রহস্যময় অন্ধকার ভেদ করিয়া উর্দ্ধে উঠিয়াছে। প্রত্যেক গুপ্তস্থানে, প্রত্যেক কোণে, এক একটি প্রতিমা অধিষ্ঠিত; কোনটা বা বামনের ন্যায় ক্ষুদ্র, কোনটা বা দৈত্যের ন্যায় বিকটাকার, কিন্তু সবগুলিই কাল-বশে। লুপ্তাঙ্গ; কাহারও বা বাহুর অংশমাত্র-কাহারও বা আধখানা মুখ অবশিষ্ট রহিয়াছে।
আমি অদীক্ষিত দর্শক—আমি-মাঝের বৃহৎ পথটি দিয়া উপরে উঠিতেছি -সে পথটি সকলেরই নিকট অবারিত। চারিধারে,এক-একটি অখণ্ড প্রস্তরে গঠিত চমৎকার স্তম্ভশ্রেণী-নক্সা ও আকৃতিচিত্রে সমাচ্ছন্ন; উহাদের তলদেশ এক-মানুষ-সমান উচ্চপদঘর্ষণে তেলা ও চিকচিকে হইয়া উঠিয়াছে। কত কত শতাব্দী হইতে, এই সকল সঙ্কীর্ণ পথের ছায়ান্ধকারে, কত অগণ্য ঘর্মাক্ত নগ্নগাত্র মনুষ্য অবিরাম চলিয়াছে; এই সকল শৈলকুট্টিম, তাহাদেরই স্বেদজল গভীররূপে শোষণ করিয়াছে। শৈল-মন্দিরের গায়ে—এমন কি, উহার সোপান-ধাপ ও টালিতে পর্য্যন্ত—কতকাল পূর্ব্বে, লেখাক্ষর ও সাঙ্কেতিক চিঃ সকল ক্ষোদিত হইয়াছিল, কিন্তু সে সমস্ত এখন দুর্বোধ ও দুর্নিরূপ্য হইয়া পড়িয়াছে;—বিচরণকারী লোকদিগের পাণিতল ও নগ্ন পদের ঘর্ষণে অতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
প্রথমেই কতকগুলি ভজন-মণ্ডপ; এত জনতা যে নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া যায়। এইখানে ভক্তজন অন্ধকারের মধ্যে বন্দনা গান করিতেছে। আর একটু উচ্চে একটি দেবালয়, ক্যাথিড়াল’ গির্জ্জার ন্যায় বিশাল; অরণ্যবৎ স্তম্ভশ্রেণী উপরকার ভীষণ পাষাণ-ভার ধারণ করিয়া আছে। এই মন্দিরে বিধর্ম্মীদিগের প্রবেশাধিকার আছে, কেবল এই নিয়ম যে, প্রবেশ করিয়া আর অধিক অগ্রসর হইতে পারিবে না। এই দেবালয়টি কোথায় গিয়া শেষ হইয়াছে, দেখা যায় না। দূর-প্রান্তের বর্ণবিন্যাস ও ক্ষোদিত গুহাগুলি শৈলের নৈশ-অন্ধকারে বিলীনপ্রায়। শুভ্র লোমশ বস্ত্রে আচ্ছাদিত একটি বৃদ্ধের নিকট, কতকগুলি ব্রাহ্মণ-শিশু বেদ পুরাণাদি পাঠ করিতেছে। শৈল-মণ্ডপের সঁড়িপথ-গুলিতে, ব্রাহ্মণদিগের আনুষঙ্গিক পূজা-সামগ্রী সকল সংরক্ষিত মহাপুরুষ, রথ, ঘোড়া, হাতী, (প্রকৃত অপেক্ষা বড়) অদ্ভুত কল্পনা-প্রসূত কত খুটিনাটি জিনিস, জমাটকাগজের উপর—রঙ্গিন কাগজের উপর আঁকা—দেবালয়ের গায়ে, ভঙ্গুর বংশদণ্ডের উপর লটকানো রহিয়াছে। এখানকার জীবকুল উন্মত্তভাবে বংশবর্ধনে ব্যাপৃত। ছোট-ছোট পাখী-চাতক কিংবা চড়াই-মন্দিরের সুড়ি-পথগুলিতে নীড়নিৰ্মাণ করিয়া, চিত্রবিচিত্র রঙ্গের অণ্ডে তাহা পূর্ণ করিতেছে। এই সঁড়ি-পথগুলিতে লোকজন যাতায়াত করিতেছে, পক্ষিশাবকগুলিচিচি শব্দ করিতেছে, এবং এই লঘু প্রাণীদিগের পরিত্যক্ত পুরীষ, কুট্টিম-প্রস্তরের উপর শিলাবৃষ্টির ন্যায় পতিত হইতেছে;—এই সমস্ত জীবন-উদ্যমের বিকাশে, বিচিত্র বিকটাকার জীবের প্রাচীর-বিলম্বিত চিত্রগুলিও যেন একটু সজীব হইয়া উঠিয়াছে।
এখনও আরও উর্দ্ধে উঠিতে হইবে। এই অর্ধ-অন্ধকারের মধ্যে, এই সকল অখণ্ড-প্রস্তরময় মসৃণ প্রাচীরের মধ্যে, মনে হয়, যেন কোন ভূগর্ভস্থসমাধি-মন্দিরের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি। এই সময়ে, হঠাৎ একটি বাতায়নের মধ্য দিয়া সূর্যের কিরণচ্ছটা প্রবেশ করিয়া আমার সর্ব্বাঙ্গ প্লাবিত করিল, তখন নিম্নদেশের দূরস্থ বৃক্ষ ও মন্দিরাদি দেখিতে পাইলাম। আমি আকাশের খুব উচ্চদেশে উঠিয়াছি। কতকগুলি শৈলপ-শৈলযুগের প্রস্তরবৎ প্রকাণ্ড, পরস্পর উপর্যপরি বিন্যস্ত, বিশ্লিষ্ট ও এক-ঝোকা, শুধু স্বকীয় পরমাণুরাশির ভারেই, প্রায় অনাদি কাল হইতে এক স্থানে দণ্ডায়মান।
আবার একটি দেবালয়; কিন্তু উহাতে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমি উহা দ্বারদেশ হইতেই দেখিলাম। এইমাত্র আমি যে স্থানটি ছাড়িয়া আসিলাম, সেখানকার শৈলপগুলির ন্যায় এই শৈলস্তুপগুলিও পরস্পর উপর্যপরি বিন্যস্ত, কিন্তু তদপেক্ষা আরও প্রকাণ্ড ও চমৎকারজনক। তা ছাড়া এইগুলি অধিকতর আলোকিত; কেন না, ইহার খিলানের গায়ে, স্থানে স্থানে চতুষ্কোণাকার ফাঁক আছে, যেখান হইতে নীলআকাশ পরিলক্ষিত হয়, এবং সূর্যকিরণ প্রবেশ করিয়া, বিচিত্র রঙ্গের অলঙ্কারে বিভূষিত, সোনালি-গিণ্টির কাজ-করা, মন্দিরের অংশবিশেষের উপর নিপতিত হয়। এই দেবালয়টি—যাহা গগনবিলম্বী বলিলেও হয়— ইহার উপরে কতকগুলি ছাদ আছে;—এই ছাদের উপর হইতে দেখা যায়, তাঞ্জোরের সমভূমি দূরদিগন্ত পর্য্যন্ত প্রসারিত, এবং তত্রস্থ অসংখ্য মন্দির, হরিদ্বর্ণ নারিকেল-কুঞ্জের মধ্য হইতে মস্তক উত্তোলন করিয়া আছে।
এখন কেবল সেই সৰ্বোপরিস্থ শৈলস্ত,পটি আমার দেখিতে বাকি একটি অখণ্ড প্রস্তরের সেই স্তুপ, যাহা আদিকালের প্রলয়বিপ্লবে, অত উর্ধে নিক্ষিপ্ত হইয়া ঝুঁ কিয়া রহিয়াছে। নিম্নদেশ হইতে দ্রেখিলে মনে হয়, যেন উহা কোন জাহাজ-"গোলুই"এর অগ্রভাগ, অথবা ‘হেলমেট’-শিরফের চূড়ান্ত। এই শৈলের গা বাহিয়া একটা অপরিস্ফুট সিড়ি উঠিয়াছে, তাহার ১৪০টা ধাপ-সঙ্কীর্ণ, ক্ষয়গ্রস্ত ও এরূপ ঝোকা যে দেখিলে মাথা ঘুরিয়া যায়।
উল্লিখিত কনক-কলস-ভূষিত ছাদের উপরেই, প্রতিরাত্রে পুণ্য-অগ্নি জ্বালানো হয়, এবং সেইখানেই মন্দিরের মুখ্য পুত্তলিকাটি, একটা প্রকাণ্ড তমসাচ্ছন্ন মণ্ডপের মধ্যে স্থাপিত। যেন কোন বন্য পশুকে রুদ্ধ করিয়া রাখিতে হইবে, এইভাবে মণ্ডপের চারিধার মজবুৎ লোহার গরাদে দিয়া ঘেরা। বিগ্রহটি কৃষ্ণবর্ণ ভীষণ গণেশ—স্বকীয় পিঞ্জরের দূরপ্রান্তে, অন্ধকারের মধ্যে বসিয়া আছেন।—একেবারে গরাদের ধারে না আসিলে স্পষ্ট দেখা যায় না। ইহার গজকর্ণ ও গজশু স্বকীয় লম্বোদরের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে, এবং ইহার প্রস্তরময় দেহটি, ঈষৎ ছাই-রঙ্গের ছিন্ন মলিন চীরবস্ত্রে আচ্ছাদিত। এই উত্তঙ্গ ব্যোমমার্গস্থ কারাগুহে বন্দীর ন্যায় আবদ্ধ থাকিয়াও, ইনি একাকী সেই সর্ব্বোপরিস্থ মন্দিরের মধ্যে রাজত্ব করিতেছেন, সেখান হইতে, দ্বিসহস্র বৎসর যাবৎ, বাধ্বনি ও বন্দনা-গান অবিরাম উচ্ছসিত হইতেছে।
আমি এখন মনুষ্য ও পাখীর রাজ্য ছাড়াইয়া বহু ঊর্ধে আসিয়াছি। নীচে কাকেরা ঘোরপাক দিয়া উড়িতেছে, চীলেরা উধাও হইয়া উর্ধে উঠিয়াছে-মনে হইতেছে, যেন নিঃস্পন্দ হইয়া স্থিরভাবে আকাশে ঝুলিতেছে। এই মন্দিরস্থ গণপতি যে প্রদেশের উপর আধিপত্য করিতেছেন, ঐ প্রদেশটি পূজা-অর্চনায় যেরূপ উন্মত্ত, সমস্ত ভূমণ্ডলে এরূপ আর কুত্রাপি দেখা যায় না। দেবালয়-সমূহ যেন বৃক্ষের ন্যায় চাৰি দিক হইতে গজাইয়া উঠিয়াছে। চারি দিকেই দেব-মন্দিররূপ লোহিত-কুসুম-রাশি যেন হঠাৎ বনভূমি হইতে বিকসিত হইয়া উঠিয়াছে। তাল নারিকেলের বন হইতে এত মন্দির উঠিয়াছে যে, এই উচ্চস্থান হইতে মনে হয়, যেন তৃণক্ষেত্রের মধ্যে, শৃগালের কতকগুলি আবাসগর্ত্ত রহিয়াছে।
ঐ অদূরে, ২০টা ত্রিকোণাকৃতি প্রকাণ্ড মন্দির-চূড়া—যেন কোন ছাউনিতে কতকগুলি তবু একত্র সাজানো বহিয়াছে। উহা ‘শ্রীরাগমে’র মন্দির। যতগুলি বিষ্ণুমন্দির আছে, তন্মধ্যে ঐটি সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ। কাল ওখানে মন্দিরের উৎসব-উপলক্ষে, লোকেরা ঠাকুর লইয়া মহাসমারোহে রাস্তায় বাহির হইবে—আমি দেখিতে যাইব।
শৈলের ঠিক তলদেশে একটি নগর অধিষ্ঠিত—এখান হইতে ঝুঁকিয়া যেন একেবারে উহার উপরে গিয়া পড়া যায়। মনে হয়, যেন কোন-একটা রং-চং-করা মানচিত্রে রাস্তাসমূহের জটিল নক্সা-জাল অঙ্কিত; বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত মন্দিরের ছড়াছড়ি; কতকগুলি মন্দির খুব সাদা ধবধবে—তাহাতে একটু নীলের আভা স্ফুরিত হইতেছে। সূর্যকিরণদীপ্ত দর্পণের ন্যায় পুণ্যতীর্থ-পুষ্করিণীগুলি ঝিকমিক করিতেছে, আর সেই পুঘরণী-জলে ব্রাহ্মণেরা প্রাতঃস্নান করিতেছে—মনে হয়, যেন কালো-কালো অসংখ্য মাছি ভাসিতেছে। ইংরাজ-বর্জিত ভারতবর্ষ। ম্যালাবার প্রদেশের ন্যায় এখানেও নারিকেলের রাজত্ব। তথাপি, অনিল-আন্দোলিত এই শাখা-পক্ষময় অরণ্যের মধ্যে—যাহা চতুর্দিকে দিগন্তে গিয়া শেষ হইয়াছে—এক একটা বড়-বড় ফাক, হলদে দাগের মত দেখা যাইতেছে। এইগুলি শুস্ক তৃণক্ষেত্র, বর্ষণের অভাবে দগ্ধ হইয়া গিয়াছে। এই শুষ্কতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে, এবং আরও দূর প্রদেশে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হইয়াছে। তাঞ্জোরেও এই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা উপস্থিত হইয়াছে।
সুতীব্র জীবন-উদ্যম-পূর্ণ বিচিত্র কোলাহল, এইখানে পৌছিবামাত্র সব. একত্র মিশিয়া যাইতেছে। উৎসবময় নগরের প্রমোদ-কল্লোল, গরুর গাড়ীর চাকার শব্দ, রাস্তার ঢাক ঢোল ও শানাইয়ের বাদ্যনির্ঘোষ, চিরন্তন বায়সদিগের কা-কা-রব, চীলদিগের তীব্র চীৎকার, উপযুপরি-বিন্যস্ত মন্দিরসমূহের স্তবগান, ভূরী ও শঙ্খধ্বনি,–এই সমস্ত শৈলদেহে প্রতিহত হইয়া অবিরাম প্রতিধ্বনিত হইতেছে।