ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/মীনাক্ষী-দেবীর রত্নভাণ্ডার
মীনাক্ষী-দেবীর রত্নভাণ্ডার।
আজ আমি প্রত্যুষে সূর্যোদয় হইবামাত্রই (১) দেবালয়ে উপস্থিত হইলাম। এই প্রস্তরময় গোলোকধাধার প্রবেশপথগুলিতে ইহারই মধ্যে ভাতিক জীবন-উদ্যমের স্ফক্তি দেখা যাইতেছে। প্রবেশ-বীথীর ধারে ধারে, সমস্ত প্রস্তর-মঞ্চের ভীষণদর্শন প্রতিমা-সমূহের মধ্যবর্তী সমস্ত কুলঙ্গির মধ্যে, ফুলের দোকানীরা কাজে বসিয়া গিয়াছে; গাঁদা ফুলের মালা গাঁথিতেছে, তাহার সহিত গোলাপ ফুল ও স্বর্ণসূত্র সংমিশ্রিত করিতেছে। অর্ধনগ্ন লোকেরা যাতায়াত করিতেছে; সদ্যস্নাত ব্যক্তির আর্জ কেশ হইতে জল ঝরিয়া পড়িতেছে, তাহাদের চক্ষে ধ্যানের ভাব, ভক্তির ভাব। পবিত্র হস্তী, পবিত্র গাভী,—যাহারা তমসাচ্ছন্ন মন্দিরের কুটিমতলে বাস করে; পক্ষীগণ, যাহারা রক্তিম মন্দির-চুড়ার বিভিন্ন উচ্চ-অংশে নীড় বাঁধিয়া আছে, সকলেই এই প্রভাত-আলোকে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে, ক্রীড়া করিতেছে;—পশুপক্ষীর মধ্যে কেহ হরব, কেহ বা বৃংহিত, কেহ বা কুজন কেহ বা গান করিতেছে। পূর্ব্বের কথামত পুরোহিতেরা আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন। তাহারা আমাকে অন্ধকারময় মন্দিরের গভীরদেশে লইয়া গেলেন।, আমার সম্মুখে, একটা গুরুভার তাম্র-দ্বার উদঘাটিত হইল; উহাই মন্দিরের গুপ্ত অংশ।
প্রথমে একটা দালান, তাহার দুই ধারে সারি সারি কৃষ্ণবর্ণ দেবমুত্তি, গুহাগহবরের মত সমস্ত অন্ধকারে আচ্ছন্ন,—তাহার পরেই বিমল আলোকচ্ছটা, “স্বর্ণপদ্ম-সরোবর” নামে একটি পবিত্র পুষ্করিণী;মুক্ত আকাশতলে, একটি চতুষ্কোণ গভীর জলাশয়; নামিবার জন্য, চারিধারে পাথরের সিঁড়ি; জলাশয়ের চারিদিকে, শোভন-সুন্দর স্তম্ভশ্রেণী চলিয়া গিয়াছে; কতকগুলি খিলান-মণ্ডপ খোদাই-কাজকরা ও কতকগুলি খিলান-মণ্ডপ পবিত্র গম্ভীর বর্ণে রঞ্জিত; আর সারি সারি ঢাকা-বারাণ্ডা; এই বারাণ্ডাগুলি, ব্রাহ্মণদিগের গুপ্ত বিচরণভূমি। এই বদ্ধ ঘেরের একটা দিক, সুশীতল নীল ছায়ায় এখনও পরিস্নাত; অন্য দিক্, সূর্যের উদয়ে ইহারই মধ্যে পাটল-রাগে,—ভাতিক সিন্দুররাগে রঞ্জিত হইয়াছে। এই সরোবরের চতুদ্দিকস্থ সারি সারি বারাণ্ডাদালানের মাথা ছাড়াইয়া, উর্ধে রক্তিম মন্দির-চূড়াগুলি; সকল স্থান হইতেই এই চূড়াগুলি দেখা যাইতেছে; এই চূড়াগুলি বিভিন্ন ব্যবধানে ও বিভিন্ন উচ্চতায় অবস্থিত হইয়া দীপ্তি পাইতেছে এবং প্রত্যেক চূড়ার চারিধারে পাখীরা ঝাকে ঝাকে উড়িয়া বেড়াইতেছে; আর একটি সোনার গম্বুজও ঝিকমিক্ করিতেছে মন্দিরের যে স্থানটি সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্র ও সর্ব্বপেক্ষা রহস্যময়, যেখানে আমি কোনো উপায়েই প্রবেশলাভ করিতে পারি নাই—সেই গম্বুজটি তাহারই মাথায় অধিষ্ঠিত। অপূর্ব্ব সরোবর! নিষ্পতা যেন মুর্তিমতী! তীরস্থ কঠোর ও বিরাট দৃশ্যের মধ্যে এই সরোবরের জল যেন মৃত বলিয়া মনে হয়—উহাতে একটি রেখামাত্র নাই। চতুর্দিকের স্তম্ভশ্রেণী, জলের উপর প্রতিবিম্বিত, দ্বিগুণিত, দীর্ঘীকৃত ও বিপর্যস্ত ভাবে দেখা যাইতেছে। এই “স্বর্ণপদ্ম-সবোবর",—এই তপন-তারা জলদরাজির দর্পণ—যাহা বিরাট মন্দিরের হৃদয়দেশে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থিত—এইখানে এমন একটি শান্তির ভাব সৰ্বত্র ওতপ্রোত হইয়া রহিয়াছে যে তাহা বাক্যের দ্বারা ব্যক্ত করা যায় না। এই সমস্ত থিলান-মণ্ডপের গোলোকধাধার মধ্যে, কোন পথ দিয়া, পুরোহিতেরা যে আমাকে লইয়া গেলেন, তাহা বুঝিবার চেষ্টা করা বৃথা। যতই আমি অগ্রসর হইতে লাগিলাম, ততই যেন সমস্ত আমার নিকট অতিভারাক্রান্ত ও অতিমানুষিক বলিয়া মনে হইতে লাগিল;— সমস্ত মন্দির উত্তরোত্তর আর ও প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথরের চালায় গঠিত। বিংশতি বাহুবিশিষ্ট দেবতা, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গীবিশিষ্ট দেবতা—এই সমস্ত অসংখ্য বিরাট দেবমূর্তি ছায়ান্ধকারের মধ্যে সারি সারি কতই যে চলিয়াছে তাহার শেষ নাই—তাহার কোন শৃঙ্খলাও নাই। আমি তাহার মধ্যদিয়া চলিয়াছি। যেন স্বপ্নে অতিকায় দৈত্যদের রাজ্যের মধ্যদিয়া-ভয়ানকের রাজ্যের মধ্যদিয়া চলিয়াছি। চারিদিকেই অন্ধকার, এবং আমাদের পদক্ষেপে সমাধি-গহ্বরসুলভ মুখরতা যেন জাগিয়া উঠিল।
ক্রমাগতই প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড প্রতিমা ক্রমাগতই বিরাট ব্যাপার নেপথে পতিত হইতেছে, আবার সেই সঙ্গে বব্বরোচিত অযত্ন তাচ্ছিল্য, বিষ্ঠা ও আবর্জনা রাশি। মানুষপ্রমণ সমস্ত দেয়াল, দেয়ালের গাত্র. নিঃসৃত অংশগুলা—সমস্তই কালিমাগ্রস্ত, আর্দ্রতা ও ময়লায় চিকচিক করিতেছে। এই একটা বারাণ্ডা——ইহা গজমুণ্ডধারা গণেশের নামে উৎসীকৃত, গণেশের পদতলে, শুণ্ডের নীচে, কতকগুলি পুনায়মান প্রদীপ জ্বলিতেছে, তাহারই আলোকে গণেশের বিকটাকার শরীরটা আলোকিত হইয়াছে। এই দেখ, একটা ভীষণ কোণে, পোর রাত্রিকালে, এই সকল বিকটাকার প্রঙ্করমূর্ত্তির মধ্যে, এক-পাল জীবন্ত পশু অবস্থিত, উহাদের নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাইতেছে; একটা সমস্ত গো-পরিবার এখনও নিদ্রা যাইতেছে—যেন এখনও সূর্যের উদয় হয় নাই; মন্দিরকুটিমের ষাণ, উহাদের গোময়ে আচ্ছন্ন—তাহা মধ্যে পা পড়িয়া পা পিছলাইয়া যাইতেছে; ঘৃণিত বলিয়া কেহ তাহা বাহিরে, নিক্ষেপ করিতে সাহস করে না,—কেন না, যাহা তাহাদের অন্ত্র হইতে নিঃসৃত, তাহাও তাহাদেরই ন্যায় পবিত্র। বড় বড় ডানা-ওয়ালা বাদুড় চাম্চিকা ভয়চকিত হইয়া আমাদের মাথার উপর ক্রমাগত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
আমার পথপ্রদর্শকেরা, কোন এক বিশেষ মুহূর্ত্তে, উৎকণ্ঠিত হইয়া তাড়াতাড়ি চলিতে লাগিল; সেই সময়ে আমরা একটা অপেক্ষাকৃত উচ্চ ও তমসাচ্ছন্ন দালানের সম্মুখ দিয়া যাইতেছিলাম; সেই দালানের গভীর-দেশে কতকগুলা বিকটাকার দেবমূর্ত্তি কতকগুলি দ্বীপের আলোকে আমি ‘চোরা-গোপ্তান্’ দেখিয়া লইয়াছিলাম। আমাকে যাহারা লইয়া যাইতেছিলেন তাহাদের মধ্যে একটি ব্রাহ্মণ, আমার নিকট আসিয়া মৃদুস্বরে আমাকে বলিলেন ঐটিই সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্র স্থান; আগে আমাকে বলেন নাই, পাছে আমি বেশী দেখিয়া ফেলি।
অবশেষে, এই গুরুপিণ্ডাকার স্তম্ভারণ্যের একটা জায়গায় আসিয়া পুরোহিতেরা থামিলেন; এই স্থানটি খুব বিশাল ও জম্কালো। কতকগুলা বৃহৎমন্দিরের মধ্যবর্ত্তী যেন একটা চৌমাথা-রাস্তা। এইখানে অনেকগুলি দালানের কুটিম উদ্ঘাটিত ও সর্ব্বদিকে প্রসারিত হইয়া ক্রমে ছায়ান্ধকারে মিশাইয়া গিয়াছে। অখণ্ড প্রস্তরের বিরাটাকার, বিগ্রহ সমূহ চারিদিক বেষ্টন করিয়া আছে; উহারা বল্লম, অসি, নরমুণ্ড হস্তে ধারণ করিয়া আস্ফালন করিতেছে; উহারা কালো, চিক্চিকে, তেলা;—হস্তঘর্ষণে উহাদের উপর লম্বা-লম্বা দাগ পড়িয়াছে; উহারা লোকের গাত্রঘর্ম্ম শোষণ করিয়াছে! কতকগুলি বেদীর উপর, তাম্র ও রৌপ্য সামগ্রী ঝিকমিক্ করিতেছে; কতকগুলা পিতলের চুড়াকার সামগ্রী বহুশতাব্দিব্যাপী কালপ্রভাবে বাঁকিয়া গিয়াছে,—বোধ হয় পূর্ব্ব্বে দীপাধার ছিল;—এই সমস্ত দেবীর রহস্যময় পূজার সামগ্রী। এবং ইহারই মাঝখানে, দীর্ঘকুন্তল ও নগ্নকায় ভিক্ষুকের জনতা; মন্দিরই ইহাদের প্রধান আড্ডা; রক্ষিগণ চীৎকার করিয়া, ঠেলাঠেলি করিয়া, উহাদিগকে সরাইয়া দিতেছে। কেন না, ভিক্ষুকেরা কৌতূহলাকৃষ্ট হইয়া একপ্রকার বেড়ার চারিধারে ক্রমাগত ঠেলিয়া আসিতেছে; দুই দিক্কার দুইটা পিপায় দুইগাছা রসি বাধিয়া এই বেড়াটি সংরচিত।
আমার প্রবেশের জন্য টানা রসির কিয়দংশ শিথিল করিয়া ভূমিতে নামাইয়া দেওয়া হইল, তাহার পর পূর্ব্ব্বের মত আবার সটানে বাধা হইল; আমি পুরোহিতদের সহিত রঞ্জু-চক্রের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। আমার সম্মুখে একটা বৃহৎ টেবিল কালো গালিচায় ঢাকা;—তাহারই উপর দেবীর অলঙ্কারগুলি স্তূপাকার। এই রাশীকৃত স্বর্ণ ও রত্নময় অলঙ্কারের নিকটে, উহারা আমাকে একটা কারান-কেদারায় বসাইল; আমার গলাল গেঁ ফুলের মালা পরাইয়া দিল; তাহার পর, পুরোহিতেরা আমার হস্তে অলঙ্কার গুলি দিতে আরম্ভ করিলেন; এই অফারগুলি কোন গভীরতম গুপ্ত কক্ষ হইতে ঘণ্টাখানেকের জণ্ঠ বাহির করা হইয়াছে; তাহারা আমার হাতে অলঙ্কারগুলি স্পর্শ করাইতে লাগিলেন; এবং আমোদ করিয়া একটার পর একটা আমার জানুর উপর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। বিবিধ বর্ণের মণিরত্নে খচিত ডজণ্ডজ ভারী ওজনের সোনার মুকুট। অজাগর সর্পের ন্যায়, মাণিক ও মুক্তার পাকানো হার, সহস্র বৎসরের পুরাতন বলয়। পুরাতন কণ্ঠনালাগুলা এত ভারী যে এক হাতে উঠানো কঠিন। রমণীর কূপ হইতে জল তুলিবার জন্য যে সব কলস ব্যবহার করে সেইরূপ বড় বড় কলস,—কিন্তু উহা পালা সোনার, এবং হাতুড়ী পিটিয়া গঠিত। বক্ষদেশ বিভূষিত করিবার জন্য নীলরঙ্গের একটি অতুলনীয় কবচ-বাদামের মত বড় বড় মণীকৃত নীলকান্তমণি দিয়া বিরচিত। যে সময় তাহারা এই সব অপূর্ব্ব র-ঐশ্বর্যে আমার হাত ভরিয়া দিতেছিলেন, সেই সময়ে দূর হইতে “সঙ্গীতলহরী আমার কাণে আসিয়া পৌছিতেছিল -ঢাকঢলের ঘোর গর্জ্জন, পবিত্র শঙ্খ ও শানাইয়ের বিলাপ-ধ্বনি। মধ্যে মধ্যে আমার পশ্চাতে ঘোর কোলাহল; ক্ষুধাতুর ভিক্ষুকদিগকে রক্ষিগণ তাড়াইতেছে; ভিক্ষুকেরা এতদূর ঠেলিয়া আসিয়াছে যে ভঙ্গুর দড়ির বেড়াটা ভাঙ্গিবার উপক্রম হইয়াছে। আবার এই দেখ, হীরকখচিত কতকগুলা ঘোড়ার রেকাব,—নিশ্চয়ই দেবীর অশ্ব-বাহনের জন্য গঠিত। এই দেখ কতকগুলা সোনার কৃত্রিম কাণ, তাহাতে সূক্ষ্ম মুক্তাগুচ্ছ। উৎসবযাত্রাকালে দেবীর জ্বণাকার ক্ষুদ্র গোলাপীমস্তকের দুই পাশে উহা আটকাইয়া দেওয়া হয়। এই দেখ, কতকগুলা সোনার কৃত্রিম হাত ও কৃত্রিম পা; দেবী যখনই ভ্রমণার্থ মন্দির হইতে বাহির হয়েন, তখনই উহা তাহার জ্বণ-প্রায় ক্ষুদ্র হস্তপদের প্রান্তদেশে বাধিয়া দেওয়া হয়•••
এই রভারাক্রান্ত টেবিলের রত্ন-ঐশ্বর্য্য যখন সমস্তই দেখা হইয়া গেল, আমি মনে করিলাম এই বুঝি শেষ। কিন্তু না; ভীষণ মুর্তিসমূহে পরিপূর্ণ, কৃষ্ণবর্ণ বারাণ্ডাগুলার মধ্যদিয়া পুরোহিতেরা আমাকে একটা অঙ্গনে লইয়া গেলেন; সেখান হইতে তুরীনাদের মত ঘোর তীব্র শব্দ নিঃসৃত হইতেছিল; সেখানে লাল পোষাকে আচ্ছাদিত ছয়টা হস্তী, রদ্দরে দাড়াইয়া আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল; আমি আসিবানাই, তাহাদের বৃহৎ ও স্বচ্ছ কর্ণরূপ তালপত্রের বীজনে ক্ষান্ত না হইয়া, আমার সম্মুখে নতজানু হইল। আমি প্রত্যেককে রৌপ্যমুদ্রা দিলাম; উহারা অতি সূক্ষ্ম ক্ষুদ্র চক্ষু দিয়া নিরীক্ষণ করিতেছিল এবং মুদ্রাটি উঠাইয়া লইয়াই, কতকগুলা বৃহৎ চামড়ার ‘কূপোর মত’ নড় বড় করিতে করিতে চলিয়া গেল; আপনার খেয়াল-অনুসারে যেখানে খুসি চলিয়া গেল;—কেহ বা সঁড়ি বারাণ্ডাপথে, কেহ বা মন্দিরের কুট্টিমতলে; এই মন্দিরের মধ্যে উহারা মুক্তভাবে বিচরণ করে।
তাহার পর, উহারা আমাকে মন্দিরের দালানে লইয়া গেল; উহার ছাদ-আদি প্রকাণ্ড প্রকাও পাথরের চালায় গঠিত; দেখিলে মনে হয়, অতিকায় দৈত্যদিগের গুহাভবন; যে সকল ভৃত্য আমাদের সঙ্গে ছিল, তাহারা দেওয়াল বাহিয়া উঠিয়া দম্মার ঝাপগুলা সরাইয়া দিল, ঝাপগুলা অপসৃত হইলে, দেয়ালের গায়ে কোন কোন স্থানে আললা আসিবাক ফুকোর-পথ দেখা গেল। কিন্তু তাহা থাকা না থাকা সমান, ঠিক রাত্রির মত অন্ধকার,—দীপ জ্বালানো আবশ্যক।
কতকগুলি নগ্নকায় ক্ষুদ্র বালক, দীপ কিম্বা মশাল লইয়া দৌড়িয়া আসিল; এই মশালগুলা মান্ধাতা-যুগের, এই জ্বলন্ত মশাল গুলি হইতে খুব ধোয়া উঠিতেছে; এইগুলি দীর্ঘ পিত্তলদণ্ড,—অগ্রভাগ শুড়ের মত বাকানো।
লোহার পতর-মারা একটা দ্বার উদঘাটিত হইল, সর্ব্বপ্রথমেই সেই ক্ষুদ্র বালকেরা প্রবেশ করিল•••এখন আমরা দেবীর বিচিত্র পশুশালায় উপস্থিত; জীবন্ত পশুর প্রমাণ একটা রূপার গরু, কতকগুলা সোণার ঘোড়, সেই চির-আর্দ্র উষ্ণতার মধ্যে—সারি সারি সজ্জিত রহিয়াছে; বালকের আসিয়া সেই খোদিত মূর্তিদের নিকট আলো ধরিল; সেই আলোকে গরু ও ঘোড়ার সাজের রত্নগুলি ঝিমিক করিতে লাগিল। উপরে—ভীষণ প্রস্তরখিলানমণ্ডপে, পালোকহীন কতকগুলা ডানা ক্রমাগত সঞ্চালিত হইতেছে এবং সেই সঙ্গে মৃদু মৃদু তীক্ষ্ণ শব্দ শুনা যাইতেছে; বাদুড় চাচিকার ঝক্ উন্মত্তভাবে ঘোরপাক দিতেছে।
লোহার পতর-মার দ্বিতীয় দ্বার; রূপা ও সোণার পশুদের জন্য আর একটা ঘর।
তৃতীয় দ্বার এবং ইছাই শেষ-দ্বার। এই খানে একটি রূপার সিংহ, একটি সোণার প্রকাণ্ড ময়ূব-প্যাখোন তোলা; প্যাথেমের ‘চোগুলা পানা দিয়া রচিত; একটা রূপার গরু, তাহার মুখ নারীমুখের মত, কিন্তু আসল নারীমুখ অপেক্ষা অনেক বড়; হিন্দু রমণীর ন্যায়, কাণে ও নাসিকার অগ্রভাগে বিবিধ রত্নালঙ্কার ধারণ করিয়া রহিয়াছে। এই ঘরের কোণে দেবীর একটা সোণর পাল্কী রক্ষিত; এই পাল্কীর গায়ে অনেক খোদিত কারুকার্য্য-হীরা ও মাণিকের ফুল উৎকীর্ণ। নগ্নকায় বালকেরা এই ঔপন্যাসিক রত্নবিভবের উপর তাহাদের নশাল ধরিল; এই মশালে আলো অপেক্ষা ধোয়াই বেশী, যাই হক এই নশালের আলোকে কোথাও কোথাও স্বর্ণালঙ্কারের খুটিনাটিগুলি প্রকাশ পাইতেছে, কোন কোন বহুমূল্য রত্ন হইতে অগ্নিচ্ছটা উচ্ছসিত হইতেছে, কিন্তু মোটের উপর সমস্তই নিবিড় নৈশ অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। দেয়ালগুলা মাকড়শার জালে বিভূষিতস্থানে স্থানে পাথরের গুড়া জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে, স্বেদ ও যক্ষার গড়াইয়া পড়িতেছে; আর বাদুড় চাচিকারা জাগিয়া উঠিয়া, ক্রমাগত ঘোরপাক দিতেছে, কিন্তু তাহাদের ডানার শব্দ শোনা যাইতেছে না। কালো রঙ্গের কাপড় হইতে ছিন্ন একটা বড় টুকরার মত তাহাদের ডানা; সেই ডানার বাতাস উহারা আমাদের গায়ে লাগাইয়া চলিয়া গেল। এবং এক প্রকার তীব্র শব্দ করিয়া উঠিল, ইদুরের কলে ইদুর পড়িলে যেরূপ শব্দ করে কতকটা সেইরূপ।