ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/পণ্ডিচেরীর অভিমুখে
পণ্ডিচেরীর অভিমুখে।
মাদুরা ছাড়িয়া, উত্তরে পণ্ডিচেরীর অভিমুখে যতই অগ্রসর হইতে লাগিলাম, তালীবনের আর্দ্র প্রদেশ ততই দূরে সরিয়া যাইতে লাগিল; এখন শুধু স্থানে স্থানে সুচ্ছায় তালকুঞ্জ দেখিতে পাওয়া যায়; তৃণভূমি, বাগান-বাগিচা, ধানের ক্ষেত তালীবনের স্থান অধিকার করিয়াছে। বাতাসও ক্রমে ক্রমে লঘু হইয়া আসিতেছে, মাঠ-ময়দানের মধ্যে জলের বিরলতা, জমি যেন শুকাইয়া গিয়াছে।
তথাপি, এখানকার লোক-জীবনে গোপ-ভূমি-সুলভ একটা শান্তির ভাব পরিলক্ষিত হয়। আমাদের য়ুরোপের ন্যায় এখানকার বসতি ঘননিবিড় নহে। নগ্নকায় রাখালেরা, লাল শাড়ী-পরিহিতা রাখালিনীয়া ছাগলের পাল, ককুদবান্ ক্ষুদ্রকায় গরুর পাল লইয়া মাঠে চরাইতেছে। মাঠের ঘাস ইহারই মধ্যে হলদে হইয়া গিয়াছে, কিন্তু এখনও যথেষ্ট আছে।
গ্রামের ঘরগুলা চূণ ও পেটা-মাটী দিয়া গঠিত। প্রত্যেক গ্রামে এক-একটি দেবালয় আছে। দেবালয়ের দেবমূর্তিগুলি পিরামিডের আকারে খাড়া হইয়া উঠিয়াছে, বিকট মূর্তিগুলা দেয়ালের উপর বসিয়া আছে;—সমস্তই প্রখর সূর্যের উত্তাপে ও লাল ধূলার মধ্যে ম্রিয়মাণ। দূর-দূর ব্যবধানে, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাছের কুঞ্জ, তাহারই ছায়াতলে কতকগুলি দেবতা সিংহাসনে সমাসীন; কতকগুলি পাথরের ছাগল ও পাথরের গরু দেবতাদিগকে আগলাইতেছে, এবং বহুশতাব্দী ইতে তাহাদের দিকে মুখ ফিরাইয়া তাহাদের ধ্যানে মগ্ন রহিয়াছে।
লাল ধূলা! এই ধূলা ক্রমেই কষ্টকর হইয়া উঠিতেছে। শুষ্কতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে। মে সেই সকল স্থানে প্রবেশ করিলাম, যেখানে অস্বাভাবিক জলকষ্ট। আকাশের সেই একই ভাব, সেই একই স্বচ্ছতা, সেই একই নীলবর্ণ।
চাষারা চারিদিকে, সেকেলে পদ্ধতি অনুসারে সুকৌশলে জলসেচন করিতেছে। ধানের ক্ষেতের ধারে ধারে ছোট ছোট জলস্রোত চলিয়াছে, তাহারই এক-হাঁটু জলে দাড়াইয়া, দুই দুইজন লোক একটা রঞ্জুর প্রান্ত ধরিয়া আছে, সেই রজু একটা ভেড়ার চামড়ার মসকে বাঁধা; উহারা ঐ মসকটাকে একপ্রকার যান্ত্রিক গতির দ্বারা তালে তালে দুলাইতেছে ও তাহার সঙ্গে গান করিতেছে; এবং উহাতে জল ভরিয়া, ধানক্ষেতের লাঙ্গল-কৃত খাতের মধ্যে ঢালিয়া দিতেছে।
গাছের তলায় যে সকল কূপ আছে তাহার প্রণালী স্বতন্ত্র, তাহার গানও স্বতন্ত্র। একটা দীর্ঘ দণ্ডের প্রান্তে একটা চামড়ার মসক আবদ্ধ, সেই দণ্ডটা একটা মাস্তুল-কাঠের মাথার উপর বিলম্বিত; সেই দণ্ডটার উপর, দুজন লোক “জিন্যাষ্টের” সহজ-শোভন চটুলতা সহকারে পদচারণ করিতেছে, একদিকে তিন পা চলিলেই দণ্ডটা কুপের অভিমুখে লুইয়া পড়িতেছে এবং মসকটাও নিমজ্জিত হইতেছে; আবার উল্টা দিকে তিন পা চলিলেই দণ্ডটা এবং সেই সঙ্গে মসকটাও উঠিয়া পড়িতেছে, এইরূপ ক্রমান্বয়ে প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত, অবিরাম উহাদের গান চলিয়াছে।
যতই অগ্রসর হইতেছি, শুষ্কতা ততই কষ্টকর হইয়া উঠিতেছে। একটু পরেই দেখিলাম, কতকগুলা গাছ যেন আগুনে পুড়িয়া গিয়াছে, পাতাগুলা কুঁকড়িয়া গিয়াছে, এবং গাছের গায়ে লাল ধূলাব যেন একটা পুরু পোঁচ পড়িয়াছে। দক্ষিণ প্রদেশে কেবল কীর্তিমদির গুলাই এই লাল ধুলায় রঞ্জিত হয়, কিন্তু এখানে গাছপালাও রঞ্জিত রহিয়াছে। এখানে ভূমি যেমন তৃষাতুর, আকাশ যেরূপ নিবৃষ্টি, তাহাতে মানুষের ক্ষুদ্র চেষ্টায় আর কি হইবে? মসকগুলা ক্রমেই কূপের গভীর দেশে তলাইতেছে, এবং শুষ্ক তলদেশে জল না পাইয়া উঠিয়া পড়িতেছে। আসন্ন ভীষণ দুর্ভিক্ষের পূর্ব্বসূচনা ও বাস্তবতা ক্রমেই উপলব্ধি হইতেছে। ভারতে আসিবার পূর্ব্বে, এইরূপ উৎপাৎ প্রাগৈহিতাসিক বলিয়াই মনে করিতাম। আমাদের এই বেল-পথ ও বাষ্পীয় পোতের যুগে, খাদ্যের আমদানির অভাবে, লোকেরা অনাহারে মরিবে —ইহা দয়াধর্ম্মের বিচারে নিতান্তই অমার্জনীয়।