ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/পণ্ডিচেরীতে

পণ্ডিচেরীতে।

 আমাদের পুবাতন ক্ষুদ্র ম্রিয়মান উপনিবেশ নগর পণ্ডিচেরীর যতই নিকটবর্তী হইতেছি ততই নারিকেল তালবৃক্ষাদি আবার দেখা দিতেছে। ইহার চতুর্দিকস্থ প্রদেশ এখনও সর্ব্বগ্রাসী শুষ্কতার কবলে পতিত হয় নাই; এই প্রদেশটি যেন একপ্রকার মরুকানন বলিয়া মনে হয়; এখনও ইহা নদীর জলে—বৃষ্টির জলে পরিষিক্ত; এখনও দক্ষিণ প্রদেশের সুন্দর হরিৎক্ষেত্র মনে করাইয়া দেয়।  পণ্ডিচেরী!•••আমাদের পুরাতন যে সকল উপনিবেশের নাম আমার শৈশবকালের কল্পনাকে মুগ্ধ করিত তন্মধ্যে পণ্ডিচেরী ও গোরের নাম, আমার মনে সুদূর বিদেশের একপ্রকার অনির্ব্বচনীয় স্বপ্ন জাগাইয়া “তুলিত। আমার যখন বয়স প্রায় দশ বৎসর, আমার এক অতিবৃদ্ধা পিতামহী একদিন সন্ধ্যাকালে, পণ্ডিচেরী-নিবাসী তাহার একটি মহিলাবন্ধুর কথা আমাকে বলিয়াছিলেন এবং তাহার পত্র হইতে একটি অংশ আমাকে পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন, সেই পত্রের বৎসর সেই সময়েই একঅর্ধ শতাব্দি পিছাইয়া ছিল; সেই পত্রে তিনি তালকুঞ্জের কথা, ‘প্যাগোডা’র (দেবালয়) কথা বলিয়াছিলেন।

 সেই সুদূরবী পূরাতন রমণীয় নর, সেখানকার ফাটাফুটো প্রাকারাবলীর মধ্যে সমস্ত ফরাসী-অতীতটা যেন নিদ্রামগ্ন, সেই নগরে আসিয়া, ওঃ।আমার মনে কি একটা তীব্র বিষাদের ভাব উপস্থিত হইল! আমাদের নিস্তব্ধ মফস্বলের অভ্যন্তরপ্রদেশে যেরূপ ছোট ছোট রাস্তা, এখানেও কতকটা সেইরূপ; ছোট ছোট রাস্তাগুলি খুব সোজা, রাস্তার বাড়ী গুলা নীচু, শতবৎসরের পুরাতন, চূণকাম-করা সাদা, লাল মাটির উপর দণ্ডায়মান; উদ্যানের প্রাচীরের উপর হইতে কমি ফুলের মালা কিংবা অন্যান্য গ্রীষ্ম প্রধান দেশের পুষ্পমালা ঝুলিয়া পড়িয়াছে; গরাদে-ওয়ালা জানার পশ্চাতে কতকগুলি দিৰিঙ্গিরমণী কিংবা মেটেফিরিঙ্গি রমণীর মুখ দেখা যাইঙেছে। সুন্দর মুখ এবং চোখে ভারতীয় গূঢ়রহস্য বিদ্যমান। # রইয়া, ‘রু ডুপ্লে’ (অর্থাৎ রয়্যাল রোড, ডুপ্লে রোড)। এই নাম অষ্টাদশ শতাব্দীর অক্ষরে, পাথরের উপর সেকেলে-বরণে থোদিত। সে নগরটি আমার জন্মস্থান, সেই নগরের কোণে, কঙকগুলি পুরাতন বাড়ীর উপর এইরূপ ধরণে নাম এখনও খোদিত আছে বলিয়া আমার স্মরণ হয়। “রু স্যালুই” এবং “quay (কে) ব্লাশ-এই quayর বানানোর বদলে সেকেলে y•••  পণ্ডিচেরীর মধ্যস্থলে, একটা বৃহৎ চত্ত্বর, ময়দানের মত প্রসারিত, সর্ব্বদাই জনশূন্য, তৃণাক্রান্ত, এবং তাহার মাঝখানে একপ্রকার শোভাফোয়ারা; বোধ হয় ইহা একশ বৎসরেরও পুরাতন নহে, কিন্তু সর্ব্বধ্বংসী সূর্যের প্রখর উত্তাপে জরাজীর্ণ বার্ধক্যের ভাব ধারণ করিয়াছে; উহাকে দেখিলে, কে জানে কেন, মনে এক প্রকার বিষাদের ভাব উপস্থিত হয়।

 “গোরা সহরের” পরেই দেশী সহর। এই দেশী সহর খুব বড়, জীবন উদ্যমে পূর্ণ, তাছাড়া খুব হিন্দুভাবাপন্ন;—বাজার আছে, তালকুঞ্জ আছে, দেবালয় আছে।

 এখানকার ভাবতবাসীরা ফরাসী, আমাদের ফ্রানসের লোক,—অন্তত এই কথা আবৃত্তি করিতে উহারা ভালবাসে। এখানকার একটি ক্লব— নিছক্ ভারতবাসীদের ক্লব—আমাকে যেরূপ আগ্রহের সহিত আদর অভ্যর্থনা করিয়াছিল তাহা আমি বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করিতে পারি না উহা বড়ই মর্মস্পর্শী। উহারা নিজের চেষ্টা ও যত্নে এই ক্লবটি স্থাপন করে। যাহাতে আমাদের মাসিক পত্রিকা, আমাদের পুস্তকাদি পাঠ করিবার সুবিধা হয় এই উদ্দেশেই ক্লবটি স্থাপিত।

 আমাদের ভাষাকে আরও দেশব্যাপ্ত করিবার জন্য, উহারা এই ক্লবের সঙ্গে একটা বিদ্যালয়ও যুড়িয়া দিয়াছে। যে সকল ছোট ছোট ছাত্রগুলিকে উহারা আমার সমক্ষে আনিল, উহারা কি সৌম্য সুন্দর! আট বৎসরের বালক, সূক্ষাবয়ব শ্যামল মুখমণ্ডল, কেমন ভদ্র, কেমন শিষ্ট, ছোট ছোট ক্ষুদে রাজার মত, উহাদের জরির পাড়ওয়ালা মখমলের পরিচ্ছদ। উহারা বিবিধ সমস্যা ও ফরাসীদের কর্তব্য সকল যেরূপ স্পষ্ট করিয়া বিবৃত করিল তাহা আমাদের নিম্ন পাঠশালার অধিকাংশ ছাত্রের পক্ষে দুরূহ।