বাই-নাচ।

 দীর্ঘায়াত নেত্র বিশিষ্ট, রং-করা একটি তরুণ মুখ, ইন্দ্রিয়াসক্তি-পরিব্যঞ্জক মুখ,—তিমির-রাজ্যের মুখ—খুব লঘুভাবে, তাড়াতাড়ি একবার এগিয়া আসিতেছে, আবার পিছিয়া যাইতেছে। চোখের দুইটি তারা, মিনা-র সাদা জমির উপর বসানো কৃষ্ণমণির (Onyx) মত কালে দুইটি তারা আমার চোখের উপর নিবদ্ধ। এই যে হৃদয়-দুর্গ অধিকার করিবার জন্য একবার আমাকে আক্রমণ করিতেছে, আবার পলায়ন করিয়া ছায়াকারের মধ্যে মিশিয়া যাইতেছে, একবার এগিয়া আসিতেছে, আবার পিছাইয়া যাইতেছে,–এই সমস্ত ক্ষণ উহার চোখের দুইটা কালো তারা আমার চখের উপর সমানভাবে নিবদ্ধ রহিয়াছে। এই শ্যামল তরুণ মুখখানি মণিরত্নে বিভূষিত; হীরক-খচিত একটা সোণার সিথি ললাট বেষ্টন করিয়া, চুল ঢাকিয়া রগের দিকে নামিয়া আসিয়াছে; কাণে ও নাকে আরও কতকগুলি হীরার টুকরা ঝিক্ মিক্‌ করিতেছে।

 আলোকোজ্জ্বল রাত্রি। জনতার মধ্যে, এই রমণীকে ছাড়া, আমি আর কাহাকেও দেখিতেছি না, উহার ঐ সিথি-বিভূষিত মস্তক ছাড়া আর কিছুই দেখিতেছি না। উহার উজ্জ্বলতা যেন আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। দর্শক-বৃন্দের জনতাও আছে—সম্মুখ দিকে ঠেলিয়া আসিয়া উহারাও রমণীকে একদৃষ্টে দেখিতেছে; এতটা ঠেলিয়া আসিয়াছে যে রমণী অতি কষ্টে ঘোরাফেরা করিতেছে—উহারা রমণীর জন্য কেবল একটি সরু পথের মত স্থান রাখিয়া দিয়াছে; সেই স্থানটুকুর মধ্য দিয়া, নর্তকী একবার আমার নিকট আসিতেছে আবার আমার নিকট হইতে পলায়ন করিতেছে; কিন্তু আমার চক্ষে জনতার যেন অস্তিমাত্র নাই; বস্তুত সেই রমণীকে ছাড়া,—সেই রমণীর শিরোভূষণটি ছাড়া, তাহার সেই চোখের কালো তার ও কালো ভুরুর খেলা ছাড়া, আমি যেন আর কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না—কিছুই দেখিতে পাইতেছি না... বেশ মোটা-সোটা ও মাংসল হইলেও, উহার দেহষ্টি ভুজঙ্গের ন্যায় সুনম; বিধাতা যেন মনোহরণ ও আলিঙ্গনের জন্যই উহার বাহু দুটি গড়িয়াছেন; রমণী, হীরক নাণিক্য-খচিত বলয়-কেউৱাদি ভূষণে আস্কন্ধ-বিভূষিত বাহুযুগলকে ভুজঙ্গ-গতির অনুকরণে কত রকম করিয়া বাকাইতেছে...কিন্তু না, সর্ব্বাগ্রে উহার চোখের দৃষ্টি আমার চোখের অন্তস্তল পর্য্যন্ত এমন ভাবে ভেদ করিতেছে যে আমার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিতেছে; ঐ চোখে নানা প্রকার ভাব খেলিতেছে—কখন পরিহাসের ভাব, কখনও স্নিগ্ধ কোমল প্রেমের ভাব...উহার মণিরত্নখচিত শিরোভূষণের, ও কর্ণনাসিকার অলঙ্কারের এরূপ উজ্জ্বলতা এবং ঐ উজ্জ্বল সোনার সি থিটি এমন পরিপাটিরূপে উহার মুখটি বেড়িয়া আছে, যে তাহাতে ঐ সুন্দর শ্যামল মুখখানিতে কি জানি কি একটা অস্পষ্ট দূরত্বের ভাব আসিয়া পড়িয়াছে—আমাকে স্পর্শ করিলেও যেন সে দুরত্ব ঘুচিবার নহে।

 সে যাইতেছে, আবার আসিতেছে; নর্তকী বিশেষ করিয়া আমার জন্যই নাচিতেছে। উহার নৃত্যে লেশমাত্র শব্দ নাই। গালিচার উপর কেবল উহার পায়ের মৃদুমধুর নুপুরধ্বনি শুনা যাইতেছে। উহার ছোট ছোট পা-দুখানির আঙ্গুলগুলি ছড়ানো, আংটীর দ্বারা ভারাক্রান্ত; গালিচার উপরে পা-দুখানি তালে-তালে ফেলিতেছে; এবং পায়ের আঙ্গুলগুলাও হাতের মত কেমন সহজভাবে নাড়িতেছে।

 ফুলের গন্ধে এখানকার বাতাস এমন পরিষিক্ত যে নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া যায়। এখানকার হিন্দুরা, হিন্দু-ফরাসীরা—আমার জন্য এই উৎসবের আয়োজন করিয়াছে, এবং উহাদের মধ্যে যিনি সর্ব্বাপেক্ষা ধনবান্, আমি নিমন্ত্রিত হইয়া তাহারই বাড়ীতে আসিয়াছি। আমি আসিবামাত্র গৃহস্বামী আমার গলায় কয়েক ছড়া জুই ফুলের মালা পরাইয়া দিলেন; সৌরভে ঘর ভরিয়া গেল—আমার যেন একটু নেশার: ঘোর লাগিল; লম্বা-গলাবিশিষ্ট একটা রূপার গোলাবদান হইতে খানিকটা গোলাপ জলও আমার উপর ছিটাইয়া দেওয়া হইল। গরমে হাঁপাইয়া উঠিতেছি। যে সকল নিমন্ত্রিত লোক বসিয়া আছে- (অধিকাংশই জরির পাড়ওয়ালা-পাগড়ীপর শ্যামবর্ণ লোক) দণ্ডায়মান নগ্নকায় ভৃত্যেরা তাহাদের মাথার উপর, রং-চঙে বড় বড় তালপাতার পাখা ব্যজন করিতেছে; যেখানে লোকেরা বেশভূষায় বিভূষিত—এমন কি পুরুষেরা পর্য্যন্ত কাণে হীরা পরিয়াছেকোমরবন্দে হীরা পরিয়াছে—সেই জনতার মধ্যে ভৃত্যদের এইরূপ নগ্নতা: কেমন বিসদৃশ বলিয়া মনে হয়।

 নর্তকীকে উহারা বলিয়াছে,আমারই জন্য এই উৎসবের আয়োজন; তাই, চতুর অভিনেত্রী এবং বংশপরম্পরাক্রমে পেদার এই নর্তকী, আমার উপরেই তাহার সমস্ত চাতুরী প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিয়াছে।

 আজিকার রাত্রির জন্য, উহাকে বহুদূর হইতে আনা হইয়াছে—এই প্রসিদ্ধ নর্তকী, দক্ষিণ প্রদেশের কোন এক বৃহৎ দেবালয়ে মহাদেবের সেবায় নিযুক্ত। উহাকে আনিতে অনেক আর্থব্যয় হইয়াছে।

 নর্তকী সন্মুখ দিকে ঝুকিতেছে কিংবা ধনুকের মত বাকিয়া পড়িতেছে, হাতের আঙ্গুল বাকাইয়া, পায়ের আঙ্গুল ঘুরাইয়া কত রকম ভঙ্গী করিতেছে। শৈশবাবধি অভ্যাসের দ্বারা উহার পায়ের আঙ্গুলগুলা বেশ সুনম হইয়াছে; পায়ের বুড়া আঙ্গুলটা সর্ব্বদাই অন্য আঙ্গুল হইতে বিচ্ছিন্ন এবং সিধা ভাবে উপরপানে তোলা। সোনালী গাজের শাড়ীতে নিতম্বদেশ অচ্ছািদিত এবং বক্ষদেশ আঁটসাট কঁচুলীতে আবদ্ধ—তাহাতে শ্যামল গাত্র ও মাংশপেশীযুক্ত মাংসল শরীরের একটু আভাস পাওয়া যাইতেছে, বক্ষের নিম্ন অংশের নড়াচড়া দেখা যাইতেছে।

 উহার নৃত্যে কেবলই কতকগুলি অঙ্গভঙ্গ ও হাব-ভাব; যে নাট্যাভিনয়ে কথোপথন নাই,—কেবল একজন মাত্র অভিনয় করে, সেইরূপ নাট্যের যেন ইহা মূক অভিনয়; আর আমার চোখের উপর চোখ নিবন্ধ করিয়া, সেই জনতা-বিরচিত সরু পথের মধ্য দিয়া, একবার আমার নিকটে এগিয়া আসিতেছে, আবার সহসা আলোকিত নৃত্যশালার শেষ প্রান্তে পিছিয়া যাইতেছে।

 এইবার নর্তকী, মনোহরণ ও ভৎসনার একটা দৃশ্য অভিনয় করি। তেছে। ঐ ওদিকে উহার পশ্চাতে কতকগুলি বাদক গান গাহিয়া এই দৃশ্যটির ভাব ব্যক্ত করিতেছে এবং গানের সঙ্গে বাঁয়া-তবলা ও বাঁশী বাজাইতেছে। নর্তকীও মূক-অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে মৃদুস্বরে যেন স্বগত গাইতেছে; সে গান আর কাহাকে শুনানো যেন তাহার উদ্দেশ্য নয়— কেবল অভিনয়ের অংশগুল পর-পর যাহাতে তাহার স্মরণে আইসে এইজন্যই যেন আপনার মনে গাইতেছে।

 এই নর্তকী নৃত্যশালার একপ্রান্তে কিছুক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে ছিল, সহসা আবার আসিয়া উপস্থিত;—উহার দেহ আপাদ-মস্তক সোনা ও জহরতে আচ্ছন্ন, উহার চোখৃ দিয়া যেন আগুন ছুটিতেছে; কুপিতা নায়িকার ন্যায় বোষকষায়িত-নেত্র হইতে আমার উপর তীক্ষ্ণ বাণ বর্ষণ করিতেছে; আমি যেন উহার নিকট কি একটা অপরাধ করিয়াছি—তাহারই জন্য যেন সে স্বর্গ মর্তকে সাক্ষী রাখিয়া, আমাকে ভৎসনা করিতেছে••

 তার পর, নর্তকী হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল, সে হাসি পরিহাসের হাসি, ঘৃণার হাসি; জনতার নিকট আমাকে হাস্যাস্পদ করিবার জন্য আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া হাসিতে লাগিল। জানা কথা, উহার ভৎসনাও যেমন কৃত্রিম, এই উপহাসও সেইরূপ কৃত্রিম। কৃত্রিম হউক, কিন্তু আসলের ঠিক্ নকল;—চমৎকার নকল।

 নর্তকী, কণ্ঠ একটু উত্তোলন করিয়া, একটু গম্ভীর স্বরে, তীব্র হাসি হাসিতেছে। তাহার হাসি মুখ দিয়া, ভুরু দিয়া, উদর দিয়া, কম্পন বক্ষ দিয়া, যেন কাটিয়া বাহির হইতেছে। হাসির আবেশে উহার সর্ব্বাঙ্গ কঁপিতেছে এবং এইরূপ হাসিতে হাসিতে সে দূরে সরিয়া যাইতেছে। সে হাসি দুর্দমনীয়, সে হাসি শুনিলে অন্যকেও হাসিতে হয়।

 আর যেন আমার মুখদর্শন করিবে না, এইভাবে অত্যন্ত অবজ্ঞা সহকারে, মুখ ফিরাইয়া, নর্তকী দ্রুতপদক্ষেপে পিছাইতে পিছাইতে চলিয়া গেল। আবার ফিরিয়া আসিল—কিন্তু এবার ধীরপদক্ষেপে ও গম্ভীর ভাবে ফিরিয়া আসিল। আমার উপর তাহার প্রবল ভালবাসা পড়িয়াছে; সে সর্ব্বজয়ী মদনের নিকট পরাভূত হইয়া, আমার দিকে বাহুপ্রসারিত করিয়া করযোড়ে মার্জনা ভিক্ষা করিতেছে; আমাকে তাহার সর্ব্বস্ব দান করিবে বলিয়া অনুনয় করিতেছে, ইহাই তাহার শেষ প্রার্থনা। এবার যখন চলিয়া গেল, তখন তাহার দেহ একটু হেলিয়া পড়িয়াছে, ওষ্ঠদ্বয় একটু ফাক হইয়া তাহার মধ্য হইতে শুভ্র দন্তরাজি প্রকাশ পাইতেছে; তাহার নাসিকায় হীরকের টুক্রাগুলি ঝিকৃমি করিতেছে; সে চায়—সে নিতান্তই চায়, আমি তাহার অনুসরণ করি; সে তাহার বাহুর দ্বারা, তাহাব কম্পিত বক্ষের দ্বারা, তাহার অর্ধনিমীলিত নেত্রের দ্বারা আমাকে ডাকিতে লাগিল; সে চুম্বকণির মত, সর্ব্বান্তঃকরণে আমাকে আকর্ষণ করিতে লাগিল। আমিও মন্ত্রমুগ্ধ অবস্থায়, ক্ষণেকের জন্য তাহাকে অনুসরণ করিলাম; কেন না, সে আমাকে সত্যই মন্ত্রমুগ্ধ করিয়াছিল। কিন্তু আসলে তাহার এই প্রেমের আহবানটা সর্ব্বৈব মিথ্যা; হাসির মত এই প্রেমের প্রকাশও তাহার অভিনয়ের একটা অংশ মাত্র; একথা সবাই জানে, তবু তাহাতে আকর্ষণের কিছুই লাঘব হয় না; প্রত্যুত, এই আহবান মিথ্যা বলিয়া জানি বলিয়াই যেন উহার এই দুষ্ট আকর্ষণের মাত্রাটা আরও বৃদ্ধি হয়••

 যতক্ষণ সে অভিনয় করিতেছিল, বাদকদলের দুই গায়কেব সহিত সে যেন এক প্রকার চুম্বক-কর্ষণে সংযুক্ত কিংবা একটা অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।

 তাহারা তাহার তিন চারি পা পশ্চাতে থাকিয়া, তাহারই সঙ্গে সঙ্গে এগিয়া আসিতেছে—পিছাইয়া যাইতেছে। সে যখন এগিয়া আসে, তাহার পিছনে পিছনে তাহারা ও এগিয়া আসে,—এবং পিছাইবার সময় হইলে তাহারাই আগে পিছাইতে আরম্ভ করে। তাহারা কখনই তাহাকে নজর-ছাড়া করে না; উহাদের চোখ যেন জলিতেছে, ওষ্ঠ অনেকটা উদনাটিত রহিয়াছে, আর উচ্চৈঃস্বরে গান করিতেছে; মস্তক সম্মুখে এগিয়া আসিয়াছে, ঝুঁকিয়া রহিয়াছে; উহারা মাথায় উচু, নর্তকী ক্ষুদ্রকায়; উহারাই যেন নর্তকীর প্রভু; উহাদেরই প্রভাবে যেন উহার ভাবিহইতেছে, উহারাই উহার মনকে অধিকার করিয়া রহিয়াছে; —যেন একটা উজ্জ্বল লঘুকায় প্রজাপতির উপর কুঁ-দিয়া নিজের খেয়াল-অনুসারে উহাকে যেখানে সেখানে চালাইয়া লইয়া বেড়াইতেছে। উহার মধ্যে, কি জানি কেমন একটা বিকৃতভাব—কেমন একটা কুটিল নষ্টামির ভাব পরিলক্ষিত হয়।

 বদিকদলের পাশে, আরও দুই তিনটি নর্ত্তকী রহিয়াছে,—উহারই এত বেশভূষায় সুসজ্জিত। উহারা প্রথমেই নাচিয়াছে। উহার মধ্যে একজনকে আমার ভারী অদ্ভূত বলিয়া ঠেকিয়াছিল; যেন একপ্রকার বিষাক্ত সুন্দর ফুল, পাতলা ও লম্বা; মুখটা সরু; একেই ত বড় বড় টানা চোখ, তাতে আবার সুর্মা দেওয়ায় আর ও বেপরিমাণ দীর্ঘ হইয়াছে; চুল খুব কালো, দুই গালের উপর দিয়া, খুব ‘পেটে-পাড়ানো ভাবে ফিতার মত নামিয়াছে; শুধু কালো পরিচ্ছদ, কালো শাড়ী, সরু জরির পাড়ওয়ালা একটা কালো ওড়না; অলঙ্কারের মধ্যে শুধু মাণিকের অলঙ্কার; হাতে মাণিক, বাহুতে মাণিক; এবং একগুচ্ছ মাণিক নাসিকা হইতে লম্বিত হইয়া ওষ্ঠের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে, মনে হইতেছে যেন রক্তপায়ী রাক্ষসীব মুখে এখনও রক্তের দাগ লাগিয়া রহিয়াছে।

 কিন্তু এখন আবার সেই স্বর্ণভূষণা নর্ত্তকী—সেই নর্ত্তকীবৃন্দের রাণী, নর্ত্তকীদের উজ্জ্বল তারা,—বাদকদল পরিবেষ্টিত হইয়া আবার সহসা আবির্ভূত হইল, তথন উহাদের স্মৃতি, আমার মন হইতে একেবারেই অন্তহিত হইল। শেষ নৃত্যের জন্য উহাকেই রাখা হইয়াছিল।

 এই নর্র্ত্তকী অনেকক্ষণ ধরিয়া নৃত্য করিল; যদিও এই নৃত্যে আমার ক্লান্তিবোধ হইতেছিল, তবুও সেই সঙ্গে ভয়ও হইতেছিল, কোন্ মুহূর্ত্তে না জানি তাহার নৃত্যের অবসান হইবে, আমি তাহাকে আর দেখিতে পাইব না।  আবার সেই ভৎসনা, সেই দুর্দমনীয় হাসি, নেত্রভঙ্গীতে সেই বিজপের ভাব, আবার সেই নিরঙ্কুশ প্রেমের আহ্বান•••

 যাই হোক, নর্তকী এইবার থামিল। সব শেষ হইয়া গেল; আমার চমক ভাঙ্গিল; যে সব লোেক সেখানে ছিল তাহাদিগকে আবার আমি দেখিতে পাইলাম। আমার অভ্যর্থনার জন্যই এই মজলিসের আয়োজন হইয়াছিল; আবার আমি মজলিসের বাস্তব ভূমিতে পদার্পণ করিলাম।

 এইবার প্রস্থানের সময় হইয়াছে। প্রস্থানের পূর্ব্বে, নর্তকীকে আমি অভিনন্দন করিতে গেলাম। দেখিলাম, নর্তকী একটা মিহি রুমাল দিয়া মুখ মুছিতেছে; উহার বড় গরম বোধ হইতেছে, মুক্তাফলের ন্যায় স্বেদবিন্দু উহার ললাটে, উহার শ্যামল মসৃণ গাত্রে দেখা দিয়াছে।' এখন সে আদব-কায়দা-দুরস্ত, পাষাণ-শীতল, সুবিনীত, উদাসীন, হৃদয়-হীন অভিনেত্রী মাত্র; সে কৃত্রিম লজ্জার সহিত, আমার প্রশংসা গ্রহণ করিল, আমাকে সেলাম করিল; প্রত্যেকবারেই, অঙ্গুরী-বিভূষিত-সৰ্বাঙ্গুলি হস্তযুগলের দ্বারা আপনার মুখ ঢাকিতে লাগিল.••

 শত সহস্র বৎসর হইতে বংশানুক্রমে যাহাদের ব্যবসায় চলিয়া আসিতেছে সেই পুরাতন নর্তকীর বংশে ইহার জন্ম, ইহার হৃদয়ে মোহবিভ্রম ও ভোগবিলাস ছাড়া আর কি থাকিতে পারে?•••