ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/পণ্ডিচেরী ছাড়িয়া

পণ্ডিচেরী ছাড়িয়া।

 কাল পণ্ডিচেরী ছাড়িয়া, নিজামের রাজ্যের ভিতর দিয়া, ভারতের দুর্ভিক্ষ পীড়িত প্রদেশ রাজপুতদের রাজ্যে যাত্রা করিব।

 আমাদের পুরাতন উপনিবেশে আমি হদ্দ দশ দিন মাত্র রহিয়াছি, আশ্চর্য্য, ইহারই মধ্যে এই স্থান ছাড়িয়া যাইতে আমার কেমন একটু কষ্টবোধ হইতেছে। এতদিন ত আমি ভারতের একস্থান হইতে স্থানান্তরে লঘুহৃদয়ে প্রস্থান করিয়াছি! কেহ মনে করিতে পারে, আমি যেন পণ্ডিচেরীতে দ্বিতীয়বার আসিয়াছি, যেন আমার মনে পণ্ডিচেরীর পূর্ব্বস্মৃতি জাগিয়া উঠিয়াছে। আমার প্রথম যৌবনে, সেনেগালের সেই নিৰ্বাপিত পুরাতন নগর Saint-Louisতে একবৎত্র বাস করিয়া, প্রস্থানের সময় আমার মনে যেরূপ ভাব হইয়াছিল, এখান হইতে যাইবার সময়েও কতকটা সেইরূপ ভাব উপস্থিত হইয়াছে।

 আমি এখানে আসিয়া একটা হোটেলে ছিলাম। পণ্ডিচেরীতে দুইটা হোটেল আছে; কিন্তু পর্যটক আগন্তুকের অভাবে, দুইটা হোটেলই কোনপ্রকারে কষ্টেসৃষ্টে চলে। যে হোটেলটা সমুদ্রের ধাবে অবস্থিত আমি সেই হোটেলটা বাছিয়া লইয়াছিলাম। হোটলের বাড়ীটা একটু সেকেলে রাজ-রাজড়ার বাড়ীর মত, নগরের গোড়াপত্তন হইতে উহার নির্ম্মাণকাল ধরা যাইতে পারে; উহার জরাজীর্ণতা চূণকামে ঢাকা পড়িয়াছে। উহার ভগ্নদশা দেখিয়া, পোডোভাব দেখিয়া, আমি একটু ভয়ে ভয়ে প্রবেশ করিয়াছিলাম। তখন কে বলিতে পারিত, যদৃচ্ছাল এই প্রবাস-গৃহটির উপর আমার আসক্তি জন্মিবে? আমি একটা বড় কার। অধিকার করিয়া ছিলাম, বয়ঃপ্রভাবে কাম্রাটা একটু বাঁকিয়া গিয়াছে, চূণকামে ধব ধব, করিতেছে এবং ভিতরটা প্রায় খালি। আফ্রিকার উপকূলে যে বাড়ীটিতে আমি অনেকদিন বাস করিয়াছিলাম, তাহার সহিত উহার কি-যেন একটা অনিৰ্দেশ্য ও ঘনিষ্টতর সাদৃশ্য আছে। সবুজ খড়খড়িওয়ালা জাল্লা হইতে ভারতের অসীম সমুদ্র দেখা যায়; দিনের যে সময়টা অত্যন্ত কষ্টজনক সেই সময়ে বহিঃসমুদ্রের স্নিগ্ধ বায়ু আদর্শশৈত বহন করিয়া আনে। ফিরিঙ্গিদের ঘরে যেরূপ থাকে, সেইরূপ আমার ঘরে, শত বর্ষের পুরাতন কতকগুলা কাঠের আরাম-কেদারা ছিল; কেদারার কিনারায় খোদাই-কাজ। ঘোড়শ লুইর আমলের একটা দেয়াল-ঘেঁসা অর্ধ-টেবিলের উপর সেই সময়কার একটা ঘড়ি ছিল। তাহার টিক্ টিক্ শব্দে জানা যায় তাহার জরাগ্রস্ত ক্ষুদ্রপ্রাণটা এখনও একটু ইংরাজ-বর্জিত ভারতবর্ষ। ধুকধুক্ করিতেছে। সমস্ত আসবাবই শুফ-জীর্ণ, পোকা-খাওয়া, ভগ্নপ্রায়; কেদারায় খুব চাপিয়া বসিতে কিংবা খাটের উপর ধড়াস্ করিয়া শুইয়া পড়িতে সাহস হয় না! কিন্তু দিন গুলি বড়ই রমণীয় ও উপভোগ্য; বায়ু নিস্তব্ধ, সমুদ্রের দিগন্ত সুনীল, চতুর্দিকের সামুদ্রিক শান্তি অতীব মধুর।

 জান্‌লার উপর হাতের কুনুই রাখিয়া বুকিয়া দেখিলে আরও অনেকটা সমুদ্র ও সমুদ্রের বেলাভূমি, নিকটস্থ অনেক পুরাতন বাড়ীর বারাণ্ডা, ও আরব-ধরণের ছাদ দেখা যায়,—ছাদগুলা সূর্য্যোত্তাপে ফাটিয়া গিয়াছে; এই সমস্ত দেখিয়াও আমার আফ্রিকা মনে পড়ে। প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত, একদল নগ্নকায় মজুর পার্শ্ববর্তী একটা অঙ্গনে, জাহাজ বোঝাই করিবার জন্য, শস্যের দানা ও বিবিধ মত্সা চটাই-থলের মধ্যে ভরিতেছে, আর একপ্রকার ঘুমন্ত সুরে গান করিতেছে। '

 কি দিন, কি রাত্রি,—আমি দরজা জানলা কখনই বন্ধ করিতাম না, পাখীরা আপনার ঘরের মত স্বচ্ছন্দে আমার ঘরে আসিত; চড়াইরা আমার ঘরের মেজের মাদুরের উপর নির্ভয়ে বিচরণ করিত; ছোট ছোট কাঠবিড়ালীরাও, চারিদিকটা এক নজরে একবার দেখিয়া লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিত, আমার সমস্ত আ বের উপর চলিয়া বেড়াইত; একদিন রাতে দেখিলান, দুইটা দাঁড়কাক আমার মশারীর কোণে বসিয়া আছে।

 আমার বাড়ীর চতুর্দিকে, ছোট ছোট নিস্তব্ধ রাস্তাগুলা (রাস্তায় নামগুলা সেকেলে পরণের) প্রখর সূর্য্যোত্তাপে যখন প্রপীড়িত হইতেছে – সেই মধ্যাহ্ন সময়ে - ওঃ! কি বিষাদময় নিস্তব্ধতা! আমার কামরার মধ্যে কিংবা কারাব চারিদিকে আধুনিক কালের কোন চিহ্রই নাই; এই সকল বিজন বারাণ্ডার কিংবা অদূরের ঐ অসীম নীল মরুক্ষেত্রের কালনির্ণ করিবার কোন নিদর্শন নাই। যাহারা শস্যের বস্তা প্রস্তুত করিতে ব্যাপৃত রহিয়াছে তাহাদের শান্তিময় ভাব-পূৰ্বকালের উপনিবেশ-জীবনের একটা দৃশ্য মনে করিয়া দেয়। তখনকার ‘কালে, এরূপ উন্মত্ত ব্যস্তভাব ছিল না, কার্যের কঠোরতা ছিল না, দ্রুতগতি বাষ্পপোত ছিল না; তখন খামখেয়ালী পালের জাহাজ, আফ্রিকা ঘুরিয়া কত বিলম্বে এখানে আসিত•••

 যাইবার সময় আমার যে কষ্ট হইয়াছিল তাহা অবশ্য গভীর নহে; কালই আমি সমস্ত কষ্ট ভুলিয়া যাইব, আমার সম্মুখে আবার কতকগুলা নূতন দৃশ্য আবিভূত হইয়া এই কষ্টের ভাবকে মন হইতে বিদূরিত করিবে। কিন্তু, পুরাতন ফ্রান্সের যে ক্ষুদ্র একটি কোণ, পথ হারাইয়া বঙ্গোপসাগরের তীরে আসিয়া পড়িয়াছে, উহা যেমন আমার মনকে আটকাইয়াছে—এই পরমাশ্চর্য ভারতে যাহা কিছু এ পর্য্যন্ত আমি দেখিয়াছি, কিংবা পরে আরও যাহা দেখিব, তাহার কিছুই এরূপ করিয়া আমাকে আটকাইতে পারে নাই কিংবা পারিবে না।