ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/হৈদরাবাদের অভিমুখে
হৈদরাবাদের অভিমুখে।
আর সে তৃণশ্যামলা ভূমি নাই; আর সে তালজাতীয় বৃক্ষাদি নাই; আর সে লাল মাটি দেখা যায় না। বেশ একটু শীত পড়িয়াছে।... পণ্ডিচেরী ও মাদ্রাজের হরিৎশ্যামল প্রদেশ ছাড়িয়া আসিবার পর,—সমস্তরাত্রি ভ্রমণ করিয়া আজ যখন প্রথম জাগ্রত হইলাম, তখন এই সমস্ত পরিবর্তন লক্ষিত হইল। সেই “চিরকেলে” কাকদিগের: কা-কা-ধ্বনি ছাড়া আর সমস্তই পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। হাজাপোড়া মাটি, ধূসরবর্ণের মাঠ, জোয়ারিশস্যের ক্ষেত, পর্যায়ক্রমে দৃষ্টিগোচর হইতেছে। নারিকেলের পরিবর্তে শুধু কতকগুলা বিরল মুসব্বরতরু, শীর্ণকায় তাপশুষ্ক খর্জ রবৃক্ষগ্রামপল্লির চতুর্দিকে লক্ষিত হইতেছে। মনে হয়, এখানকার গ্রামগুলিও যেন একটা কৃত্রিম আর্বী-ভাব ধারণ করিয়াছে। অগ্নিস্ফূলিঙ্গবর্ষী মরুভূমির সহিত,বিষাদময় প্রদেশসমূহের সহিত যে ইস্লামজাতির চিরসম্বন্ধ, সেই ইস্লামজাতি এখানে আসিয়া যেন তাহাদের জাতীয়ভাবটি মুদ্রিত করিয়া দিয়াছে।
পরিচ্ছদেরও পরিবর্ত্তন। লোকদিগের গাত্র আর নগ্ন দেখা যায় না, পরন্তু শুভ্র পরিচ্ছদে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত। আর সে দীর্ঘলম্বিত কেশগুচ্ছ দেখা যায় না, পরন্তু মস্তক উষ্ণীষের দ্বারা আচ্ছাদিত।
মাঠময়দানের উপর দিয়া যতই অগ্রসর হওয়া যায়, ততই দেখা যায়, ঘণ্টায়-ঘণ্টায় যেন শুষ্কতার বৃদ্ধি হইতেছে। যে-সব ধান্যক্ষেত্রের উপর হলকর্ষণের রেখাচিহ্ন বিদ্যমান, সেই ক্ষেতগুলি যেন আগুনে জ্বলিয়া-পুড়িয়া গিয়াছে। জোয়ারি-ক্ষেতগুলি অপেক্ষাকৃত তাপসহ হইলেও, তাহার অধিকাংশই “হলদে-মারিয়া” গিয়াছে। যে-সব ক্ষেত এখনো টিকিয়া আছে, সেই সব ক্ষেতের স্বল্পাবশিষ্ট শস্য পাছে পাখী ও ইদুরে খাইয়া ফেলে, সেইজন্য কৃষকেরা মাচার উপর বসিয়া পাহারা দিতেছে। হায় হায়! বেচারা মানুষ, দুর্ভিক্ষপীড়িত হইয়া, ক্ষুধাক্লিষ্ট দুঃসাহসী পশুর গ্রাস হইতে দুইচারিমুঠা শস্য বাঁচাইবার জন্য প্রাণপণে যুঝাবুঝি করিতেছে।
শীতরাত্রির অবসানে সূর্য্যদেব চুল্লিসুলভ প্রখর তাপ ভূমির উপর নির্দ্দয়ভাবে ঢালিয়া দিলেন। আকাশ স্বচ্ছ নীলবর্ণ ধারণ করিয়া একটা বিশাল নীলকান্তমণির ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল।
দিবাবসানে, এখানকার ভূভাগ, এক অপূর্ব্বভাব ধারণ করিল। অফুরন্ত তাপদগ্ধ জোয়ারি-ক্ষেতের উপরে, তাপদগ্ধ জঙ্গলের মধ্যে, প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড শ্যামল পাষাণস্তূপ;—বিচিত্র আকারের, মসৃণগাত্র, অসংলগ্ন বড়-বড় গণ্ডশৈল। মনে হয়—যতপ্রকার অদ্ভুত ভঙ্গীতে,—অদৃঢ়ভাবে কোন-এক পদার্থকে বসান যাইতে পারে, সেইরূপ উহাদিগকে বসানো হইয়াছে। কোনোটা একেবারে খাড়া হইয়া আছে; কোনোটা ঝুকিয়া আছে; এবং এই বিচিত্র-আকারের প্রস্তরগুলি এরূপভাবে পুঞ্জীভূত যে, উহাতে কতকটা পর্ব্বতের সাদৃশ্য উপলব্ধি হয়। আবার উহাদের মধ্যে কতকগুলি বাস্তবিকই পর্ব্বতের ন্যায় উচ্চ।
অবশেষে, সূর্য্যাস্তসময়ে হৈদরাবাদ দৃষ্টিগোচর হইল। শাদা ধূলায় আচ্ছন্ন—সব শাদা। সেই মুসলমানী-ধরণের বারণ্ডাওয়ালা ছাদ; সেই লঘুগঠনের ধ্বজচূড়াসমূহ (Minaret)। চতুর্দ্দিকস্থ তরুপল্লব শুষ্ক ও মুমূর্ষু। মনে হয় যেন ঋতুনিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়াছে;—গ্রীষ্মসায়াহ্নে যেন বিষণ্ণ শরতের আবির্ভাব। নগরের পাদদেশ দিয়া যে নদীটি বহিয়া যাইতেছে, উহার তল-পরিসর বৃহৎ মূলনদীর ন্যায়; কিন্তু উহার জল প্রায় শুকাইয়া গিয়াছে; উহার জল এত নিম্নতলে যে, প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না। হাতীরা দলে-দলে (তটভূমিরই ন্যায় ধূসরবর্ণ) ধীরপদক্ষেপে একেবারে নীচে নামিয়া যাইতেছে। নদীতে অবতরণ করিয়া উহারা জলপান করিবে—স্নান করিবে।
দিবাবসানের সঙ্গে-সঙ্গে, নগরের পশ্চাদ্ভাগে, পশ্চিমদিক্টা যেন আগুনের মত লাল হইয়া উঠিল। ভস্মাচ্ছন্ন নীলিমায় নগরের সমস্ত শুভ্রতা যেন নির্ব্বাপিত হইল। এ-হেন সুন্দর আকাশে, এই সময়ে বাদুড়েরা নিঃশব্দে সঞ্চবণ করিতেছে।