ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/রাজাদের শৈলনিবাস

রাজাদের শৈলনিবাস।

 ভারতের এই উদাস মরুদৃশ্যের উপর ভাস্বর ও বিষণ্ণ মধ্যাহ্ন ক্রমশ অগ্রসর হইতেছে। হস্তী শান্তভাবে পর্ব্বতের উপরে উঠিতেছে; অতি-মানুষপ্রমাণ একটা খোদিত ঢালু-সিড়ি দিয়া হস্তী পর্ব্বতের পার্শ্বদেশে আরোহণ করিল। এই স্থানটি ভগ্নাবশেষে সমাচ্ছন্ন; যেন ইহা দেবতাদের—মন্দিরসমূহের—প্রাসাদ-সৌধাবলীর একটা প্রকাণ্ড সমাধিক্ষেত্র।

 সহজভাবে ও মৃদুভাবে যাহাতে উপরে উঠিতে পারে, এইজন্য হাতী বাঁকা-চোরা পথদিয়া চলিতেছে। তাহার দোদুল্যমান প্রকাণ্ড দেহপিণ্ডটা আমাদিগকেও মৃদুমৃদু দুলাইতেছে। তাহার “গোদা-পায়ের” প্রতি পদক্ষেপে ধূলারাশি যেরূপভাবে নিষ্পেষিত হইতেছে, তাহাতেই তাহার প্রকাণ্ড শরীরের গুরুত্ব আমি বেশ অনুভব করিতে পারিতেছি। হাতী নিঃশব্দে চলিয়াছে; চারিদিক্‌ নিস্তব্ধ; কেবল তাহার দুই পার্শ্বে যে দুইটি রূপার ঘণ্টিকা ঝুলান রহিয়াছে, তাহা হইতে বিষণ্ণ-গম্ভীর ধ্বনি মধ্যে মধ্যে নিঃসৃত হইতেছে। কখন-কখন, উষ্ণ স্থির আকাশে উড়ন্ত পাখীর পক্ষোত্থিত শাঁই-শাঁই শব্দ শুনা যাইতেছে;—মাথার উপর দিয়া একটা শকুনি, একটা চিল চলিয়া গেল।

 পৰ্বতটা একেবারে খাড়া হইয়া উঠিয়াছে;—উহার উপরে উঠা কষ্টকর। পর্ব্বতের যে পাশে ‘খদ্‌’, তাহার উপর দিয়া দুর্গবপ্র-সমন্বিত একটা প্রাচীর প্রসারিত হইয়া ধূলিসমাচ্ছন্ন সূর্য্যরশ্মি-উদ্ভাসিত ধূসরবর্ণ দূর-দিগন্তকে বিখণ্ডিত করিয়াছে। পর্ব্বতের অপর পার্শ্বের উপর হইতে বিরাট্‌-আকৃতি পদার্থসকল দৃষ্টিগোচর হইতেছে; তিনশত ফিটেরও অধিক স্থান ব্যাপিয়া একটা গণ্ডশৈল—তাহার উপর দুর্গপ্রাসাদসমূহ অধিষ্ঠিত; সেরূপ সৌধপ্রাসাদাদি একালে নির্ম্মাণ করা দুঃসাহসের কাজ,—এক প্রকার অসাধ্য বলিলেও হয়। মাথা তুলিলেই দেখিতে পাওয়া যায়— এই সব প্রাচীনকালের প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড প্রাসাদ কতদূর পর্যন্ত চলিয়াছে, তাহার আর শেষ নাই; ইহাদের গঠনভঙ্গী আমাদের নিকট সম্পূর্ণ রূপে অপরিচিত; কত-কত শতাব্দী হইতে, এই সকল সৌধপ্রাসাদ অতলস্পর্শ খাতের ধারে অঘূর্ণিতমস্তকে অটলভাবে দণ্ডায়মান। এই নৈসর্গিক দুর্গশৈলের উপর কত-কত রাজবংশ—যাঁহাদের অস্তিত্বও এখন আমরা কল্পনা করিতে পারি না -ঐ উচ্চদেশে দুর্গম নিরাপদ আবাস স্থান নির্ম্মাণের জন্য কত সহস্র বৎসর হইতে প্রস্তরের উপর প্রস্তর রাশীকৃত করিয়াছেন। ভারতের সর্ব্বত্রই যেসব প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড ধ্বংসাবশেষ সমাকীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার নিকটে আমাদের দেশের ক্ষুদ্র ভূপতিদিগের দুর্গপ্রাসাদাদি কি হাস্যজনক!

 হাতী থপ্‌থপ্‌ করিয়া মন্থরগমনে উপরে উঠিতেছে। মধ্যে মধ্যে তাহার গাত্রবিলম্বিত ঘণ্টিকা হইতে একঘেয়ে মৃদুমধুর ধ্বনি নিঃসৃত হইতেছে। মধ্যাহ্নসূর্য্য, হাতীর তলদেশে হাতীর চলন্ত ছায়াচ্ছবি অঙ্কিত এবং মাটির উপর তাহার দোদুল্যমান শুণ্ডটি কালোরঙে চিত্রিত করিয়াছে। আদবকায়দার দস্তুর অনুসারে দুইজন লোক আমাদের আগে-আগে চলিয়াছে এবং রূপালী-মাথাওয়ালা দুইটা লম্বা ছড়ি হস্তে ধারণ করিয়া তন্দ্রাগ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায় অলসভাবে উপরে উঠিতেছে। উপরে উঠিতে উঠিতে একএকটা দ্বার আমাদের সম্মুখে আসিয়া পড়িতেছে; আমরা প্রাচ্যদেশসুলভ ঢিমা-চালে তাহার মধ্য দিয়া চলিয়াছি। দ্বারগুলা— বলা বাহুল্য—ভীষণ-দর্শন; তাহার উপরে প্রহরীদের ঘর; গোয়ালিয়ারের সৈনিকেরা পাহারা দিতেছে; কেন না, অতীত-গৌরবের নিদর্শনস্বরূপ বিপুল ভগ্নাবশেষের মধ্যে, পর্ব্বতের ঐ উচ্চচূড়ায়, তাহাদের রাজা এখন অবস্থিতি করিতেছেন। আমাদের চতুর্দ্দিকে, দূর দিগন্তের অস্পষ্ট পরিধি- মণ্ডল ক্রমশ বিস্তৃত হইতেছে। গগনবিলম্বিত একপ্রকার ভস্ম-কুয়াসার নীচে শুষ্ক তরুগণের বিচিত্রবর্ণ যেন ধূসরে বিলীন হইয়াছে।

 স্ফুলিঙ্গবৎ দীপ্যমান ধূলিকণায় পরিষিক্ত ধূসর দিগন্তদেশ ধূসর আকাশে মিলাইয়া গিয়াছে। সেই আকাশতলে বড়-বড় শিকারি-পাখী প্রাতঃকাল হইতে আবর্ত্তের ন্যায় ক্রমাগত ঘোরপাক দিয়া এক্ষণে শ্রান্ত- ক্লান্ত-অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে।

 শৈলরাশির মধ্য হইতে যেন একটা তপ্ত-নিশ্বাস উচ্ছ্বসিত হইল; আকাশে বায়ুর হিল্লোলমাত্র নাই। মধ্যাহ্নসূর্য্যের প্রচণ্ড কিরণে অভিভূত হইয়া পাখীরাও নিষ্পন্দ ও নিদ্রামগ্ন; চিল ও শকুনিরা পাখা গুটাইয়া স্থিরভাবে বসিয়া আছে এবং আমাদিগকে নিরীক্ষণ করিতেছে। গণ্ডোলা-নৌকার অবিশ্রান্ত দোলনের ন্যায় হাতীর চলন-ভঙ্গীতে আমাদের মন ক্রমশ অসাড় হইয়া পড়িতেছে; সূর্য্যের দুর্নিরীক্ষ্য আলোকে প্রতিহত হইয়া চক্ষু নিমীলিত হইতেছে; তাহার পরেই, এই সব ধূসর পদার্থরাশির মধ্যে,—বর্ষণহীন বহুবর্ষের ধূলায় লোহিতীকৃত এই সব প্রস্তররাশির মধ্যে,—সম্মুখের ভূমি ছাড়া, কাছের জিনিষ ছাড়া আমি আর কিছুই দেখিতে পাইতেছি না। প্রথমে চোখে পড়িল একটা জরির পাগ্ড়ি‌, একটা শ্যামল-রঙের ঘাড়, শাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত একটা স্কন্ধ, একটা ছোট তীক্ষ্ণ বল্লম; হিন্দু মাহুত হাতীর স্কন্ধের উপর বুদ্ধের ন্যায় উপবিষ্ট; তাহার হাতে অঙ্কুশ। তাহার পর, হাতীর মাথায় জড়ান এক-টুকরা লাল কাপড়, কালো-ডোরা-কাটা গোলাপী-রঙের বৃহৎ কর্ণযুগল; মাছি ও ডাঁশ তাড়াইবার জন্য হাতী তাহার কানদুটা হাতপাখার মত ক্রমাগত নাড়িতেছে।

 গুরুপদভরে পথ দলিত করিয়া, শান্ত-শিষ্ট বশ্য অক্লান্ত হস্তী পর্ব্বতের উপরে উঠিতেছে। তাহার পার্শ্বদেশে একটা গোলাকার গণ্ডশৈল, দেখিতে তাহারি মত; না জানি, তিমিরাবৃত কোন্ দূর অতীতের মনুষ্যগণকর্ত্তৃক কতকটা হস্তিদেহের অনুকরণে এই গণ্ডশৈলটি খোদিত হইয়াছিল; উহাতে হস্তীর শুণ্ড, দীর্ঘদন্ত-সমন্বিত মস্তক, হস্তীর পশ্চাদ্ভাগ অস্পষ্টরূপে উৎকীর্ণ রহিয়াছে। তা ছাড়া, বিলুপ্তভাষায় লিখিত কতকগুলা উৎকীর্ণ- লিপি এবং পর্ব্বতের গায়ে খোদিত কুলুঙ্গির মধ্যে বহুসংখ্যক খোদিত দেব- দেবীর প্রতিমাও রহিয়াছে। যাহারা এই ভীষণ স্থানের প্রথম অধিবাসী, সেই পাল-রাজাদিগের ও জৈনদিগেরই এই সমস্ত কীর্ত্তি।

 নীচে,—জ্বলন্ত উত্তাপময় প্রসারিত ক্ষেত্রের মধ্যে ভাসমান একপ্রকার ভস্মময় বাষ্পের তলদেশে, প্রাচীন গোয়ালিয়ারের ভগ্নাবশেষসমূহ একটু-একটু দেখা দিতে আরম্ভ করিয়াছে; তা ছাড়া, নূতন গোয়ালিয়ার—সব শাদা—যাহাকে দেশীয় লোকেরা অবজ্ঞাসহকারে “লখ্‌খর” (সৈন্য-ছাউনী) বলে—তাহারও পাথরের বড়-বড় সৌধচূড়া, ও মন্দিরচূড়াদি অল্প-অল্প দৃষ্টিগোচর হইতেছে। এখন মধ্যাহ্ন। আমাদের মাথার উপর প্রচণ্ড মার্ত্তণ্ড অনলকণা বর্ষণ করিতেছেন; পাথরগুলা এরূপ তাতিয়া উঠিয়াছে, মনে হয় যেন অগ্নিকুণ্ড হইতে আগুনের কিরণ নিঃসৃত হইতেছে। নিস্তব্ধতা ও উত্তাপে বিহ্বল হইয়া চিল, শকুনি ও কাকের নিদ্রা যাইতেছে।

 ক্রমাগত উপরে উঠিয়া অবশেষে ভীষণদর্শন প্রাসাদসমূহের পাদমূলে আসিয়া উপনীত হইলাম। এই প্রাসাদগুলা একেবারে “খদের” ধারে অধিষ্ঠিত এবং উহাদের দ্বারা পর্ব্বতচূড়ার উচ্চতা যেন আরো বর্দ্ধিত হইয়াছে। ছোট-ছোট-চূড়াসমন্বিত প্রাসাদের মুখভাগটি অতুলনীয়। সমানভাবে বসান প্রস্তরপিণ্ড উপর্য্যুপরি বিন্যস্ত হইয়া বরাবর প্রসারিত এবং বিবিধ-জীবজন্তু-ও-মনুষ্য-আকৃতির অনুকরণে রচিত নীল, সবুজ সোণালি রঙের প্রভূত খচিত-কাজে অলঙ্কৃত। এই সকল উত্তঙ্গ দুর্গম প্রাসাদে গোয়ালিয়ারের ভূতপূর্ব্ব প্রবলপ্রতাপ ভূপতিগণ যোড়শশতাব্দী পর্য্যন্ত বাস করিয়াছেন।

 শেষের একটা প্রকাণ্ড দ্বার—নীলরঙের মিনা-র কাজে আচ্ছাদিত। এখনও মহারাজের সিপাহিরা এখানে পাহারা দেয়; এই দ্বার দিয়া একটা চূড়ার উপরিস্থ ময়দানে উপনীত হইলাম। এই ময়দানটি প্রায় দেড়মাইল দীর্ঘ; উহার সমস্তটাই দুর্গবপ্রে পরিবেষ্টিত। সমস্ত পশ্চিমভারতের মধ্যে ইহা সর্ব্বাপেক্ষা অনধিগম্য বলিয়া প্রসিদ্ধ। ঐতিহাসিক যুগ হইতে যোদ্ধৃ রাজামাত্রেই এই স্থানটিকে আকাঙ্ক্ষার সামগ্রী বলিয়া মনে করিয়া আসিয়াছেন—এই স্থানটি কত লোমহর্ষণ যুদ্ধবিগ্রহ দেখিয়াছে,যাহার বর্ণনায় রাশিরাশি গ্রন্থ পূর্ণ হইতে পারে। এই উত্তুঙ্গ বিজনভূমি,—সৌধ প্রাসাদে, সমাধিমন্দিরে, দেবালয়ে, সকল সভ্যতাস্তরের— সকল যুগের পুত্তলিকাসমূহে সমাচ্ছন্ন। য়ুরোপের এমন কোন স্থান নাই, যাহার সহিত ইহার তুলনা হইতে পারে; বিলুপ্ত পুরাতন বৈভবাদির শোকোদ্দীপক ‘জাদুঘর’ ইহার মত আর নাই।

 মিনা-র কাজকরা প্রথম প্রাসাদের সম্মুখে হাতী হাঁটু গাড়িয়া বসিল; আমরা নামিয়া প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। এই প্রাসাদটি ততটা ঘোরতর “সেকেলে” ধরণের নহে—এবং ততটা ভগ্নদশাপন্নও নহে।

 ইহা হদ্দ পাঁচশত বৎসরের; কিন্তু ইহার বিরাট্‌ পত্তনভিত্তি সেই সব পালরাজাদের আমলের—যাঁহারা তৃতীয় শতাব্দী হইতে দশম শতাব্দী পর্যন্ত গোয়ালিয়ারে রাজত্ব করিয়াছিলেন। বড় বড় পাথরের মঞ্চের উপর কতকগুলা ঘোরদর্শন নীচু দালান সংস্থাপিত। ধ্বংসাবশেষের নিস্তব্ধতা, হঠাৎ অৰ্দ্ধচ্ছায়ান্ধকার এবং আমরা যে জলন্ত বহির্দ্দেশ হইতে আসিতেছি আমাদের নিকট হঠাৎ একটু শৈত্যের আবির্ভাব হইল। আগেকার বিলাস- বৈভবের মধ্যে, এখন কেবল রাশিরাশি খোদাই-কাজ এবং দেয়ালে চমৎকাব মিনা-র কাজ অবশিষ্ট রহিয়াছে; এই সমস্ত ডানাওয়ালা পশু, অদ্ভুত বিহঙ্গ, সবুজ ও-নীল পক্ষবিশিষ্ট ময়ূর প্রভৃতির প্রতিকৃতি। ময়ূরের পাখায় যেরূপ দুরপনেয় উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা দেখা যায়—সে বর্ণবিন্যাসের গুহ্যকলা এখন বিলুপ্ত হইয়াছে। দেয়ালের গাঁথুনির মধ্যে, ছোট-ছোট- ছিদ্র-করা একএকটা প্রস্তরফলক বসানো রহিয়াছে—বহির্জগতের দৃশ্য তাহার মধ্য হইতেই যাহা-কিছু দেখা যায়। এইরূপ গবাক্ষের নিকটে বসিয়াই তখনকার বন্দীকৃত সুন্দরীরা আপন-আপন কল্পনায় বিভোর হইত এবং রাজারা -আকাশের মেঘ, দূর দিগন্তদেশ, সৈন্যবাহিনী ও যুদ্ধাদি নিরীক্ষণ করিতেন।

 “খদ”প্রান্তবর্ত্তী প্রাসাদসমূহের সমস্ত মুখভাগ—যাহা উচ্চতায় প্রায় একশত ফিট্‌ ও দৈর্ঘ্যে প্রায় তিনশত ফিট্‌-সুরঙ্গগৃহের মত অষ্টে-পৃষ্ঠে বদ্ধ সমস্ত দালান, সমস্ত কক্ষ,—শুধু এই সকল সচ্ছিদ্র প্রস্তরফলকের মধ্য দিয়াই বায়ুগ্রহণ করে; কি পলায়ন, কি আত্মহত্যা, কি প্রেমের ব্যাপার, কোন কারণেই এই সকল প্রস্তরফলক খুলিতে পারা যায় না। আমাদের কারাগারের লৌহগরাদে অপেক্ষাও ইহা দারুণ কঠোর। সানের নীচে সর্ব্বত্রই,—সুরঙ্গপথে নামিবার জন্য গুপ্তসোপান, সুরঙ্গ ও সুরঙ্গকারাগার। না জানি, কত গভীর পর্য্যন্ত পর্ব্বতগর্ভ কাটিয়া এই সকল অন্ধকূপ—এই সকল সুরঙ্গ প্রস্তুত হইয়াছিল।

 এই প্রাসাদের পাশাপাশি আরও কতকগুলি প্রাসাদ সারিসারি চলিয়াছে; এগুলি পর-পর অধিকতর বর্ব্বর-ধরণের। উহার মধ্যে একটি পালরাজাদিগের আমলের—আরও বেশী গুরুভার প্রস্তরপিণ্ডে গঠিত। আর একটি জৈনদিগের আমলের;—বিশেষ কোন গঠন নাই বলিলেও হয়;—পৰ্বতগাত্রের সহিত যেন মিশিয়া গিয়াছে; গুপ্তভাবে বন্দুক ছুড়িবার দুর্গরন্ধ্রের ন্যায়, ত্রিকোণাকৃতি শুধু কতকগুলা ছোট-ছোট গবাক্ষচ্ছিদ্র প্রাসাদগাত্রে পরিলক্ষিত হয়।

 তা ছাড়া, এখানকার গড়বন্দী ময়দানটা বিভিন্ন-ধরণের দেবালয়ে সমাচ্ছন্ন; উহাদের এই বিচিত্রতার মধ্যে হিন্দুধর্ম্মের সকল বিভাগেরই নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায়। এইখানে গর্ত্ত খুড়িয়া কতকগুলা চৌবাচ্ছা প্রস্তুত হইয়াছে; এই চৌবাচ্ছাগুলা এত বড় যে, শত্রুকর্ত্তৃক দুর্গ অবরুদ্ধ হইলে হাজার-হাজার লোককে অনেকদিন পর্য্যন্ত পানীয়জল জোগাইতে পারা যায়। সমস্ত স্থানটাই দেবপ্রতিমায় ও সমাধিমন্দিরে আচ্ছন্ন।

 একটা জৈনমন্দিরে গিয়া একটু দাঁড়াইলাম; পূর্ব্বে মোগলসৈন্য আসিয়া অত্রত্য প্রতিমাদিগকে বিকলাঙ্গ করে। আমাদের প্রাচীনকালের খৃষ্টধর্ম্মের কীর্ত্তিচিহ্নগুলার সহিত তুলনা করিবার জন্যই এইখানে একটু দাড়াইলাম।••• আমাদের খুব সুন্দর গির্জাগুলিও ছোট-ছোট অ-সমান প্রস্তরে গঠিত এবং আটা দিয়া জোড়া। কিন্তু এখানে, বড়-বড় পাষাণপিণ্ড—সব বাছা-বাছা ও সব সমান—এরূপভাবে পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট এবং ঘড়ির কল্‌-কব্জার মত এরূপ যথাস্থানে স্থাপিত যে, মনে হয় যেন এই প্রস্তরসমষ্টি একখণ্ড প্রস্তরের মত অনাদিকাল হইতে একইভাবে রহিয়াছে।•••

 এক্ষণে, আমার ভারতবাসী লোকদিগের সহিত আবার আমি সেই মন্থরগামী দোদুল্যমান হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলাম; আবার হস্তিপার্শ্ববিলম্বিত ঘণ্টিকা হইতে মধুর নিক্কণ নিঃসৃত হইতে লাগিল; আবার সেইরূপ পর্ব্বতের অপর পার্শ্বের ঢালু দিয়া আমরা শান্তভাবে নামিতে লাগিলাম এবং ক্রমশ একটা লালপাথরের গুহার মধ্যে প্রবেশ করিলাম;—হঠাৎ আমাদের মাথার উপর একটা ছায়া আসিয়া পড়িল। কতকগুলা ঘোড়সোয়ার আমাদের সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল; হাতী দেখিয়া তাহাদের ঘোড়া ভড়্‌কাইয়া লাফালাফি করিতে লাগিল; একটা উট হঠাৎ মাথাঝাঁকানি দেওয়ায় উটের সোয়ার উষ্ট্রপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে পতিত হইল। এই হাতীর দেশে এমন কোন জীবজন্তু নাই যে, হাতীর পাশ দিয়া গেলে ভয় না পায়।

 যে গুহাপথ দিয়া আমরা নামিতেছি, এই পথটি বড়-বড় প্রস্তরপ্রতিমায় সমাচ্ছন্ন। এই গুহাটি তীর্থঙ্কারদিগের প্রকাণ্ড প্রতিমাসমূহের নিবাসভূমি;—এই সমস্ত মূর্ত্তি পর্ব্বতগাত্র হইতে খুদিয়া বাহির করা হইয়াছে; কুলুঙ্গির মধ্যে, গুহার মধ্যে, কোন মূর্ত্তি উপবিষ্ট, কোনটি বা দণ্ডায়মান। বিশ-ফিট্‌ উচ্চ, সম্পূর্ণরূপে নগ্ন; সে নগ্নতায় কোন খুঁটিনাটিই বাদ যায় নাই—এমন কি, অশ্লীলতার মাত্রায় উপনীত হইয়াছে। উপত্যকার এক পার্শ্ব হইতে অপর পার্শ্ব পর্য্যন্ত এই সকল মূর্ত্তি অধিষ্ঠিত;—আমরা তাহার মধ্য দিয়া চলিয়াছি।

 ঘোড়শ শতাব্দীতে, প্রতিমাধ্বংসী মোগলসৈন্য এই পথ দিয়া—এই সকল মূর্ত্তির মধ্য দিয়া যাত্রা করিবার সময়, কাহারও মস্তক, কাহারও পুরুষাঙ্গ, কাহারও হস্ত ভাঙ্গিয়া ফেলে। এইরূপে সকল মূর্ত্তিগুলিই ছিন্নাঙ্গ হইয়া রহিয়াছে।  ঐ অদূরে—যে তপ্তধূলার কুজ্ঝটিকায় সমস্ত দেশ আচ্ছন্ন—সেই কুজ্ঝটিকার মধ্য দিয়া আবার যেন এইরূপ কতকগুলি মূর্ত্তি দেখিতে পাইলাম।•••অন্যান্য উপত্যকা—অন্যান্য গণ্ডশৈল আমাদের নেত্রসমক্ষে ক্রমশ উদ্ঘাটিত হইল। সেখানেও এই সকল মূর্ত্তি সারিসারি চলিয়াছে, ইহাদের আর শেষ নাই। সমস্ত আকাশে যেন একপ্রকার ভস্মরাশি বিলম্বিত এবং সূর্য্যের জ্বলন্ত কিরণ সর্বত্রই দীপ্যমান। এই উত্তাপ ও মধুরনাদী ঘণ্টিকার প্রশান্ত নিক্কণ আমার নিদ্রাকর্ষণ করিতেছে; যতই আমরা নীচে নামিতেছি, ততই যেন সমস্তের উপর একটা আবরণ পড়িয়া যাইতেছে; এইরূপ আধ-ঘুমন্ত অবস্থায় আমরা দুলিতে-দুলিতে চলিয়াছি; এই বিরাট্‌ মূর্ত্তিগুলার রূপ একটু-একটু করিয়া অস্পষ্ট হইতে লাগিল;— ক্রমে মন হইতে একেবারেই তিরোহিত হইল।