ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/মাদ্রাজে থিওসফিষ্টদের গৃহে
মাদ্রাজে থিওসফিষ্টদের গৃহে।
“স্বর্গ বিনা ঈশ্বর, আত্মা বিনা অমরত্ব, প্রার্থনা বিনা চিত্তশুদ্ধি”...
আমাদের কথাবর্তা যখন থামিয়া গেল, চরম সিদ্ধান্তের আকারে পরিব্যক্ত উপরি-উক্ত বীজমন্ত্রটি, ঘোর নিস্তব্ধতার মধ্যে, বিষাদগম্ভীরস্বরে আমার কর্ণে যেন ক্রমাগত ধ্বনিত হইতে লাগিল।
গৃহটি নির্জ্জন;—ময়দানের উপর, নদীর ধারে, তালীবন ও অপরিচিত একপ্রকার বৃহৎ-জাতীয় পুষ্পরাশির মধ্যে অবস্থিত, এবং সন্ধ্যার বিষাদ-ছায়ায় আচ্ছন্ন। তখন আমরা গৃহের পুস্তকাগারে ছিলাম। জান্লা-শাশির মধ্য দিয়া ঘরটিতে এখনো বেশ আলো আসিতেছিল; অল্পে-অল্পে আলো কমিয়া আসিল; শাশির রঙিন কাচখণ্ডের উপর যে সব স্বচ্ছপ্রভ ক্ষুদ্র চিত্র ছিল, তাহা ক্রমশ বিলীন হইয়া গেল;—সমস্ত মানবীয় ধর্মমতের বাহ্যচিহ্নের এই চিত্রগুলি যেন একটা জাদুঘরে একত্র সংরক্ষিত হইয়াছে;—খৃষ্টের ক্রুস, সলোমনের মোহর, জিহোবার ত্রিকোণ, শাক্যমুনির পদ্ম, মহাদেবের ত্রিশূল, মিশরদেশীয় আইসিস্দেবের চিহ্নাবলী। ইহা মাদ্রাজস্থ থিওসফিষ্টদিগের গৃহ। আমি থিওসফিষ্টদিগের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য্য কথা শুনিয়াছিলাম। যদিও আমি সে-সব কথায় বিশ্বাস করি নাই, তবু মনে করিলাম,—দেখি না কেন, উহাদের নিকটে যদি কোন আশার কথা শুনিতে পাই। এই আমার শেষ চেষ্টা। কিন্তু উঁহারা আমাকে কি দিতে চাহিলেন, শোনোঃ—বৌদ্ধধর্ম্মের সেই সুবিদিত হৃদয়হীন উদাসীনভাবের কথা,—“আমার নিজের জ্ঞানলোক!”
—“প্রার্থনা?” তাহারা বলিলেন—“প্রার্থনা শুনিবে কে?…মানুষের দায়িত্ব মানুষের নিজের কাজেই। মনুবচন স্মরণ করিয়া দেখ,—‘মনুষ্য একাই জন্মগ্রহণ করে, একাই জীবিত থাকে, একাই মৃত হয়, কেবল ধর্ম্মই তাহার অনুগমন করে’...তবে প্রার্থনা শুনিবে কে? কাহার নিকট প্রার্থনা করিবে, তুমি যখন নিজেই ঈশ্বর? তোমার আপনার নিকটেই প্রার্থনা করিতে হইবে—তোমার নিজ কর্ম্মের দ্বারা।”
আমাদের মধ্যে একটা গভীর নিস্তব্ধতা আসিয়া পড়িল; এরূপ বিষাদময় নিস্তব্ধতা আমার জীবনে কখন দেখি নাই। সব নিস্তব্ধ—কেবল শূন্য আকাশে এক একটি করিয়া পাতা ঝরিয়া পড়িতেছে, তাহারই অস্পষ্ট মৃদু শব্দ শুনা যাইতেছে; মনে হইল,—যাঁহাদের সহিত আমার কথাবার্ত্তা হইতেছিল, তাঁহাদের নিশ্বাসবায়ুতে আমার মনের মধুর ও অস্পষ্ট বিশ্বাসগুলি যেন একে-একে ঝরিয়া পড়িতেছে। কিন্তু তাঁহারা স্বকীয় যুক্তিবিচারে অটল,—স্বকীয় সিদ্ধান্তে বেশ সন্তুষ্ট।
যে দুইটি লোকের সহিত আমার কথা হইতেছিল, দুজনেই বেশ এদিকে আতিথেয়, সহৃদয় ও আদর-অভ্যর্থনায় সুপটু। প্রথমটি য়ুরোপীয়,—আমাদিগের নানাপ্রকার আন্দোলন ও অনিশ্চিততায় শ্রান্তক্লান্ত হইয়া ইনি বুদ্ধপ্রবর্ত্তিত সন্ন্যাস অবলম্বন করেন, এবং এক্ষণে থিওসফিষ্টসভার সভাপতি হইয়াছেন; অন্যটি একজন হিন্দু;—আমাদের য়ুরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ উপাধি অর্জ্জন করিয়া ভারতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছেন এবং এক্ষণে ইনি আমাদের পাশ্চাত্যদর্শনাদি কতকটা অবজ্ঞার চক্ষে দেখিয়া থাকেন।
আমি উত্তর করিলাম,—“তুমি বলিতেছ, আমাদের অন্তরস্থ কোনএক পদার্থ,—আমাদের ক্ষণস্থায়ী ব্যক্তিত্বের একটু অংশ,—কিয়ৎকালের জন্য মৃত্যুর আঘাতকে প্রতিরোধ করে, তাহার অকাট্য প্রমাণ তোমরা পাইয়াছ। অন্তত এই অকাট্য প্রমাণটি কি, তুমি আমাকে দেখাইতে পার?”...
তিনি বলিলেন,—“যুক্তির দ্বারা আমরা তাহা সপ্রমাণ করিব; কিন্তু চাক্ষুষ প্রমাণ যদি চাহ, তাহা আমরা দিতে পারিব না...যাহাদিগকে লোকে অযথারূপে মৃত বলে—(কেন না, আসলে কেহই মরে না) সেই মৃত ব্যক্তিকে দেখিবার জন্য বিশেষ ইন্দ্রিয় আবশ্যক, বিশেষ অবস্থা ও বিশেষ মানসিক প্রকৃতি আবশ্যক। কিন্তু আমাদের কথায় তুমি বিশ্বাসস্থাপন করিতে পার; আমরা দেখিয়াছি এবং আমাদের ন্যায় বিশ্বাসযোগ্য আরো অন্য লোকে মৃতব্যক্তিদিগের অপচ্ছায়া দেখিয়াছে এবং তাহার সমস্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছে। দেখ, এই পুস্তকাগারের এই সকল পুস্তকে ঐ সমস্ত বিবরণ পাওয়া যায়—কাল যখন তুমি আসিয়া আমাদিগের সঙ্গে বাস করিবে, তখন এই সকল পুস্তক পাঠ করিও।”...
আমি তবে কেন এত কষ্ট করিয়া ভারতে আসিলাম,—যে ভারত সমস্ত মানবীয় ধর্ম্মমতের পুরাতন আদিমনিবাস—যদি এই পুস্তকাগারের পুস্তকেই সমস্ত কথা জানা যাইতে পারে; মন্দির সমূহের মধ্যে,—ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম পৌত্তলিকতার অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন; আর এখানে,—শাক্যমুনিকৃত এক প্রকার প্রত্যক্ষবাদের (Positivism) নব-সংস্করণ এবং সমস্ত পৃথিবী হইতে সংগৃহীত প্রেতবাদের কতকগুলা গ্রন্থ দেখা যাইতেছে।… আরো খানিকটা নিস্তব্ধতার পর, আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—মনে-মনে বুঝিতেছি, এবার আমি ছেলেমান্ষি-কৌতুহলের নিম্নভূমিতে নামিয়া আসিতেছি—তাই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম;—“আপনারা কি সাধু সন্ন্যাসীদিগের সন্ধান আমাকে বলিতে পারেন,—ভারতের সেই-সব সাধুসন্ন্যাসী, যাঁহারা সিদ্ধপুরুষ বলিয়া প্রখ্যাত, যাঁহারা নানাপ্রকার অদ্ভুতকার্য্য এমন কি, অলৌকিক কার্য্য সাধন করিতে পারেন; অন্তত তাহা হইলে ইহা সপ্রমাণ হইতে পারে যে, এখানে এমন কিছু আছে, যাহা আমাদের বুদ্ধির অতীত—যাহা অতিভৌতিক, যাহা অতিমানুষিক।”
আমার সম্মুখে যে হিন্দুটি বসিয়াছিলেন, তিনি তাঁহার তাপসসুলভ নেত্রদ্বয় ঊর্দ্ধে তুলিলেন; একটা মুখভঙ্গীর দ্বারা তাঁহার সূক্ষ্ম ও কঠোর মুখমণ্ডল সঙ্কুচিত হইল; তাঁহার মুখটি যেন শাদা পাগ্ড়ি দিয়া ঘেরা ‘দান্তে’র (Dante) মুখস্।
—‘‘সাধু-সন্ন্যাসী?—সাধু-সন্ন্যাসী? সাধু-সন্ন্যাসী এখন আর নাই”—তিনি উত্তর করিলেন।
এই বিষয়ে যাঁহার বিশেষ জ্ঞান আছে, তাঁহারই মুখে যখন শুনিলাম, সেরূপ সাধু-সন্ন্যাসী এখন আর নাই,—তখন এই পৃথিবীতেই যে অলৌকিক কাণ্ড দেখিব বলিয়া আশা করিয়াছিলাম, সে আশা আর রহিল না।
—“বারাণসীতেও নাই?”—আমি এই কথা ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম। আমি আশা করিয়াছিলাম বারাণসীতে...আমি শুনিয়াছিলাম...
আমি “বারাণসী” এই নামটি উচ্চারণ করিতে ইতস্তত করিতেছিলাম; কেন না, ঐটি আমার ‘হাতের রেস্তোর’ শেষ তাস; যদি সেখানে গিয়াও কিছু দেখিতে না পাই।...
—“শোনো বলি। ভিক্ষু-সন্ন্যাসী, চেতনাহীন সন্ন্যাসী, হঠযোগসিদ্ধ অঙ্গবিক্ষেপকারী সন্ন্যাসী এখনো অনেক রহিয়াছে; তাহাদিগকে দেখিবার জন্য আমাদের সাহায্য তোমার প্রয়োজন হইবে না। কিন্তু যাঁহারা প্রকৃত সিদ্ধপুরুষ, যাঁহারা অষ্টসিদ্ধি লাভ করিয়াছেস, সেইরূপ কতকগুলি সন্ন্যাসীকে আমরা জানি। এ বিষয়েও আমাদের কথার উপরেই তোমার বিশ্বাসস্থাপন করিতে হইবে। সেরূপ সন্ন্যাসী এক সময়ে ভারতে ছিলেন, কিন্তু এই শতাব্দীর অবসানের সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁহারা তিরোহিত হইয়াছেন। ভারতের সেই পুরাতন যোগিভাব আর নাই। জড়বিজ্ঞানবাদী রাজসিক পাশ্চাত্য জাতির সংসর্গে আমাদের অবনতি হইয়াছে; পাশ্চাত্য লোকেরাও আবার এক সময়ে অবনতি প্রাপ্ত হইবে; এই অবনতির হস্তে আমরা নিশ্চিন্তভাবে আত্মসমর্পণ করিয়া দিয়াছি; কেন না, ইহাই জগতের অবশ্যম্ভাবী নিয়ম।… হাঁ, আমাদের দেশে সিদ্ধপুরুষ যোগিসন্ন্যাসী এক সময়ে ছিলেন; এই দেখ না, আল্মারির এই তক্তাটি শুধু তাঁহাদের বিবরণঘটিত হস্তলিপি পুথির জন্য সংরক্ষিত।”...
জান্লা-শাশির উপর চিত্রিত মানবীয় সমস্ত ধর্ম্মসম্প্রদায়ের বিশেষ চিহ্নগুলি অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, এই কঠোর পুস্তকাগারে একেই ত একটু বিষাদময় অন্ধকার ছিল, তাতে আবার রাত্রি হওয়ায়, আরো ঘোর অন্ধকারে ইহা আচ্ছন্ন হইল। থিওসফিষ্টদিগের সহিত দীর্ঘকাল বাস করিব মনে করিয়া আমি মাদ্রাজে আসিয়াছিলাম; কল্য হইতে তাঁহাদের গৃহে আমার থাকিবার কথা; কিন্তু আজ সায়াহ্নে আমি মাদ্রাজ ছাড়িয়া চলিয়া যাইব স্থির করিয়াছি, আর ফিরিয়া আসিব না। এই নাস্তিত্ব ও শূন্যবাদের কঠোর আশ্রমে বদ্ধ হইয়া থাকিব কিসের জন্য? বরং যেরূপ চিরজীবন করিয়া আসিয়াছি, এই পৃথিবীর বিচিত্র পদার্থ দেখিয়া আমার নেত্রবিনোদন করিব; এই পদার্থগুলি ক্ষণস্থায়ী হইলেও, অন্তত এক মুহূর্ত্তের জন্যও বাস্তব। তা ছাড়া, অমরত্বসম্বন্ধে তাঁহাদের যেরূপ ধারণা, সেরূপ অমরত্বের প্রমাণ পাইলেই বা কি যায়-আসে? একবার যাহারা বাস্তবিক ভালবাসিয়াছে, দেহের বিনাশ কল্পনা করাও তাহাদের পক্ষে বিষম যন্ত্রণা। যে অমরত্বে তাহারা সন্তুষ্ট, আমাদের মত লোক সেরূপ অমরত্ব লইয়া কি করিবে? খৃষ্টানদিগের যাহা ধ্যানের বিষয়, আমি সেইরূপ অমরত্ব চাই;—আমি চাই আমার আমিত্ব, আমার নিজত্ব, আমার বিশেষত্বটুকু বরাবর থাকিয়া যাইবে; আমি যাহাদের ভালবাসিতাম, তাহাদিগকে আবার আমি দেখিতে পাইব—পূর্ব্বের মতই তাহাদিগকে ভালবাসিব, তাহা না হইলে আর কি হইল?
আমি যখন আবার নগরের পথ ধরিয়া চলিতে লাগিলাম, তখন কাকেরা মহা-কোলাহল আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। সকলে মিলিয়া মৃত্যুর গান গাহিতেছে; এই সময়ে নিদ্রা যাইবার জন্য তাহারা দলে-দলে বৃক্ষশাখায় বসিয়া গিয়াছে। বরাবর সমস্ত পথটায়, বট ও তালবৃক্ষের তলদেশে, গজমুণ্ডধারী গণেশের ছোট-ছোট মূর্ত্তি সন্ধ্যালোকে দেখা যাইতেছে। যে সকল লোকের নিকট হইতে আমি চলিয়া আসিলাম, তাহাদের মতবাদটি এই সকল বিগ্রহেরই ন্যায় নিতান্ত শিশুজনোচিত ও অকিঞ্চিৎকর।
সন্ধ্যার সময়, ঐ সকল থিওসফিষ্টদিগের নিকট আমার অসম্মতিসূচক পত্র পাঠাইলাম। তাঁহাদিগকে ধন্যবাদ জানাইলাম, আর বলিলাম, “আমি যত শীঘ্র পারি, মাদ্রাজ ছাড়িব বলিয়া স্থির করিয়াছি; তাই শেষবিদায় লইবার জন্য কাল আমি তাঁহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিব।”
যাহাদিগকে আমি খুব ভালবাসিতাম, রাত্রির স্বপ্নে আমার সেই সব মৃত প্রিয়জনদিগকে আমি পুনর্ব্বার দর্শন করিলাম; আমার শৈশবের সেই পুরাতন বিকৃতভাবাপন্ন অশুভদর্শন বাসভবনের মধ্যে সেই পাণ্ডুবর্ণ গলিত মূর্ত্তিগুলি দেখিলাম। আর এক রাত্রি,—যেরূপ জেরুস্যালেমে আমার ঘটিয়াছিল—যে সময়ে আমার প্রথমকালের বিশ্বাসগুলি চিরকালের মত ভাঙিয়া যায়—সেই রাত্রির মত আজও সমস্ত রাত্রি অশেষপ্রকার বিষাদের চিন্তা, দুর্নিবার ভয়ের চিন্তা, একটার পর একটা, মনোমধ্যে ক্রমাগত উদয় হইতে লাগিল; তাহার পর যেই প্রভাত হইল, অম্নি একটা দাঁড়কাক আমার ঘরের জান্লায় বসিয়া, উদয়োন্মুখ সূর্য্যের সমক্ষে মৃত্যুগান গাহিয়া আমাকে জাগাইয়া দিল।
অপরাহ্নে, বিদায় লইবার জন্য থিওসফিষ্টদিগের সহিত আবার সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। থিওসফিষ্টদিগের দলপতি আমার পত্র পাইয়া সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়াছিলেন, তথাপি তিনি স্নেহপূর্ণ মধুরভাবে আমাকে আদরঅভ্যর্থনা করিলেন; আমি এরূপ অভ্যর্থনা প্রত্যাশা করি নাই।
অনেকক্ষণ হস্তে হস্ত চাপিয়া তিনি বলিলেন—“খৃষ্টান, আমি ভাবিয়াছিলাম, তুমি বুঝি নাস্তিক!
“বুদ্ধদেব আমাদের জন্য যে সকল জড়বিজ্ঞানবাদের উপদেশ রাখিয়া গিয়াছেন, আমি তোমার নিকট তাহারই ব্যাখ্যা করিয়াছিলাম; কেন না, সাধারণত এইরূপভাবেই আমরা আরম্ভ করি—তোমার আত্মার যেরূপ প্রকৃতি দেখিতেছি, তাহাতে তোমার পক্ষে গুহ্যাঙ্গের ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মই উপযোগী; আর সে গুহ্যতন্ত্র আমাদের অপেক্ষা আমাদের বারাণসীর বন্ধুগণ ভাল জানেন; তুমি যে প্রার্থনা-উপাসনাদির কথা বলিতেছিলে,—কোননা-কোন আকারে তুমি সেইখানেই তাহা প্রাপ্ত হইবে; কিন্তু শুধু প্রার্থনাউপাসনাদি করিলেই যথেষ্ট হইবে না, পুণ্যসঞ্চয় করিবার জন্যও তাঁহারা তোমাকে উপদেশ করিবেন—‘অন্বেষণ করিলেই প্রাপ্ত হইবে’; আমি ৪০ বৎসর যাবৎ অন্বেষণ করিয়াছি; তুমি সাহসপূর্ব্বক আরো কিছুকাল অন্বেষণ কর। আমাদের মধ্যে তুমি থাকিবার চেষ্টা কর;—না না, যাও! -আমাদের শিক্ষাদীক্ষা তোমার উপযোগী হইবে না।” তাহার পর একটু হাসিয়া বলিলেন—“তা ছাড়া, এখনো তোমার সময় আসে নাই; এখনো তুমি সংসারের ভীষণ মায়াপাশে আবদ্ধ।
—“বোধ হয় তাই।”
“তুমি অন্বেষণ করিতেছ, কিন্তু অন্বেষণ করিয়া পাছে তুমি কিছু পাও, সেজন্যও তোমার ভয় হইতেছে।” —“তাই বোধ হয়।”
“আমরা তোমাকে ত্যাগের কথা বলিতেছি, আর তুমি কিনা ভোগের বাসনা করিতেছ!—তবে তুমি ভ্রমণই কর; যাও, দিল্লি দেখিয়া আইস, আগ্রা দেখিয়া আইস; যাহা তোমার ইচ্ছা হয়, যাহা তোমার ভাল লাগে, যাহাতে তোমার আমোদ হয়, তাহাই কর। শুধু এইটুকু আমাদের নিকট অঙ্গীকার কর যে, ভারত হইতে চলিয়া যাইবার পূর্ব্বে তুমি আমাদের বারাণসীর বন্ধুদিগের নিকট গিয়া কিছুকাল বিশ্রাম করিবে; আমরা তাঁহাদিগকে সংবাদ দিব, এবং তাঁহারা তোমার জন্য প্রতীক্ষা করিয়া থাকিবেন।”
যে হিন্দুটিকে আমি কাল দেখিয়াছিলাম, তিনি নিস্তব্ধ ছিলেন; তিনিও অনুকম্পার স্মিতহাস্য মুখে প্রকটিত করিয়া অতীব মধুর দৃষ্টিতে আমাকে দেখিতেছিলেন। এই সময়ে এই বিভিন্নজাতীয় তাপসযুগলকে সহসা অতীব উন্নত, অতীব নমনীয়, অতীব রহস্যময় ও বুদ্ধির অগম্য বলিয়া আমার মনে হইতে লাগিল। সহসা তাঁহাদের এরূপ পরিবর্ত্তন কেন হইল বুঝিতে না পারিয়া, আমি বিশ্বস্তভাবে ও কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁহাদের নিকট আমার মস্তক অবনত করিলাম।
ভারত ছাড়িয়া যাইবার পূর্ব্বে, উহাদের বারাণসীর বন্ধুদিগের গৃহে কিছুকাল অবস্থিতি করিতে হইবে,—বেশ ত! সে ত ভাল কথাই! আমি আনন্দের সহিত এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলাম। আমার মনে কেমনএকটা অগ্রসূচনা উপস্থিত হইল যে, সেখানকার আধ্যাত্মিক হাওয়াই আমার উপযোগী হইবে।
সর্ব্বশেষে বারাণসী; উহাকে এখন আমি হাতে রাখিলাম। আমার ভয় হয়, পাছে কোন অকাট্য প্রমাণ পাইয়া দুইটি বিভীষিকার মধ্যে একটি বিভীষিকাকে আমার গ্রহণ করিতে হয়। হয়—চিরকালের মত ব্যর্থমনোরপ্ত হইব; নয়—অন্বেষণ করিয়া কিছু পাইব; যদি পাই, তাহা হইলে আমার জীবনে একটা নূতন পথ উন্মুক্ত হইবে,—আমার মধুর মরীচিকাগুলি অন্তহিত হইবে।—