ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/গোধূলি আলোকে জগন্নাথমন্দির
ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের পীঠস্থান একটি পুরাতন নগরে, সমস্ত হইতে দূরে, সৈকতভূমি ও বালুকাস্তূপের মধ্যে, বঙ্গোপসাগরের ধারে, জগন্নাথের বিরাট্ মন্দির অধিষ্ঠিত।
ভারতের মধ্যদেশ হইতে যাত্রা করিয়া, সূর্যাস্তসময়ে এইখানে আসিয়া পৌঁছিলাম। আমার গাড়িটা সহসা নিঃশব্দ হইল,—যেন মখ্মলের উপর দিয়া চলিতে লাগিল;—আমরা এখন বালুরাশির মধ্যে আসিয়াছি। নিঃশব্দতাদ্বারা জানাইয়া-দিয়া, নীল রেখার আকারে সমুদ্র আমাদের সম্মুখে প্রকাশিত হইল।
বালুকাস্তূপরাশির উপর, ক্যাক্টস্ (cactus)-ঝোপের ভিতরে, প্রথমে ধীবরদিগের কতকগুলি ইতস্ততোবিক্ষিপ্ত কুটীর। তাহার পরেই জগন্নাথের মন্দির দৃষ্টিপথে পতিত হইল। তালপাতায়-ছাওয়া হাজার-হাজার ধূসরবর্ণ খোড়ো-ঘরের উর্দ্ধে,—রাশি-রাশি কোঠাবাড়ীর মধ্যে, মন্দিরের চূড়াটি সমুত্থিত; বিশেষত এই সামুদ্রিক ভূভাগে, আকাশভেদ করিয়া মন্দিরচূড়া অতি উচ্চে উঠিয়াছে বলিয়া, মন্দিরের এই দৃশ্যটি অতীব অপূর্ব্ব; চতুস্পার্শ্বের আর সমস্ত পদার্থ উহার পাদদেশে ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র বলিয়া মনে হইতেছে। চূড়ার আকারটি দীর্ঘ এবং উহার মাঝখানটা যেন ফুলিয়া উঠিয়াছে;—যেন একটা কুমীরের অণ্ডকে—একটা বৃহদাকার অণ্ডকে— মাটীর উপর দাঁড় করান হইয়াছে। চূড়াটি শুভ্র; তাহার উপর ইষ্টকগোলাপী রঙের একপ্রকার শিরাজাল, ইহা ভিন্ন আর-কোন অলঙ্কার নাই। চূড়ার উপরে যে-সকল পিতলের চাক্তি ও সূচ্যগ্র তাম্রখণ্ড ভল্ল-মুকুটরূপে শোভা পাইতেছে, সে সমস্ত গণনার মধ্যে না আনিলেও চূড়াটি দুইশত ফীট্ উচ্চ। গঙ্গামোহানার অন্বেষণে, জাহাজগুলা যখন বহিঃসমুদ্র দিয়া চলিতে থাকে, তখন এই মন্দিরটি তাহাদের নজরে পড়ে; এবং সামুদ্রিক নকসায়, দিগ্দর্শনের চিহ্নরূপে ইহা অঙ্কিত রহিয়াছে। কিন্তু এই স্থানের উপকূলে নোঙর ফেলিবার সুবিধা নাই; সুতরাং নাবিকগণ, দূর দিগন্তপটে অঙ্কিত একটি চিত্র ভিন্ন, এই পুরাতন মন্দিরসম্বন্ধে আর কিছুই অবগত নহে।
একটা চওড়া ও সোজা রাস্তা মন্দির পর্য্যন্ত গিয়াছে। যে সময়ে আমি পৌঁছিলাম, রাস্তাটা লোকে লোকাকীর্ণ। কিন্তু এখানকার ভারত যেন একটু বন্যভাবাপন্ন;—বিদেশীকে দেখিলে এখনো যেন বিস্মিত হয়; বিদেশীকে দেখিবার জন্য পথপরিবর্ত্তন করে, শিশুরা পিছনে-পিছনে চলিতে থাকে। নগ্ন লোকগুলা, সমুদ্রবায়ুর প্রভাবে একটু কালো হইয়া গিয়াছে; মল্মল্-ওড়নায় আচ্ছাদিত রমণীগণের পায়ে এত অধিক মল্-নূপুর যে, তাহার ভারে তাহাদের গমন মন্থর হইয়া পড়িয়াছে; হস্তের প্রকোষ্ঠ হইতে স্কন্ধ পর্য্যন্ত এত অধিক বলয়-বাজুবন্ধ যে, দেখিলে মনে হয়, যেন তাহাদের সমস্ত হাত আগাগোড়া একটা রৌপ্য কিংবা তাম্রকোষের মধ্যে আবদ্ধ। এখানকার কোন ক্ষুদ্র গৃহই রঙের চিত্রে একেবারে আচ্ছন্ন নহে; গৃহের চুনকাম-করা শুধু মুখভাগের উপর দেবদেবীর মূর্ত্তি অঙ্কিত; কাহারও দেহ নীল, কাহারও দেহ লাল, কাহারও মুখে নিষ্ঠুরভাব—এইরূপ সারি-সারি বরাবর চলিয়াছে; Thebes কিংবা Memphis—নগরের “ফ্রেসকো” চিত্রে যেরূপ মূর্ত্তিগুলি সজ্জিত, ইহা কতকটা সেই ধরণের। তা ছাড়া, গৃহের গঠনরীতি মিশরকে স্মরণ করাইয়া দেয়—সেইরূপ অনুচ্চ ও স্থূল ধরণের, সেইরূপ পোস্তার গাঁথুনি, সেইরূপ থাম, সেইরূপ গুরুভার দেয়াল—যাহা ভারাতিশয্যে পশ্চাতে ঝুঁকিয়া রহিয়াছে।
মন্দিরটি একটি বিশাল ভীষণ দুর্গবিশেষ; চতুষ্পার্শে উচ্চ দস্তুর চতুষ্কোণ প্রাকার; প্রত্যেক পার্শ্বের মধ্যস্থলে একএকটি দ্বার। যে রাস্তা দিয়া আমরা এখন পদব্রজে চলিতেছি, মন্দিরের প্রধান দ্বারটি সেই রাস্তার ঠিক সোজাসুজি। দ্বারের দুই পার্শ্বে দুইটা প্রকাণ্ড প্রস্তরময় পশুমূর্ত্তি; পশুর চোখদুটা গোলাকার, নাক থ্যাবড়া ও মুখের ‘হাঁ’ ভীষণ। এই দুই পশুমূর্ত্তির মাঝখান দিয়া একটি বৃহৎ শুভ্র সোপান মন্দিরের উপর উঠিয়াছে; সোপানের ধাপগুলা শ্যামবর্ণ নগ্নকায় লোকদিগের যাতায়াতে ভারাক্রান্ত।
বলা বাহুল্য, এই মন্দিরে আমার প্রবেশাধিকার নাই। মন্দিরের সম্মুখস্থ সানের উপর যেই আমি ধৃষ্টতাসহকারে পদার্পণ করিয়াছি, অম্নি কতকগুলি পুরোহিত আমাকে একটু পিছনে হটিয়া যাইতে—একটু দূরে গিয়া সেই বালির উপর দাঁড়াইতে অনুনয় করিল—যাহার উপর সকলেরই অধিকার আছে;—সমুদ্রের সেই বেলাভূমি,—সমুদ্রের সেই বালুকারাশি, যাহাতে করিয়া জগন্নাথপুরীর সমস্ত রাস্তা তুলাভরা গদির মত ‘থস্থসে’ বলিয়া মনে হয়।
কিন্তু এই চতুষ্কোণ ভীষণ প্রাকারটি লঙ্ঘন করিয়া ভিতরে যাইতে না পারিলেও উহা প্রদক্ষিণ করিবার আমার অধিকার আছে। ঐ প্রাকারের প্রত্যেক দিকে বরাবর একএকটা বীথি চলিয়া গিয়াছে; তাহার দুই ধারে শুষ্ক মৃত্তিকানির্ম্মিত গৃহাবলী। এই পুরাতন গৃহগুলা গুরুভার ঘনপিণ্ডাকৃতি; উহার দেয়াল ভিতর-দিকে ঝোঁকা; গৃহের মুখভাগের উপর সারি-সারি দেবদানবের প্রতিকৃতি প্রায়ই নীল ও লাল রঙে চিত্রিত, তাহার শিখরদেশে যে বারণ্ডা স্থাপিত—সেই বারণ্ডা পর্য্যন্ত একটা ক্ষয়গ্রস্ত সিঁড়ি উঠিয়াছে। এই সময়ে সায়াহ্নের শৈত্য-মাধুর্য্য উপভোগ করিবার জন্য রজতবলয়বিভূষিতা হিন্দুরমণীগণ ঐ বারণ্ডায় বসিয়া সমস্ত নিরীক্ষণ করিতেছে, অথবা আপন-আপন ভাবে ভোর হইয়া রহিয়াছে। ওড়নার
ভাঁজের মধ্য হইতে তাহাদিগকে বড়ই সুন্দর দেখাইতেছে।
যে সময়ে আমি মন্দির প্রদক্ষিণ করিতেছি, কতকগুলি ক্ষুদ্র বালিকা আমার পিছনে-পিছনে চলিয়াছে; অক্লান্ত তাহাদের কৌতূহল। উহাদের যে সদ্দার, তাহার বয়স হদ্দ ৮ বৎসর, সকলেই বেশ সুন্দর-সুশ্রী; তাহাদের নেত্রযুগল কজ্জলরেখায় দীর্ঘীকৃত হইয়া কৃষ্ণকুন্তলে মিশিয়া গিয়াছে; তাহাদের দৃষ্টি অতীব সরল। তাহাদের কানে সোনার কানবালা, নাকে নথ্।
রাত্রির পূর্ব্বেই বহুল যাত্রীর সমাগম হইবে জানিয়া, আমি সেই প্রতীক্ষায় ধীরে ধীরে মন্দির প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলাম। মন্দিরের পশ্চাদ্ভাগে, বীথিটি খুবই নির্জ্জন। যদি এই বালিকাগুলি আমার পথের সাথী হইয়া আমার সঙ্গে-সঙ্গে না থাকিত, তাহা হইলে এই বীথিটি আরও বিষাদময় বলিয়া বোধ হইত, সন্দেহ নাই। উহারা আমার দুইফীট্ অন্তরে থাকিয়া সঙ্গে-সঙ্গে চলিয়াছে; আমি যেখানে থামিতেছি, উহারাও সেখানে থামিতেছে; যখন আমি দ্রুত চলিতেছি, উহারাও নূপুর ঝঙ্কৃত করিয়া দীর্ঘপদক্ষেপে চলিতেছে।
গোলাপী রেখা-জালে বিভূষিত বৃহৎ মন্দিরচূড়াটি বরাবরই আমা হইতে সমান দূরে রহিয়া যাইতেছে; কেন না, উহা প্রাচীরবদ্ধ চতুষ্কোণ প্রাঙ্গণের কেন্দ্রবর্ত্তী; উহা আমার অলঙ্ঘনীয়; আমি উহার চতুর্দ্দিক প্রদক্ষিণ করিতেছি মাত্র। কিন্তু আরও অন্য কতকগুলি ছোট-ছোট মন্দির ভিতরদিকে প্রাচীরে ঠেস্ দিয়া রহিয়াছে,—সেই সকল মন্দির আমি নিকট হইতে দেখিতে পাইতেছি। এই সকল মন্দিরের চূড়া কুষ্মাণ্ডাকৃতি অথবা কুম্ভীরের অণ্ডের ন্যায়,—কিন্তু একটু কালিমাগ্রস্ত, ‘ফাট্-ধরা’ ও অতীব জরাজীর্ণ। কেবল মধ্যস্থলের বৃহৎ মন্দিরচূড়াটি—যাহা দূর হইতে দেখা যায়,—তাহাই ধব্ধবে শাদা, ও নূতন-টাট্কা বলিয়া মনে হয়, কিন্তু উহার ধরণটা আমাদের একেবারেই অপরিচিত! উহার গঠন যেরূপ বর্ব্বর-ধরণের, যেরূপ ‘ছেলেমানুষি’-ধরণের, উহার উপরে যেরূপ পিত্তলবিম্ব ও ঝক্ঝকে তিক্ষ্নাগ্র ধাতুখণ্ড সকল দৃষ্ট হয়, তাহাতে মনে হয়, যেন উহা অন্য গ্রহনিবাসী কিংবা চন্দ্রনিবাসী লোক কর্ত্তক নির্ম্মিত হইয়াছে। উহা বিহঙ্গকুলের আবাসস্থান। ইহারই মধ্যে উহারা সান্ধ্যভ্রমণে বহির্গত হইয়া আকাশে অবাধে ঘোরপাক্ দিতেছে।
আমি ও এই ক্ষুদ্র বালিকাগুলি—আমরা এই নিষিদ্ধ ঘেরের তৃতীয় দিকে আসিয়া পৌঁছিলাম! চতুষ্পার্শ্বের গৃহছাদ সুন্দরী রমণীগণকর্ত্তৃক বিভূষিত হইয়াছে; রাস্তার উপর বাজার বসিয়াছে; বাজারে রং-করা মল্মল্ বস্ত্র, শস্যদানা, ফলফুল বিক্রয় হইতেছে!
আমরা নীচে রহিয়াছি—আমাদের নিকট সূর্য্য অস্তমিত; কিন্তু বৃহৎ মন্দিরচূড়াটি সূর্য্যকে এখনো দেখিতে পাইতেছে;—উহার সমস্ত অংশই গোলাপী আভায় উদ্ভাসিত।
মনে হইল, পবিত্র বানরদিগের সান্ধ্যভ্রমণের ঠিক এই সময়। উহাদের মধ্যে প্রথমটি পবিত্র প্রাচীরের উপরে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং প্রাচীরের একটি দস্তুর অংশের উপর উঠিয়া-বসিয়া গা চুল্কাইতে লাগিল। প্রাচীরের শিখরদেশে দেবদানবের ছোট-ছোট মূর্ত্তি ইতস্তত খোদিত রহিয়াছে; বানরটা যদি না নড়িত, তাহা হইলে উহাকে উহাদেরই একটি বলিয়া মনে হইত, সন্দেহ নাই। তাহার পর, আর একটা বানর বাহির হইয়া পাশ্ববর্ত্তী অন্য এক দস্তুর-অংশের অগ্রভাগে আসিয়া বসিল; এইরূপে তিনটা, পরে চারিটা বানর আসিয়া বসিল; প্রাকারের দস্তুরাংশগুলি কপিবৃন্দে বিভূষিত হইল।
অতি শীঘ্রই বেলা পড়িয়া আসিল; ধূসর ও পুরাতন মন্দিরের শুধু চূড়ার অগ্রভাগটি গোলাপী-আভায় রঞ্জিত হইয়া রহিল। প্রাচীরের উপর,—প্রস্তরবর্ণের বানর, বানরবর্ণের ছোট-ছোট খোদিত প্রস্তরমূর্ত্তি ও শকুনিবৃন্দ। আকাশে—কাক ও পায়রার ঝাঁক্ বৃহৎ চক্রাকারে পাক্ দিতে দিতে, ক্রমে তাহাদের কক্ষপথ সঙ্কীর্ণ করিয়া আনিয়া, চূড়াশিখরস্থ পিত্তলবিম্বের চারিধারে ঘুরিতে আরম্ভ করিল।
এইবার বানরদিগের প্রস্থান করিবার সময়। উহাদের মধ্যে একটা বানর পিছ্লাইতে পিছ্লাইতে নীচে নামিয়া মাটীর উপর লাফাইয়া পড়িল; এবং ধৃষ্টতাসহকারে রাস্তা পার হইয়া বিক্রেতাদলের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইল; বিক্রেতাগণ পথ ছাড়িয়া দিল। অন্য বানরগুলা তাহার পিছনেপিছনে সারিবন্দি হইয়া চার পায়ে চলিতে লাগিল। দেখিলে মনে হয়, যেন কতকগুলা কুকুর,—কেবল পিছনের পা তাহাদের অপেক্ষা বেশী উচ্চ—ঊর্দ্ধপুচ্ছ হইয়া লাফাইতে লাফাইতে চলিয়াছে। যাইতে যাইতে প্রথম বানরটা বাজারের ঝুড়ি হইতে একটা কুল চুরি করিল; পরবর্ত্তী বানরগুলাও সেই একস্থান হইতেই ঐরূপ চুরি করিল; দোকানদার প্রতিবারই কোন আপত্তি না করিয়া তাহাদের অভিবাদন করিল। এক্ষণে উহারা চটুলভাবে একটা বাড়ীর গা বাহিয়া উঠিয়া দূরে চলিয়া গেল এবং ছাদের উপর দিয়া কোথায় অদৃশ্য হইয়া পড়িল।
বহির্দিকে, মন্দিরপ্রাকারের গায়ে, তাল-তরুর ডালপালা ও দর্ম্মা দিয়া নির্ম্মিত প্রহরিস্থানের ন্যায় একটা ঘরে পাণ্ডবের একটা মূর্ত্তি,—দুইমানুষপ্রমাণ উচ্চ, দেখিতে ভীষণ, কৃষ্ণবর্ণ, লম্বা-লম্বা দাঁত, হাঁ করিয়া রহিয়াছে। একজন বৃদ্ধ পুরোহিত একটা পাদপীঠের উপর উঠিয়া তাহার গলায় হল্দে ফুলের মালা পরাইয়া দিল; তাহার সম্মুখে একটা প্রদীপ জ্বালিল, একটা ছোট ঘণ্টা বাজাইল, প্রণাম করিল, তাহার পর একটা মশারির মধ্যে বদ্ধ করিয়া, তাহাকে আবার প্রণাম করিতে করিতে প্রস্থান করিল। কি-একটা দ্রুতগামী ও দুর্লক্ষ্য জিনিষের হাওয়া আমার মুখে লাগিল! একটা বাদুড় অসময়ে বাহির হইয়া, খুব নিম্নদেশে উড়িয়া বেড়াইতেছে; জনতার মধ্যে বেশ বিশ্বস্তভাবে যাওয়া-আসা করিতেছে।
মন্দিরচূড়ার অগ্রবিন্দুতে শেষ গোলাপী আভাটুকু এখনো রহিয়াছে; ইহাই পূজার সময়; মন্দির জনকোলাহলে ও বাদ্যনিনাদে পূর্ণ হইল। উভয়ই মিশ্রভাবে আমার কানে আসিয়া পৌঁছিল। ঐ গুপ্তস্থানের অভ্যন্তরপ্রদেশে না জানি কি কাণ্ড হইতেছে! না জানি কোন্ প্রতিমা (অবশ্যই খুব ভীষণ) এক্ষণে সান্ধ্যপূজা গ্রহণ করিতেছে। মন্দিরেরই মত লোকদিগের যে অন্তরাত্মা আমার নিকট দুরধিগম্য, তাহা হইতে না জানি কিরূপ আকারে প্রার্থনা উত্থিত হইতেছে!…
সে যাই হোক,—একটা বানর ভ্রমণে পরাঙ্মুখ হইয়া, নিম্নে লেজ ঝুলাইয়া, বহির্লোকের দিকে পিঠ ফিরাইয়া, মন্দিরপ্রাকারের শিখরদেশে একাকী বসিয়া আছে; এবং ঐ ঊর্দ্ধে, মন্দিরচূড়ার উপরে, দিবসের মুমূর্ষু, দশা বিষন্নভাবে নিরীক্ষণ করিতেছে। যে সকল পায়রা ও কাক আকাশে ঘোরপাক্ দিতেছিল, এক্ষণে উহারা ঘুমাইবার জন্য মন্দিরচূড়ায় আশ্রয় লইয়াছে। ঐ প্রকাণ্ড চূড়াটার সমস্ত শিরাজাল, সমস্ত খোঁচ্খাঁচ্ এক্ষণে ঐ সকল পক্ষীর সমাগমে কালো হইয়া গিয়াছে; পাখীরা এখনো পাখার ঝাপ্টা দিতেছে। শুধু ছায়ারেখা ছাড়া বানরটার আর-কিছুই এখন আমি দেখিতে পাইতেছি না। তাহার পৃষ্ঠদেশ প্রায় মানুষেরই মত, তাহার ক্ষুদ্র মস্তক চিন্তামগ্ন; প্রকাণ্ড মন্দিরচূড়ার ঈষৎ-গোলাপী-মিশ্রিত পাণ্ডুবর্ণ ‘জমি’র উপর, বানরের পৃথক্ দুইটা কান পরিস্ফুটভাবে প্রকাশ পাইতেছে!…
আবার যেন সেই নিঃশব্দ পাখার বাতাস আমি অনুভব করিলাম; বাদুড়টা যে কক্ষপথে ঘুরিতেছিল, তাহার কোন পরিবর্ত্তন না করিয়া এখনো সেই পথে যাতায়াত করিতেছে।
বানরটা বৃহৎ মন্দিরচূড়া দেখিতেছে; আমি বানরটাকে দেখিতেছি; সেই ছোট মেয়েগুলি আমাকে দেখিতেছে, এবং আমাদের সকলেরই মধ্যে দুর্ব্বোধ্যতার একটা বিশাল খাত প্রসারিত রহিয়াছে।…
এক্ষণে আমি মন্দিরের মুখ্য প্রবেশদ্বারের নিকটস্থ সেই সৈকতভূমিতে আসিয়াছি যেখানে জগন্নাথপুরীর সর্ব্বাপেক্ষা লম্বা রাস্তাটা আসিয়া মিলিত হইয়াছে। তীর্থযাত্রীরা আসিতেছে বলিয়া খবর হইয়াছে; তাহারা প্রায় নজরে আসিয়াছে। তাহাদের সহিত মিলিত হইবার জন্য, প্রতি মিনিটেই জনতার বৃদ্ধি হইতেছে।
সেই পবিত্র গাভীবৃন্দও এইখানে রহিয়াছে,—উহারা জনতার মধ্যে বিচরণ করিতেছে। উহাদের মধ্যে একটা গরু, যাহাকে শিশুরা খুব আদর করিতেছে—সেই গরুটা প্রকাণ্ডকায়, একেবারে ধব্ধবে শাদা, ও খুব বৃদ্ধা। একটা ছোট কালো গরু, তাহার পাঁচটা পা; একটা ধূসর রং-এর গরু, তাহার ছয়টা পা; এই অতিরিক্ত পাগুলা এত ছোট যে, উহা মাটী পর্য্যন্ত পৌঁছে না—অসাড় মৃত অঙ্গের মত গরুর পায়ের উপর ঝুলিয়া রহিয়াছে।
ঐ হোথা, রাস্তার শেষপ্রান্তে, তীর্থযাত্রীদিগকে দেখা যাইতেছে। সংখ্যায় দুই তিন শত হইবে। উহারা রং-করা বাখারির বড়-বড় চ্যাপ্টা ছাতা ধরিয়া আছে; এই ভরপূর সন্ধ্যার সময় এইরূপ ছাতা খুলিয়া রহিয়াছে দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়; উহাদের কটি হইতে ভিক্ষার ঝুলি ও তাম্রকমণ্ডলু ঝুলিতেছে; বক্ষের উপর কতকগুলা মাদুলি, কতকগুলা রুদ্রাক্ষমালা, জটাপটি হইয়া রহিয়াছে; গাত্র ও মুখমণ্ডল ভস্মাচ্ছন্ন; উহারা খুব তাড়াতাড়ি চলিয়াছে, পরমারাধ্য মন্দির-চূড়াটি দর্শনমাত্রে যেন জ্বরবিকারের ঝোঁকে তাড়াতাড়ি চলিয়াছে।
মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরিস্থ নহবৎখানায়, যাত্রীদিগের স্বাগতঅভ্যর্থনা-উদ্দেশে নহবৎ বাজিতে আরম্ভ হইয়াছে; উপরে ঢাকঢোলের বাদ্য, তাহার সহিত লোকদিগের দীর্ঘোচ্চারিত জয়ধ্বনি ও শুভশঙ্খের বিকট নিনাদ মিলিত হইয়া দিগ্বিদিক্ প্রতিধ্বনিত করিতেছে।
উহারা তাড়াতাড়ি,—খুব তাড়াতাড়ি চলিয়াছে। মন্দিরসম্মুখস্থ সৈকতভূমিতে আসিয়া উহারা ছাতা, বোঁচ্কা-বুঁচকি, ঝোলা-ঝুলি মাটীর উপর ফেলিয়া গন্তব্যপথে চলিতে লাগিল; বিকট প্রস্তরমূর্ত্তিগুলা যে দ্বার রক্ষা করিতেছে, সেই প্রবেশদ্বারের মধ্য দিয়া তুমুল কোলাহল-সহকারে উহারা প্রবেশ করিল, বিকারগ্রস্তের ন্যায় উন্মত্ত হইয়া সিঁড়ির উপর উঠিতে লাগিল, এবং অবারিতদ্বার মন্দিরের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেল।
এখন রাত্রি হইয়াছে, পান্থশালার অন্বেষণে আমি চলিলাম। ভারতীয়, নগরমাত্রেই দেখা যায়, এই পান্থশালাগুলি প্রায়ই সহর হইতে দূরে—সহরের বাহিরে অবস্থিত।
সৈকতময় একটি ক্ষুদ্র নির্জ্জনস্থানে একটা পান্থশালা পাইলাম। স্বচ্ছ সুন্দর মধুময় রাত্রি। সমুদ্রের দোলনশব্দ শুনা যাইতেছে; সমুদ্র-উপকূলমাত্রেই এইরূপ শব্দ শোনা যায়। জগন্নাথের মন্দির কিংবা মন্দিরের সেই অপূর্ব্ব চূড়া আর দেখা যাইতেছে না; ঐ হোথায় নীলাভ ছায়ার মধ্যে সমস্তই ডুবিয়া গিয়াছে। এখানকার সামুদ্রিক গন্ধ, বালির উপর যে সকল ছোট-ছোট বুনো গাছের চারা যেন গালিচা বিছাইয়া রাখিয়াছে, সেই সকল চারা-সমুত্থিত সৌরভ,—অতীব বিষন্নভাবে আমার শৈশবে রজন্মস্থানকে স্মরণ করাইয়া দিতেছে; বঙ্গোপসাগরের ধারে, আমার সেই (Ile d' Oleron) ওল্রোঁ-দ্বীপের সাগরতটকে স্মরণ করাইয়া দিতেছে।…
একমাত্র তাহারাই ভ্রমণের সমস্ত মাধুর্য্য, সমস্ত কঠোরতা অনুভব করিতে পারে, যাহাদের অন্তরের অন্তস্তলে স্বকায় জন্মস্থানের প্রতি একটা দুর্ব্বিজয় আসক্তি বিদ্যমান।