ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/মোগলবিভবের ধবল প্রভা
আমাদের দেশের ন্যায় ভারতবর্ষেও, রেলের ডাক-গাড়ি আজ আকাশকে যেন দগ্ধ করিয়া চলিয়াছে। জগন্নাথ হইতে—বঙ্গোপসাগরের প্রান্তদেশ হইতে ছাড়িয়া, উত্তরাঞ্চলের সেই একঘেয়ে সমতলভূমি অতিক্রম করিয়া, বারাণসী ছাড়াইয়া, (যাহার জন্য আমার মন চঞ্চল হইয়া, রহিয়াছে, এবং যেখানে আবার আমাকে পিছাইয়া আসিতে হইবে।)
আবার আমি সেই প্রদেশে আসিয়া পড়িয়াছি—যেখানে দুর্ভিক্ষের শুষ্কবায়ু নিশ্বসিত হইতেছে। আমি মুসলমান-আগ্রায় আসিয়া পৌঁছিয়াছি।
আমার মত যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণ্যিক ভারত হইতে আইসে, প্রথমেই একটা খুব পরিবর্ত্তন তাহার চোখে ঠ্যাকে; ধর্ম্মাধিষ্ঠানসমূহের যে চিত্র তার মনে অঙ্কিত ছিল, তাহা রূপান্তর প্রাপ্ত হয়; মস্জিদ্, মন্দিরের স্থান অধিকার করে। বিরাট্ কাণ্ডের পর, অতিপ্রাচুর্য্যের পর—সুসংযতা ক্ষুদ্রকায়া তন্বী শিল্পকলার সহসা আবির্ভাব হয়। স্তুপাকৃতি পদার্থসমূহের বদলে, পুরাণবর্ণিত দেবদানবের উদ্দাম প্রমোদচিত্রের বদলে, আগ্রার এই সমস্ত ভজনালয় শুভ্র মার্ব্বেলপ্রস্তরে মণ্ডিত এবং ঐ মার্ব্বেলের শুভ্রতার মধ্যে জ্যামিতিক-আকারের কতকগুলি বিশুদ্ধ নক্সা আড়া-আড়িভাবে পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট; চক্চকে পাথরের গায়ে শুধু কতকগুলি সাদাসিধা ফুল ইতস্তত অঙ্কিত।
মহামোগল! আজ এই নামটি ঔপন্যাসিক বলিয়া মনে হয়—প্রাচ্যদেশীয় কোন পুরাতন গল্পের সামিল বলিয়া মনে হয়।
পৃথিবীর মধ্যে বিশালতম সাম্রাজ্যের অধিস্বামী সেই মহামহিম নৃপতিগণ এইখানেই বাস করিতেন। তাঁহারা কতকগুলি প্রকাণ্ড প্রাসাদ পশ্চাতে রাখিয়া গিয়াছেন;—কেবল, তাঁহাদের আমলে উহাদের এরূপ ভগ্নদশা ও দৈন্যদশা উপস্থিত হয় নাই। উহাদের মধ্যে একটি প্রাসাদ হইতে সমস্ত আগ্রা দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে।
তপ্তধূলিসমাকীর্ণ, কাক-চিল-শকুনি-সমাচ্ছন্ন আকাশের নীচে সেকালের পুরাতন ও সুবিশাল আগ্রাসহর প্রসারিত।
আজ যে সময়ে এই সহরে প্রবেশ করিলাম, একদল বরযাত্রী বাহির হইতেছিল; ২০টা প্রকাণ্ড ঢাক তাহাদের আগে-আগে চলিয়াছে; বরটির বয়স ১৬বৎসর;—জরির কাজ-করা লাল মখ্মলের পোষাক-পরা; একটা শাদা-রঙের ঘোটকীর উপর আরূঢ়; একটি ছোট অদৃশ্য ‘কনে’ পাল্কির মধ্যে বদ্ধ; তাহার পশ্চাতে একদল ভৃত্য—দানসামগ্রীতে পূর্ণ সোনার গিল্টি-করা কতকগুলা ক্ষুদ্র সিন্দুক মাথায় করিয়া চলিয়াছে। সর্ব্বশেষে, জরির আস্তরণে ঢাকা বরের খাট চারিজনের স্কন্ধে মহা-আড়ম্বরসহকারে চলিয়াছে।
অতি-উচ্চ অতি-পুরাতন গৃহের শীর্ষদেশ হইতে বারাণ্ডা ও ‘হাওয়াখানা’-ঘর বাহির হইয়াছে; নীচের কুট্টিমভূমির উপর নানাপ্রকার জিনিষের বিক্রেতাগণ উপবিষ্ট, সেখানে রাশিরাশি রেশমী কাপড় ও চুম্কি ঝিক্মিক্ করিতেছে; প্রথম-তলায়, নর্ত্তকী ও বারাঙ্গনাগণ মুক্ত গবাক্ষের ধারে বসিয়া আছে; উহাদের কালো চোখের মদালস দৃষ্টি বেশ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে; উপরে কতকগুলি লোক রহিয়াছে; ঘরের দ্বার রুদ্ধ; ছাদের উপর বড় বড় শকুনি অষ্টপ্রহর বসিয়া আছে; কিংবা কতকগুলা বানর সপরিবারে বসিয়া, লেজ ঝুলাইয়া, লোকের গমনাগমন নিরীক্ষণ করিতেছে ও চিন্তায় মগ্ন রহিয়াছে—বানরেরা বহুশতাব্দী হইতে আগ্রা দখল করিয়া বসিয়াছে; উহারা টিয়াপাখীদের মত ছাদের উপর মুক্তভাবে অবস্থিতি করে; ধ্বংসদশাপন্ন কোন কোন অঞ্চল, প্রায় উহাদের নিমিত্তই ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে; সেখানে উহারা বাগান-বাগিচা লুণ্ঠন করিয়া, চতুষ্পার্শ্বস্থ হাটবাজার লুণ্ঠন করিয়া, নির্ব্বিবাদে রাজত্ব করে।
এই আগ্রার প্রাসাদটিকে দূর হইতে দেখিলে মনে হয় যেন একটা পর্ব্বত,—ধূসর-লোহিত প্রস্তরপিণ্ডে নির্ম্মিত এবং প্রাকারস্থ ভীষণ দস্তুর চূড়াগুলির দ্বারা কণ্টকিত।
যখন কারাগারসদৃশ গুরুপিণ্ডাকার রক্তবর্ণ এই প্রাকারাবলী নিরীক্ষণ করি, তখন মনে এই প্রশ্নটি স্বতই উপস্থিত হয়,—এই সকল বিলাসী বাদশারা, কেমন করিয়া এই প্রাকারবেষ্টিত স্থানটিকে স্বকীয় খাম্খেয়ালী বিলাসবিভবের লীলাক্ষেত্ররূপে নির্ব্বাচন করিয়াছিলেন। সে যাই হোক্—নদীর পাশ দিয়া—জুম্মামস্জিদের পাশ দিয়া এই লোহিত পর্ব্বতটিকে প্রদক্ষিণ করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, Alhumbra-প্রাসাদের মত, শাদাপাথরের স্বপ্নময় লঘুধরণের একটি প্রাসাদ এই বিরাট্ দুর্গের উপর স্থাপিত; এবং তলদেশের কঠোর স্থূলপিণ্ডাকার গাঁথুনি হইতে এই প্রাসাদটি এতটা বিভিন্ন যে, এই বৈপরীত্য দেখিয়া সহসা বিস্মিত হইতে হয়। ঐ উপরে মহামোগল এবং তাঁহার সুলতানেরা বাস করিতেন; এবং প্রায় অন্তরীক্ষবাসী হইয়া, দুরধিগম্য হইয়া, শুভ্র-স্বচ্ছ প্রস্তর-রাশির মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া, সমস্ত রাজ্য শাসন করিতেন।
ছুঁচাল-খিলান-বিশিষ্ট দ্বারের মধ্য দিয়া, খিলানের মধ্য দিয়া, একপ্রকার সুড়ঙ্গপথের মধ্য দিয়া, ‘তেহারা’ পুরু প্রাকার পার হইয়া, তবে ভিতরে প্রবেশ করিতে হয়। বড় বড় সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে হয়;—চারিদিকে সেই একই রক্তাভ ধূসরবর্ণ।
তাহার পরেই সহসা স্বচ্ছপাণ্ডুবর্ণ;—নীরব ও শুভ্র ভাস্বরতা; এইবার মার্ব্বেলের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি।
শুভ্র সান্, শুভ্র প্রাচীর, শুভ্র স্তম্ভ, শুভ্র খিলানঘর, ছাদের ধারে খোদাই-কাজ-করা যে প্রস্তরময় গরাদে-বেষ্টন রহিয়াছে এবং যেখান হইতে দূর-দিগন্ত পরিলক্ষিত হয়, তাহাও শুভ্র;—সমস্তই শুভ্র। কেবলমাত্র, অমল-ধবল দেয়ালের গায়ে ইতস্তত কতকগুলি ফুল—‘agat’ ও ‘Parphyre’ পাথরের ফুল—উৎকীর্ণ রহিয়াছে; কিন্তু ঐ সমস্ত ফুল এত সূক্ষ্ম, এত মৃদুপ্রভ, এত বিরলবিন্যস্ত যে, এই প্রাসাদস্থ তুষারশুভ্রতার কোন বৈলক্ষণ্য হয় না। যেদিন এখানকার শেষ-বাদ্শা এই স্থান হইতে নিব্বাসিত হন, সেইদিন যেমনটি ছিল,—এই পরিত্যক্ত অবস্থার মধ্যেও, এই মরু-নিস্তব্ধতার মধ্যেও ঐ সমস্ত ঠিক্ তেম্নি টাট্কা, তেম্নি শুভ্র-স্বচ্ছ রহিয়াছে। মার্ব্বেলের উপর কালের হস্ত অতি বিলম্বে প্রকটিত হয়, তাই এই অপূর্ব্বসুন্দর জিনিষগুলি দেখিতে এমন ক্ষণভঙ্গুর ও সুকুমার হইয়াও, আমাদের নিকট ধ্রুবনিত্য বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। ঐ উপরে কৃত্রিম পর্ব্বতের উপর, প্রাকারবদ্ধ প্রকাণ্ড দুর্গের কেন্দ্রস্থলে, একটি বিষয় উদ্যান সংস্থাপিত। উহার চতুর্দ্দিকে বড়বড় দ্বার-প্রকোষ্ঠ। যে জমাট্-প্রস্তরচূর্ণের দ্বারা ভূগর্ভের খিলান-ঘর নির্ম্মিত হইয়া থাকে, ঐ সকল দ্বারপ্রকোষ্ঠ—সেইরূপ মাল মস্লায় গঠিত কৃত্রিম গুহার প্রবেশপথ বলিয়া প্রতীয়মান হয়। কিন্তু এই সকল কৃত্রিম গুহার গঠনে বিশুদ্ধ জ্যামিতিক রেখাবিন্যাসের সুষমতা পরিলক্ষিত হয়। বৃহৎ খিলানের প্রত্যেক ক্ষুদ্র অলঙ্কারটি পর্য্যন্ত, ক্ষুদ্র খিলানের ক্ষুদ্র খুব্রিকাটা ঘরটি পর্য্যন্ত, ‘চুল-চেরা’ সমান মাপে গঠিত। সূক্ষ্ম কালো জালি-কাটা সৌধঅলঙ্কারের কিনারার সূতাটিও মনে হয় যেন তুলি দিয়া আঁকা, কিন্তু আসলে সেইস্থলে Onyx-মণি অতীব নিপুণভাবে বসান হইয়াছে।
এই ভাস্বর অথচ বিষণ্ন দালানগুলি একেবারেই অবারিত; এক দালান হইতে আর এক দালানে আবাধে যাতায়াত করা যায়; অথবা সারি-সারি অবারিত খিলানদ্বার দিয়া একেবারেই অলিন্দের উপর আসিয়া পড়া যায়। যখন ভাবি, কি সতর্ক সন্দিগ্ধতার সহিত পূর্ব্বে এই স্থানটি নিম্নস্থ ভীষণ প্রাকারাদির দ্বারা সংরক্ষিত হইয়াছিল, তখন খোলা-খালা বিশ্বস্তভাবের এই সমস্ত নিদর্শন নিতান্ত অলীক বলিয়া মনে হয়! তা ছাড়া, এইখানে একটা আম্দরবারের ময়দান আছে; এই মুক্তস্থানে রাজদরবার বসিত। এই স্থানের অনাড়ম্বর সরলতা মার্জ্জিতরুচির পরিচায়ক; কেবল, পাথরের উপর যে খোদাই-কাজগুলি দেখা যায়, তাহা একেবারে নিখুঁত। এইখানে প্রায় কিছুই নাই; মোগল-বাদ্শার জন্য কেবল একটি কালো-পাথরের সিংহাসন রহিয়াছ; তাহার পাশে, বিদূষকের জন্য একটা শাদা মার্ব্বেলের আসনপীঠ;—ইহা ছাড়া আর কিছু নাই। (মনে হয়, সেকালে রাজদরবারের এতটা গাম্ভীর্য্য ছিল যে লোকের চিত্তভারলাঘব করিবার জন্য বিদূষকের অধিষ্ঠান আবশ্যক হইত। সকলেই জানে, আজকালকার রাষ্ট্রীয় মহাসভায় এই কাজের জন্য কোন বিশেষ লোকের প্রয়োজন হয় না।)
বাদশার স্নানাগার শুভ্র—বলা বাহুল্য, একেবারে তুষারশুভ্র; আর তাহাতে কত জটিল রেখাবিন্যাস, কত ছোট-ছোট খিলান পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট, সহস্র-ভাঁজ-বিশিষ্ট কত ছুঁচাল খিলান, খুদিয়া বাহিরকরা বহু ঘর-কাটা শব্দযোনি কত খিলানমণ্ডপ, তাহার আর সংখ্যা নাই; মার্বেল-দেয়ালের উপর এক-একটা ফুলের ডাল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত—যাহার এক-একটি টুক্রাই পরমাশ্চর্য্য;—উহা স্বর্ণ ও lapis-মণি দিয়া উৎকীর্ণ।
যে সমস্ত প্রাকার এই অট্টালিকাকে ধারণ করিয়া রহিয়াছে—সেই প্রাকাবাবলীর শেষ প্রান্তভাগে, জুম্মামস্জিদের পাশে—খোলা ময়দানের পাশে, কত ছোট-ছোট হাওয়াখানা, লঘু গঠনের ছোট ছোট কত চতুষ্কমণ্ডপ; সেখান হইতে সমস্ত সহর দৃষ্টিগোচর হয়; এই সমস্ত গৃহ সুলতানাদিগের জন্য, অন্দরমহলের সমস্ত বেগমদের জন্য নির্দ্দিষ্ট ছিল। প্রাসাদের এই অঞ্চলেই, মার্ব্বেলের জালি-কাজের, জাফ্রি-কাজের বাহার খুলিয়াছে। দেয়ালের সর্ব্বাংশের মধ্য দিয়াই তুমি দেখিতে পাইবে, কিন্তু তোমাকে কেহই দেখিতে পাইবে না। এই দেয়ালগুলা আপাদমস্তক যে সব অখণ্ড প্রস্তরফলকে নির্ম্মিত, সেই সব প্রস্তরফলকে এত সূক্ষ্ম ছিদ্র কাটা যে, দূর হইতে মনে হয়, যেন সরু-সরু সুন্দর থামের মধ্যে শাদা জরির জাল টানা রহিয়াছে। কিন্তু এই সব কারুকার্য্য—যাহা সহসা ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী বলিয়া মনে হয়—আসলে উহা খুবই পাকাপোক্ত; একটা মানুষ বিপুল অর্থক্ষয় করিয়া কত স্থায়ী ও সুন্দর জিনিষ নির্ম্মাণ করিতে সমর্থ—ইহাই তাহার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
এই বিরাট্ বাসগৃহের নিম্নস্থ গাঁথুনিসমূহের মধ্যে, যে নৈসর্গিক শৈলের উপর ইহা স্থাপিত সেই শৈলের মধ্যে, আরো কত দালান সুকৌশলে সন্নিবেশিত, আরো কত অর্দ্ধচ্ছায়াচ্ছন্ন স্থান অধিষ্ঠিত যাহার বিরাট্ মহিমার মধ্যে কি-জানি কেমন-একটা গুপ্তভাবের আভাস পাওয়া যায়। তন্মধ্যে, প্রধান সুলতানার স্নানাগারের মধ্যে প্রবেশ করিলে কেমন-একটা সুড়ঙ্গ-সুলভ শৈত্য অনুভব করা যায়; সেখানে আলোকের একটু ক্ষীণ রশ্মিমাত্র প্রবেশ করে; ইহা যেন জাদুকরের একপ্রকার মন্ত্রপূত গুহাবিশেষ, উহার খিলান-মণ্ডপের কাজ দেখিলে মনে হয়, ঠিক্ যেন বৃষ্টিধারা ঠাণ্ডায় জমিয়া গিয়াছে; উহার দেয়ালগুলা অতিসূক্ষ্ম দর্পণকাচে খচিত; আর্দ্রতা ও যবক্ষারের প্রভাবে এই সহস্র সহস্র ক্ষুদ্র কাচখণ্ডগুলির ‘জলুস্’ কমিয়া গিয়াছে; চুমকি-বসানো কোন পুরাতন জরির কাপড়ের মত ‘ম্যাড়্মেড়ে’ হইয়া পড়িয়াছে।
পূর্ব্বকালে, ভারতের রূপযৌবনসম্পন্না সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীরাই এই অবরোধের মধ্যে বাস করিত; এবং এই সকল সান্, এই সকল বিশ্রামমঞ্চ—যাহার অমল ধবলতা কালও কলুষিত করিতে পারে নাই—উহারা বহুকাল যাবৎ ঐ সব বাছা-বাছা শ্যামাঙ্গিনী ললনার গাত্রস্পর্শ উপভোগ করিয়াছে।
বিজয়ী মোগলদের আসিবার বহুশতাব্দী পূর্ব্বে এইখানে একটি দুর্গ ছিল; মোগলেরা আসিয়া এই দুর্গে দুইটি নূতন জিনিষের আমদানি করিয়াছে;—দুগ্ধধবল মর্ম্মরপ্রস্তর ও জ্যামিতিক রেখাবিন্যাসের অলঙ্কারপদ্ধতি। এই সকল দালানে এখনো ধূসর-লোহিত বর্ণের খোদাইকাজ দেখা যায়; এই সকল কাজ বহুপুরাতন-জৈনরাজাদিগের আমলের। ছায়ান্ধকার সিঁড়ি দিয়া নামিয়া, গুরুভার স্থূল প্রস্তররাশির মধ্য দিয়া এমন এক স্থানে আসিয়া পড়িলাম, যাহা অতীব ভীতিজনক ও শোকাবহ ঘটনায় পূর্ণ;—সেই সব অন্ধকূপ, যেখানে হতভাগ্য লোকসকল বিষাক্ত ভীষণ সর্পের মুখে পরিত্যক্ত হইত;—একটা ঘর, যেখানে সুলতানাদিগকে ফাঁসি দেওয়া হইত; এবং তাহার পর তাহাদের মৃতদেহ এমন একটা কূপের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইত—যাহার অন্তঃসলিল, নদীর সহিত মিশিয়া গিয়াছে; কতকগুলা অতলস্পর্শ কালো গর্ত্ত;—কতকগুলা সুড়ঙ্গ, যাহার ভিতর দিয়া যাইতে সাহস হয় না এবং যেখানে হয় অস্থিরাশি, নয় ধনভাণ্ডার লাভ করা যায়। উপরে যে অমল-ধবল প্রাসাদরূপ পদ্মটি ফুটিয়া আছে, তাহারই যেন তমসাচ্ছন্ন শিকড়গুলা মাটি ফুঁড়িয়া পাতালগভীরে প্রবেশ করিয়াছে।
তমসাচ্ছন্ন আনুসঙ্গিক-ঘরগুলির উপর পুনর্ব্বার উঠিয়া, আবার সেই সব জালি-কাজকরা চতুষ্কমণ্ডপে ফিরিয়া আসিলাম;—এই সুক্ষ্ম-খোদিত চতুষ্কগুলি প্রাকারবপ্রের ধারে খাড়া হইয়া রহিয়াছে এবং উহাদের গবাক্ষগুলা ফাঁকায় বাহির হইয়া আসিয়াছে। আমি কতকটা গয়ংগচ্ছভাবে সেই সব দ্বার-গৃহে দাঁড়াইয়া রহিলাম—যেখানে অতীতকালের সুন্দরীরা কিংবা কৃত্রিম-পর্ব্বত-শিখরস্থ অবরুদ্ধ সুলতানারা, গগনবিহারী ভ্রাম্যমান বিহঙ্গদের ভ্রমণপথেরও ঊর্দ্ধদেশ হইতে, জালি-কাটা মার্ব্বেলফলকের মধ্য দিয়া কিংবা থামের ফাঁক দিয়া চতুদ্দিক্ নিরীক্ষণ করিতেন। এখানকার সমস্তই চারু-সূক্ষ্ম কারুকার্য্যে বিভূষিত; এখানকার সমস্ত খোদাইকার্য্যে ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠা লক্ষিত হয়; শাদা ‘জমির’ উপর মণিখচিত ছোট ছোট ফুল ইতস্তত ছড়ান রহিয়াছে; অন্যাংশ অপেক্ষা এই অংশটি আরো বেশী শাদা বলিয়া মনে হয়—সর্ব্বত্রই যেন একপ্রকার বিষাদের ধবল কিরণ বিচ্ছুরিত।
আজ আমরা এখানকার যতটা উজাড়-ভাব দেখিতেছি, অবশ্য সেকালে সুলতানারা সে ভাব দেখেন নাই। তখনও এই সব সমভূমি গড়াইয়াগড়াইয়া অনন্তের মধ্যে বিলীন ছিল; তখনও এই একই নদী সুদূরে আঁকিয়া-বাঁকিয়া চলিয়াছিল, কিন্তু তখন উহার উপর দিয়া দুর্ভিক্ষের শুষ্কনিশ্বাস বহিয়া যায় নাই; তখন সমস্ত দেশ মৃত্যুর কুজ্ঝটিকায় আচ্ছন্ন হয় নাই। ঐ সকল চতুষ্কমণ্ডপের উপর হইতে সুন্দরীরা নিম্নস্থ উৎসবআমোদ নিরীক্ষণ করিতেন; তাঁহাদের চিত্তবিনোদনার্থ যে বাঘের লড়াই ও হাতীর লড়াই হইত, তাহাই তাঁহারা অবলোকন করিতেন; কিন্তু এখন সেই ক্রীড়াভূমি কণ্টকগুল্মে আচ্ছন্ন, বৃক্ষলতায় আচ্ছন্ন; অনাবৃষ্টির শুষ্কতায়, এই সব বৃক্ষলতা এক্ষণে পল্লববিরহিত; এই সায়াহ্নে গ্রীষ্মের জ্বলন্ত উত্তাপ যদি না থাকিত, তাহা হইলে শীতঋতুর আবির্ভাব হইয়াছে বলিয়া সহজেই মনে হইত।
এখানে পাখীতে-পাখীতে একেবারে আচ্ছন্ন; এত পাখী ভারতের আর কোন প্রদেশে নাই। পাখীর কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কোন শব্দই এখন আমার কানে আসিতেছে না। এই সব গৃহছাদের নিস্তব্ধতা উহাদেরই চীৎকারে ভরপূর; এই সব শব্দযোনি ধবল মার্ব্বেল উহাদেরই চীৎকারে প্রতিধ্বনিত। সন্ধ্যা নিকটবর্ত্তী হইলে, পক্ষীদের মধ্যে স্থাননির্ব্বাচনের মহাধুম পড়িয়া যায়। আমার নিম্নস্থ ঐ গাছটি কাকে-কাকে ভরিয়া একেবারে কালো হইয়া যাইতেছে; আর একটি গাছ টিয়াপাখীতে আচ্ছন্ন;—মরাগাছের ডালের উপর যেন কতকগুল সবুজ পাতা গজাইয়া উঠিয়াছে। ধবলকায় চিল, বড়-বড় ‘ন্যাড়া’ শকুনি, চতুষ্পদ পশুদের মত ভূমির উপর বিচরণ করিতেছে।
দূবস্থ সমভূমির উপর ছোট ছোট ধবল গম্বুজ দেখা যাইতেছে; কোন চিত্রই, কোন বস্তুই, মার্ব্বেলের এই স্বচ্ছ ধবলতার অনুকরণ করিতে পারে না। যে ধূলার কুজ্ঝটিকায় সমস্ত ভূমি আচ্ছন্ন এবং যাহা সন্ধ্যাগমে নীল বর্ণ অথবা ইন্দ্রধনুর বিচিত্রবর্ণ ধারণ করে, সেই কুজ্ঝটিকার মধ্য হইতে,—স্থানে-স্থানে এই স্বচ্ছ ধবলতা ফুটিয়া বাহির হইতেছে। পূর্ব্বে ঐ সব উচ্চ প্রাসাদ বেগমদিগের নিবাসগৃহ ছিল; জরির পাড়ওয়ালা ওড়না পরিয়া, মণিরত্নে বিভূষিত হইয়া, সুন্দর বক্ষোদেশ অনাবৃত করিয়া ঐ সব সুন্দরী ঐখানে বিচরণ করিত। ঐ সব গম্বুজের মধ্যে তাজের গম্বুজটাই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ—সেই অতুলনীয় তাজ,—যেখানে মহা-সুলতানা মন্তাজিমহল ২৭০ বৎসর হইতে মহানিদ্রায় নিমগ্না।
সকলেই তাজ দেখিয়াছে, সকলেই তাজের বর্ণনা করিয়াছে—সেই তাজ, যাহা পৃথিবীর একটি আদর্শস্থানীয় পরমাশ্চর্য্য পদার্থ।
ক্ষুদ্রায়তন চিত্রে, ‘মিনা’র কারুকার্য্যে,—ঝক্মকে-শ্রীপচ্কল্কাবিভূষিত-উষ্ণীষধারিণী মন্তাজি-মহলের[১] মুখশ্রী এখনো সংরক্ষিত;— সেই মুখশ্রী, যাহা নিজ পতি সুল্তানের এতটা প্রেম উদ্দীপিত করিয়াছি যে, তিনি সেই প্রেমে বিমুগ্ধ হইয়া এ-হেন অশ্রুতপূর্ব্ব মূর্ত্তিমতী মহিমাচ্ছটার মধ্যে মৃত্যুকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন।
দুর্গের ন্যায় প্রাকারবদ্ধ একটি বৃহৎ গোরস্থান-উদ্যানের মধ্যে তাজ অবস্থিত; এরূপ প্রকাণ্ড অমল-ধবল মর্ম্মরপ্রস্তরস্তূপ জগতে আর দ্বিতীয় নাই। উদ্যানের প্রাচীর ধূসর-লোহিত-বর্ণ; বিশাল ঘেরের চারি কোণে বহির্দ্বারের মাথা ছাড়াইয়া শ্বেতপ্রস্তরখচিত যে সব উচ্চ গম্বুজ উঠিয়াছে, তাহাও ধূসর-লোহিত-বর্ণ। তাল ও সাইপ্রেস্-ঝাউর পংক্তি, জলের ছৌবাচ্ছাগুলা, সুচ্ছায় yoke-elm-বৃক্ষশ্রেণী,—সমস্তই একেবারে ঠিক সরলরেখায় স্থাপিত। এবং ঐ পশ্চাৎ-প্রান্তে কল্পনার আদর্শমূর্ত্তি এই সমাধিমন্দিরটি মহাগৌরবে রাজসিংহাসনে বিরাজমান; এই সমস্ত হরিৎশ্যামল উদ্ভিজ্জের মধ্যে, উহার তুষার-ধবলতা আরো যেন ফুটিয়া উঠিয়াছে। একটা ধবল প্রস্তরপীঠের উপর একটা প্রকাণ্ড গম্বুজ এবং ‘ক্যাথিড্রাল্’গির্জ্জার চূড়া অপেক্ষাও উচ্চ চারিটা ‘মিনার’-স্তম্ভ স্থাপিত রহিয়াছে। ঐ সমস্তের রেখাবিন্যাস কি প্রশান্ত, কি বিশুদ্ধ! উহার মধ্যে কি শান্তিময় সামঞ্জস্যের ভাব! কি উচ্চধরণের সহজ সরলতা! উহার সমস্তই বিরাট্পরিমাণে-গঠিত; এবং এরূপ প্রস্তরে নির্ম্মিত, যাহাতে লেশমাত্র দাগ নাই—ধূসর-পাণ্ডু রঙের একটি শিরাও নাই।
তাহার পর, নিকটে গিয়া দেখা যায়, অতি সুকুমার-ধরণের লতাপাতার কাজ দেয়াল বাহিয়া উঠিয়াছে, কার্ণিসের ধার দিয়া গিয়াছে, দ্বারের চারিধার ঘিরিয়া আছে; ‘মিনারেটের’ উপর গড়াইয়া চলিয়াছে; খুব সরু সরু কালো মার্ব্বেলের টুক্রা বসাইয়া এই সব লতাপাতা রচিত হইয়াছে। যে গম্বুজটি সুলতানার অন্তিমশয্যাকে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে, সেই ৭৫-ফীট্-উচ্চ মধ্য গম্বুজের নিম্নস্থ স্থানটিতে সহজ সরলতার আতিশয্য,—ধবল-মহিমার পরাকাষ্ঠা পরিলক্ষিত হয়। আশ্চর্য্য! যেখানে অন্ধকার হইবার কথা, সেখানেও আলোক; যেন ধবলতার সমস্ত কিরণ একস্থানে পুঞ্জীভূত হইয়াছে; মার্ব্বেলের এই মহা-আকাশে কি-জানি কেমন-একটা অপূর্ব্ব অস্ফুট স্বচ্ছতা বিদ্যমান। ধূসর-মুক্তাবর্ণ শিরাজালে ঈষৎ লাঞ্ছিত উচ্চ দেয়ালের গায়ে আর কিছুই নাই; কেবল ছোট-ঘোট কতকগুলা দস্তুর খিলান এমন বেমালুমভাবে বাহির হইয়াছে। যে, উহাদিগকে রেখাচিত্র বলিয়া মনে হয়। বিশাল গম্বুজের ভিতর-পিঠে আর কিছুই নাই—কেবল জ্যামিতিক-রেখায় বিন্যস্ত খুদিয়া-বাহির করা বহুল খুব্রি-কাটা ঘর। কেবল তলদেশে,—এই সব সুন্দর দেয়ালের চারিধারে পদ্মফুলের যেন একটা কেয়ারী রচিত হইয়াছে; যেন উহার বৃন্তগুলা ভূমি হইতে উঠিয়াছে এবং উহার খুদিয়া-বাহির করা পাপ্ড়িগুলা ঝরিয়া পড়িতেছে.. আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পকলা ন্যূনাধিকপরিমাণে এই ভূষণের অনুকরণ করিয়াছে, কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে এইপ্রকার সৌধ-অলঙ্কার খুবই প্রচলিত ছিল।
সমস্ত আশ্চর্য্য পদার্থের মধ্যে আশ্চর্য্যতম পদার্থ সেই ধবল পাথরের ‘গরাদে’, যাহা স্বচ্ছ দালানের মধ্যস্থলে সমাধিপ্রস্তরটিকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে; এ সমস্ত কতকগুলি ‘খাড়া’ মার্ব্বেল-ফলক; উহাতে এত সূক্ষ্ম জালি-কাটা কাজ যে, মনে হয়, যেন গজদন্ত-ফলকে ফোঁড় কাটা; উহার চারিধারে সেই ছোট-ছোট ফুলের মালার পাড়; Lapis, ফিরোজা, পদ্মরাগ, porphyre প্রভৃতি মণি বসাইয়া এই সকল ফুল রচিত হইয়াছে।
এই ধবল গম্বুজটির শব্দযোনিতা এত অধিক যে, মনে একটু ভয়ের সঞ্চার হয়;—উহার প্রতিধ্বনি যেন আর থামে না। যদি কেহ ‘আল্লা’র নাম উচ্চারণ করে, তাহার সেই অতিবর্দ্ধিত কণ্ঠস্বর কয়েক সেকেণ্ড পর্য্যন্ত স্থায়ী হয় এবং ‘অর্গ্যানে’র আওয়াজের মত আকাশে উহার রেশ চলিতে থাকে—যেন আর শেষ হয় না।
৯০মাইল আরো উত্তরে, দিল্লীনগরের ভীষণ প্রাকারের পশ্চাদ্ভাগে, মোগল বাদ্শাদিগের আর একটি প্রাসাদ; উহা বিভবমহিমায় আগ্রার প্রাসাদকেও অতিক্রম করে।
বড়-বড়-ছুঁচাল-খিলান-সমন্বিত দিল্লির এই প্রাসাদটি একটা অদৃশ্য পুরাতন উদ্যানের মধ্যে অধিষ্ঠিত; চারিদিক্ রুদ্ধ; উহার দস্তুর অত্যুচ্চ প্রাকারাবলী দর্শকের মনে বিষাদময় ঘোর কারাগারের ভাব আনিয়া দেয়।
কিন্তু উহা যে-সে কারাগার নহে—উহা দৈত্যদানবের কিংবা পরীদিগের কারাগার; সুকুমার শিল্পগরিমায় কোন মানবপ্রাসাদ উহার সমকক্ষ হইতে পারে না। বলা বাহুল্য, উহারও সমস্তই ধবল মার্ব্বেল নির্ম্মিত; সমস্তই খুদিয়া বাহির-করা;—গম্বুজের প্রকাণ্ড ভিতর-পিঠ প্রস্তরচূর্ণের মস্লায় নির্ম্মিত। কিন্তু ইহার এই স্থায়ী ধবলতার সহিত সোনার রং প্রচুরপরিমাণে মিশিয়াছে। মার্ব্বেলের চেক্নাই-এর উপর সোনার কাজ বসাইলে তাহার যে একটা বিশেষ ‘খোলতাই’ হয়, তাহা সকলেই জানে। দেয়ালের ও গম্বুজের ভিতর-পিঠে যে সব অগণ্য লতাপাতার অতি সূক্ষ্ম কাজ খুদিয়া বাহির করা হইয়াছে, তাহা স্বর্ণ দিয়া রঞ্জিত।
দেয়ালের যে-সকল বড়-বড় ফুকর দিয়া বিষন্ন উদ্যানটি দেখা যায়, শুধু সেই সকল ‘ফুকরের মধ্য-দিয়াই যাহা-কিছু আলো ভিতরে প্রবেশ করে। স্তম্ভশ্রেণী ও খাঁজ-কাটা ‘খিলান—একটার-পর-একটা সারি-সারি বরাবর চলিয়া-গিয়া, দূর প্রান্তের অর্দ্ধচ্ছায়াচ্ছন্ন নীলিমার গর্ভে বিলীন হইয়াছে, কিন্তু সমস্ত প্রাসাদটিতে ধবল-প্রস্তরের শুভ্র স্বচ্ছতা পূর্ণভাবে বিরাজমান।
যে দালানে সিংহাসন ছিল (সেই জনশ্রুত নিরেট সর্ণপিণ্ড ও পান্নার সিংহাসন), সেই সমস্ত দালানটি শাদা ও সোনালি রঙের। তা ছাড়া, উচ্চ মার্ব্বেল-দেয়ালে গোলাপগুচ্ছ বিকীর্ণ; চীনাংশুকের ফুলকাটা কাজের মত উহাতে টক্টকে গোলাপ ও ফিঁকা গোলাপের অভা অতি সুন্দররূপে মিশ্রিত হইয়াছে। এবং আজকাল আমাদের দেশে যাহাকে ‘নূতন শিল্পকলা’ বলে, সেই শিল্পকলার পদ্ধতি অনুসারে প্রত্যেক পাপ্ড়িটির চারিধার দিয়া সূক্ষ্ম সোনালি পাড় বেমালুমভাবে চলিয়া গিয়াছে। তা ছাড়া, lapis-ও ফিরোজা-রচিত নীলরঙের ফুলও ইতস্তত ছড়ান রহিয়াছে।•••আনাদের স্থূলধরণের ‘scrcen’ পর্দ্দার বদলে ভারতবর্ষে যে জালি-কাটা মার্ব্বেল-ফলকের ব্যবহার ছিল, সেইরূপ জালি-কাটা মার্ব্বেল-ফলকের মধ্য দিয়া দালানের পর দালান ক্রমাগত দৃষ্টিপথে পতিত হইতেছে।
প্রাচীরবদ্ধ উদ্যানের তরুকুঞ্জে দুর্ভিক্ষবায়ুর উৎপীড়ন স্পষ্ট লক্ষিত হইতেছে;—শরতের বায়ুর মত উহা উদ্যানতরুর শেষ পাতাগুলা চতুর্দ্দিকে উড়াইয়া দিতেছে; আজ ঐ সব মরা-পাতা ঘূর্ণবাতাসে উড়িয়া এই মহানিস্তব্ধ প্রাসাদের মধ্যেও আসিয়া পড়িতেছে। উদ্যানের একটি গাছে এখনো ফুল ফুটিয়া আছে; বড়-বড় লাল ফুল বৃষ্টিধারার মত ঐ বৃক্ষ হইতে ঝরিয়া সমস্ত ধবলকুট্টিমকে—সিংহাসন-দালানের সেই অপূর্ব্ব প্রস্তরকুট্টিমটিকে ছাইয়া ফেলিয়াছে।
যেখানে মোগলবাদশারা বাস করিতেন, সেই সমস্ত দেশই এখন
- ↑ শাহাজানবাদশার পত্নী; বিবাহ হইবার চোদ্দবৎসর পরে, অষ্টম সন্তান প্রসব করিয়া, ১৭২৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়।