ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/ধ্বংসাবশেষের মধ্যে
ধ্বংসাবশেষের মধ্যে।
নগরপ্রাসাদের বিস্তীর্ণ কঙ্কালস্তূপে পরিণত হইয়াছে। এখানকার মরা-মাটীর উপর যত ধ্বংসাবশেষ, মিশরের বালুরাশির উপরেও তত নাই। সেখানে, নীল-নদের ধারে, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাষাণস্তূপ; এখানে—খোদিত মার্ব্বেল, জালিকাটা ধূসরবর্ণের প্রস্তর, প্রস্তরময় জাফ্রির কাজ—বিষন্ন মাঠময়দানের মধ্যে হারাণ জিনিষের মত ইতস্তত পড়িয়া আছে। যেখানে কত শতাব্দী ধরিয়া মানবচিন্তা ও মানব-উদ্যম অসাধারণ স্ফূর্ত্তিলাভ করিয়াছিল, সেই এই ভারতবর্ষে পূর্ব্ব-পূর্ব্ব যুগের অসংখ্য ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান; এবং উহাদের প্রাচুর্য্যে, উহাদের সৌন্দর্য্যে, আমাদের আধুনিক কল্পনা দিশাহারা হইয়া যায়। অনেকগুলি নগর যুদ্ধবিগ্রহ ও লোকহত্যার পরেই ধবংস প্রাপ্ত হয়; আবার কতকগুলি বিলাসশোভন নগর অমুক অমুক রাজার খাম্খেয়ালী-আদেশক্রমে গঠিত হইতে আরম্ভ হয়, কিন্তু সময়ের মধ্যে শেষ হয় নাই; কতকগুলি প্রাসাদ অমুক সুলতানার জন্য পরিকল্পিত হয়, কিন্তু উহা ভাস্কর শিল্পীদিগেরই ব্যবহারে আসিয়াছে,—অন্য কেহ সেখানে কখনো বাস করে নাই।
দিল্লি এবং প্রাচীন রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ, যেখানে পৃথিবীর মধ্যে বোধ হয় উচ্চতম কীর্ত্তিস্তম্ভ সেই গোলাপী পাথরের কুতব-মিনার সমুত্থিত—এই দুই স্থানের মধ্যবর্ত্তী সমস্ত পথটার দুই ধারে, কত নগর ও কত দুর্গেরই ছায়ামূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়;—ত্রিশ-চাল্লিশ ফীট্ উচ্চ দস্তুর প্রাকার, পরিখা ও পরিখার যন্ত্রসেতু; ভিতরে জনপ্রাণী নাই; সমস্তই নিস্তব্ধ; কিংবা ভিতরে প্রবেশ করিলে দেখা যায়, গড়াইয়া-পড়া শিলারাশির মধ্য হইতে, কাটাগাছের ঝোপ্ঝাড়ের মধ্য হইতে, বানরের পাল উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলাইতেছে।
তা ছাড়া, কত গোরস্থান, তাহার আর শেষ নাই। কত ক্রোশ পর্য্যন্ত সমস্ত ভূমি মৃতদেহে পরিপূর্ণ; গোরস্থানের চতুষ্কমণ্ডপ, সকল যুগেরই সমাধিস্তম্ভ পর-পর চলিয়াছে;—রাশিরাশি ভাঙাচুরা জিনিষের মধ্যে গোলকধাঁধার মত পরস্পরের সহিত যেন জড়াইয়া-পাকাইয়া রহিয়াছে।
ইহার মধ্যে কতকগুলি সমাধিমন্দির এখনো ভক্তিসহকারে বহুব্যয়ে সংরক্ষিত; আবার কতকগুলি একেবারেই প্রচ্ছন্ন—ধসিয়া-পড়া পরিত্যক্ত আরো অসংখ্য সমাধিমন্দিরের পিছনে যেন ডুবিয়া রহিয়াছে। প্রস্তররাশির মধ্য দিয়া, গর্ত্তসমূহের মধ্য দিয়া, ‘হাঁ-করা’ প্রাচীন গুহাগহ্বরের মধ্য দিয়া যে সকল পথ গিয়াছে এবং যে সকল পথ ঐ গোরস্থানে আসিয়া মিলিয়াছে, ঐ সকল পথ চেনা দুষ্কর হইত,—যদি ভিক্ষুকের দল, খঞ্জ কিংবা কুষ্ঠরোগী লোক খোঁটাচিহ্নের মত উহার চারিধারে না থাকিত। উহারা তীর্থযাত্রীদের নিকট ভিক্ষা পাইবার আশায় ঐখানে বসিয়া থাকে। এই সকল ধূলিসমাচ্ছন্ন পথ অতিক্রম করিবার পর হঠাৎ একএকটা চমৎকার মস্জিদ দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়;—জালিকাটা মার্ব্বেলের দেয়াল, লাল রেশমের কাপড়ে যেন সোনালি পাড় বসান, জম্কালো কার্পেট—যাহার উপর টাট্কা gardenia ও tubercuse পুষ্পসকল সজ্জিত রহিয়াছে। ইহার মধ্যে প্রাচীন ফকীরদর্ব্বেশের বাসগৃহগুলিই সর্ব্বাপেক্ষা বিভবময়। উহারা নিজে ইচ্ছা করিয়াই দৈন্যের মধ্যে বাস করিত ও পরম সন্ন্যাসব্রত অবলম্বন করিত; কিন্তু কোন কোন রাজা উহাদের স্মৃতিরক্ষার জন্য এইরূপ মুক্তহস্তে অর্থব্যয় করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না।
প্রাকারাবলী ও খোদিত প্রাসাদাদির বহুপূর্ব্বেই গোলাপী পাথরের মিনারটি এই মৃত্যুর দেশের দিগন্তভাগে, বহুদূর হইতে নেত্রসমক্ষে প্রকাশ পায়। শুষ্ক পাথুরে জমির তরঙ্গায়িত ক্ষেত্রের উপর দিয়া এই প্রকারপ্রাসাদাদি মিনারের পাদদেশ পর্য্যন্ত প্রসারিত রহিয়াছে। এই সমস্ত শুষ্ক পাথুরে ভূমিখণ্ডের উপর এখন শুধু রাখালরা ছাগল চরাইয়া থাকে। এখন প্রায় মধ্যাহ্ন; দুঃসহ প্রখর উত্তাপ; এই সময়ে আমি কোণালুখিলান-বিশিষ্ট যুগলদ্বার পার হইয়া এই ছায়ামূর্ত্তি নগরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। একটা শ্মশানের মত ভূমিখণ্ড—বড় বড় দস্তুর প্রাকারে বেষ্টিত এবং এত বিশাল যে, সেই ঘেরের সমস্ত আয়তন সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিগোচর হয় না। উহার ভিতরে কতকগুলা গাছ, যাহা জলাভাবে মরিয়া যাইতেছে এবং উষ্ণবায়ু যাহার স্বর্ণ-পীত পত্রপুঞ্জ চারিদিকে উড়াইয়া ফেলিতেছে; আকার-গঠনহীন কতকগুলা প্রস্তরস্তূপ; ইতস্তত দৃশ্যমান কতকগুলা গম্বুজ, কতকগুলা মিনার—এতটা ক্ষয়গ্রস্ত হইয়াছে যে, উহাদিগকে শৈলখণ্ড বলিয়া ভ্রম হয়; কেবল ঐ আশ্চর্যজনক মিনারের সন্নিকটে যে সকল গুরুভার বৃহদাকার ইমারতের অবশেষগুলি আছে, তাহা রাজকীয় মহল বলিয়া বেশ বুঝা যায়। কিন্তু এই গৌরবান্বিত ভগ্নাবশেষগুলির গঠনরীতি একপ্রকার নহে—বিভিন্ন গঠনরীতি একত্র মিশিয়া গিয়াছে; এত যুদ্ধবিগ্রহ, এত আক্রমণ এই প্রাচীন ভূমির উপর দিয়া গিয়াছে, এতবার ধ্বংস হইয়াছে, আবার অমানুষিকভাবে এতবার নূতন করিয়া গঠিত হইয়াছে যে, ইহার কোন ঠিক ঠিকানা পাওয়া যায় না। পৃথিবীর এই কোণটির ইতিহাস ঘোর তিমিরজালে সমাচ্ছন্ন।
ঐখানে—উপকথা বর্ণিত কোন রাজার প্রাসাদের মধ্যে, সহস্রবৎসরব্যাপী প্রস্তররাশির সুশীতল ছায়াতলে, আমি আজ সমস্ত নিস্পন্দ মধ্যাহ্নকালটা আপনাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিব। কয়েকঘণ্টা একাগ্রচিন্তায় কিংবা নিদ্রায় অতিবাহিত করিবার জন্য, একটি ভৃত্যও সঙ্গে না লইয়া একাকী আমি একটা উচ্চ বারাণ্ডার কোণে আপনাকে স্থাপন করিলাম—অসংখ্য চৌকো-থাম-বিশিষ্ট ও প্রাচীন ভাস্করকার্য্যে আচ্ছন্ন একটা দালানঘর হইতে এই বারাণ্ডাটি বাহির হইয়াছে। এই সমস্ত ধ্বংসাবশেষের সহিত ঘনিষ্ঠরূপে পরিচিত হইবার উদ্দেশে—আজ এখানকার যাহারা গৃহস্বামী, সেই সব পশুদের সহিত ঘনিষ্ঠরূপে পরিচিত হইবার উদ্দেশেই আমি একাকী এখানে আসিয়াছি। বাহিরে—প্রচণ্ড মার্তণ্ড এই বিস্তীর্ণ মরুভূমির উপর অনলবর্ষণ করিতেছে; পতঙ্গের গান, মক্ষিকার গুঞ্জন এখানে শোনা যায় না, কেবল দূরদূরান্তর হইতে কোন নিঃসঙ্গ টিয়াপাখীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না; উপরে, প্রাসাদের খোদাই-কাজের মধ্যে তাহার নীড়, সে প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করিয়া নিদ্রা যায়। অথবা, দুর্ভিক্ষের দম্কা-বাতাসে তাড়িত হইয়া যে-সব শুক্নাপাতা ঘোরপাক খাইতে খাইতে স্তম্ভশ্রেণীর মধ্যে আসিয়া পড়ে,—তাহারই মর্ম্মর শব্দ কচিৎ-কখন শুনা যায়।
দালান-ঘরের গুরুভার ছাদটা যে সকল প্রস্তরখণ্ডে আচ্ছাদিত, সেই প্রস্তরখণ্ডগুলা আড়াআড়িভাবে এবং কৌণিক স্তূপের আকারে উপর্য্যুপরি স্থাপিত; এগুলি অতিদীর্ঘ অখণ্ড প্রস্তর; আমাদের পুরাতন ছাদের কাঠাম যেরূপ বড়-বড় গুঁড়িকাঠের উপর স্থাপিত হইত, ইহা কতকটা সেই ধরণের। যে সময়ে গম্বুজ অজ্ঞাত ছিল, বক্র-খিলান অজ্ঞাত ছিল, কিংবা তাহার উপর লোকের সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল না—সেই সময়কার মানবজাতির শৈশবকালোচিত এই গঠনপদ্ধতি। আমার নীচে, প্রথমেই স্তম্ভের অরণ্য। থামগুলা প্রকাণ্ড,—বলা বাহুল্য, অখণ্ড পাথরের—এবং উহার চৌকোণা ধরণ দেখিয়া খুব পুরাতন হিন্দু-আমলের বলিয়া কল্পনা করা যায়। আমি যে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছায়াময় কোণটিতে বসিয়া সমস্ত দেখিতেছি, সেখানকার কতকগুলি ‘গুলগুলি’-গবাক্ষ হইতে বাহিরের জিনিষও দেখিতে পাইতেছি, লাল পাথর দেখিতেছি, ধূসরবর্ণের পাথর দেখিতেছি, বেগ্নি রঙের পাথর দেখিতেছি,—মনে হইতেছে, বাহিরের সমস্ত ধ্বংসাবশেষ অগ্নিময় সূর্য্যকিরণে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিয়াছে। আরো একটু দূরে, বায়ু এরূপ স্বচ্ছ এবং আলোটা এরূপ ঠিকভাবে পড়িয়াছে যে, আমি এখান হইতে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি—কতকগুলা দ্বারপ্রকোষ্ঠ খাড়া হইয়া রহিয়াছে—উহার কোণালু খিলানে চমৎকার খোদাই-কাজ এবং আদিম-কালের coufique অক্ষরে মুসলমানি লিপি লিখিত রহিয়াছে। এবং কোন[১] অজ্ঞাতযুগের একটি লৌহ-ধ্বজস্তম্ভ সমুত্থিত—সমস্তই কৃষ্ণবর্ণ ও সংস্কৃত অক্ষরে সমাচ্ছন্ন; উহার চারিদিকে কতকগুলা সমাধিস্তম্ভ এবং সান-বাঁধানো একটা মুক্ত প্রাঙ্গণ। পূর্ব্বে এই প্রাঙ্গণটি একটি খুব পবিত্র মস্জিদের অন্তঃপ্রাঙ্গণ ছিল। ‘পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর’ বলিয়া সেই সময়ে এই মস্জিদের খ্যাতি ছিল।
নীচে, সানের উপর ‘তুড়ুক-তাড়ুক’ লম্ফঝম্ফ!…বাচ্ছারা পিছনেপিছনে চলিয়াছে—তিনটা ছাগল প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করিল এবং কোন ইতস্তত না করিয়া, যেন চিরাভ্যস্ত এইভাবে আমার এই উপরের বারাণ্ডায় উঠিয়া আসিল এবং মাধ্যাহ্নিক নিদ্রার জন্য ছায়ায় আসিয়া শয়ন করিল। কতকগুলি কাক এবং কতকগুলি ঘুঘুও আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল। সকলেই এখন ঠাণ্ডা জায়গা খুঁজিতেছে এবং ছায়ায় বসিয়া নিদ্রা যাইবার উদেযাগ করিতেছে। এখন নিস্তব্ধতার একাধিপত্য; সেই উড়ন্ত মরা-পাতার মর্মরশব্দও এখন আর শুনা যায় না; কেন না, অন্যান্য পদার্থের ন্যায় বায়ুও এখন নিদ্রামগ্ন। আমার ঢাকা-বারাণ্ডার প্রান্তদেশে একটি ক্ষুদ্র গবাক্ষ আছে, সেখান হইতে বহির্দ্দেশ দেখা যায়; সেখান হইতে আকাশও দেখা যাইবার কথা; কিন্তু না, দেখিলাম শুধু গোলাপী ‘জমি’র উপর একটা শাদা জমি যেন অস্পষ্ট দূরদিগন্তে সটানভাবে বিলম্বিত; দেখিলাম বৃহৎ মিনারের পার্শ্বদেশ, তাহার পাথরের গোলাপী রং এবং তাহাতে যে মার্ব্বেলের টুক্রাসকল বসানো আছে, তাহার শাদা রং।…
যে বারাণসীসম্বন্ধে আমি ভয়ে-ভয়ে আছি, সেই বারাণসী-অভিমুখে যাইবার পথে এইটি আমার শেষ আড্ডা; দুইদিনের মধ্যেই আমি সেখানে পৌঁছিব; সেখানে গিয়া নিশ্চয়ই বিড়ম্বিত হইব, কিন্তু সেই মহাবিড়ম্বনা হইতে এখন আর পিছাইবার জো নাই।•••এই সব ধ্বংসাবশেষের রহস্যময় শান্তির মধ্যে, সেই বিষয়ে আমি অনেক চিন্তা করিয়াছি; আমার মন সেই সাধুসন্ন্যাসীদিগের গৃহাভিমুখে ধাবিত হইতেছে যাঁহাদের শাকান্নের আতিথ্য—যাহাদের অদ্ভুত বিস্ময়জনক আতিথ্য আমি গ্রহণ করিব বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছি।…
কিন্তু চারিদিক্কার জড়তাপ্রভাবে আমার মন নিদ্রা ও স্বপ্নে অভিভূত হইলেও, আমার কল্পনাকে এখনো সেই বৃহৎ মিনারটি অধিকার করিয়া রহিয়াছে—যাহা এক্ষণে আমার খুবই নিকটে রাজসিংহাসনে বিরাজমান। গল্প আছে, রাজকন্যার খেয়াল হইল, দিগন্তপটে দূববাহিনী একটি নদী দেখিবেন; রাজা স্বীয় দুহিতার খেয়াল চরিতার্থ করিবার জন্য উদ্ধগামী নদীর আকারে ঐ মিনার নির্ম্মাণ করাইলেন। আমার বারাণ্ডার জানালা দিয়া উহা যেমন স্পষ্ট দেখা যায়, এমন আর কোথা হইতেও নহে। একটা গোলাপী-রঙের দ্বারপ্রকোষ্ঠের পার্শ্বদেশে, ঐ গোলাপী মিনারটি অমলশুভ্র আকাশ ভেদ করিয়া উর্দ্ধে উঠিয়াছে। উহার তন্বী শ্রী, উহার উচ্চতা দর্শনে নেত্র বিহ্বল হইয়া পড়ে; অন্যান্য জানিত মিনার ও মিনারেটের যেরূপ পরিমাণ,[২] তাহা ছাড়াইয়া উঠিয়াছে; তলদেশ যেরূপ ফুলিয়া উঠিয়াছে, তাহাতে মনে হয়, যেন মিনারটি ঝুঁকিয়া রহিয়াছে; তা ছাড়া, বড়ই আশ্চর্য্য—এমন যে চমৎকার জিনিষ—এখন এমন অক্ষত ও অক্ষুণ্ন—উহা ধ্বংসাবশেষ-বিকীর্ণ মরুভূমির মধ্য হইতে উত্থিত হইয়াছে। উহার পাথর এমন মসৃণ ও উহার উপাদান-রেণু এমন সূক্ষ্ম যে, এত শতাব্দী হইয়া গেল, তবু উহাতে ‘মোর্চ্চে’ ধরে নাই এবং উহার রং এখনো যেন টাটকা রহিয়াছে। গোলাকার খোদিত-‘খোল’, যাহা তলদেশ হইতে চূড়া পর্য্যন্ত উঠিয়াছে, উহা স্ত্রীলোকদিগের গাউনের একপ্রকার রেশ্মি ভাঁজের মত; ছাতা বন্ধ করিলে সেরূপ ভাঁজ পড়ে, সমস্ত যেন সেইরূপ ভাঁজবিশিষ্ট। সমস্তটা দেখিলে মনে হয়, যেন অর্গ্যান্-পাইপের একটা বাণ্ডিল, বড়বড় তালকাণ্ডের একটা গুচ্ছ; এবং বিভিন্ন উচ্চদেশে যেন একএকটা আংটার মধ্যে ঐগুলা আবদ্ধ—যাহাকে, আংটা বলিতেছি, উহা পাথরের বারণ্ডা-ঘের; শাদা খচিত-কার্য্যের আকারে মুসলমানি লিপির দ্বারা ঐ সকল বারণ্ডা সমাচ্ছন্ন…
আমি প্রায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। …সহসা মানুষের পায়ের শব্দ—দ্রুতগমনের শব্দ! এত ঘণ্টা নিস্তব্ধতার পর, এ একটা অচিন্তিতপূর্ব্ব পরিবর্ত্তন। ১০জন লোক, একঘেয়ে-লাল বড়-বড় পাথরের উপর দেখা দিল; উত্তর প্রদেশের মুসলমান, ছুঁচাল টুপি দেখিয়া আফ্গান বলিয়া চিনিলাম; পাগ্ড়ির পাক এত নীচে দিয়া গিয়াছে যে, উহাদের কান ও চোখের কোণ তাহাতে ঢাকিয়া গিয়াছে, কেবল শুকচঞ্চু-নাসিকামাত্র বাহির হইয়া আছে। দাড়ির রং মিষ্-কালো। উহারা খুব দ্রুত চলিতেছে; মুখে খলতা ও বদমাইসি প্রকাশ পাইতেছে। আমার কোটরে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া, আমি যে উপরে আছি তাহা ইঙ্গিতেও প্রকাশ না করিয়া, উহাদের দেখিয়া আমোদ উপভোগ করিতেছিলাম। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, উহারা ভক্ত তীর্থযাত্রী, ভক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াই এইখানে আসিয়াছে। লুপ্তপ্রায় মস্জিদের সুন্দর দ্বারপ্রকোষ্ঠের সম্মুখে আসিয়া উহারা দাঁড়াইল; সমাধিস্থান চুম্বন করিবার জন্য সাষ্টাঙ্গে প্রণত হইল; তাহার পর তাড়াতাড়ি উঠিয়া আরো দুরে চলিয়া গেল; ভগ্নাবশেষের মধ্যে কোথায় মিলাইয়া গেল—আর দেখা গেল না।
এখন প্রায় তিনটা বাজিয়াছে। আবার জীবন-উদ্যম আরম্ভ হইল। সবুজ টিয়াগুলা খিলানের গর্ত্ত হইতে বাহির হইল, খোদাই-কাজের ফাঁকের ভিতর পায়ের নখ বসাইয়া কি করিবে ভাবিতে লাগিল, বহির্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল; তাহার পর চীৎকার করিতে করিতে সাঁ করিয়া উড়িয়া গেল। ছাগত্রয়ও জাগিয়া উঠিল, মুড়া ও শুক্না ঘাসের সন্ধানে বাচ্ছাদের লইয়া বাহির হইল। এবং আমিও ছায়াদেহসার নগরটিতে ভ্রমণ করিবার জন্য নীচে নামিলাম।
গৃহের ভগ্নাবশেষ, মন্দিরের ভগ্নাবশেষ, প্রাসাদ ও মস্জিদের ভগ্নাবশেষ; হেথা-হোথা শীর্ণ গাভীবৃন্দ প্রস্তরাদির মধ্যে তৃণচর্ব্বণের চেষ্টা করিতে করিতে ক্রমে প্রাচীরবদ্ধ সেই শ্মশান-বিষ ভূমিখণ্ডের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িল। যাহারা গরু চরাইতে আসিয়াছিল, সেই বুনো রাখালের চাপা আওয়াজে বাঁশী বাজাইতেছিল। তাহাদের মুখে চিন্তার ভাব, ভয়ের ভাব; চতুর্দ্দিক্স্থ দেবালয়ের ধ্বংসদশা তাহাদের মনে এই ভীতির উদ্রেক করিয়াছে। চারিদিক্ হইতেই দেখা যায় ঐ গোলাপী মিনারটি মাথা তুলিয়া রহিয়াছে; এই সার্ব্বভৌম ধ্বংসদৃশ্যের মধ্যে, উহা যেন সাক্ষিরূপে দণ্ডায়মান।
অস্পষ্ট-অনির্দ্দেশ্য চৌমাথা-রাস্তার উপর, কতকগুলা দেয়ালের গায়ে। এখনো কতকগুলা গবাক্ষ রহিয়াছে; এখনো কতকগুলা বারণ্ডা বাহির হইয়া রহিয়াছে; পূর্ব্বে সেখান হইতে সুন্দরীরা বেগ্নী পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত গজবৃন্দের গমনাগমন, সারিবন্দি বৃহৎ ছত্রের উৎসব-ঠাট্, অশ্বারোহী যোদ্ধৃবর্গের রণযাত্রা, গৌরবান্বিত, প্রাচীনকালের জনতা—এই সমস্ত নিরীক্ষণ করিত।...আহা! লুপ্ত রাজপথের কোণে-কোণে অবস্থিত এই সর নহবৎখানার কি বিষন্ন মুখশ্রী!
১৮২৭ খৃষ্টাব্দে ইহার পুনরুদ্ধার হয়।
- ↑ স্মৃতিস্তম্ভটি ২০ ফিট উচ্চ; উহার শিলালিপিতে এইরূপ লিখিত আছে যে, বাহিলকদিগের উপর জয়লাভ করিয়া রাজা ধব এই স্মৃতিস্তম্ভটি উঠাইয়াছেন। বোধ হয় ৩ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি কোন সময়ে। প্রাচীনকালের ইহা একটি অপূর্ব্ব অতুলনীয় স্মৃতিস্তম্ভ।
- ↑ এই মিনারটি ২৪০ ফীট্ উচ্চ; ইহা প্রাচীন ভারতে একটা পরমাশ্চর্য্য সামগ্রী।