ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/চিতাসজ্জা

চিতাসজ্জা।

 শীতকাল; গঙ্গার উপর; ধূসরবর্ণ সন্ধ্যা আগত প্রায়। দিবাবসানে পবিত্র নদীবক্ষ হইতে কুয়াসা উত্থিত হইয়া, সন্ধ্যা না হইতে হইতেই অস্তমান সূর্য্যকে স্নান করিয়া ফেলিল। অবনত মন্দির ও চূর্ণপ্রাসাদসমন্বিত বারাণসীর বিপুল ছায়াচিত্র পশ্চিমদিগের সম্মুখে খাড়া হইয়া উঠিয়াছে। পশ্চিমগগন এখনো প্রভাময়।

 আর-সব নৌকা নিদ্রিত; কেবল আমার নৌকাখানি চলিতেছে,—এই পবিত্র নগরীর পাদদেশ দিয়া, উহার বিরাট্‌ ছায়াতল দিয়া, অত্যুচ্চ ভগ্নমন্দির ও অতীব ঘোরদর্শন প্রাসাদাদির নীচে দিয়া—ধীরে ধীরে চলিতেছে।

 তিনবৎসরব্যাপী যে অনাবৃষ্টি দেশে দুর্ভিক্ষ আনিয়াছে, তাহাতেই নদী শুকাইয়া গিয়াছে; এবং এই কারণেই সকল জিনিষেরই উচ্চতা যেন আরো বেশী বলিয়া মনে হইতেছে। এই শুষ্কতাবশতই বারাণসীর অনাদিকালের মূলগুলা পর্য্যন্ত, ভিত্তিগুলা পর্য্যন্ত অনাবৃত হইয়া পড়িয়াছে। শতশত বৎসর হইতে, যে সকল প্রাসাদ জলের নীচে নামিয়া গিয়াছিল, তাহারই খণ্ডাংশসমূহ অচল নৌকাগুলার মধ্য হইতে ইতস্তত মাথা বাহির করিয়া রহিয়াছে। জলমগ্ন জনবিস্মৃত ভগ্নাবশেষগুলা আবার দেখা দিতে আরম্ভ করিয়াছে। বৃদ্ধা গঙ্গার ভগ্নাবশেষপূর্ণ রহস্যময় তলদেশ অল্প অল্প দেখা যাইতেছে।

 এই যে সব তটভূমি বিবস্ত্রা হইয়া পড়িয়াছে, ইহাতেই এই গঙ্গাদেবীর বিকট স্বৈরশীলার পরিচয় পাওয়া যায়; ইনি পালনকর্ত্রী ও সংহারকর্ত্রী—উভয়ই। যিনি জনয়িতা ও সংহারকর্ত্তা, সেই শিবের সহিত ইহার তুলনা হইতে পারে; প্রাবৃটে যখন নদী ভরিয়া উঠে, তখন তাঁহার ভীষণ বেগ কেহই প্রতিরোধ করিতে পারে না। সর্ব্বোন্নত পাষাণপ্রাচীর, সমগ্র প্রাকার-বপ্রাদি একটা অখণ্ড প্রস্তরখণ্ডের মত নদীর উচ্চতটের উপর গড়াইয়া পড়িয়াছে এবং পড়িয়া সেইখানেই থাকিয়া গিয়াছে; কোন জাগতিক প্রলয়বিপ্লবের পর যেভাবে ঝুঁকিয়া থাকে, সেইরূপ অচল ভঙ্গীসহকারে বিস্ময়স্তম্ভিত হইয়া যেন আপনার আসন্নপতন প্রতিমুহূর্ত্তে প্রতীক্ষা করিতেছে।

 ত্রিশচাল্লিশ ফীট্‌ উচ্চতার কমে নিরাপদ্‌ স্থানের আরম্ভ হয় নাই; সেইখানেই মনুষ্যগৃহের প্রথম গবাক্ষ উদ্ঘাটিত হইয়াছে, বারণ্ডা বাহির হইয়াছে, বলভী উঠিয়াছে। আরো নীচে গঙ্গারই একাধিপত্য, বৎসরের মধ্যে অন্তত একবার সকলকেই উহাতে ডুব দিতে হইবে; চিরদিনই উহার পবিত্র মৃত্তিকা লইয়া গায়ে লেপিতে হইবে; উহারই জন্য নিবাস-আদি নির্ম্মাণ করিতে হইবে; দুর্গের গুপ্ত-গারদের মত প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড চতুষ্কমণ্ডপ—তাহার মধ্যে গুরুভার, স্থূল ও খর্ব্বকায় দেববিগ্রহ রক্ষিত, প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড ভিত্তিভূমি, বিকট-ভীষণ প্রস্তরস্তূপ—এই সমস্ত অচল-প্রতিষ্ঠ বলিয়া মনে হয়; কিন্তু কোন-কোন সময়ে নদীর স্রোতে এরূপ ভীষণ বেগ উপস্থিত হয় যে, উহাদিগকে কাঁপাইয়া তুলে—গ্রাস করিয়া ফেলে।

 গৃহাদির উর্দ্ধে, প্রাসাদাদির উর্দ্ধে, হিন্দুমন্দিরের অসংখ্য চূড়া পশ্চিমগগনে সমুত্থিত; রাজস্থানের ন্যায় এখানকার মন্দিরের চূড়াগুলাও বড়-বড়-প্রস্তরময় ঝাউএর আকারে গঠিত, কিন্তু এখানকার এই মন্দিরচূড়াগুলা লাল—ঘোর লাল,—তাহার সহিত ম্লানাভ সোণালি-কাজ মিশ্রিত। সমস্ত বারাণসীর মন্দিরচূড়াগুলি রক্তিম—কেবল চূড়ার অগ্রবিন্দুগুলি সোনালী। নদী যেমন-যেমন বাঁকিয়া গিয়াছে—সেই অনুসারে নগরীর এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত প্রস্তরময় সোপানাবলী তটভূমির উপরে যেন পক্ষ বিস্তার করিয়া রহিয়াছে—যেন একটা প্রকাণ্ড পাদপীঠ (pedestal) উপর হইতে—যেখানে মানুষের বসতি, সেইখান হইতে—নামিয়া-আসিয়া পবিত্র জলরাশির অভিমুখে প্রসারিত হইয়াছে।

 আজিকার সন্ধ্যায়, এই বৃহৎ ঘাটের শেষ-ধাপটি পর্য্যন্ত, এমন কি, ঘাটের ভিত-দেয়ালটি পর্য্যন্ত বাহির হইয়া পড়িয়াছে। দুর্বৎসর ছাড়া এই ভিত-দেয়াল কখনো বাহির হইয়া পড়ে না—ইহা দুর্ভিক্ষ ও দুঃখদৈন্যের পূর্ব্বসূচনা। এই মহিমান্বিত বৃহৎ সোপানপংক্তি এখন একেবারেই জনশূন্য—এখানে ফলবিক্রেতা, পবিত্র গাভীবৃন্দের জন্য যাহারা তৃণবিক্রয় করে সেই তৃণবিক্রেতা, বিশেষত এই লোকপাবনী পরমরাধ্যা বৃদ্ধা নদীর উপর যে পুষ্পাঞ্জলি নিক্ষিপ্ত হয়, সেই সকল ফুলের তোড়া ও ফুলের মালাবিক্রেতা—ইহাদের দ্বারাই সোপানের ধাপগুলা দিবা দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত আচ্ছন্ন হইয়া থাকে। এবং অসংখ্য বাখারির ছাতা—যাহা সকলকেই ছায়াদান করে, সেই সকল ছাতার বাঁট মাটির মধ্যে স্থায়িভাবে পোঁতা এবং ঐ সকল ছাতা যেন প্রাতঃসূর্য্যের প্রতীক্ষায় উদয়াচলের দিকে ঝুঁকিয়া রহিয়াছে।

 এই ভাজবিহীন আতপত্রগুলি দেখিতে কতকটা ধাতুময় চাক্‌তির মত, এবং যতদূর দৃষ্টি যায়, নগরীর সমস্ত প্রস্তরময় তলদেশ এই সকল আতপত্রে সমাচ্ছন্ন। দেখিলে মনে হয়, যেন ঢালের ক্ষেত্র প্রসারিত।

 ম্লানপ্রভু আলোকচ্ছায় সন্ধ্যার আগমনবার্ত্তা জানাইয়া দিল এবং হঠাৎ শৈত্যের আবির্ভাব হইল। বারাণসীতে আসিয়া ধূসর আকাশ ও শীতের লক্ষণ দেখিব, এরূপ প্রত্যাশা করি নাই।

 প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড তমোময় পাষাণপিণ্ডের পাদদেশ দিয়া, তটভূমি ঘেঁষিয়া আমার নৌকা স্রোতের মুখে নিঃশব্দে চলিয়াছে।

 নদীতটের একটা বীভৎস কোণে, প্রাসাদের ভাঙাচূরার মধ্যে, কালো মাটি ও পাঁকের উপর, তিনটি ছোট-ছোট চিতা সজ্জিত; ‘ন্যাক্‌ড়া’-পরা কতকগুলা কদাকার লোক তাহাতে আগুন ধরাইবার চেষ্টা করিতেছে; উহা হইতে ধোঁয়া বাহির হইতেছে—কিন্তু আগুন জ্বলিতেছে না। এই চিতাগুলা অদ্ভুদ আকারের,—দীর্ঘ ও সরু। এইগুলা শবদাহের কাঠ। নদীর দিকে পা করিয়া প্রত্যেক শব আপন-আপন চিতাশয্যায় শয়ান; কাছে গিয়া দেখিতে পাইলাম, ডালপালার টুক্‌রার মধ্যে পায়েরবুড়ো-আঙুল কানি দিয়া জড়ান; কানি হইতে আঙুলটা একটু বাহির হইয়া রহিয়াছে—উঠিয়া রহিয়াছে। এই চিতাগুলা কি ক্ষুদ্রাকার; সমস্ত শরীরটা এত অল্প কাষ্ঠে দগ্ধ হয়!

 আমার নৌকার হিন্দু মাঝি আমাকে বুঝাইয়া দিল—“ও-সব গরিবদের চুলো। ওর চেয়ে ভাল কাঠ কিন্‌তে ওদের পয়সা জোটে না—তাই খারাপ ভিজে-কাঠ এনেছে।”

 এক্ষণে পূজা-অর্চ্চনার সময় উপস্থিত। মহাসমারোহে সান্ধ্যপূজার অনুষ্ঠানাদি আরম্ভ হইল। উত্তরীয়বস্ত্রে অবগুণ্ঠিত হইয়া ব্রাহ্মণেরা সোপান-ধাপ দিয়া নামিতে লাগিল; পবিত্র জল লইবার জন্য, স্নানের জন্য, এবং ব্রাহ্মণের অবশ্য-পাল্য কতকগুলি ধর্ম্মানুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য তারা সিঁড়ির নীচে পর্য্যন্ত নামিয়া আসিল; পাথরের ধাপগুলা, যাহা একেবারেই জনশূন্য ছিল, এক্ষণে নিঃশব্দে জনপূর্ণ হইল; সর্ব্বসাধারণের পূজা-অর্চ্চনার জন্য নদীর পারে অসংখ্য ডোঙা, প্রাসাদমন্দিরাদির ছায়াতলে অসংখ্য বাঁশের মাচা সাজান রহিয়াছে; এই সমস্ত বসিবার স্থান ভক্তজনে পূর্ণ হইয়া গেল; তাঁহারা সংযতচিত্ত হইয়া স্থিরভাবে ধ্যানাসনে উপবিষ্ট হইলেন। এবং অনতিবিলম্বেই, এই বিপুল জনতার চিন্তারাশি সেই অতলস্পর্শ পরপারের অভিমুখে উড্ডীন হইল—যাহার মধ্যে কিছুকাল পরে আমাদের সকলেরই এই ক্ষণস্থায়ী ‘অহং’গুলা বিলীন হইবে—তমসাচ্ছন্ন হইয়া পড়িবে।

 সেই শ্মশানকোণটিতে সেই ধূমায়মান তিনটি চিতার সন্নিকটে, কাপড়জড়ানো আরো দুইটি মনুষ্যমূর্ত্তি দেখা যাইতেছে—উহারা নদীর জলে অর্দ্ধনিমজ্জিত; উহাদের প্রত্যেকেই একএকটা হাল্‌কা খাটিয়ার উপর শুইয়া আছে; উহাদের জন্য যে চিতা সজ্জিত হইতেছে, তদুপরি স্থাপিত হইবার পূর্ব্বেই পাশ্ববর্ত্তী অন্যান্য জীবন্ত লোকের ন্যায় উহারাও গঙ্গার পূতজলে স্নান করিয়া লইতেছে।

 পরপারের তটভূমি—পঙ্ক ও তৃণাদিতে আচ্ছন্ন অসীম ক্ষেত্র, যাহা প্রতিবৎসরেই গঙ্গার মধ্যে নিমজ্জিত থাকে—এই তটভূমির উপর সন্ধ্যার কুয়াসা ক্রমেই ঘনাইয়া আসিতেছে; প্রথমে ঐ তটভূমির উপর একট অনির্দ্দেশ্য ধোঁয়া-ধোঁয়া ভাব দেখা যাইতেছিল; ক্রমে এই সব কুয়াসা আকাশের মেঘের মত একএকটা সুগঠিত আকার ধারণ করিতে লাগিল। মনে হইল, যেন এই পবিত্র বৃহৎ-নগরী, পদতলস্থ জলদ-চূড়াগুলা নিরীক্ষণ করিবার জন্য অর্দ্ধচক্রাকারে খাড়া হইয়া উঠিয়াছে।

 শ্মশানের ঐ কোণটিতে একজন যুবা সন্ন্যাসী দণ্ডায়মান, বক্ষের উপর বাহুদ্বয় আড়াআড়িভাবে বিন্যস্ত এবং ঐ আর্দ্র চিতার মধ্যে কি-একটা ঘোর ব্যাপার চলিতেছে, তাহাই দেখিবার জন্য সেই দিকে মাথা ঝুঁকাইয়া রহিয়াছে। তাহার চুলগুলা কাধের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে, তাহার নগ্নদেহ যাহা এখনো পর্য্যন্ত সুন্দর ও মাংসল—শ্বেতচুর্ণে আচ্ছন্ন; এবং যেরূপ ফুলের মালা প্রতিদিন নদীতে নিক্ষিপ্ত হইয়া থাকে, সেইরূপ একটা ফুলের মালা তাহার বক্ষের উপর বিলম্বিত।

 চিতাগুলার একটু উপরে,—বহুকাল হইতে নদীব উপর গড়াইয়া পড়িয়াছে এমন একটা পুরাতন প্রাসাদের উপরিভাগে, ধুতি-কাপড়ে আচ্ছাদিত ৫/৬জন লোক উবু হইয়া বসিয়া আছে, ঐ সন্ন্যাসীর মত উহারাও অনন্যমনে ঐ দিকে তাকাইয়া রহিয়াছে! উহারা ঐ মৃতদিগের আত্মীয়জন; বিশেষত উহাদের মধ্যে দুইজন, যাহাদের দেহ বার্দ্ধক্যে নত হইয়া পড়িয়াছে, উহারা—তিনটা চিতার মধ্যে যেটি সর্ব্বাপেক্ষা ছোট ও গরিব-ধরণের, সেইটির দিকে আকুলভাবে তাকাইয়া রহিয়াছে। আমার হিন্দুমাঝি বলিল, “ওটি দশবৎসরের একটি ছোট ছেলে,—উহাকে পোড়াইবার জন্য উহারা খুব অল্প কাঠ আনিয়াছে।” ঐ চিতা হইতে ধুমরাশি উত্থিত হইয়া ঐ অচলমূর্ত্তি লোকগুলার দিকে ধাবিত হইল। যাহারা দাহ করিতেছিল, তাহাদের মধ্যে দুইজন একটা অতীব কদর্য্য ন্যাক্‌ড়া কটিদেশ হইতে টানিয়া-লইয়া চিতায় ক্রমাগত বাতাস দিতে লাগিল—ক্রমে চিতাটা ধোঁয়াইতে আরম্ভ করিল; এইবার উহাদের শিশুটির দেহ ভস্মসাৎ হইবে। এবং চতুর্দ্দিকের এই সমস্ত মন্দিরপ্রাসাদাদি—যাহা কুয়াসাচ্ছন্ন আকাশ ভেদ করিয়া উর্দ্ধে উঠিয়াছে, উহারা সদর্প ঔদাস্যসহকারে ও পরমনির্ব্বিকারচিত্তে এই শ্মশান-কোণটির উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া দরিদ্র শবের বিলম্বিত দাহকার্য্য অবলোকন করিতেছে—সেই শ্মশান, যেখানে সমস্ত রক্তমাংসের শেষ হয়, মৃত্যুতে সমস্ত দুঃখকষ্টের অবসান হয়।

 এই সময়ে, বিরাট্‌ সোপানাবলীর শীর্ষদেশে, চিতার আর একটি নূতন আহুতি আসিয়া উপস্থিত হইল; এই পঞ্চম শবটি, ঐ উপরের একটি ছায়াময় সরুপথ হইতে বাহির হইয়া এই বৃদ্ধা গঙ্গার অভিমুখে আসিতেছে; উহারও ভস্মরাশি গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হইবে। ডুলির আকারে বাঁশের কতকগুলা শাখা পাশাপাশি বাঁধা, তাহার উপর শবটি রহিয়াছে; ‘ট্যানা-পরা অর্দ্ধনগ্ন ছয়জন লোক উহাকে লইয়া আসিতেছে। শবের পা সম্মুখে বাহির হইয়া রহিয়াছে এবং পথটা এত বেশী ঢালু যে, মনে হইতেছে যেন শবটা প্রায় খাড়া হইয়া রহিয়াছে। কেহই অনুগমন করিতেছে না, কেহই কাঁদিতেছে না। কতকগুলি বালক, যাহারা স্নানের জন্য নীচে নানিতেছে, তাহারও যেন উহাকে দেখিয়াও দেখিতেছে না, উহার চতুর্দ্দিকে উৎফুল্লভাবে লাফালাফি করিতেছে। বারাণসীতে আত্মাই শুধু ধর্ত্তব্যের মধ্যে; তাই আত্মা চলিয়া গেলে যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহাকে তৎক্ষণাৎ বিযুক্ত ও অপসারিত করা হয়। প্রায় দরিদ্রেরাই শবের সঙ্গে সঙ্গে শ্মশানে আইসে; তাহাদের ভয় হয়, পাছে দাহের জন্য কাঠে না কুলায় এবং পাছে দাহের পর দাহকেরা শবের অদগ্ধ অংশ গঙ্গায় নিক্ষেপ করে।

 বড়-বড় উজ্জ্বল নক্‌সা-কাটা একটা লাল মল্‌মল্‌বস্ত্রে এই শবের দেহ আচ্ছাদিত; এবং উহার কটিদেশে কতকগুলা শাদা ও লাল ফুল গোঁজা। ইহা যে একটি রমণীমূর্ত্তি, প্রথমত এই পুষ্পসজ্জাতেই তাহা জানা যায়; তা ছাড়া, মৃত্যুর হিমময়-বিকৃতাবস্থা-সত্ত্বেও পাত্‌লা কাপড়ের ভিতর দিয়া উহার নারীসৌন্দর্য্য দিব্য প্রকাশ পাইতেছে! আমার মাঝি বলিল—“উনি একজন ধনিলোকের মেয়ে; দেখ না, ওঁর জন্য কেমন খাসা কাঠ আনা হয়েছে।”

 এই শবের দাহ দেখিবার প্রতীক্ষায়, এই গঙ্গার উপর,—এই আবিল, পীতাভ, পঙ্কিল জলের উপর আমার নৌকা থামাইলাম,—যে জল তৃণাদিতে, আবর্জ্জনারাশিতে, ফুলের পাপ্‌ড়িতে, ফুলের মালায় নিত্য আচ্ছন্ন এবং যাহা হইতে পচাগন্ধ নিয়ত উচ্ছ্বসিত হইতেছে। গোলাপ, রজনীগন্ধ, বিশেষত হল্‌দেফুল গাঁদা, কুঁদফুলের মালা প্রভৃতি যাহা এই পবিত্র বৃদ্ধা গঙ্গার বক্ষে পুষ্পাঞ্জলিরূপে প্রতিদিন নিক্ষিপ্ত হয়—এই সমস্ত ফুল জলের উপর ভাসিতেছে, গাঁজিয়া উঠিতেছে। ধবল ফেনপুঞ্জ, কিনারায় সঞ্চিত কাদার ফেনা, তাহার উপর ছড়ান গাঁদাফুল—ইহার সহিত মনুষ্যবিষ্ঠা মিশ্রিত হইয়া সমস্তই পচিয়া উঠিয়াছে।

 শববাহকেরা, একটা পরিত্যক্ত জঘন্য জিনিষের মত এই সুন্দরীর মৃতদেহকে লইয়া নীচে নামিতেছে; যখন একেবারে জলের ধারে আসিল—আমার খুব নিকটে আসিল,—অন্তর্জলীর জন্য শবকে জলের মধ্যে নিমজ্জিত করিল; এবং উহার মধ্যে একজন লোক শবের উপর ঝুঁকিয়া জন্মের মত শেষবার তাহার মুখটি দেখিয়া লইল এবং অন্ত্যেষ্টির পদ্ধতি অনুসারে করতলে একটু গঙ্গাজল লইয়া তাহার মুখের মধ্যে ঢালিয়া দিল। সেই সময়ে আমি দেখিতে পাইলাম— দুইটি দীর্ঘায়ত চক্ষু মুদ্রিত—নেত্রপল্লব কৃষ্ণ পক্ষ্মরাজিতে বিভূষিত; ঋজু নাসিকা,—নাসিকার পার্শ্বদ্বয় সুকুমার; ফুল্ল কপোল; ওষ্ঠাধরের গঠন অতীব সুন্দর—ধবলকান্তি মুখের উপর ওষ্ঠদ্বয় অর্দ্ধোদ্ঘটিত হইয়া রহিয়াছে। রমণী যে পরমা সুন্দরী ছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই; যখন ইঁহার দেহ সবল-সুস্থ ছিল, পূর্ণ-যৌবনে ইঁহার রূপ ঢল্‌ঢল্‌ করিতেছিল, বোধ হয় সেই সময়ে হঠাৎ কোন রোগে আক্রান্ত হইয়া ইনি মৃত্যুগ্রাসে পতিত হন; তাই ইহার মুখে এখনো বিকৃতির লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। তা ছাড়া, ইনি যে লাল বস্ত্রখণ্ডে আচ্ছাদিত, তাহা জলে ভিজিয়া স্বচ্ছ হইয়া উঠিয়াছে এবং উহার বক্ষ ও কটিদেশের উপর এমন আঁটিয়া ধরিয়াছে যে, উঁহার সৌন্দর্য্যকে যথেষ্টপরিমাণে ঢাকিয়া রাখিতে পারিতেছে না।…এই সৌন্দর্য্যরাশি কতকগুলা স্থূলরুচি বাহকের হস্তে সমর্পণ করা হইয়াছে এবং মুহূর্ত্তের মধ্যে সমস্তই ধ্বংস হইয়া যাইবে।...আর যে দুইজনের শব সেখানে অপেক্ষা করিতেছিল, তাহার মধ্যে একজনের পালা এইবার উপস্থিত; ইহা একজন পুরুষের শব, শাদা মলমলে আচ্ছাদিত; পবিত্র জলে স্নান করাইয়া, তাহাকেও চিতার উপর রাখা হইল। ইহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এখনো কঠিন ও আড়ষ্ট হইয়া যায় নাই; মুহূর্ত্তের জন্য উহার মস্তক একবার ডাইনে ও একবার বামে ঢলিয়া পড়িল; তাহার পর, কাষ্ঠউপাদানের উপর একেবারে স্থির হইয়া রহিল; ডালপালায় উহাকে আচ্ছাদিত করিয়া, পায়ের দিকে আগুন ধরান হইল। সেই ছোট বালকটির মৃতদেহ এখনো দাহ হইতেছে; তাহার কৃষ্ণাভ ধূমরাশি তাহার সেই জনকজননীর দিকে উড়িয়া আসিতেছে;—সেই অচলমূর্ত্তি দুইটি প্রাণী, যাহারা একদৃষ্টে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিয়াছে।

 এইবার পাখীদের শয়নকাল নিকটবর্ত্তী; ভারতে, বিশেষত বারাণসীতে পাখীদের গৌরব চিরকালই খুব বেশী; দাঁড়কাকের মৃত্যুকে ডাকিতেছে, পায়রার ঝাঁক, পাণ্ডুবর্ণ আকাশতলে যাতায়াত করিতেছে; এবং প্রত্যেক মন্দিরচূড়ায় একএকটা বিশেষ ঝাঁক আছে, তাহারা সেই চূড়ারই চতুর্দ্দিকে ঘোরপাক দিয়া চক্রাকারে উড়িয়া বেড়ায়। নদীসমুত্থিত কুয়াস ক্রমেই ঘনাইয়া আসিতেছে, সন্ধ্যাবায়ু ক্রমেই শীতল হইয়া আসিতেছে এবং গলিত দ্রব্যাদির দুর্গন্ধে ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিতেছে। সেই নবযৌবনা দেবীমূর্ত্তির চিতারোহণ দেখিবার জন্য আরো কিছুক্ষণ আমার এখানে থাকিবার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু তাহা হইলে অনেক বিলম্ব হইবে; তা ছাড়া, বিশ্বাসঘাতক ঐ লাল বস্ত্রখণ্ড দেবীর সমস্ত দেহষষ্টিকে এমনভাবে অনাবৃত করিয়া রাখিয়াছে যে, দেখিতে বড়ই সঙ্কোচবোধ হয়; এ সময়ে এতটা দেখা একপ্রকার দেবাবমাননা;—কেন না, উনি এখন মৃত। না, যখন দাহের সময় হইবে, বরং সেই সময়ে, একটু পরে আবার এখানে অসিব। এখন এখান হইতে যাওয়া যাক্‌।

 কি অক্লান্ত-প্রলয়ঙ্করী এই গঙ্গা! কত প্রাসাদ ইহার স্রোতে চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে! প্রাসাদসমুহের সমগ্র মুখভাগ স্খলিত হইয়া অটুটভাবে নীচে নামিয়া আসিয়াছে এবং অর্দ্ধনিমজ্জিত হইয়া ঐখানেই রহিয়া গিয়াছে। আর এখানে দেবালয়ই বা কত! নীচেকার যে সকল মন্দির নদীর খুব ধারে, উহাদের চূড়াগুলা ইটালীর ‘পিজা’-স্তম্ভের ন্যায় ঝুঁকিয়া রহিয়াছে এবং উহার মূলদেশ এরূপ শিথিল হইয়া গিয়াছে যে, প্রতিবিধানের কোন উপায় নাই। কেবল উপরের মন্দিরগুলা প্রস্তররাশির দ্বারা—সর্বকালের রাশীকৃত পাষাণভিত্তির দ্বারা সংরক্ষিত হওয়ায়, উহাদের রক্তিম চূড়াগ্রভাগ কিংবা সোনালী চূড়াগ্রভাগ এখনো সিধা রহিয়াছে এবং আকাশ ভেদ করিয়া উর্দ্ধে উঠিয়াছে, এবং এই প্রত্যেক চূড়ার সঙ্গে এক-এক ঝাক কালো পাখাও রহিয়াছে।—খুঁটিনাটি করিয়া দেখিতে গেলে, এ দেশের এই মন্দিরচূড়াগুলার আকারে একপ্রকার রহস্যময় ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। আমি ইতিপূর্ব্বে আমাদের “গোরস্থানের বৃহৎ ঝাউগাছের” সহিত ইহার তুলনা দিয়াছি, কিন্তু কাছে আসিয়া দেখিলে আরো অদ্ভুত বলিয়া মনে হয়; ইহা যেন, বাণ্ডিলের মত বাঁধা ছোট-ছোট চূড়ার সমষ্টি, ছোট-ঘোট অসংখ্য একইরকমের জিনিষ, ইহার এই অপরিবর্ত্তনীয় আকার শতশত বৎসর হইতে সমান চলিয়া আসিতেছে। আমাদের পাশ্চাত্য বাস্তুবিদ্যার পরিজ্ঞাত কোনকিছুরই সহিত ইহার সাদৃশ্য নাই।

 এক্ষণে বারাণসীর সমস্ত ব্রাহ্মণমণ্ডলী এই গভীরসলিলা নদীর ঘাটে আসিয়া সমবেত হইয়াছে; তীরে বাঁধা ছোটছোট অসংখ্য ডিঙীনৌকা উপাসকদিগের ভারে নত হইয়া পড়িয়াছে—জলের ভিতর অনেকটা ডুবিয়া গিয়াছে। উহাদের মধ্যে কেহ বা অঞ্জলিবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে, কেহ বা জলের উপর পুষ্পনিক্ষেপ করিতেছে। এই সমস্ত লোকের উর্দ্ধদেশে ধূসরবর্ণের সোপান, ধূসরবর্ণের সোপানভিত্তি; এই সমস্ত গাঁথুনির গঠন ভারী-ধরণের ও রং পাঁকের মত। দেখিলে মনে হয়, যেন পবিত্র বারাণসীর মূলগুলা পর্য্যন্ত বাহির হইয়া পড়িয়াছে।

 আবার আমার নৌকা ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল, অপেক্ষাকৃত নির্জ্জন ঘাটের সম্মুখ দিয়া চলিতে লাগিল; এই অঞ্চলটায় কেবল পুরাতন প্রাসাদ, নদীর ধারে কোন ডিঙা বাঁধা নাই। গঙ্গার উপর চতুষ্পার্শ্ববর্ত্তী রাজাদিগের একএকটা নিবাসগৃহ—একটু ‘পোড়ো’-ধরণের—তাহারা সময়ে সময়ে সেইখানে আসিয়া বাস করেন। প্রথমেই গুরুপিণ্ডাকার প্রকাণ্ড প্রাকার সিধা উঠিয়াছে, তাহাতে কোন প্রকার ছিদ্রপথ নাই, কেবল খুব উপরদিকে,—এই সমস্ত দুর্ভেদ্য আবাসগৃহের গবাক্ষ, বারণ্ডা, জীবন আরম্ভ হইয়াছে। আজ সন্ধ্যায় প্রাসাদের ভিতরে সঙ্গীত হইতেছে—এ সঙ্গীতের সুর চাপা, কাঁদুনে, ও অল্পদমের। শানাইয়ের কাঁদুনি শুনা যাইতেছে—শানাইয়ের আওয়াজটা কতকটা আমাদের hautbois-যন্ত্রের আওয়াজের মত। মাঝে মাঝে একটি মাত্র তান, একটি মাত্র বিলাপধ্বনি উপরে উঠিতেছে, আবার মরিয়া যাইতেছে; তাহার পর, ক্ষণকাল নিস্তব্ধ,—এই নিস্তব্ধতার সময়ে কাক একবার ডাকিয়া গেল—তাহার পরেই আবার একটা তান যেন উতরের মত অন্য এক প্রাসাদ হইতে আসিয়া পৌঁছিল। তা-ছাড়া, ঢাকঢোলের বাদ্যও শুনা যাইতেছে—যেন গুহাগহ্বরের মধ্য হইতে আওয়াজ বাহির হইতেছে। আর যেন খুব বিলম্বে-বিলম্বে ঢাকের উপর ঘা পড়িতেছে।...ঐ অতি উচ্চে, অতি দূরে, ঐ সমস্ত সঙ্গীতের রহস্যময় অনির্দ্দেশ্য বিষণ্ন সুর আমার মাথার উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে—এদিকে, এই নীচে জলের উপর আমার নৌকা মৃত্যু আঘ্রাণ করিতে করিতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছে! আমার নিকট এই সমস্ত বাদ্যধ্বনি যেন সেই তরুণীর মৃত্যুজনিত শোকসঙ্গীত। সেই মৃত্যুর দৃশ্যই অষ্টপ্রহর আমার মাথায় যেন ঘুরিতেছে,—আমার কল্পনায় জাগিতেছে। আমার নিকট ইহা শোকসঙ্গীত বলিয়া মনে হইতেছে—আরো অন্যলোকের জন্য, যাহারা আর নাই—আরো অন্য জিনিষের জন্য, যাহা আর নাই।

 যেমন আমি মনে করি নাই,—এই পবিত্র নগরীতে আসিয়া ধূসর আকাশ দেখিব, শীতের ভাব দেখিব, সেইরূপ ইহাও ভাবি নাই—আমার মনের ভাব পূর্ব্বের মতই থাকিবে,—পূর্ব্বেরই মত জীবজগতের ও বাহ্যজগতের নবনব সৌন্দর্য্যে বিমুগ্ধ হইব। বারাণসী—যাহার দ্বিতীয় নাই—যাহা ধর্ম্মের কেন্দ্রস্থল, যাহা পৃথিবী হইতে বিচ্ছিন্ন একটি বৃহৎ দেশের হৃদয়,—সেই বারাণসীতে আসিয়া, সাধুদের সংসর্গে ও তাঁহাদের প্রসাদে আমারও কিছু বৈরাগ্য জন্মিবে, আমিও কিছু শান্তি পাইব—এই আমার আশা ছিল। সাধুরা কৃপা করিয়া আমাকে গুহ্যধর্ম্মে অল্পস্বল্প দীক্ষা দিবেন বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছেন—এই দীক্ষার অনুষ্ঠান কল্য হইতে আরম্ভ হইবে। কিন্তু দেখ, এইখানে আসিয়া,—যাহা-কিছু দেখিতে সুন্দর, যাহা কিছু ভৌতিক, যাহা-কিছু মায়াময় ও মৃত্যুর অধীন, তাহাতেই যেন আমি পূর্ব্বাপেক্ষা আরো অধিক আসক্ত হইয়া পড়িতেছি—ঘোরতর আসক্ত হইয়া পড়িতেছি—উদ্ধারের কোন উপায় দেখি না।…

 আবার সেইসব চিতার নিকট ফিরিয়া আসিলাম।...এইবার প্রকৃত সন্ধ্যার আবির্ভাব হইয়াছে; পাখীদের আকাশভ্রমণ শেষ হইয়াছে; উহারা মন্দিরপ্রাসাদাদির প্রত্যেক কার্ণিসের উপর রাত্রিবাসের জন্য একটা দীর্ঘ রজ্জুর আকারে সারি সারি বসিয়া গিয়াছে—পাখার ঝাপ্‌টাঝাপ্‌টিতে রজ্জুটা যেন স্পন্দিত হইতেছে—আজিকার মত ইহাই উহাদের শেষ ঝাপ্‌টাঝাপ্‌টি। মন্দিরচুড়াগুলা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আর দেখা যাইতেছে না;—কালো-কালো বৃহৎ ঝাউগাছের আকার ধারণ করিয়া পাণ্ডুবর্ণ আকাশের অভিমুখে সমুত্থিত হইয়াছে। ফুল, ফুলের মালা, পত্র তৃণাদির জঞ্জাল টানিয়া-লইয়া আমার নৌকা আবার সেই চিতার নিকট ফিরিয়া আসিল।

 একটা স্থূল গন্ধ,—মৃত্যুর গন্ধ, বীভৎস গলিতদ্রব্যের গন্ধ ক্রমশ বাড়িতে লাগিল। ঠিক্‌ যেখানটায় চিতার ধোঁয়া উঠিতেছে, তাহার নিকটে উপনীত হইবার জন্য আবার আমাকে সেই ধ্যানমগ্ন লোকদিগের পাশ দিয়া—সেই অচলমূর্ত্তি ব্রাহ্মণদিগের ভারে ভারাক্রান্ত অসংখ্য ডিঙীর পাশ দিয়া যাইতে হইল। এই সমস্ত লোক, যাহারা যোগানন্দে আত্মহারা, যাদের মুখ ভস্মে আচ্ছন্ন, যাহাদের জ্বলন্ত চক্ষু আমার চক্ষুর উপর নিপতিত—অথচ যাহারা আমাকে দেখিয়াও দেখিতেছে না—ইহাদের গা ঘেঁষিয়া আমার নৌকা চলিতেছে, তবু যেন আমার মনে হইতেছে—আমাদের মধ্যে কি-একটা অনির্দ্দেশ্য দূরত্বের ব্যবধান রহিয়াছে।

 শ্মশানের সেই কোণটিতে আমার পোঁছিতে একটু বেশী বিলম্ব হইল। একটা বৃহৎ চিতা—ধনিলোকের চিতা দাউ-দাউ করিয়া জ্বলিতেছে—এবং তাহা হইতে স্ফুলিঙ্গ ও শিখারাশি প্রবলবেগে উর্দ্ধে উঠিতেছে। চিতার মাঝখানে সেই তরুণী, তাহার আর কিছুই দেখা যাইতেছে না, শুধু দেখা যাইতেছে তাহার শোকম্লান একটি পা—একটিমাত্র পা; যেন অতিমাত্র যন্ত্রণায়, ঐ পায়ের আঙুলগুলা পরস্পর হইতে অদ্ভুতভাবে ছাড়া-ছাড়া হইয়া রহিয়াছে। চিতা-আলোকের সম্মুখে সেই পা-খানির কৃষ্ণবর্ণ ছায়াচিত্র অতীব পরিস্ফুটভাবে প্রকাশ পাইতেছে।

 একটা ভাঙা-দেয়ালের উপরে ঘোম্‌টা-টানা, অদৃশ্যমুখশ্রী চারজন নুতন লোক উবু হইয়া বসিয়া বেশ নির্ব্বিকারচিত্তে—উদাসীন-ভাবে বলিলেও হয়—এই তরুণীকে নিরীক্ষণ করিতেছে। উহারা বোধ হয় তাহার আত্মীয়-স্বজন, একই বংশের লোক-তরুণীর রূপলাবণ্যের অঙ্কুর বোধ হয় উহাদের হইতেই নিঃসৃত।....

 এই সব লোক—যাহাদের সহিত কাল আবার মিলিত হইবার জন্য আমার ইচ্ছা হইতেছে—ইহাদের যেরূপ বিশ্বাস, তাহাতে মৃত্যু, বিচ্ছেদ, পুনর্মিলন—এই সমস্তের ধারণা কতটা বদ্‌লাইয়া যায়! এই যে তরুণীর আত্মা ইহলোক হইতে অপসৃত হইল, ইহার প্রকৃত আপনত্ব প্রায় কিছুই ছিল না; তা ছাড়া, উহার আত্মীয়দের আত্মা হইতেও উৎপন্ন হয় নাই, কিন্তু হয় ত উহা একটি বহু পুরাতন আত্মা, যুগয্‌গান্তর হইতে চৈতন্যলাভ করিয়াছে এবং যাত্রাপথে কিছুকালের জন্য উহাদের দুহিতারূপে ঐ তরু-দেহ আশ্রয় করিয়া ছিল, এইমাত্র। একটি আত্মা প্রস্থান করিল; কিছুকালের জন্য মুক্তিলাভ করিল, কিংবা চিরকালের জন্য মুক্তিলাভ করিল, তাহা কে বলিতে পারে? আরো কিছুকাল পরে—আবার আসিয়া উহাদের সহিত নিশ্চয়ই মিলিত হইবে,—কিন্তু আরো কিছুকাল পরে, আরো কিছুকাল পরে, যুগান্তরের পরে; এরূপভাবে রূপান্তরিত হইবে, পরিবর্ত্তিত হইবে যে বহুকালের পর পরস্পরের সহিত আবার মিলন হইলেও কেহ কাহাকে পূর্ব্বের সেই লোক বলিয়া চিনিতে পারিবে না—সুতরাং স্নেহমমতাও থাকিবে না, অশ্রুধারাও থাকিবে না। একই অখণ্ডের অংশসকল, যাহা বিযুক্ত হইয়াছিল, তাহা আবার পরস্পরের নিকটবর্ত্তী হইবে, একপ্রকার আনন্দহীন মোক্ষাবস্থায় উপনীত হইয়া পুনর্মিলিত হইবে।…

 সে যাহাই হউক, প্রাচীরের পাথরের উপর বসিয়া দরিদ্র-বসনে অবগুণ্ঠিত যে দুইটি জরাবনত মনুষ্যমূর্ত্তি উপর হইতে অবিচলিতভাবে মৃতশিশুর দাহকার্য নিরীক্ষণ করিতেছিল, উহাদের মধ্যে একজন দাঁড়াইয়া উঠিল এবং মুখের অবগুণ্ঠন সরাইয়া, আরো নিকট হইতে ভাল করিয়া দেখিবার জন্য ঝুঁকিয়া দেখিতে লাগিল। সেই তরুণীর চিতার আলোকে ক্ষুদ্র বালকটির মুখশ্রী সম্পূর্ণরূপে আলোকিত হইয়া উঠিল। একজন শীর্ণকায়া বৃদ্ধা যেন এইভাবে জিজ্ঞাসা করিল—“সমস্তটা ভাল করে’ পুড়েছে ত?” স্ত্রীলোকটি খুব প্রাচীন; মা অপেক্ষা দিদিমা হওয়াই সম্ভব;—কখন, কখন নাতিনাত্নী ও পিতামহীর মধ্যে কি-একটা রহস্যময় আকর্ষণ,—একটা অসীম স্নেহের বন্ধন দেখিতে পাওয়া যায়।—“সমস্তটা ভাল করে’ পুড়েছে ত?” তাহার ব্যাকুলনেত্র যেন এই ভাবটি প্রকাশ করিতেছে—“যতটা কাঠের দরকার, অর্থাভাবে তাহা কিনিয়া দিতে পারি নাই; এখন ভয় হয়, পাছে নির্দ্দয় দাহকেরা, যাহা এখনো চেনা যাইতেছে, সেই সব অদগ্ধ অংশ গঙ্গায় ফেলিয়া দেয়। আবার সে ঝুঁকিয়া ব্যাকুলভাবে দেখিতে লাগিল—ধনীদের চিতার আলোকে দেখিতে লাগিল। এদিকে দাহক, আর কিছুই অবশিষ্ট নাই ইহা দেখাইবার জন্য, একটা ডাল দিয়া পোড়া-কাঠগুলা নাড়িয়া দিল। তখন সে ইঙ্গিত করিয়া যেন এইভাবে বলিল, “হাঁ, ঠিক্‌ হয়েছে। এখন যাও; এখন ওগুলা গঙ্গায় ফেলিয়া দিতে পার।” কিন্তু তাহার দৃষ্টিতে সেই চিরন্তন মানবহৃদয়ে তীব্র বেদনা দেখিতে পাইলাম, যাহা কি ভারতে, কি অস্মদ্দেশে—সর্ব্বত্রই সমান;—যাহা আমাদের সাহস কিংবা অস্পষ্ট আশা-ভরসা সত্ত্বেও, সময়কালে আমাদের সকলের নিকটেই দুর্দ্দমনীয় হইয়া উঠে। যাহা এইমাত্র ধ্বংস হইয়া গেল, সেই ক্ষণস্থায়ী। ক্ষুদ্রমূর্ত্তিটিকে বোধ হয় উহার দিদিমা ভালবাসিত;—উহার ক্ষুদ্র মুখখানি, উহার মুখের ভাবটি, উহার হাসিটি ভালবাসিত; এখনো উহার যথেষ্ট বৈরাগ্যের উদয় হয় নাই, এবং ব্রাহ্মণের নির্ব্বিকারভাব এইবার যেন একটু খর্ব্ব হইল -কেন না, সে কাঁদিতে লাগিল।…

 যে-সব ক্ষুদ্রশিশু আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া যায়, তাহাদের নেত্রের সেই মধুর দৃষ্টিটি, কিংবা আমাদের পিতামহী প্রভৃতির সেই স্নেহের দৃষ্টিটি কিংবা তাঁহাদের সেই পলিতকেশ আমাদের নিকট আবার ফিরাইয়া দিবে,—এইরূপ কোন ধর্ম্মই কি অঙ্গীকার করিতে সাহস করে? এমন কি, যাহা সর্ব্বাপেক্ষা মধুর, সেই খৃষ্টধর্ম্মও, কি এইরূপ অঙ্গীকার করিতে সাহস করে?…

 দরিদ্র-চিতাটির শেষ-অঙ্গার ও ভস্মাবশষেগুলা একটা কাঠের হাতা করিয়া উহারা গঙ্গায় ফেলিয়া দিল।

 পাশের চিতাটির উপর সেই রূপলাবণ্যসম্পন্ন তরুণীর পা—যে পায়ের আঙুল গুলা ছাড়া-ছাড়াভাবে ছিল, সেই পা-খানি অবশেষে ভস্মরাশির মধ্যে খসিয়া পড়িল।