ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/তত্ত্বজ্ঞানীদের গৃহ
তত্ত্বজ্ঞানীদের গৃহ।
একটি পুরাতন উদ্যানের প্রান্তভাগে একটি সামান্য হিন্দুগৃহ, অত্যন্ত নিম্ন ও কালের চিহ্নে ঈষৎ চিহ্নিত; সব শাদা—চুকাম-করা; আমার জন্মভূমির সেকেলে বাড়ীর মত ঝিল্মিলিগুলা সবুজ। গৃহের ছাদ, শাদা-শাদা কতকগুলা পিল্লার উপর স্থাপিত এবং চারিপার্শ্ব হইতে বারণ্ডার আকারে সম্মুখে অনেকটা বাহির হইয়া আসিয়াছে। বেশ বুঝা যাইতেছে, এখনো আমি সেই চিরন্তন সূর্য্যের দেশেই অবস্থিতি করিতেছি। কিন্তু এই পোড়ো-ধরণের বাগানটির মধ্যে এমন কিছুই নাই, যাহা আমার চোখে বিদেশী কিংবা নিতান্ত অপরিচিত বলিয়া মনে হইতে পারে। আমাদের উদ্যানেরই মত সেই নিবিড় ছায়া, সরু-সরু পথের দুধারে সেকেলে-ধরণে-বসানো সেই ফুটন্ত গোলাপগাছ।
আমার নিমন্ত্রকেরা দয়ার্দ্র-স্মিতমুখে ও মৃদুমধুর সম্ভাষণে আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন। তাঁহাদের মুখশ্রী সুন্দর ও গম্ভীর; কৃষ্ণকুন্তলশোভিত যিশুখৃষ্টের যেন কতকগুলি পিত্তলমূর্ত্তি। তাঁহাদের অতীব মধুর দৃষ্টি আমার উপর নিপতিত হইয়া আবার তখনি যেন ঔৎসুক্যবিহীন হইয়া অন্যত্র—আরো ঊর্দ্ধে—বোধ হয় সেই সূক্ষ্মশরীরের জগতে ফিরিয়া গেল—যেখানে মৃত্যুর পূর্ব্বেই তাঁহাদের আত্মাপুরুষ কখন-কখন উড়িয়া যায়।
এরূপ শান্তিময়—এরূপ আতিথেয় গৃহ আর কোথাও নাই। যে-কেহ এখানে আসিতে চায়, তাহার জন্যই ইহার দ্বার চির-অবারিত।
তথাপি, কি-এক গভীর ও অনির্দ্দেশ্য ভীতির ভাব আমার মনকে অধিকার করিল। আমি ভয়ে-ভয়ে দ্বারে আঘাত করিলাম। আমি বুঝিয়াছিলাম, ইহাই আমার শেষ-চেষ্টা। যদি এখানে কিছু না পাই, তবে আর কোথাও কিছুই পাইব না।
এই তত্ত্বজ্ঞানীরা ধ্যানও করেন, কাজও করেন এবং অন্য হিন্দুর ন্যায় ইহারাও অতীব মধুব ধৈর্য্যসহকারে ভূচর-খেচর উভয়প্রকার জীবেরই অত্যাচার সহ্য করিয়া থাকেন। গাছের ছোট-ছোট কাঠবিড়ালী জান্লা দিয়া ইহাদের গৃহে প্রবেশ করে; চড়াইপাখী বিশ্রদ্ধভাবে ইহাদের ঘরের ছাদে বাসা বাধে। ইহাদের গৃহ পাখাতে ভরা।
মাঝের ঘরটিতে শাদা কাপড় দিয়া ঢাকা একটা তক্তাপোষ রহিয়াছে। যাঁহারা এখানে আসিয়া মিলিত হন (অনেকেই আসিয়া থাকেন), তাঁহারা এই তক্তাপোষের উপর চক্রাকারে আসনপিড়ি হইয়া বসিয়া আধ্যাত্মিক গুহ্যতত্ত্বসকল নির্ণয় করেন। ইহারা সেই সব চিন্তাশীল ব্রাহ্মণ, যাঁহাদের ললাট হয় বৈষ্ণবচৈহ্নে, নয় শৈবচিহ্নে অঙ্কিত;—যাহারা নগ্ন বক্ষে ও নগ্নপদে গমনাগমন করেন; যাঁহাদের কোমরে শুধু একটা মোটা ধুতি জড়ানো, যাঁহারা সমস্ত তত্ত্ব তন্ন-তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করেন, যাঁহারা সংসারের মোহমায়ায় ভোলেন না। ইহারা সব মহাপণ্ডিত,—পার্থিববিষয়ের প্রতি নিতান্ত উদাসীন বলিয়া যাঁহাদিগকে রাস্তার মুটে-মজুর বলিয়া ভ্রম হয়, কিন্তু যাঁহারা য়ুরোপের সূক্ষ্মতম ও আধুনিকতম দর্শনগ্রন্থসকল বিচার করিয়া দেখিয়াছেন এবং যাঁহারা প্রশান্তভাবে ও নিঃসংশয়চিত্তে তোমাকে বলিবেন—“তোমাদের দর্শনের যেখানে শেষ, আমাদের দর্শনের সেইখানেই আরম্ভ।’’
এই তত্ত্বজ্ঞানীরা—হয় একাকী, নয় সমবেত হইয়া কাজ করেন, ধ্যান করেন। একটা সামান্য মেঝের উপর কতকগুলি সংস্কৃতগ্রন্থ উদ্ঘাটিত রহিয়াছে—যাহার মধ্যে ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের গূঢ়তত্ত্বসকল নিহিত এবং যে সকল তত্ত্ব আমাদের দর্শন ও ধর্ম্মের বহুসহস্রবৎসর পূর্ব্বে প্রকাশিত হইয়াছিল। আমাদের জাতির ও আমাদের যুগের লোকদের অপেক্ষা যাঁহাদের দৃষ্টির প্রসর অনন্ত গুণে অধিক, সেই পুরাকালের তত্ত্বদর্শিগণ এই সকল অতলস্পর্শগভীর গ্রন্থের মধ্যে জ্ঞানের চরমতত্ত্বরূপ মহারত্নসকল রাখিয়া গিয়াছেন। যাহা ধারণার অতীত, তাঁহারা প্রায় তাহাকে ধারণার মধ্যে আনিয়াছিলেন; এবং তাঁহাদের রচিত গ্রন্থাদি, যাহা শতশত বৎসর ধরিয়া বিস্মৃতির মধ্যে সুষুপ্ত ছিল, আজ তাহা আমাদের মত ভ্রষ্টবুদ্ধি অধম মনুষ্যের বুদ্ধির অগম্য। তাই, এই সকল তমসাচ্ছন্ন শব্দরাশির মধ্য হইতে তমোরাশি অপসৃত হইয়া যাহাতে অল্পে-অল্পে জ্ঞানরশ্মি আমাদের নিকট প্রকাশিত হয়—আমাদের দৃষ্টির প্রসর বদ্ধিত হয়, তজ্জন্য এখনো আমাদের অনেকবৎসরের শিক্ষাদীক্ষা আবশ্যক।
মনে হয়, এই সব গ্রন্থ যদি কেহ এখন বুঝতে পারেন, তবে এই বারাণসীর তত্ত্বজ্ঞানীরাই। কেন না, ইহারাই সেই পরমাশ্চর্য্য মুনিঋষিদিগের বংশধর—যাঁহারা এই সকল গ্রন্থের রচয়িতা; ইহারা সেই একই বংশের লোক,—যাঁহারা পুরুষানুক্রমে শুদ্ধাচারী ছিলেন;—সেই একই বংশের লোক, যাঁহারা কখনো জীবহত্যা করেন নাই, যাঁহাদের দেহের মাংস অন্যজীবের মাংসে পরিপুষ্ট হয় নাই। সুতরাং ইহারের দেহের উপাদানপদার্থ আমাদের দেহের মত ততটা স্থূল কিংবা অস্বচ্ছ হইবে না। কুলপরম্পরাগত ধ্যানধারণা ও পূজা-অর্চ্চনার ফলে অবশ্যই ইঁহাদের চিত্তবৃত্তি এরূপ সুকুমার হইয়াছে, ইহাদের জ্ঞান এরূপ সূক্ষ্ম হইয়াছে যে, তাহা আমাদের ধারণার অতীত। তথাপি ইহারা অত্যন্ত বিনয়ের সহিত আমাকে বলিলেন,—“আমরা কিছুই জানি না, কিছুই প্রায় বুঝি না, আমরা শুধু সত্য অন্বেষণ করিতেছি মাত্র।”
একটি রমণী—[১] য়ুরোপীয় রমণী, পাশ্চত্য মোহাবর্ত্ত হইতে পলাইয়া আসিয়া ইহাদের মধ্যে একটা উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছেন। ইহার মুখশ্রী এখনো চিত্তাকর্ষক; শুভ্রপলিত কেশ; নগ্ন পদ; ইনি ব্রাহ্মণপত্নীর ন্যায় মিতাচারিণী, এবং সংসার হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া কঠোরব্রত তাপসার জীবন যাপন করিতেছেন। দুর্গম জ্ঞানমন্দিরের ভীষণ দ্বারটি যাহাতে আমার অন্ধ নয়নের সমক্ষে অল্পে-অল্পে প্রকাশ পায়, তজ্জন্য আমি তাঁহারই শুভ ইচ্ছার উপর নির্ভর করিয়া আছি। কেন না, আমাদের উভয়ের মধ্যে ততটা ব্যবধান নাই; পূর্ব্বে তিনি আমারই স্বজাতীয়া ছিলেন এবং আমার দেশভাষাও তাঁহার নিকট সুপরিচিত।
তথাপি অতীব সন্দিগ্ধচিত্তে আমি তাঁহার নিকট গমন করিলাম। প্রথমেই তাকে একটা ফাঁদে ফেলিবার জন্য আর একটি[২]
স্ত্রীলোকের কথা পাড়িলাম—যিনি তাঁহারই পূর্ব্বে এখানে আসিয়াছিলেন, যিনি এই তত্ত্বজ্ঞানী সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করিয়াছিলেন এবং যাঁহার প্রখ্যাত গ্রন্থাদি পাঠ করিয়াই আমি স্বধর্ম্মে সন্দিহান হইয়াছিলাম। আমি ইঁহার কাছে কথাটা এইজন্য পাড়িলাম, কেন না, আমি শুনিয়াছিলাম, ইহারও ধ্রুববিশ্বাস,—তিনি বুজ্রুকি দেখাইয়া প্রবঞ্চনা করিতেন। আমি তাঁকে বলিলাম—“আপনি কি মনে করেন না, কাহারও কোন বিষয়ে হৃদ্বোধ করাইবার জন্য যদি বুজ্রুকি দেখান হয়, তাহা মার্জ্জনীয়?”
অকপটদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাহিয়া তিনি উত্তর করিলেন—“প্রতারণা-প্রবঞ্চনা কোন অবস্থাতেই মার্জ্জনীয় নহে; মিথ্যা-কথা হইতে কখনই ভাল ফল উৎপন্ন হয় না।”
এই কথায়, আমার দীক্ষাগুরুর প্রতি আমার সহসা বিশ্বাস জন্মিল। মুহূর্ত্ত পরেই তিনি আবার বলিলেন—“আমাদের বিশেষ ধর্ম্মমত কি?...আমাদের কোন বিশেষ ধর্ম্মমত নাই। আমাদের ‘থিয়সফিষ্ট’ সম্প্রদায়ের মধ্যে (লোকে এই নামে আমাদিগকে অভিহিত করে) বৌদ্ধ আছে, হিন্দু আছে, মুসলমান আছে, ক্যাথলিক্ আছে, পুরাতন সম্প্রদায়ের গোঁড়া লোক আছে, এমন কি, তোমার ধরণের লোকও আছে। আমাদের দলভুক্ত হ’তে তোমার যদি ইচ্ছা হয়...”
—“আপনাদের দলভুক্ত হইতে হইলে কি করা আবশ্যক?”
“শুধু এই শপথ করিতে হইবে,—জাতি ও বর্ণনির্ব্বিশেষে আমি সকল
উপস্থিত হইয়াছিল যে, কোন কোন লোককে বুজরুকি দেখাইয়াও তিনি আপনার দলে আনিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার এই মানবোচিত চিত্তদৌর্ব্বল্যসত্ত্বেও, তত্ত্বপ্রকাশক বলিয়া তাঁহার যে খ্যাতি, তাহার কিছুমাত্র লাঘব হয় না। যে তত্ত্বজ্ঞান পৃথিবীর মত পুরাতন, যাহা ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করে না, তাহার সহিত শ্রীমতীর নাম বিশেষরূপে জড়িত করা ভারী ভুল। মনুষ্যকেই ভ্রাতা জ্ঞান করিব; কি রাজা, কি সামান্য একজন মজুর, সকলের প্রতিই সমান ব্যবহার করিব; সত্যের অন্বেষণে (জড়বাদীর ভাবে নহে) সাধ্যমত প্রবৃত্ত হইব। ইহা ছাড়া আর কিছুই করিতে হইবে না। এখানে আসিবার সময় তোমার যাত্রাপথে আমাদের যে সকল মাদ্রাজি বন্ধুর সহিত তুমি সাক্ষাৎ করিয়াছিলে, তাঁহাদের বৌদ্ধধর্ম্মের দিকেই একটু বেশী ঝোঁক্। আমি জানি, তাঁহাদের আগ্রহহীন ঔদাসীন্যের ভাব তোমার গূঢ়রহস্যগ্রবণ আত্মাকে প্রতিহত করিয়াছিল। কিন্তু আমরা সেই প্রাচীনকালের গুহ্য ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মেই শান্তি ও আলোক লাভ করিয়াছি। মানুষের পক্ষে যতদূর জানা সম্ভব−সত্যের সেই উচ্চতম ভাব উহারই মধ্যে নিহিত।
“আমাদের খুবই ইচ্ছা, আমরা যে পথ অনুসরণ করিতে চেষ্টা করিতেছি, পথপ্রদর্শক হইয়া তোমাকেও সেই পথে লইয়া যাই। ‘দ্বাররক্ষকে’র সেই পুরাতন রূপককাহিনীটি বোধ হয় তুমি জান; নবদীক্ষার্থীকে ভয় দেখাইবার জন্য ভীষণ রক্ষকসকল, দীক্ষার আরম্ভকালে, দেবালয়ের দ্বারদেশে বিচরণ করে। উহার প্রকৃত তাৎপর্য এই−জ্ঞানোদয়ের আরম্ভে, স্বভাবতই নানা প্রকার বিভীষিকা দেখা যায়। আমাদের বিশ্বাস এই,−মানুষের সমস্ত ব্যক্তিগত অংশ ক্ষণস্থায়ী ও মায়াময়। তোমার মত যে-সব লোকের ব্যক্তিত্বের ভাব অতীব তীব্র, তাহাদের পক্ষে সিদ্ধিলাভ করা বড়ই কঠিন। আমরা আরো অনেক কথা বিশ্বাস করি, যাহা তোমার লৌকিক সংস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীত। যে সকল আশা তোমার অজ্ঞাতেও তুমি গৃঢ়রূপে এখনো তোমার অন্তরে পোষণ করিতেছ, সেই সকল আশা যদি আমরা তোমার মন হইতে উঠাইয়া লই, তাহা হইলে তুমি কি আমাদিগকে অভিশাপ করিবে না?”
“না। আশার কথা যদি বলেন, সে পক্ষে আমার আর কি হারাইবার নাই।”
“বেশ, তা হ’লে তুমি আমাদের নিকটে এস।”
- ↑ শ্রীমতী অ্যানী বেসান্ত।
- ↑ ইনি শ্রীমতী ব্ল্যাভাজ্কি। তিনি যাহাই করুন না কেন, তাঁহাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান না দিলে, তাঁহার প্রতি অন্যায় করা হয়। কতকগুলি ভারতীয় গ্রন্থ যে সকল চমৎকার মতবাদ শতশত বৎসর ধরিয়া প্রসুপ্ত ছিল, তাহার প্রথম প্রকাশক তিনিই। সত্য বটে, তাঁহার শিষ্যেরা পর্য্যন্ত এ কথা বলিতে কুণ্ঠিত হয় নাই যে স্বমত প্রচার করিতে গিয়া, তাঁহার শেষদশায় এইরূপ একটা মত্ততা