ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/প্রভাতমহিমা
প্রভাতমহিমা।
যে সমভূমির উপর দিয়া প্রাচীন গঙ্গা প্রবাহিতা, যে তৃণসঙ্কুল বিস্তীর্ণ কর্দ্দমভূমি নৈশবাষ্পে এখনও কুয়াসাচ্ছন্ন, সেই ভূমির সুদূরপ্রান্ত হইতে সেই অনাদিকালের পুরাতন সূর্য্য উদিত হইয়াছেন। এইরূপ তিনসহস্র বৎসর হইতে প্রতিদিনই তিনি তাঁহার প্রথম পাটল কিরণ বিকীর্ণ করিতেছেন; বারাণসীর প্রস্তরস্তূপ, রক্তিম মন্দিরচূড়া, চূড়ায় স্বর্ণময় অগ্রবিন্দুচয়—সমস্ত পুণ্যনগরী তাঁহার সেই প্রথম-আলোক আগ্রহের সহিত গ্রহণ করিবার জন্য ও প্রাভাতিক মহিমায় বিভূষিত হইবার জন্য প্রতিদিনই অর্দ্ধমণ্ডলাকারে তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইতেছে।
ইহাই এখানকার সর্ব্বাপেক্ষা প্রশস্ত সময়; ব্রাহ্মণ্যযুগের আরম্ভ হইতেই এই সময়টি অতীব পবিত্র,−পূজা-অর্চ্চনার মুখ্যকাল। বারাণসী যেন সহসা এই সময়েই তাহার সমস্ত জনতা, তাহার সমস্ত কুসুমরাশি, তাহার সমস্ত পুষ্পমাল্য, তাহার সমস্ত পশু-পক্ষী স্বকীয় নদীর বক্ষে ঢালিয়া দেয়।
দিবাকরের উদয়কালে যে-কেহ জাগ্রত হইয়াছে,—কি মনুষ্য কি ইতর প্রাণী,−ব্রহ্মার জীবমাত্রই ঘাটের সিঁড়ি দিয়া আনন্দে নদীর উপর যেন ভাঙিয়া পড়িতেছে। পুরুষেরা নাবিতেছে;− তাহাদের মুখে প্রহৃষ্ট গম্ভীরভাব; গোলাপী কিংবা হল্দে কিংবা লাল শালে গাত্র আচ্ছাদিত। শুভ্রবসনা স্ত্রীলোকেরা নাবিতেছে;−মল্মল্-বস্ত্রে তাহারা অবগুণ্ঠিত। তাহাদের মসৃণ পিতলের ঘড়া ও ঘটির লোহিত কিংবা পীত আভা চারিদিকে বিকীর্ণ হইতেছে এবং তাহারই পাশে তাহাদের অসংখ্য বলয়, কণ্ঠহার, রজতনূপুর ঝিক্মিক্ করিতেছে। দিব্য সাজসজ্জা, দিব্য মুখশ্রী—তাহারা যেন নগর-দেবতার মত চলিয়াছে—তাহাদের বাহু ও চরণের বলয়নূপুরাদির মধুর নিক্কণ শুনা যাইতেছে।
প্রত্যেকেই, গঙ্গাদেবীকে পুষ্পমাল্যের উপহার,—কেবলই পুষ্পমাল্যের উপহার দিতেই ব্যস্ত;—পূর্ব্বপূর্ব্ব দিনের উপহারগুলি—যাহা এখনও জলে ভাসিতেছে—তাহাই যেন যথেষ্ট নহে। জুঁইফুলে-গাঁথা গড়েমালা,—দেখিতে আমাদের মহিলাদের গলায় জড়াইবার পালক্আচ্ছাদনের মত; অন্যান্য শাদা ফুলের মালায় সোনালি হল্দে ও জাফ্রানি হল্দে এমনভাবে মিশ্রিত, যাহাতে বিভিন্ন আভার বৈষম্য বেশ ফুটিয়া উঠে; ভারতরমণীরা তাহাদের ওড়নাতেও এইরূপ রং মিলাইতে ভালবাসে।
গৃহপ্রাসাদাদির সমস্ত ‘কার্নিস’-ঝালরের উপর যে-সব পাখীর ঝাঁক দীর্ঘরজ্জুর মত সারি-সারি বসিয়া ঘুমাইতেছিল, তাহারা জাগিয়াছে—কলরবে ও গানে মাতিয়া উঠিয়াছে।
ঘুঘু ও অন্যান্য ক্ষুদ্রপক্ষী স্নানের জন্য, আত্মবিনোদনের জন্য দলে-দলে আসিয়া বিশ্বস্তভাবে এই সব ব্রাহ্মণদের মধ্যে রহিয়াছে; কেন না, জানে, উহারা কখন জীবহত্যা করে না। সমস্ত দেবতার উদ্দেশে প্রভাতসঙ্গীত দেবালয় হইতে নিঃসৃত হইতেছে;—ঝঞ্চা-নাদের মত ঢাকঢোলের বাদ্য, শানাইয়ের কাঁদুনি, পবিত্র তূরীধ্বনি শুনা যাইতেছে। উপরে, সমস্ত জালি-কাটা বলভী, মাল্য-ঝালর ও ক্ষুদ্র স্তম্ভসমন্বিত সমস্ত গবাক্ষ, গৃহের সমস্ত ছাদ, বৃদ্ধদের মস্তকরাশিতে আচ্ছন্ন—ইহারা সেই দর্শকবৃন্দ, যাহারা ব্যাধি কিংবা জরাপ্রযুক্ত নীচে নামিতে অসক্ত অথচ যাহারা এই প্রভাত-আলোকে পূজা-অর্চ্চনায় যোগ দিতে অভিলাষী। সূর্য্যের জ্বলন্ত রশ্মিতে উহারা পরিপ্লাবিত।
লোকের হস্তধারণ করিয়া হর্ষোৎফুল্ল নগ্ন শিশুর দল নাবিতেছে। যোগী ও অলসগতি সন্ন্যাসীর নাবিতেছে। নিরীহ পবিত্র গাভীবৃন্দ নাবিতেছে—প্রত্যেকেই তাহাদিগকে সসন্ত্রমে পথ ছাড়িয়া দিতেছে এবং তাজা তৃণ ও পুষ্পরাশি তাহাদের সম্মুখে অর্পণ করিতেছে। এই মধুরপ্রকৃতি পশুরাও সূর্য্যের উদয়োৎসব দেখিতেছে এবং এই সময়ের মাহাত্ম্য যেন বুঝিয়াই তাহাদের নিজের ধরণে পূজার্চ্চনায় প্রবৃত্ত হইয়াছে। মেষ ও ছাগল নাবিতেছে, ব্যস্তভাবে কুকুর নাবিতেছে, বানর নাবিতেছে।
রাত্রির শিশিরে বাতাস যেন শীতে জমাট হইয়া গিয়াছিল, এক্ষণে সূর্য্য—সহস্রকিরণ সূর্য্য সেই বায়ুতে শুভ উত্তাপ আনয়ন করিল। কুলুঙ্গি কিংবা বেদীর আকারে ছোট-ছোট পাথরের গাঁথুনি, সোপানের ধাপে-ধাপে সজ্জিত—কোনটাতে বিষ্ণুর বিগ্রহ, কোনটাতে বহুবাহুবিশিষ্ট গণেশের বিগ্রহ। এই সকল বিগ্রহের গাত্র এখনও শুষ্ককর্দ্দমে লিপ্ত; এবং মনুষ্যভস্মে পরিষিক্ত হইয়া ইহারা অনেকমাস যাবৎ ক্ষুব্ধ নদীর জলগর্ভে নিদ্রিত ছিল। এক্ষণে ইহাদের উপর সূর্য্যরশ্মি পতিত হইয়াছে। এখনও সূর্য্য জলন্ত কিরণ বর্ষণ করিতেছে, তাই লোকেরা বড় বড় ছাতার তলে আশ্রয় লইয়াছে। ছাতাগুলা মাটীতে পোঁতা—দেখিতে বিরাট্ ব্যাঙের ছাতার মত। পবিত্র নগরীর পাদদেশে এইরূপ রাশিরাশি ছাতা উদ্ঘাটিত। এদিকে ঊর্ধ্বদেশে, পুরাতন প্রাসাদগুলা প্রভাতসমাগমে যেন নবযৌবনে উৎফুল্ল হইয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। মন্দিরের লোহিত চূড়াসকল আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে, চূড়ার স্বর্ণময় অগ্রভাগ, স্বর্ণময় ত্রিশূল ঝিক্মিক্ করিতেছে।
অসংখ্য ডিঙির উপরে এবং নীচের সোপানধাপের উপরে ভক্তেরা তাহাদের পুষ্পমাল্য ও ঘটি রাখিয়া কাপড় ছাড়িতে লাগিল। শাদা ও গোলাপী রঙের বস্ত্র, বিবিধ রঙের শাল ইতস্তত ফেলিতে লাগিল, কিংবা বাঁশের উপর ঝুলাইয়া রাখিল। তখন তাঁহাদের দিব্য নগ্নকায় বাহির হইয়া পড়িল—ঘোব কিংবা ফিঁকা পিতলের রং। পুরুষেরা যেমন ছিপ্ছিপে, তেমনি পালোয়ানি-ধরণে বলিষ্ঠ; তাহাদের চক্ষু অগ্নিময়। উহারা পূতজলে আকণ্ঠ প্রবেশ করিল। স্ত্রীলোকেরা ততটা চ্যুতবস্ত্র নহে; তাহাদের বক্ষ ও কটিদেশ একখানা কাপড়ে ঢাকা; তাহারা গঙ্গার জলে শুধু তাহাদের পা ভিজাইতেছে—বলয়াদিবিভূষিত বাহু ভিজাইতেছে। তাহার পর একেবারে নদীর কিনারায় গিয়া ও অবনত হইয়া তাহাদের আলুলিত দীর্ঘকেশ জলের উপর আছড়াইতেছে; বক্ষের উপর দিয়া, স্কন্ধের উপর দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতেছে; তাহাতে করিয়া তাহাদের রহস্যপ্রকাশক সূক্ষ্ম বস্ত্রখানি গায়ে একেবারে আঁটিয়া ধরিয়াছে; ঠিক যেন “পক্ষহীন বিজয়লক্ষ্মী”। নগ্নাবস্থা অপেক্ষা এ মূর্ত্তি আরও যেন সুন্দর, আরও যেন চিত্তচাঞ্চল্যকর।
গঙ্গাকে প্রণাম করিয়া পূজার অঞ্জলিস্বরূপ, গঙ্গার বক্ষে পুষ্পগুচ্ছ, পুষ্পমাল্য চারিদিক্ হইতে লোকে অজস্র নিক্ষেপ করিতেছে। ঘটি ভরিয়া, ঘড়া ভরিয়া জল লইতেছে; এবং প্রত্যেকে অঞ্জলি ভরিয়া জল উঠাইয়া পান করিতেছে।
এই সময়ে এইখানে ধর্ম্মভাবের এরূপ সর্ব্বগ্রাসী প্রভাব যে, এই সমস্ত রমণীয় নগ্নতার মেশামিশি ও ঘেঁষাঘেঁষিতেও কোন কুচিন্তার উদ্রেক হইতেছে বলিয়া মনে হয় না। পরস্পরকে কেহই তাকাইয়া দেখিতেছে না; দেখিতেছে শুধু নদীকে, সূর্য্যকে, আলোকের ও প্রভাতের মহিমাকে; সকলেই ভক্তিমুগ্ধ, সকলেই পূজায় মগ্ন।
স্নানের দীর্ঘ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হইলে পর, রমণীরা শান্তভাবে জল হইতে উঠিয়া গৃহাভিমুখে চলিল; পুরুষেরা তাহাদের ডিঙির উপরে, তাহাদের পুষ্পমাল্য—তাহাদের দূর্ব্বাগুচ্ছের মধ্যে থাকিয়া পূজার আয়োজন করিতে লাগিল।
আহা! এই অতীতের লোকদিগের দৈনন্দিন জাগরণ কি চমৎকার! প্রতিদিন তাহারা ভগবানের আরাধনার্থে একত্র মিলিত হয়। ভাস্বর আকাশের নীচে, জলের মধ্যে, পুষ্পগুচ্ছ ও পুষ্পমাল্যের মধ্যে, একজন দ্বীনহীন সামান্যলোকেরও একটু স্থান আছে।…পক্ষান্তরে, পাশ্চাত্য যে আমরা,—লৌহধূমযুগের লোক যে আমরা—আমাদের জাগরণ ধূলিময় মলিন পিপীলিকার হেয় জাগরণ! আমাদের দেশের নিবিড় ও শীতল মেঘরাশির নীচে অবস্থিত আমাদের জনসাধারণ, সুরা ও ঈশ্বরনিন্দার বিষে জর্জরিত হইয়া প্রাণঘাতী কল্কারখানার অভিমুখে ব্যস্তভাবে চলিয়াছে!...
জল হইতে উঠিয়া গৃহাভিমুখে যাইবার সময় রমণীরা তাহাদের শুভ্র ও বিচিত্রবর্ণের বস্ত্রাদি আবার ঠিক্ঠাক্ করিয়া পরিয়া লয়; এবং বিশাল প্রস্তরাদির সম্মুখে যখন তাহারা ঘাটের সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে থাকে, তখন প্রাচীন গ্রীসের উৎকীর্ণ চিত্রাবলী মনে পড়িয়া যায়। তাহাদের কেশপাশ হইতে এখনও জল গড়াইয়া পড়িতেছে; তাহাদের নিবিড় ও আর্দ্র কেশগুচ্ছ, তাহাদের মল্মল্বস্ত্রের উপর এলাইয়া পড়িয়াছে। প্রত্যেকেরই স্কন্ধের উপর একটি-একটি উজ্জ্বল ধাতুময় কলস; এবং এক-একটি নগ্নবাহু উর্দ্ধে উত্তোলন করিবার ইহাই উপলক্ষ্য।
পুরুষেবা সকলেই গঙ্গার উপরে রহিয়াছে; এবং যোগানন্দে নিমগ্ন হইবার পূর্ব্বে, আসনপিঁড়ি হইয়া বসিয়া ধর্ম্মবিহিত সমস্ত প্রসাধনকর্ম্ম সমাধা করিতেছে। শিবের সম্মানার্থ স্বকীয় পিত্তলবর্ণ গাত্র ভস্মরেখায় চিত্রিত করিতেছে এবং ললাটে ভীষণ শৈবচিহ্নের ছাপ রক্তচন্দনে অঙ্কিত করিতেছে।
সেই শ্মশানের কোণটিতে-যেখানে প্রভাতআলোকে চতুষ্পার্শ্বস্থ চিতাধূমকালিম পাথরগুলা দেখা যাইতেছে—সেখানে এখন কোন শবেরই দাহ হইতেছে না। কাপড় দিয়া ঢাকা দুইটা শব ঐখানে পড়িয়া রহিয়াছে; কিন্তু তাহাদের লইয়া কেহই ব্যাপৃত নহে। একটা শব চিতার উপর শয়ান; আর একটি শবের অন্তিমস্নানের অনুষ্ঠান চলিতেছে; তাহারই পাশে সুন্দর বলিষ্ঠ জীবন্ত লোকেরা স্নান করিতেছে। ডিঙির উপর, ঘাটের নীচেকার সিঁড়ির উপর, পূজা—বিপুল জনতার ব্যাপক পূজা আরম্ভ হইয়াছে। এই সময়ে আর সমস্ত কার্য্যই স্থগিত, এমন কি, চিতাতেও এখন আগুন ধরান হইতেছে না—শবেরা অপেক্ষা করিয়া রহিয়াছে।
সকলেরই মুখে কি-এক অপূর্ব্ব অন্যমনস্কভাব; মুখাবয়বসকল যেন জমাটবদ্ধ, চোখ যেন কিছুই আর দেখিতেছে না! যুবাপুরুষেরা ধ্যানে মগ্ন, হস্তদ্বয় মুখের উপর সংলগ্ন—দুইটি জ্বলন্ত চোখের তারা ছাড়া মুখের আর কিছুই দেখা যাইতেছে না—সে চোখের দৃষ্টি সংসারের পরপারে; জপমালায় আচ্ছাদিত সন্ন্যাসিগণ—যাহাদের আত্মা ক্ষণকালের জন্য হৃতচৈতন্য জড়শরীরকে ছাড়িয়া গিয়াছে; ধূসর ভস্মচুর্ণে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত বৃদ্ধগণ—সকলেরই সেই এক ভাব।…
একজন জলের ধারে বসিয়া পূজা-অর্চ্চনা করিতেছে; শাদা-শাদা চোখ; শাক্যসিংহের মূর্ত্তির মত পদ্মাসনবদ্ধ হইয়া মৃগচর্ম্মের উপর আসান; এই আসনটি সন্ন্যাসীদেরই বিশেষ আসন। দুই পা পরস্পরের উপর আড়াআড়িভাবে ন্যস্ত, জানু মাটি ছুঁইয়া রহিয়াছে; এবং বামহস্ত—দীর্ঘ অস্থিসার বামহস্ত—দক্ষিণপদ ধরিয়া রহিয়াছে। ইনি একজন বৃদ্ধ। ইহার পরিচ্ছদ গায়ে আঁটিয়া ধরিয়াছে—জল গড়াইয়া পড়িতেছে। পরিচ্ছদের রং ফিঁকা গোলাপী নারাঙ্গী—যেন উষার মেঘরাশি।
ইনি নিশ্চল হইয়া পূজা করিতেছেন; ইহার ললাটে শৈবচিহ্ন অঙ্কিত; চোখের তারা কাচের মত; ইহার সীসা-কালিম মুখ জ্বলন্ত সূর্য্যের দিকে ফেরান রহিয়াছে—জলন্তসূর্য্যের কিরণে মুখ ঝিক্মিক্ করিতেছে। মুখে একপ্রকার অপরিসীম আনন্দের ভাব। একজন নগ্নকায় পালোয়ানিধরণের বলিষ্ঠযুবক, তাঁহার রক্ষিপদে ব্রতী হইয়া, মধ্যে-মধ্যে এক-একঅঞ্জলি গঙ্গাজল লইয়া সেই জলে তাঁহার অরুণবর্ণের পরিচ্ছদকে প্লাবিত করিতেছে; এবং সেই বৃদ্ধসন্ন্যাসীর সম্মুখে মৃগচর্ম্মের উপর যে সকল পুষ্পমাল্য রহিয়াছে, সেই সব পুষ্পমাল্যের মলক্ষালন করিবার জন্য তাহার উপয় জল ছিটাইয়া দিতেছে—মৃগচর্ম্মসংলগ্ন মৃগের মুস্তক ও শৃঙ্গ জলে ভিজিয়া যাইতেছে। বোধ হয়, তাঁহার ধ্যানকে ঘনাইয়া তুলিবার জন্য, তাঁহার সম্মুখে সামান্য-ধরণের পবিত্র সঙ্গীত চলিতেছে; আর একটু উপরে, দুইজন বালক দুইটা পাথরের নোড়ার উপর বসিয়া প্রফুল্লভাবে মৃদুমৃদু হাসিতেছে; উহাদের মধ্যে একটি বালক, ভোঁ-ভো-শব্দে শঙ্খনাদ করিতেছে; আর একটি, ডুগি বাজাইতেছে; ইহা হইতে একপ্রকার চাপাশব্দ নির্গত হইতেছে। চারিধারে কাকেরা ইতস্তত বসিয়া আছে—মনোযোগসহকারে সন্ন্যাসীকে নিরীক্ষণ করিতেছে। যাহারা গৃহাভিমুখে চলিয়াছে—কি রমণী, কি বালক—তাহারা সকলেই আবার পথ হইতে ফিরিয়া এই সন্ন্যাসীকে প্রণাম করিতেছে। নীরবে শুধু একটু সস্মিত অভিবাদন করিয়া, জোড়হস্তে শুধু প্রণাম করিয়া তাহারা সন্তর্পণে চলিয়া যাইতেছে—পাছে সন্ন্যাসীর ধ্যানভঙ্গ হয়—পূজার ব্যাঘাত হয়। রহস্যময় প্রাসাদঅঞ্চল পর্য্যন্ত গমন করিয়া আমার নৌকা আবার ফিরিয়া আসিল। ফিরিয়া আসিতে একঘণ্টা বিলম্ব হইল। ফিরিয়া-আসিয়া দেখি, সেই বৃদ্ধটি সেইখানেই রহিয়াছে। দীর্ঘনখবিশিষ্ট হস্তের দ্বারা স্বকীয় শীর্ণপদ ধরিয়া রহিয়াছে; তাহার দৃষ্টি সেইরূপ স্থির—আকাশের দিকে, জলন্ত সূর্য্যের দিকে নেত্র উদ্ঘাটিত রহিয়াছে, তবু সেই ঘোলা-চোখ্ ঝল্সিয়া যাইতেছে না। আমি বলিলাম—“বৃদ্ধটি কেমন স্থির হইয়া রহিয়াছে?” ..মাজি আমার দিকে তাকাইল এবং কোন অবোধ শিশুর নিতান্ত সরল উক্তি শুনিয়া লোকে যেমন করিয়া থাকে - সেইরূপ আমার দিকে চাহিয়া সে একটু মৃদুহাস্য করিল।—“ঐ লোকের কথা বল্চেন?…কিন্তু…ও যে মৃত!”
কি! ও লোকটা মৃত!… আসল কথা,—আমি লক্ষ্য করি নাই, বালিশের উপর মাথা আট্কাইয়া রাখিবার জন্য, থুতির নীচে দিয়া একটা চর্মবন্ধনী গিয়াছে। আমি ইহাও লক্ষ্য করি নাই,—একটা কাক মুখের চারিধারে ও মুখের খুব কাছে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; যে বলিষ্ঠকায় যুবকটি তাহার গেরুয়া রঙের পরিচ্ছদে ও জুঁইফুলের মালায় জলসেক করিতেছিল, সে সেই কাককে ভয় দেখাইবার জয় ক্রমাগত একটুক্রা কাপড় নাড়িতেছে।
গতকল্য সন্ধ্যার সময় ইনি মরিয়াছেন; ইঁহার অন্তর্জলী-অনুষ্ঠানসমাপনান্তে—যেরূপ যোগাসনে বসিয়া ইনি সমস্ত জীবন কাটাইয়াছেন, এক্ষণে এই পূর্ণ প্রভাতমহিমার মধ্যে ইঁহাকে সেই যোগাসনের ভঙ্গীতে বসান হইয়াছে। বন্ধনীর দ্বারা বদ্ধ করিয়া ইঁহার মস্তককে পিছনে একটু হেলাইয়া দেওয়া হইয়াছে,—যাহাতে সূর্য্য ও আকাশ ভাল করিয়া দেখিতে পান।
ইঁহার দাহ হইবে না, কেননা, যোগীদের দাই হয় না। যোগীদের পুণ্যজীবনের মাহাত্ম্যে যোগীদের শরীর পূর্ব্ব হইতেই পবিত্র হইয়া আছে। আজ সন্ধ্যাকালে, ইহার মৃতশরীরকে একটা মাটির গাম্লার মধ্যে সমাহিত করিয়া গঙ্গায় ভাসাইয়া দেওয়া হইবে। যে ভাগ্যবান পুরুষ পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া—সংসারবন্ধন ছেদন করিয়া, সংসারচক্র হইতে চিরমুক্তি লাভ করিয়াছেন, জীবন ও মৃত্যুর অতলস্পর্শ রসাতল হইতে উদ্ধার পাইয়াছেন, লোকেরা তাঁহাকে প্রফুল্লবদনে অভিনন্দন করিতেছে, অভিবাদন করিতেছে, সাধুবাদ করিতেছে।
একটা কুকুর শবের নিকটে আসিল, তাহার গা সুঁকিল, তাহার, পর পুচ্ছ নত করিয়া চলিয়া গেল। তিনটা লালরঙের পাখী আসিয়া তাহারাও শবকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। একটা বানর নাবিয়া আসিল, শবের আর্দ্র পরিচ্ছদের তলদেশ স্পর্শ করিল এবং স্পর্শ করিয়াই একদৌড়ে ঘাটের মাথায় উঠিয়া বসিল। সেই রক্ষী যুবকটি ইহাদিগকে কিছুমাত্র নিবারণ করিতেছে না,—সব সহ্য করিতেছে। এদেশের লোকেরা পশুপক্ষীর অত্যাচার অকাতরে সহ করিয়া থাকে। সেই নাছোড়বান্দা কাকটা, পচা শবের গন্ধ পাইয়া পুনঃপুন ফিরিয়া আসিতেছে; এবং তাহার কালো ডানা, প্রায় মৃতযোগীর মুখ ঘেঁষিয়া যাইতেছে।