ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/স্বর্ণমন্দিরের নিকটস্থ একজন ব্রাহ্মণের গৃহে

স্বর্ণমন্দিরের নিকটস্থ একজন ব্রহ্মণের গৃহে।

 “অলৌকিক কাণ্ড!…এখানকার সন্ন্যাসীরা পূর্ব্বে বোধ হয় অলৌকিক কার্য্যসকল দেখাইতে পারিত, কেহ কেহ হয় ত এখনও দেখাইতে পারে…কিন্তু আমাদের মনীষিরা এই উপায়ে লোকের বিশ্বাস উৎপাদন করা হেয় জ্ঞান করেন।…না,−গভীর ধ্যানধারণাই ভারতীয় পন্থা; ধ্যানধারণাই আমাদিগকে সত্যের পথে লইয়া যায়...’’

 যিনি আমাকে এই কথা বলিলেন, তিনি একজন বৃদ্ধব্রাহ্মণ; তাঁহার, “পণ্ডিত” উপাধি। অর্থাৎ তিনি সংস্কৃত ভাষায় ও সংস্কৃত দর্শনশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। অলৌকিক ব্যাপারের প্রতি সেই নিস্তব্ধ ক্ষুদ্র গৃহের তত্ত্বজ্ঞানীদের যেরূপ অবজ্ঞা, ইহারও দেখিলাম সেইরূপ অবজ্ঞা।

 সন্ধ্যার সময়, বারাণসীর হৃদয়দেশে তাঁহার পুরাতন গৃহের ছাদের উপর বসিয়া আমরা বাক্যালাপ করিতেছি। ছাদটি ক্ষুদ্র, বিষন্ন ও চারিদিকে বদ্ধ; একটা বাহিরের সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে হয়; একটা সরু রাস্তা হইতে সিঁড়িটা উঠিয়াছে। আমার দোভাষী জাতিতে ‘পারিয়া’, সুতরাং এখানে তাহার প্রবেশ নিষিদ্ধ; সে বাহিরের সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে দাঁড়াইয়া রহিল। যখন সে আমাদের কথা ভাষান্তর করিয়া বুঝাইতেছিল, তখন মনে হইতেছিল, যেন সন্ধ্যার শব্দবাহী নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া দূর হইতে তাহার কণ্ঠস্বর আসিয়া পৌঁছিতেছে! অনুবাদের কার্য্যে মাতিয়া উঠিয়া ভ্রমক্রমে যদি কখন সে দরজার চৌকাঠে পা রাখে, অমনি বৃদ্ধব্রাহ্মণ তাহাকে চিরন্তন লোকাচারের কথা স্মরণ করাইয়া দেন, সেও পিছু হটিয়া যায়। তিনি থিয়সফিষ্টসমাজভুক্ত নহেন,—তাই বর্ণভেদপ্রথার নিয়ম তিনি লঙ্ঘন করেন না।

 এই ছাদের উপর হইতে আর কিছুই বড় দেখা যায় না,−দেখা যায় শুধু চতুর্দ্দিকে কতকগুলা জরাজীর্ণ প্রাচীর—যাহার পলস্তরা রৌদ্রে, ফাটিয়া গিয়াছে; আর দেখা যায়, আকাশে কাকের ঝাঁক উড়িয়া বেড়াইতেছে। কিন্তু এই জরাজীর্ণতার মধ্য হইতে, এই সমস্ত ধ্বংসাবশেষের মধ্য হইতে, খুব নিকটেই একটা আশ্চর্য্য জিনিষ মাথা তুলিয়া রহিয়াছে;—স্বর্ণকারের হাতের একটি অতুলনীয় কারুকার্য্য; ইহা অস্তমান সূর্য্যের শেষরশ্মির গতিরোধ করিতেছে, এবং এই সময়ে ইহার উপর যত টিয়াপাখী আসিয়া জড়ো হইয়াছে। ইহা “স্বর্ণমন্দিরের’’ একটা গম্বুজ।

 আমি মধ্যে-মধ্যে এই শ্রদ্ধাস্পদ পণ্ডিতের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাই। তাঁহার ধন-ঐশ্বর্য্যের মধ্যে একটি পুস্তকাগার ও শতশতবর্ষ পুরাতন কতকগুলি পুঁথি। বারাণসীর যে অংশটি সর্ব্বাপেক্ষা পুরাতন ও পবিত্র, সেইখানেই তাঁহার গৃহ। একাকারের মহাপ্রবর্ত্তক বেল যেখান দিয়া গিয়াছে, সেই ইতর জঘন্য আধুনিক অঞ্চল হইতে এই স্থানটি বহুদূরে অবস্থিত। ইহার পারিপার্শ্বিক দৃশ্যে কোনই পরিবর্ত্তন ঘটে নাই; সুতরাং এইখানে আসিলে পুরাকালের ভাব মনের মধ্যে জাগিয়া উঠে, বারাণসীর সেই গুহ্যধর্মের রহস্যময় ভাবে চিত্ত পরিপ্লাবিত হয়, চিত্তকে যেন দূর অতীতে পিছাইয়া আনে অনিত্য সংসারকে ক্রমাগত স্মরণ করাইয়া দেয়, এবং চিন্তাপ্রবাহকে সংসারের পরপারে লইয়া যায়। সেই ধবলগৃহের তত্ত্বজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন,—কতকগুলি স্থানের বিশেষ মাহাত্ম্য আছে; এরূপ কতকগুলি নগর আছে—যথা বারাণসী, মক্কা, লাসা, জেরুসালেম,—যে সকল নগর আধুনিক সংশয়বাদের আক্রমণসত্ত্বেও, দেবারাধনার ভাবে এরূপ ভরপূর যে, সেখানে পার্থিব মায়াবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া কতকটা অসীমের সান্নিধ্য উপলব্ধি করা যায়। তাঁহারা বলেন,—এমন কি, শুধু মন্দিরাদির বৃহত্ত্ব—শুধু অনুষ্ঠানাদির আড়ম্বরও কতকটা আত্মার উপর প্রভাব প্রকটিত করে। উহার কিছুই নিস্ফল নহে।