ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/বারাণসীতে যদৃচ্ছাভ্রমণ
বারাণসীতে যদৃচ্ছাভ্রমণ।
বিহগকুজনবিখণ্ডিত নিস্তব্ধতার মধ্যে, অতীব নূতন ও ভীষণ আকারে অনন্তের ভাব যেস্থানে আমার মনে প্রবিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, সেই তত্ত্বজ্ঞানীদের গৃহ হইতে চলিয়া আসিবার পর, অনন্তের চিন্তায় আমার মাথা ঘুরিয়া গিয়াছিল। তাই এই পৃথিবীর ক্ষুদ্র মরীচিকার মধ্যে আবার ফিরিয়া-আসা আবশ্যক বোধ করিলাম।
আমার ক্ষুদ্র গৃহ হইতে বাহির হইবার পর হইতে প্রাচ্যদেশের পরীদৃশ্য বরাবর আমার নেত্রসম্মুখে রহিয়াছে, কিন্তু আমার নিকট আর তাহার আকর্ষণ নাই। বিশেষত এই বারাণসীনগরে, পরীদৃশ্যের সহিত কি-যেন একটা অলোকসামান্য রহস্যের ভাব জড়িত; অন্যান্য স্থানেরই মত এই বারাণসী, কিন্তু তবু যেন আর সকল হইতে ভিন্ন।...
অন্যত্র যেরূপ যেখা যায়, এখানেও সেই একই ভারতীয়-ধরণের গলিঘুঁজি রাস্তার গোলকধাঁদা, গৃহের সেই ঝালোর-বিভূষিত গবাক্ষ, সেই স্তম্ভশ্রেণী, সেই সব রংচং; বিশেষত সেই একই ধরণের পাত্লা-ওড়না-পরা সুন্দরী রমণীরা পথ দিয়া চলিতেছে; সঙ্কীর্ণ রাস্তার ছায়ার মধ্যে,—এবং উহাদের ধাতুময় নূপুরের উপর, বলয়ের উপর, কণ্ঠমালার উপর, রূপালি-জরির নক্সা-কাটা গোলাপী, জদ্দা, সবুজ শাড়ীর উপর, কদাচিৎ দুই-একটি পতিত হইতেছে; তখন পুরাতন ধূসর প্রাচীরের মধ্যে, উহাদিগকে জ্যোতির্ম্ময়ী পরীর মত দেখিতে হয় এবং তখন যদি উহারা তোমার উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করে, তোমার মনে হইবে, যেন তাহাদের সমস্ত বেশভূষার উজ্জ্বলতা, সমস্ত দেহের লাবণ্যপ্রভা,—তাহাদের নেত্রের সেই অনিচ্ছাকৃত কোমল কটাক্ষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হইয়াছে।…
আবার এখানে যোগীরাও চতুষ্পথের উপর উবু হইয়া বসিয়া আছে দেখিতে পাওয়া যায়; উহারা দেবারাধনা ও মৃত্যুকে সহসা স্মরণ করাইয়া দেয়; চারিদিকেই পবিত্র শিলাখণ্ডসকল রহিয়াছে—সেই সব গঠনহীন সাঙ্কেতিকচিহ্ন, যাহার উৎপত্তিকালও কেহ জানে না, তাৎপর্য্যও কেহ বুঝে। উহাদিগকে আর কাহারও স্পর্শ করিবার জো নাই; কতকগুলি বিশেষ বর্ণের লোকেরাই উহাতে হাত দিতে পারে;—তাহারা উহাদিগকে পুষ্পমাল্য বিভূষিত করে। কতকগুলি দেবতা গরাদের পিছনে কারাবদ্ধ হইয়া দেয়ালের কুলুঙ্গির মধ্যে বাস করিতেছেন। চারিদিকেই প্রস্তরময়চূড়াবিশিষ্ট মন্দিরসকল মাথা তুলিয়া রহিয়াছে—সেখানে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ। পবিত্র গাভীবৃন্দ—অতীব নিরীহ, অতীব মধুর-প্রকৃতি—প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; যেখানের মানুষের জনতা বেশী—সেই বাজারই তাহাদের প্রিয়স্থান। সকলেরই উহাদিগকে সসম্ভ্রমে পথ ছাড়িয়া দিতে হয়। বানর, আকাশের পাখী, পায়রা, কাক, চড়াই—সবাই মানুষের মধ্যে অসঙ্কোচে খেলাইয়া বেড়াইতেছে, মানুষের গৃহে প্রবেশ করিতেছে, আহারের উদ্দেশে তাহাদের নিকট আসিতেছে—এই দৃশ্যটি আমাদের নিকট বড়ই অদ্ভুত বলিয়া মনে হয়;—এই তপোবনসুলভ সমদৃষ্টি আমাদের পাশ্চাত্যদেশে অপরিজ্ঞাত।
কাঁদুনী-সুরের বাদ্যসহকারে বিবাহের বরযাত্রী চলিয়াছে; আগেআগে নর্ত্তকের দল, তাহার পাশে-পাশে করতাল ও শানাই-বাদক। বর ক’নের মুখ জুঁইফুলের ঝালরে ঢাকা; তাহাদের জরীর পাগ্ড়ী হইতে উহা অবগুণ্ঠনের ন্যায় ঝুঁলিয়া রহিয়াছে। কখন-কখন বরক’নে খুবই অল্পবয়স্ক; বরের বয়স হদ্দ ৫ বৎসর, কন্যার বয়স দুই-কিংবাতিন বৎসর। বর-কন্যা দুই জনে কেমন গম্ভীরভাবে এক পাল্কিতে বসিয়া আছে—দেখিলে হাসি পায়। যে বরের বয়স ১৫।১৬বৎসর, সে ঘোড়ায় চড়িয়া যায়; কিন্তু তাহারও মুখ ফুলের ঝালরে ঢাকা থাকে। এই ভারতীয় লোকদের এখনও সেই সুখের আদিম অবস্থা—প্রায় শৈশব-অবস্থা বলিলেও হয়। আধুনিক জগতের সহিত যেন আপে খাপ খায় না। কিন্তু ইহাদের সূক্ষ্ম চিন্তা-কল্পনা আমাদের চিন্তা-কল্পনাকে ছাড়াইয়া যায়, এবং বিশুদ্ধ ও উন্নততর আধ্যাত্মিক রাজ্যে, উহারা আমাদের মস্তিষ্কহীন অপদার্থ লোকদিগের অপেক্ষা যে কত উচ্চস্থান অধিকার করে, তাহা বলা যায় না; অথচ আমাদের কোন কোন উচ্চপদধারী গণ্ডমুর্খ, উহাদের মুখের উপর চুরুটের ধম ফুৎকার করিতেও কুণ্ঠিত হয় না।...
বারাণসীতে, ধ্যানধারণা পূজা-অর্চ্চনার এমন একটা পুণ্যপ্রভাব চতুর্দ্দিকে বিরাজমান যে, সহজেই অন্তরাত্মা ঊর্দ্ধে উন্নীতহয়,—এই কথা সেই নিস্তব্ধ ক্ষুদ্রগৃহের তত্ত্বজ্ঞানীরা বলিয়াছিলেন; তাঁহাদের কথাটা খুবই সত্য; এখানে প্রথমে যে আইসে, কিছুদিন পরে সে আর সে লোক থাকে না। অথচ এখানকার বিচিত্র পার্থিব মায়াদৃশ্য যেরূপ চিত্তবিমোহন, এমন আর কোথাও নহে; এখানকার আকৃতির সৌন্দর্য্য যেরূপ চিত্তচাঞ্চল্যকর—রূপের সৌন্দর্য্য যেরূপ চিত্তলোভন, এমন আর কোথাও নহে; একদিকে পৃথিবীর আহ্বান, অপর দিকে স্বর্গের আহ্বান—এই দুয়ের মধ্যে সংগ্রাম বাধিয়া চিত্ত যেন কেন্দ্রচ্যুত হইয়া পড়ে।
সকল দেবালয়েই পুণ্যশঙ্খ নিনাদিত হইতেছে, ঝটিকার রোলে প্রকাণ্ড ঢাক-ঢোল বাজিতেছে; প্রভাত ও সন্ধ্যায়,—লোহিত মন্দিরচুড়ার চারিধারে ‘জলদবৎ পরিব্যাপ্ত কাকদিগের চিরন্তন কা-কা-রবকে আচ্ছন্ন করিয়া পূজার বাদ্যকল্লোল সমুত্থিত হইতেছে।
সেই দুর্গা—সেই ভীষণদর্শন করালী দেবী কালীরও মন্দির এই পুণ্যনগরীতে প্রতিষ্ঠিত আছে; মন্দিরটি ঘোর রক্তবর্ণ;—শোণিতের বর্ণ;—যে শোণিতপানেও তাঁহার পিপাসার শান্তি হয় না; হতজীবের পূতিগন্ধে সমস্ত মন্দির পরিব্যাপ্ত; মন্দিরের সানে বীভৎস রক্তের দাগ; কেন না, এখনও বলিদান চলিতেছে। ক্ষুদ্র গঠনহীন কালীমূর্ত্তি মন্দিরদালানের ভিতরদিক্কার একটা কুলুঙ্গির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। মূর্ত্তিটি কৃষ্ণবর্ণ, মনুষ্যভ্রুণের মত অপরিস্ফুট—বড় বড় চোখ; রক্তবস্ত্রের মধ্য হইতে অর্দ্ধেক বাহির হইয়া আছে। এই রক্তের পূতিগন্ধের সহিত আবার বানরের গায়ের অসহ্য দুর্গন্ধ মিশিয়াছে। কতকগুলা চোখ মিট্মিট্ করিতেছে—চারি কোণ হইতেই আমার দিকে তাকাইয়া আছে; মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্র কতকগুলা নির্লজ্জ দুবিনীত জীব লাফ দিয়া আমার কাঁধের উপর আসিয়া বসিল—ছোট-ছোট চটুল শীতল হস্ত আমার চুল ধরিয়া টানিতে লাগিল, আমার আস্তিনের মধ্যে ঢুকিবার চেষ্টা করিতে লাগিল…বন হইতে বাহির হইয়া এই বানরগুলা মন্দিরের মধ্যে আড্ডা গাড়িয়াছে—উহাদিগকে মন্দির হইতে বহিস্কৃত করিতে কাহারও সাহস হয় না; মন্দির ও মন্দিরসংলগ্ন উদ্যানে উহারা পিল্পিল্ করিতেছে; সকলেই উহাদিগকে ভক্তি করে; আজ প্রত্যেকেই এই অনধিকারপ্রবেশী ক্ষুদ্র জীবদিগের জন্য ছোলার দানা আনিয়াছে,—উহারা এই স্থানের যথেচ্ছাচারী প্রভু হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
সকলের মধ্যস্থলে স্বর্ণমন্দির; ইহা যেন বারাণসীর হৃদয়দেশ; এই হৃদয়টি অন্ধকেরে গলি-উপগলির জটিলতার মধ্যে সযত্নে রক্ষিত। মন্দিরটি ক্ষুদ্র; এরূপ আচ্ছাদিত যে, উহার কোন অংশই কেহ দেখিতে পায় না; এবং ইহার লোকবিশ্রুত গম্বুজগুলা পাত্লা সোনার পাতে মণ্ডিত—কেবল পার্শ্ববর্ত্তী ছাদের দর্শকদিগের নিকট অথবা গগনবিতণরী বিহঙ্গদিগের নিকটেই সুপরিচিত। যতই উহার নিকটে যাওয়া যায়, ততই জটিল গোলকধাঁদার মধ্যে আসিয়া পড়া যায়, ক্রমেই উহার পরিসর সঙ্কীর্ণ হইয়া উঠে, সাঙ্কেতিক মূর্ত্তির সংখ্যাবৃদ্ধি হয়। প্রচুর ভগ্নাবশেষ; রাশীকৃত মলা-আবর্জ্জনা; সর্ব্বত্রই বিগ্রহ—এক প্রকার প্রহরিঘরের মধ্যে অবস্থিত; হল্দে ফুলের মালা মাটীতে পড়িয়া-পড়িয়া পচিতেছে; ডিম্বের ন্যায় গোলাকার কিংবা লিঙ্গাকারে খোদিত শিলাখণ্ডসকল আধারপীঠের উপর সংস্থাপিত; এই প্রস্তরগুলা এরূপ পবিত্র যে, উহাদিগের পাশ ঘেঁষিয়া যাইতেও কেহ সাহস করে না। দোকানে, পিতল কিংবা মার্ব্বেলের পুতুলসকল বিক্রীত হইতেছে;—এখানকার তৈয়ারী বলিয়াই উহাদের বিশেষ মাহাত্ম্য। প্রেতমূর্ত্তি সন্ন্যাসী,—চোখগুলা জলন্ত অঙ্গারের মত—সমস্ত শরীর ভস্মাবৃত, মুখমণ্ডল গুপ্তচিহ্নের দ্বারা অঙ্কিত—শুক্ন কাঠের আগুন জ্বালাইয়া তাহার সম্মুখে উবু হইয়া রাস্তার ছায়ায় বসিয়া আছে। তাহাদের পাশ দিয়া যখন চলিয়া গেলাম, অস্থিসার বাহু ধীরে ধীরে উত্তোলন করিয়া তাহারা আমাকে ইঙ্গিতে আশীর্ব্বাদ করিল।
চারিদিক্ রুদ্ধ চত্বরের মত একটা স্থান—তাহার উপর রাশীকৃত প্রাচীর ও ভগ্নাবশেষ স্থাপিত; ইহাই বলিতে গেলে স্বর্ণমন্দিরের অঙ্গন অথবা আধারপীঠ; কিন্তু ইহা ঠিক মন্দিরের সম্মুখে অবস্থিত নহে; মন্দিরের দ্বারদেশে যাইতে হইলে আবার একটা সঙ্কীর্ণ অন্ধকেরে গলির ভিতর দিয়া যাইতে হয়। এই স্থানটি অতীব পবিত্র, সাধুসন্ন্যাসীরা এখানে নিয়ত বাস করে। এখানকার কোন জিনিষ স্পর্শের দ্বারা কলুষিত না হয়, এইজন্য বিদেশীকে সর্ব্বদাই বিশেষরূপে সতর্ক থাকিতে হয়। এখানে-ওখানে, দেয়ালের মধ্যে খোদিত কুলুঙ্গি রহিয়াছে;—কুলুঙ্গিগুলা জালিকাটা পিতলের কপাটে বদ্ধ—তাহার মধ্যে মসৃণ শিলাখণ্ডসকল সারি-সারি অধিষ্ঠিত, এই শিলাখণ্ডগুলা, জন্ম ও মৃত্যু, এই দুই মহারহস্যের সাঙ্কেতিকমূর্ত্তি। বড়-বড় বন্যপশুকে যেরূপ পিঞ্জরে বদ্ধ করিয়া রাখা হয়, সেইরূপ ধাতুময়-স্থূল-গরাদে-বিশিষ্ট পিঞ্জরসকল ভীষণদর্শন বিগ্রহে পরিপূর্ণ; এবং এক একটা ছায়াময় কোণে,—ন্যাক্ড়াকানি ও হল্দে ফুলের মালায় পরিবেষ্টিত ভাঙাচোরা ভীষণ গণেশমূর্ত্তি,—ভক্তবৃন্দের ভক্তিপূর্ণ হস্তের ঘর্ষণে ক্ষয় হইয়া গিয়াছে। শুষ্ক ফুলের মালা মাটীর উপর ছড়ান রহিয়াছে; তাহার সহিত বহুবর্ষসঞ্চিত ধূলারাশি মিশিয়াছে। মধ্যে-মধ্যে পবিত্র গরুদের গোময়ের উপর পা পড়িয়া যায়; এই গাভীবৃন্দ সমস্তদিন ইতস্ততঃ জনতার মধ্যে বিচরণ করিয়া সন্ধ্যার সময় আবার এইখানে ফিরিয়া আইসে। এই স্থানটি তীর্থযাত্রীদিগেরও একটা আড্ডা। চতুষ্পার্শ্বস্থ তপোবনের ধর্ম্মনিষ্ঠ তপস্বী, দিব্যভাবপরিব্যক্ত সুন্দর মুখশ্রী, অরুণবস্ত্রধারী, শুদ্ধচিত্ত যোগী,—রুদ্রাক্ষ ও কড়ির মালায় সর্ব্বাঙ্গ সমাচ্ছন্ন—ইহারা একটা প্রস্তরময় চতুষ্কমণ্ডপের মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে। পুরাকালে, ইহাদেরই জন্য এই সকল মণ্ডপ নির্ম্মিত হয়। ইহাদের চতুষ্পার্শ্বে এখানকার নিত্যনিবাসী ভিক্ষু সন্ন্যাসী, মৃগীরোগগ্রস্ত সন্ন্যাসী,—জ্বরবিকারীর ন্যায় রক্তনেত্র ধরালুণ্ঠিত কঙ্কালমূর্ত্তি, যাহারা ভিক্ষার জন্য লুপ্ত-অঙ্গুলী হস্ত বাড়াইয়া দেয়, সেই সব কুষ্ঠরোগী...এই সকল জড়বৎ অচল ভস্মলিপ্ত ছদ্মবেশী লোক—যাহাদের সমস্ত জীবন যেন চোখের তারার মধ্যেই পুঞ্জীভূত,—ইহারাই মন্দিরের আশপাশে যেন একটা অস্পষ্ট বিভীষিকার ছায়া বিস্তার করিয়া রহিয়াছে; কতকগুলা বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, যাহাদের জটাকলাপ স্ত্রীলোকের খোঁপার মত মস্তকের চূড়াদেশে উঁচু করিয়া বাঁধা;—ইহাদের দৃষ্টিপথে একবার যে পতিত হয়, ঐ ভীষণ মূর্ত্তি উপচ্ছায়ার ন্যায় তাহাকে নিয়ত অনুসরণ করে—সে কখনই তাহা ভুলিতে পারে না।
স্বর্ণমন্দিরের মধ্যে কোন বিধর্ম্মী প্রবেশ করিতে পায় না। কিন্তু দ্বারদেশের সম্মুখে, পুরোহিতদিগের একটি সেকেলে-ধরণের গৃহ আছে; এই গৃহ ও স্বর্ণমন্দির—এই উভয়ের মধ্যে একটা সরু গলিপথ। এই পুরোহিতগৃহের উপরে সকলেই অবাধে উঠিতে পারে। এখানে প্রতিদিন প্রাতে ও সন্ধ্যায় মৃত্যুদেবতার নিকট শোকসঙ্গীত হইয়া থাকে; তাহার সঙ্গে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড ঢাক-ঢোল বাজিতে থাকে। এবং যেখানে বসিয়া তুরীবাদকেরা তুরীনাদ করে, সেই গবাক্ষবারণ্ডাটি এমন জায়গায় অবস্থিত যে, সেখান হইতে মন্দির-গম্বুজের অসীম ঐশ্বর্য্য, খুব নিকট হইতে দেখা যায়। এই মন্দিরের তিনটি গম্বুজ। একটা গম্বুজ কালো-পাথরের—উহা পিরামিড়-আকারে সজ্জিত দেবদেবীর মূর্ত্তিতে পরিপূর্ণ। আর দুইটি একেবারেই সোনার;—খোদাই-কাজ-করা পুরু সোনার পাতে গঠিত; তা, ছাড়া, ইহার একটি অসাধারণত্ব দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়;—এই পুরু, খাদহীন সোনার পাতের যে উজ্জ্বলতা, তাহা যুগযুগান্তরেও ম্লান হয় নাই। কোন কৃত্রিম উপায়ে কোন সোনার কাজে ঐরূপ উজ্জ্বলতার অনুকরণ করা অসম্ভব। এই সকল সোনার কারুকার্য্যের খোঁচ্-খাঁচের মধ্যে টিয়ারা বাসা বাঁধিয়া সপরিবারে বাস করিতেছে;—কেহই তাহাদের বাধা দেয় না; উহা যেন পূর্ব্ব হইতেই একপ্রকার বোঝাপড়া হইয়া আছে। স্বর্ণপুষ্প, স্বর্ণপল্লবের মধ্যে এই সকল অসংখ্য টিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; ইহাদের স্বাভাবিক সবুজ রং, সোনার জমির উপর আরও যেন সবুজ দেখাইতেছে।
প্রায় সকল রাস্তাই গঙ্গায় আসিয়া শেষ হইয়াছে; গঙ্গার ধারে আসিয়া আরও ফলাও—আরও পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে; এই গঙ্গার ধারেই বারাণসীর বিরাট্ মহিমা যেন সহসা আবির্ভুত,—বড়-বড় প্রাসাদ, দীপ্ত আলোকের তরঙ্গলীলা। এই গঙ্গার জন্যই, নগরের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত, জম্কাল সোপান প্রস্তুত হইয়াছে—সেই সোপান দিয়া গঙ্গার পূতজলে অবতরণ করা যায়; এমন কি, যখন জল শুকাইয়া নদীর তল নিম্ন হইয়া পড়ে (যেমন এই সময়ে), নদীর গভীর গর্ভে নিমজ্জিত ভগ্নাবশেষসমূহ যখন বাহির হইয়া পড়ে, তখনও ঐ সোপান দিয়া নদীর জলে নাবা যায়। সোপান-ধাপের স্থানে-স্থানে ছোট-ঘোট পাথরের ঘর রহিয়াছে, সেইখানে বিভিন্ন মন্দিরের বিভিন্ন দেবতার ক্ষুদ্রাকার মূর্ত্তিসকল প্রতিষ্ঠিত। প্রতিবর্ষ বর্ষাগমে এই সকল মূর্ত্তি জলের মধ্যে দীর্ঘকাল নিমজ্জিত থাকে এবং জলের বেগকে আট্কাইবার জন্য এই সকল ক্ষুদ্র মূর্ত্তি গুরুপিণ্ডাকারে নির্ম্মিত হইয়াছে।
এই নদীই বারাণসীর জীবন—বারাণসীর মাহাত্ম্যের মুখ্যহেতু। কি প্রাসাদ, কি অরণ্য—সকল স্থান হইতেই লোকেরা এই জাহ্নবীর পুণ্যতীরে মরিবার জন্য আইসে; বৃদ্ধ ও রুগ্ন ব্যক্তিগণ দূর হইতে সপরিবারে এখানে আইসে, উহাদের মৃত্যু হইলে পরিবারস্থ লোকেরা আর ফিরিয়া যায় না। এখানকার লোকসংখ্যা এখনই ত তিনলক্ষ,—এই সংখ্যা আবার বৎসরে বৎসরে আরও বর্দ্ধিত হয়; যাহাদের অন্তিমকাল আসন্ন, তাহারা এই স্থানকে আগ্রহের সহিত আকাঙ্ক্ষা করে।…
কাশীধামে মৃত্যু! গঙ্গাতীরে দেহত্যাগ! গঙ্গার জলে মৃতদেহের অন্তিম অবগাহন, গঙ্গাজলে শেষ ভস্মনিক্ষেপ—আহা! সে কি সৌভাগ্যের কথা!...