ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/স্থৈর্য্যনাশ
“মনস্ঃ—সংস্কৃত ভাষায় এই শব্দের অর্থ—এমন একটি পদার্থ যাহা আমাদের চতুর্দ্দিকে বিকীরিত হইতেছে—ব্যাপ্ত হইতেছে—অথচ উহার এমন কোন পৃথক সত্তা নাই যাহা চিরকাল অক্ষুণ্নভাবে বর্ত্তমান থাকিবে। উহার কোন নির্দ্দিষ্ট সীমা দির্দ্দেশ করা সম্ভব নহে।...”
বিঙ্গ-পরিসেবিত সেই ক্ষুদ্র গৃহের নীরবতার মধ্যে আমার দীক্ষাদাত্রী আমাকে ঐ কথাগুলি বলিলেন। সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা সামান্য তক্তার উপর, মুখামুখী হইয়া আমরা দুজনে উপবিষ্ট।
তাঁর উপদেশে কেমন একটা একগুঁয়েমি ভাব আছে;—কিন্তু সেই উপদেশ একদিকে যেমন অনন্য কঠোর, তেমনি আবার কারুণ্যরসসিক্ত; এই উপদেশের প্রভাবে, আত্মার পৃথক সত্তার ধারণা আমার মন হইতে যেন ক্রমশঃ অপসারিত হইতে লাগিল; যাদের আমি ভালবাসি, আমার আত্মীয় স্বজন, অপর লোক, আমি স্বয়ং—সমস্তই ধ্বংস হইতে চলিল; কতকগুলি ক্ষুদ্র অংশ একই সমষ্টি হইতে ক্ষণকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হইয়াছে; পরে, কালচক্র যখন আবার আবর্ত্তিত হইবে, তখন ঐ সকল অংশ, সেই অক্ষয় অক্ষুণ্ন মহাসমষ্টির অতল গর্ভে আবার আসিয়া চিরতরে নিমজ্জিত হইবে! “একদিন ঈশ্বরের ক্রোড়ে গিয়া আবার তোমরা পুনর্ম্মিলিত হইবে”—বাইবেলের এই অস্পষ্ট ও মধুর আশ্বাস-বাণীর ইহাই সুস্পষ্ট ও বিষাদময় ব্যাখ্যা।
যাহারা আমাদের ভালবাসার জিনিস তাহাদের পৃথক্ সত্তা স্থায়ী হইবে—ইহা একটা মায়া বিভ্রম মাত্র; তাহাদের হাসি, তাহাদের দৃষ্টি, অন্য হইতে যাহা কিছু তাহাদের বিশেষত্ব, তাহাদের অমর আত্মার যে একটু ছায়া আমাদের নিকট প্রতিভাত হয়, আত্মারই মত যাহাকে আমরা নির্ব্বিকার ও অবিনশ্বর বলিতে ইচ্ছা করি—এ সমস্তই মায়া-বিভ্রম। মানব-জীবনসম্বন্ধে খৃষ্টানদের যে ধারণা, এতদিন সেই ধারণাকে আমি প্রাণপণে আঁক্ড়াইয়া ধরিয়াছিলাম—আমার মমতাময় মানব-হৃদয়ের নিকট যাহা অতীব বীভৎসজনক বলিয়া মনে হইয়াছিল সেই মতবাদটিকে পরীক্ষারও অযোগ্য বিবেচনা করিয়াছিলাম; অবশেষে, মাদ্রাজে, ঐ মতবাদকে আমি একেবারেই অগ্রাহ্য করি; অবশ্য মাদ্রাজে, ঐ মতবাদটি বৌদ্ধধর্ম্মের আরও নির্ম্মম নিষ্ঠুর আকারে আমার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু এখন দেখ, যে মতবাদ কোন্ পুরাকালে আমাদের রহস্যময় পূর্ব্বপুরুষেরা পরিব্যক্ত করিয়াছিলেন, আমার দীক্ষাগুরু সেই সমগ্র মতবাদটি একটু একটু করিয়া ক্রমশ আমার উপর চাপাইয়া দিয়াছেন; এবং অনেক অবর্ণনীয় ভয়-আশঙ্কার পর, এখন দেখিতেছি আমার দীক্ষাগুরুর উপদেশের মধ্যে যেটুকু সান্ত্বনা পাওয়া যায় তাহাই অগত্যা আমাকে মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিতে হইবে।
এই উপদেশের ফলে,—তত্ত্বজ্ঞানীদের ধ্যানলব্ধ বিচ্ছেদ-তত্ত্বটি আমার অন্তরের অন্তস্থলে প্রবেশ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। যে সকল প্রিয়জনকে আমি হারাইয়াছি তাঁহাদের স্মৃতির সহিত এখন আর একটা যাতনাময় জিজ্ঞাসা সংযুক্ত নাই। অবশ্য তাঁহারা জীবিত আছেন, কিন্তু পীড়নকারী ও মায়াময় আমিত্ব হইতে তাঁহারা প্রায় বিমুক্ত। দূর ভবিষ্যতে তাঁহাদের সহিত পুনর্ম্মিলিত হইব—কিংবা আরও ঠিক করিয়া বলিতে গেলে—তাঁহাদের সহিত একেবারে মিশিয়া যাইব—এই কল্পনাটি এখন আমি মানিয়া লইয়াছি। এইরূপ যে মিশিয়া যাইব, তাহা মৃত্যুর পরক্ষণেই নহে, কিন্তু হয় ত যুগ-যুগান্তরের পর। তাছাড়া, এই যুগযুগান্তর-কালও বিভ্রমাত্মক,—সুতরাং উহার সহিত বর্ত্তমান জন্মের ক্ষণিক জীবনের যতটুকু সম্বন্ধ সেইটুকু কালই আমরা উপলব্ধি করিতে পারি।
আমি জানি, এই সন্ন্যাস বৈরাগ্যের ভাব আমার মন হইতে চলিয়া যাইবে; এই তত্ত্বজ্ঞানীদের গৃঢ় প্রভাব হইতে দূরে সরিয়া গেলেই, আবার আমি জীবন পাইব, কিন্তু পূর্ব্বেকার মত নহে; আমার আত্মার অন্তরের মধ্যে যে বীজ উপ্ত হইয়াছে, তাহা অঙ্কুরিত হইয়া আবার আমার জীবনকে আচ্ছন্ন করিবে,—সম্ভবত আবার আমাকে বারাণসীতে ফিরিয়া আনিবে। এতদিন পৃথিবীতে যে কাজ করিয়াছি, যে ভাবে জীবন কাটাইয়াছি, এখন তাহার দীনতা ও ব্যর্থতা উপলব্ধি করিতেছি; রূপ ও রঙে আমি উন্মত্ত ছিলাম, পার্থিব জীবনে যারপরনাই মুগ্ধ ছিলাম; যাহা কিছু ক্ষণভঙ্গুর তাহাকে আটকাইয়া রাখিতে—যাহা কিছু অস্থায়ী তাহাকে ধরিয়া রাখিতে, আমার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল।
আজ রাত্রে আমি তত্ত্বজ্ঞানীদের গৃহ হইতে চলিয়া যাইব; উহার বাহ্য আকর্ষণে আমি চিরমুগ্ধ—না জানি আবার কোন্ দিন উহার আকর্ষণে আকৃষ্ট হইয়া এখানে আসিব।
লক্ষ্যহীন হইয়া বাবাণসী নগরে ইতস্ততঃ পর্যটন করিতে করিতে, এইবার দৈবক্রমে নর্ত্তকী ও বেশ্যাদিগের অঞ্চলে আসিয়া পড়িয়াছি। বাড়ীর নীচের তালায় অসংখ্য ছোট ছোট দোকান; সেখানে চুমকিবসানো মল্মল, জরির মল্মল, বংকরা মল্মল বিক্রীত হইতেছে; দোকানীরা এই মাত্র প্রদীপ জ্বালিয়াছে। রাস্তার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত সমস্ত বাড়ীর উপরকার তালাগুলি সোহাগ-লালিতা তিমিরাশ্রিতা ললনাদের বাসস্থান; নৈশ বেশ্যাবৃত্তির জন্য উহারা অত্যুজ্জ্বল বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া, গবাক্ষের সম্মুখে, বারাণ্ডার ধারে বাহার দিয়া বসিয়াছে; পশ্চাদ্ভাগে উহাদের দীপালোকিত ঘরগুলি দেখা যাইতেছে, শিশু-রুচিসুলভ প্রাচুর্য্য সহকারে অসংখ্য ঝাড়লণ্ঠন কড়িকাঠ হইতে ঝুলিতেছে। ঘরের চুনকাম-করা শাদা দেয়ালে গণেশের চিত্র, হনুমানের চিত্র, কিংবা রক্তাপ্লুতা কালীর চিত্র রহিয়াছে। বেশ্যাদিগের নগ্ন বাহুতে, কর্ণযুগলে, নাসারন্ধ্রে,—বলয়াদি ও বিবিধ রত্নরাজি ঝিক্মিক্ করিতেছে। তীব্রগন্ধী পুষ্পমালা বহু-স্তবকে বক্ষের উপর ঝুলিতেছে। প্রভাতে গঙ্গাতীরে যে সকল দুরধিগম্যা ব্রাহ্মণ-কন্যাকে দেখা যায় তাহাদেরই মত ইহাদের একই প্রকার মখমল-কোমল নেত্র, বোধ হয় তাহাদেরই মত একই প্রকার উজ্জ্বল শ্যামল গাত্র,—সহসা বিভ্রম জন্মিতে পারে...