ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/যে প্রস্তর-পীঠের উপর বুদ্ধদেব বসিয়াছিলেন

যে প্রস্তর-পীঠের উপর বুদ্ধদেব বসিয়াছিলেন।

 যে প্রস্তর-পীঠের উপর বুদ্ধদেব বসিয়াছিলেন সেই পীঠটি দেখাইবার জন্য আমার বন্ধু আমাকে সহরের বাহিরে, পল্লীর মাঠময়দানের দিকে লইয়া গেলেন। পথে যাইতে যাইতে, সেই মেঠো নিস্তব্ধতার মধ্যে আমরা অলৌকিক তত্ত্ব সম্বন্ধে আলাপ করিতে লাগিলাম।

 বারাণসীর পল্লীভূমি অতীব নির্জ্জন, প্রশান্ত, এবং গোপজীবন-সুলভ শান্তি-রসাশ্রিত। কতকগুলি যব ও ধান্যের ক্ষেত দেখা যাইতেছে; এখন ফেব্রুয়ারী মাস—ইহার মধ্যেই শস্যাদি পাকিয়াছে, গাছপালা সবুজ হইয়া উঠিয়াছে; এইরূপ না হইলে, কতকটা ফ্রান্‌সের ক্ষেত্রভূমি বলিয়া মনে হইত। রাখালেরা বেণু বাজাইতে বাজাইতে গো মহিষ ও ছাগল চরাইতেছে। বনভূমির কোণে, কতকগুলি পুরাতন পবিত্র শিলাখণ্ড রহিয়াছে,—সেইখান দিয়া যাইবার সময়, কোন ভক্ত কৃষক উহার উপর একটা হল্‌দে ফুলের মালা ফেলিয়া গিয়াছে; এই সকল শিলাখণ্ড গণেশ ও বিষ্ণুর মূর্ত্তি বলিয়া পূজিত; গঠন-হীন হইলেও এখনও উহাতে গণেশ ও বিষ্ণুর কতকটা সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। সুন্দরসুন্দর রঙের পাখী,—কাহারও বা ফেরোজা মণির মত নীল-রং, কাহারও বা মরকত মণির মত সবুজ-রং—উহারা বিশ্বস্তভাবে আমাদের খুব কাছে আসিয়া বসিতেছে;—উহারা মানুষকে ভয় করে না, কেননা এখানে কেই উহাদিগকে হত্যা করে না। এই সমস্ত প্রদেশের উপর মূর্ত্তিমান শান্তিরস যেন স্তব্ধভাবে পক্ষ বিস্তার করিয়া রহিয়াছে।

 এখানে ওখানে অট্টালিকা ও সমাধি-মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ স্তুপাকারে অবস্থিত—তাহাতে বৃক্ষের শাখা প্রশাখা ও শিকড় জড়াইয়া রহিয়াছে; উহার উপর ক্ষুদ্র গ্রাম সকল স্থাপিত;—দেবালয় ও সমাধিস্থানের পুরাতন প্রাচীরে এখানকার কুটীর-সকল নির্ম্মিত হইয়াছে।

 যে সময়ে বৌদ্ধধর্ম্ম বিস্তার লাভ করে, সেই সময়ে কতকগুলি বৌদ্ধমঠ নির্ম্মিত হইয়াছিল; তাহার পর, দেশের উপর দিয়া যখন মুসলমান ধর্ম্মের প্রচণ্ড স্রোত বহিয়া যায়, তখন ঐ সকল মঠ মস্‌জিদে পরিণত হয়; আবার যখন প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম আসিয়া দেশকে পুনরধিকার করে, তখন আবার ঐ সকল মস্‌জিদ পরিত্যক্ত হয়। এই সকল পরিত্যক্ত মস্‌জিদ; সন্ন্যাসী যোগী ও যোদ্ধাদিগের এই সকল সমাধি-মন্দির;—সমস্তই, আম্রকানন ও কদলীবনের নালিন ছায়ায় মিশিয়া গিয়াছে; ধর্ম্মোন্মত্ত প্রত্যেক আক্রমণকারীর ইচ্ছামত, বড় বড় প্রস্তরখণ্ড কতবার ওলট্‌পালট্‌ হইয়া গিয়াছে—উহার একদিকে বুদ্ধের পদ্ম এবং অপরদিকে কোরাণের বয়েৎ অঙ্কিত রহিয়াছে। এই সকল প্রশান্ত ধ্বংসাবশেষের উপরে এখনকার কুটীরবাসী লোকেরা প্রাচীন পদ্ধতি-অনুসারে, শিল্পকর্ম্মে ব্যাপৃত, উহারা রেশমের কোমরবন্দ বুনিতেছে; উহার সূতাগুলা তৃণের উপর প্রসারিত হইয়া কথন কখন সমাধি ভূমির উপর দিয়া‌ও চলিয়া গিয়াছে; উহারা মলমল-কাপড়ে রং করিতেছে; রং-করিয়া ফাট্‌-ধরা কোন পুরাতন মন্দির-চূড়ার উপর, রদ্দুরে শুকাইতে দিয়াছে।

 শ্রদ্ধাস্পদ পণ্ডিত, আমাকে যে তীর্থস্থানে লইয়া যাইতেছেন, উহা আরও দূরে অবস্থিত।

 পথের মাঝে একটা গরুর গাড়ীর পাশ দিয়া আমরা চলিয়া গেলাম—গরুর গাড়ীটা শিশুতে ভরা,—বৃদ্ধ যাদুকরের মত একজন লোক উহাদিগকে লইয়া যাইতেছে। উহা আমাদের দেশের জুজুর গাড়ী কিম্বা জুজুর ঝুড়ী মনে করাইয়া দেয়। ছেলে মেয়েতে প্রায় ২০টি শিশু গাদাগাদী করিয়া রহিয়াছে; ফুকর-বিশিষ্ট তক্‌তা-ঘেরের মধ্য হইতে—চাঁদোয়ার নীচে হইতে—গাড়ীর সর্ব্বাংশ হইতেই উহাদের মাথা দেখা যাইতেছে। উহারা কণ্ঠহার নলক প্রভৃতি অলঙ্কারে বিভূষিত, উৎসবোচিত পরিচ্ছদ ও চুম্‌কি-বসান উচ্চ মুকুটে সজ্জিত; উহাদের বড় বড় চোখ‌্—কজ্জল-রেখায় অঙ্কিত হওয়ায় আরও বড় দেখাইতেছে;—আমি শুনিলাম, শোভর জন্য নহে কিন্তু পাছে পথিমধ্যে কোন দুষ্ট ডাইনী ঐ নির্দ্দোষী শিশুদের উপর নজর দেয়- তাহা নিবারণ করিবার জন্যই উহারা চোখে কাজল পরিয়াছে। দেখিতে জুজুর মত যে ভাল মানুষটি, গাড়ীটা আস্তে আস্তে হাঁকাইতেছে উহার দীর্ঘ শুভ্র শ্মশ্রু নদীর মত প্রবাহিত, উহার নগ্ন গাত্র,—উত্তর দেশীয় ভল্লুকের ন্যায় শাদা রামে আচ্ছাদিত। লোকটা শিশুদের লইয়া কোথায় যাইতেছে? বোধহয় শিশুদের কোন একটা উৎসবে;—সেই জন্যই উহারা এই আনন্দের সাজসজ্জায় সজ্জিত এবং পুতুলের ন্যায় অলঙ্কারে বিভূষিত।

 এখন আমরা খোলা মাঠের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি। এখন গাড়ী হইতে নামিয়া, প্রখর রৌদে, একটি অনুর্ব্বর ক্ষুদ্র ভূ-খণ্ডের উপর দিয়া হাঁটিয়া যাইতে হইবে। এই আমাদের গন্তব্য স্থান;—ধ্বংসাবশেষ গুলারই ন্যায় ঘোর-ধুসরবর্ণ কতকগুলা গগুশৈল—তাহারই মধ্যে একটা চক্রাকৃতি পাথুরে জায়গা; এইখানে একজন রাখাল বাঁশি বাজাইতেছে, আর সেই বংশী-ধ্বনির সঙ্গেসঙ্গে ছাগেরা একপ্রকার সূক্ষ্ম তৃণ চর্ব্বণ করিতেছে। এইখানে কতকগুলা বড় বড় গাছ আছে, দূর হইতে আমাদের ওকগাছ বলিয়া ভ্রম হয়—এই সব গাছের ছায়ার মধ্যে একটা বহু পুরাতন কালো পাথরের পীঠ আছে; আমি ও পণ্ডিত এই প্রস্তরপীঠের উপর ভক্তিভাবে বসিলাম। দুই সহস্র বৎসরের অধিক হইল, বুদ্ধদেব ইহার উপর বসিয়া তাঁহার প্রথম উপদেশ বিবৃত করিয়াছিলেন। কিয়ৎ শতাব্দি হইতে, বৌদ্ধধর্ম্ম এই সমস্ত প্রদেশ হইতে অন্তর্হিত হইয়া, সুদূর প্রাচ্য ভূখণ্ডে বিস্তারলাভ করিয়াছে। এখন এই পুরাকালের পূণ্যভূমিতে ভারতবাসিগণ আর আইসে না। কিন্তু ইহার পরিত্যক্ত অবস্থা সত্ত্বেও, এই প্রস্তর-পীঠটি এখনও বহুসহস্র মনুষ্যের কল্পনার সামগ্রী হইয়া রহিয়াছে। সুদূর চীনে, জাপানের দ্বীপপুঞ্জে, শ্যামের অরণ্যে, দুর্ব্বোধ্য পীত মস্তিষ্কসকল এই ঔপন্যাসিক আসন-পীঠের ধ্যান করিতেছে। কখনও কখনও সেখান হইতে তীর্থ যাত্রীরা পদব্রতে যোজন যোজন পথ অতিক্রম করিয়া, এইখানে আগমন করে এবং নতজানু হইয়া এই পীঠকে চুম্বন করে। এই গোপভূমিসুলভ শান্তির মধ্যে, এই রমণীয় নিস্তব্ধতার মধ্যে, আমি ও পণ্ডিত আমরা দুজনে ব্রাহ্মণ্যিক তত্ত্ব সম্বন্ধে বিশ্রম্ভালাপ করিতেছি।

 প্রাচীন ও হৃদয়হীন তত্ত্বজ্ঞানের উদ্দীপক এই পীঠের অনতিদূরে, ক্ষুদ্র পর্ব্বতের ন্যায় গুরুপিণ্ডাকৃতি একটা স্তূপ উঠিয়াছে—এক সময়ে উহা বহুল কারুকার্য্যে ভূষিত ছিল; কিন্তু দুই সহস্র বৎসর পরে এখন উহার খোদাই কাজগুলি ক্ষয় হইয়া গিয়াছে—এবং উহার আপাদ মস্তক, তৃণ ও কণ্টকগুল্মে আচ্ছন্ন হইয়াছে। পুরাতন বারাণসীতে যে বৌদ্ধমন্দির সর্ব্বপ্রথমে নির্ম্মিত হয়, ইহাই তাহার ধ্বংসাবশেষ। এই প্রকাণ্ড স্তূপের ভিতর-দেয়াল মনুষ্যপ্রমাণ উচ্চ; ইহার সমস্ত বহিঃপ্রসারিত অংশগুলি ইহার সমস্ত ক্ষয়গ্রস্ত প্রস্তর, সূক্ষ্ম স্বর্ণপত্রে মণ্ডিত; এবং উহা এই জরাজীর্ণ অবস্থাতেও অপূর্ব্ব ও অভাবনীয় উজ্জ্বলতা ধারণ করিয়া রহিয়াছে। চীনবাসী, অ্যানামাবাসী, ব্রহ্মবাসী তীর্থযাত্রীগণ তাহাদের নিজ নিজ দূর-দেশ হইতে স্বর্ণপত্র আনিয়া উহার গায়ে লাগাইয়া দেয়; এবং যাহা তাহাদের চিরধ্যানের বস্তু তাহাকে প্রত্যক্ষ দর্শন করিয়া এইরূপভাবে ভক্তিউপহার প্রদান করা উহারা কর্ত্তব্য জ্ঞান করে। বড়লোকদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইলে যেরূপ তাহাদের নিকট নিজের নাম লিখিয়া পাঠাইতে হয়—এই স্বর্ণপত্রগুলি, এই অবজ্ঞাত উপেক্ষিত পুরাতন পুণ্যপীঠের হস্তে অর্পিত একপ্রকার “সাক্ষাৎকার-পত্র” বলিলেও চলে।

 দিবাবসানে, আবার বারাণসীনগরে ফিরিয়া আসিয়া আমার ভ্রমণ সহচর তাঁহার এক বন্ধুর বাগানবাটীতে গাড়ী থামাইলেন। ইনিও তাঁহারই ন্যায় জাতিতে ব্রাহ্মণ, দর্শনশাস্ত্রে ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। ফলাদি আহার ও জল পান করিবার জন্য আমাকে তিনি সেইখানে লইয়া গেলেন। (বলা বাহুল্য, একজন ম্লেচ্ছ সঙ্গে আছে বলিয়া, তিনি স্বয়ং খাদ্যপানীয় গ্রহণ পক্ষে বিশেষ সতর্ক ছিলেন।) বাড়ীটি পুরাতন কিন্তু অতীব রমণীয়। ইহার সংলগ্ন একটি উদ্যান আছে—উদ্যানের রাস্তাগুলি একেবারে সোজা, আমাদের অনুকরণে ধারে ধারে চির-হরিৎ তরুরাজি এবং ফ্রান্সের সেকেলে বাগানের মত, ফোয়ারা-বিশিষ্ট জলের চৌবাচ্চা রহিয়াছে; আমাদের দেশের গোলাপাদি ফুলও রহিয়াছে; শীতের প্রভাবে কতকগুলা গাছ পত্রহীন হইলেও,—এই সকল ফুল, এই বায়ুর উত্তাপ, এই সকল হল্‌দে পাতা দেখিয়া মনে হয় যেন গ্রীষ্মঋতু শেষ হইয়া আসিতেছে, অথবা খর-রৌদ্র শরতের আবির্ভাব হইয়াছে; যেন বৃষ্টির অভাবে এই শরৎ অকালে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে—আলোকের আতিশয্যে বিষন্নভাব ধারণ করিয়াছে...