ইংরেজ ডাকাত/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
উহাদিগের কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে স্পষ্টই বিশ্বাস হইল যে, যদি প্রকৃতই এই চুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে আফিস বন্ধ হইবার পর শনিবারের রাত্রিতে এই চুরি হয় নাই, বা তাহার পরদিবসও এই চুরি হইতে পারে না। রাত্রি চারিটার সময়ও যখন তালা ঠিক বন্ধ আছে, এরূপ দেখা গিয়াছে, তখন চারিটার পর হইতে আফিস খুলিবার মধ্যে যে কয়েক ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়, তাহার মধ্যেই এই চুরি হওয়ার সম্ভাবনা। এরূপ অবস্থায় সোমবার প্রাতঃকালে সেইস্থানে যাহার পাহারা ছিল, তাহাকে একবার জিজ্ঞাসা করা কর্ত্তব্য, এই ভাবিয়া, যাহার পাহারা ছিল, তাহাকে ডাকাইলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানিতে পারিলাম যে, সে ফরিয়াদী ওয়ার্ণার সাহেবকে চিনে। সে কহিল, সোমবার আন্দাজ সাতটার সময়, ওয়ার্ণার সাহেবকে তাঁহার দোকানের তালা খুলিতে দেখিয়াছে। কিন্তু ওয়ার্ণার সাহেবকে সে বিষয় জিজ্ঞাসা করায়, তিনি তাহা অস্বীকার করিলেন। এইরূপ নানা কারণে ওয়ার্ণার সাহেবের উপরই আমাদিগের সন্দেহ হইল; কিন্তু স্পষ্ট করিয়া কাহারও কিছু বলিতে সাহস হইল না। গোপনে কিন্তু আমরা তাঁহারই বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। যে সকল ইংরাজ বা জর্ম্মাণ মিসের’ গৃহে তাঁহার যাতায়াত ছিল, তাহাদের উপরই তখন আমাদের সেই অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। তাহাতে একটু ফলও ফলিল।
যে মিসের নিকট তাঁহার সর্ব্বদা যাতায়াত ছিল, একদিবস দেখিলাম, সন্ধ্যার সময় সেই মিস্ আপনার স্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক একখানি ঠিকাগাড়িতে উঠিল। আমিও অপর আর একখানি ঠিকাগাড়ি করিয়া তাহার অনুগমন করিলাম। তাহার গাড়ি ইডেন গার্ডেনের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইল, আমিও সেইস্থানে গিয়া অবতরণ করিলাম। মিস্ বাগানের ভিতর প্রবেশ করিল, আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়া, তাহার নিকট-নিকটেই বেড়াইতে লাগিলাম। সেই সময়ে তাহার হস্তস্থিত অলঙ্কারের মধ্যে একগাছি সোণার বালার উপর আমার নয়ন পড়িল। উক্ত বালা দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইল, যে সকল দ্রব্য চুরি গিয়াছে বলিয়া ওয়ার্ণার চুরির নালিস করিয়াছিল, তাহার মধ্যে এইরূপ গড়নের দুইগাছি বালার কথাও উল্লিখিত আছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি আর কোন কথা না বলিয়া, সেই স্থান হইতে আপনার থানায় আগমন করিলাম। সেইস্থানের আমার উর্ধ্বতন ইংরাজ-কর্ম্মচারীর নিকট আমার মনের সন্দেহের কথা বলিলে, সেইদিবস রাত্রিতেই তিনি সেই মিসের বাড়ীতে গমন করিয়া সেই বালার কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।—আমিও তাঁহার সঙ্গেই ছিলাম।—উত্তরে মিস, কহিল যে, সে সেই বালা ওয়ার্ণার সাহেবের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে। তাহার নিকট ইহাও অবগত হওয়া গেল যে, ওয়ার্ণার সাহেব বোম্বাই সহরে আপনার মাতার নিকট একটী পার্সেল পাঠাইয়া দিয়াছেন। মিস্ বিবেচনা করেন যে, সেই পার্সেলের ভিতর করিয়া ওয়ার্ণার সাহেব কতকগুলি সোনার গহনা পাঠাইয়া দিয়াছেন। এই ব্যাপার প্রকাশ হওয়াতে কালবিলম্ব ব্যতিরেকে বোম্বাই পুলিস-কমিসনারের নিকট এক টেলিগ্রাফ পাঠান হইল। তিনি সেই পার্সেল আটক করিয়া, এইস্থানে পাঠাইয়া দিলেন। উহাতে কয়েকখানি সোণার গহনা ছিল, সে গুলিও চুরির মালের তালিকাভুক্ত।
এখন আর ওয়ার্ণার সাহেব যান কোথা? তাঁহার উপর বিশ্বাস-ঘাতকতার নালিস চালান সাব্যস্ত করিয়া, “সিঙ্গার কোম্পানির” প্রধান দোকানে বোম্বাই সহরে স্বত্বাধিকারীর নিকট এক টেলিগ্রাফ পাঠান হইল। তাহাতে সমস্ত কথা স্পষ্ট করিয়া লেখা হইল। আরও লেখা হইল, যেন সেইস্থান হইতে একজন কলিকাতায় আসিয়া এই মোকদ্দমায় ফরিয়াদী হন। তাহার বিপক্ষে যে এই সকল ষড়যন্ত্র হইতেছে, প্রথমে ওয়ার্ণার তাহার কিছুই জানিতে পারিয়াছিল না। বোম্বাই হইতে যখন দোকানের একজন স্বত্বাধিকারী আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাহার কিছু পূর্ব্বেই ওয়ার্ণার এই সকল বিষয় জানিতে পারিয়া পলায়ন করিল।
ওয়ার্ণারকে ধরিবার জন্য অনেক উপায়-অনুসন্ধান ও বিশেষ চেষ্টা হইল; কিন্তু কিছুই ফল হইল না। সেই সময়ে আমিও উহার অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, তাহাতে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, ওয়ার্ণার হাবড়ার রেলে আরোহণ করিয়া পশ্চিমাভিমুখে গমন করিয়াছে। ক্রমে সন্ধানে সন্ধানে আমিও সেইদিকে গমন করিয়া, সর্ব্বশেষে মোকামা-ষ্টেশনে উহার অনুসন্ধান পাইয়াছিলাম; কিন্তু সে স্থান হইতে সে কোন্দিকে চলিয়া গিয়াছিল, তাহা ঠিক করিতে না পারিয়া, আমি প্রত্যাগমন করি। ওয়ার্ণারের নামে ওয়ারেণ্ট বাহির হইয়াছিল, কিন্তু অনেক দিবস পর্য্যন্ত সে ধৃত হয় নাই।
এই ঘটনার প্রায় বৎসরাধিক পরে একটী কয়েদী লইয়া একজন ইংরাজ-কর্ম্মচারীকে রেঙ্গুন গমন করিতে হয়। তিনি ওয়ার্ণারকে চিনিতেন, সেইস্থানে তিনি উহাকে দেখিতে পান। ওয়ার্ণার একটী চাকরী যোগাড় করিয়া লইয়া এতদিন সেইস্থানেই ছিলেন। ইংরাজ পুলিস-কর্ম্মচারী কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিয়া আপন ঊর্দ্ধতন-কর্ম্মচারীকে সেই সংবাদ প্রদান করেন। এই সংবাদের উপর নির্ভর করিয়া ওয়ারেণ্ট সহ একজন ইংরাজ-কর্ম্মচারীকে সেইস্থানে পাঠান হয়, তিনি সেইস্থানে গমন পূর্বক উহাকে ধৃত করিয়া কলিকাতায় আনয়ন করেন। কলিকাতার সেসন-কোর্টে সেই মোকদ্দমার বিচার হয়। বিচারে ওয়ার্ণার অপরাধী সাব্যস্ত হয়, ও কঠিন পরিশ্রমের সহিত তাহার চারি বৎসরের মেয়াদ হয়। ওয়ার্ণার তদবধি হরিণ-বাড়ীর জেলেই আবদ্ধ থাকে।