ইংরেজ ডাকাত/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
কয়েদীদ্বয় কিরূপে এবং কোথায় ধৃত হইলেন, সেই বিষয় পূর্ব্বে বলা অপেক্ষা তাঁহারা কে, এবং কেনই বা তাঁহাদের জেল হইয়াছিল, তাহা বোধ হয়, পূর্ব্বে পাঠকগণের জানা আবশ্যক।
কলিকাতা লালদীঘির ধারে ‘ডেলহৌসি স্কোয়ার ঈষ্ট’ রাস্তায়, ‘সিঙ্গার কোম্পানির’ সেলাইয়ের কলের একটী দোকান আছে, ওয়ার্ণার এই দোকানের বড় সাহেব ছিলেন। তিনি অবিবাহিত—তাঁহার চরিত্র-দোষ যথেষ্ট ছিল। সন্ধ্যার সময় একবার কলিঙ্গা-বাজার স্ট্রীটে তাঁহাকে গমন করিতেই হইত, ও সেইস্থান হইতে তিনি কোনদিবস রাত্রি ১২টার পূর্ব্বে প্রত্যাগমন করিতেন না। শনিবার, রবিবার বাগানেই কাটিয়া যাইত।
একদিন সোমবার বেলা এগারটার সময়, ওয়ার্ণার সাহেব থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। থানার প্রায় সকলেই তাঁহাকে চিনিত। সেই সময় থানায় যে দেশীয় কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তিনি বিশেষ সম্মানের সহিত ওয়ার্ণারকে বসিতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই অসময়ে আপনি কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন?” উত্তরে ওয়ার্ণার কহিল, “আমার আফিসে ভয়ানক চুরি হইয়া গিয়াছে; সেই চুরির সংবাদ প্রদানের নিমিত্তই আমার এখানে আগমন। তোমার উর্দ্ধতন ইংরাজ-কর্ম্মচারী যদি উপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে তাঁহাকে সংবাদ প্রদান কর; তিনি আগমন করিলেই চুরির সমস্ত অবস্থা আমি তাহার নিকট বলিব।”
সাহেবের কথা শুনিয়া কর্ম্মচারী দ্রুতপদে গমন করিয়া আপনার উর্দ্ধতন ইংরাজ-কর্ম্মচারীকে সংবাদ প্রদান করিল। সংবাদ পাইবামাত্র ইংরাজ-কর্ম্মচারী উপর হইতে আফিসে আগমন করিলেন। ইনিও ওয়ার্ণারের পরিচিত। ওয়ার্ণারকে দেখিয়া কর্ম্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার আফিস হইতে কিরূপে চুরি হইয়া গিয়াছে?” উত্তরে ওয়ার্ণার কহিল,— “গত শনিবার আফিস বন্ধ করিয়া আমি বাসায় গমন করি। আফিসের জানালা দরজা প্রভৃতি সমস্তই আমার সম্মুখে বন্ধ করা হয়, এবং আমিই আফিসের চাবি লইয়া বাসায় গমন করি। সেইদিবস আমার টেবিলের দেরাজের ভিতর নগদ টাকা, নোট, এবং সোণা ও রূপার কতকগুলি গহনা ছিল; সর্ব্বসমেত উহার মূল্য ছয় সাত সহস্র মুদ্রার কম নহে। অদ্য সর্ব্বাগ্রে আমি আফিসে গমন করিয়া, সদর দরজা খুলিবার সময় দেখিতে পাই,—যে, ‘চব্স্’ তালা সদর দরজায় দেওয়া ছিল, তাহা খেলা। পরিশেষে অফিসের ভিতর গমন করিয়া দেখিতে পাই, আমার টেবিলের দেরাজও খোলা, এবং তাহার ভিতর যাহা কিছু ছিল, তাহার কিছুই নাই—সমস্তই চুরি হইয়া গিয়াছে।”
থানায় এই সংবাদ প্রদান করিলে, থানার কর্ম্মচারীগণ এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে গমন করিলেন। আমাদিগের নিকটও সংবাদ আসিল—আমরাও গমন করিলাম। সদর দরজার সেই ‘চব্স্’ তালা দেখিলাম, তাহা যেমন তেমনই আছে; টেবিলের দেরাজের তলারও কোন প্রকার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। আমরা যেরূপভাবে অনুসন্ধান আরম্ভ করি, প্রথমে এই অনুসন্ধানও সেইরূপ ভাবে আরম্ভ করিলাম। আফিসের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া এমন কোন চিহ্ন বা দ্রব্যাদি পাইলাম না, যাহাতে এই চুরি বাহিরের কোন লোক দ্বারা হইয়াছে, এরূপ সন্দেহ হইতে পারে। সদর দরজায় যে চব্স্ তালা বন্ধ ছিল, তাহা দেখিয়াও কোনরূপে অনুমান করিতে পারিলাম না যে, কোন প্রকার অস্ত্র প্রয়োগে অথবা অপর কোন চাবির দ্বারা এই তালা খোলা হইয়াছে। আমাদিগের বিশ্বাস ছিল, চব্স্ তালা অপর চাবির দ্বার খোলা যায় না। এই নিমিত্ত ওয়ার্ণার সাহেবের অগোচরে সেই তালাটী আমরা টি, টম্সন্ কোম্পানির বাড়ীতে পরীক্ষার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম। তাঁহারা সেই তালা খুলিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষাপূর্ব্বক কহিলেন, সেই তালার চাবি দ্বারাই সেই তালা খোলা হইয়াছে, অপর কোন চাবি ব্যবহৃত হয় নাই। টি, টম্সন্ কোম্পানির নিকট হইতে এই অবস্থা জানিতে পারিয়া, আমাদিগের আরও একটু অনুসন্ধানের প্রয়োজন হইল। সেই তালার যদি দুইটী চাবি থাকে, তাহা হইলে অপর চাবিটী কোথায়? ওয়ার্ণারকে জিজ্ঞাসা করায়, সে সন্দেহও মিটিয়া গেল। তিনি কহিলেন, সেই তালার চাবি দুইটী আছে, একটী সর্ব্বদা ব্যবহৃত হয়, অপরটী যে স্থানে তিনি থাকেন, সেইস্থানে একটী বাক্সের ভিতর আছে। এই কথা শুনিয়া ওয়ার্ণারের বাসায় গমন করিলাম। তিনি একটা বাক্সের ভিতর হইতে সেই চাবিটী বাহির করিয়া আমাদিগকে দেখাইলেন। বহুদিবস ব্যবহৃত না হওয়ায়, উহার অঙ্গ ময়লায় পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। দেখিবামাত্রই বোধ হইল, এই চাবির দ্বারা এই তালা খোলা হয় নাই। এই সকল অবস্থা দেখিয়া মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। রাত্রিকালে সেই ঘাটিতে যে পাহারাওয়ালাদ্বয়ের পাহারা পড়ে, তাহাদিগের উভয়কেই গোপনে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করায়, তাহাদিগের মধ্যস্থিত একজনের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, রবিবার রাত্রি চারিটার সময় সে সদর দরজার সেই তালা দেখিয়াছে, তখন উহা খোলা ছিল না। সে আরও কহিল, সেই সময় যে জমাদারের ‘রাউণ্ড’ ছিল, সেও সেই তালা তাহার সম্মুখে টানিয়া দেখিয়াছে, তখন সেই তালা খোলা ছিল না, বন্ধ ছিল। পাহারাওয়ালার কথা শুনিয়া রবিবারে যে জমাদার সেই তালা টানিয়া দেখিয়াছিল, তাহাকে তখন ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম। দেখিলাম, সেও সেই পাহারওয়ালার কথার পোষকতা করিল।