ইংরেজ ডাকাত/প্রথম পরিচ্ছেদ
ইংরেজ ডাকাত।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
প্রত্যুষে ছয়টার সময় শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলাম। এ শয্যা আমার বাড়ীর শয্যা নহে, থানার শয্যা। কতকগুলি কার্য্যের ঝঞ্ঝাটে রাত্রিতে বাড়ী না গিয়া থানাতেই শুইয়াছিলাম। শয্যা হইতে উঠিয়াই দেখিলাম, নিকটেই “ষ্টেটস্ম্যান্” কাগজখানি রহিয়াছে। পিয়ন যে কথন্ কাগজখানি রাখিয়া গিয়াছে, তাহা জানিতে পারি নাই। বিছানার উপর বসিয়াই কাগজখানি খুলিলাম। দেখিলাম, উহাতে একটী সংবাদ বাহির হইয়াছে; তাহার মর্ম্ম এইরূপ, “গত রাত্রিতে হরিণ-বাড়ীর জেল ভাঙ্গিয়া সেই প্রসিদ্ধ ডাকাইত ‘হিলি’, ‘ওয়ার্ণারের সহিত পলায়ন করিয়াছে। যদি তাহারা শীঘ্র ধৃত না হয়, তাহা হইলে কত লোকের যে সর্ব্বনাশ সাধিত হইবে, তাহার আর স্থিরতা নাই। পুলিসের কর্ত্তব্য,—যাহাতে উহারা শীঘ্র ধৃত হয়, তাহার বিশেষরূপে চেষ্টা করা।”
ভাবিলাম,—“এরূপ অবস্থায় আর বসিয়া কাগজ পড়া উচিত নহে; প্রাতঃকৃত্যাদি, যত শীঘ্র হয়, সমাপন করিয়া। লওয়াই কর্তব্য। বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এখনই এখানে উক্ত বিষয়ের সংবাদ আসিবে।” এই ভাবিয়া যত শীঘ্র পারি, প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করিয়া যেমন আমার গৃহে প্রবেশ করিতেছি, অমনই দেখিলাম, একজন প্রহরী একখানি পত্রহস্তে দৌড়িয়া আসিতেছে। পত্রখানি পড়িলাম,—লালবাজার পুলিস হইতে আমাদিগের বড় সাহেব এই পত্রখানি লিখিয়াছেন। উহাতে লেখা আছে,—“এই পত্র পাঠমাত্র, ডিটেক্টিভের কর্ম্মচারী মাত্রই আমার নিকট আগমন করিবেন; যেন কিছুমাত্র বিলম্ব না হয়।”
কাহার সাধ্য, এই পত্র পাঠ করিয়া গমনে বিলম্ব করে? সেই সময়ে কোন কর্ম্মচারী গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত, কেহ বা নিদ্রিত নহেন, অথচ শয়ন করিয়া আছেন, কেহ বা উঠিয়াছেন মাত্র। কেহ বা স্নান করিতেছেন, কেহ বা স্নান করিয়া বসিয়াছেন; কেহ বা স্নান করিবার অভিলাষে তৈলমর্দন করিতেছেন। কেহ সেই সময়েই বাহির হইতে আগমন করিয়াছেন; কেহ বা বাহিরে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতেছেন। এইরূপ সময়ে বড় সাহেবের আদেশ-লিপি আসিয়া উপস্থিত হইল। যিনি নিদ্রিত ছিলেন, তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল; যিনি শুইয়াছিলেন, তিনি উঠিলেন। যিনি স্নান করিতেছিলেন, তাঁহার সে দিবস পূরা স্নান হইল না; যিনি তৈলমর্দ্দন করিতেছিলেন, তাহার তৈল মুছিতে হইল। এইরূপ যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, তিনি সেই অবস্থাতেই আপন আপন পরিধেয় প্রভৃতি লইয়া বহির্গত হইলেন। আমরা সকলে একত্র হইয়া পুলিস আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। গমনকালে মনে করিলাম,—‘আমরা যত লোক গমন করিতেছি এত লোকের আবশ্যক কি? দশ কুড়িজন হইলেই যথেষ্ট।’ কিন্তু পুলিসে গিয়া কি দেখিলাম? যাহা আমরা একবারও মনে ভাবি নাই, তাহাই দেখিলাম। দেখিলাম, ইংরাজপুলিস-কর্ম্মচারী যত আছেন, সকলেই সেইস্থানে উপস্থিত; দেখিলাম, আদেশ-প্রার্থী হইয়া সকলেই সেই প্রাঙ্গনে দণ্ডায়মান। পুলিসের পোষাক কাহারও পরিধানে নাই, সকলেই আপন আপন ইচ্ছানুযায়ী পরিচ্ছদে শোভিত হইয়াছেন। ইহাদের সংখ্যা প্রায় এক শত হইবেক। আমরাও সেই প্রাঙ্গনের একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হইলাম। সেই সময় আমাদের বড় সাহেব তাঁহার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া, আমাদিগের নিকট আসিলেন। তাঁহার হস্তে একখানি কাগজ ও একটী পেন্সিল। সেইস্থানে যতগুলি কর্ম্মচারী ছিলেন, তিনি সকলের নাম লিখিয়া লইয়া, জেলের পলাতক কয়েদীদ্বয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত প্রত্যেককেই এক একদিকে যাইতে আদেশ প্রদান করিলেন। যিনি যেমন আদেশ পাইতে লাগিলেন, তিনি তখনই আদেশ-অনুযায়ী স্থানাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। কাহারও উপর আদেশ হইল, হাবড়া হইতে গাড়িতে উঠিয়া বর্দ্ধমান গিয়া থাকিবেন, এবং সেইস্থানে যত গাড়ি থামিবে, প্রত্যেক গাড়িতেই উহাদিগের অনুসন্ধান করিবেন। কেহ বর্দ্ধমানে নামিয়া পদব্রজে হাবড়া পর্যন্ত আগমন করিবেন; কেহ হাবড়া হইতে পদব্রজে বর্দ্ধমান গমন করিবেন। কেহ ইষ্টারণ বেঙ্গল রেলওয়ে গমন করিয়া নৈহাটী ষ্টেশনে থাকিবেন, কেহ নৈহাটী হইতে হাঁটিয়া আসিবেন, কেহ নৈহাটীতে হাঁটিয়া গমন করিবেন। কেহ দমদমা, কেহ বারাকপুর, কেহ বারাসত-অভিমুখে গমন করিবেন। কেহ ডায়মণ্ডহারবার গমন করিয়া জাহাজ সকল দেখিবেন, কেহ সেইস্থান হইতে স্থলপথে কলিকাতায় আসিবেন, কেহ বা কলিকাতা হইতে স্থলপথে সেইস্থানে যাইবেন। কেহ নৌকা, কেহ ‘ষ্টীমলঞ্চ’ লইয়া ভাগীরথী বাহিয়া উত্তরে, কেহ বা দক্ষিণে গমন করিবেন। কেহ বা কিনারায় কিনারায় গমন, কেহ বা প্রত্যাগমন করিবেন। কেহ বা কলিকাতার ষ্টীমার সকল, কেহ বা পান্সি সকল দেখিবেন; কেহ বা উলুবেড়িয়ায়, কেহ গেঁয়োখালিতে অবস্থান করিবেন। কেহ বা হাবড়ার গৃহে গৃহে, কেহ বা কলিকাতার বাড়ীতে বাড়ীতে অনুসন্ধান। করিবেন; আর কেহ কেহ বা কলিকাতার চতুঃপার্শ্বের প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে খুঁজিবেন। এই আদেশ পাইয়া সকলেই চলিয়া গেলেন। কে বল বাকি থাকিলাম ‘আমি’। আমার উপর কোন আদেশ হইল না দেখিয়া ভাবিলাম,—‘হয় ত অন্য কোন কর্ম্ম আছে, এই নিমিত্ত আমিই অবশিষ্ট থাকিলাম—আমাকে বোধ হয়, এই অনুসন্ধানে গমন করিতে হইবে না।’ ক্ষণকালের জন্য আমি এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় সাহেব আমাকে কহিলেন,—“আমিও এই অনুসন্ধানে বহির্গত হইতেছি। যদি তুমি ইচ্ছা কর, তাহা হইলে আমার সহিত যাইতে পার, কিম্বা যদি তুমি একাকী তোমার ইচ্ছানুযায়ী অন্য কোন স্থানে গমন করিতে ইচ্ছা কর, সেখানেও যাইতে পার। স্থূল কথা, পলাতকদিগের সন্ধান করা চাই।” এই কথা শুনিয়া আমি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম,—“কয়েদীদ্বয় যে স্থান হইতে, এবং যে প্রকারে পলায়ন করিয়াছে, সেইস্থান আপনি দেখিয়াছেন কি?” উত্তরে সাহেব কহিলেন,—“না, কিন্তু আমি এখনই সেইস্থানে গমন করিতেছি।” সাহেবের এই কথা শুনিয়া, আমিও তাঁহার সহিত গমন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম; তিনিও সম্মত হইলেন।