ইংরেজ ডাকাত/দশম পরিচ্ছেদ
দশম পরিচ্ছেদ।
যখন আমরা সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করি, সেই সময় রাজারামপুর-নিবাসী বাবু হরনাথ মিত্রের সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইল। আমরা কে, কোথা হইতে আসিতেছি, এবং কি নিমিত্তই বা আগমন করিয়াছি, এই সমস্ত বিষয় তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে আমিও তাঁহাকে সংক্ষেপে সমস্ত কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, “আমি, বোধ হয়, আপনাদিগকে কিছু সাহায্য করিতে পারিব। আপনারা আমাদিগের বাড়ীতে আসুন, সেইস্থানেই সমস্ত কথা শুনিতে পাইবেন।” হরবাবুর কথা শুনিয়া আমাদের মনে অনেক ভরসা হইল। তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাঁহাদের গ্রামাভিমুখে চলিলাম। যখন তাঁহাদের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি নয়টা।
সাহেবদ্বয় আসিয়াছেন—বিলাত হইতে; থাকেন—কলিকাতায়। এদেশে ব্রাহ্মণ-শূদ্রের ভিতর যে কিরূপ সম্বন্ধ, তাহা তাঁহারা অবগত নহেন। আমি ব্রাহ্মণ, আর হরনাথ বাবু শূদ্র; সুতরাং হরনাথ বাবুর বাড়ীর সমস্ত লোকেরা আমাকে যেরূপ মান্য করিলেন, যেরূপে আমার সেবা করিলেন, তাহা দেখিয়া সাহেবদ্বয় অবাক্ হইলেন, এবং কহিলেন,— “তোমাদের দেশের লোেক তোমাদিগকে (অর্থাৎ ব্রাহ্মণদিগকে) যে, এরূপভাবে দেখিয়া থাকেন, তাহা আমরা কখন স্বপ্নেও ভাবি না। আমাদিগের প্রধান পাদবি ও কোন খৃষ্টানের নিকট বোধ হয়, এরূপ সম্মান প্রাপ্ত হয়েন না।”
আমি বিশেষরূপ যত্ন প্রাপ্ত হইলাম বলিয়াই যে হরনাথ বাবু সাহেবদ্বয়ের অযত্ন করিলেন, তাহা নহে। তিনি তাঁহার বাহিরের ঘর সাহেবদিগের জন্য ছাড়িয়া দিলেন, এবং সমস্তদিবস উহাদিগের আহার হয় নাই শুনিয়া, প্রথমেই দুগ্ধ ও কদলী আনাইলেন। সাহেবদ্বয় ইচ্ছামত দুধ ও কলা খাইয়া কতক সুস্থ হইলেন; আমিও উদয় পুরিয়া জলযোগ করিলাম।
আমরা সকলে সুস্থ হইয়া উপবেশন করিলে পর, হরনাথ বাবু কহিলেন, “গত কল্য (অর্থাৎ ৭ই মার্চ) সন্ধ্যার সময় আমরা দামোদর-তীরে সান্ধ্য-সমীরণ সেবন করিতেছিলাম। সেই সময় দেখিতে পাইলাম, শ্রীকৃষ্ণপুরের নিকট দামোদরতীরে বালুকার উপর দুইজন ইংরাজ বসিয়া রহিয়াছেন। যে স্থানে ইংরাজের কখনও পদার্পণ হয় না, সেইস্থানে দুই দুইজন ইংরাজকে দেখিয়া আমাদের অতিশয় কৌতুহল উপস্থিত হইল। এক পা দুই পা করিয়া, আমরা ক্রমে সাহেবদিগের নিকট গমন করিলাম। তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, উঁহারা সরকারী কর্ম্মচারী। দামোদর নদীর কোন্ কোন্স্থানে বাঁধ বাঁধিবার প্রয়োজন, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত তাঁহারা এ প্রদেশে আগমন করিয়াছেন, এবং থাকিবার উপযুক্তরূপ স্থান প্রাপ্ত না হওয়ায়, সেইস্থানেই অবস্থিতি করিতেছেন। আসিবার সময় আপনারা বোধ হয়, দেখিয়া থাকিবেন, দামোদর নদীর ধারে ধারে বাঁধ বাঁধা আছে। সরকার বাহাদুর কর্ত্তৃক উক্ত বাঁধ বাঁধা হইয়াছে, এবং বৎসর বৎসর উহা মেরামতও করিয়া থাকেন। এই বাঁধের দ্বারা আমাদিগের কি উপকার হইয়াছে, তাহা আমরাই জানি। উক্ত বাঁধের নিমিত্ত তাঁহারা এ প্রদেশে আগমন করিয়াছেন, সাহেবদিগের মুখে এই কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে তাঁহাদিগের প্রতি অতিশয় দয়ার উদ্রেক হইল। আমরা। তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া আমাদিগের এই বাড়ীতে আনয়ন করিলাম, এবং আমাদিগের বাঙ্গালীর যে খাদ্য (লুচি, তরকারি প্রভৃতি) তাহাদিগকে খাইতে দিলাম। আহারাদি করিয়া সমস্ত রাত্রিই তাহারা আমাদিগের বাড়ীতে শুইয়াছিলেন।
“উক্ত সাহেবদ্বয়ের মধ্যে একজনকে অতিশয় বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ লোক বলিয়া, আমাদিগের বোধ হয়। কথার প্রসঙ্গে যখন যে কথা উপস্থিত হয়, তাহাতেই বুঝিতে পারি যে, উঁহার সর্ব্বদিকে বিশেষ দৃষ্টি আছে। সাহিত্যের কথা পাড়িয়া বুঝিলাম, তিনি একজন সাহিত্য-সেবী। সমর-সংক্রান্ত কথায় জানিতে পারিলাম, তিনি একজন সৈনিকপুরুষ; নিজে অনেক রণক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিয়া অনেক যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। বিজ্ঞানে উহার বেশ দখল আছে, রাজনৈতিক সমস্ত কার্য্যই উনি বিশেষরূপে বুঝিতে পারেন। ডাক্তারি বিদ্যাতেও কতক পারমাণে অভিজ্ঞ। এক কথায় সর্ব্বগুণে বিভূষিত এরূপ একটী লোক পাওয়া নিতান্ত সহজ নহে। তাঁহাদিগের সহিত একত্র উপবেশন করিয়া নানাকথা-প্রসঙ্গে প্রায় রাত্রি দুইটা পর্য্যন্ত আমরা বসিয়াছিলাম। অদ্য প্রাতঃকালে পাঁচটার সময় তাঁহারা এইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক, দামোদরের ধারে ধারে বাঁধ সকল দেখিতে দেখিতে চণ্ডীপুর-অভিমুখে গমন করিয়াছেন।”
আমার সাহেবদ্বয় তাঁহাদিগের জুতা ও কোট খুলিয়া সেই গৃহের বিছানার উপর শয়নপূর্ব্বক হরনাথ বাবুর কথাগুলি শুনিতেছিলেন। যখন তাহার কথা শেষ হইল, অমনিই হাবিৎ সাহেব উঠিয়া তাঁহার কোট পরিলেন, এবং জুতা পায়ে দিয়াই কহিলেন, “চল, চণ্ডীপুরে গমন করি—আর বিলম্ব করা উচিত নহে।”
হাবিতের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “সাহেব! এই রাত্রি দশটার সময় অজানিত পথে এরূপভাবে তুমি যাইতে চাহ, অক্লেশেই যাইতে পার; আমি কিন্তু এভাবে যাইব না। আমি প্রথমে যাওয়ার বন্দোবস্ত করিব, তারপর যদি যাওয়া বিবেচনা-সিদ্ধ হয়,যাইব। নতুবা এই রাত্রি এইস্থানে অতিবাহিত করিয়া পরদিবস প্রাতঃকালে উহাদিগের অনুসন্ধানে বহির্গত হইব।” এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে উঠিয়া অন্য গৃহে গমন করিলাম; ভাবিলাম,—“দেখি, উহারা কি করে?”
রাজারামপুর বর্ধমান-জেলার অন্তর্গত জামালপুর থানার অধীন। জামালপুর এইস্থান হইতে অধিক দূর নহে, দামোদর নদীর অপর পারে। আমি রাজারামপুরের একজন চৌকীদারকে ডাকাইয়া তাহার হস্তে একখানি পত্র দিয়া কহিয়া দিলাম, “যত শীঘ্র পার, এই পত্রখানি জামালপুর থানায় লইয়া যাও। সেইস্থান হইতে যদি কেহ আগমন করেন, তাঁহাদিগকে সঙ্গে করিয়া এইস্থানে আনয়ন করিবে।” চৌকীদারকে আমি যে পত্র প্রদান করিলাম, তাহার মর্ম্ম এই—
“জামালপুর থানার ইন্চার্য্য অফিসার মহাশয়! আমরা কলিকাতা পুলিসের কর্ম্মচারী, বিশেষ প্রয়োজনীয় সরকারী কার্য্যের অনুরোধে এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। কিন্তু এখন দেখিতেছি, আপনাদিগের সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন হইতেছে; কারণ, এ প্রদেশের রাস্তা, ঘাট এবং গ্রামাদি আমরা অবগত নহি। এই নিমিত্ত আপনাকে লেখা যাইতেছে যে, আপনি পত্র পাঠমাত্র যে পুরাতন কর্ম্মচারী, এই প্রদেশের সমস্ত উত্তমরূপে অবগত আছেন, তাঁহাকে আমাদিগের সাহায্যের নিমিত্ত পাঠাইয়া দিবেন। সবিশেষ প্রয়োজনীয় সরকারী কার্য্য—কোনরূপে বিলম্ব না হয় জানিবেন। ইতি ৮ই মার্চ, ১৮৮৯।”
চৌকীদার আমার পত্র লইয়া প্রস্থান করিলে, হাবিৎ সাহেব আমার নিকট আসিলেন, এবং কহিলেন, “তুমি এখন কি করিতে চাও? তোমার কি ইচ্ছা যে, এই স্থানে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়াই রাত্রি অতিবাহিত করিবে?” উত্তরে আমি কহিলাম, “সাহেব! আমি যাহা করিতে চাই, তাহা পরে দেখিবে। তোমরা যাহা করিতে চাহ, তাহা করিতে পার। আমি তোমাদিগের সহিত এইরূপ কলহ করিতে করিতে গমনের প্রার্থনা করি না। আমি এ প্রদেশ একে চিনি না, তাহাতে রাত্রিকাল, কোথায় যাইতে কোথা যাইব, তাহা ঠিক করিতে পারিতেছি না। আমি সেইজন্য নিকটবর্ত্তী থানায় পত্র লিখিয়াছি। সেইস্থান হইতে কোন লোক আসিলে, তাহাকে সঙ্গে লইয়া আমি বহির্গত হইব। ইহাতে তোমাদের ইচ্ছা হয়, আমার অপেক্ষায় থাকিতে পার; ইচ্ছা না হয়, গমন করিতে পার। আমার কোনও আপত্তি নাই।” এই বলিয়া আমি চুপ করিলাম। বুঝিলাম, আমার কথা সাহেবদিগের ভাল লাগিল না। হাবিৎ সাহেব। নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার সঙ্গীকে কহিলেন, “আমি জানি বাঙ্গালী নিতান্ত অকর্ম্মণ্য জাতি। এই বহুমূল্য সময় নষ্ট করিতে ইহার যেমন মজবুত, তেমন আর কেহই নহে। সাহসেও পৃথিবীর মধ্যে ইহারা অদ্বিতীয়! ঐ বাবু যে সকল কথা বলিয়া আমাদিগকে বুঝাইবার চেষ্টা করিল, আমার বোধ হয়, উহার একটা কথাও প্রকৃত নহে। স্থূল কথা—ও নিতান্ত ভীত হইয়াছে; রাত্রিকালে গৃহের বাহির হইতে উহার সাহস হইতেছে না। আর ও যদি নিতান্তই এখন আমাদিগের সঙ্গে গমন না করে, তাহা হইলেই বা আমরা কি করিব? কোথায় বা আমরা গমন করিব, এবং কাহাকেই বা আমরা জিজ্ঞাসা করিব? এরূপ অবস্থায় দায়ে পড়িয়া এখন উহার মতেই মত দিতে হইবে। যাহা হউক, কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া আমি ইহার প্রতিশোধ লইতে সবিশেষরূপে চেষ্টা করিব।” এই বলিয়া সাহেবদ্বয় পুনরায় শয়ন করিলেন। *
*মাঘ মাসের সংখ্যা,
“ইংরেজ ডাকাত।”
(শেষ অংশ)
(হিলি ও ওয়ার্ণার নামক দুইজন দস্যুর অদ্ভুত বৃত্তান্ত)
যন্ত্রস্থ।