ইংরেজ ডাকাত/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
৮ই মার্চ্চ তারিখের সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার সময় জামালপুর অতিক্রম করিয়া ছয়টার সময় কাল্না গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। জানিতে পারিলাম যে, এইস্থানে পলায়িত সাহেবদ্বয় ৬ই মার্চ্চ সন্ধ্যার পর আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং সমস্ত রাত্রি সিউচরণ বাগ্দীর গরুর গাড়ির ভিতর শয়ন করিয়াই রাত্রি যাপন করে। ৭ই মার্চ্চ প্রাতঃকালে এইস্থানে উহাদিগকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক সিউচরণ আপন গ্রামে প্রত্যাগমন করে। মেমারি হইতে এই স্থান বাইশ চব্বিশ মাইলের কম নহে। সেইস্থানে অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইলাম যে, পলায়িত ইংরাজদ্বয় সেইস্থানে অবস্থিতি করিবার উপযুক্ত স্থান প্রাপ্ত না হইয়া, সবিশেষরূপে বিপদ্গ্রস্থ হইয়াছিল। একে থাকিবার স্থান পাইল না, তাহার উপর জেল হইতে পলায়ন করিবার পর, আর উপযুক্তরূপ আহার পায় নাই। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া আশ্রয় অনুসন্ধান করিতে লাগিল। কিন্তু সেইস্থানের কোন ব্যক্তিই তাহাদিগের কষ্টের দিকে লক্ষ্যও করিল না। আহারের সংস্থান করিয়া দেওয়া ত পরের কথা, থাকিবার নিমিত্তও কেহ স্থান প্রদান করিল না। কিন্তু জানি না, উহাদিগের কষ্ট দেখিয়া পরিশেষে জনৈক রজকের অন্তঃকরণে কেন দয়ার উদয় হইল? সে আপনার গৃহ হইতে কিছু অন্নব্যঞ্জন আনিয়া উহাদিগকে প্রদান করিল। ক্ষুধার্ত সাহেবদ্বয় সেই অন্নব্যঞ্জন আহার করিয়া আপন আপন জঠরানল নির্ব্বাপিত পূর্ব্বক পুনঃ পুনঃ সেই রজককে ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিল। নিতান্ত দয়া-পরবশ হইয়া এই রজক সাহেবদ্বয়কে আহারের সংস্থান করিয়া দিল সত্য কিন্তু থাকিবার কোন বন্দোবস্তই করিল না। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া নিকটবর্ত্তী একটী পুষ্করিণীর ধারে ধরাশয্যায় শয়ন করিয়া, উহাদিগকে ৭ই মার্চ্চ তারিখের সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিতে হইল। উহারা যখন দেখিল, সুর্য্যদেব অস্তাচলাবলম্বী হইতেছেন, তখন সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিকটবর্ত্তী দামোদর নদীর অভিমুখে গমন করিল।
এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিয়া, আমরাও সেই দামোদর-তীরে গমন করিয়া তাহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু প্রথমে কোনই সংবাদ পাওয়া গেল না। সেই সময় একজন লোক দামোদর পার হইতেছিল; তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল যে, দুইজন সাহেবকে ৭ই সন্ধ্যার পর নদীর অপর পার্শ্বে বালির উপর বসিয়া থাকিতে সে দেখিয়াছে।
বর্দ্ধমান জেলার মধ্যে দামোদর একটী প্রসিদ্ধ নদ; কিন্তু উহার জল সকল সময় সমান থাকে না। আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় ঐ নদীতে জল অধিক ছিল না। কোনস্থানে হাঁটু-জল, কোনস্থানে তাহারও কম; কোনস্থানে কোমর-জল, কোনস্থানে বা এক বুক। সকলকেই হাঁটিয়া নদী পার হইতে হয়; সেইস্থানে নৌকা নাই, বা অন্য কোনরূপে পার হইবার উপায়ও নাই। এই নদী হাঁটিয়া পার হইতে হইবে দেখিয়া, আমার সঙ্গী সাহেবদিগের বিশেষ ভাবনা হইল। আমার সম্বলের মধ্যে ছিল—পরিধানে এক খানি ধুতি, গায়ে একটী পিরাণ, একখানি চাদর এবং পায়ে একজোড়া জুতা। আমি জুতা খুলিলাম, পিরাণ খুলিলাম, চাদর পরিধান করিলাম; এবং কাপড় প্রভৃতি হস্তে লইয়া, অক্লেশে নদী পার হইলাম। অপর পারে গমন করিয়া কাপড়, জুতা প্রভৃতি পরিলাম। একটু অসুবিধার ভিতর হইল—কেবল ভিজা চাদর।
সাহেবদিগের দুঃখের কথা আর কি বলিব? তাঁহারা প্রথমে নৌকার চেষ্টা করিলেন—পাইলেন না। পরে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অনন্যোপায় হইয়া আপন আপন বুট-মোজ পা হইতে খসাইলেন, কামিজ কোট খুলিলেন। পরিশেষে অবশিষ্ট পেণ্টুলান খুলিয়া দিগম্বর-মূর্ত্তি ধারণপূর্ব্বক জলে পড়িলেন। অনেকদূর হাঁটু ও তাহার কম জল ভাঙ্গিয়া যাইতে হইল। সাহেবদিগের অবস্থা দেখিয়া ঘাটে লোক জমিয়া গেল। পুরুষগণ হাসিতে লাগিল; স্ত্রীলোকগণ মুখে কাপড় দিয়া গালি দিতে দিতে পলাইল। সাহেবদিগের পরিধেয় সকল পূর্ব্বতীরে বালুকার উপরই পড়িয়া রহিল, আমি দেখিয়াও দেখিলাম না। সাহেবগণ নদী পার হইয়া অপর পারে গমন করিয়া, পোষাক পরিধান করিতে গিয়া দেখেন, উহা অন্য পারে পড়িয়া রহিয়াছে—কেহ তাঁহাদিগের কাপড় প্রভৃতি আনয়ন করে নাই। এই অবস্থায় ইংরাজের মেজাজ চটিয়া গেল। হাবিৎ সাহেব আমাকে কহিলেন, “কেহই আমাদিগের কাপড় আনে নাই—আমরা কি পরিব?” হাবিতের কথা শুনিয়া আমি একটু হাসিলাম; হাসিয়া কহিলাম,— “সাহেব! এ কি তোমার কলিকাতা যে, তোমার চাকর তোমার কাপড় লইয়া সঙ্গে সঙ্গে আসিবে? এখন পুনরায় নদী পার হও, ও কাপড় প্রভৃতি লইয়া আইস।”
আমার কথা শুনিয়া হাবিৎ অসন্তুষ্ট হইলেন; কিন্তু ডলসুরি সাহেব বিশেষ নম্র ও লজ্জিতভাবে আমাকে কহিলেন, “বাবু! কোন প্রকারে আমাদিগের কাপড়গুলি এইস্থানে আনাইয়া দেও।” ডালসুরির কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “আচ্ছা, তোমরা এইস্থানে দাঁড়াইয়া থাক; আমি তোমাদিগের কাপড় আনাইয়া দিতেছি।” এই বলিয়া সেইস্থানে যে সকল লোক দাঁড়াইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে একটী দরিদ্র লোককে চারি আনা প্রদান করিলাম। সে নদী-পারে গমন করিয়া সাহেবদিগের পেন্টুলান, জুতা প্রভৃতি আনিয়া দিলে, উঁহারা আপন আপন লজ্জা নিবারণ করিলেন।
যে সময় সাহেবগণ সেই স্থানে উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়াইয়াছিলেন, সেই সময় সেই স্থানের অনেক লোক তাহাদিগকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। দুইজন সাহেবকে তাহারা গত কল্য সন্ধ্যার সময় এইস্থান দিয়া গমন করিতে দেখিয়াছে, কি না; এই কথা আমি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায় সকলেই কহিল, তাহারা কোন সাহেবকে গত কল্য এইস্থানে দেখে নাই। কিন্তু একজন লোক কহিল, “দুইজন নূতন লোক শ্রীকৃষ্ণপুরের একজন গোয়ালার বাড়ীতে রহিয়াছে।” এই কথা শুনিয়া হাবিৎ সাহেব সেই অবস্থাতেই সেইস্থানে গমন করিতে উদ্যত! সাহেবের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, সাহেব! ওরূপ কার্য্য করিও না। আমি উহার বন্দোবস্ত করিতেছি।” এই বলিয়া আমি সেই লোকটীকে সেই গোয়ালার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম। তাহাকে কহিলাম, “তুমি গিয়া সেই লোক দুইটীকে দেখিয়া আইস—তাহার সাহেব কি না?” আমার কথা শুনিয়া সে দেখিতে গমন করিল। কিন্তু তাহার আসিতে বিলম্ব হওয়ায়, হাবিৎ আমাকে কহিলেন, “বাবু! তুমি সব নষ্ট করিলে! আমি গমন করিতে চাহিলাম, তুমি আমাকে গমন করিতে দিলে না; এখন নিশ্চয়ই তাহারা আমাদের কথা জানিতে পারিয়া পলায়ন করিয়াছে।” সাহেবের কথা শুনিয়া আমার রাগ হইল। কিন্তু মনের রাগ মনে রাখিয়া কহিলাম, “চল সাহেব, আমার সঙ্গে, আমি তোমাকে সেই স্থানে লইয়া যাইতেছি।” এই বলিয়া সেইস্থানে লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া সেই গোয়ালার বাড়ীতে গমন করিলাম। দেখিলাম, সেইস্থানে দুইজন অতিথি রন্ধন করিতেছে। তাহাদিগকে দেখিয়া সাহেবকে কহিলাম, “হাবিৎ! এখনও উহারা তোমার আসিবার সংবাদ, পায় নাই বা পলায় নাই; তুমি অনায়াসে উহাদিগকে এখনই গ্রেপ্তার করিতে পার।” সাহেব আমার কথা শুনিয়া দ্রুতপদে তাহাদিগের নিকট গমন করিল। দেখিল, দুইজন পশ্চিম দেশীয় সন্ন্যাসী, সেই গোয়ালার গোয়ালঘরে বসিয়া রন্ধন করিতেছে। এই অবস্থা দেখিয়া সাহেবদ্বয় বিশেষ লজ্জিত হইলেন, ও উহাদিগকে গালি দিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।