ইতিহাস/শিবাজী ও মারাঠা জাতি
শিবাজী ও মারাঠা জাতি
ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা বিদ্যালয়ে পড়িয়া থাকি তাহা রাজাদের জীবনবৃত্তান্ত, দেশের ইতিবৃত্ত নহে।
দেশের লোকের সমগ্র চিত্তে যখন কোনো-একটি অভিপ্রায় জাগিয়া উঠে এবং সর্বসাধারণে সচেষ্ট হইয়া সেই অভিপ্রায়কে সার্থক করিতে চায় ও সেই অভিপ্রায়কে প্রতিকূল আঘাত হইতে বাঁচাইবার জন্য বুহ্যবদ্ধ হইয়া উঠে, তখনই সে দেশ যথার্থভাবে ইতিহাসের ক্ষেত্রে আসিয়া দাঁড়ায়।
এইরূপ কোনো-একটি এক-অভিপ্রায়কে লইয়া ভারতবর্ষের কোনোএকটি প্রদেশ আপনাকে একচিত্ত বলিয়া উপলব্ধি করিয়াছে, এরূপ অবস্থা ভারতবর্ষের ভাগ্যে অধিক ঘটে নাই।
কোনো দেশের লোক যখন এইরূপে ঐক্য উপলব্ধি করে তখন তাহারা স্বভাবতই সেই উপলব্ধিকে ইতিহাসে প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারে না। যে-সকল ঘটনা বিচ্ছিন্ন, যাহা আকস্মিক, দেশের লোকের চিত্তে যাহার কোনো অখণ্ড তাৎপর্য নাই, দেশের লোক তাহাকে সহজেই ইতিহাসরূপে গাঁথিয়া রাখে না, কারণ গাঁথিয়া রাখার কোননা-একটি সূত্র তাহারা নিজেদের মনের মধ্যে পায় না।
এইজন্য আধুনিক ভারতের রাজকীয় বৃত্তান্ত অধিকাংশই বিদেশীর লেখা। দেশের সাধারণ লোকে এইসকল বৃত্তান্ত স্মরণীয় করিয়া রাখিবার জন্য কোনো উৎসাহ বোধ করে নাই।
সমগ্র দেশের কোনো বিশেষ কালের ইতিহাসকে রক্ষা করিবার স্বতঃপ্রবৃত্ত চেষ্টা দেশের লোকের দ্বারা যদি ভারতবর্ষের কোথাও ঘটিয়া থাকে, সে মহারাষ্ট্র দেশে। মহারাষ্ট্রের ‘বখর’গুলি তাহার নিদর্শন।
যে সময় লইয়া এই-সকল জাতীয় ইতিবৃত্ত রচিত হইতেছিল সেই সময়ে দেশের লোকে যে আপনাদের একটি অঙ্গবদ্ধ স্পষ্টসত্তা অনুভব করিয়াছিল, তাহা এই ইতিহাস লিখিবার প্রবৃত্তির দ্বারাই নিশ্চিত সপ্রমাণ হইতেছে।
রাজপুতনাতেও ইতিহাসের টুকরা পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা এক-একটি দলের, এক-একটি খণ্ড রাজ্যের ইতিহাস; সমস্ত রাজপুত জাতির ইতিহাস নহে। কিন্তু মারাঠাদের সম্মিলিত পরিচয় আছে; তাহা কেবল একএকটি পোত্রবিশেষের গৌরবকীর্তন নহে।
শিখগুরুদের ইতিহাসের মধ্যে শিখদের জাতীয় ইতিহাস রচিত হইয়াছে, কিন্তু মারাঠার ইতিহাসের মতো এমন ব্যাপক এবং সাঙ্গোপাঙ্গ হইয়া উঠে নাই। শিখের ইতিহাসে বীরত্বের ও মহত্ত্বের অনেক পরিচয় আছে, কিন্তু তাহাতে সুপরিণত রাষ্ট্রগঠনের ইতিবৃত্ত পাওয়া যায় না। মারাঠারা কেবলমাত্র বীরত্ব করে নাই, তাহারা রাষ্ট্রের সৃষ্টি করিয়াছিল।
অতএব আধুনিক ভারতের যদি কোনো প্রদেশের ইতিহাস থাকে, এবং সেই ইতিহাস হইতে যদি ঐতিহাসিক তত্ত্ব কিছু শিক্ষা করা যাইতে পারে, তবে তাহা মারাঠার ইতিহাস হইতে।
ইংলণ্ডে এক সময়ে বৃটনেরা ছিল— ডেন্দের সহিত স্যাক্সনদের সহিত তাহাদের লড়াই চলিত। মাঝে হইতে রোমানেরা কিছুদিন তাহাদের উপর আধিপত্য করিয়া গেল। তাহার পরে নর্মানের এই দ্বীপ অধিকার করিয়া লইল। এই-সকল কাড়াকাড়ি ছেঁড়াছেঁড়ির বৃত্তান্তে ইতিহাসের মূর্তি প্রস্ফুট নহে। কিন্তু ইংলণ্ডে যখন হইতে জাতি গড়িয়া উঠিতে লাগিল, নানা শক্তির মন্থনে যখন হইতে দেশের চিত্ত সজাগ হইয়া আপনার লক্ষ্য নির্ণয় ও তাহার পথ পরিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত হইল, তখন হইতে ইংলণ্ডের ইতিহাস যেন দেহ ধারণ করিল এবং এই ইতিহাস মানুষের শিক্ষার বিষয় হইয়া উঠিল।
ভারতবর্ষেও মোগল পাঠানে মিলিয়া রক্তবর্ণ নাট্যমঞ্চে যে অভিনয় করিয়া গিয়াছে তাহাতে রসের অভাব নাই, কিন্তু তাহাতে ইতিহাস জমিয়া উঠে নাই। সুতরাং তাহা পড়িয়া আমাদের কৌতূহল চরিতার্থ হইতে পারে, কিন্তু আমাদের ঐতিহাসিক শিক্ষা লাভ হয় না।
ভারতবর্ষে কেবল মারাঠা জাতির ও শিখজাতির কিছুকালের ইতিহাসে যথার্থ ঐতিহাসিকতা আছে। কী নিয়মে কিসের প্রেরণায় জাতি গড়িয়া উঠে, কিসের শক্তিতে তাহার উন্নতি হয় এবং কিসের অভাবে তাহার পতন ঘটে, ঘরের দৃষ্টান্ত লইয়া যদি কেহ সেই তত্ত্বের আলোচনা ভারতবর্ষে করিতে চায়, তবে কেবলমাত্র মারাঠা ও শিখের ইতিহাস তাহার সম্বল।
অথচ বাংলার বিদ্যালয়ে ভারতবর্ষের যে ইতিহাস পড়ানো হয় তাহাতে মোগল-পাঠানের বৃত্তান্ত সকলের চেয়ে বড়ো জায়গা জুড়িয়া আছে। সেই বৃত্তান্ত দেশের লোকের বৃত্তান্ত নহে; সেই বৃত্তান্তে ভারতবর্ষ কেবল উপলক্ষ্য মাত্র; অর্থাৎ ভারতবর্ষ এই বৃত্তান্তের ফ্রেম মাত্র, ছবি নহে। এই বিদেশী রাজাদের কীর্তি-কাহিনীর সংশ্রবে মারাঠা ও শিখের যেটুকু ইতিহাস আমাদের ছাত্রের পড়িতে পায় তাহা অতি অকিঞ্চিৎকর। অথচ আধুনিক ভারতবর্ষের কেবল এই অংশমাত্রেই দেশের লোকের ইতিহাস বলিতে যদি কিছু থাকে তাহা আছে।
প্রায়ই জাতীয় অভ্যুত্থানের মূলে এক বা একাধিক মহাপুরুষ আমরা দেখিতে পাই। কিন্তু এ কথা মনে রাখিতে হইবে, সেই-সকল মহাপুরুষ আপন শক্তিকে প্রকাশ করিতেই পারিতেন না, যদি দেশের মধ্যে মহৎ ভাবের ব্যাপ্তি না হইত। চারি দিকে আয়োজন অনেক দিন হইতেই হয়; সেই আয়োজনে ছোটো বড়ো অনেকেরও যোগ থাকে। অবশেষে শক্তিশালী লোক উঠিয়া সেই আয়োজনকে ব্যবহারে প্রয়োগ করেন।
মারাঠার ইতিহাসে আমরা শিবাজীকেই বড়ো করিয়া দেখিতে পাই। কিন্তু শিবাজী বড় হইয়া উঠিতে পারিতেন না, যদি সমস্ত মারাঠা জাতি তাঁহাকে বড়ো করিয়া না তুলিত। বহু দিন হইতে বহু ধর্মবীর দেশের উচ্চনীচের, ব্রাহ্মণ-শূদ্রের কৃত্রিম ব্যবধান ভেদ করিয়া পরস্পরের মধ্যে যোগসাধন করিতেছিলেন। ভক্তির রাজপথকে তাঁহারা ইতর ও বিশিষ্ট সকলেরই জন্য উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন। এক ভগবানের অধিকারে তাহারা দেশের সকলকে সমান গৌরবের অধিকারী করিয়াছিলেন। মারাঠায় ধর্মান্দোলনে দেশের সমস্ত লোক একত্র মথিত হইতেছিল। শিবাজীর প্রতিভা সেই মন্থন হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। তাহা সমস্ত দেশের ধর্মোদ্বোধনের সহিত জড়িত, এইজন্যই দেশের শক্তিতে তিনি ধন্য ও তাহার শক্তিতে দেশ ধন্য হইয়াছে।
যদি এ কথা সত্য হইত যে, শিবাজী প্রতিভাশালী দস্যু মাত্র, তিনি নিজের স্বার্থসাধন ও ক্ষমতাবিস্তারের জন্য অসামান্য কৌশল প্রয়োগ করিয়াছিলেন, তবে তাহার সেই দস্যুতাকে অবলম্বন করিয়া কখনোই সমস্ত মারাঠা জাতি এক হইয়া উঠিত না। বিশেষত, শিবাজী যখন অওরঙ্গজেবের জালে জড়িত হইয়া বন্দী হইয়াছিলেন এবং দীর্ঘকাল তাঁহাকে রাজ্য হইতে দূরে যাপন করিতে হইয়াছিল তখনও যে তাহার কীতি ভাঙিয়া ভূমিসাৎ হয় নাই তাহার একমাত্র কারণ, সমস্ত দেশের ধর্মবুদ্ধির সহিত তাহার চেষ্টার যোগ ছিল। বস্তুত, তাঁহার সাধনা সমস্ত দেশেরই ধর্মসাধনার একটি বিশেষ প্রকাশ। এই ধর্মসাধনার আহ্বানেই খণ্ড খণ্ড মারাঠা আপনার বিচ্ছিন্ন শক্তিকে একত্র সম্মিলিত করিয়া মঙ্গল-উদ্দেশ্যের নিকট নিবেদন করিতে পারিয়াছিল; লুণ্ঠনের ভাগ লইয়া, ক্ষমতার ভাগ লইয়া, পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করে নাই।
অবশেষে যখন একদিন এই ধর্মসাধনা স্বার্থসাধনে বিকৃত হইয়া গেল, যখন সমস্ত দেশের শক্তি আর এক মিলিতে পারিল না, তখন পরস্পর অবিশ্বাস ঈর্ষা বিশ্বাসঘাতকতা বটগাছের কুটিল শিকড়জালের মতে মারাঠাপ্রতাপের বিশাল হর্ম্যকে ভিত্তিতে ভিত্তিতে দীর্ণ বিদীর্ণ করিয়া দিল। ধর্ম সমস্ত জাতিকে এক করিয়াছিল, এবং স্বার্থ ই তাহাকে বিশ্লিষ্ট করিয়া দিয়াছে— ইহাই মারাঠা- অভ্যুত্থান ও পতনের ইতিহাস। ব্যক্তিগত মহাশক্তির সঙ্গে দেশের শক্তিকে মিলাইতে পারে ধর্মের যোগ; কিন্তু ব্যক্তিগত শক্তি যখন স্বার্থকে অবলম্বন করে তখন সমস্ত দেশের শক্তি কখনোই তাহার সঙ্গে এক হইয়া মিলিতে পারে না।
ধর্মের উদার ঐক্য দেশের ভেদবুদ্ধিকে নিরস্ত করিয়া দিলে তবেই দেশের অন্তর্নিহিত সমস্ত শক্তি এক মিলিত হইয়া অভাবনীয় সফলতা লাভ করে, ইহাই মহারাষ্ট্র-ইতিহাসের শিক্ষা, ইহার ব্যতিক্রম ঘটিলে প্রবল প্রতাপও আপনাকে রক্ষা করিতে পারে না।