ইন্দিরা (১৮৭৩)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
এখন হইতে এই ইতিবৃত্ত মধ্যে এক শত বার আমার স্বামীর উল্লেখ করিবার আবশ্যক হইবে। এখন তোমরা পাঁচ জন রসিকা মেয়ে একত্র কমিটিতে বসিয়া পরামর্শ করিয়া বলিয়া দেও, আমি কোন্ শব্দ ব্যবহার করিয়া। তাঁহার উল্লেখ করিব? এক শত বার “স্বামী স্বামী” করিয়া কান জ্বালাইয়া দিব? না জামাই বারিকের দৃষ্টাস্তানুসারে, স্বামীকে ‘উপেন্দ্র” বলিতে আরম্ভ করিব? “না প্রাণ নাথ” “প্রাণ কান্ত” “প্রাণেশ্বর” “প্রাণ পতি,” এবং “প্রাণাধিকের” ছড়া ছড়ি করিব? যিনি আমাদিগের সর্ব্বপ্রিয় সম্বোধনের পাত্র, যাঁহাকে পলকেই ডাকিতে ইচ্ছা করে, তাহাকে যে কি বলিয়া ডাকিব, এমন কথা পোড়া দেশের ভাষায় নাই। আমার এক সখী, (সে একটু সহর ঘেঁসা মেয়ে) স্বামীকে “বাবু” বলিয়া ডাকিত —কিন্তু শুধু বাবু বলিতে তাহার মিষ্ট লাগিল না—সে মনোদুঃখে স্বামীকে শেষে “বাবুরাম” বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিল। আমারও ইচ্ছা করিতেছে, আমি তাই করি।
মাংসপাত্র ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়া, মনে২ স্থির করিলাম, “যদি বিধাতা হারাধন মিলাইয়াছে—তবে ছাড়া হইবে না। বালিকার মত লজ্জা করিয়া সব নষ্ট না করি।”
এই ভাবিয়া আমি এমত স্থানে দাঁড়াইলাম যে,ভোজনস্থান হইতে বহির্ব্বাটীতে গমনকালে যে এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে যাইবে, সে দেখিতে পাইবে। আমি মনে বলিলাম যে, “যদি ইনি এদিক ওদিক চাহিতে২ না যান, তবে আমি এ কুড়ি বৎসর বয়স পর্য্যন্ত পুরুষের চরিত্র কিছুই বুঝি নাই।” আমি স্পষ্ট কথা বলি, তোমরা আমাকে মার্জ্জনা করিও—আমি মাথার কাপড় ফেলিয়া দিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। এখন লিখিতে লজ্জা করিতেছে, কিন্তু তখন আমার কি দায়, তাহা মনে করিয়া দেখ।
অগ্রে২ রাম রাম দত্ত গেলেন—তিনি কোন দিকে চাহিলেন না। তার পর স্বামী গেলেন-তাঁহার চক্ষু যেন চারিদিগে কাহার অনুসন্ধান করিতেছিল। আমি তাঁহার নয়নপথে পড়িলাম। তাঁহার চক্ষু আমারই অনুসন্ধান করিতেছিল, তাহা বিলক্ষণ জানিতাম। তিনি আমার প্রতি চাহিবা মাত্র, আমি ইচ্ছাপূর্ব্বক,—কি বলিব, বলিতে লজ্জা করিতেছে—সর্পের যেমন চক্রবিস্তার স্বভাবসিদ্ধ, কটাক্ষও আমাদিগের তাই। যাঁহাকে আপনার স্বামী বলিয়া জানিয়াছিলাম, তাঁহার উপর একটু অধিক করিয়া বিষ ঢালিয়া না দিব কেন? বোধ হয় “প্রাণনাথ” আহত হইয়া বাহিরে গেলেন।
হারাণী নামে রামরাম দত্তের একজন পরিচারিকা ছিল। আমার সঙ্গে তাহার বড় ভাব—সেও দাসী, আমিও দাসী—না হইবে কেন? আমি তাহাকে বলিলাম, “ঝি, আমার জন্মের শোধ একবার উপকার কর। বাবুটি কখন যাইবেন, আমাকে শীঘ্র খবর আনিয়া দে।”
হারাণী মৃদু হাসিল। বলিল, “ছি! দিদি ঠাকুরুন! তোমার এ রোগ আছে, তা জানিতাম না।”
আমিও হাসিলাম। বলিলাম, “মানুষের সকল দিন। সমান যায় না। এখন তুই গুরুমহাশয় গিরি রাখ——আমার এ উপকার করবি কি না বল্।”
হারাণী বলিল,“তোমার জন্য একাজ আমি করিব কিন্তু আর কারও জন্য হইলে করিতাম না।”
হারাণীর নীতি শিক্ষা এই রূপ।
হারাণী স্বীকৃত হইয়া গেল, কিন্তু ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব হইতে লাগিল। ততক্ষণ আমি কাটা মাছের মত ছট্ফট্ করিতে লাগিলাম। চারি দণ্ড পরে হারাণী ফিরিয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে কহিল,“বাবুর অসুখ করিয়াছে—বাবু এ বেলা যাইতে পারিলেন না—আমি তাঁহার বিছানা লইতে আসিয়াছি।”
আমি বলিলাম, “কি জানি, যদি অপরাহ্নে চলিয়া যান—তুই একটু নির্জ্জন পাইলেই তাঁহাকে বলিস্ যে আমাদের রাঁধুনী ঠাকুরাণী বলিয়া পাঠাইলেন যে, ‘এ বেলা আপনার খাওয়া ভাল হয় নাই, রাত্রি থাকিয়া খাইয়া যাইবেন।’ কিন্তু রাঁধুনীর নিমন্ত্রণ, কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করিবেন না। কোন ছল করিয়া থাকিবেন।” হারাণী আবার হাসিয়া বলিল, “ছি।” কিন্তু দৌত্য স্বীকৃত হইয়া গেল। হারাণী অপরাহ্নে আসিয়া আমাকে বলিল, “তুমি যাহা বলিয়াছিলে, তাহা বলিয়াছি। বাবুটি ভাল মানুষ নহেন—রাজি হইয়াছেন।”
শুনিয়া আহলাদিত হইলাম, কিন্তু মনে২ তাঁহাকে একটু নিন্দা করিলাম। আমি চিনিয়াছিলাম যে তিনি আমার স্বামী, এই জন্য যাহা করিতেছিলাম, তাহাতে আমার বিবেচনায় দোষ ছিল না। কিন্তু তিনি যে আমাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন, এমত কোন মতেই সম্ভবে। আমি তাঁহাকে বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থায় দেখিয়াছিলাম— এজন্য আমার প্রথমেই সন্দেহ হইয়াছিল। তিনি আমাকে একাদশ বৎসরের বালিকা দেখিয়াছিলেন মাত্র। তিনি আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন, এমত কোন লক্ষণও দেখি নাই। অতএব তিনি আমাকে পরস্ত্রী জানিয়া যে আমার প্রণয়াশায় লুব্ধ হইলেন, শুনিয়া মনে২ নিন্দা করিলাম। কিন্তু তিনি স্বামী, আমি স্ত্রী—তাঁহার মন্দ ভাবা আমার অকর্ত্তব্য বলিয়া সে কথার আর অলোচনা করিলাম না। মনে২ সঙ্কল্প করিলাম, যদি কখন দিনপাই, তবে এ স্বভাব ত্যাগ করাইব।
অবস্থিতি করিবার জন্য তাঁহাকে ছল খুঁজিয়া বেড়াইতে হইল না। তিনি কলিকাতায় কারবার আরম্ভ করিয়াছিলেন, সেই জন্য মধ্যে২ কলিকাতায় আসিতেন। রামরাম দত্তের সঙ্গে তাঁহার দেনা পাওনা ছিল। সেই সুত্রেই তাঁহার সঙ্গে নূতন আত্মীয়তা। অপরাহ্নে তিনি হারাণীর কথার স্বীকৃত হইয়া, রামরামের সঙ্গে পুনশ্চ সাক্ষাৎ হইলে বলিলেন, “যদি আসিয়াছি, তবে একবার হিসাবটা দেখিয়া গেলে ভাল হইত।” রামরাম বাবু বলিলেন, “ক্ষতি কি? কিন্তু কাগজ পত্র সব আড়তে আছে, আনিতে পাঠাই। আসিতে রাত্র হইবে। যদি অনুগ্রহ করিয়া কাল প্রাতে একবার পদার্পণ করেন—কিম্বা অদ্য অবস্থিতি করেন, তবেই হইতে পারে।” তিনি উত্তর করিলেন, “তাহার বিচিত্র কি? এ আমারই ঘর। একবারে কাল প্রাতেই যাইব।”