ইন্দিরা (১৮৭৩)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
প্রথমে মনে করিলাম, যে আমার বেতনের টাকা গুলি সংগ্রাহ করিয়া শীঘ্রই পিত্রালযে যাইতে পারিব। কিন্ত মহেশপুর কোথায়, কেহ চিনে না-এমন লোক পাইলাম না যে কোন সুযোগ করিয়া দেয়। মহেশপুর কোন জেলা, কোন দিগে যাইতে হয়, আমি কুলবধূ, এ সকলের কিছুই জনিতাম না, সুতরাং কেহ কিছু বলিতে পারিল না। এই রূপে এক বৎসর রাম রাম বাবূর বাড়ীতে কাটিল। তাহার পর এক দিন অকস্মাৎ এ অন্ধকার পথে প্রদীপের আলো পড়িল, মনে হইল। শ্রাবণের রাত্রে নক্ষত্র দেখিলাম মনে হইলে।
এই সময়ে রাম রাম দত্ত আমাকে এক দিন ডাকিয়া বলিলেন, “আজ একটি বিশিষ্ট লোককে নিমন্তরণ করি- য়াছি-তিনি আমার মহাজন, আমি খাদক,—আজিকার পাক শাক যেন পরিপাটি হয়। নহিলে বড় প্রমাদ হইবে।”
আমি যত্ করিয়া পাক করিলাম। আহারের স্থান অন্তঃ- পুরেই হইল-সুতরাং আমিই পরিবেশন করিতে প্রবৃত্তা হইলাম। কেবল নিমন্ত্রিত ব্যক্তি এবং রামরাম বাবু আ- হারে বসিলেন।
আমি অগ্র অন্নব্যঞ্জন দিয়া আসিলাম-পরে তাঁহারা আসিলেন। তাহার পর মাংস দিতে গেলাম। আমি অবগুণ্ঠনবতী, কিন্তু ঘোমটায় স্ত্রীলোকের স্বভাব চাকা পড়ে না। ঘোমটার ভিতর হইতে একবার নিমন্ত্তিত বাবুটিকে দেখিয়া লইলাম।
দেখিলাম, তাঁহার বয়স ত্রিশবৎসর বোধ হয়; তিনি গৌরবর্ণ এবং অত্যন্ত সুপুরুয; তাঁহাকে দেখিয়াই রমণী মনোহর বলিয়া বোধ হইল। বলিতে কি, আমি মাং- সের পাত্র লইয়া একটু দাঁড়াইয়া রহিলাম, আর একবার তাহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। আমি ঘোমটার ভি- তর হইতে তাঁহাকে খর দৃষ্টিতে দেখিতে ছিলাম, এমত সময়ে তিনি মুখ তুলিলেন-দেখিতে পাইলেন যে আমি ঘোমটার ভিতর হইতে তাঁহার প্রতি তীব্র দৃষ্টিতে চাহিয়া আছি। পুরুষে বলিয়া থাকেন, যে অন্ধকারে প্রদীপের মত, অবগুণ্ঠন মধ্যে রমণীর কটাক্ষ অধিকতর তীব্র দে- খায়। বোধ হয়, ইনিও সেইরূপ দেখিয়া থাকিবেন। তিনি একটু মাত মৃদু হাসিয়া, মুখ নত করিলেন। সে হাসি কেবল আমিই দেখিতে পাইলাম। আমি সমুদায মাংস তাঁহার পাতে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া আসিলাম।
আমি একটু লজ্জিতা, একটু সুখী হইয়া আসিলাম। লজ্জার মাথা খেয়ে বলিতে হইল- আমি নিতান্ত একটুকু সুখী হইয়া আসিলাম না। আমার নারী জন্মে প্রথম এই হাসি- আর কখন কেহ আমাকে দেখিয়া মধুর হাসি হাসে নাই। আর সকলের হাসি বিষ লাগিয়াছিল।
এতক্ষণ বোধ হয়, পতিব্রতা মগুলী আমার উপর ভ্রূভঙ্গী করিতেছেন এবং বলিতেছেন, “পাপিষ, এ যে অনু- রাগ।” আমি স্বীকার করিতেছি, এ অনুরাগ। কিন্তু আমি সধবা হইয়াও জন্মবিধবা। বিবাহের সময়ে একবার মাত্র স্বামিসন্দর্শন হইয়াছিল-সুতরাং যৌবনের প্রবৃত্তি সকল অপরিতৃপ্ত ছিল। এমন গভীর জলে ক্ষেপণী নি- ক্ষেপেই যে তরঙ্গ উঠিবে, তাহাতে বিচিত্র কি?
আমি স্বীকার করিতেছি যে এ কথা বলিয়া আমি দোষ শুন্য হইতে পারিতেছি না। সকারণে হউক, আর নিষ্কা- রণেই হউক, পাপ সকল অবস্থাতেই পাপ। পাপের নৈমিত্তিকতা নাই। কিন্তু আমার জন্মের মধ্যে এই প্রথম পাপ ও এই শেষ পাপ।
পাকশালায় ফিরিয়া আসিয়া, আমার যেন মনে হইল, আমি ইহাঁকে পূর্ব্বে কোথাও দেখিয়াছি। সন্্দেহ ভঞ্জ- নার্থ, আবার অন্তরাল হইতে ইহাঁকে দেখিতে গেলাম। বিশেষ করিয়া দেখিলাম। দেখিয়া মনে মনে বলিলাম, “চিনিয়াছি।”
এমত সময়ে রামরাম বাবু, আবার অন্যান্য খাদ্য লইয়া যাইতে ডাকিয়া বলিলেন। অনেক প্রকার মাংস পাক করিয়াছিলাম-লইয়া গেলাম। দেখিলাম, ইনি সেই কটাক্ষটি মনে করিয়া রাখিয়াছেন। রামরাম দত্তকে বলিলেন, “রাম বাবু, আপনার পাচিকাকে বলুন, যে পাক অতি পরিপাটি হইয়াছে।”
রামরাম ভিতরের কথা কিছু ববিলেন না, বলিলেন, “হাঁ উনি রাঁধেন ভাল।”
আমি মনে মনে বলিলাম “তোমার মাতা আর মুণ্ড রাঁধি।”
নিমন্ত্রিত বাবু কহিলেন, “কিন্তু এ বড় আশ্চর্য্য যে আপনার বাড়ীতে দুই এক খানা ব্যঞ্জন আমাদের দেশের মত পাক হইয়াছে।”
আমি মনে মনে ভাবিলাম, “চিনিয়াছি।” বস্তুতঃ দুই এক খানা ব্যঞ্জন আমাদের নিজ দেশের প্রথামত পাক করিয়াছিলাম।
রামরাম বলিলেন, “তা হবে; ওঁর বাড়ী এ দেশে নয়।”
ইনি এবার যো পাইলেন, একেবারে আমার মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া বলিলেন, “তোমাদের বাড়ী কোথায় গা?”
আমার প্রথম সমস্যা; কথা কই কি না কই। স্থির করিলাম কথা কহিব।
দ্বিতীয় সমস্যা, সত্য বলিব না মিথ্যা বলিব। স্থির করিলাম, মিথ্যা বলিব। কেন এরূপ স্থির করিলাম, তাহা যিনি স্ত্রীলোকের হৃদয়কে চাতুর্য্যপ্রিয়, বক্রপথগামী কবিয়াছেন, তিনিই জানেন। আমি ভাবিলাম, “আবশ্যক হয়, সত্য কথা বলা আমার হাতেই রহিল। এখন আর একটা বলিয়া দেখি।” এই ভাবিয়া আমি উত্তর করিলাম,
“আমাদের বাড়ী কালদীঘি।” তিনি চমকিয়া উঠিলেন। ক্ষণেক পরে মৃদুস্বরে কহিলেন, “কোন্ কালাদীঘি, ডাকাতে কালদীঘি?”
আমি বলিলাম “হাঁ।”
তিনি আর কিছু বলিলেন না।
আমি মাংস পাত্র হাতে করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম দাঁড়াইয়া থাকা আমার যে অকর্ত্তব্য, তাহা আমি ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। দেখিলাম যে তিনি আর ভাল করিয়া আহার করিতেছেন না। তাহা দেখিয়া রামরাম দত্ত বলিলেন,
“উপেন্দ্র বাবু, আহার করুন না।” ঐটি শুনিবার আমার বাকি ছিল। উপেন্দ্র বাবু! আমি নাম শুনিবার আগেই চিনিয়াছিলাম, ইনি আমার স্বামী।
আমি পাকশালায় গিয়া পাত্র ফেলিয়া এক বার অনেক কালের পর আহলাদ করিতে বসিলাম। রামরাম দত্ত বলিলেন, “কি পড়িল?” আমি মাংসের পাত্র খানা ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিলাম।