ইন্দিরা (১৮৭৩)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
তখন সে চিন্তিতভাব আমার দূর হইল। ইতিপূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম, যে তিনি আমার হাস্য কটাক্ষের বশীভূত হইয়াছেন। মনে২ করিলাম, যদি গণ্ডারের খড়া প্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি হস্তীর শুণ্ড প্রয়োগে পাপ থাকে, যদি ব্যাঙের নখ ব্যবহারে পাপ না থাকে, যদি মহিষের শৃঙ্গাঘাতে পাপ না থাকে, তবে আমারও পাপ হইবে না। জগদীশ্বর আমাদিগকে যে সকল আয়ুধ দিয়াছেন, উভয়ের মঙ্গলার্থে তাহার প্রয়োগ করিব। আমি তাহার নিকট হইতে দূরে আসিয়া বসিলাম। তাঁহার সঙ্গে প্রফুল্ল হইয়া কথা কহিতে লাগিলাম। তিনি নিকটে আসিলেন, আমি তাঁহাকে কহিলাম, “আমার নিকটে আসিবেন না। আপনার একটি ভ্রম জন্মিয়াছে দেখিতেছি,” হাসিতে২ আমি এই কথা বলিলাম এবং বলিতে২ কবরী মোচন পূর্ব্বক (সত্য কথা না বলিলে কে এ ইতি হাস বুঝিতে পারিবে?) আবার বাঁধিতে বসিলাম “আপনার একটি ভ্রম জন্মিয়াছে। আমি কুলটা নহি। আপনার নিকটে দেশের সম্বাদ শুনিব বলিয়াই আসিয়াছি। অসৎ অভিপ্রায় কিছুই নাই।”
বোধ হয়, তিনি এ কথা বিশ্বাস করিলেন না। অগ্রসর হইয়া বসিলেন। আমি তখন হাসিতে২ বলিলাম, “তুমি কথা শুনিলে না, তবে আমি চলিলাম। তোমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎ,” এই বলিয়া আমি গাত্রোত্থান করি্লাম
অমি সত্য সত্যই গাত্রোত্থান করিলাম দেখিয়া তিনি ক্ষুর হইলেন; আসিয়া আমার হস্ত ধরিলেন। আমি রাগ করিয়া হাত ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলাম, কিন্তু হাসিলাম, বলিলাম, “তুমি ভাল মানুষ নও। আমাকে ছুঁইও না। আমাকে দুশ্চরিত্রা মনে করিও না।”
এই বলিয়া আমি দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলাম। স্বামী—অদ্যাপি সে কথা মনে পড়িলে দুঃখ হয়—তিনি হাত ঘোড় করিয়া ডাকিলেন, “আমাকে রক্ষা কর, রক্ষা কর, যাইও না। আমি তোমার রূপ দেখিয়া পাগল হইয়াছি। এমন রূপ আমি কখন দেখি নাই।” আমি আবার ফিরিলাম—কিন্তু বসিলাম না—বলিলাম, “প্রাণা। ধিক! আমি কোন ছার, আমি যে তোমা হেন রত্ন ত্যাগ করিয়া যাইতেছি, ইহাতেই আমার মনের দুঃখ বুঝিও। কিন্তু কি করিব? ধর্ম্মই আমাদিগের এক মাত্র প্রধান উপায়-একদিনের সুখের জন্য আমি ধর্ম্ম ত্যাগ করিব না। আমি চলিলাম।”
তিনি বলিলেন, “আমি শপথ করিয়াছি, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়েশ্বরী হইয়া থাকিবে। এক দিনের জন্য কেন?”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “পুরুষের শপথে বিশ্বাস। নাই।” এই বলিয়া আবার চলিলাম—দ্বার পর্য্যন্ত আসিলাম। তখন আর ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে না পারিয়া তিনি দুই হস্তে আমার দুই চরণ ধরিয়া পথ রোধ করিলেন।
তাঁহার দশা দেখিয়া আমার দুঃখ হইল। বলিলাম, “তবে তোমার বাসায় চল—এখানে থাকিলে তুমি আমায় ত্যাগ করিয়া যাইবে।”
তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। তাঁহার বাসা সিমলায়, অল্পদূর, সেই রাত্রেই আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলেন। সেখানে গিয়া দেখিলাম, দুই মহল বাড়ী। একটি ঘরে আমি অগ্রে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিয়াই ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিলাম। স্বামী বাহিরে পড়িয়া রহিলেন।
তিনি বাহির হইতে কাতরোক্তি করিতে লাগিলেন, আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “আমি এখন তোমারই দাসী হইলাম। কিন্তু দেখি তোমার প্রণয়ের বেগ কাল প্রাতঃকাল পর্য্যন্ত থাকে না থাকে। যদি কাল ও এমনি ভালবাসা দেখিতে পাই, তখন তোমার সঙ্গে আবার আলাপ করিব। আজ এই পর্য্যন্ত।”
আমি দ্বার খুলিলাম না। অগত্যা তিনি অন্যত্র গিয়া বিশ্রাম করিলেন। আনেক বেলা হইলে দ্বার খুলিলাম। দেখিলাম, স্বামী দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। আমি আপনার করে তাঁহার কর গ্রহণ করিয়া বলিলাম, “প্রাণনাথ, হয় আমাকে রামরাম দত্তের বাড়ী পাঠাইয়া দাও, নচেৎ অষ্টাহ আমার সঙ্গে আলাপ করিও না। এই অষ্টাই তোমার পরীক্ষা।” তিনি অষ্টাহ পরীক্ষা স্বীকার করিলেন।