ইন্দিরা (১৮৭৩)/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
পুরুষকে দগ্ধ করিবার যে কোন উপায় বিধাতা স্ত্রীলোককে দিয়াছেন, সেই সকল উপায়ই অবলম্বন করিয়া আমি অষ্টাহ স্বামীকে জ্বালাতন করিলাম। আমি স্ত্রী- লোক-কেমন করিয়া মুখ ফুটিয়া সে সকল কথা বলিব। আমি যদি আগুন জ্বালিতে না জানিতাম, তবে গত রাত্রে এত আগুন জ্বলিত না। কিন্তু কি প্রকারে আগুন জ্বলিলাম—কি প্রকারে ফুৎকার দিলাম—কি প্রকারে স্বামীর হৃদয় দগ্ধ করিলাম, লজ্জায় তাহার কিছুই বলিতে পারি নাই। যদি আমার কোন পাঠিকা নর হত্যার ব্রত গ্রহণ করিয়া থাকেন, এবং সফল হইয়া থাকেন, তিনিই বুঝিবেন। যদি কোন পাঠক কখন এই রূপ নরঘাতিনীর হস্তে পড়িয়া থাকেন, তিনিই বুঝিবেন। বলিতে কি, স্ত্রীলোকই পৃথিবীর কণ্টক। আমাদের জাতি হইতে পৃথিবীর যত অনিষ্ট ঘটে, পুরুষ হইতে তত ঘটে না। সৌভাগ্য এই যে এই নরঘাতিনী বিদ্যা সকল স্ত্রীলোকে জানে না, তাহা হইলে এত দিনে পৃথিবীতে আগুন লাগিত।
এই অষ্টাহ আমি সর্ব্বদা স্বামীর কাছে কাছে থাকিতাম —আদর করিয়া কথা কহিতাম—নীরস কথা একটি কহিতাম না। হাসি, চাহনী, অঙ্গভঙ্গী,—সে সকল ত ইতর স্ত্রীলোকের অস্ত্র। আমি প্রথম দিনে আদর করিয়া কথা কহিলাম—দ্বিতীয় দিনে অনুরাগ লক্ষণ দেখাইলাম —তৃতীয় দিনে তাঁহার ঘরকরনার কাজ করিতে আরম্ভ করিলাম; যাহাতে তাঁহার আহারের পারিপাট্য, শয়নের পারিপাট্য, স্নানের পারিপাট্য হয়, সর্ব্বাংশে যাহাতে ভাল থাকেন, তাহাই করিতে আরম্ভ করিলাম—স্বহস্তে পাক করিলাম; খড়িকাটি পর্য্যন্ত স্বয়ং প্রস্তুত করিয়া রাখিলাম। লজ্জার কথা কহিব কি?—এক দিন একটু কাঁদিলাম; কেন কাঁদিলাম, তাহা স্পষ্ট তাঁহাকে জানিতে দিলাম না—অথচ একটু২ বুঝিতে দিলাম যে অষ্টাহ পরে পাছে বিচ্ছেদ হয়—পাছে তাহার অনুরাগ স্থায়ী না হয়, এই আশঙ্কায় কাঁদিতেছি। এক দিন, তাঁহার একটু অসুখ হইয়াছিল, সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া তাঁহার শুশ্রূষা করিলাম। এ সকল পাপাচরণ শুনিয়া আমাকে ঘৃণা করিও না—আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে সকলই কৃত্রিম নহে—আমি তাঁহাকে আন্তরিক ভাল বাসিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম। তিনি যে পরিমাণে আমার প্রতি অনুরাগী, তাহার অধিক আমি তাহার প্রতি অনুরাগিণী হইয়াছিলাম। বলা বাহুল্য যে তিনি অষ্টাহ পরে আমাকে মারিয়া তাড়াইয়া দিলেও আমি যাইতাম না।
ইহাও বলা বাহুল্য যে তাঁহার অনুরাগানলে অপরিমিত ঘৃতাহুতি পড়িতেছিল। তিনি এখন অনন্যকর্ম্মা হইয়া কেবল আমার মুখপানে চাহিয়া থাকিতেন। আমি গৃহকর্ম্ম করিতাম-তিনি বালকের মত আমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইতেন। তাঁহার চিত্তের দুর্দ্দমনীয় বেগ প্রতিপদে দেখিতে পাইতাম, অথচ আমার ইঙ্গিতমাত্রে স্থির হইতেন। কখন কখন আমার চরণস্পর্শ করিয়া রোদ করিতেন, বলিতেন, “আমি এ আষ্টাহ তোমার কথা পালন করিব—তুমি আমায় ত্যাগ করিয়া যাইও না।” ফলে আমি দেখিলাম যে আমি তাঁহাকে ত্যাগ করিলে। তাঁহার উন্মাদ গ্রস্ত হওয়া অসম্ভব নহে।
পরীক্ষার শেষ দিন আমিও তাঁহার সঙ্গে কাঁদিলাম। বলিলাম, “প্রাণাধিক! আমি তোমার সঙ্গে আসিয়ী ভাল করিনাই। তোমাকে বৃথা কষ্ট দিলাম। এখন আমার বিবেচনা হইতেছে, পরীক্ষা মিথ্যা প্রম মাত্র। মানুষের মন স্থির নয়। তুমি আট দিন আমাকে ভাল বাসিলে—কিন্তু আট মাস পরে তোমার এ ভালবাসা থাকিবে কি না, তাহা তুমিও বলিতে পার না। তুমি আমায় ত্যাগ করিলে আমার কি দশা হইবে?”
তিনি হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন, “তোমার যদি সেই ভাবনা হয়, তবে আমি তোমাকে এখনই যাবজ্জীবনের উপায় করিয়া দিতেছি। পূর্ব্বেই আমি মনে করিয়াছি, তোমার যাবজ্জীবনের সংস্থান করিয়া দিব।”
আমিও ঐ কথাই পাড়িবার উদ্যোগ করিতেছিলাম; তিনি আপনি পাড়ায় আরও ভাল হইল। আমি তখন বলিলাম, “ছি! তুমি যদি ত্যাগ করিলে তবে আমি টাকা লইয়া কি করিব? ভিক্ষা করিয়া খাইলেও জীবন রক্ষা হয়, কিন্তু তুমি ত্যাগ করিলে জীবন রক্ষা হইবে না। তুমি এমন কোন কাজ কর, যাহাতে আমার বিশ্বাস হয় যে তুমি এজন্মে আমায় ত্যাগ করিবে না। আজ শেষ পরীক্ষার দিন।”
তিনি বলিলেন, “কি করিব, বল। তুমি যাহা বলিবে, তাহাই করিব।”
আমি বলিলাম “আমি স্ত্রীলোক, কি বলিব? তুমি আপনি বুঝিয়া কর।” পরে অন্য কথা পাড়িলাম। কথায়২ একটা মিথ্যা গল্প করিলাম। তাহাতে কোন ব্যক্তি আপন উপপত্নীকে সমুদায় সম্পত্তি লিখিয়া দিয়াছিল— এই প্রসঙ্গ ছিল।
তিনি গাড়ি প্রস্তুত করিতে বলিলেন। গাড়ি প্রস্তুত হইলে কোথায় গেলেন। আট দিনের মধ্যে এই তিনি প্রথমে আমার কাছ ছাড়া হইলেন। ক্ষণেক পরে ফিরিয়া আসিলেন। কোথায় গিয়াছিলেন, তাহা আমাকে কিছু বলিলেন না। আমিও কিছু জিজ্ঞাসা করিলাম না। অপরাহ্নে আবার গেলেন। এবার একখানি কাগজ হাতে করিয়া আসিলেন। বলিলেন, “ইহা লও। তোমাকে আমার সমস্ত সম্পত্তি লিখিয়া দিলাম। উকীলের বাড়ী হইতে এই দানপত্র লেখাইয়া আনিয়াছি। যদি তোমাকে আমি কখন ত্যাগ করি, তবে আমাকে ভিক্ষা করিয়া খাইতে হইবে।”
এবার আমার অকৃত্রিম অশ্রুজল পড়িল—তিনি আমাকে এত ভাল বাসেন! আমি তাঁহার চরণ স্পর্শ করিয়া বলিলাম, “আজি হইতে আমি তোমার চিরকালের দামী হইলাম। পরীক্ষা শেষ হইয়াছে।”