ইন্দুমতী/দস্যুদলে

তৃতীয় সর্গ।

দস্যুদলে।

দেবব্রত পড়িলেন বিষম বিপদে।
আশ্রয়দাতার এই বিপদের দিনে,
কেমনে ছাড়িয়া যান তা’দের সকলে?
একমাত্র উপলক্ষ তিনি যে সবার।
যা থাকে কপালে হবে,আশ্রয়দাতার
থাকিবেন সঙ্গে তিনি করিলেন স্থির।
 এদিকে বাড়িল ক্রমে ঠাকুরের পীড়া,
একদা নিশীথে হ’ল জীবন সংশয়।
পরামর্শ হেতু দ্রুত সহচর সাথে,
দেবব্রত চলিলেন বৈদ্যের নিকটে।
দূরগ্রামে গিয়া তিনি লইয়া ঔষধ,
ফিরিলেন তাড়াতাড়ি গ্রাম অভিমুখে।
 পথে তাঁ’র দুই দিকে সুদীর্ঘ প্রান্তর,
তরল আঁধারে ঢাকা। পথে দীর্ঘ গাছ,
আঁধারে ভীষণ কায়, রয়েছে দাঁড়া’য়ে।
পাতায় পাতায় কা’র জোনাকির আলো
করিতেছে ঝলমল দেখিতে সুন্দর।

গভীরা রজনী এবে সুপ্তা বসুন্ধরা,
নাহি কোন সাড়াশব্দ জন-মানবের।
মাঝে মাঝে শুনা যায় কুক্কুর চিৎকার,
শৃগালের খেক্কা রব দূর গ্রাম হ’তে
ভাসিয়া আসিছে নৈশ বায়ুস্তর দিয়া।
মাঝে মাঝে শুনা যায় বাদুড়ের আর
পক্ষ সঞ্চালন শব্দ। বৃক্ষের শাখায়
পেচক গম্ভীর রবে ডাকে মাঝে মাঝে।
মাথার উপরে কত শত গ্রহ তারা,
ছায়াপথ,সমুজ্জ্বল করেছে গগন।
এক মহা নীরবতা ব্যাপ্ত চরাচর।
পথের উপরে এক বৃক্ষের তলায়,
বৃক্ষের আঁধারে বসে দস্যু এক দল,
সম্মুখে লুষ্ঠিত দ্রব্য পূর্ণ থলিকায়,
বিশ্রাম করিতেছিল মুছি ঘর্ম্ম জল।
দেবব্রত আর তা’র সহচরে দেখি
জনৈক কহিল উচ্চে, “কে সায় ওখানে?”
উত্তর।  পথিক।
দস্যু।    এস, লহ এই মোট।
আমরা সকলে শ্রান্ত বহিতে অক্ষম।
দেব।  গৃহেতে মুমূর্ষু,রোগী বড় ব্যস্ত এবে।
দস্যু।  অবাধ্য হইলে গুলি করিব তোমায়।

 সহচর প্রতি কিছু করিয়া ইঙ্গিত,
দেবব্রত কহিলেন চাহি দস্যুপানে,
“কোথায় যাইতে হবে চল ত্বরা করি।
দস্যু।   ভাল। লহ এই মোট উভয়ে তুলিয়া।
 তখন লইল দুটী বোঝা দুই জনে।
একে একে ধীরে ধীরে ষোলজন দস্যু,
হইল বাহির বৃক্ষ অন্তরাল হ’তে।
ভীতিপূর্ণ ছদ্মবেশ,সশস্ত্র সকলে।
ইংরাজীতে কথা তা’রা কহিতে কহিতে,
যে পথে যাইতেছিল দেবব্রত ফিরে,
সেই পথ দিয়া তা’রা চলিল সকলে।
১ম দস্যু।  ক্রোশ মাত্র ব্যবধান গ্রাম আমাদের,
কেমনে বিদায় দিব এই দুই জনে?
২য় দস্যু।  চক্ষু বেঁধে লয়ে চল গ্রাম্য-পথ দিয়া।
চক্ষু বেঁধে রেখে যা’ব পুনঃ এই স্থানে।
৩য় দস্যু।  সারারাত্র এই করি ক্লান্ত দেহে সবে।
৪র্থ দস্যু।  অদল বদল করি আনি’ সাত ক্রোশ,
কি কাজ আছিল বল দুই ক্রোশ তরে
জুটায়ে অজানা লোক? করিয়াছ ভুল।
৫ম দস্যু।  হইয়াছে যাহা তা’র বৃথা আলোচনা।
৬ষ্ঠ দস্যু।  রাস্তার উপর, গ্রাম্য পথের মোড়েতে,
বিশ্রামের ব্যপদেশে বসিয়া সকলে,

এদের বিদায় দিব,গেলে বহুদূর,
যাইব আমরা সবে সেই গুপ্ত-স্থানে।
৭ম দস্যু।  আমি বলি গুলি করি মার ইহাদের।
১ম দস্যু।  হয়েছে একটি খুন নাহি কর আর।
 এইরূপে বহুবিধ তর্কের পরেতে,
গৃহীত হইল ষষ্ঠ দস্যুর মন্ত্রণা।
তা’র পরে অন্যকথা আরম্ভ করিয়া
ধীর পাদক্ষেপে তা’রা লাগিল চলিতে।
 সবশুনি দেবব্রত বুঝিল ইহারা,
চণ্ডিপুর গ্রামবাসী যুবকের দল।
শঙ্করের জ্যেষ্ঠ পুত্র, মহাউচ্ছৃঙ্খল,
উদ্ধত বীরেন্দ্র বাবু তাহাদের নেতা।
সেই গ্রামে ছিল যত বলিষ্ঠ,সাহসী,
নিষ্কর্ম্মা,উদ্ধত যুবা,বীরেন্দ্রের মত,
তা’দের লইয়া দল হয়েছে গঠিত।
সকলে মিলিয়া এবে কোন দূর গ্রামে
করিয়া ডাকাতি,লুটি নিরীহের ধন,
করি নরহত্যা, এবে ফিরিতেছে ঘরে,
চারিদিকে বিভীষিকা করিয়া বিস্তার।
‘স্বদেশী হাঙ্গামা’ নামে আজ কাল যা’রা
অনর্থ করি’ছে দেশে অশান্তি বিস্তার,
ষড়যন্ত্র,গুপ্তহত্যা,পাপ অনুষ্ঠান,

কলঙ্ক লেপন করি দেশবাসী মুখে,
ইহারা তা’দের শাখা সুদূর পল্লীতে!
উদয় হইবা মাত্র এই চিন্তা মনে,
ক্রোধে,ক্ষোভে,দেবব্রত হ’লেন অস্থির।
করিবেন কিবা তাহা ভাবিলেন মনে।
 কিছুদূর গিয়া তা’রা রাস্তার উপর,
যেথা হ’তে গ্রাম্য পথ গিয়াছে বাঁকিয়া,
বিশ্রামের ব্যপদেশে বসিল সকলে।
সানুচর দেবব্রতে করিল বিদায়।
 তথা হ’তে দেবব্রত গিয়া কিছু দূর,
সহচর সাথে তাঁ’র পরামর্শ করি,
বিহিত আদেশ দিয়া,ফিরিলেন একা
সেই দস্যুদলে পুনঃ। বলিলেন পরেঃ−
দেব।  শুন গো বীরেন্দ্র বাবু,শুন ভাই সব!
এমন দুষ্কর্ম্মে কেন হইয়াছ রত?
ঘৃণিত,জঘন্য,এই তস্বরের কার্য্যে
প্রবৃত্তি হইল কেন? শান্তিময়ী নিশি
করি বিভীষিকাময়ী,স্বদেশ বাসীর
কেন কর সর্ব্বনাশ,যমদূত মত,
নিজেদের সর্ব্বনাশ ডাকিছ আগ্রহে?
শিক্ষিত,মার্জ্জিত-বুদ্ধি,তোমরা সকলে,
সকলে অবস্থাপন্ন,নাহিক অভাব,

কেন করি পাপ কার্য্য কলঙ্ক সলিলে
ডুবাও আপন নাম, স্বদেশের আর?
 সকলে চমকি উঠি, চাহি পরস্পরে
পরস্পর পানে, সবে হইল বিস্মিত
সাহসে তাহার।
বীরেন্দ্র।   নাহি জানি তুমি কেবা
কেমনে জানিলে মোরে! বাখানি সাহস!
তস্কর আমরা নহি। “স্বদেশ উদ্ধার”
আমাদের ব্রত,আর আমাদের পণ।
করিতে সঞ্চয় অর্থ সেই ব্রত তরে,
কৃপণের ধন লুটি সুবিধা যেমন,
করি নরহত্যা আর প্রয়োজন মত।
দেব।  “স্বদেশ উদ্ধার!” জানি না ইহার অর্থ।
কেমনে করিবে তুমি স্বদেশ উদ্ধার?
বীরেন্দ্র।  “স্বদেশ” বলিতে এই আমাদের দেশ,
যে দেশের রাজা এই ইংরাজ এখন।
চাহি এই দেশ পুনঃ লইতে আমরা,
তাড়াইয়া ইংরাজেরে সমুদ্রের পারে।
সে নহে কঠিন কাজ লোকে ভাবে যত।
করিতে হইবে যুদ্ধ ইংরাজের সনে,
স্বদেশ উদ্ধার কভু হবে না কথায়।
চাহি গোলা গুলি অস্ত্র বন্দুক কামান

আর বোমা। প্রয়োজন বহু অর্থ তায়।
সেই অর্থ করি সবে এরূপে সংগ্রহ।
হইলে সংগ্রহ অর্থ, যুদ্ধ উপযোগী
হইবে সংগ্রহ অস্ত্র। তখন আমরা
সকলে করিব রণ। বহু খণ্ড যুদ্ধে,
বোমার জ্বালায় আর, করিব বিব্রত
ইংরাজ সকলে। প্রাণভয়ে ভীত হ’য়ে
সকলে চলিয়া যাবে এদেশ ছাড়িয়া।
স্বদেশ উদ্ধার হবে, আমরা তখন
হইব দেশের রাজা, করিব শাসন।
বুঝিলে আমার কথা পথিক প্রবর?
দেব।  বুঝিলাম সব কথা অতি পরিষ্কার,
বুঝিলাম বাতুলতা তোমা সবাকার।
আশ্রয় করিয়া সবে তস্করের বৃত্তি
করিবে সঞ্চয় অর্থ, আয়ুধ সংগ্রহ,
খণ্ড যুদ্ধে ইংরাজেরে করিবে বিব্রত,
দেখায়ে বোমার ভয় তাড়া’বে তা’দের
সুদূর সাগর পারে। বীরত্বে যাহারা
জগতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, যা’দের সমান
কৌশলী নাহিক আর; জ্ঞানে, বুদ্ধি বলে,
সমস্ত জগতে যা’রা সর্ব্ব বরণীয়;
দারুময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধীবরের তরি,

বিনিময়ে করিয়াছে যাহারা এখন
ভাসমান লৌহ দুর্গ; সুসজ্জিত যাহা
অসংখ্য বীরেন্দ্র বৃন্দে,ইরম্মদ নাদী
শত শত বিভীষণ দুর্জ্জয় কামানে,
করিবারে পারে যাহা প্রলয়ের খেলা,
উদগীরণ করি কভু অনল গোলক—
গিরি গাত্র চূর্ণ যা’তে স্ফটিকের মত—
কভু ক্ষুদ্র শেল খণ্ড অনল স্ফুলিঙ্গ,
বিচূর্ণ তারকা কিম্বা শিলাবৃষ্টি মত;
করিতে সক্ষম যাহা মুহূর্ত্তে সংহার
অসংখ্য অরাতি; যা’র সহস্র সহস্র
হেন রণ-তরি ভাসে রাজহংস মত
অনন্ত বারিধি কোলে, পৃথিবী ব্যাপিয়া;
বাহুবলে জয় করি অর্দ্ধেক পৃথিবী
প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে বিশাল রাজত্ব,
দিবাকর যথা হ’তে অস্ত নাহি যান,
দোর্দ্দণ্ড প্রতাপে যাহা করিছে শাসন;
নগণ্য বণিক বেশে ভারতে প্রবেশি,
এক পদাঘাত করি হিন্দু মুসলমানে
কাড়িয়া লইল যা’রা বঙ্গ সিংহাসন;
তর্জনী হেলায়ে পরে, একে একে একে,
মহাপরাক্রান্ত যত রণ ধুরন্ধর,

সমস্ত বীরের জাতি দলি পদতলে,
শত শত খণ্ডরাজ্য ভারতবর্ষের,
ভাঙ্গিয়া গড়িল পুনঃ এক মহারাজ্যে,
করি এক ছত্রাধীন; চির বিধূমিত
অন্তর-বিদ্রোহ এই ভারতবর্ষের,
নির্ব্বাণ করিল যা’রা একটি ফুৎকারে;
আব্রহ্ম ভারতবর্ষ মুষ্টির ভিতর
রাখিয়া সতত যা’রা করিছে শাসন,
শান্তিতে করিছে পূর্ণ এই মহাদেশ,
বিজ্ঞান,বাণিজ্য,শিল্প,করিছে প্রসার,
খুলিয়া দিতেছে জ্ঞান চক্ষু সকলের;
অনন্ত জ্ঞানের, যা’র কণামাত্র জ্ঞান
শিখিয়া তোমরা সবে কর স্পর্দ্ধা এত,
স্বাধীনতা মহাধন দয়ায় যাহার
শিক্ষালাভ করিয়াছ সকলে এখন;
একটী নিশ্বাসে যা’রা করিতে সক্ষম
ভারতে প্রলয়, আর জনপ্রাণী হীন;
মানিলাম সেই মহা প্রবল ইংরাজ,
তোমার বোমার ভয়ে, ভ্রকুটী দেখিয়া,
সকলে পলায়ে যা’বে সাগরের পারে।
ভাবিয়াছ আমাদের কি হ’বে তখন?
অন্তর বিদ্রোহে পূর্ণ হইবে ভারত,

ভাঙ্গিবে সহস্র খণ্ডে এই মহাদেশ,
শাসন,বিচার,ন্যায়,জ্ঞান,শিক্ষা,শিল্প,
সুখ,শান্তি,কৃষি আর বাণিজ্য,সকলি
যা’বে রসাতলে। বল যার দেশ তার
হইবে লোকের নীতি। ধন,মান,প্রাণ
রহিবে না নিরাপদ কাহার কখন।
তস্করে পুরিবে দেশ,বন্যজীবে আর।
নগর শ্মশান,পল্লী হইবে কানন।
দেশবাসী হবে শেষে পশুর সমান
শিক্ষা,শিল্প,বাণিজ্যের অভাবে কেবল।
সভ্যতা-আলোক,যা’তে দেশ সমুজ্জ্বল,
সে আলো নিভিয়া যা’বে ঘোর অন্ধকারে।
হয়ত অপর কোন বৈদেশিক জাতি
কাড়িয়া লইবে দেশ,অতীতে যেমন
কাড়িয়া লয়েছে তারা,করিবে শাসন
কঠিন নিগড়ে বাঁধি,ঘোর অত্যাচারে
এ সব ভেবেছ কিগো স্বদেশ হিতৈষী?
স্বদেশ হিতৈষী তুমি নহ কদাচন
কার্য্য,কিম্বা চিন্তা,কিম্বা হিন্দু আচরণে।
স্বদেশের শত্রু তুমি,তোমার দলের
পণ্ডিত সকল আর। মহান অনর্থ
সাধিতেছ তুমি,আর গুপ্ত সম্প্রদায়।

এই যে যুবক দল দেশের ভরসা,
যা’দের মঙ্গলে দেশে হইবে মঙ্গল,
উন্নতি হইলে হ’বে দেশের উন্নতি,
কত আশা বুকে ধরে জনক জননী
যা’দের করিছে কত যতনে পালন,
ভাব দেখি একবার কিবা সর্ব্বনাশ
করিছ তা’দের তুমি, আর তাহাদের
পিতা মাতা সকলের! কি ঘোর বিপদে
যেতেছ তা’দের ল’য়ে কুমন্ত্রণা দিয়া!
কি এক অশান্তি বীজ করিছ বপন
শান্তিপূর্ণ দেশময়, কিবা পরিণাম?
 জ্বালাময়ী বাক্য শুনি দেবব্রত মুখে
হইল স্তম্ভিত সবে, লাগিল আঘাত।
একে শ্রান্ত, ক্লিষ্ট সবে রাত্র জাগরণে,
পরিশ্রম হেতু আর, হত্যা অপরাধে
ভয়েতে বিহ্বল পুনঃ। অপহৃত দ্রব্য
লইয়া সকলে ব্যস্ত। মনে জানে তা’রা
বারেক হইলে ধৃত নিশ্চয় মরণ।
যখন মনের এই অবস্থা তা’দের,
দেবব্রত কথা গুলি পরতে পরতে
লাগিল তা‘দের প্রাণে। বুঝিল তাহারা
তাহাদের বাতুলতা, অসারতা আর।

গোপন করিয়া ভাব কহিল বীরেনঃ-
বীরেন্দ্র।  চেষ্টার অসাধ্য কিছু নাহিক জগতে।
ইংরাজের অত্যাচার সহ্য নাহি হয়।
আমাদের কভু তা’রা করে না বিশ্বাস,
আমাদের সর্ব্বপথ করি’ছে সঙ্কোচ।
একবার চেয়ে দেখ,আমাদের দেশ
পূর্ব্বেতে কি ছিল,ইহা কি হ’তেছে এবে।
দেব। সত্য বটে যত্নে আর শ্রমে সিদ্ধি হয়,
চেষ্টার বিষয় হ’লে মানব আয়ত্ব।
এই ক্ষেত্রে ভাব দেখি চেষ্টার বিষয়
কত দূর হয় তব আয়ত্ব অধীন?
নবনী-কোমল এই বঙ্গদেশে বাস
দুর্ব্বল বাঙ্গালী তুমি,দুর্ব্বল বাঙ্গালী
থাকিবে যে চিরকাল নাহিক সন্দেহ।
যদি কভু গিরিময় হয় বঙ্গদেশ,
কোমলা শ্যামলা ধরা কঠিন পাষাণে।
হয় পরিণত,তবে পাষাণ সমান
হইবে তোমার ওই দুর্ব্বল শরীর,
কোমল স্বভাব হবে বীর উপযোগী।
যুদ্ধ করা কভু নহে বাঙ্গালীর কাজ।
জ্ঞান,ধর্ম্ম,বিদ্যাচর্চ্চা,আর দেবসেবা,
পরহিত ব্রত,আর দরিদ্র পালন,

লোকশিক্ষা,কৃষিকার্য্য,শান্তিপূর্ণ কাজ,
শান্তিময় সুখময় গার্হস্থ জীবন
বাঙ্গালীর উপযোগী। রাজসেবা ধর্ম্ম।
 ইংরাজের অত্যাচার দেখি না ত কিছু।
সর্ব্বত্র দেখিতে পাই উদ্দেশ্য মহান।
কিবা সুশাসন কিবা ন্যায়ের বিচার,
দুষ্টের দমন কিবা, শিষ্টের পালন,
দেশের মঙ্গল হেতু কিবা যত্ন তা’র।
দারুণ দুর্ভিক্ষ দিনে তুমি বঙ্গবাসী
যখন পারনা নিজে যোগাতে আহার,
পরের সাহায্য করা দূরের সে কথা,
দয়ালু ইংরাজ জাতি, সমস্ত পৃথিবী
ঘুরিয়া আহার আনি, আমাদের প্রাণ
করেন যতনে রক্ষা। সংক্রামক পীড়া
যবে করে লোক ক্ষয় সারা দেশময়,
প্রাণের মমতা তুচ্ছ করিয়া ইংরাজ,
বদনে আশ্বাস বাণী, লইয়া ঔষধ,
শুশ্রূষা করিয়া সবে প্রতি ঘরে ঘরে,
করেন জীবন রক্ষা। পীড়িতের তরে,
বিনা ব্যয়ে তাহাদের শুশ্রূষার হেতু,
সমস্ত ভারতময় প্রায় প্রতি গ্রামে,
চিকিৎসা-আলয় কত দিয়াছেন করি।

ঘুচাইতে আমাদের মনের আঁধাব
কত শত বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া,
সুশিক্ষার করেছেন অনন্ত ব্যবস্থা।
লৌহবর্ত্ম,ডাকঘর,তারের সংবাদ,
করিছে দেশের কত উন্নতি বিধান।
অসংখ্য সুন্দর বর্ত্ম ভারতে করিয়া,
ঊর্ণনাভ জাল মত,নদ,নদী,খাল,
তরিতে অসংখ্য সেতু করিয়া নির্ম্মাণ
করেছেন এ দেশের অশেষ কল্যাণ।
কৃষির মঙ্গল,আর দেশ রক্ষা হেতু
সলিল প্লাবন হ’তে,কত শত ক্রোশ
দুরন্ত নদীর ধারে, সুদৃঢ়, সুন্দর,
দিয়াছেন কত বাঁধ। কৃষির সৌকার্য্যে
করেছেন কত খাল সংখ্যা নাহি তা’র।
নির্দ্দয় কুসীদ জীবি তা’র হাত হ’তে
দরিদ্র কৃষকে রক্ষা করিতে ইংরাজ,
গ্রামে গ্রামে করেছেন সাহায্য সমিতি।
স্বাস্থ্যের উন্নতি হেতু, বিজ্ঞান সম্মত
অসংখ্য উপায় তাঁ’রা করিছেন সদা।
দেশের মঙ্গল হেতু কত পরিশ্রম,
কতযত্ন,অর্থব্যয়,করি’ছে ইংরাজ।
যে দিকে চাহিয়া দেখ দেশের কল্যাণ,

মঙ্গল উদ্দেশ্য তা’র পাইবে দেখিতে।
স্বদেশী হইয়া তুমি স্বদেশ বাসীর
হরণ করিতে ব্যস্ত ধন মান প্রাণ;
চেয়ে দেখ আর, ওই আমাদের রাজা,
সুন্দর ব্যবস্থা কত, কঠোর কানুন
লোক হিতকর কত ব্যবস্থা সুন্দর,
করেছেন প্রণয়ন লোক রক্ষা হেতু
নিরপেক্ষ ভাবে লোকে করিতে শাসন।
অত্যাচারী নহে কভু দয়ালু ইংরাজ।
 কে বলিল আমাদের করেনা বিশ্বাস
সর্ব্বপথ করিয়াছে সঙ্কোচ ইংরাজ?
দেখ কত উচ্চপদ পেতেছি আমরা
যোগ্যতা যেমন। শিক্ষা,শাসন,বিচার,
চিকিৎসা,পুলিস,পূর্ত্ত বিভাগ সকলে
আমাদের পথ তা’তে দিতেছে খুলিয়া
যোগ্যতার অনুরূপ। কত শত দিকে
কত পথ আমাদের দিতেছে খুলিয়া।
রাজ-প্রতিনিধি সভা গঠিত এখন
স্বদেশীয় মন্ত্রীদলে। আইন কানুন
করিছেন তাঁ’রা, এই দেশের কল্যাণে।
আমাদের অবিশ্বাস করিলে ইংরাজ
কখন দিতনা এত বিশ্বাসের কাজ

কখন হ’তনা উচ্চ পদের প্রসার।
বুঝিয়াছ ভুল,তুমি উদ্দেশ্য রাজার।
 তুলনা করিতে চাহ এখন এদেশ
পূর্ব্বের সহিত? তুলনা হবেনা তা’র।
পূর্ব্বে ছিল প্রতিগ্রাম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র,
আপন সীমায় বদ্ধ আপনি স্বাধীন।
ছিলনা সহানুভুতি,কিম্বা পরিচয়,
নিকট গ্রামের সাথে,কিবা কাজ দূরে?
সভ্যতা,বাণিজ্য,শিল্প,শিক্ষা,উদারতা,
মেশামিশি ভালবাসা ছিলনা সে কালে।
ধন,মান,প্রাণ,কা’র এত নিরাপদ
ছিলনা তখন দেশে। চেয়ে দেখ আজ,
সমস্ত ভারত যেন এক পরিবার,
শান্তিপূর্ণ,নিরাপদ,কিবা সাম্যভাব,
উন্নতির কতদূরে গিয়াছে এখন।
 দয়ালু ইংরাজ রাজ। দেশের মঙ্গল,
প্রজার কল্যাণ, সদা উদ্দেশ্য তাঁহার।
হেন রাজ প্রতিকূলে বিদ্রোহের ভাব
যে জন পোষণ করে হৃদয়ে তাহার,
সেই লোক নহে কভু স্বদেশ হিতৈষী;
স্বদেশের মহাশত্রু, শত্রু সে নিজের।
বীরেন্দ্র।  করিয়াছে নষ্ট কিন্তু শিল্প আমাদের,

বস্ত্র-শিল্প বিশেষতঃ ইংরাজ তোমার।
দেব।  কোন শিল্প নষ্ট নাহি করেছে ইংরাজ,
উৎসাহ দিতেছে তা’রা আছে যাহা কিছু।
এ দেশের যাবতীয় শিল্পের উন্নতি,
এদেশবাসীর শুধু উৎসাহ সাপেক্ষ।
আমরা সকলে দায়ী ইহাদের তরে।
বস্ত্র-শিল্প নষ্ট নাহি করেছে ইংরাজ।
সূক্ষ্ম-বস্ত্র-শিল্প নষ্ট আমাদের দোষে,
উৎসাহ অভাবে,আর অভাবে ক্রেতার।
উৎসাহ স্বদেশ বাসী যদি দেয় তা’রে,
দেখিবে হইবে তা’র অশেষ উন্নতি।
অন্য বস্ত্র-শিল্প যাহা হইতেছে লোপ,
হইতেছে শুধু তাহা বিজ্ঞান অভাবে,
অর্থের অভাবে আর। হস্ত-জাত বস্ত্র,
প্রতিযোগীতায় কভু পারে না যুঝিতে
যন্ত্র-জাত বস্ত্র সাথে, সুলভে উৎপন্ন।
অর্থপ্রসূ অর্থ ইংরাজের। আমাদের
বিপরীত তা’র। যত যৌথ কারবারে,
শিল্পের উন্নতি হেতু দিতেছে ইংরাজ
তাহার সমস্ত ধন,দিতেছে উৎসাহ।
আমাদের দেশ ধন করি’ছে সঞ্চয়।
আমরা দেখিনা চাহি কোন শিল্প প্রতি,

শিল্পীর উৎসাহ কেহ দিই না কখন।
অর্থনীতি পড় যদি বুঝিবে সকলি।
বীরেন্দ্র।  দেশের সমস্ত ধন করিছে শোষণ
তোমার ইংরাজ রাজা। যা কিছু ফসল,
উৎপন্ন হ’তেছে দেশে, যেতেছে লইয়া।
খনন করিয়া এই ভারত পঞ্জর,
বহুমূল্য ধাতু হ’তে কয়লা,প্রস্তর,
সমস্ত যেতেছে লয়ে যা পায় যেখানে।
দেব।  রাজস্ব রাজার প্রাপ্য। ন্যায্য প্রাপ্য যাহা
ল’তেছে ইংরাজ তাহা। তাহার অধিক
কিছুই লয় না রাজা,জানিও নিশ্চয়।
রবি যথা এক গুণ সমুদ্রের বারি
শোষণ করিয়া দেয় বহু গুণ তা’র,
ইংরাজ দিতেছে পুনঃ ফিরায়ে এ দেশে,
বহুগুণে বেশী তা’র গৃহিত রাজস্ব,
দেশরক্ষা হেতু,আর দেশের মঙ্গলে,
দেশের উন্নতি,আর সুখ স্বাস্থ্য তরে,
শিক্ষা,শিল্প,বাণিজ্যাদি তাহার কল্যাণে,
আমাদের অবস্থার করিতে উন্নতি।
বিশাল বিরাট এই ভারত সাম্রাজ্য।
ভাব দেখি কত অর্থ হয় প্রয়োজন,
রাখিতে তা’ সুরক্ষিত করিতে শাসন?

যে দেশে আছিল ক্ষুদ্র পর্ণের কুটীর
অধিকাংশ মানবের আবাস ভবন,
যে দেশে আছিল “কড়ি”, ক্ষুদ্র লৌহখণ্ড
প্রচলিত মুদ্রা, আর যে দেশে হইত
‘বিনিময়’ প্রথা দ্বারা ব্যবসা বাণিজ্য,
যে দেশে আছিল বিদ্যা অল্পজন মাঝে,
অধিকাংশ লোক ছিল জ্ঞান,অসভ্য,
ভাব দেখি কি হ’য়েছে সে দেশে এখন?
ইংরাজ দেশের ধন করিলে শোষণ
হইত কি দেশে এত উন্নতি,মঙ্গল?
 ইংরাজ লইত যদি সমস্ত ফসল,
অনশনে তাহা হ’লে মরিত সকলে।
এই দেড় শত বর্ষ ইংরাজ রাজত্বে
জান তুমি জন সংখ্যা বাড়িয়াছে কত?
উৎপন্ন ফসল তা’র অনুপাত কত?
আহার্য্য ফসল আর অপর ফসল—
পাট,শণ,তুলা আদি, শিল্প দ্রব্য তরে,
কত পরিমাণে হয় উৎপন্ন এ দেশে?
প্রার্থনা আমার, ইহা জানি সবিশেষ
আনিও এ অভিযোগ রাজ প্রতিকূলে।
 ভূগর্ভে নিহিত ধাতু এই ভারতের
নিহিত থাকিলে হ’ত কিবা ফলোদয়?

সহস্র সহস্র বর্ষ ছিল যে নিহিত,
দেশবাসী খনি কেন করেনি খনন?
খনন করিয়া খনি কত উপকার,
ভাব দেখি এই দেশে হতেছে এখন?
 বাণিজ্যে দেশের হয় প্রকৃত উন্নতি।
যথেষ্ট এদেশে যাহা,যায় অন্য দেশে,
অন্য দেশ হ’তে আসে নাহি যাহা হেথা।
“অবাধ বাণিজ্য” ফলে ভিন্ন দেশে দেখ
হইয়াছে,হইতেছে,উন্নতি অশেষ।
চাহ তুমি রোধিবারে দেশের বাণিজ্য?
 কি বলিতে চাহ আর,স্বদেশ-হিতৈষী,
ইংরাজের প্রতিকূলে?
 সকলে নির্ব্বাক!
ক্ষণেক ভাবিয়া পরে কহিল বীরেন্দ্র।
বীরেন্দ্র।  স্বর্গাদপি গরিয়সী স্বদেশ আমার!
অনন্ত সৌন্দর্য্যময়ী,রত্ন প্রসবিনী,
জ্ঞান-ধর্ম্ম কিরীটিনী,বীরের জননা,
পৃথিবীর সারভূতা স্বদেশ আমার!
সুদূর নীলিমা হ’তে আসি রত্নাকর,
উত্তাল তরঙ্গ তুলি ফেণ-পুঞ্জময়,
তিনপার্শ্ব বেড়ি যা’র সরোষে গর্জ্জিয়া,
যতনে করেন রক্ষা সকল সময়।

তুষার-কিরীট পরি অভ্রভেদী শির,
দুর্লঙ্ঘ্য পর্বত শ্রেণী চির হিমময়,
নিযুক্ত বিধাতাদেশে যাঁহার রক্ষায়।
জ্ঞানের,ধর্ম্মের,আর উষার কিরণ,
যেখানে প্রথম হ’ল জগতে উদয়;
যে দেশ হইতে তাহা সমস্ত পথিবী
করিল সভ্যতা পূর্ণ, আর আলোময়।
যেখানে অসংখ্য নদী, নির্ঝর, তড়াগ,
উর্ব্বর করিছে ভূমি সকল সময়।
যেখানে অসংখ্য বৃক্ষ, নানাজাতি ফলে,
ক্ষুধায় সকল জীবে আহার যোগায়।
বার মাস যেথা বাস করে ষড় ঋতু,
নিদাঘে যেখানে বয় মলয়ের বায়।
ত্রিদিব হইতে নামি সুরতরঙ্গিণী
করেছে যাহারে ধন্য মহাপুণ্যময়।
তেয়াগিয়া দেহ যা’র কূলে পিতৃগণ
অনন্তের কোলে আজ সুখেতে ঘুমায়।
যাঁহাদের দেহ রেণু প্রতি ধূলি কণা
এদেশের করিয়াছে মহা পুণ্যময়।
শ্যামল শস্যেতে ভরা যাহার প্রান্তর,
অনন্ত ঐশ্বর্য্যে ভরা যাহার অন্তর,
উৎসর্গ করেছি প্রাণ সেবায় তাঁহার

তাঁহার মঙ্গল ভিন্ন নাহি চিন্তা আর।
দেব।  স্বদেশীর মত কথা বলিয়াছ ঠিক।
কিন্তু ভাই। কিসে হয় দেশের মঙ্গল,
প্রকৃত উন্নতি দেশে, কয় জনে ভাবে,
কয় জনে কবে তাহা স্বজাতির তরে?
বীরেন্দ্র।  কি করিলে হবে বল দেশের মঙ্গল,
দেশের উন্নতি,তাহা করিব সকলে।
দেব। উত্তম সঙ্কল্প ইহা,বলিব সকলি।
কিন্তু ভাই! রেখো মনে,মহাবলবান্
দয়ালু ইংরাজ জাতি। ন্যায়ে প্রতিষ্ঠিত
বিশাল ইংরাজ রাজ্য। সুশাসন তা’র
মহানীতি,সমব্যথা তা'র মূল মন্ত্র।
সর্ব শ্রেষ্ঠ রাজ্য ইহা জগৎ ভিতরে।
জাতিগত,ধর্ম্মগত প্রভেদ যে দেশে,
সংখ্যার অতীত আছে ভিন্ন সম্প্রদায়ে,
রাজনীতি-ক্ষেত্রে কভু পারেনা হইতে
সমগ্র ভারতে এক সম্পূর্ণ একতা।
অন্য সম্প্রদায় কভু দিবে না তোমারে
তুমি ও দিবেনা কভু অন্য সম্প্রদায়ে,
হইতে দেশের রাজা। তা’র ফলে হবে
বিদ্বেষ, সমরানল চির প্রজ্জ্বলিত
সমস্ত ভারতময়। আসিবে আবার

কোন শক্তিমান জাতি, হ’বে রাজ্যেশ্বর।
সাধারণ-মিত্র এই দেশের ইংরাজ,
ইংরাজ থাকিলে রাজা হবেনা বিরোধ।
বিরোধ অভাবে দেশ হবে শান্তিময়,
কৃষি শিল্প বাণিজ্যের হইবে উন্নতি,
দারিদ্র্য ঘুচিবে, দেশে হইবে মঙ্গল।
পাশ্চাত্য শিক্ষার অতি অভাব এ দেশে;
পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরু ইংরাজ এখন।
ইংরাজ থাকিলে হ’বে দেশের মঙ্গল,
শিক্ষার উন্নতি, আর ভাষার একতা।
ইংরাজের অমঙ্গলে হইবে নিশ্চয়
ভারতের অমঙ্গল, অশেষ বিপদ।
শুধু বা ভারত কেন, সমস্ত পৃথিবী
ভুঞ্জিবে তাহার এই বিপদের ফল।
গুপ্ত-হত্যা, ষড়যন্ত্র তা’র প্রতিকূলে
করিলে হইবে দেশে ঘোর সর্বনাশ।
ইংরাজ বিশাল তরু, যার তলদেশে,
শীতল ছায়ায় যা’র পেয়েছ আশ্রয়,
পড়ে যদি সেই তরু, কে জানে কোথায়,
জগতের রাজনীতি-ঝঞ্ঝাবাত আসি,
উড়ায়ে লইয়া যাবে মরিব সকলে।
সকলে মিলিয়া দেখ মিত্রভাবে তা’রে।

ধন, প্রাণ দিয়া তা’র কর সহায়তা।
তাহার বিপদ,ভাব বিপদ দেশের,
আমাদের ব্যক্তিগত বিপদ সবার।
রাজভক্ত,অনুরক্ত,হইলে আমরা
নিশ্চয় প্রীতির নেত্রে দেখিবে ইংরাজ,
নিশ্চয় বাসিবে ভাল এদেশ বাসীরে,
লইবে অধিক যত্ন দেশের মঙ্গলে।
বীরেন্দ্র।  করিব তাহাই।
দেব।    একা?
বীরেন্দ্র।    সকলে মিলিয়া।
দেব।  কি আছে প্রমাণ বল তোমার কথার?
বীরেন্দ্র।  আমাদের সাথে গুপ্ত-সমিতির স্থানে
দয়া করে চল, ওই অদুর পল্লীতে।
দেবব্রত চিন্তা করি, মুহূর্ত্ত তখন,
বলিলেন ‘চল ত্বরা’। উঠিল সকলে।
যাইতে যাইতে পথে প্রাণের আবেগে
কত কথা দেবব্রত কহিতে লাগিল।
“সকল বিষয়ে এবে পরমুখাপেক্ষী
হ’তেছি আমরা। নাহিক কাহার কোন
যতন উদ্যোগ,কিসে প্রকৃত উন্নতি,
করিব আমরা। দেখ সমাজের প্রতি,
বিষ্ফোটক আজ তা’র সারা অঙ্গময়।

উন্নতি বিধান করা, লোক-হিতকর
নিয়মের অনুষ্ঠান সমাজের কাজ,
কিবা কাজ করিতেছে সমাজ এখন?
সমাজের অত্যাচারে, আজ পরস্পরে
বিচ্ছিন্ন হ’তেছি কত দেখ চারিধারে,
অশান্তি, দারিদ্র্য, দুঃখ বাড়িছে কেবল
স্বেচ্ছাচারী হইতেছি আমারা সকলে।
 চেয়ে দেখ ওই হিন্দু-সংসারের প্রতি।
একান্নবর্ত্তিতা স্থানে স্বতন্ত্রতা, আর
সুখ শান্তি স্থানে, কিবা কলহ বিবাদ।
ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই যেখানে সেখানে।
ত্যজিয়া সামান্য স্বার্থ নিজ সহোদরে
করিতে পারনা যবে তুমি আপনার,
কেমনে করিবে ভাই স্বার্থ বলিদান
পরহিত-ব্রতে তুমি? স্বায়ত্ব-শাসন,
সুন্দর প্রমাণ তা’র দেখ দেশময়!
 বারেক চাহিয়া দেখ স্বদেশের প্রতি,
কি অবস্থা করিতেছি আমরা তাহার।
ছাড়িয়া বাণিজ্য,শিল্প,কৃষি আদি কাজ,
ভেবে দেখ কোন্ পথে চলে’ছি সকলে।
উন্নত শিক্ষার দেখ কিবা পরিণাম!
উন্নত শিক্ষিত যুবা দেশের সকলে,

“ব্যবহারশাস্ত্র” শুধু করি অধ্যয়ন,
রাজদ্বারে করিতেছে কিবা গণ্ডগোল,
করি’ছে দেশের আর কিবা সর্ব্বনাশ!
 চেয়ে দেখ একবার স্বজাতির প্রতি।
অর্দ্ধাশন,অনশন,ব্যাধির জ্বালায়,
দারুণ জীবন-রণে,ঘোর দুশ্চিন্তায়,
মুষ্টিমেয় অন্ন তরে ঘোর পরিশ্রমে,
স্বল্পায়ু হতে’ছি সবে আমরা কেমন।
অকাল মৃত্যুর আর ভীষণ প্রকোপে
প্রত্যহ আমরা কত যেতেছি কমিয়া।
কি ফল হইবে বল রাজ-নীতি লয়ে
তোমার স্বদেশবাসী যদি লোপ পায়?
যুড়ি দুই কর এলে ইংরাজ সমীপে
চাহ ভিক্ষা সবে মিলি,“ওহে দয়াময়!
শিখাও ভারতে আজ তোমার বিজ্ঞান,
কেমনে হইবে স্বাস্থ্য,বংশ রক্ষা আর,
দীর্ঘায়ু হইব সবে,হ’ব বলবান্,
জীবন-সংগ্রামে সবে হইব বিজয়ী
শিখাও হে দয়াময়! সারা দেশময়।”
 বারেক চাহিয়া দেখ স্বদেশের রুচি।
“চাকুরী” সকলে চাহি,স্বল্প শ্রমকর,
না পাইলে তাহা,গালি দিই ইংরাজেরে,

সকলে “স্বদেশ” হই। দেখিনা চাহিয়া,
আমাদের মাঠে ঘাটে,অরণ্যে,সলিলে,
পড়িয়া রয়েছে কত অগণিত ধন।
কৃষির উন্নতি কিসে ভাবিনা কখন।
কি করিলে হয় মাঠে ফসল প্রচুর,
অগণিত ফল বৃক্ষে, জলাশয়ে আর
জনমে অসংখ্য মৎস্য, সুলভে আহার
মিলে সবাকার, তাহা ভাবিনা কখন।
কেমনে বাণিজ্য,আর শিল্পের উন্নতি,
কেমনে করিতে হয় যৌথ কারবার,
ভাবিনা কখন তাহা। কাহার উপর
কা’র নাহি সমব্যথা,নাহিক বিশ্বাস।
বিপদে কাহারে কভু করিনা সাহায্য।
নিধন আত্মীয়,আর দীন প্রতিবাসী,
চাহিনা তা’দের প্রতি। করিনা তাদের
সুখেতে আনন্দ,আর দুঃখে সমব্যথা।
এত কাজ স্বত্তে তবু রাজনীতি লয়ে
সকলে আমরা মত্ত,করি গোলমাল।
কবে যে ফুটিবে হায়! চক্ষু আমাদের,
ঈশ্বর জানেন তাহা।
 সকলে তখন
উপনীত হ’ল গুপ্ত-সমিতির স্থানে।

সেই নিশাশেষে, সভা করিয়া আহবান
এই স্থির হ’ল,তা’রা সেই দিন হ’তে
সব ষড়যন্ত্র,আর পাপ-অনুষ্ঠান,
ভণ্ড দেশহিত-ব্রত করি বিসর্জ্জন,
যাহাতে দেশের হয় প্রকৃত মঙ্গল,
সমাজের হিত,আর কৃষির উন্নতি,
করিবে তাহাই সবে,হবে রাজভক্ত।
 দেবব্রত পদধূলি,পরিচয় আর,
লইয়া সকলে তাঁ’রে করিল বিদায়।
 ঊষার রক্তিম রাগ ফুটিল তখন
পূরব গগনে। একে একে তারাগুলি,
মিলাইয়া গেল ধীরে নীলিমার গায়।
তিমির হইল হ্রাস! প্রভাত সমীর
বহিল দুলায়ে ধীরে পত্র লতিকায়।
মনের আনন্দে কত বৈতালিক গান
বিহগ গাহিল উচ্চে পাদপ শাখায়।