ইন্দুমতী/পল্লী চিত্র

দ্বিতীয় সর্গ।
পল্লী চিত্র।

চণ্ডীপুর নাম তা’র গ্রামটী সুন্দর,
বাস করে তথা প্রায় তিনশত ঘর
হিন্দু মুসলমান। পূর্ব্বে ছিল সুখ,
ছিল সবে এক প্রাণ,ছিল সমব্যথা।
শরীরের কোন স্থানে লাগিলে আঘাত,
সমস্ত শরীর মত পাইত বেদনা
সারা চণ্ডীপুর গ্রাম একের দুঃখেতে
সেই দিন কিন্তু হায়! গিয়াছে এখন।
আজ সেথা পর-নিন্দা,হিংসা,পরচর্চ্চা,
দলাদলি,দ্বেষ,আর কলহ,শক্রতা,
আর বৃথা অভিযোগ হ’তেছে সৃজন।
 আপোষে মিটেনা আর কলহ বিরোধ।
পঞ্চায়ৎ প্রথা কেহ গ্রাহ্য নাহি করে,
উকীল, মোক্তার এবে মন্ত্রী সকলের,
কথায় কথায় লোক ছুটে রাজদ্বারে।
 গ্রামের যুবক সব উন্নত এখন!

কম বেশী নাগরিক প্রথায় সজ্জিত,
হইয়াছে নাগরিক ভাবেতে বিভোর।
সন্ধ্যায় বাজে না খোল, হরিনাম গান
হয় না সেখানে আর। ভাগবৎ পাঠ,
সে সব গিয়াছে উঠে, উপন্যাস আদি
ঘরে ঘরে হইতেছে অধীত এখন।
কাহার লাগে না ভাল নীরস পল্লীর,
বিচিত্রতা শূন্য, শান্ত, নির্জ্জন জীবন।
আর কুল লক্ষ্মীগণ? পুরুষ যেমন
দিতেছে তা’দের শিক্ষা শিখি’ছে তেমন।
 আভূমি প্রণাম কেহ করে না ব্রাহ্মণে।
প্রিয় গ্রাম্য-সম্বোধন,শিষ্টাচার আদি,
সে সকল অতি শীঘ্র যেতেছে উঠিয়া,
আপনারে বড় ভাবে সকলে এখন।
 গ্রামস্থ সকলে প্রায় কৃষি উপজীবী,
অবস্থা তা’দের ভাল সচ্ছল সংসার।
শ্রীধর ঠাকুর যাঁ’র গৃহে দেবব্রত,
পুত্র নির্ব্বিশেষে আজ পেয়েছে আশ্রয়,
তাঁহার অবস্থা ছিল পূর্ব্বেতে উন্নত।
বিস্তর নিষ্কর ভূমি,বহু গোলা ধান,
গোশালা গাভীতে পূর্ণ,মীনপূর্ণ সরঃ,
অর্থপ্রসূ নানাবিধ ফলের উদ্যান,

আর ছিল বহু বন্ধু সম্পদ সম্মান।
তাঁহার সুন্দর গৃহ প্রশস্ত দালান,
শরতে হাসিত কত দেবী আগমনে,
মুখরিত হ’ত সদা অতিথি কুটুম্বে।
 সে গ্রামের জমিদার শঙ্কর বিশ্বাস,
সুচতুর,অর্থশালী,ক্ষমতা সম্পন্ন,
নির্দ্দয় প্রকৃতি অতি,থাকিত সেথায়।
ব্রাহ্মণের ব্রহ্মোত্তর করিতে হরণ,
সর্ব্বস্ব করিয়া পণ শ্রীধরের সাথে
যুঝিয়া করিল শেষে সর্ব্বনাশ তাঁ’র।
 শ্রীধরের তিন কন্যা আর দুই পুত্র।
উপরি উপরি তিন কন্যার বিবাহে,
ভদ্রাসন খানি তাঁ’র পড়িল বন্ধক
শঙ্করের হাতে। ক্রমে ক্রমে ঋণ ভারে,
শোচনীয় দশা শেষে হইল তাঁহার।
সহাস্য আনন তবু শ্রীধর ঠাকুর,
অনন্ত বিশ্বাস তাঁ’র ঈশ্বর দয়ায়।
ভাবেন ফুৎকারে যাবে বিপদ উড়িয়া,
কিশোর সন্তান দুটী হইলে মানুষ।
 আশ্বিনের শেষ ভাগে পূতি-বাষ্পজ্বরে,
শ্রীধর লইল শয্যা গৃহিণী সহিত,
পুত্র কন্যা সহ আর। দেবব্রত শুধু

রহিলেন নিরাময় শুশ্রূষার হেতু।
একদা প্রভাতে আসি শ্রীধরের গৃহে
দলবল সহ সেই শঙ্কর বিশ্বাস,
বলিল ডাকিয়া “শুন শ্রীধর ঠাকুর!
বিক্রীত তোমার গৃহ ঋণ দায়ে এবে,
আসিয়াছি অধিকার লইতে ইহার।
গৃহ ছাড়ি চলি যাও তোমরা সত্বরে,
নচেৎ তাড়াইয়া দিব বলেতে আমার।”
 জ্বরে অচেতন শুয়ে শ্রীধর ঠাকুর
কে দিবে উত্তর তা’র? সকলে নীরব।
দেবব্রত ধরি তবে শঙ্করের হাত,
কহিল বিনয়ে কত দিতে অবসর,
যাবৎ ঠাকুর নাহি হয়েন আরোগ্য।
শুনিল না কথা তাঁ’র শঙ্কর বিশ্বাস।
বাহির করিয়া দিল সব পুরজনে
এক বস্ত্র পরিহিত, পীড়ায় কাতর।
লুটিয়া লইল, গৃহে যাহা কিছু ছিল।
করিল ঘোষণা, “যদি কেহ দেয় এই
ব্রাহ্মণে আশ্রয়, আমি করিব তাহার
সর্ব্বনাশ। যেই কথা সেই কাজ, শুন!
অন্য কেহ নহি, আমি শঙ্কর বিশ্বাস।”
 সমবেত জন সবে শুনি এই কথা,

অবাক হইয়া সেথা রহিল দাড়ায়ে।
 এ হেন্ সময়ে তথা পাট ক্রয় হেতু
একটী মুসলমান অপর গ্রামের,
গোশকট সঙ্গে লয়ে আর কর্ম্মচারী
যাইতে ছিলেন তিনি সেই পথ দিয়া।
জনতা দেখিয়া তিনি দাঁড়াইয়া দূরে
দেখিলেন নিজ চক্ষে এই নির্য্যাতন।
কাঁপিয়া উঠিল ক্রোধে তাঁ’র কলেবর।
রুদ্যমান পরিবারে ডাকিয়া তখন
বলিলেন তার স্বরে হৃদয় উচ্ছ্বাসে,
“এস বাপ্ সবে,আর,জননী আমার,
আমার শকটে উঠ। সবারে আশ্রয়
দিব গৃহে আপনার। মানুষে কি পারে,
দেখিতে আপন চক্ষে হেন অত্যাচার?
 “শুন গো বিশ্বাস বাবু! করি সাবধান;
যদি তুমি বাধা দেও ইহাতে আমাকে,
আল্লার কসম,আমি প্রহরের মধ্যে
লুটিব তোমার গৃহ মারিব তোমায়।
লোকনাথপুরে ঘর, নাম ইব্রাহিম,
সর্ব্বনাশ কর মোর করি নিমন্ত্রণ।”
 এই তেজদৃপ্ত বাক্য শুনিয়া সকলে,
সমবেত প্রতিবাসী উঠিল উল্লাসে,

“জয় জয়” শব্দে ঘন করিয়া গর্জ্জন।
আরোহণ উপযোগী করিয়া শকট,
তৃণ আর শয্যা দিয়া,আর আবরণে,
মুহূর্ত্তে সকলে মিলি,দুস্থ পরিবারে
উঠাইয়া দিল তা’তে। সাথে সাথে তা’র
চলিলেন দেবব্রত। চলিল শকট
সেই গ্রাম্য পথ দিয়া।

একটী ঝঙ্কারে

জাগিল দেবত্ব ভাব হৃদয়ে সবার,
দেখি জমিদার, বিনা বাক্য ব্যয়ে আর,
সদলে চলিয়া গেল গণিয়া প্রমাদ।
 কতক্ষণে গেল যান লোকনাথপুরে।
ইব্রাহিম দ্রুত গিয়া গ্রামে আপনার,
নিজের গৃহের কাছে গোলাবাড়ী খানি—
পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন,মার্জ্জিত সুন্দর—
বিপন্ন গৃহস্থ হেতু করিল নির্দ্দেশ।
যথাযোগ্য সমাদরে নামায়ে সবারে,
ধর্ম্ম পিতা, ধর্ম্ম মাতা, ধর্ম্ম ভাই বোন্
সম্বন্ধ করিয়া স্থির বলিল তাঁ’দের,
করিতে বসতি সেথা যত দিন পুনঃ
তাঁহাদের ভদ্রাসন না হয় উদ্ধার।
ভরণ পোষণ আর সমুদয় ভার,

তাঁহাদের লইলেন ইব্রাহিম নিজে।
 হায় ইব্রাহিম! নর-কুল দেব তুমি!
তোমার মতন যদি হইত অনেক,
তাহ’লে হইত ইহা সোনার সংসার।