ইন্দুমতী/পরীক্ষা
অষ্টম সর্গ।
পরীক্ষা।
প্রবাস করিয়া শেষ ভাগিরথী নীরে,
আবার আসিল তা’রা রাজধানী ফিরে।
রাধিকা নবীন গেল দেবব্রতে ল’য়ে
আপন আলয়ে, অতি পুলকিত হ’য়ে।
সম্পূর্ণ আরোগ্য এবে হয়েছে নবীন,
সংসারে তাহার বড় আনন্দের দিন।
করেন ত্রিসন্ধ্যা আর ব্রাহ্মণের কাজ,
সাত্বিক ভাবেতে পূর্ণ হয়েছেন আজ
বুঝেছেন এতদিনে, ধর্ম্মে কর্ম্মে মতি
থাকিলে লোকের হয় অশেষ উন্নতি।
চেয়ে দেখ একবার রাধিকার প্রতি,
মানবী রাধিকা এবে দেবী মূর্ত্তিমতী।
পতি-ধ্যান, পতি-জ্ঞান, পতি আরাধনা,
অন্য কিছু নাহি তা’র পতি চিন্তা বিনা।
সরমে নরম, সদা পূর্ণ কোমলতা,
শান্তি পূর্ণ মন, সদা ধর্ম্মে অনুরতা।
শ্মশান-বৈরাগ্য সদা জাগে মনে তা’র,
বুঝিয়াছে ধর্ম্ম বিনা সকলি অসার।
কখন কোথায় মন কোন্ পথে ধায়,
কোন্ কাজে কিবা ফল কে জানেরে তায়?
দেবব্রত মনে হ’ল আনন্দ অপার,
সার্থক হইল দেখি কাজ আপনার।
জানিতেন তিনি ইহা, মানবের মন,
একস্থানে স্থির ভাবে থাকেনা কখন।
পাপের, পুণ্যের শক্তি সদা টানে তায়,
জড়-জগতের মধ্য-আকর্ষণ প্রায়।
পড়িলে পাপের টানে অধোগতি তা’র,
ঊর্দ্ধগতি হয় পুণ্য আকর্ষণে আর।
পুণ্যের পরিধি মাঝে রাধিকা,নবীনে,
তাই তিনি আনিলেন অশেষ যতনে।
পূর্ণ আজ দুইমাস সেই দিন হ’তে
রাধিকার অভিসার গভীর নিশিথে।
বলে ছিল মনে যদি নাহি হয় বল,
দুইমাস পরে রাধা সেবিবে গরল।
জানিতে বাসনা হ’ল কিবা ফল,
সেবিবে গরাল কিম্বা রাখিবে জীবন।
এত দিন সুশিক্ষার হ’ল কিবা ফল,
চিত্তের সংযম,কত চরিত্রের বল।
লইতে এখন তাই পরীক্ষা রাধার,
দেবব্রত চলিলেন কক্ষেতে তাহার।
তখন দ্বিযামা নিশা,ঘুমায় নবীন,
ঘুমায় অপর সবে সাড়া শব্দ হীন।
দেবব্রত ধীরে ধীরে রাধিকা উদ্দেশে,
আসিলেন রাধিকার কক্ষদ্বার দেশে।
মুক্ত বাতায়ন পথে দেখেন চাহিয়া,
রামায়ণ লয়ে রাধা পড়িছে বসিয়া।
অনন্ত সৌন্দর্য্য দিয়া যেন চিত্রকর,
আঁকিয়া রেখেছে ছবি ঘরের ভিতর।
দ্বারদেশে ধীরে ধীরে করাঘাত করি,
ডাকিলেন দেবব্রত রাধিকা সুন্দরী।
চমকি উঠিয়া রাধা খুলিলেন দ্বার,
দেবব্রতে দেখে হ’ল বিস্ময় তাহার।
গোপন করিয়া ভাব,অতি সমাদরে
লইয়া গেলেন তাঁ’রে কক্ষের ভিতরে।
বসিতে আসন দিয়া বসিলেন কাছে,
ইচ্ছা তা’র জানিবার কিবা কথা আছে।
শীলতার ভয়ে শুধু সরল নয়নে
চাহিয়া রহিল রাধা দেবব্রত পানে।
দেবব্রত বলিলেন কাতরে রাধায়,
এসেছেন এবে তিনি লইতে বিদায়।
প্রভাত হইলে নিশা যাবেন চলিয়া,
নিজালয়ে আগে,পরে সংসার ছাড়িয়া।
সংসারে তাঁহার আর নাহি কোন সাধ,
মরুময় প্রাণে তাঁ’র শুধুই বিষাদ।
অতৃপ্ত রহিল যত হৃদয়ের আশা,
মিটিল না তাঁ’র কোন প্রাণের পিয়াসা।
করিবেন করে আর লইয়া সংসার
কে আর করিবে তাঁ’রে সোহাগ,আদর?
দুঃখীর সমান তাঁ’র নাহি হেথা স্থান,
কি ফল রাখিয়া আর এ ছার পরাণ।
এইরূপে কতকথা বিলাপ করিয়া,
বলিলেন নেত্রজল বসনে মুছিয়া।
দুইমাস পূর্ব্বে কেন হ’লনা এমন,
তা’ হলে সকল সাধ মিটিত তখন।
কে জানে কাহার শাপে কিবা হয় পাপ,
কোন্ পাপে কিবা হয় কা’র মনস্তাপ।
কেন আজ তাঁ’র মনে লালসা অনল,
সহসা উঠিল জ্বলি হইয়া প্রবল?
অনুমান করিলেন,রাধার হৃদয়
নিশ্চয় হয়েছে এবে সুখ শান্তিময়।
যাহার কথায় শান্তি হইল রাধার,
অশান্তি হইল কিনা হৃদয়ে তাহার?
শুনিতে শুনিতে রাধা বিহবল হইয়া,
দেবব্রত পদতলে পড়ি আছাড়িয়া,
বলিল তাঁহারে অতি করুণ বচনে
“ক্ষমাকর দয়াময়! অনুতপ্ত জনে!
তোমারে চিনেছি আমি তুমি মহাশয়,
আর কেন ছল মোরে বৃথা ছলনায়?
তুমি জিতেন্দ্রিয় দেব! কৃপায় তোমার,
অনন্ত নরক হ’তে পেয়েছি উদ্ধার।
চিনেছি এখন আমি স্বামী মহাধন,
সুখ শান্তি পাইয়াছি তোমার কারণ।
চিত্তের সংযম মম হয়েছে এখন,
গরল সেবনে আর নাহি প্রয়োজন।
তুমি পিতা, তুমি মাতা, তুমি গুরু আর,
তোমার কৃপায় জ্ঞান হয়েছে আমার।”
কাঁদিতে লাগিল রাধা আবেগের ভরে,
স্মিতমুখে দেবব্রত বলিল তাহারে।
“এক কাজ আছে বাকী বলি তাহা শুন,
প্রায়শ্চিত্তে অনুতাপ হইবে নির্ব্বাণ।
অতীত সকল কথা পতির নিকটে,
বলিবারে চাহ তুমি সব অকপটে।
বলিলে সকল কথা যাবে অনুতাপ,
সংসারে হইবে তুমি সম্পূর্ণ নিষ্পাপ।”