নবম সর্গ।
মিলন।

রাধিকা নবীন সনে ভারতের নানা স্থানে
দেবব্রত করিলেন কত পর্য্যটন,
দেখিলেন তীর্থ কত রহিয়াছে শত শত
হেরিলে পবিত্র হয় মানবের মন।
কত যুগে কত ঋষি যেখানে ধ্যানেতে বসি
সাধনা করিল মন্ত্র সিদ্ধি আপনার,
যেখানে বসিয়া কত ব্যাস আদি মুনি যত
ভুবনে করিল ধর্ম্ম জ্ঞানের প্রচার।
কত শত বর্ষ চলে গিয়াছে অনন্ত কোলে
কত রাজ্য রাজধানী হইয়াছে লয়,
রয়েছে সেস্থান গুলি কীর্ত্তির পতাকা তুলি
ঘোষণা করিছে বিশ্বে সাধনার জয়।
নদনদী অগণন পর্ব্বত কানন বন
শ্যামল তৃণেতে ভরা বিস্তৃত প্রান্তর,
কত ফল কত ফুল  সুন্দর বিহগ কুল
দেখিয়া তা’দের সুখে ভরিল অন্তর।

কভু উঠি গিরি শিরে চাহিয়া দেখেন দূরে,
শ্যামল ধরণী খানি যেন চিত্রপট,
উন্নত পাদপ চয় আতপত্র মনে হয়,
দেখায় রজত সূত্র নদ নদীতট!
অনন্ত প্রান্তর শেষে আকাশ নামিয়া এসে
মিশিয়া গিয়াছে যেন ধরণীর গায়,
আকাশ ধরণী যেন এক দেহ এক মন,
অনন্ত প্রেমেতে বাঁধা রয়েছে উভয়।
অধোদেশে ধরাতল তৃণ শস্যে সুশ্যামল,
ঊর্দ্ধদেশে নীল নভঃ অনন্ত অপার,
উঠিয়া পর্ব্বত শিরে দেখিতে দেখিতে ধীরে
অনন্তে মিশিয়া প্রাণ হইত উদার।
কি মহা গৌরবময় প্রভাতে অরুণোদয়,
দিনান্তে আবার যবে অস্ত হয় তা’র,
চেতনা প্রভাতে আসে চলে যায় দিবাশেষে
ঘোর অন্ধকারে ডুবে সমস্ত সংসার।
কত দেখে কত দেশে ভ্রমণ করিয়া শেষে
আসিলেন হরিদ্বারে তাঁহারা সকলে,
মহিমা মণ্ডিত স্থান দেখিলে জুড়ায় প্রাণ,
গোমুখী হইতে গঙ্গা আসে কলকলে।
সুনীল শীতল জল বহিতেছে অবিরল,
অসংখ্য উপল খণ্ড, তা’র মধ্য দিয়া,

যেন তীব্র তিরস্কারে সরায়ে তা’দের দূরে
সাগর উদ্দেশে ধায় আকুল হইয়া।
সুনীল গগন গায় বিরাট বিশাল কায়
অনন্ত পর্ব্বত শ্রেণী গিয়াছে মিশিয়া,
যেন স্বর্গ দুর্গদ্বারে পরিখার ধারে ধারে
প্রাকার উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া।
ইহাদের তুলনায় কতক্ষুদ্র এ ধরায়
মানব আমরা হই নাহি সীমা তা’র,
কণামাত্র জ্ঞান পেয়ে ভাবি আমাদের চেয়ে
কেবা বড় আছে এই সংসারেতে আর।


একদিন সন্ধ্যাকালে চাহি ব্রহ্মকুণ্ড জলে
নগেন্দ্র ও পঙ্কজিনী সাথে ইন্দুমতী,
ব্রহ্মকুণ্ড ঘাটে এসে চিন্তাপূর্ণ নেত্রে বসে
দেখিতে ছিলেন সবে গঙ্গার আরতি।
অনন্ত সলিল রাশি কল কলে যায় ভাসি,
কুণ্ডেতে অসংখ্য মৎস্য করে বিচরণ,
পরপারে যায় দেখা চিত্রেতে চিত্রিত যথা,
অনন্ত পর্ব্বত শ্রেণী নিবিড় কানন।
পূরব গগন গায় চন্দ্রমা উঠেছে তায়
জোছনা করেছে আলো জগতের প্রাণ,

কোমল কিরণ দিয়া আবরি পাষাণ হিয়া
মধুর করেছে কত পার্ব্বতীয় স্থান।
পঞ্চদীপ লয়ে হাতে ঘণ্টার তালের সাথে
পুরোহিত করিতেছে আরতি গঙ্গার,
হরের মন্দির মাঝে কত কাংস ঘণ্টা বাজে
বম্ বম্ রবে কত হ’তেছে ঝঙ্কার।
এই মহা পুণ্যক্ষণে একদৃষ্টে একমনে
রয়েছেন কা’র পানে চাহি ইন্দুমতী?
কুণ্ডের সেতুর পরে ধ্যানে মগ্ন যুক্তকরে
বসিয়া রয়েছে ওই কোন্ মহামতি?
সুন্দর সুঠাম কায় দেব ভাব পূর্ণ তায়
শান্তিপূর্ণ মুখ খানি উন্নত ললাট,
ভুলিয়া সংসার যেন কোথায় গিয়াছে মন, •
রয়েছে বসিয়া যেন এক চিত্রপট।
দেখিয়া নিমেষ তরে চিনিলেন প্রাণেশ্বরে,
ছুটিল আনন্দ স্রোত শিরায় শিরায়,
ইন্দীবর নেত্র দুটী আনন্দে উঠিল ফুটি,
আনন্দে রঞ্জিল গণ্ড রক্তিম আভায়।
উচ্ছ্বাসে আপনা হারা নয়নে সলিল ধারা
পার্শ্বে ছিল পঙ্কজিনী ইঙ্গিতে তাহায়,
চম্পক অঙ্গুলি তুলি ফুটিলনা মুখে বুলি
দেখাইয়া দিল ইন্দু তা’র দেবতায়।

চাহিয়া তাঁহার প্রতি আশ্চর্য্য হইয়া অতি
পঙ্কজিনী বুঝিলেন ইনি কোন জন,
নিকটে নগেন্দ্র ছিল তাহারে বলিয়া দিল
সন্ধান লইতে ইন্দু-পতির তখন।
এদিকে আরতি শেষে দেবব্রত উঠে এসে
রাধিকারে লয়ে সাথে ধীরে ধীরে ধীরে,
তাঁ’দের সম্মুখ দিয়া সোপানে উঠিয়া গিয়া
নবীনের সাথে গেল নগর ভিতরে।
শিক্ষা ও সংযম ফলে হৃদয় বাঁধিয়া বলে,
উদাস নয়নে ইন্দু রহিল চাহিয়া,
বিষাদ কাতর স্বরে কহিলা পঙ্কজ তা’রে
“এমনি পাষাণ বটে পুরুষের হিয়া।”


প্রভাতে গঙ্গার তীরে ভ্রমিতে ভ্রমিতে ধীরে
দেবব্রত দেখিলেন একটী সন্ন্যাসী,
চাহিয়া তাঁহার পানে রহিয়াছে এক মনে
নদীর সৈকতে এক শিলাসনে বসি।
নিকটে আসিয়া তিনি তখনি তাঁহারে চিনি
ছুটে গিয়ে ধরিলেন পা দুখানি তাঁ’র,
বলিলেন “মনে আছে আমি যে তোমারি কাছে,
পেয়েছি জীবন রক্ষা কি কহিব আর?

তিনটী বৎসর আগে— পরাণে সে স্মৃতি জাগে—
সেই বটবৃক্ষতলে কাল র্সপ হ’তে,
বাঁচা’লে আমার প্রাণ করিলে উৎসাহ দান,
ধরিলে মোহিনী ছবি জীবনের পথে।
আর আর আশা যত তোমার কথিত মত
হইয়াছে পূর্ণ এবে শুধু এক বাকী,
বল ওহে দয়াময় কৃপা করি অভাগায়
আমার সে আশা প্রভো! পূর্ণ হবে না কি?”
হাসিয়া মধুর হাসি কহিলেন সে সন্ন্যাসী
“এখানে পূরবে বৎস তব অভিলাষ;
পাবে পুনঃ ইন্দুমতী তিনি মহাসাধ্বী সতী,
হইবে তোমার শীঘ্র সুখের বিকাশ।
ঈশ্বরে রাখিয়া মন কার্য্য কর’অনুক্ষণ
পরসেবা কর সদা হইয়া নিষ্কাম,
করিবে পরের ভাল মুছাবে নয়ন জল
সংসারে করিবে ধর্ম্ম কর্ম্ম অবিরাম।
বাসনা করেছ যাহা সময়ে পুরিবে তাহা
পাইবে আমার তুমি পুনঃ দরশন,
যাও এবে ওই খানে বসি ওই শিলাসনে
চাহিয়া তোমার পথ আছে একজন।

নগেন্দ্র প্রভাতে এসে নবীনের দ্বারদেশে
শুনি দেবব্রত গেছে করিতে ভ্রমণ,
মুহূর্ত্ত চিন্তার পরে নবীনের হাত ধরে
বলিল তাঁহার কাছে সব বিবরণ।
বলিল বিগত রাতে দিয়াছে সে দেবব্রতে
পরীক্ষা করিতে, নিজ অন্য পরিচয়,
কহে নাহি কোন কথা ইন্দুর প্রসঙ্গে সেথা
কি জানি ইহাতে যদি বিপরীত হয়।
কেমনে তা’দের হয় এ মিলন আনন্দময়,
তখন উভয়ে ভাবি করিলেন স্থির,
মন্ত্রণার অবসানে নগেন্দ্র আনন্দ মনে
একাকী চলিয়া গেল ভাগিরথী তীর।
গঙ্গার পুলিনে এসে শিলাসনে একা বসে
তন্ময় হইয়া তিনি ছিলেন ভাবিতে,
সন্ন্যাসী জানিতে পারি অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করি
দেখাইল দেবব্রতে অদূর সৈকতে।
সন্ন্যাসী আদেশ মত আসিলেন দেবব্রত
তখনি নগেন্দ্র পাশে চিন্তাপূর্ণ মনে,
প্রথম আলাপ পরে পায় পায় ধীরে ধীরে
নবীনের গৃহে গেল তা’রা দুইজনে।
তিন জনে বসে সেথা হইল অনেক কথা,
দেখিয়া অধিক বেলা নগেন্দ্র তখন;

আর কিছু নাহি বলে নিজালয়ে সন্ধ্যাকালে
নিমন্ত্রণ করে সবে,করিল গমন।


রাধিকা নবীন সনে আসিলেন নিমন্ত্রণে,
তীর্থ স্থানে নাহি আজ কোন অন্তরায়,
পঙ্কজিনী আসি দ্বারে মহা সমাদরে তা’রে
যতনে লইয়া গেল কন্যা মমতায়।
অন্তঃপুর কক্ষে বসি আনন্দ সাগরে ভাসি
রাধা,ইন্দু,পঙ্কজিনী করে পরিচয়,
বাহিরের কক্ষে হেথা কত গল্প কত কথা
নগেন্দ্র,নবীন,আর দেবব্রত কয়।
নগেন্দ্রের কন্যা “হেম৷” রূপে গুণে অনুপমা,
সুচারু কুসুম-হাস বিনম্র বদন,
অমৃত সিঞ্চিত স্বরে গুণ গুণ গান ধরে
আসিয়া তাঁ’দের কাছে দিল দরশন।
নবীন বলে তা’রে গাওত মা’ উচ্চৈঃস্বরে
শুনাও বারেক ওই সুমধুর তান,
নিকটে আছিল বীণা ধীরে ধীরে মূরছনা
করিয়া ধরিল বালা বিষাদের গান।
সকলে স্তম্ভিত হ’য়ে বালিকার মুখ চেয়ে
শুনিল বিষাদ ভরা তাহার সঙ্গীত,

ইন্দুর জীবন গাথা ইন্দুর মরম ব্যথা
ইন্দুর উচ্ছ্বাসে গান হয়েছে রচিত।
সুদূর অতীতে তা’র সুখের শান্তির আর
ছিল যেই প্রেমময় প্রীতির জীবন,
কেমনে তা’ নদীতীরে ভাগিরথী পূত-নীরে
পতির সহিত তা’র হ’ল বিসর্জ্জন।
কেমনে সে মৃত্যু কোলে ভাসিতে ভাসিতে জলে
নিরাশ্রয়া হ’য়ে পুনঃ পাইল আশ্রয়,
কিন্তুতা’র প্রাণেশ্বর অতল জলধি ’পর
আঁধারে ভাসিয়া গেল কে জানে কোথায়!
বুকে ধরে কত আশা কত প্রেম ভালোবাসা
কত আশাপথ চেয়ে এ তিন বৎসর,
কাটাইল কত দুখে ভারতের বুকে বুকে
করিল সন্ধান, পতি মিলিল না তা’র।
পুণ্য তীর্থ হরিদ্বারে খুঁজিতেছে দ্বারে দ্বারে,
জাগ্রত ঈশ্বর পতি যদি নাহি পায়,
সুনীল শীতল জলে কিম্বা পড়ি শিলাতলে,
হৃদয়ের জ্বালা ইন্দু জুড়াবে নিশ্চয়।
 শুনিয়া এ শোক গান বিষাদে ভরিল প্রাণ
দেবব্রত নেত্র কোণে দেখা দিল জল,
তখন কাতর স্বরে কহিল সে বালিকারে
“কে শিখা’ল এই গান বলত মা’ বল”!

বালিকা। 

  পিসিমা।

দেবব্রত।    কোথায় তিনি?

বালিকা।   বাড়ীর ভিতর।
নগেন্দ্র বলিল তাঁ’রে যদি ইচ্ছা হয়,
বালিকার সাথে যেতে পারেন তথায়।
পেয়ে তাঁ’র অনুমতি দেবব্রত শীঘ্রগতি
বালিকার হাত ধরে গেল দ্বার দেশে,
যেমন খুলিল দ্বার দেখিল কি চমৎকার
কে তা’র ধরিল হাত বরণের বেশে!
মঙ্গল শঙ্খের ধ্বনি তা’র সহ হুলুধ্বনি
উঠিল পুরীর মাঝে ঘন ঘন ঘন,
সুসজ্জিত গৃহান্তরে পঙ্কজিনী লয়ে তাঁ’রে
দেখাইল বধু বেশী ইন্দুরে তখন।
তখন আশীষ করি ইন্দুমতী হাত ধরি
দেবব্রত হাতে হাত করি সমর্পন,
বলিলেন হাসি তিনি “লহ তব ইন্দুরাণী,
দুর্যোগে তরনী আর চড়োনা কখন।”

সমাপ্ত।