ইয়ুরোপে তিন বৎসর/৩
তৃতীয় অধ্যায়।
স্কট্লণ্ড; ১৮৬৯ সালের ২১এ জুলাই হইতে ২০এ সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত।
গত ২১ শে জুলাই বেলা প্রায় ১০ টার সময় আমরা স্কট্লণ্ডে যাইবার মানসে লণ্ডননগর হইতে যাত্রা করিলাম। বহুদূর পর্য্যন্ত আসিয়াও দেখা গেল যে টেমস্নদী লণ্ডনের নীচে যেরূপ অপরিষ্কার ও জঘন্য, তথায়ও সেইরূপ। অগণ্য জাহাজ ও ধূমপােত ইতস্ততঃ যাতায়াত করিতেছে; উভয় পারে কতই কুঠী, কতই কার্য্যালয়, কতই বাণিজ্যালয় আছে; সর্ব্বদাই ধুম ও ধূলা উত্থিত হইতেছে; এবং তত্তাবতেই লণ্ডন নগরের সমধিক বাণিজ্য প্রাচুর্য্যের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। যাইতে যাইতে রূপান্তর দৃষ্টিগােচর হইল; ঐনদীর উভয় পারে সুবিস্তৃত পশুচারণ ও শস্যক্ষেত্র, তৃণাচ্ছাদিত ভূমি, সুন্দর তরুরাজি এবং হরিদ্বর্ণ তরঙ্গমালাকৃতি পর্ব্বত সমুদয় দেখা গেল। এবং তদুপরি গােমেষাদি যূথে যূথে সঞ্চরণ করিতেছে। কখন একটা দূরস্থ বৃহৎকায় কুঠী, কি বৃহদাকার হােটেল দেখা যাইতেছে, কখন বা শ্রেণীবদ্ধ রেলগাড়ী সমুদয় ঘর্ঘর শব্দে ধূমােদ্গীরণ করিতে করিতে নিঃশব্দ গ্রামের ও ক্ষেত্রের উপর দিয়া যাইতেছে। ক্রমে টেম্সনদীর জল স্বচ্ছ শ্যামলবণ বোধ হইতে লাগিল। এবং বেলা প্রায় দুই প্রহর বেলা প্রায় দুই প্রহর দুই ঘণ্টার পর, আমরা উক্ত নদী ছাড়িয়া জার্মাণ মহাসাগরে উপস্থিত হইলাম। রাত্রি ৯ ঘণ্টার সময় বহুজনাকীর্ণ ইয়ার্মথ নগর দেখিতে পাইলাম; তথা হইতে বিনির্গত শত শত আলোক নীল জলের উপরে খেলা করিতেছে, এবং দূরস্থিত ঐ নগরের মন্দির ও গির্জ্জার চূড়া সকল সন্ধ্যাকালীন ধুসরবর্ণ আকাশপটে সুচিত্রিত ছবির ন্যায় দেখাইতেছে। এক ঘণ্টার মধ্যেই আর কূল দেখা গেল না। প্রভাতে উঠিবামাত্র সাগর-তরঙ্গ-প্রপীড়িত ফ্রাম্ব্রো পর্ব্বত দৃষ্টিপথে পতিত হইল, অনতিবিলম্বেই আমরা স্বারবরো ও হইট্বি নামক দুই সুন্দর নগরের নীচে দিয়া আসিলাম। এতদুভয়ই সাগরকূলবর্ত্তী অতি উৎকৃষ্ট আরামের স্থান; এখানে প্রতি বৎসর ইংলণ্ডের নানাদিক হইতে শত শত লোক আসিয়া থাকে। ইয়র্কসিয়রের উপকূল শ্রেণীবদ্ধ পীতবর্ণ বালুকাময় শৈলরাজি দ্বারা নির্ম্মিত। অপরাহে স্কটলণ্ডের পর্বতময় উপকূল নয়নগোচর হইল। ফুত অফ্ ফোর্থ নামক সাগরশাখা দিয়া প্রবেশ করিবার সময় একটি সুন্দর অতি অদ্ভুতগঠন পর্ব্বত দৃষ্টিগোচর হয়, উহা সংখ্যাতীত জলচর পক্ষীর বাসস্থান। অতঃপর আমরা গ্রাণ্টন নগরে অবরোহণ করিয়া ২২শে জুলাই সন্ধ্যার সময় এডিনবর্গ নগরে উপনীত হইলাম।
এডিনবর্গ নগর স্কট্লণ্ডের রাজধানী। উহার বিস্তার লণ্ডন নগরীপেক্ষা কম,অধিবাসীর সংখ্যাও কম এবং বাণিজ্যও কম, তথাপি ঐ নগরের শোভা সমধিক মনোহারিণী। গৃহ সমুদয় অতি সুগঠিত। তাহার মধ্যে মধ্যে উচ্চ গিরি বিরাজ করিতেছে এবং অসংখ্য মন্দির-চূড়া ও পর্ব্বত-শেখর দ্বারা ঐ নগর অপূর্ব্ব শ্রীধারণ করিয়াছে। উহার একস্থানে সর্ ওয়াল্টর স্কটের স্মরণার্থে একটি স্তম্ভ নির্ম্মিত আছে। উহা ২০০ ফিট উচ্চ, কিন্তু সোপান-পরম্পরা দ্বারা উহার শিরে আরোহণ করা যায় না, কেবল ১৮০ ফিট পর্য্যন্ত উঠিতে পারা যায়। সেই পর্য্যন্ত উঠিলে পর সমুদায় নগরের শোভা দৃষ্টিগোচর হয়। ক্যাল্টন নামক পর্ব্বতের উপর নেল্সন, প্লেফায়ার, এবং ডিউগাণ্ট ইষ্টয়ার্টের স্মরণার্থ স্তম্ভ আছে। আর জাতীয়-মনুমেণ্ট নামক একটি স্তম্ভ প্রসিদ্ধ ওয়াটার্লুর যুদ্ধে হতজীবন বীরপুরুষগণের স্মরণার্থে নির্ম্মিত হইতেছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ হয় নাই। এই পর্ব্বতের নিকট ডেবিড হিউমের স্মরণার্থ এক স্তম্ভ আছে। ক্যালটন গিরি ২২৪ ফিট, উচ্চ; উহার শৃঙ্গে উঠিলে চতুষ্পার্শ্বের অতিমনোহর দৃশ্য দর্শন-পথে পতিত হয়। উত্তরে ফৃত অফ ফোর্থ সাগরশাখার নীল জল এবং তাহার দক্ষিণতীরস্থ বহুজনাকীর্ণ গ্রাণ্টন, লিথ প্রভৃতি নগর; অপর পারে ফাইফ্সিয়রের দূরবর্ত্তী উচ্চ পর্ব্বতশ্রেণী। নীচে ও নিকটে নানা মন্দির-চূড়া ও উচ্চ অট্টালিকাশোভিত এডিনবর্গ নগর। দক্ষিণে পেণ্টলাণ্ড ও লেমারমুরের দূরস্থ নয়নপথরোধী পর্ব্বতশ্রেণী। ক্যালটন গিরির নিকটে রবার্ট বর্ন্সের স্মরণার্থ একটি সুন্দর অট্টালিকা আছে। উহার মধ্যে উক্ত কবিবরের জীবনসম্বন্ধীয় নানাবিধ বিচিত্র সামগ্রী আছে। উহার ভিত্তি সকল কবির স্বহস্ত লিখিত নানা পত্র দ্বারা মণ্ডিত। হস্তাক্ষর উত্তম নহে; পত্রগুলি অতি সরল ভাষায় লিখিত ও তাহার মধ্যে এক এক খান এরূপ পত্র আছে, যাহাতে প্রকৃত অকৃত্রিম কবিত্ব ও স্নেহ-রস পরিপূরিত আছে। বিশেষতঃ তন্মধ্যে ক্লারিণ্ডার উদ্দেশে যে একখানি পত্র লেখা আছে, তাহা পাঠ করিলে সহৃদয় পাঠকবর্গের নয়নযুগল অশ্রুজলে প্লাবিত হয়। এই ক্লারিণ্ডা উক্ত কবিবরের প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী হইয়া নানা ক্লেশ পাইয়াছিলেন। তন্নিমিত্তে কবিবর একান্তমনে ঈশ্বর-সন্নিধানে ক্লারিণ্ডার বিরহাদি কাতরতার শান্তি হউক, এই প্রার্থনা সম্বলিত প্রগাঢ় ও অকপট স্নেহগর্ভ যে পত্র লিখিয়াছিলেন, আমরা তাহাও পাঠ করিলাম। অনন্তর কবিবরের পানপাত্র, মৃণ্ময় জলপাত্র, তরবারি, নস্যাধার, ত্রিপাদিকা প্রভৃতি কতই সামগ্রী দেখিলাম।
আমরা এখান হইতে হোলিরুড রাজপ্রাসাদ ও গির্জ্জাঘর এবং তদনন্তর এডিনবর্গনগরস্থ দুর্গ সন্দর্শন করিতে গেলাম। এই দুর্গ অতি পুরাতন এবং এক উচ্চ পর্ব্বতের উপরে নির্ম্মিত, তথায় উঠিবার এক পাশ দিয়া কেবল একটী পথ তাছে।
বারুদের আবিষ্ক্রিয়ার পূর্ব্বে এই দুর্গ অবশ্যই দুষ্প্রবেশ ছিল। ঐ দুর্গের মধ্যে স্কট্লণ্ডের রাজমুকুটাদি রক্ষিত হইতেছে।
এডিনবর্গের অধিবাসীর সংখ্যা ১৭৫০০০।
২৭শে প্রাতে আমরা এডিনবর্গ হইতে লিন্লিথ্গউ গ্রামাভিমুখে যাত্রা করিলাম। ঐ গ্রামে পর্ব্বত ও সুবিস্তৃত গোচারণভূমি বেষ্টিত কতিপয় গৃহ মাত্র আছে, তন্মধ্যে চতুর্থ কি পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব্বে বিনির্ম্মিত এক পুরাতন রাজবাটীর ভগ্নাবশেষ আছে। গ্রামে সেই একমাত্র দর্শনযোগ্য বস্তু ব্যতীত আর কিছুই নাই। ঐ প্রাসাদ অতি বৃহদাকার এবং সুগঠন এবং উহা যে সুরম্য স্থানে নির্ম্মিত, তাহাও ভাবিলে ইহা বিচিত্র বোধ হয় না যে, এককালে স্কট লণ্ডীয় নৃপতিগণের উহা অতিপ্রিয় বাসস্থান ছিল। ঐ অট্টালিকার নীচে একটা হ্রদ ও তাহার চতুষ্পার্শ্বে তৃণাচ্ছাদিত ক্ষেত্র, ও তরঙ্গাশ্রিত পাদপমণ্ডিত পর্ব্বতমালা এবং সুনীল সাগরশাখার দূরবর্ত্তী উচ্চ শৈলশ্রেণী বিরাজিত আছে। ঐ প্রাসাদের বৃহৎ বাতায়নতলে দণ্ডায়মান হইয়া সেই সুদৃশ্য ক্ষেত্রচয়, সেই হ্রদ ও সেই পর্ব্বত দেখিলাম। যে স্থান পুরাকালে প্রমেদোন্মত্ত নৃপতিগণের হাস্যরবে ও আনন্দিত সেনা-নিচয়ের আনন্দ কোলহলে প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল, অধুনা সে স্থান নিস্তব্ধ ও নিভৃত হইয়া আছে। অতঃপর তথাকার বৃহদাকার সভামন্দির, ভোজনাগার ও পুরাতন গির্জার ভগ্নাবশেষ সন্দর্শন করিলাম। সেই সমস্ত ছাদশূন্য আগারের ভিতরে বেড়াইতে বেড়াইতে স্বপ্নবৎ মনে উদয় হয় যে, যে সমুদয় গতায়ু রাজা ও রাজমহিষীগণ ইতিপূর্ব্বে এই স্থানে অশেষ আমোদপ্রমোদে দিনপাত করিয়া গিয়াছেন, এক্ষণে তাঁহারা যেন ছায়ারূপে তথায় কখন ভ্রমণ করিতেছেন, কখন বা সচিন্তভাবে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন।
রাজপ্রাসাদের চতুর্দ্দিকস্থ সেই সুন্দর হ্রদের নিকটে বহুক্ষণ ভ্রমণ ও তদনন্তর আহারাদি করিয়া আমরা তথা হইতে ষ্টরলিং নগরাভিমুখে যাত্রা করিলাম। আমরা যেখানে যে রূপেই কেন ভ্রমণ করি না, লিনলিথ্গো গ্রামের নিস্তব্ধতা, তত্রত্য গণ্ডগিরি, তৃণাচ্ছাদিত ক্ষেত্র, ভগ্নাবশিষ্ট রাজপ্রাসাদ, সুন্দর গির্জা ঘর কখনই বিস্মৃত হইতে পারিব না।
ষ্টরলিং নগর অতি ক্ষুদ্র, অধিবাসীর সংখ্যা ১২,০০০। বৈকালে আমরা ভ্রমণে বহির্গত হইলাম এবং অন্যমনস্ক হইয়া দেখিতে দেখিতে ও কথায় কথায় প্রায় ৫ ক্রোশ দূরে গিয়া পড়িলাম। ফোর্থ সাগরশাখার উপর এক অতি পুরাতন ও এক নূতন পোল আছে। ঐ শাখা লিনলিথ্গোর নীচে অতি পরিসর; ষ্টরলিং নগরের নীচে অতি সঙ্কীর্ণ। নদীর অপর পারে এক উচ্চ ও বন্ধুর গিরিশিখরে প্রসিদ্ধ উইলিয়ম ওয়ালেসের স্মরণার্থে এক অতি প্রকাণ্ড স্তম্ভ আছে। যে যোদ্ধাপতি স্কটলণ্ডের রক্ষাকর্ত্তা ও তাঁহার স্বাধীনতা সাধনে স্বীয় প্রাণদান করিয়াছিলেন, তাঁহার স্মরণ-স্তম্ভের নিমিত্ত উপযুক্ত স্থানই মনোনীত হইয়াছে। উহা বহুদূর হইতে দেখিতে পাওয়া যায়। ইহারই নীচে ষ্টরলিংএর ক্ষেত্রে ওয়ালেস্ প্রথমে জয়লাভ করিয়াছিলেন।
ষ্টরলিং দুর্গ এক উচ্চ ও দূরারোহ পর্ব্বতের উপর নির্ম্মিত। বন্দুক ও কামান সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব্বা, উহা দুষ্প্রবেশ ছিল, সন্দেহ নাই। নীচে হইতে ঐ দুর্গ দেখিতে অতীব ভয়ঙ্কর। সেই উচ্চ ও বন্ধুর গিরি, যাহার শৃঙ্গোপরি ঐ দুর্গ শোভিত আছে এবং যাহার শৃঙ্গময় পার্শ্বদেশে বহুতর তরুবর শোভা পাইতেছে, সন্দর্শন করিলে নয়নযুগল তৃপ্তিলাভ করে। এক ঘণ্টার পর আমরা বনাক্বর্ণের ক্ষেত্রে উপস্থিত হইলাম। এই স্থানে স্কটলণ্ডীয়দিগের রণ-পতাকা উড্ডীন হইয়াছিল। প্রসিদ্ধ সেনাপতি রবার্ট ব্রুস্ এই প্রসিদ্ধ ক্ষেত্রে জয়লাভ ও ইংরাজদিগকে পরাস্ত করিয়া স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করিয়াছিলেন।
মাসের ২৮ দিবসে আমরা ষ্টরলিং পরিত্যাগ করিয়া কালেণ্ডর নগরে উপস্থিত হইলাম। ঐ নগর উচ্চ এবং তুষারাবৃত পর্ব্বতের ক্রোড়স্থ। স্কটলণ্ড যে কীদৃশ পর্ব্বত ও জঙ্গলময় দেশ তাহার পরিচয় এখানেই প্রথমে পাওয়া যায়। ইহার কোন উচ্চ স্থানে দণ্ডায়মান হইয়া দেখিলে উচ্চ ও দুরারোহ পর্ব্বতশ্রেণী ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। কখন একটা ক্ষুদ্র গ্রাম কিম্বা তৃণাচ্ছাদিত ক্ষেত্র নয়নপথে পতিত হয় বটে, কিন্তু তাহার পর আবার অনন্ত পর্ব্বতমালা ও গগন-স্পর্শী শৈলশৃঙ্গ দেখা যায়। এই ভূমি কবিশিশুকে লালন পালন করিবার উপযুক্ত ধাত্রীস্বরূপ।
কালেণ্ডরের নিকটে একটা ভীম-নাদ জলপ্রপাত আছে। তাহা দেখিবার যোগ্য বস্তু বটে। মনে মনে চিন্তা করিয়া দেখুন যে, দুই পর্ব্বতশ্রেণীর মধ্যবর্ত্তী একটা গভীর সঙ্কীর্ণ পথে দণ্ডায়মান আছেন; দুই দিকের শৈল হইতে স্খলিত উপলখণ্ড ঐ বর্ত্মোপরি বিকীর্ণ আছে। পথে কেটী নাম্নী গিরিনদী ‘কুল কুল’ শব্দে ও চঞ্চলবেগে প্রবাহিত হইতেছে ও তাহার জল অতি উচ্চ দেশ হইতে নিম্নস্থ গভীর গহ্বরে নিপতিত হইতেছে। অনন্তর আমরা এক পর্ব্বত-শেখরে উঠিয়া অভ্রভেদী বেননেভিস পর্ব্বতশৃঙ্গ সন্দর্শন করিলাম উহা ২৮৮২ ফিট উচ্চ।
কালেণ্ডর হইতে ট্টোসাকে শকটযানে যাওয়া অতি আহ্লাদজনক। আমাদিগের গাড়ি গিরিনদী, হ্রদ ও উপতাকার নিকট দিয়া ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল, দেখিলাম কেবল উচ্চ পর্ব্বতশ্রেণী ধূ ধূ করিতেছে। বোধ হইল যেন, দানবদল সেই দেশ রক্ষার্থ প্রহরীর ন্যায় দণ্ডায়মান রহিয়াছে।
অনন্তর আক্রে নামক হ্রদ ও ট্রোসাকে সন্নিধানে পঁহুছিলাম। এই স্থানের পর্ব্বত ও কতিপয় হ্রদ স্কটলণ্ডের মধ্যে যারপরনাই মনোহর এবং পথিবীতে যত রম্য স্থান আছে, তন্মধ্যে পরিগণনীয়। পর্ব্বতের উপরে পর্ব্বত এবং তদুপরি উচ্চশৃঙ্গে মন্দ সমরে দোদুল্যমান বৃক্ষ সমুদয় অদ্ভুত শ্রীধারণ করিয়াছে, তাহাতে আবার স্বচ্ছ স্রোতস্বতী ‘কুল কুল’ ধ্বনি করত পর্ব্বত হইতে ছায়াময় উপত্যকায় লম্ফ প্রদান পুরঃসর পতিত হইয়া সেই প্রদেশের শোভা সমধিক মনোহর করিয়াছে। আমরা প্রায় এক ঘণ্টা ট্রোসাক পর্ব্বতে ভ্রমণ করিলাম; বোধ হইতে লাগিল যেন প্রকাণ্ড প্রস্তররাশি আকাশে লম্বমান রহিয়াছে। তরু, লতা, গুল্ম ও বনপুষ্প যে কতই দেখিলাম, তাহার সংখ্যা করা দুঃসাধ্য।
এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা কেটরীণ হ্রদের নিকটে উপস্থিত হইলাম এবং কি বিস্ময়কারিণী শোভা আমাদিগের নয়নপথে পতিত হইল। সেই শোভার যেরূপ চমৎকারিতা, বোধ হয় তাহার সদৃশ শোভা ভূমণ্ডলে অতি দুলর্ভ এবং তাহা অনুভব করাও নিতান্ত অসম্ভব। চতুর্দ্দিকে বন্ধুর উচ্চ গিরি হ্রদের তট হইতে গাত্রোত্থান করিয়াছে; হ্রদের অসংখ্য শাখা প্রশাখা নানাদিকে প্রবিষ্ট হইয়াছে। শত শত স্বচ্ছ গিরিনদী বেগে লম্ফদান ও নৃত্য করিতে করিতে শেখর হইতে শেখরান্তরে পতিত হইতেছে; বোধ হয় যেন হীরকরাশি এবং গলিত রৌপ্য ঝর্ঝর করিয়া পড়িতেছে ও হ্রদের স্থিরনীরে মিশাইয়া যাইতেছে। এখানে শব্দ মাত্র নাই। কি জল, কি স্থল, কি বৃক্ষ, কি পর্ব্বত, সকলেই নিস্তব্ধ; বোধ হয় যে ইন্দ্রজালের প্রভাবে সব নীরব হইয়া রহিয়াছে। প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা ঐ হ্রদের অপর পারে উপনীত হইলাম। তথায় একখান শকট আমাদিগের প্রতীক্ষায় ছিল, আমরা তাহাতে উঠিতে পর্ব্বতের উপর ও অধিত্যকার ভিতর দিয়া লামণ্ড হ্রদের নিকটে আসিলাম। এখানেও একটা সুন্দর জলপ্রপাত আছে। উহার ফেনময় জল অতি বেগে প্রায় ১৬ ফিট উচ্চ হইতে অধঃপতিত হইয়া ঐ হ্রদে পড়িতেছে। আমরা এক ধূমপোতে আরোহণ করিয়া কিয়ৎক্ষণের মধ্যে লামণ্ড হ্রদের অপর পারে পৌঁছিলাম। কেটরীন হ্রদের ন্যায় লামণ্ড হ্রদ দেখিতে সুন্দর বটে, কিন্তু ততদূর বিস্ময়কর নহে। তাহাতে সংখ্যাতীত সুদর্শন ও নানা প্রকার দ্বীপ আছে, যদ্বারা তাহার চিত্তগ্রাহিণী ও চমৎকারিণী শোভা সম্পাদিত হইয়াছে। তাহার তটস্থ ভূমি ঊর্ব্বরা এবং তাহার হৃদয়স্থ পীত ও হরিদ্বর্ণ দ্বীপচয় যার পর নাই সুন্দর।
অতঃপর রেলগাড়িতে আমরা তথা হইতে গ্লাসগো নগরে পৌঁছিলাম। ঐ নগর অতি বর্দ্ধিষ্ণু— অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ।
বস্তুতঃ ঐ নগর স্কটলণ্ডের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবসায়ের সর্ব্বপ্রধান স্থান, এবং উহাকে দেখিলেই বাণিজ্যের স্থান বলিয়া বোধ হয়। গ্লাসগো নগরের মধ্যে জর্জ স্কয়ার নামক স্থান অতি সুরম্য। ঐ স্থানের একদিকে রাণী ভিক্টোরিয়া ও অপর তাঁহার স্বামী আলবর্টের প্রতিমূর্ত্তি আছে, মধ্যস্থলের সর্-ওয়াল্টার স্কটের স্মরণার্থ এক স্তম্ভ নির্ম্মিত হইয়াছে। ২রা আগষ্ট প্রাতে সাত ঘণ্টার সময় এক অতি উত্তম ধূমপোতে উঠিয়া সাগরতীরস্থ ওবান নগরে উপস্থিত হইলাম। লণ্ডননগরের নীচে টেম্স নদ যেমন কদাকার, গ্লাসগোর নীচে ক্লাইড নদও তদ্রূপ। কিন্তু যাইতে যাইতে ক্লাইড নদের রূপান্তর লক্ষিত হইল। সে দিবস আকাশোপরি উজ্জ্বল প্রভাকর প্রভা বিতরণ করিতেছিল ও সমুদ্র-জল স্থিরভাবাপন্ন ছিল এবং আমাদিগের উভয় দিকের সুন্দর পর্ব্বত কখন দিবাকর-করে সমুজ্জ্বল, কখন বা তরু-ছায়াচ্ছিন্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছিল। স্থানে স্থানে অতি প্রশস্ত তৃণাচ্ছাদিত ও শস্যপূর্ণ ক্ষেত্র-চয় ও উপত্যকার গৃহমণ্ডলী দেখা গিয়াছিল। ক্লাইড নদের শাখা দিয়া আমরা বহির্গত হইয়া উত্তরাভিমুখে এবং দক্ষিণে চলিলাম। বামে কান্টায়ের প্রায়োপদ্বীপ এবং দক্ষিণে স্কট্লণ্ড দেশ রহিল। ঐ প্রায়োপদ্বীপ পার হইয়া সমুদ্রে আসিয়া উপনীত হইলাম; তথায় একখান ধূমপোত ওবান নগরে লইয়া যাইবার অন্য আমাদিগের প্রতীক্ষায় ছিল। স্কট্লণ্ডের পশ্চিম কূল কিরূপ অনুর্ব্বর, বন্ধুর বিচ্ছিন্ন ও পর্ব্বত ময়, তাহা লিখিয়া কি জানাইব? যে দিকে নেত্রপাত করা যায়, সেই দিকেই সহস্র সহস্র সাগর-শাখা, অসংখ্য প্রস্তরময় দ্বীপ ও সহস্র তীর হইতে সমুত্থিত সুদীর্ঘ উচ্চ পর্ব্বতশ্রেণী নয়নপথে পতিত হয়। অপরাহ্ণে আমরা ওবান নগরে উপস্থিত হইলাম; ঐ নগর ক্ষুদ্র অথচ সুন্দর, এবং উহার পশ্চিমে উচ্চ গিরিশ্রেণী আছে,তন্নিমিত্তে সমুদ্র হইতেঐ নগর সন্দর্শন করিলে উহাকে অতি সুন্দর দেখায়। পরপ্রাতে আমরা এক ধূমপোতে উঠিয়া আইওনা ও ষ্টাফা দ্বীপ দেখিতে গেলাম। সকল পথেই উচ্চ ও বন্ধুর পর্ব্বতশ্রেণী দেখিতে দেখিতে চলিলাম, আরও দেখিলাম যে কাচোপম স্বচ্ছ নির্ঝর ঝর্ঝর্ করিয়া শৈল হইতে শৈলান্তরে পতিত হইতেছে। দূর হইতে বোধ হয় যেন সুচিক্কণ রৌপ্য তারের পুচ্ছ নির্ম্মল রবিকরে ঝল্মল্ ঝল্মল করিতেছে। অসংখ্য সাগরহংস সকল আমাদিগের ধূমপোতের পশ্চাতে আসিতে লাগিল এবং কখন তরঙ্গোপরে রঙ্গে সন্তরণ, কখন বা ক্ষণকাল জলমগ্ন থাকিয়া পুনর্ব্বার জলক্রীড়া করিতে লাগিল।
অনতিবিলম্বে আমরা আইওনা দ্বীপে উপস্থিত হইলাম; এস্থান খষ্টীয় ধর্ম্মের এক আদিম নিবাস বলিয়া প্রসিদ্ধ। কিন্তু যে পূতন পবিত্র দ্বীপ পূর্ব্বকালীন বাগী ধর্ম্মোপদেশকদিগের বক্তৃতায় প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল ও যাহা নরপতি গণের মহা ধূমধাম সন্দর্শন করিয়াছিল, তাহা অধুনা কেবল ৫০০ শত নিঃস্ব অধিবাসীর বাসস্থান হইয়াছে।
অতঃপর আইওনা হইতে আমরা ষ্টাফা নামক বিজন ক্ষুদ্র দ্বীপ সন্দর্শন করিতে গেলাম, এখানে কতকগুলি অতি আশ্চর্য্যগঠন গিরিগহ্বর আছে; তন্মধ্যে ফিঙ্গলের গহ্বর সর্ব্বাপেক্ষা প্রকাণ্ড ও চমৎকার। উহার উপরে স্বাভাবিক পর্ব্বত খিলান দেখিলে এবং নীচে সমুদ্রের জলের অনবরত ভীষণ শব্দ শুনিলে বিস্ময়াপন্ন হইতে হয়। সে দিবস সাগর-নীর স্থিরভাবে থাকাতে আমরা একখান নৌকা করিয়া সেই গহ্বরের অভ্যন্তরে গিয়াছিলাম। গহ্বরের উভয় পার্শ্বের দেয়াল অসংখ্য বৃহদাকার স্বাভাবিক প্রস্তর-স্তম্ভ-নির্ম্মিত, আর .উহার বর্ণ নিবিড় শ্যামল হওয়াতে সেই গহ্বরের শোভা অতি ভয়ঙ্করী হইয়াছে। যতবার সমুদ্র-বারি সঘোষে গহ্বর মধ্যে প্রবিষ্ট হয়—তত বারই তথা হইতে দশ গুণ উচ্চ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়।
৫ই আগষ্ট আমরা ওবান পরিত্যাগ পুরঃসর এক ধূমপোতে গ্লেন্কো নামক স্থান দর্শনমানসে গিয়াছিলাম; এই স্থানে তৃতীয় উইলিয়মের সময়ে এক অতি ভয়ঙ্কর নরহত্যাকাণ্ড হইয়াছিল। পর দিন তথা হইতে যাত্রা করিলাম ও বেন্নেবিশ নামক স্কট্লণ্ডের সর্বোচ্চ পর্ব্বতশেখর দর্শন করিয়া কালিডোনিয়ার খাল দিয়া ইনবার্ণেস নগরে যাত্রা করিলাম। কালিডোনিয়ার খাল দিয়া যাইতে যাইতে চতুর্দ্দিকের শোভা অন্ধকারময় তথচ রমণীয় দৃষ্ট হইল। আমাদিগের উভয় পাশ্বেই অবিচ্ছিন্ন শৈলশ্রেণী, তাহাতে আবার সে দিবস অতি অপরিস্কার হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, দুই দিকের পর্ব্বতে সংলগ্ন এক শ্যামল চন্দ্রাতপ আমাদিগের মস্তকোপরি বিস্তৃত হইয়া আছে। কি অগ্রে, কি পশ্চাতে যে দিকে যত দূরে যাহা ছিল, সে সকলই তিমিরাবৃত। উপরে নবীন নীরদজাল, নীচে নীল জলরাশি ও দুই পারে অতি উচ্চ গিরিমালা ব্যতীত আর কিছুই নয়নপথে পতিত হইল না। সে শোভা ভয়প্রদ বটে, কিন্তু নিশ্চয়ই বলিতেছি যে, সে শোভার পরিবর্ত্তে কি সেই ঘনতর ঘনঘটার বিনিময়ে পৃথিবীর মধ্যে যেমনই কেন সুন্দর ও উৎকৃষ্ট স্থান হউক না, তাহা দেখিতে ইচ্ছা করি না। অনন্তর আমরা ফয়ার্শ স্থানের জলপ্রপাত দর্শন করিয়া ইনবার্ণেস্ নগরে পঁহুছিলাম।
ইনবার্ণেস নগর অতি ক্ষুদ্র; অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় ১২,০০০। আমরা এই স্থানে দুই দিবস অতিপাত করিয়া ৯ই আগষ্ট প্রাতে এবার্ডিন নগরাভিমুখে যাত্রা করিলাম। এই নগর স্কট্লণ্ডের মধ্যে তৃতীয় এবং বস্তুতঃ অতি উত্তম স্থান। ইহাতে প্রায় ৮০,০০০ লোকের বাস। এখানকার সমস্ত গৃহ লোহিতপ্রস্তরনির্ম্মিত, তন্নিমিত্তে ইহার এক অদৃষ্টপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য আছে এবং ইহার নিকটে উক্ত প্রকার প্রস্তরের বিস্তর পর্ব্বত দেখিতে পাওয়া যায়।
অনন্তর এবার্ডিন নগরে সুন্দর বাজার, পোতনির্ম্মাণের স্থান ও দর্শনোপযুক্ত আরো কয়েক বিষয় সন্দর্শন করিয়া উক্ত নগর পরিত্যাগ করিলাম, এবং প্রাতে দশ ঘণ্টার সময় এডিনবরো নগরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
১৫ই সেপ্টেম্বরে আমরা ঐ নগর ত্যাগ করিয়া লিবন হ্রদে নিকটে গেলাম। ঐ হ্রদের মধ্যে একটা দুর্গ আছে। এই দুর্গে স্কটলণ্ডের প্রসিদ্ধ রাণী মেরী কিয়ৎকাল কারাবাসিনী হইয়াছিলেন। এই হ্রদের তীরে কিন্রস নামক এক গ্রাম আছে, আমরা ঐ গ্রাম হইতে নৌকাতে সেই দ্বীপে গেলাম। সেখানে উক্ত পুরাতন দুর্গের ভগ্নাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ দ্বীপের আচ্ছাদন ও ভূষণ স্বরূপ সতেজ উদ্ভিদরাশি ভিতর দিয়া সেই দুর্গের উচ্চ চূড়া দূর হইতে দেখিয়ে পাইলাম। দ্বীপের নির্জ্জনতা বিস্ময়কর। এখানে জীব মাত্র নাই এবং সমুদ্রতরঙ্গের অবিশ্রান্ত গম্ভীর ধ্বনি ও নানা বিষ পাদপ-পত্রের মর্ম্মর শব্দ ব্যতীত আর কিছুই শুনিতে পাওয়া যায় না। পূর্ব্বে এই দুর্গ সুন্দর ছিল বোধ হয়। তাহার ভগ্নাবশেষের নিকট দিয়া যাইতে যাইতে কি উহার অনন্য নীরব গৃহের ভিতর বেড়াইতে বেড়াইতে সেই হতভাগিনী রাণীর কারাবাসের কথা অবশ্যই মনে পড়ে। আমরা সেই দিন এডিনবর্গ নগরে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া পরে ১৭ই সেপ্টেম্বরে তথা হইতে যাত্রা করিলাম।
বাষ্প-শকটে আরোহণ করিয়া অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যে হথরণ্ডেন গ্রামে উপনীত হইলাম। সপ্তদশ খৃঃ শতাব্দীতে ড্রমণ্ড নামক যে কবি ছিলেন, এই তাঁহার প্রিয়তম বাসস্থান ছিল। আমরা তথাকার দুর্গ ও ভূগর্ভস্থ গর্ভ সন্দর্শন করিলাম। কথিত আছে যে, এইস্থানে রবার্ট ব্রুশ কিয়ৎকাল অবস্থিতি করিয়াছিলেন। এস্থান হইতে একটা অতি সংকীর্ণ ও গভীর পথ দিয়া আমরা রসলীনে উপস্থিত হইলাম। সেই পথের যে রূপ অপরূপ শোভা, তাহা বর্ণনা দ্বারা পরের হৃদয়ঙ্গম করা অতি কঠিন। উভয় পার্শ্বে প্রকাণ্ড শৈল সকল সরল ভাবে উথিত হইয়াছে, তন্মধ্যে গভীর সঙ্কীর্ণ পথ, উপরে গিরি-তরু অন্ধকার বিতরণ করিতেছে, এবং নীচে এস্কনাম্নী নদী তীরের ন্যায় দ্রুতবেগে প্রস্তরখণ্ডের মধ্য দিয়া কুল কুল ধ্বনি করতঃ সম্বাহিত হইতেছে। এই কান্তার হইতে বহির্গত হইয়া আমরা রসলীনে পৌছিলাম। তথায় একটা ভগ্ন দুর্গ ও পুরাতন গির্জা ঘর আছে। কথিত আছে যে, দ্বাদশ খৃঃ শতাব্দীতে এই ঘর নির্ম্মিত হইয়াছিল। উহার ভিত্তি ও ছাদ প্রস্তরনির্ম্মিত এবং ঐ ভিত্তিতে অতি সুচারুরূপে খোদিত নানা প্রকার মূর্ত্তি অদ্যাপি উত্তমাবস্থায় আছে, এবং একাল পর্য্যন্তও তথায় উপাসনা কার্য্য সম্পাদিত হইয়া থাকে।
রসলীন হইতে রেলগাড়ি যোগে আমরা মেলরোজ গ্রামে উপনীত হইলাম। স্কটের রচিত সুললিত একখানি কাব্য প্রকাশ হওয়া পর্য্যন্ত বিদেশীয় পর্য্যটকবগের এই নগর অতি প্রিয়তম দর্শনীয় স্থান হইয়াছে। তথাকার প্রসিদ্ধ অতি প্রকাণ্ড ভগ্ন মন্দির দেখিয়া চমৎকৃত হইলাম। উহার বাতায়ন সকল অতি উচ্চ, ভিত্তি লতামণ্ডিত, থাম ও খিলান সকল অতি উৎকৃষ্টরূপে খোদিত ও সুভূষিত। উহার চতুষ্পার্শস্থ, সমাধি স্থান অতি নির্জ্জন। শত শতাব্দী গত হইয়া গিয়াছে, নির্দ্দয় কাল কতই পীড়ন করিয়াছে, এবং নিষ্ঠুর সমরোৎসব উহাকে নষ্টশ্রী করিয়াছে বটে, কিন্তু তথাপি অদ্যাপিও যাহা আছে, তাহা দেখিলে দর্শকদল তাহার সমুচিত প্রশংসা করিয়া উঠিতে পারে না। উহার নির্ম্মাণের প্রস্তর অতীব কঠিন হওয়াতেই এতদিনে উহার ধার সকল চিক্কণ আছে এবং ভাস্করকর্ম্ম কিছু মাত্র বিলুপ্ত হয় নাই।
মেলরোজ গ্রামের নীচে প্রসিদ্ধ টুইড নদী, ঐ নদীর তট বস্তুতঃ অত্যন্ত সুন্দর। নিকটে শস্যপূর্ণ ক্ষেত্র, আয়ত গোচারণভূমি, তৃণাচ্ছাদিত শৈল, তদুপরি গোমেষাদি শয়ন করিয়া রহিয়াছে, ভুজঙ্গগতি নদী নিঃশব্দে প্রবাহিত হইতেছে, পরিষ্কার গৃহ সকল বনের মধ্য দিয়া অল্প অল্প দেখা দিতেছে, সমস্ত দিন পরিশ্রমের পর কৃষক একাকী ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখে আগমন করিতেছে। মেলরোজের প্রায় দেড় ক্রোশ দূরে সর্ ওয়াল্টার স্কটের বাসস্থান; সেই স্থান সন্দর্শনার্থে গমন করিলাম। সেই সুন্দর ও প্রকাণ্ড অট্টালিকা টুইড নদীর উপর, তদীয় পাঠগৃহে অদ্যাপি তাঁহার ব্যবহৃত চৌকি ও টেবিল আছে, তাঁহার পুস্তকালয়ে বিশ হাজার পুস্তক আছে, এবং তৎসমুদয় অতি যত্নে রক্ষিত হইতেছে। সভাগারে তাঁহার ও তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র ও দুই কন্যার প্রতিকৃতি আছে। এখানে আর আর যে সমস্ত দ্রব্য আছে, তন্মধ্যে উপঢৌকন স্বরূপ নানা স্থান হইতে নানাপ্রকার যে সামগ্রীসমগ্র তিনি পাইয়াছিলেন, তাহাও দেখিলাম। তাঁহার অস্ত্রালয়ে যুগ যুগান্তরের ও দেশ দেশান্তরের, এমন কি পারস্য দেশীয় ও ভারতবর্ষীয় তরবারি পর্য্যন্ত নানাবিধ যুদ্ধাস্ত্র দেখিতে পাওয়া গেল।
অতঃপর ড্রাইবর্গে স্কটের সমাধি স্থান দেখিতে গেলাম। যাইবার সময় টুইড নদী পার হইতে হয়; ঐ নদীর সেখানে এরূপ প্রবল স্রোত যে, আমরা কি প্রকারে উহা পার হইব, তাহাই বিস্ময় ও উৎকণ্ঠার সহিত চিন্তা করিতেছিলাম; কিন্তু কি আশ্চর্য্য যে, একমাত্র কৌশলে আমরা সেই নদী স্বচ্ছন্দে পার হইলাম। সে কৌশল এই-নদীর উভয় তটে একটা লৌহরজ্জু নিবদ্ধ আছে এবং আর এক গাছ কঠিন রজ্জু দ্বারা পারাপারের নৌকা ঐ রজ্জুর সহিত বাঁধা আছে, সুতরাং ঐ নৌকা স্রোতে ভাসিয়া যাইতে পারে না। এবং উহাকে একভাবে রাখিয়া দিলে স্রোতের বেগে আপনই একপার হইতে অপর পারে গিয়া উপস্থিত হয়, একবারও দাঁড় কেলিতে হয় না। ড্রাইবর্গ নামক সমাধিস্থান যেরূপ পুরাতন ও পবিত্র বোধ হয়, তদ্রূপ স্থান আমি ইতিপূর্ব্বে দেখি নাই। ইহা দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্ম্মিত হইয়াছিল। অধুনা সমাধি স্থান সমপুরাতন নানাপ্রকার লতা গুল্মদিতে আচ্ছাদিত হইয়াছে। এবং ইহারা উপযুক্ত প্রহরীর ন্যায় উহার গৌরব রক্ষা করিতেছে। ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিলে, এখানে একটা ভগ্ন খিলান, ওখানে একটা লতামণ্ডিত প্রাচীর, এবং কোথাও বা পতনোদ্যত মন্দির নয়নগোচর হয়। এই প্রকার একটা মন্দিরের নীচে সর্ ওয়াল্টার স্কটের মৃতদেহ সমাহিত আছে, এবং তাহার এক পার্শ্বে তদীয় প্রণয়িনী, অপর পার্শ্বে তাঁহার পুত্র এবং মধ্যে আড়ভাবে তাঁহার জামাতা মহানিদ্রায় নিদ্রিত আছে।
১৮ই তারিখ সন্ধ্যার সময় আমরা মেলবোজ পরিত্যাগ করিয়া কারলাইল নগর দর্শনে যাত্রা করিলেন। রেলগাড়িতে যাইতে যাইতে স্কট্লণ্ডের উর্ব্বরা ও শস্যাচ্ছাদিত নিম্নভূমির অদৃষ্টপূর্ব্ব নয়নরঞ্জিনী শোভা দর্শনপথে পতিত হইল। আমরা ইতিপূর্ব্বে কিয়ৎকালাবধি কেবলই উহার উচ্চ পর্ব্বতীয় প্রদেশ অনুর্ব্বর শৈল ও অতৃণাচ্ছাদিত ক্ষেত্রচয় সন্দর্শন করিয়া আসিতেছিলাম, সতরাং অধুনা এই শোভা অতীব মনোহারিণী বোধ হইতে লাগিল।
সন্ধ্যা ৮টার সময় আমরা কারলাইল নগরে উপনীত হইলাম। কারলাইল অতি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নগর; সকল গৃহই ইষ্টকনির্ম্মিত। ঐ স্থান ত্যাগ করিয়া কতিপয় ইংলণ্ডীয় হ্রদ দর্শনাকাঙ্ক্ষায় কেসুইক নগরে গেলাম। ইউরোপের মধ্যে সুইজারলণ্ড যেরূপ, ইংলণ্ডের মধ্যে কম্বরলণ্ড তদ্রূপ; ইহা কেবল পর্ব্বতের ও হ্রদের নিবাসস্থান। কেসুইক নগর পাহাড় পর্ব্বতে বেষ্টিত, ইহার শোভা কোন অংশেই স্কট্লণ্ডের উচ্চ প্রদেশের শোভা অপেক্ষা কম নহে। যে রজনীতে আমরা কেইক নগরে পঁহুছিলাম, সে রাত্রি যার পর নাই তমসাবৃত; অতি শীতল সমীরণ সন্ সন্ শব্দে সঞ্চালিত হইতেছে এবং যে দিকে নয়নপাত করা যায়, সেই দিকেই দূরস্থিত শ্যামজলধরবেষ্টিত গিরিশৃঙ্গ অল্প অল্প দৃষ্টিগোচর হয়, তাহাতে আবার দ্রুত বেগবতী ও বক্রগতি গৃটা নাম্নী নদী ভীষণ শব্দে আমাদিগের নিকটে প্রবাহিত হইতেছে। পর দিন প্রাতে আমরা ডারওয়েণ্ট-ওয়াটার হ্রদের পর পারস্থিত লডোর নামক বিখ্যাত জলপ্রপাত দর্শন মানসে নৌকা করিয়া যাত্রা করিলাম। এই জলপ্রপাত অতীব প্রশস্ত, ইহার জল অতি উচ্চ প্রদেশ হইতে বজ্রসদৃশ শব্দে নীচে পতিত হইতেছে, এবং প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ড ইহার গতি অবরোধ করাতে তাহার সলিল ফেনিল ও অতি বেগবান হইয়াছে। অনন্তর আমরা ২০শে সেপ্টেম্বর দিবসে লণ্ডননগরে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। উহা অতি অরমণীয়, উহার হাট বাজারে লোকারণ্য, উহার শকট সমুদয় বৃহৎ ও কুৎসিত, এবং উহ সহস্র সহস্র কার্য্যালয় ও বিলাসাবাসপূর্ণ হওয়াতেও তথায় আসিয়া অন্তঃকরণে এক অননুভূতপূর্ব্ব ভাবের উদয় হইল, সেভাব কেবল পূর্ব্ব-পরিচিত চির-বিরহিত বান্ধব সন্দর্শনে উপজিয়া থাকে।