চতুর্থ অধ্যায়।

লণ্ডন নগর; ১৮৬৯ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর হইতে ১৮৭০ সালের ১৫ই জুন পর্য্যন্ত।

 সে দিন এমন ঘন কুজ ঝটিকাজালে লণ্ডন নগর আচ্ছন্ন হইয়াছিল যে, চারি হস্ত দূরস্থ কোন পদার্থই দেখিতে পাওয়া যায় নাই, এমন কি পথের এক ধার হইতে অন্য ধারে যাওয়া কঠিন হইয়াছিল। গৃহে প্রত্যাগমন কালে আমরা পথভ্রান্ত হইয়াছিলাম। কিয়ৎ হস্ত দূরস্থ আলোকও নয়নগোচর হয় না এবং কুহা ও তিমিরজাল জড়িত গ্যাসদীপের নিস্তেজ জ্যোতিঃ অতি নিকটবর্ত্তী হইলেই ক্রমশঃ নয়নগোচর হয়।

 * * * * * *

 বিগত ৫।৬ দিবস পর্য্যন্ত অতি প্রচণ্ড শীতের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে, প্রায় প্রতিদিন বরফ পড়িতেছে, এবং পথ ঘাট গৃহ বৃক্ষাদি সমস্তই শ্বেতবর্ণ ধারণ করিয়াছে। সরসীর জল জমিয়া গিয়াছে ও তদুপরে কত লোকে যাতায়াত ও খেলা করিতেছে। মনে মনে ভাবিয়া দেখুন একটা অতি বৃহৎ জলাশয় বরফে জমিয়া দৃঢ় হইয়াছে ও শত শত লোক লোহার জুতা পরিয়া কখন সমান ভাবে কখন গোলাকারে কখন বা বক্র ভাবে বরফ কাটিয়া বেগে পরিভ্রমণ করিতেছে। তাহাদিগের গমনের বেগ ও কৌশল দেখিলে চমৎকৃত হইতে হয়। শুনিলাম কয়েক বৎসর পূর্ব্বে একটা সরোবরের জল এইরূপে জমিয়া গিয়াছিল ও তাহার উপর অনেক লোকে এই প্রকার খেলা করিতেছিল, অকস্মাৎ সেই বরফক্ষেত্র ভাঙ্গিয়া যাওয়াতে প্রায় তিন শত মনুষ্য জলমগ্ন হইয়া কালকবলে পতিত হইয়াছিল। তথাপি সকলে এই খেলায় এত আসক্ত যে, যে ব্যক্তি সেই দিবস ডুবিয়া মরিতে মরিতে অতি কষ্টে জীবন রক্ষা করিয়াছিল, সেই কহিয়াছিল যে, যদি দুর্ঘটনার পর দিন আবার জল জমিয়া যাইত, সে অবশ্যই আবার খেলা করিতে গমন করিত।

 তুষারপাত দেখিতে অতি সুন্দর; সমস্ত নভোমণ্ডলে যেন রৌপ্যখণ্ড ভাসিয়া বেড়ায় ও ধীরে ধীরে ধরাভিমুখে পতিত হইতে থাকে।

 * * * * * *

 পূর্ব্বকালে ইংলণ্ডের লর্ডসম্প্রদায়ের (aristocracy) লোকেরা শান্তির সময় ব্যবস্থাপক ও যুদ্ধবিগ্রহের সময় সেনাধ্যক্ষ হইতেন। সে কালে কাযে কাযেই তাঁহারা সম্মান-ভাজন হইতেন; কিন্তু সে কাল আর নাই। তাঁহাদিগের ক্ষমতা ক্রমে হ্রাস প্রাপ্ত হইতেছে, তথাপি সাধারণ লোকে তাঁহাদিগকে পূর্ব্ববৎ সম্মান করিতে ত্রুটি করে না এবং মধ্যম শ্রেণীর লোকাপেক্ষা সামাজিক প্রভুতায় ও চিত্তৌৎকর্ষ বিষয়ে তাঁহারা অপকৃষ্ট হইয়া ও ইংলণ্ডের মধ্যে শ্রেষ্ঠবংশীয় বলিয়া আদৃত হইয়া আসিতেছেন। এই অপকৃষ্টতার কারণ দুষ্প্রাপ্য নহে। মধ্যবর্ত্তী লোকেরা এমত অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করে যে, তাহাদের পরিশ্রমী ও যত্নশীল না হইলে চলে না। আপন আপন অবস্থা উন্নত করিতে ও যশখ্যাতি লাভ করিতে তাহাদিগকে পরিশ্রম করিতে হয়। তাহাদিগের অভ্যুদয়াকাঙ্ক্ষাও আছে এবং তাহারা যে অবস্থায় লালিত পালিত হয়, তাহা আলস্য ও ঔদাস্তের অবস্থা নহে। এদিকে উচ্চবংশীয় লোকেরা ধন মান লইয়া জন্ম গ্রহণ করেন, এবং তন্নিমিতেই নির্ব্বোধ লোকের পূজনীয় হয়েন। যেরূপ কর্ম্ম কার্য্য ও ভাবনা চিন্তা থাকিলে চিত্তের উৎকর্ষতা সম্পন্ন হইতে পারে, তাহা তাহাদের নাই; কেবল অর্থ ও অভিমান আছে। অতএব ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে যে, তাঁহারা ধনাধিক্য ও বিলাস-পারিপাট্য ব্যতীত আর সকল বিষয়েই মধ্যমশ্রেণীয় জনাপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট। উচ্চবংশীয়েরা বুঝিয়াছেন যে, তাঁহাদিগের প্রভুত্ব দিন দিন খর্ব্ব হইয়া আসিতেছে ও আর্য্য সভার আর পূর্ব্ববৎ ক্ষমতা নাই; কিন্তু তাহা জানিয়া কি করিবেন এবং যে সাধারণ উন্নতি ও স্বাধীনতা ইউরোপে দিন দিন বৃদ্ধি পাইয়া লোকের হিতসাধন করিতেছে, তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াই বা কি করিবেন? তাঁহারা অগত্যা বাহ্য সম্মানে সন্তুষ্ট হইতেছেন। ইংলণ্ডের সর্বোচ্চশ্রেণীর কথা এই পর্য্যন্ত বলিয়া সর্ব্বনিম্নশ্রেণীস্থ অর্থাৎ শ্রমোপজীবী লোকদিগের কথা কিছু বলিতেছি। আমি আপনাকে বারম্বার বলিয়াছি যে, এক জন বিদেশীয় লোক ইংলণ্ডে আসিলে সর্ব্বত্রেই স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বনের ভাব জাজ্জ্বল্যমান দেখিয়া চমৎকৃত হয়। ইংলণ্ডীয় ভৃত্য ও শ্রমীদিগেরও সাতিশয় আত্মমর্য্যাদা ও স্বাধীনতা আছে, তন্নিমিত্তে প্রভু ভৃত্যের প্রতি এত সদ্ব্যবহার করিয়া থাকে যে, পূর্ব্বদেশে কেহ সেরূপ দেখে নাই ও শুনে নাই। এখানকার ভৃত্যগণ ভক্তি সহকারে উত্তমরূপে কার্য্য করিবে, কিন্তু তোষামোদ বা ন্যূনতা স্বীকার করিবে না; কারণ তোষামোদ তাহার চুক্তির মধ্যে নাই।

 এই স্বাধীনতা তাহাদিগের অনেক সদ্‌গুণের প্রসূতি স্বরূপ হইয়াছে। কারণ অতি কঠিন দুষ্পালনীয় নিয়মবলীর কিঞ্চিন্মাত্র অন্যথচার হইলেই যদি দণ্ড প্রাপ্ত হইতে হয়, তবে লোকে শাস্তির ভয়ে অগত্যা মিথা বলিতে ও ওজর করিতে শিখে। মিথ্যা, চাতুরী ও ভীরুতা, পরাধীনতার সহচর; সত্য, সারল্য ও সাহস স্বাধীনতার সঙ্গী।

 কিন্তু এই সমস্ত সদ্‌গুণ থাকাতেও ইংলণ্ডীয় নিম্ন-শ্রেণীস্থ লোকদিগের চরিত্র কতিপয় বিষম দোষে দূষিত। তাহাদিগের মব্যে সুরাপান ও কলত্র-পীড়ন অত্যন্ত প্রবল, তাহাদিগের স্বাধীনতা অনেক সময়ে উগ্রতায় পরিণত হয়, এবং অমিতব্যয়িতা জন্য তাহারা দরিদ্রতা-নিবন্ধন মহা ক্লেশ ভোগ করিয়া থাকে। ইংলণ্ডের মধ্যে ইহারাই কেবল অশিক্ষিত এবং স্ব স্ব অবস্থার শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিতে অসমর্থ, তন্নিমিত্তে ইংলণ্ডীয় সকল শ্রেণীস্থ লোকদিগকে শিক্ষাদান করণোদ্দেশে নানা উপায় অবলম্বিত হইতেছে।

 বিদ্যা ও বিষয়-বোধাভাবে এই সকল লোকদিগের মধ্যে যে যে দোষ জন্মিয়াছে, তন্মধ্যে অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া দারপরিগ্রহ করা এক অতি প্রধান দোষ। ইংলণ্ডে উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর লোকের আত্মাভিমান থাকাতে তাহারা স্ত্রী পরিবারের সমুচিত ভরণ-পোষণের উপায় অগ্রে না করিয়া উদ্বাহ-শৃঙ্খলে বদ্ধ হয় না। নীচ লোকের মধ্যে এ বুদ্ধি নাই, সুতরাং তাহার তন্নিমিত্তে বিষময় ফল ভোগ করে। লণ্ডন নগরের যে শ্রমী বহুপরিবার-বেষ্টিত, সে উচ্ছৃঙ্খলস্বভাবাপন্ন হইলে তাহার পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা কোন্ পাষাণহৃদয়কে বিদীর্ণ না করে? তাহাদিগের বাসস্থলে প্রবেশ করিলে দেখা যায়, একটা ধূম-কলুষিত অপ্রশস্ত পথের পার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র ঘরে এক পরিবারস্থ অনেক গুলি লোক একত্রিত হইয়া রহিয়াছে;—বৃদ্ধ মাতা পঞ্চদশবর্ষীয়া যুবতী কন্যা হইতে ক্রোড়স্থ শিশু-সন্তান পর্য্যন্ত লইয়া সেই অতি ক্ষুদ্র জঘন্য ঘরটিতে ঘেষাঘেষি করিয়া বসতি করিতেছে; কাচের ভগ্ন কবাট প্রচণ্ড শীতানিল নিবারণে অসমর্থ, অতি প্রয়োজনীয় আহার, অত্যাবশ্যক বস্ত্র, ও সুখসেব্য বহ্নি অভাবে তাহারা যে বিসদৃশ দুঃখভোগ করে, তাহা অস্মদ্দেশীয় নিতান্ত নিঃস্ব লোকের দ্বারের নিকটেও যাইতে পারে না। কিরূপে সেই বৃহৎ পরিবার প্রতিপালন করিবে, তাহা ভাবিয়া গৃহস্বামী দশ দিক শূন্যময় দেখে। এবং ক্রমাগত এইরূপ দরিদ্রতা নিবন্ধন কষ্টভোগ করিয়া তাহার হৃদয় পাষাণ সমান হইয়া উঠে ও সে আপন গৃহে সুখ না পাইয়া অন্যস্থানে সুখাম্বেষণে গমন করে। সে স্থান কোথায়? কেন, লণ্ডন নগরেতে সুরাপানের স্থানের অভাব নাই; সে স্থান গ্যাসের আলোকে সমুজ্জ্বল, তথায় উত্তম আসন আছে ও সুখসেব্য বহ্নি আছে। সেই খানে দীনদুঃখী মজুরগণ মদ্যপান করিতে আকৃষ্ট হয়, ও দৈনিক অল্প উপার্জ্জন হইতে চিন্তানিবারিণী সুরাপানে কিছু কিছু ব্যয় করে, এবং ক্রমে গৃহত্যাগী হইয়া প্রকৃত মাতাল হইয়া উঠে। তাহার পর কি করে? আহা! যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড করে, তাহা বর্ণনা করাই দুঃসাধ্য; সুরাপান করিলে মনুষ্যের হৃদয়স্থ সমস্ত পৈশাচিক প্রবৃত্তি উত্তেজিত হয়। নিরন্না স্ত্রী ও ক্ষুধার্ত্ত সন্তানগণের হৃদয়-বিদীর্ণকারী হাহাকার শব্দে বিরক্ত ও জ্বালাতন হইয়া সুরাপানোন্মত্ত গৃহস্বামী বিষম নির্দ্দয়তা প্রকাশ করিতে আরম্ভ করে; এই সকল গৃহে মৃত্যু সতত অতিথি। কুপরিচ্ছদ ছোট ছোট বালকবৃন্দ ভাবি সাংসারিক সুখে জলাঞ্জলি দিয়া পথের ভিখারী হইয়া পথিকগণের নিকট দুই এক পয়সা, ভিক্ষা পাইয়া প্রদীপ্ত জঠরানল কথঞ্চিৎ নির্ব্বাণ করে।

 যাহা বর্ণনা করিলাম, তাহা অত্যুক্তি জ্ঞান করিবেন না, তবে এই মাত্র বলা উচিত যে, লণ্ডনের সকল মজুরেরা এরূপ নহে। তাহাদিগের মধ্যে যাহারা অতি মন্দ, উল্লিখিত বিবরণে তাহাদিগকেই লক্ষ্য করা গিয়াছে।

 পল্লীগ্রামস্থ শ্রমীগণের অবস্থা কিছু ভাল, তাহাদিগের মধ্যে সুরাপান যে নাই, এমন কথা বলা যায় না। তবে তাহা তত অধিক নহে, এবং নগরের লোক তাহাতে আসক্ত হইয়া যে পরিমাণে পরিবারের সুখ দুঃখ নিরপেক্ষ হয়, পল্লীগ্রামস্থ লোকের কোন ক্রমেই তদ্রূপ হইতে পারে না। তথাকার কোন ভবনে যদৃচ্ছাক্রমে প্রবেশ করিলে, যাহা দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা লোচনানন্দদায়ক সন্দেহ নাই। দেখা যায়, মাতা সন্তানগণ লইয়া অবিসম্বাদে বাস করিতেছে, এবং দীনভাবাপন্ন হইলেও বালক বালিকাগণের আস্যদেশ স্বাস্থ্যজনিত সুরঙ্গে রঞ্জিত রহিয়াছে। তাহারা সচরাচর রুটি ও পনির এবং সপ্তাহ মধ্যে দুই কি তিন দিন মাত্র মাংস খাইতে পায়। ইংলণ্ডের কোন বোন স্থানে পল্লীগ্রামস্থ কৃষকপত্নীগণ একটা শূকরশাবক ক্রয় করিয়া তাহাকে যত্নে প্রতিপালন করে, এবং যখন সে বিলক্ষণ হৃষ্টপুষ্ট হয়, তখন তাহাকে বধ করিয়া তাহার মাংস সযত্নে রাখিয়া দেয়, এবং সময়ে সময়ে তাহা হইতে এক এক ক্ষুদ্র টুকরা কাটিয়া লয়; এই মতে একটা শূকরশাবক সমস্ত পরিবারকে বর্ষাবধি মাংস যোগাইয়া থাকে, এতদ্ভিন্ন তাহারা প্রায় অন্য মাংস ক্রয় করিতে পারে না। ইংলণ্ডের ভূস্বামীরা অস্মদ্দেশীয় ভূম্যধিকারীগণ অপেক্ষা সুশিক্ষিত ও ভাল লোক বলিয়া বিপৎকালে প্রজাগণ তাহাদিগের সাহায্য ও আনুকূল্য প্রার্থনা করে, এবং তাহাদিগের প্রার্থনা প্রায়ই নিষ্ফলা হয় না। প্রতি রবিবারে সুবেশ গ্রাম্য লোক ও তাহাদিগের বিকসিত-কুসুম-সদৃশ কন্যাগণকে ভূস্বামী সহ গির্জা ঘরে সমবেত হইতে দেখা যায়। তাহা দেখিলে তন্তঃকরণে বিশুদ্ধ সুখের সঞ্চার হইয়া থাকে।

 * * * * * *

 সে দিন অক্‌সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণের বাইচ খেলা দেখিতে গিয়াছিলাম। যাঁহারা এরূপ বাইচ খেলা স্বচক্ষে দর্শন না করিয়াছেন,তাঁহারা অনুভব করিতে পারিবেন না যে, ইংলণ্ডের লোকেরা এই বাৎসরিক পর্ব্বে কি পরিমাণে আমোদ ও উৎসাহ প্রকাশ করে। এই কার্য্যোপলক্ষে টেম্‌স নদীর উভয় কূলে দৃষ্টিপথ পর্য্যন্ত কেবল মনুষ্যারণ্য ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। নৌকা সকল সঙ্কীর্ণ ও সুদীর্ঘ করিয়া নির্ম্মাণ করে—এবং তীরসদৃশ বেগে জলের উপর দিয়া তর্‌তর্ শব্দে যেন উড়িয়া যায়। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ উপরি উপরি নয় বৎসর পরাজিত হইয়া এবার জয়লাভ করিয়াছে।

 * * * * * *

 এদেশে সাধারণের হিতকার্য্য যে, কত প্রকারে সম্পাদিত হয়, তাহা কিরূপে জানাইব? এক লণ্ডন নগর মধ্যে দরিদ্র-শালায় প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার লোক প্রতিপালিত হইতেছে। তদতিরিক্ত অগণ্য অনাথ-নিবাস ও চিকিৎসালয় আছে। ইংলণ্ড দেশ সর্ব্ব দেশ অপেক্ষা ধনশালী এবং তাহার বদান্যতাশক্তি ঈদৃশী যে, তুলনায় কেবল আমেরিকা তাহার সমতুল্য বলিলে বলা যায়।

 * * * * * *

 ইংলণ্ডের বদান্যতা ও বঙ্গদেশের বদান্যতা ভিন্ন প্রকার। ইংলণ্ডীয় সমাজে যে স্বাধীনতা আছে, বঙ্গসমাজে তাহা নাই। ইংলণ্ডে দানশক্তি পরিমিত ও নির্দ্দিষ্ট পথেই পরিচালিত হইয়া থাকে। বঙ্গদেশে পরোপকার গুণ অজস্র, ও দেশীয় বেগবতী নদীজলের ন্যায় সর্ব্বত্র প্লাবিত করে ও কোন প্রকার নিয়ম মানে না। ইংলণ্ডীয়েরা পর-দুঃখ দূর করিয়াই সন্তুষ্ট হয়। বাঙ্গালীরা দীন জনকে স্বজননির্বিশেষে যুগপৎ করুণা ও স্নেহ দিয়া সন্তুষ্ট করে। এক জন ইংরাজ স্বীয় দাতব্য দানাগারে প্রেরণ করিয়া নিশ্চিন্ত থাকে, বাঙ্গালীরা তদ্রূপ নয়। তাহাদিগের মধ্যে স্বধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ অতি দরিদ্র হইলেও ভিক্ষুককে মুষ্টিভিক্ষা দিতে কাতরতা অনুভব করে না, এবং অতি দূর জ্ঞাতি-কুটুম্বকেও নিজ ব্যয়ে ভরণপোষণ করিয়া থাকে। সমৃদ্ধিশালী ইংলণ্ডদেশে দারিদ্র্য নিবন্ধন যত দুঃখ ও ক্লেশ আছে, দরিদ্র বঙ্গদেশের অতি নীচ শ্রেণীর মধ্যেও তত দেখা যায় না; তাহার এক মাত্র কারণ বাঙ্গালী জাতির স্বাভাবিক দয়া ও বদান্যতা। বাঙ্গালীদিগের এরূপ স্বাবলম্বন শক্তি জন্মে নাই, যদ্দারা তাহারা প্রতিবাসীগণের সাহায্যনিরপেক্ষ হইয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে সমর্থ; সুতরাং তাহারা সততই পরস্পর পরস্পরের উপকারার্থে কার্য্য করিতে বাধ্য হয়, এবং তন্নিমিত্তে সমাজবন্ধনী সুকুমার মনোবৃত্তি সমুদায় সমধিক উৎকর্ষিত হইয়া থাকে। ইংরাজেরা স্বাবলম্বী লোক, অন্যের কি হইবে তাহা দেখে না, এবং অন্যকৃত সাহায্যও চাহে না। অগত্যা সে স্বতন্ত্র হইয়া থাকে, এবং যদি তাহাদিগকে কেহ কিছু উপকার করে, তবে তাহারা সেই উপকার নিতান্ত অসম্ভাবিত জ্ঞানে কৃতজ্ঞতার সহিত স্বীকার করে।

 * * * * * *

 সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং ভূয়সী দয়া ও পরোপকারিতা গুণ কি সম্মিলিত হইতে পারে না? আমার বোধ হয় যে, কোন জাতির স্বাধীনতাকে যথাবিহিতরূপে বিকশিত করিতে চাহিলে সামাজিক বৃত্তি সমুদায়কে কিয়ৎপরিমাণে জলাঞ্জলি দেওয়া প্রয়োজনীয়; কিন্তু এরূপ প্রয়োজন অতি শোচনীয়।

 এখানে জারজ ও অনাথ-সন্তানগণের পালনার্থে একটি গৃহ আছে। আমি তথায় সর্ব্বদাই গিয়া থাকি। এই দুঃখী সন্তানগণ মাতাকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হওয়াতে তাহারা এখানে ভরণ পোষণ ও শিক্ষা প্রাপ্ত হয়; তাহার উদ্দেশ্য এই যে, ইহারা। বয়ঃপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত হইয়া সৎপরিশ্রমের দ্বারা যথাকথঞ্চিৎরূপে স্বীয় জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিবে।

 এই গৃহের সংলগ্ন একটা গির্জা ঘর আছে, তথায় অনাথ বালকবালিকারা প্রতি রবিবারে আসিয়া উপাসনা করে। তাহাদিগের তদ্দিবসীয় পরিস্কার পরিচ্ছদ দেখিলে ও চিক্কণ স্বরে ধর্ম্মবিষয়ক গান শুনিলে সাতিশয় আনন্দ অনুভূত হয়; এবং উপাসনান্তে তাহাদিগকে একত্রে সামান্যরূপ অন্নাহার করিতে দেখিলে অধিকতর আনন্দ জন্মে। এই বিষয়ে আমি একটা কবিতা লিখিয়াছি, তাহা আপনাকে পাঠাইতেছি।


অনাথ শিশুদিগের ধর্ম্ম-সঙ্গীত।

সুন্দর পুতলী সম তোমরা সকলি।
কে দিল ত্বদীয় কণ্ঠে কোকিল কাকলী।
ধর্ম্মের সঙ্গীত গাও আধ আধ স্বরে।
স্বর্গের বালক যেন মর্ত্তের উপরে।

পাপে নহে কলুষিত শুদ্ধমতি যেই।
কিশোরের অন্তরের স্বতঃ ভাব এই।
আপনি উদয় হয় বাধা নাহি মানি।
পবিত্র অন্তর হতে যেন প্রতিধ্বনি।

সেইরূপে পাখিগণ সুমধুর স্বরে।
নিজ গূঢ় মনোভাব প্রকাশিত করে।
সেইরূপে রজনীতে কানন রসিয়া।
মনোসুখদুঃখ গায় নিকুঞ্জ মোহিয়া।

সুন্দর বালকগণ ত্বদীয় বদন।
বাসন্তী ফুলের কান্তি প্রিয়-দরশন।
যতবার দেখি আরো দেখিবারে চাই।
হেন মনোলোভা শোভা আর কোথা পাই।

কিশোরের অন্তরের ভাব যে সকল।
উজল করিছে মৃদু বদন কমল।
কখন সে মুখ-ছবি মলিন ছায়ায়।
কভু হাস্যে সমুজ্জ্বল তরুণার্কপ্রায়।

যদিচ কলঙ্ক তব জীবনে রহিবে।
সরমের জন্ম কথা হৃদয়ে জাগিবে।
যদিচ শৈশবে দুখ সমীরণ ক্রূর।
শুষ্কপ্রায় কোরেছিল জীবন-অঙ্কুর।

তথাপি দুখান্ত, জেনো হবে কিছু দিনে।
কৃপণের স্বপ্নাধিক পাইবে দ্রবিণে।
অন্বেয ধর্ম্মের কোষ সে ধনের তরে।
যাহা সে সমান ভাযে সবারে বিতরে।

সম্প্রতি আর একটি কবিতা লিখিয়াছি, তাহাও আপনাকে পাঠাইতেছি।


পিতার সমাধি স্থান।

তিমির বসন পরি রজনী আসিল।
দলে দলে বিহঙ্গম নীড়ে প্রবেশিল।
মেষ পালে শোভা পায় পর্ব্বত-শিখর।
পড়িছে সন্ধ্যায়, তথা, শিশিয় শীকর।
শব্দমাত্র নাহি আসে শ্রষণ-কুহরে।
নিদ্রাযোগে প্রাণিগণ শ্রম দূর করে।
অনন্তর দেখি এক সমাধির স্থল।
সন্ধ্যার তারক উদি করিল উজ্জ্বল।

নিকটস্থ তরু-তলে হেরি তার পর।
আলিঙ্গিত স্নেহভাবে ভগ্নী-সহোদর।
তরুণ অরুণ অতি সুন্দর যেমতি।
মৃদু ভাবে তারা দুটি সুন্দর তেমতি।
নবমবর্ষীয়া কন্যা হবে কি না হবে।
সম্যক জ্ঞানের দীপ্তি কভু না সম্ভবে

কনিষ্ঠ তাহার ভ্রাতা উজ্জ্বলবদন।
শিশু শশি সম অতি মূরতি মোহন।

সুধাংশু উদয় হলে নিকুঞ্জ কাননে।
কাঁদে যথা পরীকন্যা সকরুণ স্বনে।
সেই রূপ জ্ঞান হয় এই বালিকায়।
কিম্বা হবে দেবকন্যা উদিত ধরায়।
প্রহরীর সম রয় এ সমাধিস্থলে।
দীন-ভাব প্রকাশিছে নয়ন-কমলে।
তাহার আনন চারু করুণা-নিধান।
এ স্থানের যোগ্যা সেই, তার যোগ্য স্থান।

তরু অন্তরালে বালা দাঁড়াইয়া থাকি।
আকাশের দিকে চায় ফিরাইয়া আঁখি।
বাষ্পসমাকুল তার চারু নেত্রদ্বয়।
ভক্তিরসে প্রেমরসে বিগলিত হয়।
হোতেছে রজনী ক্রমে তিমির-আবৃত।
স্বনস্বনে শীত বায়ু হয় সঞ্চালিত।
চিত্র-পুত্তলিকা-প্রায় আছে দাঁড়াইয়া।
তমোময় আকাশের পানে নিরখিয়া।

দাঁড়ায়ে নিকটে আছে শিশু সুকুমায়।
স্নেহ আলিঙ্গনে বদ্ধ স্বীয় সোদরায়।
শিশু ভ্রাতা চাহে সদা ভগ্নী মুখ-পানে।
সে তোষে ভ্রাতার মন ভালবাসা দানে।
আহা এ জগতে আর এমন কি আছে,
তুলনায় তুল্য হয় এ ভাবের কাছে?
অনাথারে করিবারে প্রীতি-অর্ঘ্য দান।
প্রিয় ভগ্নী সম কেবা স্নেহের নিধান।

নিশির শিশির-সিক্ত প্রভাত কমল।
তদুপম সে শিশুর বদন উজ্জ্বল।
হেরে ভগিনীর মুখ সতৃষ্ণ নয়নে।
আরো ধীরে ধীরে যায়,তার অঙ্ক পানে।
সোদর সোদরা দোঁহে করয়ে ক্রন্দন।
উভে মিলি করে ঈশ্বরের আরাধন।
কেন কাঁদে নাহি জানে অজ্ঞান সোদর।
না জানে যে পিতা এবে ত্যক্ত কলেবর।

প্রেম ভরে করে বালা পুষ্প বরিষণ।
সমাধির স্থানোপরি করিয়া যতন।
প্রতি রাত্রি বন-পুষ্প করিয়া চয়ন।
সাজায় সমাধিস্থল করিয়া যতন।
মোছাইল সোদরের সজল নয়ন।
দোঁহে করে পরস্পর স্নেহ-আলিঙ্গন
পর ঘরে যায় ফিরে স্নেহার্দ্র অন্তর।
অন্ধকারে ঢাকে নিশা নিজ কলেবর।

 * * * * * *

 একদা আমি অবৈতনিক সৈন্যদিগের যুদ্ধ-কৌশল দেখিবার মানসে ব্রাইটন নগরে গিয়াছিলাম। সেনাগণ দুই দলে বিভক্ত হইল। একদল সদ্যাগত আক্রমণকারী, অপর দল রক্ষকের ভাবাবলম্বন করিল। তিন ঘণ্টা পর্য্যন্ত তুমুল সংগ্রাম হইল, পরে আক্রকণকারীরা তাড়িত হইয়া ক্রমে সমুদ্র-তীর পর্য্যন্ত পশ্চাদ্ধাবিত হইল ও পরিশেষে পরাজয় স্বীকার করিল। এই কৃত্রিম যুদ্ধ-ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিলে প্রকৃত যুদ্ধ কি প্রকারে হইয়া থাকে, তাহা বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম হয়। এবং আমি এই সমস্ত বিগ্রহ ব্যাপার অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত সন্দর্শন করিয়াছিলাম। ব্রাইটন সমুদ্রকূললর্ত্তী একটি অতি সুন্দর নগর, এবং তথাকার সমূদ্রকূলের নিকটস্থ অট্টালিকা সকল প্রাসাদের ন্যায় সুনির্ম্মিত। ইংলণ্ডীয় উপকূলস্থ সমস্ত নগরের মধ্যে ব্রাইটন নগর সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ ও সুরম্য স্থান এবং নির্দ্দিষ্ট সময়ে তথায় মহা লোকারণ্য হইয়া থাকে। এই সময়ে তথাকার জাঁকজমক শোভাসৌন্দর্য্য, আমোদপ্রমোদ, মধুর বাদ্যোদ্যম, সুশোভন শকটের ঘর্ঘর শব্দ ও অগণ্য বিলাসাবাস দেখিলে ও শুনিলে নবাগত ব্যক্তিমাত্রেরই এই প্রতীতি জন্মে যে, ইহাই সর্ব্বোত্তম রমণীয় স্থান ও ভোগ-বিলাসের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নিকেতন। এমন কি নন্দনকানন বলিলেও বলা যায়।

 * * * * * *

 ব্রাইটন হইতে সমুদতীরস্থ অতি সুন্দর ওয়ারদিং নগরে এবং তথা হইতে আরণ্ডেল নগরে গেলাম, এবং তথাকার অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গ সন্দর্শন করিলাম। প্রহরীস্তম্ভ হইতে চতুর্দ্দিকস্থ নানা স্থান নয়নগোচর হইল। তথা হইতে ওয়াইট নামক দ্বীপে উপস্থিত হইলাম। ইহা ইংলণ্ডের উপবন বলিয়া বর্ণিত হয়, কারণ তথায় উদ্ভিদগণ সতেজে জন্মে এবং পল্লীগ্রামস্থ সমস্ত শোভাই দেখিতে পাওয়া যায়। তথাকার অন্যান্য কতিপয় গ্রাম দেখিয়া লণ্ডন নগরে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম।

 * * * * * *

 জুন মাসের প্রথম দিবসে আমরা ডর্‌বি নগরস্থ ঘোড়াদৌড় দেখিতে গিয়াছিলাম। সামান্যতঃ যেরূপ ঘোড়াদৌড় হইয়া থাকে, ইহা তদপেক্ষা কিছুই ভাল নহে; কিন্তু লোকে তাহাতে যে কি পরিমাণে আমোদ ও ঔৎসুক্য প্রকাশ করিয়া থাকে, তাহা বর্ণনা করিলে বোধ হয় কেহই বিশ্বাস করিবে না। ইংলণ্ডের সকল লোকে ইহাকে এক মহোৎসব জ্ঞান করে এবং এমন কেহই নাই যে, তাহাতে যৎপরোনাস্তি উল্লাস প্রকাশ না করে। এই আমোদ দেখিতে যে কত লোক সমবেত হয়, তাহা গণনা করিতে শুভঙ্করের সাধ্য নাই; কিন্তু সকল লোকেই যে ঘোড়াদৌড় দর্শনাভিলাষে আসে, এমত নহে; একদিন আমোদ করাই বিস্তর লোকের উদ্দেশ্য। লণ্ডন ও ডর্‌বি নগরের মধ্যে রেলের গাড়ি প্রতি ঘণ্টায় যে কত বার গমনাগমন করে, তাহার ইয়ত্তা হওয়া কঠিন এবং ডর্‌বি নগরে যাইবার পথ নানাবিধ শকটে একরূপ রুদ্ধ হইয়া যায়। এ সময় ইংরাজেরা স্বাভাবিক মৌনভাব পরিহার করিয়া যার পর নাই আমোদ করিয়া থাকে, এবং তাহাদিগের সে সময়ের পরিষ্কার পরিচ্ছদ ও পুলক-প্রফুল্ল সহাস্য বদন সন্দর্শন করিলে দর্শকের হৃদয় আহ্লাদে পরিপূর্ণ হয়। ইতর আমোদেরও অভাব নাই। পুরুষেরা মুখস মুখে দেয়, কৃত্রিম নাসিকা প্রস্তুত করে, পথিকগণের প্রতি মটর ছুটায়, এবং বালকের নানা মূর্ত্তির সং সাজিয়া বেড়ায়। সে দিবস এবম্বিধ অমোদেই অতিবাহিত হইয়া যায়।

 * * * * * *

 ইংলণ্ডের পল্লীগ্রাম না দেখিয়া বিদেশীয়গণ যেন তদ্দেশ পরিত্যাগ না করেন। আয়র্‌লণ্ড যাইতে যাত্রা করিয়া পথমধ্যে আমি একজন জমিদারের সহিত তদীয় গ্রাম্য আবাসে কয়েক দিবস যাপন করিয়াছিলাম। এবম্বিধ স্থান নিতান্তই দর্শনোপযুক্ত। পরিষ্কার ও সুগঠন গৃহ, পরিসর বারাণ্ডা ও নিকটস্থ সুন্দর উপবন ও ক্ষেত্র, সুন্দর সরোবর ও সুশীতল ছায়াতম নিবিড় বিপিন, দুরশৈলমালাবেষ্টিত অবিচ্ছিন্ন দর্শন, পাদপাচ্ছাদিত পথ, ও হরিণ-যূথালঙ্কৃত বিস্তৃত ক্ষেত্র, সুরভি-বনকুসুম-শোভিত তরুরাজী, সুন্দর কুটার, সুগঠন গির্জা ঘর, এ সকল দেখিতে কেনা অভিলাষী হয়? কিন্তু কেবল ইহাও নহে; পল্লীগ্রামস্থ ইংরাজেরা ভিন্ন ও অভিনব প্রকৃতি অবলম্বন করে। লণ্ডন নগরের সমাজিক কঠিন নিয়মের নিগড় না থাকাতে তাহারা পল্লীগ্রামে স্বাধীন ও স্বেচ্ছানুরূপ ব্যবহার করে, ও পরের সঙ্গে উদার চিত্তে আমোদ প্রমোদ করে। জমীদারদিগকে দীনভাবাপন্ন গ্রামবাসিদিগের সহিত স্বাধীন, এমন কি সপ্রেমভাবে, মিলিত হইতে ও তাহাদিগের গৃহ, ভূমি ও বৎসরের ফলাফল প্রভৃতি নানাবিষয়িণী কথা স্নেহগর্ভ বচনে জিজ্ঞাসা করিতে এবং আপৎকালে ত্রাণার্থে করপ্রসারণ করিতে দেখিলে চিত্ত যথার্থই পুলকিত হয়। গ্রাম্য বালিকারা, ভূস্বামীর কলত্র ও কন্যাগণকে ভক্তিভাবে ভালবাসে এবং তাঁহারাও সদয়ভাবে তাহাদিগের সহিত কথাবার্ত্তা কহেন। অকপট ও সসম্ভ্রম ভক্তি দ্বারা সে আলাপ মধুর করে, এবং সময়ে সময়ে সেই আলাপ সোদরা-স্নেহে পরিণত হইয় উঠে।

 এখানকার রবিবার নিতান্তই শান্তিপ্রদ। যে ব্যক্তির কণামাত্র বাৎসল্য গুণ আছে, প্রফুল্লানন ও সুবেশ গ্রাম্য স্ত্রীপুরুষদিগকে স্ব স্ব ক্ষুদ্র ভবন হইতেও বহির্গত হইতে গ্রাম্য গির্জাভিমুখে যাইতে দেখিলেও তাঁহার হৃদয়কেন্দ্র লোকপ্রিয়তা রসে প্লাবিত হয়। ভূস্বামীকে সপরিবার যাইতে দেখিলে গ্রামবাসিগণ সসম্ভ্রমে নমস্কার করে ও তাহাদিগের আর্য্যগণেরাও সস্মিতমুখে তাহা স্বীকার করিতে কৃপণতা করেন না। উপাসনার কার্য্য সম্পূর্ণ হইলে ভূস্বামীর ভবনে গ্রাম্য বালক-বালিকাদিগকে সমবেত হইতে এবং সেই দিবস এক উৎসব-দিনের ন্যায় অতিবাহিত হইতে দেখা যায়।