পঞ্চম অধ্যায়।

আয়ার্লণ্ড ও ওয়েল্‌স; ১৮৭০ সালের ১৫ই জুন হইতে ১৫ই জুলাই পর্য্যন্ত।

 আমি আয়ার্লণ্ড দেশে যাওয়ার বিষয় সংক্ষেপে বলিতেছি। ১৫ই জুন দিবসে লণ্ডন হইতে বহির্গত হইয়া ও কিয়ৎকাল বার্কশিয়রে থাকিয়া আইরিস সাগর পার হইলাম, এবং ঐ মাসের ২১শে দিবসে আয়র্লণ্ডের রাজধানী ডব্‌লিন নগরে পেছিলাম। এই নগর অতি সুদৃশ্য, এখানে এক বিশ্ববিদ্যালয় ও সুন্দর উদ্যান আছে। লিফি নাম্নী নদী ইহার নীচে দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। এই নদী অতি অপরিষ্কার। ডবলিনের অনতিদূরে কিংষ্টন নামক সমুদ্রতীরস্থ নগর ডবলিনবাসিদিগের আমোদ প্রমোদের স্থান; সমুদ্রকুলস্থিত নগরমাত্রেরই নানাবিষয়িণী চারুতা আছে। এখানে বৃদ্ধ ও রুগ্নগণ স্বাস্থ্যলাভ করিতে আইসে; এখানে ছাত্রবৃন্দ ও শ্রমোপজীবী লোক বিশ্রাম ও অবকাশের দিবস সুখে যাপন করিতে আইসে; এখানে যুবকযুবতীগণ ব্যস্তসমস্ত বহুজনাকীর্ণ নগরের কঠিন সামাজিক নিয়মাবলী পরিত্যাগ করিয়া আমোদ প্রমোদ করিতে আইসে।

 অনন্তর আমরা রেলগাড়িযোগে জগদ্বিখ্যাত জায়ণ্টস্ কজ্‌ওয়ে দেখিতে গেলাম। শিলাময় ভূখণ্ড সমুদ্রমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। স্কট লণ্ডের ফিন গালের গহ্বর যে প্রকার প্রস্তরে নির্ম্মিত, এখানকার প্রস্তরের গঠন প্রায় তদ্রূপ। ইহার স্তম্ভ সকল তিন হইতে নয় কোণবিশিষ্ট, তার এমন সৌষ্ঠবান্বিত যে, দেখিলে বোধ হয় যেন বাটালি দ্বারা পরিষ্কৃত হইয়াছে। ভীষণনাদী আট্‌লাণ্টিক মহাসাগর এই সকল স্তম্ভকে তরঙ্গাস্ত্র দ্বারা প্রচণ্ড পরাক্রমে অবিরাম প্রহার করিতেছে, কিন্তু কিছুই করিতে পারে নাই। অদূরে অনেক গুলা গহ্বর আছে, কিন্তু তন্মধ্যে কোনটা ফিন গালের গহ্বর তুল্য সুন্দর নহে।

 এস্থান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিবার সময় ডনলুস্ নামক দুর্গ সন্দর্শন করিলাম, ইহা সাগর-প্রবিষ্ট প্রকাণ্ড গিরির উপর নির্ম্মিত। এই দুর্গের যেরূপ স্থিতি, তাহা দেখিলে ভয় হয়; সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ ইহার তিন দিকে চিরকাল প্রহার করিতেছে, তথাপি ইহার কিছুই হয় নাই। পূর্ব্বকালে চারিদিকেই সমুদ্র ছিল, কিন্তু এক দিক হইতে সমুদ্রবারি অপসারিত হইয়াছে।

 না জানি পূর্ব্বকালে এই দুর্গের যৌবনাবস্থায় ইহা রাজা ও আর্য্য লোকদিগের কতই আমোদপ্রমোদের স্থান ছিল, এখানে কতই যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাত হইয়াছিল। অনন্তর পুরাবৃত্ত-প্রসিদ্ধ লণ্ডন্‌ ডবী নগরীতে আসিলাম; দেখিলাম তথায় ওয়াকারের স্মরণার্থ স্তম্ভ আছে, এই সাহসিক বীর পুরুষই এই নগরাবরোধের সময়ে তাহার পরিরক্ষণ সাধন করিয়াছিলেন ও অকুতোভয়ে ভগ্নচেতা অবরুদ্ধ ব্যক্তিদিগকে অভয় দান করতঃ তাহাদিগের আশু দুর্দ্দিনাবসানের ভবিষ্যদ্বাণী বলিয়াছিলেন; সেই দুঃসময় কিছু বিলম্বে অবসান হইয়াছিল এবং পরিশেষে সেই নগর রক্ষা পাইয়াছিল। আমর সেই স্তম্ভের উপর আরোহণ করিয়া ওয়াকারের প্রতিমৃর্ত্তি দেখিলাম, যেন তিনি হস্ত প্রসারণপূর্বক ক্ষুপিপাসা-পীড়িত লোকদিগকে সগর্ব্বে কহিতেছেন যে, তোমাদের দুঃখের দিন অপমান হইতেছে। এই স্থানে ভ্রমণ করিতে করিতে উল্লিখিত অনধিকৃত দুর্গের বর্ণনা যাহা মেকালি কর্ত্তৃক বর্ণিত হইয়া, তাহাই কেবল মনোমধ্যে জাগিতে লাগিল।

 লণ্ডন্‌ডরি হইতে এনিস্‌কিলেন নগরে গেলাম। এই নগর আয়র্লণ্ডের অধিকাংশ নগরের ন্যায় অতি অপরিস্কার, কিন্তু ঐ নগর যে হ্রদের তটে আছে, তাহ অতি সুন্দর; তাহার নাম অরণ। ঐ হ্রদে অনেকক্ষণ নৌকায় বেড়াইয়া একটা ক্ষুদ্র দ্বীপে অবতীর্ণ হইলাম।

 এনিস্‌কিলেন নগর ত্যাগ করিয়া আথলোন নগরে গেলাম। কবিবর ওলিবর গোল্‌ডস্মিথ বিরচিত সুললিত কাব্যে যে আবরণ গ্রামের উল্লেখ আছে, তাহাও পুলক সহকারে দর্শন করিলাম।

 ইংলণ্ড, স্কট্‌লণ্ড ও আয়র্লণ্ড মধ্যে সানন নদ সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ। এই নদের উপর আথলোন নামক নগর। আমরা তথা হইতে বহুজনাকীর্ণ লিমারিক নগর দেখিয়া পরে সানন নদের জলপ্রপাত সন্দর্শন করিতে গেলাম। বস্তুতঃ ইহা প্রকৃত জলপ্রপাত নহে; এখানে সানন নদের গভীরতা অতি কম এবং ইহা অতি আয়ত ও প্রস্তরময় গর্ভের উপর দিয়া ভীষণ বেগে ও কল কল শব্দে প্রবাহিত হইতেছে। চতুর্দ্দিকে বসন্তলক্ষী বিরাজিত, পাদপপুঞ্জে নদীর জল ছায়াময়, এবং ঐ জলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ প্রতিফলিত হইয়াছে। নদীর জল যেখানে সুগভীর, সেখানে অতি পরিষ্কার ও স্থির, অন্য স্থানে তাহার বেগগামী বারি ভূরি প্রস্তরখণ্ড প্রতিঘাতে বিচ্ছিন্ন ও বহুল ফেনময় হইয়া প্রবাবিত হইতেছে।

 লিমারিক হইতে আমরা কিলানির প্রকাণ্ড হ্রদ দেখিতে গেলাম। এই হ্রদ আয়ার্লণ্ডের ভূষণ স্বরূপ এবং স্কটলণ্ডের পরম সুন্দর হ্রদের তুল্য। কিয়ৎকাল শকটে ভ্রমণ করিয়া একটা অতি অরণ্যময় উপত্যকার ভিতর দিয়া অশ্বারোহণে ভ্রমণ করিলাম।

 তথা হইতে বিনির্গত হইয়া আমরা হ্রদের নিকট আসিলাম এবং এক খানি নৌকা ভাড়া করিলাম। চতুর্দ্দিকে যাহা দেখিতে লাগিলাম, তাহা বর্ণনা করা কাহার সাধ্য! কেবল এই মাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, পর্ব্বত, নদী, দ্বীপ, সাগর শাখা, ভূশাখা নিবিড়ারণ্য একস্থানস্থ হইয়া স্থল বিশেষের যে দুশ্চিন্তনীয় সৌন্দর্য্য বিধান করিতে পারে,তৎসমুদায়ই এখানে বিদ্যমান আছে। এই সকল হ্রদের চতুঃসীমায় উচ্চ পর্ব্বত থাকাতে, সেখানে একটি উচ্চ কথা কহিলে তাহা প্রতিধ্বনিত হয়। আমাদিগের পথ-দর্শকের নিকট একটা রণশিঙ্গা ছিল, সে তাহা বাজাইল, এবং পরে তিনবার তাহার প্রতিশব্দ শ্রবণ-কুহরে প্রবিষ্ট হইল, ও কোন খানে প্রতিধ্বনি শিঙ্গার শব্দাপেক্ষা সমধিক উচ্চ জ্ঞান হইল।

 আয়ার্লণ্ডের বিবরণ সমাপন করিবার পূর্ব্বে ইহাকে লোকে কেন হরিদ্বর্ণ বলে, তদ্বিষয়ে কিছু লিখিতেছি। রেলগাড়িযোগে মাঠের মধ্য দিয়া যাইবার সময় কি উত্তর, কি দক্ষিণ, কি পূর্ব্ব, কি পশ্চিম, যে দিকে নেত্রপাত করা যায়, সেই দিকেই নিবিড় শ্যামল ক্ষেত্রচয়, সেই দিকেই ঘন হরিদ্বর্ণ অটবী, সেই দিকেই দূর্ব্বাদলোপম নবোদ্ভূত উদ্ভিদরাশি নয়নকে রঞ্জন করে। অম্বেষণ করিয়া এবম্প্রকার শোভা ইংলণ্ডে দেখিতে পাওয়া যায় না।

 আয়ার্লণ্ডদেশীয় দুঃখী লোকদিগের গোল আলু একমাত্র জীবনোপায়; এবং ইহারা প্রায় কখনই কোন প্রকার মাংসাহারের সুখ সম্ভোগ করিতে পায় না। এখানে যে অসীম গোল আলুর ক্ষেত্র সমস্ত আছে, তাহা দেখিলে চমৎকৃত হইতে হয়। এখানকার পল্লীগ্রামবাসী লোকেরা নিতান্তই দুঃখী। স্বামী স্ত্রী ও সন্তানগণ গণিতে অনেকগুলি; কি রৌদ্র, কি বৃষ্টি সকল সময়েই একত্রে ক্ষেত্রে কার্য্য করে ও রাত্রিতে একখান অতীব জঘন্য কুটীর মধ্যে শূকর ও হংসসহ শয়ন করিয়া থাকে। উর্ব্বর দেশের কৃষকগণ যে অত্যন্ত নিঃস্ব ও নিরন্ন, আয়ার্লণ্ড তাহার একমাত্র দৃষ্টান্ত স্থল নহে। আমি আয়ার্লণ্ড সম্বন্ধে একটা কবিতা লিখিয়াছি, তাহা আপনাকে প্রেরণ করিতেছি।

আয়ার্লণ্ড।

সুন্দর এরিন[] তব উজ্জ্বল ভূধরে।
কতবার ভ্রমিয়াছি আনন্দ অন্তরে।
শুভ্রকান্তি কল্লোলিনী হ্রদের উপর।
বাহিয়াছি দ্রুতগামী তরি মনোহর।
কি সুন্দর উপত্যকা নদী-শোভাকর,
শৈশব-স্বপন সম মনোমুগ্ধকর।

হেরিয়াছি আভোকার সুনির্ম্মল জল।
আনন্দেতে বহিতেছে করি কল কল।
হেরিয়াছি জায়াণ্টের ভীম স্তম্ভ সার।
অনন্ত সমুদ্র যাহে করিছে প্রহার।
দন লুসের শৈল-দুর্গ কিবা ভয়ঙ্কর।
সাগর-তরঙ্গ পার্শ্বে বিকট শেখর।

ওয়াকারের বীর মূর্ত্তি যথায় শোভিছে।
অজেয় নগর যেন অদ্যাপি রক্ষিছে।
হেরিয়াছি শূন্য ক্ষেত্র তব ‘অবরণ’!
কে না কাঁদে স্মরি তব দুঃখ-বিবরণ?
শান্তভাবে হেরিয়াছি ভ্রমিয়াছি কত।
কিলাণীর হ্রদ যথা ভূধরে বেষ্টিত।

মনোহর দ্বীপ তব দেখি হীনদশা।
ভাবনা উদয় হয় মনেতে সহসা।
বিষাদে বিপদে তুমি মগ্ন হে যেমন।
বহুদূরে আছে এক প্রদেশ তেমন।

অনন্ত সাগর পারে ভারত প্রদেশ।
দরিদ্রা দুঃখিনী মাতা নাহি সুখ-লেশ।

উজ্জ্বল এরিন হায়! দ্বীপ মনোহর।
চির দুঃখে দগ্ধ হবে তব কলেবর?
পুরাতনী স্বাধীনতা গৌরব আলয়।
পুনঃ তব সুখ-রবি হবে না উদয়?
চারিদিকে বীচিমালা করে মহাধ্বনি।
শম্রকের জন্ম-ভূমি বীর-প্রসবিনী!

ত্বরিতে হইবে তব দুঃখরাশি ক্ষয়।
ত্বরিতে হইবে তব সৌভাগ্য-উদয়।
পুরাকালে ছিলা যথা হইবা তেমন।
শাস্ত্রের উজ্জল নিধি বিদ্যার ভবন।
বীর স্বাধীনতা গৌরব-আলয়।
প্রেমের নিবাস স্থান অনন্ত অক্ষয়।

 আয়ার্লণ্ড হইতে প্রত্যাগমনের সময় বৃষ্টল নগরে রাজা রামমোহন রায়ের গোরস্থান দর্শন করিলাম। রাজার স্মরণার্থ সেই গোরের উপর ভারতবর্ষীয় প্রণালীতে একটী মন্দির নির্ম্মিত হইয়াছে। বৃষ্টল হইতে ওয়েল্‌স প্রদেশের অন্যান্য স্থান দেখিতে যাত্রা করিলাম। স্নোডন নামক ওয়েল্‌সের সর্বোচ্চ পর্ব্বতশৃঙ্গ দর্শন করিলাম, ঐ পর্ব্বত ৩৫৭১ ফিট্। তথা হইতে কার্ণার্ভর ও কনোয়ে নগরের পুরাতন ও ভগ্নাবশেষ দুর্গ সন্দর্শন করিয়া ১৪ই জুলাই লণ্ডন নগরে প্রত্যাগমন করিলাম।


  1. আয়ার্লণ্ডের অন্য একটা নাম।