ষষ্ঠ অধ্যায়।


লণ্ডন নগর; ১৮৭০ সালের ১৫ই জুলাই হইতে ১৮৭১ সালের ১৪ ই আগষ্ট পর্য্যন্ত।

 যে ব্যক্তি ইংলণ্ডের সমাজ-বৃত্তান্ত নিগূঢ়রূপে অভ্যাস করিয়াছেন, তিনি জানিতে পারিয়াছেন যে, কোন্ কোন্ দলস্থ লোকেরা রাজনীতি সম্বন্ধে কি কি রূপ মতালম্বন করিয়া থাকে। সংক্ষেপে এই বলা যায় যে, সামাজিক পরিবর্ত্তনে যে যে সম্প্রদায়ের উপকার হইবার সম্ভাবনা; তাহাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই লিবারেল; ও যে যে সম্প্রদায়ের নিষ্ট হইবার সম্ভাবনা, তাহাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই কন্‌সার্ভেটিব।

 ১। ইংলণ্ডের কুলীনবর্গ।—লোকতন্ত্রপ্রিয়তার সময় উপস্থিত, এবং সমগ্র ইউরোপ একবাক্যে প্রজাগণের শাসনাধিকার স্বীকার ও কুলীনগণের ক্ষমতার নাস্তিত্ব প্রচার করিতেছে। কুলীনদিগের পূর্ব্বভোগ্য ক্ষমতা অনেক হ্রাস প্রাপ্ত হইয়াছে ও বর্ত্তমান কালের গতি আলোচনা করিয়া দেখিলে স্পষ্টই প্রতীতি হইবে যে, যে ক্ষমতা অদ্যাপি আছে তাহাও লোপ প্রাপ্ত হইবে। যখন কোনরূপ মানসিক বা সামাজিক পরিবর্ত্তন ও বিপ্লব ঘটে, তখন তাহা প্রজাবর্গের অনুকূলে ঘটিতে দেখা যায়, সুতরাং কুলীনবর্গের এই যত্ন যে, কোন প্রকার পরিবর্ত্তন না হইতে পায়। সুতরাং কুলীদিগের মধ্যে অধিকাংশই মনে মনে কনসার্ভেটিব অর্থাৎ পূর্ব্বাচার পরিরক্ষক। যাহারা বাহ্যে পরিবর্ত্তনপ্রিয়তা প্রদর্শন করেন, তাঁহাদিগের অন্তরে সে ভাবের অসদ্ভাব আছে।

 ২। ইংলণ্ডের ভূম্যধিকারী মধ্যাবস্থার লোক।—এই দলস্থ লোক অধিকাংশই সুশিক্ষিত ও উন্নত। কিন্তু তাহারা উন্নত হইলেও নগরের মধ্যাবস্থার লোকদিগের সমান হইতে পারে না। নগরীর লোকেরা তাহাদের অপেক্ষা প্রায়ই অধিক উৎকৃষ্ট, কুসংস্কার-হীন, কার্য্যকুশল ও পরিশ্রমী। তাহাদিগের বহুদর্শিতা, ঔৎসুক্য ও সাহস অধিক পরিমাণে আছে। গ্রাম্য ভূম্যধিকারী প্রায় সমস্ত বৎসর আপন পল্লীগ্রামস্থ আবাসের চতুঃসীমায় রুদ্ধ থাকে; অগত্যা মানসিক ও বৈষয়িক যে সমুদায় পরিবর্ত্তন হয়,সে তাহার অনুরাগী হয় না এবং কি আপনি কি আপনার প্রজাগণ সকলেই সুখচ্ছন্দে থাকাতে তাহার অন্তঃকরণে কোন্ ব্যবস্থার কিরূপ পরিবর্ত্তন ও সংশোধন হইলে দেশের কি পরিমাণে কল্যাণ হইবে, তাহা ধারণাই হয় না। তিনি গ্রাম্য গির্জা ঘর ও প্রজাগণের সুখসম্পত্তির প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলেন যে, বর্ত্তমান ব্যবস্থাবলীই এই সকল সুখের নিদান। চঞ্চল-চিত্ত ও উম্মত লোকেরাই সর্ব্ব বিষয় পরিবর্ত্তন ও নূতন নূতন ব্যবস্থা প্রচলিত করাইয়া দেশকে উৎসন্ন দিতেছে, ধর্ম্মের প্রচার করিতেছে ও সামাজিক বিপ্লব ঘটাইতেছে, এই বলিয়া তাহাদিগকে অভিশম্পাৎ করেন! এই নিমিত্ত গ্রাম্য ভূম্যধিকারীগণ অধিকাংশই কনসার্ভেটিব।

 ৩। নগরের মধ্যাবস্থার ভদ্রলোক।—এই সমস্ত লোকেরা অত্যন্ত বিদ্বান্ ও সভ্য এবং স্বদেশীয় কি ভদ্র কি অভদ্র নানাদলাক্রান্ত লোকের সহিত সর্ব্বদা আলাপ পরিচয় হওয়াতে তাহাদিগের বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ জন্মে এবং এই সংসাররূপ কার্য্যালয়ে সেই বৃত্তি সতত নানাপ্রকারে পরিচালিত হইয়া সমধিক তীক্ষ্ণ হইয়া উঠে এবং তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন যে, তাঁহাদিগের ও দেশের উন্নতি সাধনের পরিবর্ত্তন একমাত্র উপায়। তাঁহারা অনুভব করিয়াছেন যে, পরিবর্ত্তন ব্যতীত ভবিষ্যতের অভ্যুদয়াশা নাই। এই নিমিত্ত নাগরিক ভদ্রবংশীয়েরা প্রায়ই লিবারেল অর্থাৎ পরিবর্ত্তনপ্রিয়।

 ৪। সওদাগর ও বণিক সম্প্রদায়।—ইংলণ্ডে অদ্যাপিও সৌভাগ্যশালী ও ধনাঢ্য সওদাগরের এবং নিঃস্ব ভাবাপন্ন ভদ্রকুলোদ্ভব লোকদিগের মধ্যে মর্য্যাদার প্রভেদ আছে, কিন্তু ইংলণ্ডের দিন দিন বর্দ্ধনশীল সভ্যতা এই সমস্ত অভিমানমূলক অকারণ প্রভেদ দূর করিতেছে এবং যত সামাজিক পরিবর্ত্তন হইতেছে, ততই সমভাব সংস্থাপিত হইতেছে। এই সমভাবের সৃষ্টি হওয়াতে ব্যবসায়ী লোকেরা পরমানন্দিত হইতেছে, এই নিমিত্ত তাহা পবিবর্ত্তনে অসম্মত নহে। সুতরাং ব্যবসায়ী লোকেরাও প্রায়ই লিবারেল।

 ৫। শ্রমোপজীবী সম্প্রদায়।—ইংলণ্ডের মধ্যে কেবল এই সম্প্রদায়ের লোক সংপূর্ণ অনভিজ্ঞ ও বিদ্যারসে নিতান্ত বঞ্চিত, সুতরাং তাহারা আপনাপন হিতাহিত বুঝিতে পারে না। কিন্তু যে দলভেদজন্য মর্য্যাদাভেদ হওয়াতে তাহারা সকলের নিম্নশ্রেণীস্থ হইয়াছে, তৎপ্রতি লক্ষ্য করিয়া তাহারা ক্ষুব্ধ ও ঈর্ষান্বিত হয়, এবং মনে মনে এই বিবচনা করে যে, সমভাব সংস্থাপিত করিতে হইলে কোন না কোন প্রকার পরিবর্ত্তনের প্রয়ােজন আছে। সুতরাং এই সংপ্রদায়ের লােক প্রায় সকলেই লিবারেল। এই কথা নগরীয় শ্রমােপজীবী লােকদিগের প্রতিই বর্ত্তে, গ্রামস্থ এতদবস্থার লােকের প্রতি খাটে না। কারণ তাহাদিগের প্রায় কোন প্রকার মত আছে বলিয়া বলা যায় না। অনেক সময়ে ভূস্বামীর বা গ্রাম্য প্রধান লােকের যাহা মত তাহাৱা সেই মতই অবলম্বন করে।

 উপরে যাহা লিখিত হইল তাহা পাঠ করিয়া অপনি এই সিদ্ধান্ত করিবেন যে সর্ব্বশ্রেণীর লােক আপন অভীষ্ট বস্তুর প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াই স্ব স্ব মত স্থির করে এবং আপনার অভিলষিত বিষয়ই সর্ব্বসাধাণের অভিলষিত বলিয়া দর্শাইতে প্রবৃত্ত হয়। যদি আপনি এই প্রকার সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন তবে আমার বক্তব্য এই যে, এরূপ আচরণ মনুষ্যের সভাবসিদ্ধ। যেমন সম্মুখীন নিকটস্থ প্রস্তরখণ্ড দূরস্থ শৈলাপেক্ষা উচ্চ জ্ঞান হয়, যেমন চিত্রপটে নিকটস্থ বস্তু দূরস্থিত বস্তু অপেক্ষা বৃহদাকার বােধ হয়, তদ্রূপ এই বিশাল সংসাররূপ চিত্রপটে আমাদিগের নিকটসম্পর্কীয় বস্তু সার্থপরতার চক্ষু দিয়া দেখিলে অতি গুরুতর বলিয়া উপলব্ধি হয়। আমরা নিজের অভীষ্ট ও প্রয়োজন বিলক্ষণ বুঝি; পরের ইষ্ট অন্বেষণ করিতে কে সম্যক্ চেষ্টা করিয়া থাকে?

 * * * * * *

 সে দিন আমরা লণ্ডন নগরের ‘টাউয়ার’ নামক প্রসিদ্ধ দুর্গ দেখিতে গিয়াছিলাম। এই দুর্গের ভিতর ইংলণ্ডের ইতিহাস সম্বন্ধীয় কত যে দ্রব্য দেখিলাম, তাহা বলিতে পারি না। যে যে স্থানে রাজাগণ ও বিখ্যাতনামা রাজপুরুষেরা কারারুদ্ধ ছিলেন, যে যে স্থানে নবীনা রাজমহিষী ও মহাবিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিজ্ঞ ও সেনাপতিদিগের শিরশ্ছেদন হইয়াছিল, যেখানে এক সমাধিস্থলে প্রতিদ্বন্দী যোদ্ধাগণ, মহাবল পরাক্রান্ত সম্রাটগণ ও জগদ্বিমোহিনী সুন্দরীগণ এক্ষণে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত রহিয়াছেন, বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে আমরা সেই সকল স্থান দেখিতে লাগিলাম।

 * * * * * *

 ভারতবর্ষে মহিলাগণ বিদ্যাশিক্ষা করেন না বলিয়া সামাজিক অনেক অমঙ্গল ঘটিয়া থাকে। ইয়ুরোপে রমণীগণ যদিও যৎকিঞ্চিৎ বিদ্যাশিক্ষা করেন, তথাপি তাঁহারা আপন আপন উপজীবিকা লাভার্থে কোন ব্যবসায় কি কর্ম্মে নিযুক্ত হইতে পারেন না, হইলে সকলে হেয় জ্ঞান করে; সুতরাং তাঁহারাও পুরুষের অধীনতা স্বীকার করিয়া জীবন-যাপন করেন, ও এই অধীনতা হইতে সামাজিক অনেক অনিষ্ট উৎপন্ন হয়। পাছে জীবিকা নির্ব্বাহের কোন স্বতন্ত্র উপায় অবলম্বন করিলে জনসমাজে হাস্যাস্পদ হইতে হয়, সেই ভয়ে ইংলণ্ডীয় মহিলারা, হয় উদ্বাহ শৃঙ্খলে বদ্ধ হন, নয় চিরজীবন পিতামাতার গৃহে বাস করিয়া আলস্যে কালহরণ করেন। চিরদিন জুনকজননীর অধীনতা নানা-অসুখ-প্রসবিনী জানিয়া কাজে কাজেই যুবতীগণ বিবাহ করিতে ব্যাকুল হন। ইংলণ্ডীয় যুব পুরুষের আত্মমর্য্যাদা ও গৌরব পাছে ক্ষয় হয়, এই ভয়ে আপনার মানের উপযুক্তরূপ পরিবার-পালনের উপায় স্থির না করিয়া সহসা বিবাহ করিতে স্বীকার করেন না। যাঁহাদের প্রচুর সঙ্গতি আছে, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে উদ্বাহ-শৃঙ্খলে বদ্ধ হইতে ইচ্ছুক নহেন। কিন্তু যুবতীরা মনে মনে বিবাহ করিতে অত্যন্ত ব্যস্ত, নচেৎ তাঁহাদিগের সুখের প্রত্যাশা কোথায়? বিবাহের বাজারে যুবাপুরুষ তত মিলে না, কিন্তু যুবতী স্ত্রী এত অধিক পাওয়া যায় যে, তন্মধ্যে অনেকে অবিক্রেয় হইয়া ফিরিয়া যান। এখানকার যুবতীদিগের বিদ্যাশিক্ষা পুরুষের মনোহরণের উপায় শিখিবার নিমিত্ত, চিত্তোৎকর্ষ সাধন করিবার উদ্দেশ্য নহে। অঙ্ক কি বিজ্ঞান, দর্শন কি অন্যান্য দুরূহ শাস্ত্র যুবতীগণের পাঠ্য পুস্তকের মধ্যে নাই; কেবল কাব্য, ইতিহাস, আশুবোধ সাহিত্য ও উপন্যাস ও পুরাবৃত্ত, কিঞ্চিৎ ফরাশিশ্ ভাষা, সুলেখন ও নৃত্য, গীত, বাদ্য, অর্থাৎ যদ্দ্বারা তাঁহারা পুরুষের চিত্তাকর্ষণ করিতে পারবেন, তাহাই শিখিলে তাঁহাদিগের বিদাশিক্ষার পর্য্যবসান হইয়া থাকে। আমাদের দেশে পিতা মাতা যেমন কন্যার বিবাহের জন্য ব্যস্ত হন, ইংলণ্ডে যুবতীগণ আপন আপন বিবাহ জন্য সেইরূপ ব্যস্ত, অথচ মাতাও সাহায্য করতে ত্রুটি করেন না। সভামধ্যে যুবতী কন্যা স্বাধীনতা প্রকাশ করেন না, সর্ব্বজনমনোরঞ্জিনী ও চারুশীলা হন। কোন বিষয়ে স্বীয় মতামত দৃঢ়তার সহিত ব্যক্ত করেন না। স্নেহ কি প্রীতি ভিন্ন অপর ভাব অস্ফুটিত রাখেন, রাজনীতি সম্বন্ধে কোন স্থির ও স্বতন্ত্র মত অবলম্বন করেন না। সকল বিষয়েই আপনাদিগকে স্নেহশীল ও সুকুমার বলিয়া পরিচয় দেন, যথার্থ মনের ভাব কখনই প্রকাশ করেন না। এবম্বিধ কৌশল ও প্রতারণাদ্বারা সভ্য জাতির মধ্যে রমণীগণ পুরুষের মন আকর্ষণ করিতে ও বিবাহ সম্পাদন করিতে যত্ন করেন। এরূপ চতুরতা নিতান্ত গর্হিত না হইতেও পারে, কিন্তু ইহা দ্বারা যে মানব-প্রকৃতি অতি অশ্রদ্ধেয় হয়, তাহার কোন সন্দেহ নাই। আমাদিগের দেশে যে বিবাহ-প্রণালী প্রচলিত আছে, অনেকে তাহার নিন্দাবাদ করিয়া থাকেন। বস্তুতঃ যে প্রথার পরতন্ত্র হইয়া দশমবর্ষীয়া বালিকার স্কন্ধে দুর্ব্বহ চিন্তার ভার অর্পিত হয় এবং চতুর্দ্দশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে সে পর্ভবতী হইয়া আপন শরীর ও প্রসূত সন্তানের স্বাস্থ্য চিরকালের নিমিত্তে ভগ্ন করিয়া ফেলে, এমন প্রথা যে অতি গর্হিত ও দোষাবহ তাহা বলা বাহুল্য। কিন্তু ইংলণ্ডীয় যুবকগণ স্বেচ্ছামত দারপরিগ্রহ প্রথানুসারে স্বানুরূপ স্বভাবযুক্তা রমণী বাছিয়া লইতে পারেন, সুতরাং বিনা বিবাদবিসম্বাদে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহের ও চিরকাল দাম্পত্যপ্রণয়ের সুখসম্ভোগের অমোঘ উপায় স্থির করিতে পারেন—যিনি একথা বলেন, তিনি হয় ইংরাজী কুসংস্কারাবিষ্ট, নয় নিজে প্রেম-সরোবরে নিমগ্ন। ফল কথা এই যে, অস্মদ্দেশীয় বালক যেরূপ ভাবী স্ত্রীর স্বভাব কিছুই জানিতে পারে না, ইংলণ্ডীয় যুবা পুরুষগণ শুভবিবাহের দিন পর্য্যন্ত ভাবী পত্নীর প্রকৃত স্বভাব প্রায়ই জানিতে পারে না।

 এই সকল অনিষ্টের এক মাত্র মহৌষধি এই—তথাকার স্ত্রীলোকদিগকে স্বাধীনরূপে নিজ নিজ উপজীবিকার্থে সকল কার্য্য করিতে দেও, তাহাদিগকে বল যে তাহারা উদ্বাহ-শৃঙ্খলে বদ্ধ বা জনকজননীর গলগ্রহ না হইয়া স্বীয় ভরণপোষণের উপায় করিতে সমর্থ হইবে, তাহা হইলে তন্মধ্যে অনেকে বিবাহের ঔৎসুক্য ও উপর্য্যুক্ত সমস্ত বঞ্চনা ভাব ও কৌশলাদি এক কালে পরিত্যাগ পূরঃসর মানবমণ্ডলীর মর্য্যাদা রক্ষা করিতে অগ্রসর হইবে। তাহাদিগকে বল তাহারা স্বোপার্জ্জিত অর্থে স্ব স্ব ভরণপোষণ নির্ব্বাহ করিলে সমাজে অনাদৃত হইবে না, তাহা হইলে তাহারা আর বিবাহ করিতে ব্যগ্র হইবে না ও পরাধীনতা তাহাদিগের অনন্যগতি মনে করিবে না।

 * * * * * *

 সম্প্রতি ফ্রান্‌স ও প্রুশীয় দেশের মধ্যে যে ভয়ানক যুদ্ধ হইতেছে সে বিষয়ে আমি আপনাকে একটা কবিতা পাঠাইতেছি। বৎসরের শেষ দিন আমি উহা রচনা করিয়াছিলাম।


যুদ্ধ।

ধরায় ধরে না হর্ষ, আইল নূতন বর্ষ,
যেন এক বাল বিদ্যাধর।
চাঁচর চিকুর আর,  স্মিতফুল্ল মুখ তার,
পরিচ্ছদ শরীরে সুন্দর।
ফুল-সাজি লয়ে করে, সবে ফুল দান করে,
আশীর্ব্বাদে কুশল মঙ্গল।
বাজিল আনন্দ বাঁশী,  সবার বদনে হাসি,
উঠিল সুখের কোলাহল
সে বালকে সম্ভাবিতে,  স্নেহে কর প্রসারিতে
সকল সমান ব্যগ্র চিত।
বালক আসি ধরায়,  সুস্বরে বলে সবায়
থাক সুখে, কর পরহিত।
বৃথা তার আশীর্ব্বাদ, শুনি ঘোর আর্ত্তনাদ,
চৌদিকে জ্বলিছে যুদ্ধানল।

দুর্ভিক্ষ ভীষণাকার, দুঃখ, মৃত্যু, অনাহার,
সর্ব্বনাশা সমরের-দল
নাশিছে শস্যের ক্ষেত,  নগর কত উচ্ছেদ
করিছে লোহিত নদী-জল।
রণ-ক্ষেত্রে নিপতিত মুমূর্ষুর দুষ্ফুরিত
রোদনে ভেদিত ভূমিতল।
সে করুণ আর্ত্তনাদ  শুনে উপজে বিষাদ,
এ পাপ রণের পরিচয়;
হা বিধাতঃ কি তোমার,  চির করুণা অপার
মাঝারে এমন কার্য্য হয়।

দেখ আলু থালু কেশে, বিধবা মলিন বেশে
অহর্নিশি করিছে রোদন।
আহার বিহনে আহা,  অবিরাম করে হাহা
পিতৃহীন যত শিশুগণ।
অনুঢ়া যুবতী কাঁদে বিনিয়া বিষাদ ছাঁদে
সুখের ভবন সে অরণ্য।
শস্যক্ষেত্র শোভমান  এবে সমাধির স্থান,
উপবন এক্ষণে উৎসন্ন।
মহাবীর্য্য যুবা কত সমরে হইল হত,
নিবাইতে দুরাশা অনল।
সভ্যতা বিদ্যার বল! কোথা শান্তি কৈ কুশল,
অমৃতে যে উঠিল গরল।

ক্ষান্ত হও অতঃপর,  হেন কাজ লজ্জাকর,
কর না জর্ম্মাণ সুতগণ।
বিজয়ে হইয়া মত্ত,  ভুলিয়া পরম তত্ত্ব,
পাপাচার কেন অনুক্ষণ?

হের হের স্বর্ণপুরী  তাতে ক্রোধানল পূরি,
সর্ব্বথা করিলে ছারখার।
ওই দেখ হ’য়ে স্থির, জিতের নয়নে নীর,
শুন হে আর্ত্তের হাহাকার।
একবার ভাব মনে, তব ভাবী সুতগণে,
স্মরি এই ক্রূর ব্যবহার।
পিতৃ নাম উচ্চারিতে,  লজ্জিত হইবে চিতে,
তুলিতে নারিবে শির আর।

সত্য, জানে সব লোক,  জ্বালিতে রণপাবক
ফ্রান্স আগে হৈল অগ্রসর।
বাসাইল রণতূরী,  রাখিতে সুবর্ণপুরী,
শেষে ভয়ে প্রসারিল কর।
নারি নিবারিতে অরি,  শেষে তনুত্যাগ করি,
তার সুতগণ পড়ে রণে।
ক্রমে দেখ দেখ তার, কিবা সুন্দর আগার,
মাটী হয় নিবাসী বিহনে।
মরিল অযুত লোক,  তাই ফ্রান্স পেয়ে শোক
ছটফটি কাঁদে নিশিদিন।
ঊর্দ্ধ করি দুটী করে, সদা ডাকে উচ্চৈঃস্বরে,
ঈশ্বর হরহে এ দুর্দ্দিন।

প্রুশীয় নির্দ্দয় যদি,  সাধি বাদ এ অবধি,
এখনও বৈরাচার করে।
ফ্রান্সের সব ধন, করিতে চাহে হরণ,
ফরাশীশ না স’বে অন্তরে।
মরিবে দেশের লাগি,  হবে শতদুখভাগী,
শুন ওই শুন ভেরী-রব।

সাজিল সমরে ঘোর,  সাহসেতে করি জোর,
“মরি কিবা বাঁচি” রণে সব।
লভিবারে স্বাধীনতা,  ত্যজিয়া কাপুরুষতা,
বীরদম্ভে চলে পৃথ্বী পর।
শোধিবে সব নিগ্রহ,  করিবে ঘোর বিগ্রহ,
বিনাশিবে অরাতি নিকর।

 * * * * * *

 এ বৎসর শীত ঋতুর অসাধারণ প্রচণ্ডতা; তিন সপ্তাহ পর্য্যন্ত ধরাতল তুষারাবৃত রহিয়াছে। সর্ব্বত্রই জল জমিয়া গিয়াছে এবং বরফের উপর ছুটাছুটী সর্ব্বদাই হইতেছে। গৃহাভ্যন্তরে পাত্রস্থ বারি তুষারস্তরে আবৃত হইয়াছে, কখন কখন এমন অধিক বরফ পড়িতেছে যে, পথের উপর প্রায় ৯ অঙ্গুলি পরিমাণ বরফ জমিয়া গিয়াছে এবং মনুষ্যগণের ও শকটাদি গমনাগমনের অত্যন্ত কষ্ট হইয়াছে।

 অনন্তর এই দীর্ঘ শীতকালের অবসান হইতে এবং বরফ গলিয়া যাইতে আরম্ভ হইল। দুই চারি দিন আমরা সুখসেব্য বায়ু সেবন করিলাম; কিন্তু আবার শীত উপস্থিত, বরফের উপর দৌড়াদৌড়ি পুনরায় আরম্ভ হইল এবং পথ সকল ঘন তুষারে আবৃত হইল। অদ্য আমি অতি সুখে নানা স্থানে ভ্রমণ করিলাম, এবং দৃঢ়ীভূত বরফরাশি অস্তাচল-চূড়াবলম্বী দিনপতির পীতবর্ণ কিরণে অপরূপ শোভা ধারণ করিয়াছে দেখিলাম।

 এই দেশে আমি শীতকালে যেমন সুখ সম্ভোগ করি,তেমন অন্য সময়ে করি না। এক্ষণে প্রত্যুষে বহির্গত হইলে তুষারানিল তীক্ষ শরের ন্যায় চক্ষু কর্ণ নাসিকার ব্যথা জন্মাইয়া থাকে; তথাপি একবার চঞ্চলগমনে পথ ভ্রমণ করিয়া আসিলে শরীর যেরূপ সুস্থ ও বলিষ্ঠ জ্ঞান হয়, তদ্রূপ আর কোন কালেই হয় না। কিন্তু এই দুরন্ত সময়ে এখানকার দরিদ্র লোকের অবস্থা দেখিলে হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়। সহস্র লোক অতি জঘন্য গৃহে বাস করে, তাহার বাতায়ন দ্বার না থাকাতে শীতানিল নিবারণ করিতে পারে না, একটু কয়লা পায় না যদ্বারা বাসগৃহকে উত্তপ্ত করে, গাত্রে এমন বস্ত্র নাই যদ্বারা কথঞ্চিৎ শীত রক্ষা হয়, এবং কাহার কাহার এমন সংস্থান নাই যে পুষ্টিকর বস্তু আহার করে। এখানে শীতকালে অনেক লোক উপযুক্ত আহার ও বাসস্থান অভাবে পীড়াগ্রস্ত ও অকালে কালগ্রাসে পতিত হয়।

 * * * * * *

 আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্ত্তনের দিন ক্রমেই নিকটবর্ত্তী হইতেছে। এক্ষণে স্বদেশের কথা আমার অন্তঃকরণে কতবারই উদয় হয় এবং কতই বা আমি সেই স্বদেশের বিষয় অনন্যমনা হইয়া চিন্তা করি, তাহা আপনি অনুভব করিতে পারেন না। এ বিষয়ে আমি একটী বন্ধুকে লক্ষ্য করিয়া সম্প্রতি একটা কবিতা লিখিয়াছি, তাহা প্রেরণ করিতেছি।


জন্মভূমি।

স্বদেশ কাহিনী এবে পড়ে কি হে মনে?
বহু দিন হ’ল হেথা এসেছি দুজনে।

কত সুখ দুঃখ কথা জাগরিত হয়,
নিশার স্বপন সম সহসা উদয়।

স্বদেশ নগর-পথে ভ্রমিতাম কত,
স্নান যবে তারা-জোতি রজনী বিগত;
নির্জন নগর-পথে ভ্রমেছি দুজনে।
কত ভাব,ভাবিতাম পড়ে কি হে মনে?

অস্তমিত রবি যবে, অবসান বেলা,
হেরিতাম জাহ্ববীর তরঙ্গের খেলা;
শুনিতাম তরঙ্গের সুললিত তান,
গাইতাম কখন বা আনন্দের গান৷৷

সন্ধ্যায় হেরেছি কত স্বদেশের শোভা,
ভ্রমিয়াছি গ্রাম্যবনে অতি মনোলোভা।
হাসিয়াছি হেরে স্বভাবের চারু বেশ।
কাঁদিয়াছি স্মরিয়া মানব দুঃখ কেশ৷৷

যাপন করেছি দিবা বিদ্যালোচনায়—
যাপন করেছি নিশি কত ভাবনায়;
জন্মভূমি-কথা সদা জাগরিত হয়,
নিশার স্বপন সম সহ উদয়॥

 * * * *

 মধ্যে যে শিল্পসামগ্রীর পরিদর্শন হইয়াছিল, সে দিবস আমরা তাহা সন্দর্শন করিতে গিয়াছিলাম। যাহা যাহা দেখিলাম, তন্মধ্যে পৃথিবীস্থ সমস্ত জাতীয় ও সকল স্থান হইতে সযত্ন-সংগৃহীত চিত্র-পটগুলি আমাদিগের চক্ষে তাল লাগিয়াছিল। ইংরাজী ছবিগুলি ইউরোপীয় অন্যান্য জাতির ছবি অপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট তাহার সন্দেহ নাই, এবং ইটালী, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ম দেশীয় চিত্রকার্য্য সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

 উক্ত প্রদর্শনের অন্যান্য অংশও কম মনোহর নহে। তন্মধ্যে ভারতবর্ষজাত দ্রব্যসামগ্রীসমগ্র দর্শাইবার নিমিত্ত একটা স্থান নির্দিষ্ট ছিল, এবং তথায় গালিচা, পাটী, শাল, বহুমূল্য ও সুদৃশ্য বস্ত্র, তাস, কিংখাব, হস্তিদন্ত-নির্ম্মিত দ্রব্য এবং ভারতবর্ষীয় মহিলাগণের ব্যবহার্য্য স্বর্ণরৌপ্যাদিনির্মিত আভরণ সমুদায় প্রদর্শিত হইয়াছিল। ইংলণ্ড-মহিলাগণ অতি আশ্চর্য্যের সহিত সেই সকল গহনা দর্শন করিতেছিল, কোথায় কি পরা যায়, কিছুই বুঝিতে পারিতেছিল না। তথায় কি প্রণালীতে পটু বস্ত্র রচিত হয়, কুম্ভকারগণ কিরূপে মৃৎপাত্রাদি প্রস্তুত করে, কিরূপে দুলিচা গালিচা এবং অন্যান্য শ্রমজাত দ্রব্য প্রস্তুত হয়, তাহা দেখাইবার জন্য যে কত কার্যালয় সংস্থাপিত হইয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। আমরা ছয় ঘণ্টা বেড়াইয়াছিলাম, কিন্তু প্রদশিত তাবৎ দ্রব্য ভাল করিয়া দেখিয়া শেষ করিতে পারিলাম না।

 ইংলণ্ড হইতে প্রত্যাগমন করিবার পূর্ব্বে তদ্দেদেশীয় অদ্বিতীয় কবি সেক‍্সপিয়ারের জন্ম-গৃহ ও বাসগৃহ সন্দর্শন করিলাম। এবং যে অনতিদূরবর্ত্তী ক্ষেত্র হইতে তিনি বালস্বভাবসুলভ ক্রীড়াসক্তি প্রযুক্ত হরিণ-শিশু চুরি করিয়াছিলেন, তাহাও প্রদর্শিত হইল। আভন নদীতীরে এক গির্জার অভ্যস্তরে এই মহাকবি চিরনিদ্রায় নিদ্রিত আছেন।

 সন্ধ্যার সময় কেনিলওয়ার্থ নামক সুবিখ্যাত দুর্গ দর্শন করিয়া লণ্ডনে ফিরিয়া আসিলাম।