সপ্তম অধ্যায়।


ফ্রান্স, সুইজর্লণ্ড ও ইতালি।

 গত আগষ্ট মাসের চতুর্দ্দশ দিবসে আমরা লণ্ডন নগর পরিত্যাগ করিয়া তৎপরদিনে অর্থাৎ জগৎবিখ্যাত নেপোলিয়ান বোনাপাটির জন্মদিনে ফ্রান্সের রাজধানী পারিস নগরে উপনীত হইলাম। পারিস অতি সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্য্যশালী নগর। এরূপ নগর আমি আর দেখি নাই। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে বিগত যুদ্ধ ইহাকে ছিন্নভিন্ন ও হতশ্রী করিয়া ফেলিয়াছে। এবং ইহার ভূষণস্বরূপ বহু প্রাসাদ ও অট্টালিকার কেবল ভগ্নাবশেষ অধুনা দেখিতে পাওয়া যাইতেছে। যে সুরম্য উদ্যান, যে সুগঠন প্রস্তরময় মূর্ত্তি সকল সন্দর্শন করিয়া পর্যটকগণ পুলকিত ও চমৎকৃত হইত, তাহাদিগের বর্ত্তমান দশা দেখিলে অন্তঃকরণে অননুভূতপূর্ব্ব অনির্ব্বচনীয় ভাবের উদয় হয়। যদিও পারিস নগরের যার পর নাই দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে, তথাপি তাহার যে সৌন্দর্য্য এখনও দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে কে যুগপৎ হর্ষ-বিস্ময় প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারে? রাত্রিকালে এখনও দেখ সমস্ত পথ আলোকময়, সমস্ত রাজমার্গ লোকারণ্যময়, বোধ হইবে যেন এই নগর কেবল প্রমোদে ও উৎসবে উন্মত্তপ্রায় হইয়া আছে। প্রায় সকল পথই সুন্দর ও পরিষ্কৃত, দুই পার্শ্ব বৃক্ষশ্রেণীতে শোভিত এবং রাত্রিকাল আলোকে সমুজ্জ্বলিত। লুভর নামক প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া আমরা অতিসুন্দর চিত্রকর্ম্ম ও প্রস্তরমুর্তি সন্দর্শন করিলাম। সেই সমস্ত ছবির রূপলাবণ্য ও ভাবভঙ্গীর বিষয় আর বিশেষ করিয়া কি লিখিব, কেবল এই মাত্র লিখিতব্য যে, তৎসমুদায় স্বচক্ষে নিরীক্ষণ না করিলে কেবল বর্ণনা দ্বারা চিত্রকরের নৈপুণ্যের সম্যক পরিচয় দেওয়া অতীব কঠিন।

 পারিসের মধ্যে একটা সিংহদ্বার আছে, তাহাকে আর্চ অব ট্রাইয়ম্ফ কহে; ইহা নেপোলিয়ন বোনাপার্টির দিগ্বিজয়-চিহ্ন স্বরূপ তদীয় আদেশক্রমে নির্ম্মিত হইয়াছিল। সৌভাগ্যক্রমে বিগত সংগ্রামে ইহার কোন অনিষ্ট হয় নাই। ইহার উপর বিস্তর উৎকৃষ্ট কারিকুরি ও নেপোলিয়ান যেখানে যেখানে জয়লাভ করিয়াছিলেন, তাহার নাম ও সংখ্যা উচ্চাক্ষরে লিখিত আছে। আমরা এই ঘরের উপরে উত্থান করিয়া সমস্ত পারিস নগর ও তন্নিম্নস্থ সীন নামক নদ সন্দর্শন করিলাম। আহা কি চমৎকার দর্শন! পারিস কি পরিচ্ছন্ন ও সুনির্ম্মিত নগর। সীন নদও অতি সুন্দর ও পরিষ্কার। লণ্ডনের নীচে টেম‍্স্ নদের ন্যায় অপরিষ্কার ও জঘন্য নহে। আমরা এক ষ্টীমারে আরোহণ করিয়া সীন নদ দিয়া প্রসিদ্ধ নতরদাম নামক গির্জা দেখিতে গেলাম। ইহাতে যে চমৎকার শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শিত হইয়াছে, তাহা বর্ণনাতীত। প্রকৃতই ফ্রান্সের মধ্যে ইহা সর্ব্বোত্তম গির্জা। রোগীদিগের আবাস নিমিত্ত আর একটী উত্তম অট্টালিকা আছে। নেপোলিয়ন বোনাপাটির মৃতদেহ সেণ্টহেলেনা দ্বীপ হইতে আনীত ও এই স্থানে সমাহিত হইয়াছে। এক মর্ম্মর-নির্ম্মিত গৃহে মর্ম্মর-নির্ম্মিত থাম ও মুর্ত্তির মধ্যে এবং এক প্রকাণ্ড গম্বুজের নীচে তাঁহার সমাধিমন্দির বিরাজিত আছে। এই গম্বুজের চাকচক্য বহু দূর হইতে দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। এক কালে এই সমাধিমন্দিরের চতুষ্পার্শ্বে ১৯০ জয়-পতাকা উড‍্ডীন ছিল। কিন্তু এক্ষণে তৎসমুদয় স্থানান্তরিত হইয়াছে।

 অনন্তর আমরা সাঁক্লু, নামক স্থানে গেলাম। ইহা ফ্রান্সের অধিপগণের অতিপ্রিয় বাসস্থান ছিল। তথায় যাইবার সময় ফ্রান‍্সের চতুর্দ্দিকস্থ প্রাচীর সন্দর্শন করিলাম। বিগত অবরোধ-সময়ে বর্ষিত গোলাগুলির আঘাতে ইহার শরীর ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে দেখিলাম। সাঁক্লুর প্রাসাদ ভস্মীভূত হইয়াছে, কিন্তু তাহার চতুস্পার্শ্বস্থ সুন্দর উদ্যান ও পদবী সমস্ত পূর্ব্বাবস্থায় আছে। আমরা এই স্থানে দুই ঘণ্টা মাত্র অবস্থিতি করিয়া ভর্সেলস্ নগরাভিমুখে যাত্রা করিলাম।

 ভর্সেলস-নগরস্থ অতি সমৃদ্ধ প্রাসাদ ফ্রান‍্সের অতি পরাক্রমশালী সম্রাট চতুর্দ্দশ লুইর অনুমত্যনুসারে নির্মিত হইয়াছিল। আমরা তাহার ভিতর গিয়া দেখিলাম যে, গৃহমাত্রই ছবি ও মূর্ত্তি দ্বারা উৎকৃষ্টরূপে সজ্জিত আছে ও তত্তাবৎই ফ্রান‍্সের গৌরব প্রকাশ করিতেছে। চিত্রকরের ভূলির কি মোহিনী শক্তি, কি ঐন্দ্রজালিক কৌশল! ভর্সেলসের উপবন সমুদায় অতি বিখ্যাত এবং লোকে বলে যে, তদ্রূপ আর পৃথিবীতে দেখিতে পাওয়া যায় না। তথায় পরিচ্ছন্ন পথ, ছায়াময় পদবী, কৃত্রিম জলস্তম্ভ, সুশোভন দীর্ঘিকা, নিকুঞ্জ কানন এবং নিভৃত আসন সমুদায়ই আছে। বোধ হয় যেন ক্রীড়াকুশল দেবদেবীগণের ইহা এক রমণীয় কেলি-কানন।

 অনন্তর আমরা ভর্সেলস হইতে পারিস নগরে প্রত্যাগত হইয়া ১৮ ই আগষ্ট প্রাতে রাইন নদতীরস্থ কলোন নগরাভিমুখে যাত্রা করিলাম। এবং বেল‍্জিয়ম দেশের ভিতর দিয়া আসাতে দেখিলাম যে, ঐ দেশ পর্ব্বতময় এবং সুদর্শন। সন্ধ্যার সময় কলোন নগরে পঁহুছিলাম; এই স্থানে ওডিকলোন নামক সুগন্ধ জল প্রস্তুত হয় বলিয়াই এ গ্রাম এত বিখ্যাত। কিন্তু ইহার ন্যায় জঘন্য স্থান, অতি কম দেখিতে পাওয়া যায়। পরদিন প্রাতে মায়েন‍্সনগরে যাইবার নিমিত্ত ষ্টীমারে আরোহণ করিলাম। রাইন নদ অতি বৃহৎ এবং যে যে প্রদেশ দিয়া প্রবাহিত হইতেছে, তাহা দেখিলে যুগপৎ আমোদ ও বিস্ময়ের আবির্ভাব হয়। আমরা তাহার সৌন্দর্য্যের ভূয়সী প্রশংসা করিতে করিতে ধীরে ধীরে উজানে যাইতে লাগিলাম। ক্রমে রাইন নদ শৃঙ্খলবদ্ধ সুন্দর হ্রদ-সমুহের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল, উভয় পার্শ্বে দ্রাক্ষালতামণ্ডিত দুর্গ-শোভিত পর্ব্বতশ্রেণী শোভা পাইতেছে। সন্ধ্যার সময় বাডন-বাডন নগরে আসিলাম। এই স্থানটি অতি পরিপাটী, উদ্ভিদ্-শোভিত, শৈলবেষ্টিত এবং পর্ষটকদিগের পরম রমণীয়। এখানে কি প্রাতঃ, কি মধ্যাহ্ন, কি রাত্রি, সকল সময়েই প্রকাশ্যরূপে জুয়া খেলা হইয়া থাকে। রাত্রিতে ঐ খেলার গৃহ সকল আলোকে ঝক‍্মক্ করে এবং তথা হইতে সর্ব্বদাই স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার শব্দ নির্গত হইয়া থাকে। আমরা শুনিলাম যে, আগামী বৎসর হইতে এই মহানিষ্টকর ব্যসন রাজাজ্ঞা দ্বারা প্রতিষিদ্ধ হইবেক। অনন্তর বাডন-বাডন নগর পরিত্যাগ করিয়া সুইজর্লণ্ডদেশস্থ রাইন নদের প্রকাণ্ড জলপ্রপাত সন্দর্শন করিতে গেলাম। দেখিলাম ফেনময় প্রভূত জলরাশি শৃঙ্গ হইতে শৃঙ্গান্তরে নিপতিত ও শৈলরাশি ভেদ করিয়া অতিবেগে প্রবাহিত হইতেছে। সে শোভা সৌন্দর্যের পরিসীমা নাই; আর শুভ্র কুজ‍্ঝটিকার ন্যায় ফেনরাশিতে সূর্য্যরশ্মি পড়াতে এক উজ্জ্বল ইন্দ্রধনু এই প্রপাতের উপর সতত পরিশোভমান হইয়া আছে।

 এই স্থান হইতে জুরিচ, তথা হইতে লুসরণ নগরে গেলাম। লুসরণ নগরের নিকটে একটা হ্রদ তাছে। তদ্রুপ সুন্দর হ্রদ, বোধ হয়, ইয়ুরোপের মধ্যে নাই। উহা রবিকরোউজ্জ্বল তুষার-শেখর উচ্চপর্ব্বত দ্বারা বেষ্টিত। রিগি পর্ব্বত ৬০০০ ফিট উচ্চ, আমরা রেলগাড়ীতে তদুপরি উঠিলাম। রেলগাড়ী দ্বারা পর্ব্বত আরোহণ করা অতি আশ্চর্য্য ব্যাপার সন্দেহ নাই। গাড়ী চালাইবার নতুন কৌশল দেখিলাম। এঞ্জিন পশ্চাতে থাকে এবং গাড়ীকে ঠেলিয়া তোলে, এবং এরূপ কৌশলে রেল পাতিত হইয়াছে যে, সেই গাড়ী স্থলিত হইয়া নিম্নদিকে আসিয়া পড়িতে পারে না। ঐ পর্ব্বতের শেখরদেশ হইতে চতুর্দ্দিকে নেত্রপাত করিলে আহ্লাদের আর পরিসীমা থাকে না; নীচে লুসরণ ও জুগ নামক দুই হ্রদের নীলোজ্জ্বল জলের সুস্থির ও অনুপমেয় শোভা এবং তত্তীরস্থ লুসরণ ও জুগ নামক নগরের রবিকিরণোদ্দীপ্ত গৃহাবলী দেখা যাইতেছে! ঐ হ্রদের নীল নীরে পাইল তুলিয়া ষ্টীমার যাইতেছে; বোধ হইতেছে যেন, মরাল সন্তরণ করিতেছে। দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকের দর্শন এরূপ নহে। সেদিক কেবল কুজঝটিকাময় ও অভ্রভেদী পর্ব্বতমালায় বেষ্টিত, সে দিকে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। যে শোভা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিলাম, তাহা অদৃষ্টপূর্ব্ব ও অচিন্তনীয়। সেই অখণ্ড, অনন্ত ও তরঙ্গ সদৃশ পর্ব্বতশ্রেণী সমুদয় সন্দর্শন করিলে এক অনাসাদিত ও অপূর্ব্ব আনন্দ অনুভব করা যায়। যে স্থল সুইজর্লণ্ডদেশীয় মাত্রেই শ্লাঘা ও আহলাদের সহিত সন্দর্শন করে অর্থাৎ যে স্থানে বিখ্যাত টেল, জেস‍্নার নামক শত্রুকে বিনাশ করিয়া স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করিয়াছিল, উক্ত পর্ব্বতের চূড়া হইতে আমরা সেই স্থানও নয়নগোচর করিলাম।

 অনন্তর আমরা উচ্চ পর্ব্বতের উপরিস্থ একটা হোটেলে গেলাম। এবং তথায় যাইবামাত্র এমন এক নিবিড় কুহায় সকল দিক আচ্ছন্ন করিল যে, ছয় হস্ত দূরস্থ কোন পদার্থই দেখা গেল না। অবিলম্বে শিলাবৃষ্টি আরম্ভ হইল, কিন্তু অধিক ক্ষণ থাকিল না; এবং অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই পরিষ্কার আকাশে সুর্য অস্ত গেল।

 লুসরণ হ্রদের একাংশের নাম ফ্লুলেন। লোকে বলে, “পৃথিবী মধ্যে না হউক, ইউরোপ মধ্যে ইহা এক পরমশোভনীয় স্থান।” সেহ স্থির হ্রদ এবং তদুভয়পার্শ্বস্থ পর্ব্বতশ্রেণীর শোভা চিত্রিত পটের ন্যায় বোধ হয়।

 লুসরণ পরিত্যাগ করিয়া আমরা ষ্টীমার ও অশ্ব শকটে আরোহণ করিয়া দুই হ্রদের মধ্যস্থিত ইনটারলাকেন নামক নগরে উপনীত হইলাম। সন্ধ্যার সময় আমরা ইন‍্টরলাকেন নগরে উত্তীর্ণ হইলাম এবং বহুদূরবর্ত্তী জংফ্রা। গিরির তুষারাবৃত ও নির্ম্মল সুধাংশুকরোদ্দীপ্ত শেখর নয়ন-পথে পতিত হইল। অনন্তর প্রাতঃকালে হ্রদ ও পর্ব্বতমালাবেষ্টিত অতি মনোহর ইন‍্টরলাকেন নগর পরিত্যাগ করিয়া ষ্টীমারযোগে তুন নামক হ্রদ দিয়া অপরাহ্নে বরন নামক নগরে উপস্থিত হইলাম। এই নগর অতি সুশ্রী; ইহাতে একটা বৃহৎ গির্জা, সুগঠন সৌধমালা ও পরিস্কার পথ আছে। এখান হইতে অল্প‍্স্ পর্বতশ্রেণী দেখিতে পাওয়া যায়। তথা হইতে আমরা অতিসুন্দর জেনিবা হ্রদতীরস্থ লসেন নামক নগরে গেলাম। এই স্থানে সুবিখ্যাত পুরাবৃত্তলেখক গিবন স্বরচিত রোম দেশের ইতিহাস সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন। তাঁহার বাসস্থলে “গিবন হোটেল” নামক একটা গৃহ নির্ম্মিত হইয়াছে।

 যাইতে যাইতে আমরা সেই ভয়াবহ দুর্গের সমীপদেশে পঁহুছিলাম, যাহার নাম কেহ মুখে তানিতে চাহে না; তাহাকে শিলন দুর্গ কহে। তথাকার ভূগর্ভস্থ অতি ভীষণ গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলাম, এই স্থানে বীরবর বনিভার্ড শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া ছয় বৎসরকাল অতীব দুঃখে যাপন করিয়াছিলেন। তিনি জেনিবা নগরের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে অস্ত্র ধারণ করিয়াছিলেন বলিয়া এই বিষম দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়াছিলেন। শিলন দুর্গে আর কয়েকটী ভয়ানক স্থান দেখিলাম। তন্মধ্যে উবলিএত্ যার-পর-নাই ভয়ঙ্কর। ইহা গাঢ় তিমিরাবৃত; ইহার দ্বারদেশ হইতে তিনটা সোপান দেখিতে পাওয়া যায়। বোধ হয় যেন তাহার নীচে আরও সোপান আছে, যদ্বারা অন্য এক ভূতলস্থ গৃহে যাইতে পারা যায়। কিন্তু বস্তুতঃ আর সোপান নাই। ভ্রান্তকারাবাসিগণ চতুর্থ সোপানে পদার্পণ করিতে গিয়া একেবারে ৫ হস্ত নীচে পড়িয়া যায়। আহা, মনুস্যগণ স্বজাতির নিষ্পীড়নার্থে কতই কৌশল করিয়া রাখিয়াছে।

 শিলন হইতে ষ্টীমারযোগে জেনিবা নগরে আসিলাম। আসিতে আসিতে হ্রদের একদিকে কৃষ্ণবর্ণ জুরা পর্ব্বতশ্রেণী, অপর দিকে মহান্ আল্পস গিরি নেত্রগোচর হইল। জেনিবা নগর অতি পরিপাট্য ও জনাকীর্ণ, এই স্থানে রুসো ও সিস‍্মণ্ডি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।

 সুইজর্লণ্ডদেশে ভ্রমণ করিতে করিতে অতি নিম্নশ্রেণীস্থ লোকদিগের উত্তমাবস্থা দেখিয়া চমৎকৃত হইতে হয়। অতি সামান্য গ্রামে গেলেও সুন্দর ও সুবর্ণ কাষ্ঠ-নির্ম্মিত কুটীর সমুদায় ও তন্নিকটস্থ সুকর্ষিত শস্যক্ষেত্র নয়নগোচর হয়। অধিবাসী কৃষিগণ স্ব স্ব অবস্থাতে মহা সন্তুষ্ট, এবং স্বদেশের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত বলিয়া বোধ হয়। পরিচ্ছন্নতা গুণে, ধী-সম্পত্তিতে, ও শিষ্টাচারে সুইজর্লণ্ডের কৃষিগণ ইয়রোপীয় সমশ্রেণীস্থ লোকাপেক্ষা উত্তম এবং ইংলণ্ডদেশীয় কৃষকবৃন্দাপেক্ষা যে কত উৎকৃষ্ট, তাহা বলা যায় না। কৃষকপত্নীগণ আপন আপন কুটীরের বাহিরে উপবিষ্ট হইয়া বস্ত্রাদি সিলাই করে, তাহাদিগের সুস্থ ও সুবেশধারী সন্তানগণ উপবনসদৃশ ক্ষেত্রে দৌড়াদৌড়ি করিয়া বেড়ায়।

 অনন্তর আমরা সেণ্ট গথার্ড নামক প্রসিদ্ধ পথ দিয়া ইতালীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম। এই পথ দিয়া পূর্ব্বাকালে হানিবল ও ইদানী নেপোলিয়ান যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন! এই পথের পার্শ্বে ভয়ঙ্কর উচ্চ পর্ব্বত-চূড়া এবং অদুরে বেগবতী পার্ব্বতীয় নদী নৃত্য করত শৃঙ্গ হইতে শৃঙ্গান্তরে পতিত হইতেছে। যখন আমরা শকটযোগে ক্রমে আল্প‍্স‍্গিরির উপরে উঠিতে লাগিলাম, তখন অন্তঃকরণ যে কিরূপ প্রফুল হইতে লাগিল, তাহা আমি বর্ণনা করিতে অশক্ত। যদিও এখন গ্রীষ্মকাল, তথাপি এস্থান এমন শীতল যে, আমাদিগের গাত্র-বস্ত্রে শীত রক্ষা হইল না। পরিষ্কার আকাশে চন্দ্রোদয় হইয়াছিল এবং আল্প‍্স্ পর্বত অতি সুন্দর দেখাইতেছিল। ক্ষণকাল পরে আমরা বিখ্যাত সেণ্ট গথার্ডের উপরিস্থ হ্রদ ছাড়িয়া আসিলাম, এই হ্রদের কৃষ্ণবর্ণ জল নিকটস্থ চন্দ্রকিরণোচ্ছল পর্বতশৃঙ্গের সহিত তুলনায় বড়ই শোভাযুক্ত বোধ হইয়াছিল। পরদিন অপরাহ্বে আমরা কমে নগরে পঁহুছিলাম।

 ইতালির মধ্যে একটা সুন্দর হ্রদের উপর এই নগর; দেখিতে অতি সুন্দর। বিকালে কমো নামক হ্রদে অতি সুখের সহিত স্নান ও তদনন্তর আহার করাতে পূর্ব্বদিনের সমস্ত পথক্লান্তি দূরীভূত হইল। এখান হইতে নির্গত হইয়া মিলান নগরে উপনীত হইলাম এবং তথাকার শেত-প্রস্তরনির্ম্মিত সুদর্শন গির্জা দেখিলাম। ইহার ভাস্বরের কার্য্য প্রভৃতি অতি বিস্ময়কর। কারিকরি দেখি বোধ হইল যে, এমন সর্ব্বঙ্গসৌষ্ঠব ও সুশ্রী গির্জা ইয়ুরোপের মধ্যে আর নাই।

 এই নগরে একটা ছবি প্রদর্শনের স্থান আছে। লোকে বলে ইহা ইয়ুরোপের মধ্যে অদ্বিতীয়; কিন্তু আমরা পারিসে যেমন দেখিয়াছিলাম, তদপেক্ষা এই সমস্ত ছবি নিকৃষ্ট বোধ হইল। কারণ প্রায় সকল ছবিগুলি অতি পুরাতন এবং তন্নিমিত্ত বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে।

 মিলান হইতে ভিনিস নগরে গেলাম। পূর্ব্বে যে এই নগর অতি ঐশ্বর্য্যশালী ছিল, নগর দেখিলেই তাহা স্পষ্ট বোধ হয়। তাহার গির্জা সমস্ত কি ছোট, কি বড়, দেখিতে অতি শোভাময়; এবং অট্টালিকা সকল রাজভবনের ন্যায়। নগরের বিশেষ শোভা এই যে, অন্য নগরে যে স্থানে রাস্তা পথ থাকে, এ নগরের সে স্থানে সমুদ্রজল জোয়ার ভাটা খেলিতেছে। বস্তুতঃ এই নগর সমুদ্রের উপর নির্ম্মিত, অট্টালিকা সকল সমুদ্র হইতে উথিত ও এক বাটী হইতে অন্য বাটীতে যাইতে হইলে নৌকাদ্বারা যাইতে হয়। এরূপ অভিনবদর্শন পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। বিশেষ ইহার পূর্ব্ববৃত্তান্ত স্মরণ করিলে ইহার আদর অনেক গুণে বৃদ্ধি হয়। ইহার এক্ষণে এইরূপ ভগ্নাবস্থা ও দুর্দ্দশা, কিন্তু পূর্ব্বকালে এই নগর ইয়ুরোপের মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বাণিজ্যস্থান ও প্রজাতন্ত্রের জন্মভুমিসরূপ ছিল।

 তিন দিবস ভিনিস্ নগরে অবস্থান করিয়া তথাকার দর্শনযোগ্য সামগ্রী সমগ্র অর্থাৎ রাজপ্রাসাদ ও সভাগৃহ প্রভৃতি সন্দর্শন করিলাম। সভামন্দিরটী অতি বৃহৎ এবং উত্তম উত্তম ছবিদ্বারা সুশোভিত।

 এখানে যে সকল ভয়ানক কারাগার আছে, তাহা সম্যক রূপে বর্ণনা করা সাধ্যাতীত।

 এই স্থান ও কারাগারের নিকটে একটা বৃহৎ গির্জা ঘর আছে, তাহার বহির্ভাগে পিত্তলনির্ম্মিত কয়েকটা অশ্বমূর্ত্তি আছে। এই সমুদায় কন্ষ্ট্যাণ্টিন রোমনগর হইতে স্বকীয় রাজধানীতে লইয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু তথা হইতে বিজেতা ভিনিনিয়ানগণ প্রত্যানয়ন করিয়াছিল; তথা হইতে আবার নেপোলিয়ন বোনাপাটি তৎসমুদয়কে পারিস নগরে আনিয়াছিলেন, পুনর্ব্বার তাহার ভিনিস নগরে ভাত হইয়াছে। এই গির্জা ব্যতীত অপর কয়েকটা গির্জা কাছে, তৎসমুদায়ই অতি সুদৃশ্য; এবং তাহাতে প্রসিদ্ধ ভাস্কর কানোবা প্রভৃতি কৃত বহুবিধ শিল্পকার্য্য দৃষ্টিগোচর হয়।

 অনন্তর ২রা সেপ্টেম্বর দিবসে আমরা ভিনিস নগর পরিত্যাগ করিয়া রণ্ডিসি দিয়া বম্বে নগরাভিমুখে যাত্রা করিয়াছি। বোধ হয় যে, আগামী ২২শে সেপ্টেম্বর দিবসে উক্ত নগরে পঁহুছিতে পারি।

সমাপ্ত।

Printed by Sarachchandra Deva, at the Vina Press,

37 Machuabazar Street— Calcutta.