ইস্তাহার/মুক্তির নিমন্ত্রণ
গভীর রাত্তিরে আবছা কুয়াশার চাদরে ঢাকা
প্রাচীন কালের মসজিদের পেছনে ডালিম গাছে আলো ছড়িয়ে
সুগোল নরম চাঁদখানা যখন দেখা দিল,
তখন সহসা মনে পড়ল তোমার কথা, কমল।
উত্তর দিগন্ত থেকে হালকা হাওয়া এল,
ঝিঝি পোকার ডাকও ক্ষীণতর হল,
সবুজ ঘাসের বুক থেকে বিষণ্ণতার প্রলেপ তখন মুছে গেছে।
হাসপাতালের তের নম্বর বেডে তুমি হয়ত যথারীতি
রিক্ত রাত্রির তিক্ততা বুকে নিয়ে অবচেতন মনে ঘুমিয়ে রয়েছ।
গলির মোড়ে তোমার ইদানীংকালের বাসস্থান। হাসপাতাল।
জানালা খুললেই চোখে পড়ে গেটের দু'পাশের দুটো বড় আলো
মহান মৃত্যুর সঙ্গে তোমার বদ্ধ ঘরের বৈদুতিক আলোর আভা
অহেতুক যেন মিশতে চায়। ভাবছি তোমার কথা।
বিশ্বজোড়া চাঁদের আলোর অগ্নিকুণ্ডে যে মহান প্রাণের যজ্ঞ,
তার হোমের আগুনেই তুমি হয়ত আহুতি দিতে চলেছ
তোমার সারা যৌবনের সব গৌরবের মণিরত্নকে!
তোমার চোখ দুটো ছলছল, কণ্ঠ রুদ্ধ। আতঙ্কিত। করুণ।
এই মমতাহীন পৃথিবীকে এতদিন পরে চিরতরে ছেড়ে যেতে
তোমার খুব কষ্ট হয়, কমল। তা আমি জানি।
কিন্তু আমি হলে, মৃত্যুকেই মেনে নিতাম! হ্যাঁ, ঠিকই বলছি!
জন্ম নেবার সঙ্কল্প নিতাম এমন কোন অভিশাপহীন দেশে,
যেখানে মানুষে মানুষে নেই ভেদ, ভাইয়ে ভাইয়ে নেই ক্ষেদ,
শিশুরা যে দেশে আণবিক বোমা নিয়ে খেলা করে না,
অথবা সভ্যতার দাবিতে জল ঘোলা করতে ভয় পায়।
আমি ফিরে পেতে চাই দেশলাইয়ের বদলে চকমকি,
লেখার বদলে হিজিবিজি, কথার বদলে অদ্ভূত সাঙ্কেতিক স্বর।
তোমার হাসপাতালের তপ্ত বেড আমি কোন দিনই চাই না,
আমার মৃত্যুকে আমি নিমন্ত্রণ করব কোন গাছতলায়, অথবা
দুর্গম অরণ্যের পথ ধরে খুঁজে পাওয়া কোন গুহার অন্তরালে।
আমি চাই, আমার এই নশ্বর কঙ্কাল তিলে তিলে মিশুক
এই নগ্ন নিষ্কৃত্রিম কালো মাটির স্তরে মাটিরই মতো।
তোমার কাছে মৃত্যু যখন এসে দাঁড়াবে, বন্ধু,
জেনো তা মৃত্যু নয়, মহামুক্তি মহাবন্ধন থেকে,
হয়ত আশীষলব্ধ মানুষের নতুন কোন দেশে
তোমার জন্যে এসেছে ব্যগ্র নিমন্ত্রণ।
তোমার যাত্রাপথে তাই অনায়াসে অবহেলা করে যেয়ো
এই উগ্র পৃথিবীর বক্র উপহাস।
তুমি যেয়ো, তবু এইখানে এই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে
নিশ্চয়ই তোমাকে আমার মনে পড়বে
এমন কোন আবছা কুয়াশার চাদরে ঢাকা রাতে
এই পরিচিত হাসপাতালের কাছে।